এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  •  বাঘ, টুনি, ভূতু  আর আমাদের পরিবার 

    Anindita Roy Saha লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ১৩ জুলাই ২০২১ | ২৬৭১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবিটা দেখে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। গহীন অরণ্যের গভীর গাঢ় সবুজ, অখন্ড নৈঃশব্দের তীব্র গোপন শব্দ আর দুটি মাতৃহারা মমতা মাখানো ব্যাঘ্রশাবক একটা এমন পরিমণ্ডল তৈরি করে যা একাধারে নিসর্গ প্রকৃতির ও বাস্তব জীবনের। বর্তমান সময়ের রাজনীতি, মানুষ, জঙ্গল আর পশুজগৎ নিয়ে এক অনন্য উপাখ্যান শেরনি। ছবির শেষ দৃশ্যে যে চরম সত্য ও কঠিন ভবিষ্যতের ইশারা, তা নিরাশাব্যঞ্জক হলেও আমাদের জন্য সাবধানবাণী। ছবিতে তার কিছু আগে লুকিয়ে আছে সমাধান খোঁজার পথের একটি দিশা। ফরেস্ট ফ্রেন্ডস আর স্থানীয় মানুষ। হ্যাঁ, জঙ্গলের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজন সেই অঞ্চলের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ যার পোশাকী নাম participatory forest management. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অরণ্য সংরক্ষণে এই পদ্ধতির ব্যবহারে সাফল্য দেখা গিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই কাজে অতিরিক্ত সম্ভাবনা জাগায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, যারা শুধু উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবী আর চাক্ষুষ করছে পরিবেশের সমস্যা। আশা আছে, আমাদের নতুন প্রজন্ম generation Y আর Z-এর হাতে গড়ে উঠবে পৃথিবীর সুস্থ ভবিষ্যৎ।

    শহুরে Y, Z-দের নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা বেশ খানিক নাড়াচাড়া করেছেন, তাদের অতিরিক্ত ভোক্তা আচরণ, বৈদ্যুতিন অভ্যাস, একক জীবনের প্রতি প্রবণতা ইত্যাদি। সঙ্কটাপন্ন সময়ের তাগিদে এখন আরো গবেষণা চলছে তাদের পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে, তাদের প্রকৃতি সংরক্ষণ প্রবণতা সম্পর্কে। কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মনে প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে চেতনা জাগানোর জন্যে পাঠক্রম, সংবাদ মাধ্যম ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী বোধ হয় সাহিত্য মাধ্যম। সিনেমা, গল্পকথা। এইসব ভাবতে ভাবতে মনে উঁকি দিয়ে গেল আমাদের ছোটবেলায় পড়া কয়েকটা বই। জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা জাগাতে এই গল্পগুলি তুলনারহিত। মানুষের সাথে জীবজন্তুর সংঘাতের নয়, বরং পারস্পরিক নির্ভরতার গল্প। কত সহজ ভাষায় ফরেস্ট ফ্রেন্ডরা বুঝিয়ে দেয়, জঙ্গল জানোয়ার আর জলবায়ু অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ, তাই ভালোবাসায় বেঁধে বেঁধে থাকাই বেঁচে থাকা। সুললিত গদ্যে ঠিক এই বাণীটিই অনেকদিন আগে বয়ে এনেছিল শিশু সাহিত্যের পৃষ্ঠাগুলি। আজকের প্রজন্মের জন্য আবার খুলে যাক পশুপ্রেমের এই জগৎ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উৎসাহ উদ্দীপিত করুক তাদের। সেই আশায় আবার ফিরে দেখা আমাদের ছোটবেলার তিনটি বই।

    ১. কে ভাই, টুনি ভাই

    ছোটঠাকুমা আমাদের গল্প বলতেন, বাংলার লোককথা। উনি পড়তে জানতেন না। বলতেন পূর্ববঙ্গের মায়েদের মুখে মুখে বহুদিন ধরে চলে আসা গ্রামজীবনের গল্প। নানারকম সদস্য নিয়ে আছে পরিপূর্ণ গ্রাম- ফুলফল, গাছপালা, পশুপাখি আর তারই মাঝে মানুষজন। একটু বড়ো হয়ে পড়তে শিখে গল্পগুলো চিনতে পারি, ছত্রে ছত্রে মিল, সবগুলি চরিত্র চেনা। টুনটুনির বই। লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মুখবন্ধে বলেছিলেন, সন্ধ্যারাতে ঘুমে ঢুলে পড়া শিশুদের এই গল্পগুলি শুনিয়ে তাদের মায়েরা জাগিয়ে রাখতেন। এগুলি পূব বাংলার গ্রামাঞ্চলের পটভূমিকায় রচিত। আমরা ওপার বাংলার মানুষেরা হয়তো শুনেছি দিদিমা-ঠাকুমার মুখে মুখে, আর পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা পড়েছে বইতে। টুনটুনির গল্প আমাদের সকলের শৈশবে বুনে দিয়েছে প্রকৃতির কোলে মানুষ ও জীবজন্তুর দৈনন্দিন বেঁচে থাকার গল্পে বোনা কারুকার্যময় এক নকশিকাঁথা।

    পূর্ববঙ্গ জলপ্রধান জায়গা, জঙ্গল আর বাদা পেরোলে সুন্দরবনও বেশি দূর নয়। তাই বাঘ, কুমীর, শেয়ালেরা যেন সব ঘরের লোক, প্রতিবেশী। কে নেই সেই যৌথ জীবনে? গৃহস্থের ঘরের কোণেই আছে কাক, চড়াই আর টুনটুনি। দাওয়াতে লঙ্কা শুকোতে দিলে খেতে চলে আসে কাক আর চড়াই। অথবা পিঠের গন্ধে আকুল হয়ে চড়াই তার চড়নীর কাছে আবদার করে পিঠে গড়ে দিতে। আর টুনটুনি তো ঘুরেই বেড়ায় সারা গাঁয়ে এ ঘর থেকে ও ঘর। রাজার বাগানে বসে যেমন সে টাকা শুকানো দেখে, তেমনি আবার নাপিতভায়ার বাড়িও তার অবাধ গতি। বিড়াল মহারানী, অতিকায় হাতি আবার ক্ষুদ্র মশা, সবার দোরে সে পৌঁছে যায়। সবাই মিলে একটা বৃহৎ পরিবার, সবার সহাবস্থান। বোকা জোলা, বুদ্ধিমান ঠাকুরমশাই, নরহরি দাস, মজন্তালী সরকার, বুদ্ধুর বাপ, সকলেই মিলেমিশে থাকে সেই গ্রামে। ওদিকে বাঘমামাও মানুষের প্রতিবেশী। তারও ইচ্ছে জাগে পিঠে খেতে, মানুষের মেয়ে বিয়ে করে সুরাঁধুনি ঘরে আনতে। শেয়াল আর কুমীরও আছে সেই গ্রামে। আলুর ক্ষেত, আখের ক্ষেত নষ্ট করেও তারা কিন্তু গ্রামজীবনের অংশই থেকে যায়। ঠিক যেমন থাকে বাঘ, যার বাচ্চারা খেয়ে ফেলতে চায় ‘’তোর যে শালা, মোর যে মামা, মার যে সোদর ভাই’’-কে। ছোট শিশুরা গল্প শুনতে শুনতে নিজেরই অজান্তে পশুপাখিকে চিনতে শেখে, ভালোবাসতে শেখে। যখন ফোঁড়া কাটাতে টুনিভাই নাপিত থেকে শুরু করে মশা পর্যন্ত সকলের দ্বারস্থ হয়, তখন একটা জৈবিক ও সামাজিক শৃঙ্খলের অস্তিত্ব স্পষ্ট দেখতে পাই আমরা। “কে ভাই! টুনি ভাই! এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?” একদিকে আগুন, লাঠি, জল আর অন্যদিকে হাতি, বিড়াল, ইঁদুর- অজৈবিক ও জৈবিক সকল সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার এক অটুট সম্পর্ক। মিথোজীবীতার এমন অজস্র ছবি দেখতে পাওয়া যায় টুনি ভাই ও তার সঙ্গীসাথীদের জীবনযাত্রায়।

    গ্রামে বাস করে কিছু প্রান্তিক মানুষও। সমাজের এক কোণে পড়ে থাকা কুঁজো বুড়ি, পান্তা বুড়ি কিংবা উকুনে বুড়ি। পরিবারের বাইরে তাদের আশ্রয় মেলে বৃহত্তর জীবজগতের মাঝে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় লাউ, গোবর কিংবা বক। উকুনে বুড়ি পুড়ে মরলে বক সাতদিন উপোস করে, নদীর জল শুকিয়ে যায়, গাছের পাতা ঝরে পড়ে, ঘুঘুর চোখ কানা হয়, হাতির লেজ খসে পড়ে। এক কথায় বলা যেতে পারে, বাস্তুতন্ত্র ও সৃষ্টি-শৃঙ্খলের ছন্দপতন হয়। কারণ প্রকৃতির বিশাল দুনিয়ায় সবাই যাপন করে এক পরস্পর-নির্ভর জীবন।

    ২. কাঁচা মাংস খায় জংলীরা

    তুতু-ভূতু-কে কি বলা যায় টুনটুনির বই-এর উত্তরসূরী? ১৯৫৯ সালে লেখা এই বইটি ছিল আমাদের শহুরে শৈশবে কল্পনার রাজ্যে প্রবেশের একটা চাবিকাঠি। বইটা অজস্রবার নাড়াচাড়া করতে করতে পাঁচিলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচে বেড়াল আর রাস্তায় ঘেউ-ঘেউ করা নেড়ি কুকুরটা হয়ে উঠেছিল আমাদের ভীষণ কাছের। ছানা-পানা, চ্যাও-ম্যাও, তুতু-ভুলু, এইসব ভূতুর খেলার সাথীদের মানুষের মতো করেই দেখতে শিখিয়েছিল এই বইটি। কী অসীম মমতায় তাদের সৃষ্টি করেছিলেন শ্রী ধীরেন বল। এটাই বোধ হয় সে সময়ের প্রথম বই, যার প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রায় পাতাজোড়া ছবি, রঙের জাদুতে অত্যুজ্জ্বল। অল্প কথায় বলা সহজ গল্পটি তেমনই মনোগ্রাহী। হাঁসু খোকা, বগা পুলিশ থেকে শুরু করে ভূতুর মা-বাবা আর প্রতিবেশীরা, সকলেরই আচরণ ঠিক যেন আমাদের মতো। নালিশ, বকুনি, মনখারাপ। সেই যে ভূতুর মা এইসা বকুনি দিলে, “ছি-ছি ভূতু, এ কি বদস্বভাব তোর? ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে একি নোংরামি!”, “ওরা অশিক্ষিত, ওদের সঙ্গে কখনো মিশবে না”, “এখন আমরা মানুষের মতোই সভ্য আর শিক্ষিত।” এ তো মানুষ-মায়ের তিরস্কারের ভাষা, কেবল ‘মানুষের মতো’ হয়ে ওঠার ইঙ্গিতটুকু ছাড়া। কিংবা আবার মা বলেন, “মাছ-মাংস খেতে যদি এতোই সাধ, মাছ ধরে এনো, আমি তোমায় রান্না করে খাওয়াবো। কাঁচা মাংস খায় জংলীরা।” ঠিক যেন আমাদের মায়েদের শাসন ও সোহাগ। একটু ছিপ ফেলে মাছ ধরা, একটু ইঞ্জিনিয়ারিং করে পুল বানানো, আবার একটু ঝগড়াঝাঁটি, মারামারির পর দিনশেষে পংক্তিভোজন- এই সব মিলে জীব-জন্তুদের মায়াময় ‘মনুষ্যজগৎ’।

    তুতু আর ভুতু কিন্তু বাড়ির আশ্রিত বা পুষ্যি নয়। ইংরেজি নামে আর বাহারের ডাকে বাঙালির গৃহপালিত কুকুর-বিড়াল এরা নয়। নিখাদ বাঙালি তুতু আর ভূতু আদতে আমাদের মতোই একটা নিপাট সাদাসিধে জীবন যাপন করে। তাদের নিজেদের বাড়িঘর আছে, ইস্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি হয়, বর্ষাকালে পথে জল জমে, রাত্তিরে হলঘরে বালবের আলো জ্বলে, তাদের বাবারা ভুড়ুক ভুড়ুক তামাক টানে, মায়েরা উল-কাঁটা দিয়ে সোয়েটার বোনে। সেই গ্রামে পুলিশ পাহারা দেয়, সেখানে পুকুর ইজারা নেওয়া যায়, সেখানে পাড়ার লোকেরা সবাই দল বেঁধে নালিশ করতেও যেতে পারে। সবে মিলে একটা পরিপূর্ণ যৌথ জীবনের ছবি, একটা সমাজবদ্ধতার পাঠ। পশুদের জেনে নেওয়ার আর ভালোবাসার এর চেয়ে সুন্দর যাত্রা শুরু আর কী হতে পারে! বাঙালি ছেলেমেয়েরা ভাগ্যবান, শিশুসাহিত্যের পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে তাদের প্রকৃতি আর পশুপ্রেমের হাতেখড়ি।

    ৩. সার্কাস কোম্পানি ও কয়েকটি মানুষ

    খানিকটা বড় হয়ে হাতে এসেছিল আরেকটি বই- Gerald Durrell রচিত My family and other animals. দশ বছরের ছোট্ট জেরাল্ড মা আর ভাই-বোনেদের সাথে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে এসেছে গ্রীসের কর্ফু দ্বীপে। আঙ্গুর আর জলপাইয়ের ক্ষেতে ঘেরা সবুজ উজ্জ্বল এই গ্রীক দ্বীপটি। সেখানে স্নানের ঘরে সাপ আর ঘরের ছাদে টিকটিকি, বাড়ির দরজায় গাধা আর পাশের গাছে জোনাকি - এইসব নিয়ে গড়ে ওঠে জেরাল্ডের খুদে জগৎ। সে তাদের সবার নামকরণ করে আর বাড়িটা ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি চিড়িয়াখানায়। সেখানে জায়গা পায় উদ্ভট প্রাণীরা যাদের সাধারণত বলা হয় ‘little uglies’. ইংল্যান্ডের ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে এসে রৌদ্রোজ্জ্বল কর্ফু দ্বীপে ছোট্ট জেরাল্ড দেখে নানারকমের পোকামাকড়। ফুলের ওপর এসে বসে উড়ে মাছি, ভোমরা। পিঁপড়ে আর শুঁয়োপোকা যেমন তাকে আকর্ষণ করে, তেমনি তার বন্ধু হয়ে ওঠে ছোট্ট পাখি খঞ্জনা, গয়াল, গুবরেপোকা। গোলাপের পাপড়ির ভেতর মৌমাছি, প্রজাপতি আর রান্নাঘরের সামনে ভেষজ গাছগাছালির মিষ্টি সুবাস - ইংরেজ বালকটির সামনে সব মিলিয়ে এক মোহময় জগত তৈরি করে। কেমন করে ফোটে ফুল, কেমন করে রং বদলায় কীটপতঙ্গ, আর কেমন করেই বা শুকনো পাতার ফাঁকে গা ঢাকা দেয় শিকারী মাকড়শা- এইসব ছোট ছোট প্রকৃতির খেলা হাতছানি দেয় ভবিষ্য়তের পশুপ্রেমী ড্যারেলকে। ছোট জেরাল্ডের প্রথম বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বোধ হয় শুরু হয় কেন্নোর বাসা বাঁচানো দিয়ে। সেখানে সে নোটিশ লাগায় ‘Bewar- earwig nest- quiat plese’. লেখকের নিজের ভাষায়, পাঁচটির মধ্যে তিনটি বানানই ভুল, কিন্তু শুদ্ধ হয়েছে জীবজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দদুটি । পোষা কুকুর রজারকে নিয়ে জেরাল্ড ঘুরে বেড়ায় চাষিদের গ্রামে। সেখানে আছে সুগায়িকা আগাথি, পশুপালক ইয়ানি কিংবা ড্রাইভার স্পাইরো। এইসব মানুষদের সঙ্গে যেমন তার বন্ধুত্ব, তেমনি তার বাড়ির মধ্যেও আছে আরো বন্ধু- কচ্ছপ আকিলিস, পেঁচা ইউলিসিস, টিকটিকি জেরেনিমো, আরো কত কে! পায়রা কোয়াসিমোদো ওয়াল্টজ শুনে ঘাড় দোলায়, কিন্তু মিলিটারি মার্চ হলে তার আবার ঠিক পছন্দ নয়। মানুষের মতো এরা সকলেই এই যৌথ পরিবারটির সদস্য। জেরাল্ডের ভাইবোনেরা একেকজন একেক প্রকারের ছিটগ্রস্ত। সে তাদেরকেও মনে করে অন্যান্য জীবজন্তুদের মতোই। এদের সকলকে নিয়ে তৈরি হয় ছোট্ট জেরাল্ডের বৃহৎ পরিবার। আর এইখানেই মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে রচিত হয় এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। গল্পের শেষে যখন তারা ইংল্যান্ড ফিরে আসছে, তাদের সঙ্গে অজস্র ট্রাঙ্কে ভরা অসংখ্য জীবজন্তু। জাহাজের পরীক্ষক নিরাপত্তার মাপ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ এমনিই ছাড়পত্র লিখে দেন। তাতে যাত্রীদের বর্ণনায় বলা হয় ‘সার্কাস কোম্পানি ও কয়েকটি মানুষ’ ।

    জীবজন্তুদের নিয়ে লেখা ড্যারেলের বইগুলি পড়ে উৎসাহিত হয়েছেন অজস্র পাঠক। উল্লিখিত বইটি কর্ফু ট্রিলজির একটি। মজার ছলে লেখা অসামান্য এই গল্পগুলি জীবজন্তুকে অন্যভাবে দেখতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মাত্র চার বছর, ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সময়ে তাঁরা কর্ফু দ্বীপে ছিলেন। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই জন্ম দিয়েছিলো ভবিষ্যতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষক জেরাল্ড ড্যারেল-এর। সুদূর ১৯৫৬ সালে লেখা এই ‘My family and other animals’ বইটিকে আজও সাধারণ পাঠকের পক্ষে পশুপ্রেম ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রথম পাঠ বলা যেতে পারে। ১৯৬৩ সালে ড্যারেল স্থাপন করেছিলেন Jersey Wildlife Preservation Trust, যা পরিবর্তিত নাম Durrell Wildlife Conservation Trust হিসাবে কাজ করে চলেছে তাঁর মৃত্যুর পয়ঁত্রিশ বছর পরেও। ১৯৮২ সালে জেরাল্ড ড্যারেলকে Order of the British Empire (OBE) দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। পশুপ্রেমী ড্যারেলের সারা জীবনের কাজের মূল উদ্দেশ্যটি ধরা পড়ে তাঁরই কথায়, “Animals are the great voteless and voiceless majority who can survive only with our help.”

    এই কঠিন সময়ে পরিবেশ আর জীবজগতের ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বারে বারে মনে পড়ে যায় ছোটঠাকুমার মুখে শোনা গল্প, টুনটুনির বইয়ের কাঠখোদাই ছবি, তুতু-ভূতুর খেলার মাঠ আর মাছ ধরার পুকুর পাড়ের সজীব দৃশ্যপট। সেই সহজ সুন্দর শান্ত সহাবস্থানের জীবনে সংঘাত নেই, ধ্বংস নেই, আছে কেবল মিলে মিশে থাকা এক স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবজগৎ। এর নামই তো বিজ্ঞানের ভাষায় জৈবিক সামঞ্জস্য (ecological balance)। অনুপম গদ্যে লেখা এই শিশু সাহিত্যগুলি কতদিন আগেই সেই মিলনের ছবি এঁকে দিয়েছিল। পরিবেশ, প্রকৃতি আর মানুষের সম্মিলিত জীবনের এইসব অসামান্য পথপঞ্জি আমাদের নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করুক, জীবজগতের সম্মিলিত ভবিষ্যৎ সুন্দর করুক। বাঁচুক প্রকৃতি, বাঁচুক পৃথিবী।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ১৩ জুলাই ২০২১ | ২৬৭১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৩ জুলাই ২০২১ ২০:১০495759
  • বাঃ ! চমৎকার লেখা।


    শেরনি ফিল্মটি আমি লোকজনকে বলে বলে দেখাচ্ছি।

  • | ১৮ জুলাই ২০২১ ১১:৩৯495908
  • এই লেখাটা চোখ এড়িয়ে গেছিল কী করে যেন। 


    ডারেলের বই, তুতু ভুতু এইদুটো সাথে করবেটের মাই ইন্ডিয়া মিলে জীবজগতকে আমাদের অংশ ভাবতে শিখিয়েছে। একটা অস্বস্তির ব্যপার হল উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বই আদতে মনে হয় ভায়োলেন্স প্রোমোট করে। মানুষের প্রয়োজনে বা নিতান্ত অকারণেও জীবজন্তুকে অত্যাচার করার এই ব্যপার আমি নিজে থেকে খেয়াল করি নি। ইন্দ্রাণী মানে ছোটাইয়ের কন্যার তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা পড়েছিলাম গুরুর পাতাতে, তখন সেই অরথম অবাক হয়ে ভাবি সত্যি তো  বাঘের ছানাদুটোকে মেরে দিল কেন? ছোট্ট ছানাদুটো ত মানুষ্মেয়েকে বিশ্বাস করেছিল। 


    এরপরে খেয়াল করে দেখি অনেকসময়ই একটা চাপা হিংস্রতা আমাদের সাহিত্যে ছেয়ে থাকে।  এজন্যই হয়ত বা নীরিহ কুকুরের গায়ে গরমজল ঢেলে দেওয়া, রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা গর্ভিনী কুকুরের পেটে লাথি মারা জাতীয় হিংস্র আচরণ আকছার ঘটে আমাদের চারপাশে। বনবেড়াল বাঘডাঁশা জাতীয় কোন প্রাণী পাড়ায় এসে পড়লে ত কথাই নেই, ঘিরে ফেলে দলবেঁধে খুঁচিয়ে মারার অপার আনন্দ। 


    এইরকম বই আরো অনেক দরকার বাংলায়। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন