এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ছেঁড়াকাঁথা

  •  ছেঁয়াবাজীর ছলনা  - ১৭

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ছেঁড়াকাঁথা | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১১৩১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • অনিতার পর আর কেউ আমাদের স্কুলে বেতের বাড়ি খায় নি, অন্তত আমি যতদিন পড়েছি। অনিতা এরপরে দেড়মাস স্কুলে আসতে পারে নি, ওর নাকি জন্ডিস হয়েছিল। সুমিতা, অনিতার মেজবোনও আমাদের ক্লাসেই পড়ত। ওর কাছেই আমরা জানতে পারি ওদের বাবা একদিন স্কুলে এসেছিলেন, ওঁকে দেখেই  নাকি কয়েকজন দিদিমণি একসাথে জানতে চান অনিতা কেন স্কুলে আসছে না। জন্ডিস হয়েছে শুনে একজন নাকি আবার বলেও ফ্যালেন মার খেয়ে কারো জন্ডিস হয় না। অনিতা-সুমিতার বাবা কোনও উত্তর-প্রত্যুত্তরের মধ্যে না গিয়ে ওদের দুজনের জন্যই টিসি চান, আর তাতেই একেবারে মন্ত্রের মত কাজ হয়। সব দিদিমণিরা এমনকি হাইস্কুলের বড়দি প্রমীলাদি পর্যন্ত বোঝাতে থাকেন যে এটা ঠিক নয়, উনি যেন ওদের ছাড়িয়ে নিয়ে না যান। শেষপর্যন্ত উনি টিসি না নিয়েই ফেরৎ যান'; আমরা রোজই ভয়ে ভয়ে ইতিহাস ক্লাসে যাই, কিন্তু ইরাদি আর বেত হাতে ক্লাসে আসেন না, অন্যরাও অন্য ক্লাসে বেত হাতে যান না। হাইস্কুলের মণীষাদি খুবই মারকুটে ছিলেন, তিনিও আর বেত মারেন না, তবে অদ্ভুত অপমানজক শাস্তি উদ্ভাবনে এঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। ক্লাসে কথা বলায় দুজনকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে একে অপরের কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ও পাশে মিনুদিকে পাহারাদার হিসাবে বসিয়ে রাখা, অঙ্ক না পারলে জুতো হাতে নিয়ে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, দুজন ছাত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মারামারির অভিযোগ পেয়ে নিজের নিজের জুতো দিয়ে একে অপরের গালে মারতে বাধ্য করা ইত্যাদি ছিল তাঁর উদ্ভাবন।

    জুতো দিয়ে মারার ক্ষেত্রে তাঁর কড়া দৃষ্টি থাকত মার যেন জোরে না হয়, অত্যন্ত আস্তে হয়, কিন্তু মারার আগে কোনোভাবেই জুতোর তলা যেন ঝেড়ে না নেওয়া হয়, যেমন আছে তেমনি অবস্থায় আস্তে আস্তে অপরের গালে চেপে ধরতে হবে| তবে এঁর এইসব শাস্তি দেওয়াও কিছুদিন পরে বন্ধ হয়ে যায় মলি ধরকে জুতো মাথায় করে পুরো স্কুল ঘোরানর পর। জলি আর মলি দুই বোন যে কতকাল ধরে আমাদের স্কুলে পড়ত সে আর দিদিমণিরাও  ঠিক করে মনে করতে পারতেন না। কোনও ক্লাসে দুই, কোনও ক্লাসে তিন কিম্বা চারবছর করেও পড়েছে এরা। আমাদের স্কুলের ছাত্রীদের তুলনায় এরা রীতিমত বড়লোক ছিল, তিনতলা বাড়ী, গলায় কানে, হাতে মোটা মোটা সোনার গয়না, নাচে গানে পারদর্শী এই দুই বোনের পড়াশোনা একেবারেই ভাল লাগত না; অথচ ওদের বাবার কড়া হুকুম অন্তত উচ্চমাধ্যমিক অবধি পাশ না করলে উনি বিয়ের চেষ্টা করবেন না। জলি একটু শান্তশিষ্ট নিরীহমত  হলেও মলি খুবই চটপটে, বলিয়ে কইয়ে। এদিকে দুজনেই বেশ মোটাসোটা। একদিন অঙ্ক ক্লাসে কোনোভাবেই  অঙ্ক না পারায় মণীষাদি মলির চেহারার সাথে বুদ্ধির সামঞ্জস্য নিয়ে মতপ্রকাশ করেন, ফলত মলি অত্যন্ত আপত্তি করে ও  নিজের আয়তন ও বুদ্ধির মিল অমিল নিয়ে তর্ক করবার চেষ্টা  করায় মণীষাদি ওকে আদেশ করেন জুতো মাথায় করে গোটা স্কুল ঘোরার। অপমানিত মলি সেদিন বাড়ী যাওয়ার আগে সহপাঠীদের কাছে ঘোষণা করে যায় যে ও মণীষাদিকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াবেই, নাহলে ওরা যেন ঐ সজনে গাছের নীচে বাঁধা গরুটাকে মলি ধর নামে ডাকে।

    পরেরদিন টিফিনের একটু আগে জলি-মলির বাবা স্কুলে এলেন, সঙ্গে ওঁদের পাড়ার আরও তিন চারজন লোক। মধুসূদনদা তো ওর বাবা ছাড়া অন্য  কাউকে কিছুতেই টীচার্সরুমে ঢুকতে দেবেই না, ওঁরাও ছাড়বেনই না। অনুরোধ উপরোধ থেকে হুমকী, চীৎকার, প্রমীলাদি ওঁদের ভেতরে আসতে দিতে বলেন। এরপরে প্রচুর বাগবিতন্ডা ও কিছু চেঁচামেচির পর মণীষাদি নাকি সত্যিই ক্ষমা চান। তার পরেরদিন থেকে মলি আবার স্কুলে আসে।  আমরা এইসব শুনে ভয়ানক অবাক হয়ে যাই। বড়রা, বিশেষত দিদিমণিরা যে নিজেদের কোনও কথা বা কাজকে 'ভুল' কিম্বা 'অন্যায়' বলে স্বীকার করতে পারেন এটা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল। এই মলিকে আমি ক্লাস নাইনে উঠে পেয়েছিলাম, জলি ততদিনে মাধ্যমিক পাশ করে গেছে, মলিও আমার বছর চারেক বাদে পাশ করে যায়। এই ঘটনার পরে মণীষাদিসহ বাকী দিদিমণিদের বেয়াড়া ছাত্রী শাসনের জন্য বাক্যবাণই একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে। নাচ, গান বা শটপাটে অসম্ভব দক্ষতার জন্য নয়, আমাদের পরের ছয় সাত ব্যাচ পর্যন্ত মলি বিখ্যাত ছিল স্রেফ এই ঘটনাটার জন্য। ওর রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও ওর বাবার তাতে সমর্থন ছাড়াও দ্রুত বদলাতে থাকা সময়ও বাধ্য করেছিল মণীষাদিকে ক্ষমা চাইতে।

    এই সেই সময় যখন পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে বদলে গেছে শাসকদল, এই সেই সময় যখন আমরা জানতে পারছি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তিহার জেলে আছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই নিয়মিত নিজমুত্র পান করেন। নিজের গন্ডীতে  সীমাবদ্ধ না থেকে পরেরটাও কেন পান করেন না সেই নিয়ে বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে চিন্তাভাবনা আলোচনা করছি। এই সেই সময় যখন দেখছি পাড়ার খগেন কাকু, গুহ-কাকুরা আবার অফিস যাচ্ছে ধীরেসুস্থে, আগের মত দশটার মধ্যে পৌঁছনোর তাড়া আর নেই। এই সেই সময় যখন আমরা প্রথম শুনলাম আমাদের স্কুলে নির্বাচন হবে, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির। আর কি আশ্চর্য্য! তাতে নাকি ভোট দেবে আমাদের সবার গার্জেন! গোধুলি, শিবানী, সমাপ্তি, কল্পনা, সবিতারা অনেকদিন ধরে এই স্কুলে পড়ছে, কোনওদিন এমন অদ্ভুত কথা ওরাও কেউ শোনে নি। ওদের কেউ কেউ কোনও ক্লাসে তিনবছরের বেশী থেকে গেলে 'গার্জেন কল' হয়, তাতে সাধনাদি/শতদলদি/ইরাদি/প্রমীলাদি, এই চার বড়দির যাঁর স্কুলের ছাত্রী তিনি থাকেন, ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি গোপালবাবুও থাকেন, ছাত্রীর বাবা কিম্বা মা  জড়সড় হয়ে এসে দাঁড়িয়ে আরও একবছর একই ক্লাসে একই স্কুলে রেখে দেওয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করেন। বড়দি খুব রাগ করেন, গোপালবাবু উদার হয়ে রেখে দিতে বলেন। ব্যাস গার্জেনের এটুকুই ভূমিকা।

    এদিকে গরমের ছুটিতে ভাইয়ের একটা অপারেশান হয়েছে। সারকামসিশান, হঠাৎই একদিন স্কুল থেকে আসার পরে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে ভাই। এমনিতে ওর সহ্যশক্তি খুব, ব্যথায় বিশেষ কাঁদে টাদে না।প্রচন্ড ভীড়ের ট্রেনে উঠলে আমি অধৈর্য্য হয়ে পড়ি কিন্তু ভাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। খুব ঠ্যালাধাক্কা খেলে বা গরম লাগলে স্রেফ মুখটা টকটকে লাল হয়ে যায়। কান্নাকাটি যা করে তা জেদ করে। সেই ছেলে অত জোরে কাঁদছে আর সমানে বলছে ‘বই ব্যথা করে আমার বই ব্যথা করছে ও মাআআআ’। প্রথমে তো কেউ বুঝতেই পারছে ‘বই ব্যথা’ কী, পরে দেখা গেল লিঙ্গের মাথার দিক অনেকটা ফুলে উঠে কেমন টসটসে দেখাচ্ছে। স্কুলে অমিতাদি দাদুকে বলেছেন ও একবারও বাথরুমে যায় নি, বাড়িতেও পেচ্ছাপ করতে পারছে না। আস্তে আস্তে তলপেটও ফুলে উঠতে লাগল। মা আর বড়মাইমা তাড়াতাড়ি ভাইকে নিয়ে বড়মাইমার কাকামণির নার্সিঙহোম পদ্মপুকুরের কাছে, গেল। বড়মামা চলে গেল অফিস থেকে। রাতে শুধু বড়মামা ফিরল, ভাইকে জরুরী ভিত্তিতে অপারেশান করানো হয়েছে। মা নার্সিঙহোমে ভাইয়ের সাথে আর বড়মাইমা তার কাকামণির বাড়িতে থেকে গেছে। পরেরদিন ভাইকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু বাড়ি আসার দেড়দিনের মাথায় আবার পুঁজ জমে ইনফেকশান মত হয়ে গেল।   

    আবারো সেই নার্সিংহোমে ভর্তি করানো, এবারে থাকতে হল পাক্কা সাতদিন। তো এইসবে বেশ কিছু খরচ হয়ে যাওয়ায় মা খুব চিন্তিত হয়ে থাকে সবসময়। কোনও রোজগার তো নেই, গাড়িটা বিক্রি করে আর বাবার অফিস থেকে যা টাকা পাওয়া গেছে তাই স্টেট ব্যাঙ্ক আর ইউনাইটেড ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা। মাসের শুরুতে এই ব্যাঙ্ক থেকে দুশো আর ওই ব্যাঙ্ক থেকে দুশো টাকা তুলে চারশো টাকায় সারা মাস চালায় মা। বড়মামা অপারেশান আর নার্সিঙহোমের খরচ দিয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ফিরে মা ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলে এনে বড়মামাকে ফেরত দিয়ে দেয়। এইসময়ই খুব তাড়াতাড়ি অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল পর পর। মণীষাদির ক্ষমা চাওয়ার পরেরদিনই গোপালবাবু  আমাদের বাড়ী এসে দাদুর সাথে কথা বললেন, চা খেলেন, তারপর মা'কে ডেকে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন। উনি চলে যাওয়ার পর জানলাম মা কাল থেকে  স্কুলে যাবে, আমাদের জুনিয়র হাইতেই। ভাই ভারী খুশী হল মা'কেও রোজ রোজ স্কুলে যেতে হবে শুনে। বাড়ীর সবাই কিছুটা শঙ্কিত কারণ গোপালবাবু বলে গেছেন দিনকাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে, এরপরে আর হয়ত চাকরীর ব্যবস্থা করা যাবে না, তাই মা এখন থেকেই স্কুলে গিয়ে কিছু কিছু ক্লাস নিতে থাকুক।

    ওঁরা কমিটি থেকে কিছু টাকা দেবেন প্রতিমাসে আর চেষ্টা করবেন সরকার থেকে জুনিয়ার হাই স্কুলের জন্য আর একটা শিক্ষকপদের অনুমোদন পাওয়ার। হাইস্কুলে কিছুতেই সম্ভব নয়।  মা'র আর কোনও উপায় নেই তাই কোনও কিছুতেই আপত্তিও নেই। পরেরদিন  স্কুলে সেকেন্ড পিরিয়ডে শুনলাম সবাই বলাবলি করতে লাগল একজন নতুন দিদিমণি এসেছেন, আমার কিরকম বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল উত্তেজনায়; আমি ভেবেই উঠতে পারছি না মাদিদিমণি ব্যপারটা ঠিক কেমন হবে!  টিফিনের পর ইরাদি মা'কে নিয়ে এলেন আমাদের ক্লাসে। পরিচয় করিয়ে দিলেন তোমাদের নতুন ইংরিজি দিদিমণি বলে, কাল থেকে ক্লাস নেবেন। ওঁরা চলে গেলেন, আমি আর পরের ক্লাসগুলোয় দিদিমণিদের পড়ানো বিশেষ কিছু শুনতে পেলাম না, খালি চিন্তা  মা কি আমার দিকে কটমট্ করে তাকাল কলম মুখে দিয়ে বসেছিলাম বলে?  আমার কি উঠে দাঁড়াতে একটু দেরী হয়েছিল? ক্লাসের কেউ কি  বুঝতে পেরেছে নতুন দিদিমণি আসলে আমার মা? শুনলাম ছবি আর রীতা বলাবলি করছে 'নতুন দিদিমণির শাড়ীটা কি ধবধবে সাদা দেখেছিস? আর কেমন ইস্ত্রি করা। উনিও মনে হয় খুব রাগী হবেন, মুখটা কি গম্ভীর দেখেছিস'। সে আর বলতে!

    ঠিক করতে পারি না মা'কে স্কুলে কি ‘মা' বলেই ডাকবো নাকি দিদিমণি! কানে আসে ছবি বলছে 'এই দিদিমণি বিধবা। দেখছিস না সিঁথিটা কেমন বেশী বেশী সাদা। অনেকদিন সিঁদুর পরে মুছে ফেললে সিঁথি অমনি সাদা হয়ে যায়'। আমি ঠিক করে ফেলি কাউকে জানানো চলবে না উনি আমার মা, আমি ‘দিদিমণি' বলেই ডাকব। ডেকেওছিলাম চার পাঁচদিন। তারপর একদিন কুমকুম বলে ‘ইংরিজি দিদিমণি তোর মা হয় না?' আমি খুব জোরে মাথা নেড়ে না বলতে যাই  গলা দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ বেরোয় কেবল। কুমকুম, ছবি সবাই মিলে জিগ্যেস করতে থাকে, আমি জোর করে বলি ‘ধ্যাৎ কে বলেছে?' আমার তখন মনে পড়ে না মিতা রীতা দুই বোন তো আমাদের পাড়াতেই থাকে। আমি প্রাণপণে অস্বীকার করতে চাই আর তক্ষুণি কুমকুম বলে ওঠে 'বলবে আবার কে? দিদিমণিরও তো তোর মত চোখের মণিটা সবসময় নড়ে, তোর মতই তো ট্যারা।  নিশ্চয়ই উনি তোর মা’।  যা ভয় করেছিলাম ঠিক তাই হল ... সবাই জেনে গেল।  বেশ ছিলাম এতদিন, এবার এখানেও আবার আমাকে সবাই চোখ নিয়ে ক্ষ্যাপাবে। একদম চুপ করে যাই আমি।  চিনিয়ে দিয়েছে, উত্তরাধিকারসূত্রে বহন করে আনা নিস্ট্যাগমাস আমাকে নিসংশয়ে চিনিয়ে দিয়েছে মা'র মেয়ে বলে।

    মীনাদি, আমাদের সেলাই দিদিমণিও মা'র সাথে একই সময় যোগ দিলেন আংশিক সময়ের শিক্ষক হিসেবে। মেয়েদের স্কুল অথচ ছাত্রীরা তিন তিনটে বছর একটুও সেলাই শিখবে না এই নিয়ে  ম্যানেজিং কমিটি সদস্যরা অনেকদিন থেকেই চিন্তিত ছিলেন। তাছাড়া ইংরিজির জন্য অতিরিক্ত অর্থব্যয় করে শিক্ষক নিয়োগ করা হল, কিন্তু সেলাই কিম্বা কর্মশিক্ষা উপেক্ষিত রইল, তাও আবার এমন একটা স্কুলে যেখানকার মেয়েরা পড়াশোনা শিখে দারুণ দিগগজ হয়ে যাবে এমনটা শিক্ষিকারা বা কমিটি কেউই আশা করেন না, বরং হাতের কাজ, সেলাই ফোঁড়াই শিখলেই এইসব মেয়েদের জীবনে বেশী কাজে লাগবে বলে মনে করেন সবাই, তাই একইসাথে মীনাদিও এলেন আমাদের  সেলাই শেখাতে। এসেই আমাদের শেখালেন দড়ির পাপোষ বানানো, নাইলন সুতো আর তার দিয়ে ফুল পাতা বানিয়ে তারকাটা বাল্বের চারদিক দিয়ে নানারঙের নাইলন সুতো জড়িয়ে বানানো ফুলদানীর মধ্যে বসিয়ে ঘর সাজানোর জিনিষ। সপ্তাহে দুদিন টিফিনের পর আসতেন স্কুলে, এসেই নির্দিষ্ট ক্লাসে চলে যেতেন, কমনরুমে খুব একটা বসতেন না। একদিন বলেছিলেন উনি ম্যাট্রিক পাশ, বেশী পড়াশোনা করেন নি, তায় আংশিক শিক্ষক, তাই অন্য দিদিমণিরা ওঁর সাথে কথা বলতে চান না, বললেও ঠেস দিয়ে দিয়ে কথা বলেন। 

    শুনে আমরা কেউই অবাক হই নি, আমাদের দিদিমণিদের পক্ষে এরকমটাই স্বাভাবিক। এমনিতে সর্বদা হাসিখুশী মীনাদি কাউকে বকতে পারতেন না, ফলে ক্লাসে প্রচন্ড হই হট্টগোল হত। একদল মেয়ে ওঁর চারদিকে একেবারে ঘিরে ধরে নিজের নিজের কাজ দেখিয়ে নিত, অনেকে বাড়ী থেকে স্কুলের কাজের বাইরের অনেক সেলাই টেলাইও ওঁকে দিয়ে দেখিয়ে নিত। আর আমার মত যারা সেলাই ফোঁড়াইয়ে এক্কেরে ঢ্যাঁড়শ, আমরা কোনওমতে ক্লাসের কাজটুকু সেরেই বেঞ্চের ফাঁক দিয়ে বা ওপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। এক একসময় এমন হট্টগোল হত যে পাশের ক্লাস থেকে কোনও দিদিমণি এসে আমাদের বকে যেতেন, মীনাদিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে| এরকম দু তিনবার হওয়ার পরে ক্লাসে গোলমাল বেড়ে গেলেই মীনাদি যাকে সামনে পেতেন তাকেই প্রাণপণে খিমচে দিতেন।  মুহূর্তে ওঁর চারপাশ ফাঁকা হয়ে যেত, তখন উনি দুই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যেতেন দ্বিতীয়  কাউকে খিমচানোর জন্য আর আমরা নতুন খেলা পেয়ে টপাটপ হাইবেঞ্চে উঠে বেঞ্চের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে লাস্ট বেঞ্চের দিকে চলে যেতাম। কেউ কেউ অবশ্য 'কুমির  তোর জলকে নেমেছি' স্টাইলে মেঝের ওপর দিয়েও এঁকে বেঁকে দৌড়ে যেত। অসহায় রাগে বেগুনী হয়ে মীনাদি শুধু বলতেন ‘অসভ্য মেয়েরা সব’।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১১৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Aditi Dasgupta | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:২৭527261
  • কত বিচিত্র অনুভূতির নকশা! যে ভোগে সেই বোঝে! Every personal is political। আহা! সত্যি আসলে গল্পের চেয়ে অনেক বেশী তীব্র।
  • | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:১৫527279
  • হ্যাঁ অদিতি, সত্যি আসলেই গল্পের চেয়ে বেশী তীব্র। 
    ধন্যবাদ। 
  • সুদীপ্ত | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৯527281
  • এই সিরিজটা খুব ভালো লাগছে। বছর পনেরো-কুড়ি আগেও স্কুলে মারধোর, কানমোলা হয় না এ জিনিস বিরল ছিল, সেসব এখন অনেক কম শুনি। মুখে জুতো ঘষা বা জুতো মাথায় নিয়ে ঘোরা এগুলো চমকে দেওয়ার মতো!  মানে একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার এ জিনিস মাথায় আসাই ভয়ানক ব্যাপার! 
    সেলাই দিদিমণির কথায় মনে পড়ল, আমাদের ক্লাস থ্রী না ফোরে বীথিদি ক্লাস নিতেন কর্মশিক্ষার, বয়েজ স্কুল হলেও আমরা চেন সেলাই, টাঁক সেলাই, রাখি বানানো, পুতুল বানানো এসব শিখেছিলাম। খুব ভালো গান গাইতেন, ওঁর কাছেই বাইশে শ্রাবণের কোনো এক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে  প্রথম শোনা আর শেখা দুটো গান 'কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ' আর 'আমি মারের সাগর পাড়ি দেবো', এখনো প্রিয়। 
  • যোষিতা | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০১:২৩527293
  • গার্লস স্কুলের গল্প দরকারি।
    ছকে বাঁধা আতুপুতু ড্রয়িংরুমের গল্পের বাইরে সত্যিকারের জীবনের গল্প লেখার সময় এখন না এলে আর কবে আসবে? 
    মেয়েদের গল্প মেয়েরা বলবে। কারো শিখিয়ে দেওয়া ছকে স্টেপ ফেলে ফেলে নয়।
    চলুক।
  • Aditi Dasgupta | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৪২527314
  • আসলে স্কুল স্টোরি শুধু ছেলেদের ই হয়না, মেয়েদের ও থাকে! তার কথাগুলি শুনতে হবে, দুঃখ আর মজা পেতে হবে। মানবিক মানবীকে বাদ দিয়ে হয় নাকি?
  • | ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৬:৫৩527333
  • আমার মনে হয় অরত্যেকের গল্পই ইউনিক।  মোটামুটি একটা সমতে গল্পগুলোতে অনেক কমিটি ন ফ্যাক্টর থাকলেও ব্যক্তিপর্যায়ে গিয়ে গল্পগুলো খানিকটা করে আলাদা হয়ে যায়। 
     
    আবারো ধন্যবাদ যোষিতা, অদিতি। 
  • | ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:০৭527336
  • *গাদা টাইপো হয়েছে। 
     
    আমার মনে হয় প্রত্যেকের গল্পই ইউনিক।  মোটামুটি একটা সময়েতে গল্পগুলোতে অনেক কমন ফ্যাক্টর থাকলেও ব্যক্তিপর্যায়ে গিয়ে গল্পগুলো খানিকটা করে আলাদা হয়ে যায়। 
     
    আবারো ধন্যবাদ যোষিতা, অদিতি
  • কমন ফ্যাক্টারের জীবন  | 173.49.***.*** | ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:৪১527338
  • ব্যক্তিপর্যায়ে প্রত্যেকটা গল্পই আলাদা হবার কথা - এমনকি প্রতিটি জেলিফিশের জীবনও। তবে, কেমন যেন মনে হয় সবাই তেমন চায় না। 
    আমরা বেশির ভাগ মানুষ চাই, অনেকটা করে কমন গল্প অনেকটা করে কমন গল্প অনেকের সাথে, অন্তত কারোরো না কারোর সাথে। আর খুব অল্প, অল্প একটু একদম নিজের গল্প।  কিন্তু, কিছু মানুষ, মনে হয়েছে, ঐ একদম নিজের গল্পটুকু একেবারেই চান না। উল্টোদিকে কিছু মানুষ চান অনেকটা করে নিজেরই গল্প। 
     
    কি জানি! 
  • Aditi Dasgupta | ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:২৬527343
  • একেবারে ঠিক। আসলে এলিয়েনেশন এর ভয়টা লালিত পালিত হতে থাকে সেই সামাজিকীকরণের সময় থেকেই! Ugly ducling এর গল্পও পাশাপাশি চলতে থাকে। এ যেন রেলগাড়িতে যেতে যেতে পাশাপাশি দুটো রেল কে দেখা। জুড়ে যাচ্ছে আবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে। নিজের জীবন নিয়ে আমরা কখন যে কোনটা চাই তার থই পাইনা! অনেকের মধ্যে থেকে ভীষণ একা লাগে, মেলেনা, আবার সেই মেলাতেই ছুটে যাই!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন