এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  পরিবেশ

  • বাবুমশাইর দূরবীন আর চরাচরের পাখি

    অনিন্দিতা লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | পরিবেশ | ১৯ জুলাই ২০২৩ | ৮৩২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • শহরের পাখপাখালি 

    ধরুন, এই বর্ষায় বেদম কাকভেজা হয়ে পথ চলছি। রাস্তার ধারে, ল্যাম্পপোস্টে, মাথার ওপর তারে, বাড়ির কার্নিশে ভেজা কাকের সারি দেখতে পাচ্ছি কি? সবাই শুনছি শহরের বুক থেকে চড়াই পাখি হারিয়ে যাচ্ছে । চিল, শকুন, কিংবা ময়না, শালিখ, এইসব চেনা পাখিগুলো এখন আর আগের মতো আশেপাশে দেখা যায় না। অন্যদিকে শহরের একফালি বারান্দায় ঝুলতে থাকা টিয়াপাখির খাঁচাও এখন কম দেখা যায়। খাঁচায় বন্ধ রেখে কথা বলানো আর ছোলাবাদাম খাওয়ানো ‘মিঠু’দের সংখ্যা কমছে, অন্তত মধ্যবিত্ত সমাজে। রাস্তাঘাটে শালিখ দেখে হাতে গোনার খেলা বোধ হয় আজকের ছোট ছেলেমেয়েরা আর খেলে না। তিনটে শালিখ তো আর ঝগড়া করেই না গেরস্তের বাড়ির রান্নাঘরের চালে বসে। সবে দিক থেকেই শহরে পাখির দর্শন কমছে। গাছগাছালির অভাবে শহরের বাস উঠতে চলেছে এই ডানাওয়ালা প্রজাতির। এ কথাও এখন সর্বজনবিদিত যে, এদের দ্রুত হ্রাস অনেকাংশেই আমাদের কার্যকলাপের মাশুল, পরিবেশের অবক্ষয় আর জলবায়ু বদলে যাওয়ার ফলশ্রুতি। আবার অন্যদিকে মানুষ আগের চেয়ে বেশি সচেতন হয়েছে, পশুপাখির প্রতি প্রেম বেড়েছে, তাদের মুক্ত অস্তিত্বের ভাবনা চেতনায় নাড়া দিচ্ছে। আর সেই তাগিদেই পাখি দেখতে এদিক সেদিক বাইরে ছুটে চলেছে শহুরে মানুষ। বেশ লম্বা কিংবা ছোটোখাটো সপ্তাহান্তের ছুটিতে ভ্রমণপিপাসুরা অনেকেই আজকাল চলে যান  বনে জঙ্গলে। নতুন জায়গায় বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পশুপাখি আর গাছপালা দেখতেও ইদানিং আমাদের ভারী ভালো লাগে। বেশ একটা শখ কিংবা অভ্যাস তৈরী হয়েছে যেন। সেই সঙ্গে পাখিদের নিয়ে আজকাল বেশ আলাপ আলোচনা শোনা যাচ্ছে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, পাখি দেখার দল তৈরি হচ্ছে। তবে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে আমরা পাখিদের সম্পর্কে বেশ জানি, তাদের স্বভাব, বাসস্থান, প্রজনন, জীবনচক্র এইসব? পাখিদের কি আমরা মিলিয়ে নিয়েছি আমাদের বৃহত্তর অস্তিত্বে? 

    বনের  পাখি দেখার হুজুগ 

    পশুপাখির দর্শন পেতে প্রশস্ত সময় শীতকাল।  আর তার মানেই চিড়িয়াখানা, নিক্কো পার্কে ভিড় জমানোর মরশুম। তাছাড়া ঋতু আর ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান (national park), বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অভয়ারণ্য (wildlife sanctuary), জীবমন্ডল সংরক্ষণ ক্ষেত্র (biosphere reserve), পক্ষী উদ্যান (bird sanctuary), এইসব জায়গায় আজকাল ভালোই ভিড় হয়। দূরবীন চোখে পক্ষীপ্রেমীর দল গাছপালার ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন, এমন দৃশ্য বেশ দেখা যায়। অনেক পাখির ইংরেজি নামও বলতে পারেন অনেকে। একটু পত্রপত্রিকা ঘেঁটে কিছু নাম মনে রাখা যায় বই কি! কিন্তু জাঙ্গল ব্যাবলার যে ছাতারে পাখি, কিংবা ড্রঙ্গো যে আমাদের ফিঙে, আর ব্লু-থ্রোটেড বারবেট যে বসন্ত বৌরি, এমন সব নামের মেলামেলি জানেন কয়জন? পক্ষীবিদ নয়, আমি বলছি শহর থেকে বেড়াতে আসা সৌখিন পক্ষী দর্শকদের কথা। পাখির ইংরেজি গাইড বইতে তো আর দেশি নামগুলো থাকে না! এরপর আছে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা, সামাজিক মাধ্যমে ভাগ করে নেওয়া আর আত্মতৃপ্তিতে উপচে ওঠা। এ এক ধরণের জয়ঘোষণা। প্রকৃতি-সচেতনতা যে একটা কাম্য গুণ তা আজকের সামাজিক ভাবমূর্তি সচেতন মানুষ জানে। 

    এই পক্ষীপ্রেমের হুজুগে সত্যি পাখি দেখে কজন! তাদের কোনোভাবে বিরক্ত না করে নিঃশব্দে প্রকৃতির রসভোগ করে আসেন কি সবাই! প্রকৃতির কোলে প্রকৃতির সৃষ্টিকে সঠিকভাবে উপভোগ করতে হলে কিছু প্রশিক্ষণের দরকার আছে। যেমন প্রথমেই জানতে হবে, কোন কোন জায়গাগুলি সম্ভাব্য পাখিরালয়, তারা কীভাবে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে, কেমন করে খুঁজবো তাকে! এই অভিযানে একা না গিয়ে কয়েকজন থাকা ভালো, আর অবশ্যই সঙ্গে থাকা দরকার অভিজ্ঞ পক্ষীবিশারদ। এছাড়াও ভীষণ জরুরি হচ্ছে পর্যটকের পোশাকআশাক। জঙ্গলের সবুজ খয়েরীর ফাঁকে হারিয়ে যায় এমন রঙের পোশাক পরতে হবে, চুপিসারে চলতে হবে, এসব তো সাধারণ বুদ্ধির কথা। কিন্তু অধুনা ভারতবর্ষের হুজুগপ্রেমী দর্শকেরা এই সামান্য নিয়মগুলি মানেন কি! ছবি তোলার মাতামাতি আর দেখতে পাওয়ার আনন্দে অনেক সময়ই বিঘ্নিত হয় অরণ্যের শান্তি। জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অভয়ারণ্য, জীবমন্ডল সংরক্ষণ ক্ষেত্র ইত্যাদি গড়ে তোলার পেছনে একটা  বাস্তুতান্ত্রিক বিজ্ঞান আছে। প্রকৃতির ভারসাম্য এবং জীবজগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের সম্মিলিত জৈব অস্তিত্বের মূল ভিত্তি।  অথচ জঙ্গলের মাঝেই গড়ে উঠছে পর্যটনকেন্দ্র আর তথাকথিত প্রকৃতিপ্রেমীদের অবাধ প্রবেশ, পর্যটকের ভিড়, হোটেলের রমরমা ব্যবসা, যানবাহন আর খাওয়াদাওয়ার দোকানের দেদার সংখ্যাবৃদ্ধি। এর ফাঁকে কোথায় যে উড়ে যাবে পাখীর দল, কে তার হিসেবে রাখে! বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের (anthropogenic) কার্যকলাপের ফলেই পিছু হটছে মানুষের দ্রষ্টব্যরা। শিল্প, শহর, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, এসব তো পুরোনো কথা। নতুন চিন্তা শুধু আনাড়ী দর্শকদের নিয়ে। তাদের উদ্যম নিয়ে প্রশ্ন নেই, সমস্যা অনাবিল শৌখিনতা নিয়ে, সঠিক পদ্ধতির অভাব নিয়ে। 

    পাখি চিনি ক্যামনে 

    পাখি দেখা (bird watching) একটা কৌশল, তার জন্য চাই পড়াশুনা, চাই প্রশিক্ষণ।  বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ পড়াশুনা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় গড়ে তুলেছেন কিছু মূল পদ্ধতি। বাইনোকুলার হাতে নিলে কিংবা টেলিস্কোপে চোখ রাখলে বেশী স্পষ্ট দেখা যায়, আলো-আঁধারি কাটিয়ে সাধারণ দৃষ্টির চেয়ে বড় আকারে ও বিস্তারে পাখি দেখা যায়। পাখি দেখার এটিই প্রথম ধাপ। 
    বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাখি দেখতে হলে প্রথমেই আসবে পাখির শারীরিক বৈশিষ্ট্য। আধো অন্ধকার জঙ্গলে অনেক সময় পাখির আকার ও আয়তন আসলের চেয়ে বড় মনে হয়। তখন মনে মনে আন্দাজ করে নেওয়া যেতে পারে, কার মতো এই পাখিটি  পায়রা-কাক, না ঈগল-চিল নাকি চড়াই-টুনটুনি-রবিনের মতো। তেমনি, এটি কি গঠনে লেজঝোলা টিয়ার মতো, নাকি লম্বা-ঠ্যাং বকের মতো, নাকি ফুরফুরে শালিখের মতো! তারপর আছে গাত্রবর্ণ। মূল শরীরের কী রং, শরীরের উপরিভাগ আর নিম্নভাগের কী রং, ধীরে ধীরে ডানার দিকে এগোয় কী রঙের আভা। পা-মাথা-লেজের রংও লক্ষ্যনীয়। রং বদলের নমুনাও কম নয়। 

    শরীরের মধ্যে প্রথমে দেখা যাক মাথা, ঠোঁট আর ডানা। তারপর লেজ, পা আর থাবা। সঙ্গে তাকানো যাক মাথার দিকে। কারো মাথায় থাকে মুকুটের মতো রেখা, কারো চোখের পাশে, কারো আবার চোখের নীচে বলয় আর গোঁফরেখা। চোখের গঠনও আলাদা, পিউপিল, আইরিস অনুযায়ী কারো চাহনি হিংস্র, কারো শান্ত। আর রয়েছে ঠোঁট। লম্বা-সরু কিংবা মোটা-বেঁটে, খাদ্যের ধরণ ও সংগ্রহ পদ্ধতি অনুযায়ী আলাদা আলাদা। এভাবেই তো টিয়া আর শকুন, সারস আর শালিখ আলাদা করে চিনি। শুধু গঠন নয়, ঠোঁটের রংও আলাদা হয়। সাধারণত কালচে হলেও অনেক পাখির রংচঙে ঠোঁটও  হয়। এই চিন্হগুলি দেখে পাখির প্রজাতি আন্দাজ করা যায়। জানা যায় এরা দলবদ্ধ হয়ে থাকে কিনা, এরা কী ধরণের বাসা বাঁধে, জলাভূমিতে থাকে, নাকি শুকনো অঞ্চলে, নাকি  গাছের ডালে, এমনি অনেক কিছু স্বভাব বৈশিষ্ট্য। ডানার গড়ন আর ওড়ার ধরণ দেখেও পাখি চেনা যায়। ডানার মুখ হতে পারে তীক্ষ্ণ কিংবা ভোঁতা, ছোট কিংবা লম্বা। পাখি কত উচ্চতায় ওড়ে, কত দূরে পাড়ি দিতে পারে, কতক্ষণ টানা অভিযান চালাতে পারে, সব কিছুর ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে তার ডানা দুটিতে। 

    পাখি পুচ্ছটি তুলে নাচে কখনো দিক নিয়ন্ত্রণের জন্য, আবার কখনো তার সঙ্গীর প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য। ময়ূরের পেখম তুলে নাচ শুধু কাব্যিক নয় ,প্রকৃতই দৃষ্টিসুখকর। লেজের দৈর্ঘ্য, কোনো কোনো পাখির বিভাজিত লেজ, আর লেজের গড়ন ওড়ার ধরণকে প্রভাবিত করে। ওড়ার কায়দা থেকেও পাখি কোন প্রজাতিভুক্ত তা অনুমান করা যায়। ঠিক এভাবেই ঠ্যাঙের রং ও গড়ন পাখি চেনার পক্ষে খুব জরুরি লক্ষণ হয়ে ওঠে। যেমন, লম্বা ঠ্যাংওয়ালা পাখি ওড়ার চেয়ে হাঁটে বেশি, কাদার ওপর দিয়ে চলে নদীর ধারে। তেমনি, সাঁতার কাটা পাখির থাকে চামড়া-ঢাকা জোড়া পা। ছোট পাখি সরু ঠ্যাং নিয়ে গাছের ডালে বাস করে বেশি। যে পাখির থাবা সামনে-পেছনে বিভক্ত, তারা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে গাছের ডাল। অন্যদিকে তীক্ষ্ণ ধারালো থাবা খাদ্যশিকারের অস্ত্র। 

    পাখিদের ব্যবহার কি মানুষের মতো হতে পারে? তাদের আচরণ কি পর্যবেক্ষণ করা যায়? পক্ষীবিশারদেরা বলেন, যায়। আর এটি মূলত লেজ নাড়ার ধরণ দিয়ে বোঝা যায়। কোনো পাখি লেজ নাড়ে একদিকে, কেউ আবার ওপর-নীচে। অনেক পাখি আছে যারা একা ওড়ে, আবার অনেকে থাকে এক জোট হয়ে। মানুষের স্বভাবের মতোই, আত্মভরী বড় শিকারী পাখিরা সাধারণত একক, আবার ছোটদের শক্তি দলবদ্ধতায়। পরিযায়ী পাখীরা বৃহৎ সংখ্যায় থাকে। বাসা বাঁধার ধরণটিও একটা দেখার বিষয়। বেশির ভাগ পাখিই ডিম পাড়ার সময় ছাড়া অন্য সময়ে ঘর গড়ে না ।  তাই তো দেখি, ঝুম বৃষ্টিতে গাছের ডালে বসেই ভিজছে কাক, মানে কাকভেজা যাকে বলে। জলাভূমির পাখি, শুকনো ডালের পাখি, লোকবসতির আশেপাশে থাকা পাখি, প্রত্যেকে  কিন্তু আলাদা স্বভাবের। 

    সব শেষে শোনা যাক পাখির ডাক, যা বাদ দিলে তাদের ব্যবহারের আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না। অনেক সময় পাখির ডাক দিয়েই তো অনুমান করা যায় তার অবস্থান। যেমন কোকিলের কুহু শুনেই তো তাকে খুঁজতে থাকা। পাখির ডাকের তীক্ষ্ণতা, সুরের ওঠাপড়া, ছন্দ, সুর, স্বচ্ছতা, কর্কশতা, নানা কিছু দিয়ে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। এতো কিছু বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য, লক্ষণ, সব পর্যবেক্ষণ করে এগোলে পাখি দেখা সহজ হয়। শুধু হুজুগে না মেতে, সুশিক্ষিত ভাবে, সুপরিকল্পিত উপায়ে শখ মেটানো, সেটাই বোধ হয় প্রকৃতিপ্রেমের প্রথম পাঠ। 

    পাখি চেনে কয়জনা 

    ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমবর্ধমান। তাদের সমৃদ্ধি উপচে পড়তে শুরু হয়েছে নব্বই-এর দশক থেকে। বিদেশের সাথে যোগাযোগ বেড়েছে, বিদেশী নানা স্বভাবের মতো জঙ্গলে যাওয়ার  শখও আমাদের ছুঁয়েছে। যে দেশে কেবল গুটিকয় মানুষ  সেলিম আলির নাম জানে, পক্ষীবিদ্যার (ornithology) চর্চা যেখানে সীমিত জীববিজ্ঞানের ছোট গন্ডিতে, সে জায়গায় পাখি দেখার উৎসাহী দর্শক আজকাল অগুনতি। বিশ্বায়নের যুগের উন্নতির নতুন মুখ বন্যপ্রাণী পর্যটন (wildlife tourism), প্রকৃতি পাঠ (nature study), পক্ষী দর্শন (bird watching) ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, সত্যি কি মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে, নাকি এগুলি মূলত দেখনদারী! আজকাল পক্ষী চর্চা বিষয়ে অনেক বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এসেছে, পাখি নিয়ে অনেক লেখালেখি, সম্মেলন, এমনকি পাখি মেলাও হতে দেখা যায়। সবের পেছনেই কোনো না কোনো ভাবে বিদেশী ছায়া। British birdwatching fair এর ধাঁচে জয়পুরে মেলা হয়। পাখি নিয়ে গবেষণাপত্র কিংবা সবার জন্য পুস্তিকা রচনার ধারাটিও বিদেশী অনুকরণে। সম্পূর্ণ দেশজ ভাবে পাখিকে চেনা, পোষা কিংবা ভালোবাসা, সেটা বোধ হয় শহুরে মধ্যবিত্ত নয়, গ্রামাঞ্চলের ‘লখা’-রাই ধরে রেখেছে, সে পাখি ধরার পেশা দিয়েই হোক, অথবা পাখি ধরতে না চাওয়ার জিদ  থেকেই হোক। নিখিল বিশ্বের ‘চরাচর’-এর পাখির সে রূপ দেখার চোখ আর যাই হোক, মধ্যবিত্ত নকলনবিসিতে পাওয়া একটু মুশকিল। 

    ভারতবর্ষে পাখি দেখার চর্চার কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। প্রথমেই বলা যায়, এই শখটি প্রধানত পুরুষপ্রধান। বলা হয়, মেয়েরা ভালোবাসে পাখি, আর ছেলেরা ভালোবাসে পাখি দেখা। কত কম সময়ে কত ভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পারা গেলো, এতে একটা সুপ্ত পৌরুষ-গর্ব চাপা থাকে। পাখি দেখতে দুর্গম স্থানে যাওয়ার প্রয়োজনটাও অবশ্য আরেকটি কারণ। 
    আগেই বলা হয়েছে, এই শখটি সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। শুধু তাই নয়, এটি এক ধরণের আত্মশ্লাঘার বিষয়। ভাবখানা এমন যেন, এই সূক্ষ্মরুচি বিরল শখটি পালন করে সমাজে বিশেষ অবদান রাখা হচ্ছে। তাই ফরেস্ট বাংলো থেকে শুরু করে নিয়মকানুনের কড়াকড়ি, সবই এদের জন্য কিছুটা হলেও শিথিল করা হোক, শখের অভিযাত্রীদের মুখে এমন কথা শোনা গেছে।  এমন অভিমতও অনেকে পোষণ করেন যে, পক্ষীপ্রেমীদের সুরক্ষা রাষ্ট্রের কর্তব্য, কারণ পাখি দেখার জায়গাগুলো প্রায়শই দুর্গম। 

    সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের পরিবেশচর্চায় যোগ হওয়া কিছু শব্দ, যেমন, বৈশ্বিক সর্বভুক (global omnivore), বাস্তুতন্ত্রের মানুষ (ecosystem people) ইত্যাদি ব্যবহার করে দু ধরণের মানুষকে আলাদা ভাবে বোঝানো হয়। একদিকে পাশ্চাত্যমুখী উর্ধগামী উন্নতিশীল মধ্যবিত্ত ভারতীয়, অন্যদিকে পাখি নিয়ে ঘর করা লখিন্দর বা লখারা। মাধব গ্যাডগিল আর রামচন্দ্র গুহ ‘ভারত’ আর ‘ইন্ডিয়া’ নামে অভিহিত করেছেন এই দুই বলয়কে। শহরে বাসকারী তথাকথিত শিক্ষিত, বিত্তবান, প্রকৃতি-সৌখিন মানুষদের সাথে বিস্তর প্রভেদ গ্রামের পাখি-ওয়ালাদের। হয়তো তারা শহুরে বাবুদের প্রতি সন্দিহান, হয়তো তারা অখুশি। তবু ভুললে চলবে না, তাদের হাতে রক্ষা হয় জলজঙ্গলের প্রাণ। নতুন যুগের নতুন-ধনী উঠতি-স্বভাব ভারতীয় মধ্যবিত্ত কিন্তু এতটুকু চিন্তিত নয় এই মানুষগুলোর জন্য। এই দরিদ্র স্থানীয় মানুষগুলি সাধারণত ভ্রমণার্থী পক্ষীপ্রেমীদের  গাইড। হয়তো তারা জীবনের প্রয়োজনে কখনো কখনো বেআইনি শিকারেও লিপ্ত হয় । সেটাই তাদের মহা অপরাধ। অথচ এই প্রান্তিক মানুষগুলির সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নটি কোনোভাবেই এই বিশ্বনাগরিকদের মনে আসে না। এদের নিয়ে কোনো আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রকল্প তৈরী হয় না। ইন্ডিয়া থেকে আসা পাখিপ্রেমীরা ভারতের লখাদের থেকে দূরেই থেকে যায়। শহুরে হুজুগে বাবু, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পক্ষীবিদ আর বনাঞ্চলের লখিন্দর, একই চরাচরে বাস করেও রয়ে যায় বহুদূরবর্তী পৃথক ভৌগোলিক বলয়ে। 

    শহুরে  জীবনযাপন প্রণালীতে পরিবর্তন যে আনতেই হবে, তা আজ পরিবেশবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, সকলেই বলছেন। সেদিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো আমাদের আশেপাশেই পাখিদের ফিরে পাওয়া যাবে। ঘরের কাছে দেখতে পেলে দূরের বনে ভিড় করার গরজ কমতে পারে, হুজুগ কমতে পারে, জঙ্গলের শান্তি বজায় থাকতে পারে। সেই অভিমুখে এগোলে তবেই অন্তরীক্ষের শান্তি, বনস্পতির শান্তি, পৃথ্বীর শান্তি, সর্বপ্রাণীর শান্তি। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৯ জুলাই ২০২৩ | ৮৩২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    এখন - Kunal Basu
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2607:fb91:87b:8018:9e16:4314:a5e1:***:*** | ১৯ জুলাই ২০২৩ ১৯:০১521446
  • ভালো লাগলো খুব। পাখিদের ব্যবহার আর আচরণ এক সময়ে অনেক লক্ষ্য করেছি। দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়!
    আমার মনে হয় কিছুকিছু জায়গা খুব দুর্গম হওয়াই ভালো। সব জায়গায় মানুষ পৌঁছে ইকোসিস্টেমের সাড়ে সর্বনাশ করতে না পারলে খুবই ভালো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন