মাঝারি চেহারার মেয়েটা ক্লাসরুমের এক কোণে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে ছিল। আঙুলের মাঝে সরু পেন্সিলটা শক্ত করে ধরে। তার মাথার লম্বা বিনুনি পিঠ ছাড়িয়ে চেয়ারের হেলান দেওয়ার জায়গায় লুটিয়ে। তার প্রিয় বিষয় ইংরেজির ক্লাস আরম্ভ হবে একটু পরেই। মজার কথা, সে বাঙালি, তবু ও ইংরেজি তার প্রিয় বিষয়।
তার আশেপাশের চেয়ারে বসা ব্রিটিশ মেয়েগুলোর কাছে ইংরেজি এক ভয়ঙ্কর বিষয়। সকাল সকাল শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের সংলাপ তাদের জন্য আনে একরাশ বিরক্তি। আর লাঞ্চ-ব্রেকের পর ইংরেজির ক্লাস থাকলে ঘুমটা তাদের ভীষণ ভালো হয়। অথচ এই মেয়েটার মাথার ভেতরে ইংরেজি শব্দগুলো যেন নদীতে সাঁতার দেওয়া রং বেরঙের মাছের মতো সাবলীল ভাবে ঘোরাফেরা করে। O বর্ণের মাঝে সে মুক্তি খোঁজে, U এর দুই বাহুর মাঝের গভীর খাতের ভেতরে সে খোঁজে মুক্তো।
তবে, প্রতিটি ইংরেজি ক্লাসে সে একটাই সমস্যা অনুভব করে। খুব সামান্য সে সমস্যা কিন্তু তার কাছে তা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কোর্স কারিকুলামের মধ্যে সে এমন কিছু খুঁজে পায় না, যা তার মাতৃভাষা আর সংস্কৃতির কথা বলে। মাতৃভাষা দূরে থাক, তার নিজস্ব সংস্কৃতি এদেশের কোর্স কারিকুলামে অপ্রকাশিত, অচেনা, এমনকি, অস্বীকৃত। কারিকুলামে প্রায় পুরোটাই এমন ভাবে তৈরি যে এদেশের সংখ্যাগুরু জনতার প্রতিনিধি আর সেই জনতার কথা ভেবেই লেখা। অথচ সেই সংখ্যাগুরু জনতার বাইরে পড়ে আছে কত ছোট ছোট সম্প্রদায়, যাদের সংস্কৃতির ইতিহাস নেহাত ফেলনা নয়, বরং জায়গায় জায়গায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
মিসের হাই হিলের ঠক ঠক শব্দে তার চিন্তার জালটা ছিন্ন হলো। টেবিলের ওপর হাতের ফোল্ডারটা রেখে ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক করে মৃদু হেসে সমস্ত ছাত্রীদের ‘গুড মর্নিং’ বললেন তিনি। ব্যস্ত হাতে গাঢ় নীল রঙের ফোল্ডারের স্ট্র্যাপটা খুলে স্টেপল করা একতাড়া A4 সাইজের কাগজ বের করে রাখলেন টেবিলে । সামনের বছরেই সেকেন্ডারি স্কুলের শেষে GCSE পরীক্ষা, তাই পড়াশোনা এখন জোরদার। ওই একতাড়া কাগজগুলো হলো প্রতিটি ছাত্রীর জন্য তৈরি করা আজকের লেসন। সামনের সারিতে বসা একটি মেয়েকে ডেকে তিনি সেই কাগজগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে বললেন। একটু পরেই মেয়েটা তার টেবিলের ওপর স্টেপল করা কয়েকটা পাতা পেলো অন্য মেয়েটার হাত থেকে। আজকের লেসনের হেডিং-এ সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ গেল আটকে। ব্রিক লেন। মনিকা আলি।
ইস্ট লন্ডনের ব্রিক লেন! তার ছোটবেলার একটা বিস্ময়ের নাম! মনে পড়ে, সেখানে রাস্তার নামগুলো বাংলায় দেখে তার সাত বছরের ছোট্ট মুখটা হাঁ হয়ে গেছিল। ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়েরাস্তাগুলোর নাম একটা একটা করে দেখিয়ে আনন্দে খিলখিলিয়ে উঠে বাবার জ্যাকেটে টান দিয়ে বলেছিল, “দেখ দেখ, এই রাস্তার নাম বাংলায় লেখা!” বাবা মা'র সাথে একটা বাংলাদেশি ক্যাফেতে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে, পুঁই শাক, পাবদা মাছ, রসগোল্লা কিনে রাস্তায় নেমে একটা বইয়ের দোকানে তার চোখ পড়েছিল। বই তার ভীষণ প্রিয় আর তাই বাবা-মা'ও বাধা দেয়নি। দোকানে ঢুকে সে তো অবাক! চারিদিকে থরে থরে বাংলা বই। আনন্দে ছুটোছুটি করে সে কোথা থেকে দুটো বই তুলে নিয়ে এলো, একটা ছবি দেওয়া বাংলা ছড়ার বইআর একটা বই বাংলা লিখতে শেখার। সেই সময়ে তার প্রাইমারি স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড চাইনিজমেয়েটা রোজ রাত্তিরে মায়ের কাছে মান্দারিন শিখত। বইদুটো মায়ের হাতে দিয়ে বললো, “মা, আমিও বাংলা শিখব আজ থেকে”।
মিসের দেওয়া কাগজগুলো আজ তাকে নস্টালজিক করে তুললো। আজ পর্যন্ত সে শুধু ইংরেজ লেখকদের লেখা একান্তই ব্রিটিশ বইগুলো পড়ে এসেছে। এই প্রথম সে জানলো, উপমহাদেশ -জাত এক লেখিকা একটি আস্ত বই লিখে ফেলেছেন সেই বরোটি নিয়ে যে বরোতে এককালে সে থাকতো; বইটি ওই বরোতে বাস করা সেই মানুষদের নিয়ে লেখা যাদের শেকড় আর ওর নিজের শেকড় একই মাটি থেকে রস নিয়ে বেড়ে উঠেছে। লেখিকা স্মৃতি থেকে ব্রিটিশ-বাঙালি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর মনের কথা খুব সহজে লিখেছেন এই গল্পে।
বছর কুড়ি আগে এই মেয়েটির বাবা-মা এসে পৌঁছেছিল বিলেতের মাটিতে। এদেশের মানুষ 'চিকেন টিক্কা মসালা'কে জাতীয় খাদ্যের সম্মান দিলেও টিপ আর শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরিহিতা তার মাকে গালিগালাজ করতে ছাড়ত না। ভদ্রতার আড়ালে এই নিষ্ঠুর বিদ্বেষ কষ্ট দিত তার বাবা-মাকে। মেয়েটার মনে পড়ে, তার মায়ের কাছে শোনা একটি গল্প। বছর বারো আগে তার বাবা-মা পূর্ব ব্রিটেনের এক ছোট শহরে এক পাকিস্তানি ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাহায্যে যখন ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামাচ্ছিলো, তখন একটা সাদা ছেলের দল গাড়ির হর্ন বাজিয়ে গাড়ি থেকে আধখাওয়া বেকন স্যান্ডউইচ ওর মায়ের গায়ে ছুঁড়ে পাকিস্তান ফিরে যাবার আদেশ দিয়েছিল।
সময়ের সাথে সাথে বিদ্বেষ অবশ্যই কমেছে। আজকের ব্রিটেনে দেখা যায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। কিন্তু তার কখনোই মনে হয় না সে এই ব্রিটিশ সংস্কৃতির সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যেতে পেরেছে। তার ক্লাসের মেয়েরা যে টিভির প্রোগ্রাম দেখে বড়ো হয়েছে তার সঙ্গে তারা মানসিক যোগ স্থাপন করতে পারে। সেখানে উপমহাদেশীয় উপস্থিতি খুব সামান্য, বেশির ভাগ সময় একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা কমিক রিলিফের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর রয়েছে তার সংস্কৃতির প্রতি অনুকম্পা, বিদ্রূপ আর কটাক্ষ।
ক্লাসের পড়ার শেষে মেয়েটার মাথার একটা বন্ধ দরজা যেন খুলে গেল। এতদিন ধরে যে কথাগুলো তার মগজের গ্রে ম্যাটারে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো আজ যেন সেগুলো কুয়াশা কাটিয়ে তার চোখের সামনে পরিষ্কার ভেসে উঠল। ক্লাস শেষের বেল বেজে উঠলো। এর পরেই লাঞ্চ-ব্রেক। মিস একটু অধৈর্য হাতে ক্লাসের মেয়েদের জমা দেওয়া এক্সারসাইজ পেপার গুলোকে ঠেলেঠুলে ফোল্ডার বন্দি করতে লাগলো। মেয়েটা'র মনে হলো, এটাই সঠিক সময়। সে ধীর পায়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে মিসের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। ক্লাসের অন্য মেয়েরা তাকে মুখচোরা হিসেবেই চেনে, আর তাই তারাএকটু অবাকই হলো মেয়েটাকে এগিয়ে যেতে দেখে। মেয়েটা যেন আজ নিজের মনের ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করলো তার এতদিনের শব্দহীন অনুভূতিকে শব্দে প্রকাশ করার ।
আর তাই, সে মিসের কাছে গিয়ে বলল, "মিস, আমার কিছু বলার আছে, আপনার একটু সময় নষ্ট করবো, আমি দুঃখিত তার জন্য, কিন্তু নিরুপায়। 'ব্রিক লেন' এর মত একটি অন্য সংস্কৃতির বই আমাদের কারিকুলামে রাখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।আমার নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি কোথাও সামান্য স্বীকৃতি পেলে আমার মনে সবচাইতে আনন্দ হয়। এখনো পর্যন্ত এদেশের সংস্কৃতির মধ্যে আমার ঘোরাফেরায় ছিল একটা লজ্জা, একটা আড়ষ্টতা; আজকের ক্লাসের পর আমার মনে হলো আমার সংস্কৃতি যেন স্বীকৃত হলো। যারা মনে করে এই ধরণের বই পড়া নিতান্তই একটা তুচ্ছ ব্যাপার, তাদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই কথা - এই বইয়ের প্রতিটি শব্দে এই মেয়েটির অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। এই কিছুক্ষন আগেই আমার পাশে বসা ব্রিটিশ মেয়েটা আমাকে বললো তার মনের একটাই দুঃখ, সে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় ভালো করে কথা বলতে জানে না। আর তা শুনে গর্বে আমার বুকটা ভরে উঠলো, আমার অন্তত সেরকম দুঃখ নেই। এর পর থেকে হয়তো আমার অভিযোগ জানানোই উচিতহবে না, কারণ আমার সম্প্রদায়ের বাইরে আরো অনেক সম্প্রদায় আছে যারা নূন্যতম স্বীকৃতির অভাব স্বাভাবিক ধরে নিয়ে নিঃশব্দে দিন কাটায়। আপনাকে বিশেষ অনুরোধ, এরকম অন্য আরো সম্প্রদায়ের অনুভূতিকে শব্দে প্রকাশের সুযোগ দিন। এই দেশের প্রতিটা মানুষের জন্য দরকার এক টুকরো জায়গা আর সেই জায়গায় তার নিজের শেকড় স্থাপনের অধিকার।"