এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ছেঁড়াকাঁথা

  • ছেঁয়াবাজীর ছলনা  - ১৬

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ছেঁড়াকাঁথা | ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ১০২৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সিক্সের ঘর থেকে ভাগাড়ের গন্ধ খুব বেশী পাওয়া যায় আগের ক্লাসগুলোর তুলনায়। প্রাথমিক বিভাগ পেছনের দিকে হওয়ায় এই মূল বাড়ীটার আড়ালে গন্ধ তত যেত না, কিন্তু সিক্স হল একদম মূল বাড়ীতে, এখানেই বিভিন্ন বিভাগের দিদিমণিদের কমন রুম। এই বাড়ীর টানা বারান্দার শেষদিকেই মধুসুদনদা কিম্বা সুরেশদা মস্ত একটা পেতলের  গোলাকৃতি চ্যাপটা পাতের ওপর কাঠের হাতুড়ী ঠুকে  ঠুকে স্কুল শুরু  ও ছুটি হওয়া, ক্লাস শুরু ও শেষ হওয়ার সময় নির্দেশ করে। ওকেই নাকি 'ঘন্টা' বলে। সেই প্রথম যখন ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস থ্রীতে, তখন খুব অবাক হয়েছিলাম, ঘন্টা আবার এমন দেখতে হয় নাকি!! দিদার ঠাকুরঘরের ঘন্টা তো একদম অন্যরকম দেখতে! মধুসুদনদা লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল মাথায়, অল্পবয়সী, ঘন্টা পেটায় একেবারে গায়ের জোরে।  সুরেশদা ছোট্টখাট, ফরসা, বয়স্ক লোক, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, পাকার ভাগই বেশী, ঘন্টা পেটায় আস্তে ধীরে রয়ে সয়ে। হাইস্কুলের বড়দি প্রমীলাদি প্রেয়ার করান প্রতিদিন, আর তারপর অল্প কিছু উপদেশ দেন। পাকাচুলো প্রমীলাদি হাল্কারঙের পাড়ওলা ধবধবে সাদা শাড়ী সাধারণ করে, যেমনিভাবে মা'রা সবাই বাড়ীতে পরে, অমনি করে পরে স্কুলে আসেন। অমনভাবে পরে বাইরে বেরোতে আর কাউকে দেখি নি।

    প্রমীলাদির গলার আওয়াজ এত নীচু যে একদম সামনের মেয়েরাই ভাল করে শুনতে পায় না। কথা বলেনও খুব ধীরে থেমে থেমে। প্রেয়ারে সোমবার গাইতে হয় শিবস্তোত্র, ‘প্রভুমীশমনিশমশেষগুণ ... '; মঙ্গলবারে 'জনগণমন অধিনায়ক'; বুধবারে 'ধনধান্য পুষ্পভরা', বৃহস্পতিবারে 'শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান', শুক্রবারে আবার সেই 'প্রভুমীশমনি', শনিবারে 'জনগণ'| মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি প্রেয়ার ভালই লাগে, বুধবারও তত খারাপ লাগে না, কিন্তু সোম আর শুক্রবারে কিছুতেই প্রেয়ারে যেতে ইচ্ছে করে না। কি একঘেয়ে সুরে কতক্ষণ ধরে হতেই থাকে, হতেই থাকে। অনেকে ঐ দুইদিন ইচ্ছে করেই দেরী করে আসে। দেরী করে আসলে নিজের ক্লাসের লাইনে দাঁড়াতে পারবে না, লেট লাইনে দাঁড়াতে হবে, সবাই দেখবে এরা দেরী করে এসেছে, সব ক্লাসের মেয়েদের লাইন এক এক করে চলে গেলে তবে লেট লাইন যেতে পাবে। তা ঐ  প্রভুমীশমনি'র থেকে তাও ভাল। এই গানটা যখন শুরু হয় তখন প্রায় কারুর গলাই শোনা যায় না, মাঝে মাঝে দিদিমণিরা কেউ কেউ একটু বকে দেন বা হয়ত একটু গেয়েও দেন, তখন একটু আওয়াজ বাড়ে, কিন্তু শেষবার যখন 'প্রণমামি শিবম শিব কল্পতরু' লাইনটা আসে তখন সব্বাই গলা ছেড়ে গায়।  

    সিক্সের প্রথম দেড়মাসে একদল নতুন দিদিমণি আমাদের পড়িয়ে গেলেন, তাঁদের আমরা বলতাম বিটি দিদিমণি। এঁরা নাকি বিটি পড়েন আর সেই শিক্ষাক্রমের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হিসেবে  বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে দেড়মাস করে পড়িয়ে আসেন। এঁদের শিক্ষক শিক্ষিকারা মাঝে মাঝে এসে ক্লাসের পেছনে বসে এঁদের পড়ানো দেখতেন আর এঁদের খাতায় মন্তব্য লিখে দিয়ে যেতেন। এঁদের পড়ানোর ধরণটা আমাদের খুব অদ্ভুত লাগত। এঁরা একটাকরে বড় খাতা নিয়ে আসতেন, যাঁকে এঁরা বলতেন প্র্যাকটিক্যাল নোটবুক। দুদিকে শক্ত পিচবোর্ডের মলাট আর ভেতরে একপিঠ লাইনটানা একপিঠ সাদা অনেকগুলো কাগজ, ধারের দিকে দুটো করে গর্ত করা, জুতোর ফিতের মত ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখা। ইচ্ছেমতন পৃষ্ঠাসংখ্যা বাড়িয়ে কমিয়ে নেওয়া যায় এমন খাতা সেই প্রথম আমরা দেখলাম। তারমধ্যে আবার এই বিটিদিদিরা যা পড়াবেন তার ছবি এঁকে আর এক দুই প্যারাগ্রাফ লিখে নিয়ে আসতেন। বোর্ডেও অনেক চার্ট, ছবি এঁকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, মজাই লাগত। এঁদের মধ্যে ভূগোল দিদিমণির খাতা সবচেয়ে সুন্দর ছিল, কতরকমের ছবি আর ম্যাপ। ম্যাপের মধ্যে আবার আলাদা আলাদা রঙ করে করে এলাকা চিহ্নিত করা। সেই থেকেই আমার ম্যাপ দেখার আগ্রহের শুরু।  

    এরকম একজন বিটিদিদিমণি পরেও আমাদের স্কুলে দুইবার পড়িয়েছেন দুইজন দিদিমণি অসুস্থ হয়ে চার পাঁচমাস করে ছুটি নেওয়ার সময়। কিন্তু আশ্চর্য্য তখন তিনি আর ছবিটবি এঁকে পড়ানোর কোনও চেষ্টাই করেন নি, অন্যদের মতই রিডিং পড়ে দিয়ে মুখস্ত করে আসতে বলেছিলেন। রীমা ছবির কথা, প্র্যাকটিক্যাল নোটবুকের কথা জিগ্যেস করায় ভীষণ রেগে গিয়ে ওকে মারবেন বলে ভয়ও দেখিয়েছিলেন। তবে আমরা জেনে গেছিলাম বিটি দিদিদের পড়ানোর কোনও মূল্য নেই, এই চ্যাপ্টারগুলো আমাদের স্কুলের দিদিমণিরা আবার পড়াবেন, তাই আমরাও কেউ ক্লাসে বিশেষ মন দিতাম না। ক্লাস সিক্সের ঘরটা মস্ত বড় হল্ঘর, প্রায় ৭০ জন ছাত্রী অনায়াসে ধরে যায়, কিন্তু অত ছাত্রী তো হয় না এই স্কুলের সিক্সে। ফাইভে উঠে যারা পরীক্ষা দিয়ে অন্য কোনও স্কুলে সুযোগ  পায়, তারা সবাই চলে যায়। যারা ফেল করে থেকে যায়, তাদের সাথে সাধনাদির প্রাথমিক বিভাগ থেকে আসা মেয়েরা আর অন্য কোনও স্কুলে ক্লাস সিক্সে কেউ তিনবার ফেল করলে যখন সেখান থেকে টিসি দিয়ে দেয়, তারা তখন এখানে এসে সিক্সে ভর্তি হয়। অন্য সব স্কুলেই নিয়ম হল একই ক্লাসে তিনব্ছরের বেশী থাকতে দেওয়া হয় না, তৃতীয়বারেও ফেল করলে টিসি দেওয়া হয়।

    ভাগাড়পাড়া স্কুলে অবশ্য এমন নিয়ম নেই, যতবার খুশী ফেল করে থাকা যায় এখানে। শুধু তিনবারের বেশী হয়ে গেলে সারা বছরের মাইনে ২৪ টাকার জায়গায় ৩৬ টাকা হয়ে যায়। এই হলঘরে বড়সড় পাঁচটা জানলা, মোটা মোটা লোহার শিক লম্বালম্বি বসানো। দুটো শিকের মধ্যের ফাঁক দিয়ে একটা রোগা মেয়ে  দিব্বি গলে বেরিয়ে যেতে পারে। ক্লাসের পাশেই একটা কচুব্ন। আসলে ওটাও একটা মস্ত মাঠ, তবে শুধু মাঝ্খানে অনেকটা অংশ পরিস্কার আর পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণে  কচুবনে ভর্তি, পূবদিকে আমাদের স্কুলের মাঠ। দুপুরে ছেলেদের স্কুলের ছেলেরা নাকি দুটো মাঠজুড়েই খেলে। পশ্চিমের কচুবন ঘেঁষে একটা মস্তবড় শিমূলগাছ, এপ্রিল মাসভর লাল টকটকে ফুলে ভরে থাকে। কিন্তু নীচে পড়ে থাকা শিমূল ফুলগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় কেমন বিশ্রীমত দেখতে, উঁচুতে যখন ফুটে থাকে শুধু লাল টকটকে পাপড়ি দেখা যায়, তাই সুন্দর দেখায়, মাটিতে খসে পড়লে আসল রূপটা দেখা যায়। ক্লাসের পেছনে পাকা রাস্তা সোজা গেলে স্টেশান,  রিকশা, সাইকেল চলে অনবরত। লোকজন বাজার করে ফেরে, ডোরাকাটা নাইলনের ব্যাগের মুখ দিয়ে উঁকি মারে কচুর লতি কি মুলোশাকের ডগা, ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা উর্ধশ্বাসে দৌড়ায় ট্রেন ধরতে।

    রাস্তাটার পাশেই সেই যে সেই পুকুরটা, ক্লাস থ্রীয়ের জানলা দিয়ে যাকে দেখতাম। সোমবার সকালে এই পেছনের জানলা দিয়েই আমরা নজর রাখতাম রেখাদি আসছেন কিনা। রেখাদি আমাদের ক্লাসটিচার, সোমবারে কলকাতা থেকে আসেন তাই ট্রেন থেকে নেমে এদিক দিয়ে আসতে দেখা যায়, অন্যদিন  বাড়ী থেকে আসেন, সে এদিক দিয়ে দেখা যায় না| ওঁকে আসতে দেখলেই আমরা লক্ষ্মী শান্ত হয়ে বই নিয়ে বসে যাই। উনি এসে ক্লাসে গন্ডগোল হতে দেখলে এলোপাথাড়ি বেত চালান, অনেকটা পুলিশের লাঠিচার্জ করার কায়দায়, কারুর চোখে লাগল কি নাকে ঢুকে গেল সেসব খেয়ালও করেন না। এতদিনে আমি বাড়ীতে বড়দের সবকথা না বলতে অথবা মিথ্যে বলতে বেশ শিখে গেছি; শিখে গেছি দাদুর খুচরো পয়সার বাক্স থেকে সময় সুযোগমত দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা তুলে নিতে। সিকি কিম্বা আধুলি নিতে সাহস হয় না, যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে বেদম মার খেতে হবে। তা দশ, পাঁচ পয়সায় দিব্বি চুরন, হজমীগুলি, কারেন্ট নুন খাওয়া হয়ে যায়। এদিকে মা টিফিনবাক্সে  দুটো পাঁউরুটি  টোস্ট করে, মাখন আর চিনি মাখিয়ে দিয়ে দেয়, কখনও কখনও সঙ্গে একটা আতা সন্দেশও থাকে। অত সকালে আটার রুটি বানানো হয় না, আর আমার রুটি ভালও লাগে না।

    মাখনমাখানো পাঁউরুটি কেমন ত্যাকত্যাকে নরম হয়ে থাকে, ভাল্লাগে না। তার থেকে চুরন কিম্বা হজমীগুলি অনেক বেশী ভাল খেতে। সবচেয়ে ভাল খেতে কাঠিভাজা। জিলিপীর মত প্যাঁচানো দেখতে কিন্তু মচমচে নোনতা। একটার দাম ২০ পয়সা। সে খুব কমই খাওয়া হয়। বেশিরভাগ দিনই পাঁউরুটি দুটো কল্পনাকে দিয়ে দিই, ও ভালবেসে খায়। সেই যে কল্পনা একদিন খুব পেটের ব্যথায় কেঁদেছিল, তারপর থেকেই। সেদিন প্রেয়ারের সময় প্রমীলাদি একটু বেশী সময় ধরে ভাষণ দিচ্ছিলেন আর আমরা উসখুস করছিলাম, তাই দেখে উনি আরো অনেকক্ষণ ধরে  ধৈর্য্যশীল হওয়ার গুণাগুণ ব্যাখ্যা করছিলেন। এমন সময় কল্পনা হঠাৎ ভীষণ জোরে চীৎকার কেঁদে ওঠে, পেটে হাত দিয়ে বেঁকে কুঁজো হয়ে যায়। সবাই কেমন হতভম্ব হয়ে যখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা, তখন আয়া মিনুদি এসে ওকে টপ করে কোলে তুলে  টীচার্স রুমে নিয়ে শুইয়ে দেয়, দিদিমণিরাও সব তাড়াতাড়ি পেছন পেছন যান। আমরা এলোমেলোভাবে যে যার ক্লাসে চলে যাই, লাইনটাইন আর করি না। অন্য সব ক্লাসে দিদিমণিরা চলে গেলেও আমাদের ক্লাসে রেখাদি আসেন না, আমরা একজন দুজন করে গিয়ে কমনরুমে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখি কল্পনা তখনও ফোঁপাচ্ছে।

    আর রেখাদি সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বকছেন রাতের খাবার হজম না হওয়া সত্ত্বেও সকালের খাবার খাওয়ার জন্য, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার না খেয়ে মুখরোচক খাবার খাওয়ার জন্য। উনি জানতেন না কল্পনার বেশীরভাগ দিনই রাত্রে খাওয়া হয় না, সকালেও না। ওর মা দুপুরের পর এসে রান্না করলে ওরা সবাই বিকেলের দিকে একবার খায়। কল্পনার মা যেসব বাড়ী কাজ করে তারা কেউ কোনওদিন রুটি বা মুড়ি দিলে রাত্রে ওরা একগাল খায়, নাহলে আবার সেই পরেরদিন বিকেলে। উনি জানতে চানও নি অবশ্য। মিনুদি কোত্থেকে একঠোঙা মুড়ি এনে ওর হাতে দিয়ে বলে 'তুই আস্তে আস্তে একটু করে জল দিয়ে দিয়ে খা দিকিনি'। রেখাদির দিকে তাকিয়ে বলে 'আপনি ক্লাসে যান দিদিমণি, এই মুড়িটুকু খাইয়েই আমি ওকে ক্লাসে দিয়ে আসছি'।  আমরা চুপি চুপি ফিরে আসি। আমি জানি অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে পেটে খুব ব্যথা হয়, বাবা বলত রাত্রে না খেলে অনেকক্ষণ পেট্খালি থাকবে, পেটে খুব  ব্যথা হবে। কল্পনা পরে আমাদের বলেছিল মিনুদি ওর নিজের টিফিনের মুড়িটুকু দিয়েছিল খেতে, কল্পনা খেতে চায় নি, মিনুদি জোর করে খাইয়ে দেয়। বলার সময় কল্পনা আমাদের দিকে তাকায় না, বাইরের ঝোপের বুনো পুটুশ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

    হলুদ রঙের পাপড়ির ছোট্ট ছোট্ট ফুল, মাঝখানে পরাগরেণুর চারপাশে গাঢ় লালচে কমলা একটা বর্ডার দেওয়া। অমনি লালচে হয়ে উঠতে থাকে ওর নাকের ডগা, চোখের চারপাশ --- ওকে কেমন অচেনা লাগে।  টিফিনের পরে ফোর্থ পিরিয়ডে ইরাদিদিমণির ইতিহাস ক্লাস। উনি এসেই একজন একজন করে দাঁড় করিয়ে মুখ্স্থ বলতে বলেন, যেমন আমাকে হয়ত জিগ্যেস করলেন শেরশাহের রাজ্যশাসন সম্পর্কে যা জান বল। আমাকে বই থেকে আগাগোড়া মুখ্স্থ বলে যেতে হবে গড়গড়িয়ে, উনি হয়ত দুই তিন প্যারাগ্রাফ শুনে বুঝে গেলেন আমি মুখস্ত করেছি, তখন আমাকে বসিয়ে দিয়ে রীমাকে জিগ্যেস করলেন তার পর থেকে বলতে। তারমানে রীমাকে চতুর্থ প্যারা থেকে বলে যেতে হবে। আর মাঝখানে থেমে গেলেই বেত দিয়ে প্রচন্ড মার। ইরাদিমনির এই মারের কথা আমরা প্রাইমারী থেকেই শুনে আসছি বটে তবে নিজেরা দেখি নি হাফ ইয়ার্লির আগে। আমি খেয়াল করে দেখেছিলাম উনি এসে রোজই ডানদিকের ফার্স্ট বেঞ্চের প্রথম থেকে পড়া ধরতে শুরু করেন, তারপর ডান, বাঁ, ডান, বাঁ করে এগোতে থাকেন। কাজেই যার যেমন বসার  জায়গা, সেই অনুযায়ী পাতার নির্দিষ্ট অংশ মুখস্থ করে গেলেই চলে, পুরো পড়া তৈরী করার কোনও দরকার নেই।

    এটা সকলকে বুঝিয়ে দেওয়ায় সবাই খুব খুশী, এই ক্লাসের সবাই পড়া পারে বলে ইরাদিও খুশী। কিন্তু হাসিখুশী তো আর তেমন পাকাপোক্ত কিছু নয়, একটু ফ্ঙ্গবেনে ব্যপার, তাই হাফ ইয়ার্লির খাতা বেরোবার দিন ইরাদি ক্লাসে এলেন দুটো বেত হাতে নিয়ে, যদি একটা ভেঙে যায় তাহলে যাতে অসুবিধে না হয়। ক্লাসের দুজন মাত্র ইতিহাসে পাশ করেছে, বাকী সব ফেল। আমাদের হাফ ইয়ার্লির খাতা দেখানো হত। কোনও কোনও দিদিমণি স্রেফ খাতা হাতে দিয়েই ছেড়ে দিতেন, কেউ কেউ আবার খাতা দেওয়ার সময় কিছু ভুলত্রুটি যা সহজেই এড়ানো যেত, সেগুলো সম্বন্ধে প্রত্যেককে আলাদা করে বলে দিতেন। তা ইরাদি এক এক করে রোল নাম্বার ধরে ধরে ডাকছেন আর খাতা হাতে দিয়েই বেত দিয়ে সপাৎ সপাৎ করে পায়ে মার। সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ। পাতা উল্টানোর আওয়াজটুকুও নেই। অনিতা গেল খাতা আনতে। অসম্ভব রোগা অনিতা, কাগজের মত ফ্যাকাশে ফর্সা, প্রথম্ মারটা পড়তেই দুলে উঠল হাওয়ালাগা গাছের মত। হাওয়া কেটে কেটে বেত উঠছে ---নামছে ---উঠছে ---নামছে। শুঁউউইই করে একটা প্রায় শোনা যায় না এমন আওয়াজ, সামনের বেঞ্চের মেয়েরা দেখল অনিতার পায়ের কাছে ঈষৎ হলুদাভ তরল জমা হচ্ছে দ্রুত। অনিতা দুইহাতে মুখ ঢেকে ওখানেই হাঁটুগেড়ে বসে পড়ছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ১০২৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫২525963
  • জানি না, কে কেমন ভাবে নেবে। দামী নামী ইস্কুলে পড়িয়ে হয়ত ভাল নম্বর, প্রভাবশালী লবির মেম্বারশিপ, এসমস্ত হয়, কিন্তু জীবনের আসল শিক্ষাটায় বিশাল গ্যাপ থেকে যায়। আজ ভাগাড়পাড়া ইস্কুলে পড়বার পর জীবনকে দেখবার চিনবার যে তোখ তৈরি হলো, সেটা গোখলে ইস্কুলে পড়ে হতো কিনা গভীর সন্দেহ আছে।
  • যোষিতা | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫২525964
  • তোখ চোখ
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:7a6a:9d53:7567:***:*** | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ০০:১৩525971
  • মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। টীচাররা ছোটছোট বাচ্চাদের এমনি করে মারেন যে কী করে! আমাদের স্কুলেও কিছু স্যাডিস্ট মানসিকতার টীচার ছিলেন, ভার্বালি খুব অ্যাবিউজ করতেন। কিন্তু মার দেওয়া বারণ ছিলো। ভাগ্যিস।
  • | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪০525996
  • যোষিতা,   হ্যাঁ গোখেলে পড়লে বা অন্তত হিন্দু বালিকা কি হীরালাল পালে পড়লেও  কল্পনা গোধুলি সমাপ্তিদের চিনতাম না নিশ্চয়ই। অভাব বলতে  আমি যা জানতাম সেটাতে দিনে একব্বার খেতে পাওয়ার মত  রুক্ষ ব্যপার স্যাপার ছিল না।  চারবেলা (হ্যাঁ চারবেলাই) খাবার, পরার জামা, পড়ার বইখাতা ঠিকঠাক জুটেছে। তবে কি বলুন তো, যখন নতিন চাকরির অফারের  ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার থার্ডপার্টি এজেন্সি ফোন করে বলে তোমার স্কুল তো লোকেট করতে পারছি না, এটা আদৌ এগজিস্ট করে তো? তখন কিরকম যেন একটা লাগে। এখন অবশ্য চাকরিজীবন প্রায় শেষই হয়ে এলো। এখন আর তেমন কিছু মনেও হয় না।
     
     আর ইনফ্লুয়েনশিয়াল লবি, নানারকম জিনিষের পড়াশোনার নানা রাস্তার খোঁজ একটা মোটামুটি চলেবল লাইব্রেরি এইগুলো নেহাৎ ফেলনাও নয়। আমি ছানা পাড়লে কখনোই এই ইস্কুলে পড়াতাম না। হয়ত দেবীশ্বরী কিংবা বিনোদিনী গার্লস বা ওইরকম কোন স্কুলে দিতাম। 
     
    কেকে ,
    এককথায় সিক স্যাডিস্টিক মনস্টার। তখন অবশ্য এসব ভাবতে পারতাম না। 
  • | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪১525997
  • *নতুন চাকরি
  • | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৩525998
  • যেটা লিখতে ভুলে গেছি ভাগাড়পাড়ায় না পড়লে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের সমস্যাগুলো কোনদিন বোধহয় বুঝতে শিখতাম না। 
  • যোষিতা | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:০৫526001
  • আমি জানি।
  • র২হ | 2607:fb90:e334:8063:c4ef:e366:aaff:***:*** | ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:৩০527326
  • "হাসিখুশী তো আর তেমন পাকাপোক্ত কিছু নয়, একটু ফ্ঙ্গবেনে ব্যপার"
     
    হুঁ...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন