কাঁকড়া আমরা সবাই চিনি। নানা জাতের কাঁকড়া, যেমন: মেঠো কাঁকড়া, সামুদ্রিক কাঁকড়া; আবার নানা রঙের কাঁকড়া, যেমন: বাদামি, লাল, হলুদ; ছোট-বড়-মাঝারি মাপের কাঁকড়া আমরা দেশে বিদেশে দেখে থাকি। এদের মধ্যে সামুদ্রিক লাল কাঁকড়া আমরা আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন সি-বিচের ধারে দেখতে পাই এবং এদের চলাফেরাও বেশ মজার।
এ বছর পুজোর দিনকয় আগে আমি বাবা ও মায়ের সাথে বকখালি থেকে ঘুরে এলাম। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর লাল কাঁকড়া দেখলাম। অন্যান্য কাকড়ার থেকে এই লাল কাঁকড়া দেখতে একটু অন্যরকম। অন্যান্য কাঁকড়াদের মত এদের চারটি করে দু’দিকে আটটি পা থাকলেও, মূল তফাৎটা হল, এদের একটি মাত্র বড় দাঁড়া। এরা টকটকে লাল রঙের, যা এদেরকে দেখতে বেশ আকর্ষণীয় করেছে। লাল কাঁকড়ারা তাদের একমাত্র বড় দাঁড়াটি সাধারণত তাদের মুখের সামনে রেখে থাকে। এটা দিয়েই তারা হাতের মত করে খাবার খায়, আবার প্রয়োজনে আত্মরক্ষার কাজে লাগায়। আর অন্য দাঁড়াটি আকারে তুলনায় অনেকটাই ছোট। লাল কাঁকড়ারা খুবই শান্তিপ্রিয়। এরা দলবদ্ধভাবে অল্প জায়গায় অনেকে একসাথে থাকতে ভালোবাসে। সমুদ্রের ধারে, বালিতে, প্রত্যেকে নিজের নিজের গর্ত তৈরি করে বাসা বানায়।
সি-বিচে জলের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, সর্ষে দানার মত থেকে শুরু করে, ছোট মটর-কড়াই এর মত আকারের বালির গোল গোল ঢেলা প্রচুর পড়ে থাকতে দেখলাম; প্রথমে এগুলি কি তা না বুঝলেও, পরে আবিষ্কার করেছিলাম যে লাল কাঁকড়ারা তাদের গর্ত খুঁড়ে বাসা তৈরি করার জন্য দাঁড়া দিয়ে বালির ঢেলা তৈরি করে – যেগুলি বাড়ির উপর ছড়িয়ে রেখেছে। এদের বাসার গর্তগুলি বেশ গভীর ছিল। উপর থেকে গর্তের ভিতর বসে থাকা কাঁকড়াকে দেখতে পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সমুদ্রের জলের ধারে এরা এমন দল বেঁধে বসেছিল, যে একটু দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন জলের ধারে বালির উপর কেউ লাল চাদর পেতে রেখেছে। সমুদ্রের জলের ঢেউ কখনও অল্প, আবার কখনও বালির অনেকটা উঁচু পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। লাল কাঁকড়ারাও দল বেঁধে সেই ঢেউয়ের তালে উপরে নিচে ওঠানামা করছিল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেন লাল চাদরটা জলের দামে একবার নিচে নেমে যাচ্ছে ও আবার ঢেউয়ের ঠেলায় উপরে উঠে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, লাল কাঁকড়াগুলো এত জোরে দৌড়ে উপরে যাচ্ছিল যে ঢেউয়ের জল তাদের ছুঁতেই পারছিল না। এরা দলবেঁধে সবাই একসঙ্গে থাকলেও, তাদের মধ্যে অদ্ভুত রকমের মিলমিশ ছিল। তারা কখনোই একে অপরের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি বা মারামারি করছিল না। তাই সেদিক থেকে দেখলে এরা বড়ই শান্তিপ্রিয়। শুধু তাই নয়, লাল কাঁকড়ারা, ছোট হোক বা বড় হোক, বেশ ভিতুও বটে। এদের সাদা সাদা চোখদুটো শরীর থেকে উঁচুর দিকে উঠে থাকে, আর তাই দিয়ে তারা শুধু যে সমুদ্রের জলের দিকে নজর রাখে তাই নয়, আশেপাশে কোনো মানুষ বা অন্যকিছু তার দিকে এগিয়ে আসছে কিনা, সেটাও সবসময় নজর রাখে।
আমরা যখন তাদেরকে আর একটু ভালো করে দেখার জন্য তাদের একটু কাছে যাবার চেষ্টা করছিলাম তখন তারা বেশ কিছুটা দূরে থাকতে থাকতেই সবাই মিলে ছুট্টে যে যার গর্তের মধ্যে অর্ধেকটা করে ঢুকে যাচ্ছিল। তাদের আর একটু কাছে গেলেই তারা গর্তের মধ্যে পুরোপুরি ঢুকে লুকিয়ে পড়ছিল। আমিও একটু চালাকি করে তাদের গর্তের কাছে গিয়ে পায়ের শব্দ না করে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। লাল কাঁকড়ারা একে একে গর্ত থেকে একবার করে অর্ধেকটা বেরিয়ে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখেই আবার গর্তের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে লাগল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলার পর আমি যখন সরে চলে এলাম, তারা আবার বেরিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে খেলা করতে লাগল আগের মত।
সমুদ্রের ধারে এই লাল কাঁকড়াদের সুন্দর খেলা করা দেখতে বহু মানুষ অনেক দূর দূর থেকে সেখানে ভিড় জমায়।