'টুই টুই' ঝুমকোলতার গাছে একটি ছোট্ট টুনটুনি এসে বসল। গাছটি বিদুষীর বাগানের। লতিয়ে লতিয়ে বিদুষীর পড়ার টেবিলের সামনের বারান্দায় এসেছে ওই গাছটা। বিদুষী তার স্কুলের পড়া পড়ছিল তার পড়ার টেবিলে বসে। আজ রবিবার। টুনটুনি পাখিটা আসতে ও খুব খুশি হল।
'টুই টুই' বিদুষীর মনে হল টুনটুনি পাখিটা বোধ হয় ওর সাথে কথা বলতে চায়। তাই বিদুষী টুনটুনিকে উদ্দেশ্য করে বলল - 'তুমি কি সেই টুনটুনি যে রাজার ঘর থেকে সোনার টাকা নিয়েছিলে?'
- 'টুই টুই টুই টু টুই'
- 'ও তুমি না, তোমার ১৫৩ তম দিদিমা নিয়েছিল?'
- 'টুই'
- 'আচ্ছা তুমি কোন গাছে থাকো?'
- 'টুই টুই টুই'
- 'ও গল্ফ ক্লাবের লেবু গাছে'
- 'টুই'
বিদুষীর সাথে টুনটুনি পাখির ভারী ভাব হল।
বিদুষীর মা সকালের জলখাবার লুচি, আলুর দম নিয়ে এলো। বিদুষী লুচির নরম পাতলা অংশটা টুনটুনিকে খেতে দিলো। টুনটুনি তো খুব খুশি লুচিটা পেয়ে। কিন্তু একটা মুশকিল হল লুচির ওই অংশটা টুনটুনির থেকে বেজায় বড়ো। তাই সে লুচিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আরম্ভ করল। কিভাবে খাবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। অবশেষে বিদুষী তাকে সাহায্য করল লুচিটা খেতে। বিদুষী লুচির পাতলা অংশ ছোট ছোট টুকরো করে দিলো টুনটুনিকে। টুনটুনি মহাখুশিতে অর্ধেকটা খেয়ে নিল। বিদুষীরও খাওয়া শেষ হল।
'আচ্ছা ওই বিড়ালটার তারপর কী হয়েছিল?' বিদুষী আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করল।
- 'টুই টু টুই' ( ও... সেই দুষ্টু বেড়ালটা)
বিদূষীর দিদি তাদের পোষা কুকুরটাকে নিয়ে ঘরে ঢোকে।
- 'ভৌ ভৌ' কুকুরটা টুনটুনিকে দেখে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
- 'টুই ই ই' টুনটুনিটা ভয়ে বিদুষীদের পাশের বাড়ির কার্নিশে উড়ে গিয়ে বসে হাঁপাতে থাকে।
'টুই টুই টু টু টুই' (কথা হচ্ছিল বিড়ালটার সম্পর্কে কোথা থেকে একটা হুমদো কুকুর চলে এলো রে বাবা আর একটু হলেই...)
বিদুষী একটু রেগে গিয়ে ওর দিদিকে বলল - 'তুমি এখন আবার জিমিকে নিয়ে এলে কেন? দেখছিলে না আমি টুনটুনির সাথে গল্প করছিলাম। জিমি চিৎকার করাতে ছোট্ট টুনটুনিটা পালিয়ে গেল। ওকে আর নিয়ে আসবে না এখানে।' এবার বিদুষীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে - 'জানো তো টুনটুনি আমার সব কথা বুঝতে পারে। আমিও ওর সব কথা বুঝতে পারি।'
বিদুষীর দিদি বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল - 'হুঃ, ও আবার টুনটুনির কথা বুঝতে পারে! গল্প করছে দুজনে মিলে। জিমি চল ওদের গল্প করতে দে।' বিদুষীর দিদি প্লেটটা নিয়ে জিমির সাথে চলে যায়।
টুনটুনিটা আবার উড়ে এসে বিদুষীর জানালার কাছে বসল। 'টুই টুই টুই টু টুই' (বাবা তোমার কুকুরটা কি দুষ্টু গো, আমার দিকে ঝাপিয়ে এল, আরেকটু হলেই..')
- 'আমি বুঝতে পেরেছি তুমি খুব ভয় পেয়েছিলে তাই তো দিদিকে বললাম জিমিকে আর নিয়ে না আসতে। তারপর বলো বিড়ালটার কি হলো?'
- 'টুই টু টু টু টুই টুই টুই টুই' (ও বাবা আর বলো না বেড়ালটার তো বেগুন গাছে থাকা কাঁটাগুলো সব গায়ে ফুটে গেল। তারপর তো হতচ্ছাড়া বিড়ালটা ওই অবস্থায় পালিয়ে গেল) বলে টুনটুনি হাসতে থাকে।
বিদুষীও হাসতে থাকে।
পরের দিন ভোরবেলা থেকে টুনটুনি বিদুষীর জানালার ধারে ঝুমকোলতার গাছে বসে 'টুই টুই' করেই যাচ্ছে। বিদুষী টুনটুনির কাছে গিয়ে বলে - 'আজকে তুমি বেশী ডেকো না আর তুমি এখন চলে যাও বেলার দিকে এসো। এখন তো আমার পড়া আছে, তাই তোমার সাথে গল্প করতে পারব না গো।' এই বলে দুঃখিত হয়ে বিদুষী পড়তে থাকে। টুনটুনি কিন্তু যায় নি। টুনটুনি ঝুমকোলতার গাছে বসে বিদুষীর দিকে তাকিয়ে আছে আর 'টুই টুই' করছে।
- 'বিদুষী ই ই ই' বলে বিদুষীর স্যার পড়াতে আসে। বিদুষীর এই স্যারটা বড্ড রাগী।
- 'টুনটুনি তুমি এখন যাও, স্যার পড়াতে এসেছেন। তুমি ঘণ্টা দুয়েক পরে এসো।' বলে বিদুষী।
স্যার এসে চেয়ারে বসে। 'কত দূর হল অঙ্ক?' স্যার এই বলে অঙ্ক বইয়ের পৃষ্ঠা উলটাতে থাকে।
টুনটুনি স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বিদুষী তো ভয়ে আছে কখন আবার টুনটুনি ডেকে বসে।
স্যার এবার বিদুষীকে কয়েকটা অঙ্ক করতে দিলো। ছ'টা অঙ্কের মধ্যে বিদুষী একটা অঙ্ক করতে পারেনি। বাকি সবগুলো পেরেছে এবং ঠিক হয়েছে। একটা অঙ্ক করতে না পারায় স্যার রেগে বিদুষীকে বলল - 'আরে গাধা এতো সহজ অঙ্কটা পারলি না।'
টুনটুনিও এবার রেগে যায়। রেগে সে 'টুই টুই টু টুই টু টুই টুই টুই টুই টুই' করতে থাকে।
'উফ বাবা এই সময়ে কোথা থেকে আবার একটা টুনটুনি চলে এল। আর এতো ডাকছে। এই পাখিগুলো আমাদের শান্তি করে কোনো কাজ করতে দেয় না। দাড়া' এই বলে স্যার একটা কাগজ ছিঁড়ে, পাকিয়ে, গোল বল বানিয়ে, টুনটুনির দিকে ছুঁড়ে দিলো।
'টুই টুই টুই টুই টুই'(ও রে বাবারে, এ তো স্যার নয় গুন্ডা। বোমা মারছে আমার দিকে) টুনটুনি লাফিয়ে পালিয়ে গেল।
বিদুষীর খুব রাগ হচ্ছিল স্যারের ওপর। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। টুনটুনির জন্য ওর খুব কষ্ট হলো।
.....
- 'তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে নিয়ে যাবো, চলো চলো' টুনটুনি এসে তার বান্ধবী বিদুষীকে বলে।
- 'কোথায় যাবো? কি দেখাবে?' বিদূষী কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
- 'রাজার স্বর্ণমুদ্রা, শুধু তাই নয় আরো অনেক টাকা জমিয়েছি দেখবে চলো'
- 'আচ্ছা চলো' এই বলে বিদূষী টুনটুনির সাথে যায়।
বেশ কিছুটা এগোনোর পর বিদূষী দেখতে পায় প্রকাণ্ড এক বট গাছের কোটরে ভিতরে ঢুকে যায় টুনটুনি। সেই কোটর থেকে টুনটুনি মাথা বের করে লাফাতে থাকে। বিদূষী এগিয়ে যায় কোটরের কাছে। কোটরের ভিতর হাত ঢোকাতেই পয়সাগুলো ঝনঝন করে পড়ে যায়। বিদুষীর ঘুম ভেঙে যায় এবং ওর হাত লেগে বেড সাইট টেবিলে রাখা স্টিলের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ঝন ঝন শব্দ করে। ঘোর কাটে বিদূষীর।
ঘোর কাটে বীনাপানি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বড়দি শ্রীমতি বিদুষী চক্রবর্তীর।
বড়দির ঘরের জানলার ধারে ছোট্ট একটি টুনটুনি খেলা করছে। বড়দির মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে। তার মনে পড়ে তার ছোটবেলার বন্ধু টুনটুনির কথা। কত গল্প করত তারা দুজনে।
বড়দির আর্দালি দেখতে পান রাশভারী গম্ভীর বড়দির শিশুসুলভ হাসি। তিনি সহকারি প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি পুনম ভট্টাচার্যকে ডেকে নিয়ে আসেন বড়দির এই অসামান্য রূপ দেখানোর জন্য।
আর্দালি এবার সংকুচিত হয়ে বলেন - 'না দিদি এবার দেখুন বড়দি এবার কিছু একটা চিন্তা করছেন, মুখের সেই হাসিটা এখন আর নেই।'
- 'তাই তো। কি হলো? কি সুন্দর হাসছিলেন।'
- 'হ্যাঁ দিদি চিন্তাটা যে কেন এই সময় বড়দির মাথায় এলো'
- 'ওই দেখো আবার হাসছেন বড়দি।'
- 'হ্যাঁ তাই তো।'
বড়দি চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে তাকাতেই তার চোখ পড়ে শ্রীমতি ভট্টাচার্য এবং তার আর্দালীর ওপর। 'আরে আপনারা বাইরে কেন ভিতরে আসুন। আর মিসেস ভট্টাচার্য আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, স্কুলে বাগান করার বিষয়ে।'
শ্রীমতি ভট্টাচার্য চেয়ার নিজের দিকে টেনে নিয়ে বসে বললেন - 'হ্যাঁ বলুন'
- 'আমাদের স্কুলের পূর্ব দিকে জায়গাটা তো ফাঁকা আছে। আর বেশ বড় জায়গাটা। ওখানে বাগান করলে কেমন হয় ছাত্রীদের দিয়ে।'
- 'বাহ্, এ তো খুব ভাল প্রস্তাব'
- 'হুম। এর ওপর ছাত্রীদের নম্বর দেওয়া হবে। যে ক্লাস যত ভালো বাগান করতে পারবে তাদের তত নম্বর বাড়বে। আর বাগান আমরা ভাগ করে দেবো। প্রত্যেকটা ক্লাসে নিজস্ব বাগান থাকবে। এই বছর যারা ক্লাস ফাইভে পড়ছে তাদের বাগান সামনের বছর যারা ক্লাস ফাইভে পড়বে তাদের হবে। এভাবে করলে কেমন হয়? আর একটা ঝুমকোলতার গাছ লাগাব।'
- 'বাঃ! বেশ দারুণ ব্যাপার'
- 'প্রচুর গাছ লাগাব মেয়েদের দিয়ে, তাতে অনেক পাখি আসবে। নতুনভাবে সেজে উঠবে আমাদের স্কুল।' আবার সেই হাসি ফুটে ওঠে বড়দির মুখে।
- 'বেশ। এবার তাহলে চলুন স্কুল অনেকক্ষণ আগে ছুটি হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে তো।'
- 'ও হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন'
শ্রীমতি ভট্টাচার্য বড়দির সাথে বড়দির গাড়ি করেই বাড়ি ফেরেন।
বড়দি যোধপুর পার্কে শ্রীমতি ভট্টাচার্যকে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ি আরো পশ্চিমে ফিরে আসেন।
- 'মা জানো আজ স্কুলে একটা টুনটুনি এসেছিল' - মাকে জড়িয়ে থাকে শ্রীমতি বিদুষী।
- 'ও মা তাই নাকি। তা তোর সেই টুনটুনি?'
- ' না না এতো গুলো বছর ও বেঁচে নেই। ওর নাতনির নাতনি করে পনেরোতম নাতনি হবে হয়তো। ভাবছি স্কুলে ঝুমকোলতার লাগাবো। মেয়েদের দিয়ে বাগান করবো'
- 'হুম। তুই টুনটুনির সাথে কথা বললি?'
- 'কি যে বলো মা!'
- 'আগে তো বলতিস। ওই টুনটুনি আর তুই কত গল্প করতিস।'
- 'সেই ভাষা যে আমি ভুলে গেছি মা'