এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ছেঁড়াকাঁথা

  • ছেঁয়াবাজীর ছলনা  - ২০

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ছেঁড়াকাঁথা | ১৪ মার্চ ২০২৪ | ৮৪৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • দেখতে দেখতে গরমের ছুটি এসে যায়, ছুটির দিনও আমরা একটু দেরী করে স্কুল ছাড়ি, যদি বাড়ী তৈরীর কোনও তোড়জোড় চোখে পড়ে। বাড়ী তৈরীও শুরু হয় নি, অভিভাবকদের সাথে দিদিমণিদের মিটিংও হয় নি, হয়ত বন্যায় ধুয়ে গেছে সেইসব কথাবার্তাই। আমাদের স্কুলে সবই চলছে আগের মতই যেমন চলছিল। আশেপাশে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, বেশ দ্রুতই হচ্ছে। মেথরপট্টির মধ্যে একটা ঝকঝকে নতুন টিউবওয়েল বসানো হয়েছে, বেশ উঁচু করে সিমেন্ট বাঁধানো চারদিকে। একটা  পৌরসভার টাইমকলও বসানো হয়েছে।  আর শুরু হয়েছে যাদের বাড়ীতে পাকা বাথরুম নেই, তাদের সক্কলের বাড়ীতে পাকা বাথরুম বানিয়ে দেবার উদ্যোগ। পৌরসভা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন্নগর থেকে খাটা পায়খানা তুলে দেবে। যাদের বাড়ীতে পাকা বাথরুম আছে, তারা অনেকেই খুব অসন্তুষ্ট, তাদের মতে আগে সমস্ত রাস্তাঘাট ঠিক করা হোক, রাস্তায় সমস্ত লাইটপোস্টে লাইট লাগানো হোক, তারপর ‘ছোটলোক'দের বাথরুম বানিয়ে দিলেই হবে। পাড়ায় মরা কুকুর বা বিড়াল ফেলবার জন্য মেথরপট্টির ছেলেদের ডাকলে ওরা আজকাল দশ কুড়িটাকা চায়। তাতেও অনেক লোক খুব রেগে যাচ্ছে। এই সরকার এসে নাকি 'ছোটলোক'দের মাথায় তুলছে।  

    সব মামারা এলে বাড়ীতে এই নিয়ে সাংঘাতিক তর্ক বেধে যায়। যে দিদা কখনও দাদুর সামনে জোরে কথা বলে না, সেই দিদা এই ‘সুডুলুকদের মাথায় তোলা' নিয়ে খুব রেগে জোরে জোরে কথা বলে। বড়মামা সায় দেয়, ছোটমামাও, সেজমামা আর দাদু বারেবারেই বলে কাউকে পয়সা না দিয়ে কোনও কাজ করানো অন্যায়। আর যার জন্যই করুক, উপকার তো সকলেরই হবে। এই খাটা পায়খানা উঠিয়ে দিলে, ভাগাড়ে আর অত গন্ধ হবে না, চাই কি ভাগাড় হয়ত অন্য কোনও ছোট জায়গায় সরিয়েও নেওয়া হতে পারে। দিদা মানে না, ঘোমটা আরেকটু টেনে দিয়ে বড়মামাকে বলে ‘তাইনরে ক য্যান বেশী কথা না কয়, ঐসব আমার জানা আসে’। গরমের ছুটির প্রায় শেষদিকে  ছোটমামার বিয়ে, তাই তর্ক বেশীদূরে এগোতে পারে না অন্য কোনও কাজের কথায় চাপা পড়ে যায়। আমার মনে দাদুর কথায় একটু আশা হয়, হয়ত আমরা যখন ক্লাস নাইন টেনে উঠব, ততদিনে কোন্নগরের সব বাড়ীতে সেপটিক ট্যাঙ্কের ব্যবস্থা হয়ে যাবে, আর ভাগাড়টা উঠে অন্য কোথাও চলে যাবে। ‘বালিকা শিক্ষা সদনের বাড়ী'ও নিশ্চয়ই ততদিনে হয়েই যাবে। স্কুলটা তখন বেশ রিঙ্কু শুভ্রাদের স্কুলের মত হয়ে যাবে। কেউ আর আমাকে বলবে না ‘ও তুই ভাগাড়পাড়া স্কুলে পড়িস', বলবে না ‘আরে ওখানে যারাই পড়ে তাদের সব্বার মাথায় উকুন থাকে' তোর নেই? সেকিইই?'

    দাদু অবশ্য শুনতে পেলেই বলে ‘অর মাথা খুব গরম, হের লাইগ্যা উকুন আইতে পারে না, কুনোদিনও অর উকুন হয় নাই’।  শুনে কেউ কেউ মুচকি হাসে, কেউবা আবার বলে ‘ও চুল আরেকটু বড় হলেই হবে ঠিক।‘ তারপরই এইসব ভাবনা মিলিয়ে গিয়ে মনের ভিতরে কেউ চুপি চুপি বলে ‘দূর তুই ওসব দেখে কি করবি? তুই তো তার আগেই মরে যাবি।‘ সবার মাঝখান থেকে আমি একা হয়ে যাই, আরও একা, আমি চুপ করে কোনও একটা ঘরের কোণায় বসে থাকি   চারপাশে ছেয়ে আসে এক রূপোলী ধুসর জগৎ , কেবলই লোভ দেখায় ‘চল মরি, মরতে বড় মজা’। আমি মৃত্যুর উপায় খুঁজতে থাকি, গোয়াল থেকে নারকেল দড়ি নিয়ে বই দেখে ফাঁস বানাবার চেষ্টা করি, কিন্তু ভেবে পাই না সকলের চোখের আড়ালে কীভাবে  মরা যায়। কেউ কিচ্ছু টের পায় না, আমি সবার থেকে আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে যেতে থাকি, নিজেকে ঢুকিয়ে নিই এক অদৃশ্য কেসের ভেতরে। আজকাল আর রাগ, দুঃখ কিছুই হয় না, খুশীও না, কেমন একটা বোদা ধুসর লাগে সবকিছু। তিন চারমাসের পুরানো কাগজের পাতা উলটাই অন্যমনস্কভাবে। ইরানের শাহ রেজা মিশরে পালিয়ে গেছেন, আয়াতোল্লা খোমেইনি বহু বছর পালিয়ে থাকার পরে দেশে ফিরে ইরানের সর্বময়  কর্তৃত্ব দখল করেছেন।

    ‘সর্বময় কর্তৃত্ব’ মানে কি দিদার মত? একটা আস্ত দেশের মাথায় দিদার মত কেউ থাকা ব্যপারটা পছন্দ হয় না আমার। কাগজে ভাল মন্দ অনেক কিছু লেখে। আরো পঁয়ত্রিশ বছর পরে আজার নাফিসির ‘রিডিং লোলিটা ইন তেহেরান’ পড়ে জানব খোমেইনির কর্তৃত্বে সত্যি কেমন দাঁড়িয়েছিল ইরানী বালিকাদের জীবন। গরমের ছুটির শেষদিকে ছোটমামার বিয়ে হয়ে গেল। কত জায়গা থেকে কতসব আত্মীয়স্বজনরা এল, বরযাত্রী যাওয়ার জন্য আমার একটা দারুণ সুন্দর সিল্কের জামা হল, সেটা আবার চমৎকার ফিটিংসের বানিয়েও দিলেন নবগ্রামের টেলার মাসিমণি। এঁর কাছেই আমাদের ফ্রক, মা’দের ব্লাউজ ইত্যাদি বানানো হত। ইনি মাঝেমধ্যে খুব অদ্ভুত ডিজাইনের জামা বানাতেন। এইবছরই ক্লাস শুরুর আগে মা আমার জন্য মেরুণ রঙের স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজ বানাতে দিল, স্কার্টে খুব কম প্লিট দিয়ে কেমন একটা বস্তামত বানিয়ে দিলেন আর ব্লাউজটা আরও খারাপ। মা বলেছিল আমি বড় হচ্ছি কিনা, তাই একটু ঢিলেঢালা বানাতে। তা উনি ব্লাউজটার দ্বিতীয় বোতামের নীচে থেকে আস্তে করে চওড়াটা বাড়িয়ে গেছেন, ফলে কোমরের কাছে গিয়ে সে ব্লাউজ পুরো শায়ার মত ছড়ানো। তাকে স্কার্টে গুঁজেও পরা যায় না, আবার না গুঁজলে ফৎ ফৎ করে উড়তে থাকে।

    এদিকে এই সেটটা বানানোই হয়েছে সেভেন-এইট দুই বছর চলার জন্য, নাইন থেকে তো শাড়ী। আবার আরেক সেট বানাতে তো কাপড়ের খরচ, মজুরীর খরচ। মা এত বিরক্ত হয়ে বলল ‘একটু বেঢপ হয়েছে তো কী হয়েছে? স্কুলে কি ফ্যাশান করতে যাও?' যে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। ঐ জামাই পরে যাই। প্রথমদিকে সবাই একটু মুচকি মুচকি হাসত, এখন আর কেউ কিছু বলে না। ঐজন্য বরযাত্রী যাবার জামাটা নিয়ে খুব ভয় ছিল, তা সেটা উনি খুব সুন্দর করেই বানিয়ে দিলেন। নবগ্রাম মিষ্টিমহল ছাড়িয়ে এগোলে রাস্তাটা দুইভাগ হয়ে যায়, বাঁদিকে গেলে পোস্টাপিস, আর একটু এগিয়ে মস্ত খাটাল, তারপর সেবক সঙ্ঘ, মহাদেশ পরিষদ ইত্যাদি; আর বাঁদিকে না বেঁকে অল্প ডাইনে হেলে সোজা এগিয়ে গেলে এই টেলারিং শপটা আসত।  রাস্তার বাঁদিকে একটা পুকুর, আর্ধেকটা শ্যাওলা আর জলঝাঁঝিতে ঢাকা। একদিকে জলে শ্যাওলা নেই, সেদিকের মাটির ঘাটে দুই একজন বসে বাসন মাজে, গা ধোয়, জল থেকে একরকম আঁশটেমত গন্ধ আসে আর আসে মশা। সে প্রায় টুনটুনি পাখির সাইজের মশা সব, নবগ্রামের মশা আর লোডশেডিং দুইই খুব বিখ্যাত তখন। দোকানে টেলার-মাসিমণির দুই মেয়ে বসে বসে বোতাম লাগাত, হেম সেলাই করত ফ্রকের নীচে।

    মাসিমণি মেসিন চালাতেন, কেমন বির্ব্ণ চেহারা যেন রং ফুরিয়ে যাওয়া রঙপেন্সিলে আঁকা, মুখে কখনও হাসি দেখি নি। মাঝে মাঝে অনেকদিন করে দোকান বন্ধ থাকত, একটু দূরের ছোট্ট পানের দোকানদার বলত অসুস্থ। চৈত্রমাসের সেলের সময় মা গড়িয়াহাটের বোম্বে ডাইং বা এম জি রোডের খাটাউ ভয়েলের দোকান থেকে কটন কিম্বা রুবিয়া ভয়েলের সাদা অথবা হালকা রঙের ফুলফুল প্রিন্টের কাপড় কিনে আনত  দুটো। একটা পয়লা বৈশাখ আর একটা ষষ্ঠীর জামা বানাবার জন্য। এনেই তাড়াতাড়ি বানাতে দিয়ে আসত  যাতে বেশীদিনের জন্য দোকান বন্ধ করে যাওয়ার আগেই বানিয়ে দিয়ে যেতে পারেন। তাও এক আধবার জামা দেবার দিন থেকে আট দশদিনের জন্য দোকান বন্ধ হয়ে থাকে। আস্তে আস্তে রেডিমেড জামা পরা বাড়ছিল, বানানো কমছিল। ক্লাস নাইনে উঠে শুনলাম ওঁকে মানকুন্ডুতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, নাকি মাথার গোলমাল। সেদিন ঐ বেঢপ জামাটার জন্য যত রাগ করেছি, তার কথা ভেবে লজ্জা করছিল। এই যে আমি কোনও সেলাইই করতে পারি না, আমার কি উচিৎ হয়েছিল মনে মনে অত রাগ করা। দোকানটা আস্তে আস্তে পুরানো হয়ে হয়ে ভাঙা দরজা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে উঠে গেল, আমার বেঢপ জামাটার জন্য রেখে গেল এককুশি মায়া।

    ছোটমামার বিয়ের কয়েকদিন আগে তখন বাইরের রঙ করা শেষ হয়ে ভেতরের ঘরে চুনকাম হচ্ছে,  আমাদের ঘরটাতেও হচ্ছে। দুপুরবেলায় আমাদের ঘর থেকে বিরাট জোরে দুমম দড়াম করে আওয়াজ হল। আমরা দিদার ঘরের সব জানলা দরজা বন্ধ করে মেঝেয় শুয়ে ছিলাম, হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি দাদু পড়ে গেছে। খাটের ছোবড়ার গদির ওপরে চেয়ার রেখে পাখার ব্লেড থেকে চুন মুছতে গিয়েছিল, চেয়ার পিছলে মাটিতে চিৎ হয়ে পড়েছে। খোকা মিস্তিরি বারবার  নাকি মানা করে গেছিল অমনিভাবে না উঠতে, হাত পা ধুয়ে এসে ঘরাঞ্চির উপরে উঠে পরিস্কার করে দেবে। সবাই খুব ভয় পেয়ে যায়, দাদু কিন্তু নিজে নিজেই উঠে বসে, মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। বরফ দেওয়া হয় মাথায়, পেছনটা ফুলে আলুমত হয়ে যায়। দিদা খুব বকে দাদুকে,  বড়মামীমা রাগ করে বলে ‘মেয়ে! মেয়ে! মেয়ের কষ্ট হবে বলে অত্কান্ড করে গিয়ে উঠসেন উপরে বয়সটা কি কম হইসে?  আপনার বড়ছেলে ঘর যখন চুনকাম করাইতাসে, পরিস্কারও লোক দিয়া করাইয়াই দিত! এখন এই যে ঘটনাটা ঘটাইলেন, তারেই তো অফিস থাইক্যা আইসা ছুটতে লাগব!' দাদু মুখ তুলে বড়মামীমার দিকে তাকায়, একটু কি অবাক! বড়মামীমা তো সামনাসামনি দাদুকে এরকম সুরে বলে না কখনও কিছু! ক্লান্তভঙ্গীতে দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়ায়।   

    খোকামিস্তিরি সাবধানে একহাত দিয়ে সাপটে ধরে দাদুকে ঘরে খাটে এনে বসিয়ে দেয়। কে যেন বালিশ ঠিক করে দেয়, দাদু চুপ করে শুয়ে পড়ে। বাইরের গেটের আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি মা কোন ফাঁকে যেন শাড়ি পাল্টে তৈরী হয়ে কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব ফর্সা মায়ের কান আর গাল টকটকে লাল হয়ে আছে। বড়মামীমা তাড়াতাড়ি ডেকে বলে ‘এই দিদি কই যাস এই দুফর রোদ্দুরে? তর দাদা আইসা যাইবখনে।‘ মা কান দেয় না, দ্রুত হেঁটে চলে যায়, কিছুক্ষণ বাদে রিকশা করে কানাই-ডাক্তারকে নিয়ে ফেরৎ আসে। এমনিতে দাদুর কিছু হলে ডঃ পি কে রায়কেই দেখান হয়, আমাদের কিছু হলেও তাই। কিন্তু উনি তো কারো বাড়ীতে গিয়ে দেখেন না, তাই কানাইবাবু। উনি প্রেশার মেপে, দেখেটেখে বিশ্রাম আর ঘুমের উপদেশ দিয়ে হাই প্রেশারের ওষুধ লিখে দিয়ে চলে যান। তার পরের পরেরদিন সকাল থেকে ভেতরের উঠোনে, বাড়ির সামনে ম্যারাপবাঁধা শুরু হয়ে যায়। মন্টুমামাদাদু, মামীদিদা, পর্ণা পার্থকে নিয়ে রাঁচি থেকে চলে আসে, জামশেদপুর থেকে বড়মামাদাদু, মামীদিদা আর শীলুমাসি, ফরিদাবাদ থেকে সেজমামা, সেজমামীমা, খুকুকে নিয়ে, রাঁচিদিদা, চিনুমামাকে নিয়ে এসে যায়। বাড়ীর সামনে মস্ত উঁচু গেট হয় সাদা আর লাল কাপড় দিয়ে।

    ছবিমাসি নাকি সাদা আর হলদে রঙের গেট বানাতে বলেছিল, তাই নিয়ে সবাই খুব হাসাহাসি করে। বিয়ের প্যান্ডেল আবার লাল কাপড় ছাড়া হয় নাকি!! সকালগুলো আসে সোনালী রঙের জুতো পরে আর ঝিলমিলে দিনগুলো দৌড়ে দৌড়ে চলে যায়। বিয়ের আগেরদিন ছোটমামাও আসে রাঁচি থেকে, হিন্দমোটরের পুরানো অফিসে গিয়ে নেমন্তন্ন করে আসে, পাড়ার বন্ধুদের বলে। দাদু বাড়ীর মধ্যেই ঘুরেফিরে সব তদারক করে বেড়ায়। আগেই দাদু আর দিদা গিয়ে বেশীরভাগ নেমন্তন্ন করে এসেছে, যে কটা বাকী ছিল বড়মামা দিদাকে নিয়ে গিয়ে করে আসে, দাদুকে বেরোতে দেওয়া হয় না। আমরা বাঁশ বেয়ে বেয়ে খেলে বেড়াই, বাড়ীতে এত লোক রাত্রে শোবার জায়গা কম পড়ে যায়। শীলুমাসি আমাদের ঘরে এসে শোয়। অনেক রাত্রি অবধি গল্প করে মা আর শীলুমাসি। খুব কালো বলে নাকি শীলুমাসিকে কেউ পছন্দ করছে না, অনেক বয়স হয়ে গেছে তাই। মা বলে ‘সে কপালে যখন আছে, তখনই হবে বিয়ে, আগে চেষ্টা করলেই কি আর হবে! বরং তুই পড়ানো টড়ানো কিছু একটা যোগাড় করে নে, ঐটা কক্ষণো ছাড়িস না’। সারাবাড়ী জুড়ে ছাদ থেকে লাল হলদে টুনিলাইটের চেন ঝুলিয়ে সাজানো হয়েছে, তারই আলোয় ঘরে কেমন আলো আলো ভাব, সারাদিনের হইচই আর হুড়োহুড়িতে  ক্লান্ত আমাকে শীলুমাসির সমস্যা বিন্দুমাত্রও স্পর্শ করে না, একটা ফুর্তি ফুর্তি মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

    বিয়ের দিন ভোর চারটেয় উঠে ‘নান্নিমুখ' করতে গিয়ে দাদু আবার মাথা ঘুরে পড়ে গেল। দাদুকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে মামাদাদু, মেসোদাদুরা বড়মামাকে দিয়ে নান্দীমুখ করিয়ে নিল আর তক্ষুণি ঠিক হয়ে গেল, দাদু নয় বরকর্তা হিসাবে বড়মামা যাবে বিকেলে, উপোস টুপোস যা করার সেও দাদু নয় বড়মামাই করবে। সবচেয়ে ছোটছেলের বিয়ে, যা নাকি দাদুর ‘শেষ দায়িত্ব' ছিল, নিঃশব্দে সে দায়িত্বের হাতবদল হয়ে যায়। দাদু চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে, কাউকে কিচ্ছু বলে না, ঘুমায়ও না। ডাকলে সাড়া দেয়, খাবার দিলে খেয়ে নেয়, আর চুপটি করে শুয়ে থাকে। বাড়ীময় হইহই চলতে থাকে, চলতেই থাকে , শুধু দাদুর ঘরে একটু কম। তাও ওটাই বাইরের বারান্দা থেকে ভেতরে যাবার মূল ঘর, বাগানের দিকে প্যান্ডেল করে আটকে রেখেছে, তাই কিছু হইচই এখানেও হচ্ছে বৈকী। ওদিকে উঠোনের একদম পিছনদিকে ছোট কুলগাছটা কেটে মস্ত গর্ত খুঁড়ে উনুন বানানো হয়েছে, হরিঠাকুর তার দুজন স্যাঙাত নিয়ে সেখানে রান্না শুরু করেছে। ঠিক বিয়েবাড়ী বিয়েবাড়ী রান্নার গন্ধ। আসল ভোজ তো পরশুদিন, কিন্তু আজ আর কাল অতলোকের রান্না করার জন্য ওদের আজ থেকেই আসতে বলা হয়েছে। এদিকে উঠোনে কুয়োত্লার সামনে ছোটমামাকে ঘিরে ‘গায়ে হলুদ'এর প্রচন্ড হুল্লোড়, হলুদ মাখানো। সব মামীরা, মামীদিদারা ওখানে।  

    মা আর রাঁচিদিদা আরো দুই একজন নিরামিষ রান্নাঘরের দায়িত্বে। বুড়ীর মা-মাসি আজ বুড়ীকে নিয়ে এসেছে। বুড়ীর মাথায় দুদিকে উজ্জ্বল কমলা ফিতে দিয়ে ফুল করা কলাবিনুনি, পরনে টিয়ারঙের জর্জেট শাড়ি আর কমলা ব্লাউজ, খুশীতে মুখটা চকচক করছে। এমনিতে বুড়ী ফ্রকই পড়ে কিন্তু আজ ওর মা ওকে জোর করে শাড়ি পরিয়েছে, এই কদিনই নাকি ওকে শাড়িই পরতে হবে। শাড়ি পরে যে বুড়ীটাকে কি সুন্দর লাগছে কি বলব। মস্তবড় গামলায় সারারাত ধরে রিঠা ভেজানো ছিল, আজ সকালে বুড়ীর মা-মাসি রিঠাগুলোকে কচলে কচলে জলের সাথে মিশিয়েছে, সাথে অ্যাত্তব্ড় একবাটি আমলকীবাটা। সেই গামলা থেকে প্রত্যেকের জন্য কয়েক মগ করে জল বালতিতে তুলে দেয় মাসি মাথা ঘষার জন্য। যার যত লম্বা চুল তাকে তত বেশী জল আর খানিকটা করে ঐ রিঠা আমলকীবাটার কাথ দেয়। তাই দিয়ে মাথা ঘষে চুল ফুলিয়ে বিকেলবেলা সেই সিল্কের জামাটা পরে গলায় একটা লকেটওলা মালা পরে, কানে, হাতে সব পরেটরে সেজেগুজে বাসে চড়ে বরযাত্রী যাই। এই লকেটটা বাবা পছন্দ করে হাতে এঁকে দিয়ে আমার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল। সবাই খুব ভাল বলে ওর ডিজাইন দেখে। দাদু তেমনিই শুয়ে থাকে, শুধু বর যাত্রা করার আগে সবাই ডাকলে, উঠে ছোটমামার মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে আবার শুয়ে পড়ে।

    আমরা রওনা দিই, দাদু শুয়ে থাকে, আর দিদা, রাঁচিদিদা থাকে, আর থেকে যায় মা।  মা’কে নাকি যেতে নেই। আমি আর একটা নতুন শব্দ শিখি ‘এয়োতি’। আস্তে আস্তে নতুন বৌ ছোটমামীমা পুরানো হতে থাকে, ছোটমামা একা একা রাঁচি চলে যায়। সেজমামারা, অন্য সব আত্মীয়রা ফেরত চলে যায় নিজের নিজের জায়গায়। প্যান্ডেল খুলে বাঁশের খাঁচা একমাস ধরে ফেলে রাখে ডেকোরেটার, তারপর সেটাও খুলে নিয়ে যায়্। আমাদের স্কুল খুলে যায়। স্কুলের মাঠ বাড়ী সব একইরকম আছে, কোনও নতুন বাড়ী তৈরী শুরু হয় নি। আমরা সেই মাটির মেঝে, ছিটেবেড়ার দেওয়াল আর টালির চালওয়ালা ঘরেই ক্লাস করি। রেখাদিদিমণি ক্লাসে এসে '১৭ পাতা থেকে ২১ পাতা পর্যন্ত মুখস্থ করে আসবে' বলে চটি খুলে পা তুলে চেয়ারে বাবু হয়ে বসে কাদের যেন খাতা দেখতে থাকেন। নয়ত বাইরে মাঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকেন। কোনও কোনওদিন ইচ্ছে হলে ঐদিনের পড়া দেওয়া পাতাগুলো রিডিং পড়েন। ওঁর গলার আওয়াজ আস্তে আস্তে নামতে নামতে শেষে আর কিছুই বোঝা যায় না, শুধু ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে একটা অস্পষ্ট বিজবিজ ধ্বনি শোনা যায়। সময় কাটাতে আমরা চন্ডীচরণ দাশের মস্ত ম্যাপবই খুলে ম্যাপ পয়েন্টিং খেলতে শুরু করি। 

    এই করে করে সেভেন এইট দুইবছরে ম্যাপ পয়েন্টিঙে আমরা সক্কলে দারুণ চৌকশ হয়ে উঠি, কিন্তু ভূগোল সকলের কাছেই একটা চরম বিভীষিকা হয়ে থেকে যায়। ইতিহাসও তথৈবচ, ইতিহাস বই দেখলেই সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। অথচ ইতিহাসটা সুধাদি মোটামুটি বলেই দিতেন ক্লাসে, সুধাদির গলার আওয়াজ বেশ মিষ্টি, টানা গড়গড় করে যখন রিডিং পড়ে দেন, দিব্বি ভাল লাগে শুনতে। কিন্তু বাড়ী এসে আর কিছুতেই পড়তে ইচ্ছে করে না। মা পড়ায় ইংরিজি আর সংস্কৃত। সংস্কৃত ভাষাটা কি সুন্দর! জোরে জোরে পড়লে টুংটাং করে কানে বাজে। খুশী হয়ে ছোটদির মাধ্যমিকের ঐচ্ছিক সংস্কৃতের বই থেকে অনেক শ্লোক মুখস্থ করে ফেলি আমি। আমাদের একজন নতুন দিদিমণি এসেছেন জীবন বিজ্ঞান পড়াতে, নাম শিখাদিদিমণি। দেখতে অনেকটা হাইস্কুলের মণীষাদিদিমণির মত, ঐরকমই রাগী, খুব বকাবকি করেন। আমরা তাই নিজেদের মধ্যে ওঁকে ছোটমণীষাদি বলে ডাকি। অঞ্জলীদি অঙ্ক আর ফিজিক্যাল সায়েন্স পড়ান, দিব্বি সুন্দর বুঝিয়ে দেন, ভাল লাগে পড়তে অঙ্ক করতে। কিন্তু অঙ্কে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। বছরের শুরুর দিকে অনেকদিন ছুটিতে ছিলেন অঞ্জলীদি, এখন তাড়াতাড়ি করে সিলেবাস শেষ করার চেষ্টা করেন।

    এদিকে বাড়ীতেও দাদু আর অঙ্ক দেখিয়ে দিতে পারে না, বীজগণিতের বইয়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ‘আমি জানি না রে এই অঙ্কগুলা, মনে পড়তাসে না।' তারপর কেমন ফ্যালফ্যালে চোখে আস্তে করে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে। পাটীগণিত দাদু শিখিয়ে দিয়েছিল, বীজগণিত আর জ্যামিতি আমার আর সারা জীবনেও ঠিক করে শিখে ওঠা হয় না। ফলতঃ অঙ্কশাস্ত্রের সাথেই আর ভাব ভালবাসা হয়ে ওঠে না। ছোটমামার বিয়ের সময় এসে সেজমামা বার বার করে মা'কে বলে গেছে পুজোর ছুটি পড়লে আমাদের নিয়ে ফরিদাবাদ যেতে, সেখান থেকে দিল্লী আগ্রা, হরিদ্বার, দেরাদুন মুসৌরি এইসব বেড়ানো হবে। ছোটমামীমা ওর বাবা মায়ের কাছে দিল্লীতে চলে যাবে মহালয়ার দিনেই, ছোটমামা রাঁচি থেকে ছুটি নিয়ে আসবে, আমরাও গেলে সবাই মিলে বেড়ানো হবে। বর্ষাকালের মাঝামাঝি থেকে সেজমামা বারবার টিকিট কাটার তাগাদা দিয়ে চিঠি লেখে। মা একটা পত্রলিপি খাতায় বারবার কিসব হিসেব করে। তারপর একদিন  খুব সক্কালে ঘুম থেকে উঠে মা আমাকে নিয়ে ট্রেনে করে হাওড়া গিয়ে লঞ্চে করে গঙ্গা পেরিয়ে ফেয়ারলি প্লেস ঘাটে নেমে খানিক হেঁটে  চলে যায় কয়লাঘাটা রেলওয়ে রিজার্ভেশান সেন্টার।

    লক্ষ্মীপুজোর পরের দিনের জন্য ডিলাক্স এক্সপ্রেসে টিকিট কাটা হয়, আমার আর মায়ের ফুল, ভায়ের হাফ টিকিট। ছোটমামীমা নাকি এইসব জায়গায় অনেকবার গেছে, কলকাতা থেকে যত আত্মীয়স্বজন ওদের দিল্লীর বাড়ীতে যেত সব্বাই নাকি এই জায়গাগুলোতেই যেত। ছোটমামীমা আমাকে মানালির গল্প বলে, কাশ্মীরের গল্প বলে, পহেলগাঁওয়ের গল্প বলে। সেসব নাকি আরো অনেক সুন্দর জায়গা। মা’কে বলতে মা'ও বলে হ্যাঁ মানালি খুব সুন্দর, রোটাংপাসও নাকি অসম্ভব সুন্দর, বাবা আর মা গেছিল সেখানে। আমি বলি তাহলে তো আমরা সেখানে গেলেই পারি, মা প্রথমে কিচ্ছু বলে না, অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। আরেকটু জোর দিয়ে বলি ‘তাহলে মানালিই চল না মা, আমরা তো দেখি নি ঐ জায়গাটা।‘ মা খুব আস্তে আস্তে বলে ‘তোরা বড় হয়ে চাকরি করে নিজেরা যাস। এই যে যাচ্ছি, কতগুলো খরচ হয়ে যাবে। তোর বাবার অফিস থেকে পাওয়া টাকা জমানো ছিল তাই ভেঙে যাচ্ছি,  কদিন পরে যদি চাকরিটা না থাকে তাহলে তোদের পড়াশোনা কী করে হবে বলত? সেজদা বলেছিল সমস্ত টাকাটা দেবে। কিন্তু তাই কি হয় নাকি? আমার কি সাহস! মা সমানে বকতাসে, দাদাও বারণ করসে,  অসন্তুষ্ট ... তোদের বাবা আজ থাকলে তো তোদের প্রত্যেক ছুটিতে বেড়াতে নিয়ে যাইত। কত্ত প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল তার’।

    মা এমনিতে দাদু, দিদা বড়মামা, মেজমামা, সেজমামার সাথে বাঙালভাষায় আর ছোটমামা আর আমাদের সাথে চলতি বাংলায় কথা বলে। কিন্তু এইসময় মা’র ভাষা মিলেমিশে যাচ্ছিল। বাবা ... বাবা ... কত কত্তদিন বাদে বাবার কথা কেউ বলল। কেউ না কেউ না মা বলল। বাবা নাকি খুব আয়েশ করে বেড়াতে ভালবাসত, কোথাও গেলে অন্তত দুইরাত থাকবেই। দৌড়ঝাঁপ করে সবকিছু একসাথে দেখে  নেওয়া একেবারেই পছন্দ করত না। অনেকদিন বাদে আবার সেই ধুসর খোলসটা এসে আমাকে ঢেকে ফেলতে থাকে। শরতের আকাশ মুছে ঘোলাটে মেঘ ছেয়ে যায় চারিদিকে। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ মুছে যেতে থাকে আস্তে ধীরে। পুজো কেটে গিয়ে লক্ষ্মীপুজো এসে যায়। সেই বাবা ট্যুরে নিয়ে যেত কিম্বা আমরা কটক থেকে কলকাতা আসবার সময় যে স্যুটকেস নিয়ে আসতাম সেরকম একটা মাঝারি বড় স্যুটকেসে আমাদের জামাকাপড় আরো কিসব যেন ভরা হয়। ট্রাঙ্কের ওপর থেকে লেপ কম্বলের গাদা সরিয়ে হোল্ডল বের করা হয়, ট্রেনে বিছানা লাগবে সেসব নেবার জন্য। হোল্ডলে চাদর বালিশ ভরার পর বাঁধতে যেতেই চামড়ার স্ট্র্যাপ ফটাশ করে ছিঁড়ে যায়। মা আবার বেরিয়ে গিয়ে চলচ্চিত্রমের কাছের ব্যাগের দোকান থেকে সারিয়ে আনে।

    লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদে খিচুড়ি পায়েস কম করে বানিয়ে লুচি আর আলুফুলকপিভাজা বেশী করে বানায় মা, ট্রেনে খাবার জন্য ঐই সঙ্গে নেওয়া হবে। আমার আর ভাইয়ের সবকটা ভাল জামা ভরে নেওয়া হয়, আর পুজো হয়ে যাওয়ার পর প্রসাদ খাওয়ার সময় থেকে ভাই বমি করতে শুরু করে। আগে যতদিন ছোটমামা এখানে ছিল ছোটমামার পাড়ার সমস্ত বন্ধুরা দিদাদের বাড়ী ভোগ খেতে আসত। দোতলায়্ ভেতরের  বারান্দায় ঠাকুরঘরের সামনে সবাই লাইন করে বসত, দিদা আর বড়মামীমা পরিবেশন করত খিচুড়ি, আলুভাজা, ফুলকপির তরকারি, টমেটো খেজুরের চাটনি, কিশমিশ দেওয়া গোবিন্দভোগ চালের ঘন পায়েস আর বাড়ীর দুধের সরতোলা ঘিয়েভাজা ধবধবে সাদা  লুচি। অরুণদা, বিশেদা, শঙ্করদারা হইহই করে খেতো। ছোটমামার বন্ধু বলে আমাকে দিদা বলত ওদের মামা বলে ডাকতে, কিন্তু অরুণমামা বললেই কেমন হাসি পেয়ে যায়। তাছাড়া শুভ্রা, শঙ্করী, মালুদের দাদাদের তো দাদাই বলব, দিদাটা এমন বোকা। কিন্তু গতবছর ছোটমামা চাকরি নিয়ে রাঁচি চলে যাওয়ার পর থেকেই লক্ষ্মীপুজোয় আর কেউ প্রসাদ খেতে আসে না। বড়মামীমা মা'কে দিয়ে যায়, মা'ও গিয়ে ওদের ঘরে দিয়ে আসে। আর বুড়ীর মা-মাসির জন্য রেখে দেওয়া হয় দুইঘরেই, একটা খায় আর আরেকটা ধরে  বাড়ী নিয়ে যায় মাসি, সঙ্গে বেঁচে যাওয়া ফলগুলোও দিয়ে দেওয়া হয়।

    আমরা কেউই প্রায় ফল খেতে চাই না তো, কদমা আর রঙীন মঠগুলোও দিয়ে দেয় দিদা। বেঁচে যাওয়া মিষ্টিগুলো দেওয়া হয় না কিন্তু। ওগুলো রেখে রেখে অনেকদিন ধরে খাওয়া হবে। আমাদের ঘরের পুজোয় অত মঠ, কদমা থাকে না, দুই টাকার গুজিয়া আর পাঁচ টাকার সন্দেশ, খিচুড়ি, আলুভাজা ফুলকপিভাজা কিম্বা শুকনো শুকনো তরকারি, টমেটোর চাটনি, পায়েস আর লুচি। আর থাকে বাতাসা দিয়ে চালকলামাখা, নারকেলের জল আর চিড়া। এই চালকলামাখা খেয়েই ভাইয়ের বমি শুরু হয়। সারারাতে প্রায় সাতবার বমি করে, ভোর সাড়ে পাঁচটায় আলো ফুটতেই মা ওকে কোলে নিয়ে ড পি কে রায়ের বাড়ী চলে যায়, সেই আমাদের স্কুলের কাছে বাড়ী ওঁর। উনি দেখেশুনে ওষুধ দেন আর বলেন দুই ঘন্টায় যদি আরো বমি করে তাহলে হাসপাতালে নিয়ে দেখানই ভাল। ডিলাক্স এক্সপ্রেস ধরার জন্য আমাদের ন'টার সময় বেরোবার কথা বাড়ী থেকে। স্নান করে তৈরী হব কিনা বুঝতে পারি না, মা কিন্তু তাড়া লাগায়, পাঁউরুটি টোস্ট খেয়ে চানে যেতে বলে। দিদা এসে বারবার করে না করে বেরোতে, মা শুধু বলে দেখাই যাক না, রাত দেড়টার পর থেকে তো আর বমি হয় নি। দিদা, বড়মামা, বড়মামীমা সবাই একটু একটু রাগ করে, দাদুও একবার বলে ভেবে দেখতে, মা বলে হ্যাঁ ভাবতাসি তো, কিন্তু তৈরী হওন লাগে অক্ষণই, না যাইলে কাপড় জামা বদলাইতে আর কতক্ষণ!চান করতে গিয়ে আমি শুনতে পাই বড়মামীমা বলছে ‘কি জেদ বাবা! মনে করেছে যখন আর কারো কথা শুনবে না, আরে ছেলেটা অত অসুস্থ, ট্রেনের মধ্যে যদি বাড়াবাড়ি হয়!'

    নিউদিল্লী স্টেশানে সেজমামা আর ছোটমামা আমাদের নিতে এসেছিল। সেখান থেকে আবার লোকাল ট্রেনে চেপে আমরা ফরিদাবাদ গেলাম, কেমন ছোট ছোট একতলা বা দোতলা বাড়ী, রাস্তার একধার থেকে একটা বাড়ী শুরু হলে টানা চলতে থাকে, আটটা বা দশটা বাড়ী পরে গিয়ে শেষ হয় আরেকটা রাস্তার মোড়ে। বাড়ীগুলোর মাঝে কোনও ফাঁকফোকর নেই, বাগান বা খোলা জায়গা বাড়ীর সামনে কিম্বা পিছনে, পাশের দিকে বাড়ীগুলোর দেওয়াল কমন। একে নাকি রো-হাউস বলে, এইসবদিকে খুব নাকি দেখা যায়, জায়গা বাঁচে। কিন্তু আলো হাওয়া? সে নাকি প্রচন্ড গরম আর প্রচন্ড শীতের সময় বাইরে থেকে বেশী না আসাই ভাল। বেশ সমান মাঝারি চওড়া রাস্তা আর কেমন একটু অন্যরকম দেখতে রিক্সা চলে। ছিমছাম পরিস্কার ছোটমত শহরটাকে বেশ ভালই লাগল আমাদের, শুধু একটাই সমস্যা, আমাদের কথাও কেউ তেমন বোঝে না, আমরাও অন্যদের বুঝি না। সেজমামা বা সেজমামীমা কেউ সঙ্গে না থাকলে খুব  মুশকিল। কীভাবে কীভাবে যেন বাটাচক নামে একটা জায়গায় আমরা পৌঁছোলাম, সেখান  থেকে রিক্সা নিয়ে সেজমামার বাড়ী, সেখানে ছোটমামীমা আগে থেকেই এসে ছিল। ভাই এখন দিব্বি চাঙ্গা, ট্রেনেই চুপচাপ বসে থেকে আর ইলেকট্রলের জল খেয়ে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সুস্থ হয়ে গেছে।

    ছোটমাইমা এখানে আর ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘুরছে না, সেজমামা বলে ‘আমি বারণ করসি’, মা বলে ‘ভাল করসস’। তারপর দিদার নিয়মকানুনের কড়াকড়ি নিয়ে পাঁচজনে মিলে খানিক নিন্দে করে, আমরা ততক্ষণে সামনের সিমেন্ট বাঁধানো উঠোনে একটু খেলা করি। প্ল্যান ঠিক হয় ছোটমামা, ছোটমাইমা আর আমরা তিনজন পরশু সকালে বেরিয়ে দিল্লীর আই এস বি টি গিয়ে হরিদ্বারের বাস ধরব, সেজমামা ছুটি পায় নি, যেতে পারবে না। এমনি হইহই করে একে একে দেখা হয়ে যায় হরিদ্বার, হৃষিকেশ, লছমনঝুলা, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, জয়পুর। কিন্তু জয়পুরে হাওয়ামহল দেখা হয় না, সেদিন বন্ধ ছিল। দেখা হয় না দিল্লী এযাত্রায়, হয় না দেরাদুন মুসৌরীও। আর এই বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে পড়া হয়ে যায় সেজমামার আলমারি থেকে পুরো বিভুতি রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাবলী। মা একবার বাধা দিতে গেছিল সব খন্ড না পড়তে, বড়দের বলে। সেজমামা হেসেই উড়িয়ে দেয়, বলে বই হল বই, তার আবার ছোটদের বড়দের কী? এরপরে তো বলবি বড়দের রোদ্দুর, বড়দের আলো। মা আর কিছু না বলে চুপ করে যায়। পথের পাঁচালি, অপরাজিত আগেই পড়া, দাদুর আলমারীতে ছিল। নতুন করে পড়া হয় কেদার রাজা, ইছামতী, অনুবর্তন, দেবযান, চাঁদের পাহাড়, মিসমিদের কবচ, হীরামাণিক জ্বলে, তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প, দুইখন্ড ভর্তি অজস্র ছোটগল্প।

    পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়। ভাল হয়। আবার খারাপ হয়। আবার ভাল হয়। একসময় মনে হয় মরে না গিয়ে আফ্রিকা পালিয়ে গেলো হয় তো, শঙ্করের মত। কিম্বা লছমনঝুলার ব্রীজের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা আরো ওপরের দিকে চলে গেছে সেটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেও হয় তো। এই ফরিদাবাদে থেকে যেতে পারলেও হোত, এখানে মা'ও বেশ ভাল মেজাজে থাকে, সবসময় বকেঝকে না। দুপুরে দাঁড়িয়ে দেখি সেজমামাদের পাশের বাড়ির পাঞ্জাবী দাদিমা আর তাঁর বহুরাণীরা মিলে ধাঁই ধপাধপ করে পিটিয়ে পিটিয়ে আস্ত আস্ত লেপ তোষক বানিয়ে ফেলেন। সেজমাইমা বলে এরা সাংঘাতিক পরিশ্রমী, এক মিনিটও বসে থাকে না। সেজমামা বলে এখানে লালার দোকান দেখেছিস কিরকম পরিস্কার ঝকঝকে, আর কোন্নগরে পচাকলুর দোকান! বাপরে কয়েকশো বছরের নোংরা জমে আছে মনে হয়। কালীপুজো এসে যায়, ওরা বলে দিওয়ালি। কালী নয় আসলে লক্ষ্মীর পুজো। কালীপুজোর পরের দিন আবার আমরা নিউ দিল্লী স্টেশানে গিয়ে কালকা মেলে চড়ে বসি। ফিরে এসে শুনি এরমধ্যে দাদু আরো একবার পড়ে গেছিল বাথরুমে। দাদু আমাদের দেখে বলে ‘যাক যাওনের আগে তগো লগে দেখাটা হইয়া গেল’। অনেকদিন বাদে মা আবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৪ মার্চ ২০২৪ | ৮৪৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীমু | 182.69.***.*** | ১৪ মার্চ ২০২৪ ২২:৩১529373
  • "পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়। ভাল হয়। আবার খারাপ হয়। আবার ভাল হয়।" - এই সিরিজটার মতই yes  
  • kk | 2607:fb90:eab2:c595:2120:3520:467d:***:*** | ১৫ মার্চ ২০২৪ ০০:৩৫529376
  • এই সিরিজ পড়ে কী যে বলবো সবসময় কথা খুঁজে পাইনা। সবার থেকে আলাদা হয়ে নিজেকে অদৃশ্য কেসে ঢুকিয়ে নেওয়া হাত দিয়ে ছুঁতে পারি মনে হয়। "রং ফুরিয়ে যাওয়া রঙপেন্সিলে আঁকা " লাইনটা পড়ে মনটা কী রকম একরকম হয়ে যায়। তারপরে .... আমারও বাবার কথা মনে পড়লো আজ খুব।
  • Aditi Dasgupta | ২৪ মার্চ ২০২৪ ২০:২৭529762
  • মা আর তার দুই ডানা ,চার পাশে অনেক গাছ,কিন্তু মাথার উপর রোদ ঢাকতে পারেনা কেউই পুরোপুরি, তারা জানে, তাই রোদ মাথায় নিয়েই পাড়ি দেয়, একঘেয়ে নিরাপদ নিরাপত্তাহীনতার সংসার থেকে একটু ছুটি নিয়ে অচেনার আনন্দ নিতে।
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ২৫ মার্চ ২০২৪ ২৩:৩৩529801
  • ভীষণ ভাল হচ্ছে এই সিরিজ টা। ভীষণ ভাল। অসামান্য ডিতেইলিং। 
  • | ২৬ মার্চ ২০২৪ ২০:৪৩529838
  • দীমু কেকে অদিতি স্বাতী, ধন্যবাদ সঙ্গে চলার জন্য। 
  • Nupur Raychaudhuri | ০৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২৩530379
  • এত মায়াবী লেখা, ব্যথাতুর হয়ে ওঠে মন 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন