এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ছেঁড়াকাঁথা

  •  ছেঁয়াবাজীর ছলনা - ৫

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ছেঁড়াকাঁথা | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৩৩৮২ বার পঠিত
  • ইন্দ্র রায় রোডের বাড়িটার চারদিকে সিনেমা হল। যে দিক দিয়েই বেরোন যাক না কেন ট্রামলাইনের রাস্তায় উঠলেই একটা  সিনেমা হল পড়বেই পড়বে। বাঁ দিকে শোভাদিদিদের বাড়ি,  সর্দারজিদের বাড়ি পেরিয়ে বেরোলেই উল্টোদিকে ভারতী সিনেমা। ডানদিকে ইন্দ্র রায় রোড দিয়ে থানার দিকে এগোলে রাস্তার এপাশে বাঁ ধারে ইন্দিরা সিনেমা ডানধারে দাঁ পেপার হাউস  আর বড়রাস্তার ওইপাশে বিজলী সিনেমা। ইন্দ্র রায় রোড ধরে বাঁ দিকে এগিয়ে  রমেশ মিত্র রোডের ক্রসিঙে বাঁ দিকে তরুণ সমিতির পুজোর মাঠ, বাইরে মস্ত আবর্জনা ফেলার জায়গা। কি গন্ধ বাপরে! মোড় ঘুরে ডানদিকে স্টেট ব্যাঙ্ক, সকালে ন’টার স্কুলবাস মিস করলে ব্যাঙ্কের সামনে এসে দাঁড়াতে হয়। গোপালদার বাস সাড়ে দশটার পর এখান দিয়ে যাবার সময় তুলে নেয়। বাসে তুলে বকাবকি করে ন’টার সময়  কেন ভারতীর উল্টোদিকে ছিলাম না। মোড় না ঘুরে সোজা গেলে চক্রবেড়িয়া, ওখানে ঈপ্সিতার বাড়ি, জিজি বলে ইস্পিতা। মোড় থেকে বাঁদিক  দিয়ে ট্রামলাইনের দিকে গেলে রাস্তার ওপারে পূর্ণ সিনেমা। ইন্দিরা বিজলী, ভারতীতে  ‘রাণুর প্রথম ভাগ’, ‘বসন্তবিলাপ’, ‘বন পলাশীর পদাবলি’  এইসব বাংলা সিনেমা, বাংলায় পোস্টার আঁকা থাকে। পূর্ণতে বেশিরভাগ ইংরিজি। 
     
    এক  শনিবার বিকেলে মা ভাল ফ্রক পরিয়ে চুল আঁচড়ে কালো ক্লিপ দিয়ে মুখে পাউডার দিয়ে সাজিয়ে দিল, বাবা বেড়াতে নিয়ে যাবে। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে  বাবা আমাকে নিয়ে ট্রামলাইন পেরিয়ে বনফুলের সামনে দিয়ে হেঁটে ঢুকল গিয়ে পূর্ণ সিনেমায়। কি কান্ড! সিনেমায় তো বড়রা যায় মা বলেছে! কিরকম লোহার খাঁচামত জানলা। গোলাপী সবুজ সাদা সব টিকিট দিচ্ছে। টিকিটগুলো ভাল না কেমন পাতলা পিতপিতে কাগজ।  কোন্নগর যাবার ট্রেনের টিকিট কি সুন্দর শক্ত মোটা গাঢ় হলুদ কার্ডের মত, তাতে কালো রঙে ছাপা থাকে।  আমরা সিঁড়ি দিয়ে  দোতলায় উঠে একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকলাম। বাবাগো কি অন্ধকার! একটা লোক কিরকম সরু আলো নিয়ে এগিয়ে এলো। এগোতে গিয়ে কিসে যেন হোঁচট খেয়ে প্রায় উলটে পড়তে গিয়ে ককিয়ে উঠি। বাবা আআহ ভজু! দেখে চলো, বলে  কোলে নেয়। কিরকম সব সিঁড়িমত জায়গা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে নামিয়ে একটা সিটে চাপড় দিয়ে বলে বোসো। ওমা বসতে গিয়ে দেখি সিটটা খাড়া হয়ে বন্ধ হয়ে  গেছে! যাহ বসব কোথায়? কী করে? এটা কি ভুতের গুহা? এরকম অন্ধকার তারপর সিটটা নিজে নিজে খাড়া হয়ে যাচ্ছে! বাবা বসে হাত দিয়ে সিট নামিয়ে ধরে রাখে, আমি ভয়ে ভয়ে উঠে বসি। সিটটা আমাকে নিয়েই খাড়া হয়ে যেতে চায়, বাবা বলে  ভেতরে ঢুকে চেপে বোস। 
    আমরা বসেছি কিরকম একটা বারান্দার মত জায়গায়, সামনে বেঁটে রেলিং। ইচ্ছে করে রেলিঙের ধারে গিয়ে নীচে কী আছে দেখি। কিন্তু দাঁড়ালেই সিটটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! কি মুশকিল! সামনে একটা মস্ত স্টেজের মত, ডিপ মেরুণ রঙের পর্দা টাঙানো। ঠিক ইস্কুলের সরলা মেমোরিয়াল হলে যেমন আছে অমনি। দেখতে দেখতেই সেই পর্দাটা সরে দারুণ সব ব্যপার শুরু হয়ে গেল। প্রথমে সাদাকালো কি সব যেন হল, তারপরই রঙচঙে আসল সিনেমা, নাম  ‘হাটারি’।  গন্ডার হাতি আরো কতসব জন্তু জানোয়ার, একটা পাহাড়, বাবা ফিসফিস করে বলল ওটা আসলে আগ্নেয়গিরি ছিল। একটা জিপ নিয়ে সে কি দৌড়ঝাঁপ করে সাংঘাতিক কান্ড সব!  ইশ মা দেখতে পেল না, জিজি দেখতে পেল না। বাড়ি আসার পরে মা অবশ্য বলল ‘দুরো ওইসব ইংলিশ বই ভাললাগে না’; বাইরের ঘরের আলমারি থেকে একটু লম্বা পাতলা হার্ডবাউন্ড একটা ইংরিজি বই বের করে বাবা ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়েছিল আগ্নেয়গিরি কেমনি করে  জেগে উঠে আগুন লাভা  বমি করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। বলেছিল আর একটু বড় হলে আমি নিজেই পড়ে বুঝতে পারব। বড় হয়ে সেই বইটা আমি আর বাবার আলমারিতে পাই নি। মা’ও কিছু বলতে পারে নি। লাইফ ম্যাগাজিনের নেচার লাইব্রেরি সিরিজের  পাঁচখানা বই এখনো আছে। বাবা তো আর সবকটা কিনে ফেলার সময় পায় নি, কিন্তু মায়ের আবছা মনে হয় ছয় কিম্বা সাতখানা কিনেছিল। 
     
    আরো  কয়েকমাস বাদে বাবা আবার পূর্ণতে নিয়ে গেল। এইবার একটা সাদাকালো ইংরিজি  সিনেমা ‘মাইটি জো ইয়াং’। জো, একটা কুট্টিমত গরিলাছানা আর একটা ভীষণ সুন্দর দেখতে মেয়ে একসাথে বড় হয়ে  সাংঘাতিক সব কান্ড করে।  এই দুটো সিনেমা পরপর দেখেই আমার আফ্রিকায় যাবার  দারুণ ইচ্ছে হয়, মাথায় নানারকম প্ল্যান গজাতে থাকে। কোন্নগরে দাদুর বাড়ির বাছুর পোষার ইচ্ছেটা চলে গিয়ে গরিলা পোষাই ঠিক করলাম। অবশ্য হাতিছানাও মন্দ নয়। মুশকিল হল রাখবো কোথায়?  বাবা গিয়ে বললে তরুন সমিতির মাঠটায় রাখতে দেবে  না? রোজই ভাবি আজ ঠিক মা’কে বলব, কিন্তু বাছুরকে ট্রেনের পেছনে বেঁধে আনার কথা বলায় সবাই এমন হাসাহাসি করেছিল যে গরিলার কথা বলার ইচ্ছেই হচ্ছে না। বড়রা যা হাঁদা! হয়ত  টাঙ্গানাইকার নামই শোনে নি। ওইজন্যই তো বাবা ওদের নিয়ে যায় না সিনেমা দেখাতে।  বাবা বলেছে  টাঙ্গানাইকায় খুব জঙ্গল। তাতে সিংহ, হাতি  গরিলা ভর্তি আর অনেক নদী হ্রদ পাহাড় এইসবও আছে।  ভবানীপুরের বাড়িতে দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আসতে গেলে  দোতলার দিকে ঘোরার সময়  মাঝখানে যে সমান জায়গাটা আছে সেইটে হয়ে যায় আমার পুকুর। ওইখানে আমি বোবোকে চান করাই, বোবো আমার পোষা গরিলা। টিনোপলের কৌটোকে মগ বানিয়ে পুকুর থেকে জল তুলে তুলে ওর গায়ে ঢেলে ঘষে ঘষে জঙ্গলের মাটি ঘাস পাতা সব পরিস্কার করে দিই। ঘাঁতুন এই পুকুরে এলে খুব খুব জল ছেটায় শুঁড় দিয়ে। ঘাঁতুন জঙ্গলে থাকে কিন্তু আমার কাছে বেড়াতে আসে আর টারজানের গল্প বলে। 
     
    টারজানের সিনেমাও বাবা পূর্ণতে দেখিয়েছিল। ‘টারজান দ্য এপ ম্যান’। ততদিনে আমি ব্যালকনি সিট, ড্রেস সার্কল এসব বুঝতে পারি। অন্ধকার হলে ঢুকে একটু দাঁড়িয়ে চোখ সইয়ে নিয়ে  লম্বা লম্বা সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আলোকাকুর পেছন পেছন গিয়ে সিটে বসতে পারি। বাবা আমাকেই একলা একলা সিনেমায় নিয়ে যায়, তাই গরমের ছুটিতে আমাকে না নিয়ে  বাবা মা’য়ের সিমলা কুলু মানালি বেরিয়ে আসার দুঃখও অনেকটা ভুলে গেছি।  সেই  মে মাসে যেই না গরমের ছুটি পড়ল, অমনি একদিন ছোটমামা আমাদের ভবানীপুরের বাড়িতে এসে বলল কিরে যাবি নাকি আমার সাথে? আর আমি তো কেউ একবার বললেই তার সাথে বেড়াতে চলে যেতাম। মা দেখি হোমটাস্কের খাতা গুছিয়ে দিচ্ছে,  এমনি বাড়িতে কোনও খাতা বই দিত না ইস্কুল থেকে কিন্তু গরমের ছুটির জন্য ইংরিজি বাংলা হাতের লেখার খাতা, নামতা লেখা আর  একশোটা যোগ বিয়োগের অঙ্কখাতা দিয়েছে। মা ওইগুলো দিচ্ছে দেখে আমি ভারী খুশী হয়ে ভাবলাম বাহ তাহলে অনেকদিন মামাবাড়ি থাকতে পারবো নিশ্চই। মা’ও বলল যা গরমের ছুটিটা কোন্নগরে থেকে আয়। কারো কথার অবাধ্য হবে না, আমরা পরে গিয়ে ইস্কুল খোলার আগে  নিয়ে আসবো । 
     
    তারপর তো গিয়ে প্রথম কিছুদিন দিব্বি রইলাম, হোমওয়ার্কের খাতা মাঝে মাঝে খুলি আর বেশিরভাগ সময় হয় উঠোনে লালীর বাছুরের সাথে খেলি নয়ত বাঁধানো শিশুসাথী,  দেব সাহিত্য কুটীরের নবপত্রিকা, জয়যাত্রা এইসব বই পড়ি। মামাবাড়ির দোতলার ভেতরের বারান্দায় ঠাকুরঘরের সামনে থেকে দেখা যায় বাড়ির পাশের মাঠটা শেষ হয়ে একটা মস্ত পুকুর। ওইপাশে অল্প কিছু কচুরিপানা, এইপাশের ঘাটে  লোকে স্নান করে, মেয়েরা কাপড় কাচে। কত জল আহা ওখানে  গেলে মনের আনন্দে জল খলবল করে খেলা যাবে। দাদুকে চুপিচুপি বলি ওখানে যদি যেতে দেয়, খেলার কথা বলি না একদম। কিন্তু তাও দেয় না, বরং মাঠের দিকের মস্ত কাঠের কালো  পাল্লাওলা খিড়কির দরজায় খিলের সাথে সাথে ওই উঁচুতে ছিটকিনিটাও আটকে দেয়। খিলটায় আমার হাত যায়, ছিটকিনিটায় যায় না। কতদিন কেটে গেল।  একদিন দাদুর কাছে পোস্টকার্ডে মা’য়ের চিঠি এলো, কিন্তু হলুদ পোস্টকার্ড নয়, কি সুন্দর উজ্জ্বল নীল আকাশের নীচে সাদা বরফচুড়োওলা পাহাড়, সবুজ গাছের ফোটো একদিকে। আরেকদিকে সাদা পাতায় ডানদিকে ঠিকানা আর বাঁ দিকে এইটুকুনি জায়গায় মা’র লেখা। শিমলা কুলু মানালি এইসব জায়গায় গেছে, সেখান থেকে লিখেছে, আমাকে ভাল হয়ে থাকতে বলেছে, শীগগিরই নিতে আসবে।  ভারী অবাক হয়ে যাই,  বাবা মা এইসব জায়গায় বেড়াতে গেছে আমাকে না নিয়ে!  কিরকম যেন খারাপ লাগে। আমি তো বড় হয়ে গেছি অক্টোবর মাসেই ছয় বছর পূর্ণ হয়ে যাবে আর বড়রা তো কাঁদে না, তাই কান্না কান্না ভাবটা গিলে ফেলি। 
     
    এদিকে হোমওয়ার্ক  বিশেষ কিছু হয় নি।  ইস্কুল খোলার দিন এগিয়ে আসছে। আমার হাতের লেখা খুব খারাপ, তাইজন্য আমাকে মিস গাঙ্গুলি দশপাতার ওপরে অতিরিক্ত  আরো পাঁচপাতা কার্সিভ রাইটিং দিয়েছেন। কোনওমতে হাতের লেখা শেষ হয়, কিন্তু অঙ্ক আর হয় না, ইচ্ছেই করে না নিয়ে বসতে।  ছোটমামার ঘরে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে বসে আমি মনে মনে গল্প করি। ইস্কুল যেদিন খুলবে তার আগের রবিবার বাবা আর মা এলো কোন্নগরে আমাকে নিয়ে যেতে। আমাকে নিয়ে যাও নি কেন? নাকি বাবার খুব টেনশান হচ্ছিল অফিসে কারা সব খুব পিছনে লাগছিল তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। নতুন চাকরি জয়েন করবার আগে টেনশান কমাতে  ডাক্তারকাকা বলেছিল কোনও ঠান্ডা খোলামেলা জায়গায় কিছুদিন থেকে আসতে। আর ওখানে তো অনেক পাহাড়, মা’র নাকি শরীর খারাপ আমাকে কোলে নিয়ে উঠতে পারবে না তাই আমাকে নিয়ে যায় নি। কিন্তু  আমি তো নিজে নিজেই হাঁটতে পারি। আর মা তো দিব্বি ঘুরে এলো, শরীর খারাপ হলে কি কেউ বেড়াত যেতে পারে? মা রেগে ধমক দেয় বড় হয়ে নিজের ক্ষমতায় যেও। বড়মাইমা মিটিমিটি হেসে বলে হ্যাঁ রে আর কিছুদিন বাদে দেখবি মা’র শরীর কত খারাপ আর তারপরেই একটা দারুণ মজা হবে। কী মজা, জিগ্যেস করলে  ওই বড়রা যেমন করে, পরিস্কার কিছু না বলে হেসে হেসে বলতে লাগল দেখতেই পাবি কেমন মজা, তোর সাথে খেলার একটা সঙ্গী আসবে দেখিস। কি সব যে বলে এরা! মাথামুন্ডু নেই কোন।   
     
    ইস্কুল খুললে আমি অঙ্কের খাতা জমা দিই, পঁয়ত্রিশটা অঙ্ক হয়েছে মাত্র। মিস দত্ত জিগ্যেস করেন বাকীগুলো করি নি কেন? আমি কি করব হল না তো। যখন হচ্ছিল না তখন বাড়িতে জিগ্যেস করি নি কেন?   বা রে মা আর বাবা যে শিমলা বেড়াতে গিয়েছিল আমাকে রেখে, কী করে জিগ্যেস করব! মিস দত্ত একটু গম্ভীর হয়ে যান।  ডায়রিতে  কী যেন লিখে দেন। পরেরদিন মা আসে আমাকে ইস্কুল থেকে নিয়ে যেতে, কি মজা সেদিন আর সারা কলকাতা ঘুরে সবার শেষে গিয়ে বাস থেকে নামতে হবে না। মা’র সাথে হয় রিকশা করে নয় বড়রাস্তায় গিয়ে ট্রামে চড়ে বাড়ি ফিরে যাব ঝটপট। মিস দত্ত আর মিস গাঙ্গুলি মা’কে নিয়ে মিসদের ঘরে ঢুকে যান, আমাকে বলেন বাইরে খেলা করতে।  সুমিতা আর সুলগ্না জিগ্যেস করে তুই বাসে উঠবি না? ঈপ্সিতা বলে ওর তো মা এসেছে নিতে। আমরা সবাই বাসে ফিরি,  শুধু মৌসুমীর মা আসেন নিতে। একদিন মৌসুমীর বাবা এসেছিলেন, ওরা চলে যাবার পর ওর মা এসে শুনে গাড়িবারান্দার সিঁড়িতে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। তারপর তো আমরা চলে গেলাম বাসে, ইস্কুল থেকে নাকি পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। মৌসুমী আরো তিনদিন বাদে ইস্কুলে এলো। আমাদের মিস গাঙ্গুলি বলে দিয়েছিলেন ওর মা আর বাবা আলাদা জায়গায়  থাকেন আর ওকে বাবার কাছে যেতে দিতে কোর্ট থেকে না করেছে। আমরা যেন ওকে কিছু না বলি। জিজি পরে  শুনে বলেছিল ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। মানে বলে নি যথারীতি। নাকি আর একটু বড় হলে নিজেই জেনে যাবো।  মনে মনে টুকে রাখি ডিভোর্স টেনশান স্নব স্মার্ট এইসব মানেগুলো জানতে হবে।    
     
    টকটকে লাল মুখ করে মা বেরিয়ে আসে  মিসদের ঘর থেকে। আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে হাঁটতে থাকে। আমার কথার উত্তর দেয় না, দাঁত চেপে কিশকিশ করে বল তুই চল আজ বাড়িতে তারপর দেখাচ্ছি তোর মজা! বেশী সত্যবাদী হয়েছিস না?’ আমি একেবারে অবাক হয়ে যাই কি আশ্চর্য মা’ই তো সবসময় বলে সত্যি কথা বলতে, কখনো মিথ্যে না বলতে। আজ আর রিকশায় ওঠে না, ট্রামরাস্তার দিকে যায় না। আমাকে হেঁচড়ে টেনে হরিশ মুখার্জী রোড দিয়ে হাঁটিয়ে আনে। মিত্র ইন্সটিটিউশান পেরিয়ে মুক্তদলের আগে গলি  রূপচাঁদ মুখার্জী লেন দিয়ে বনফুলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি আসে। আমার পা ব্যথা করছে এত হেঁটে। মা বলল করুক ব্যথা। বুড়োধাড়ি মেয়ে নিজের হোম ওয়ার্ক নিজে করতে পার না আবার ইস্কুলে বলেছ বাবা মা আমাকে রেখে দিয়ে বেড়াতে গেছে! কেন ছোটমামার কাছে দাদুর কাছে দেখাতে পার নি? এখন থেকে রোজ হেঁটে যাবে হেঁটে আসবে। কান্না পাচ্ছে একটু একটু। বাড়িতে ঢুকে দেখি জিজি আজ তাড়াতাড়ি এসে গেছে সাথে কুটুবাবু।  আমার দিকে তাকিয়ে মা আবার  চাপা গলায় বলে খবরদার কাঁদবে না, কান্না গেলো, গেলো বলছি। খবরদার যেন কেউ টের না পায়, তাহলে ওই  রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে আসবো। কুটুবাবু আসলে বাবা জিজিদের ছোটমামা হয়, ঠাকুমার ছোট ভাই। কুটুবাবু মা’কে খুব ভালোবাসে, মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিব্বি হেসে হেসে কথা বলছে, মন্টুদাদাকে দিয়ে কিসব খাবার বানিয়ে দিল। আমিই খালি কান্না পাওয়া আর কান্না গেলার মধ্যে ঘুরতে থাকি।  
     
     
    বাবা টারজান দ্য এপম্যান দেখিয়ে আনার পর মনে মনে ঠিক করি আমি বড় হয়ে একা একা  আফ্রিকা চলে যাবো, মা’কে তো বলে যাবোই না। বাবাকে বলব কিনা ঠিক করে উঠতে পারি না। বোবো আর ঘাঁতুনের সাথে পরামর্শ করি, ওরাও ঠিক করে বলতে পারে না বাবাকে বলা হবে না হবে না।  এখনো মাঝে মাঝে ভাবি আচ্ছা  বাবার কি আসলে  আমাকে ছাড়া সিমলা মানালি ঘুরতে  মন খারাপ হয়েছিল? তাই কি পর পর দুটো সিনেমা দেখিয়ে এনেছিল!  দাঁ পেপার হাউস থেকে সুন্দর গন্ধওলা রবার কিনে দিয়েছিল! 
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৩৩৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:২৯102559
  • খুব ভাল চলছে এই লেখাটা। ছোট্ট খুকিকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যেন! 

  • r2h | 49.206.***.*** | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০০:১৭102562
  • এই লেখার সব কটা পর্বই পড়ছি, যথারীতি বলা হয়নি। ইনফ্যাক্ট একটা কন্টিনিউয়াস দীর্ঘ লেখার দাবী আমার ছিল; মানে কখনো বলিনি বোধয়, মনে মনেই ছিল, ভাগাড়পাড়া, ভেলভেলেটা ইত্যাদি পড়ে।
    আমার দাবীতে অবশ্য আরেকটা ব্যাপার ছিল যে এই লেখাটার বাস্তব অনুযায়ী হওয়ার দায় নেই, লেখক এতে ইচ্ছেমত কল্পনাকে স্বাধীনতা দিন, কী হয়েছিল তার যতটা দাবী, কী হতে পারতো, কী হয়নি, কী হলে আরো জীবন আরো তীব্র হতো, সেসবেরও ততখানিই দাবী।
    মনে মনে আমি ঐ হিমালয়ের গল্পের চরিত্রকেও এখানে কোথাও গুঁজে দিই।

    তবে সে যাগ্গে অত দাবীদাওয়া থাকুক, পড়ছি।

  • সম্বিৎ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১১:৫৭102685
  • হাম ভি পড়ছি।

  • | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১২:৫৪102688
  • থ্যাঙ্কু সবাইকেই। 


    (হুতোকে বেদম ঠ্যাঙাবো) 

  • Nirmalya Nag | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৩:৫০102691
  • আহা, ঘাঁতুন আর বোবোকে দেখতে পাচ্ছি, ওদের ছেটানো জল যেন আমার গায়েও এসে লাগল।.. 

  • বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় | 45.112.***.*** | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৪৬102737
  • খুব ইন্টারেস্টিং লেখা।একটা আন্ডার কারেন্ট টের পাচ্ছি। বাকি টা পরে, ক্রমশঃ প্রকাশ্য.. 

  • শিবাংশু | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৩৬102833
  • পড়ছি ....

  • Titir | 128.2.***.*** | ১০ নভেম্বর ২০২১ ০১:২৮500958
  • ছোট্ট খুকিটার শৈশব সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। 
  • অপু | 223.19.***.*** | ১০ নভেম্বর ২০২১ ০২:০৩500959
  • দ, খুব খুব ভালো লাগলো। একেবারে  ঠাসবুনোন লেখা। নিখুত বিবরণ।
     
    ওই দিক টা আমি জানি তো ভালো করে। আমার আশুতোষ কলেজ।গোটা সাতেক সিনেমা হল ছিল। তুমি যেগুলো বললে তার বাইরে রূপালী ( এখানে বেশীর ভাগ সম য় পানু বই চলতো।) ইন্দিরা, ভারতী  আর রাস্তা ক্রস করে বসুশ্রী।
     
    শ্রীহরি কচুরি আর চাপ চাপ ডাল কি ভোলা যায়। মাঝে মাঝে লাল দই।
  • নিরমাল্লো | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৪২527315
  • হেব্বি ভাল্লাগছে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন