এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দায় কার?

    ARIJIT MUKHOPADHYAY লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ মে ২০২৫ | ৫৫ বার পঠিত
  • "আমি চুরি করিনি!" - লিখে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা এক নাবালকের! এটা কি সমাজের বিপর্যয় নয়? মনুষ্যত্বের হেরে যাওয়া নয়? মানুষের আধুনিকতার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মত একটা ঘটনার পিছনে দোষী কারা? দোষ কী শুধু সেই 'সিভিক' কাম দোকানদারের? নাকি নাবালকের অভিভাবকের? অথবা সমাজের? নাকি আমাদের সবার?
     
    পাঁশকুড়ার ঘটনা! চিপসের প্যাকেট হাতে একটি ছেলেকে ধাওয়া করে সিভিক-দোকানদার! ছেলেটি নাবালক, সপ্তম শ্রেণী মাত্র! ভরা বাজারে দাঁড়িয়ে চোর অপবাদ দেওয়া হয় তাকে! বাচ্চা ছেলেটি জোর গলায় সেই অপবাদের বিরুদ্ধে চিৎকার করে! কিন্তু সে জানতই না যে তার চিৎকার শোনার মত লোকজন এই 'সুস্থ মেকি' সমাজে আর বেঁচে নেই।
     
    সেদিনের সেই অপমান মেনে নিতে পারেনি ক্লাস সেভেনের ছোট্ট ছেলে কৃষ্ণেন্দু! সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে তার নিজের মা ও তাকে অবিশ্বাস করবে! যার ওপর ভরসা করে সে হাঁটতে শিখেছিল! যাকে সে সবচেয়ে আপন ভাবত! সেই নিজের মা'ই অজান্তে তাকে ঠিলে ফেলে দিল গভীর এক খাদের গর্ভে, যে খাদের গভীরতা হয়ত আমাদের পক্ষে মাপা অসম্ভব! যে গর্ভের নাশকতা আমাদের আন্দাজের বাইরে! কতটা তীব্র কষ্ট পেলে একটা চিরকুটে তার শেষ বক্তব্যটুকু লিখে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় একটা ক্লাস সেভেনের বাচ্চা? কতটা অপমানিত হলে সে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে চুটকি মেরে উড়িয়ে দিয়ে হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে! 
     
    সৎ মানুষেরা একটু আত্মাভিমানী হন। বাচ্চারাও এর ব্যতিক্রম নয়। বাচ্চাদের সমস্যাটা আরও বৃহৎ কারণ ওদের কথা শোনার মানসিকতা বা ধৈর্য্য বড়দের নেই, সচরাচর থাকে না। আমরা বড়রা সবসময় মনে করি যে ওরা ভুল, আমরাই ঠিক! ওরা ভুল বলছে, মিথ্যে বলছে কারণ ওরা ছোট। আমরা বড়রা কোনোদিনই ভুল বা মিথ্যে বলিনা। আমরা অনেক সময়ই নিজেদের ইচ্ছেগুলো জোর করে চাপিয়ে দি ওদের ওপর। আমরা সমাজের কাছে মাথা উঁচু করে চলার অছিলায় বাচ্চাদের ইচ্ছাগুলোকে পাত্তাই দিনা। আমরা বুঝতেই চাইনা যে ওরা আসলে কী চায়? আমরা নিজেদের মান সম্মান নিয়ে এতটাই উতলা যে ওদের খেলার সময়টুকুও কেড়ে নিয়েছি কালের চক্করে পড়ে। 'স্ট্যাটাস' মেইনটেইন করতে গিয়ে আধুনিকতার স্টাইলে মোড়া জীবনযাপনের সুখ খুঁজতে গিয়ে কেড়ে নিয়েছি ওদের মাতৃভাষা শেখার প্রয়াস! 
     
    আসলে আমরা খুব স্বার্থপর! আমরা সবাই নিজের মত করে গল্পটা গুছিয়ে নিতে জানি। কৃষ্ণেন্দু'র মাও হয়ত ভরা বাজারে ছেলের অপমান নিজের অপমান ভেবে নিয়েছিলেন! ভেবে নিয়েছিলেন দোকানদার সত্যি বলছেন! আবার দোকানদার ভেবে নিয়েছিলেন হয়ত ছেলেটা সত্যিই চোর! তার 'সিভিক সত্তা' তখন হঠাৎ জাগরিত হয়ে উঠেছিল হয়ত! হয়ত তিনি প্রত্যেক খরিদ্দার কেই 'চোর' চোখে দেখেন! 
     
    সবাই সবার সুবিধে মত একটা করে প্লট বানিয়ে নিল, মাঝখান থেকে নাবালক কৃষ্ণেন্দু তার মনের ভিতরে গুঁজে রাখল একটা চাপা আর্তনাদ! একটা অদেখা অচেনা রাগ! একটা প্রচন্ড পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা! সে আগুনে জল দেওয়ার লোকের বড্ড অভাব! সে যন্ত্রণার খোঁজ নেওয়ার বুঝি একজনও নেই! অভাব আরও বেড়ে গেল যখন সে দেখল যে তার নিজের মা-ই আঙুল তুলছেন তার দিকে! এই একজনই তো ছিলেন যে শত দোষ সত্ত্বেও ক্ষমা করে দিতেন! এই একটা মানুষই তো জ্বর হলে জেগে বসে থাকতেন মাথার গোড়ায়! এই একজনই তো খিদে পেলে বুঝতে পারতেন! কিন্তু সেই মা-ই যখন ছেলে চোর বলে বকাবকি করতে থাকেন, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বাড়িতেও সে টানাপোড়েন থেমে থাকে না - তখন সে ভেবেই নেয় যে সে বড্ড একা! তার পাশে দাঁড়ানোর মত কেও নেই - এমনকি নিজের মা ও না! 
     
    বাবা মা মানেই যে তারা সবজান্তা - এটা ভুল! যুগ পাল্টেছে। ওনারা ভুলে যান যে সন্তানরা আরও বেশি অভিজ্ঞ না হলেও শিক্ষিত - আধুনিকতায় শিক্ষিত, কম্পিউটারে শিক্ষিত, সাক্ষরতায় শিক্ষিত, বিদ্যায় শিক্ষিত, হাবভাবে শিক্ষিত, ব্যবহারে শিক্ষিত! আমরা মানি বা নাই মানি - এখন বাচ্চারা অনেক বেশি চাপ নিতে জানে। তারা তাদের ভরসার জায়গায় বাবা মা কে বসায়। সেই জায়গাটা নষ্ট করে ফেলা মানে ওই যন্ত্রণায় নুনের ছিটা দেওয়া!
     
    কেউই কিন্তু এর দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। এর দায় যেরকম ওই সিভিক দোকানদারের, ঠিক সেরকমই ওর মায়ের ও। এর দায় যতটুকু শিক্ষার ততটুকুই সমাজের। মানুষ সামাজিক জীব। সকলের তরে যদি সকলে বাঁচতে নাই পারি তাহলে মানুষ আর পশুর মধ্যে তফাৎ কোথায়? বাবা-মা'দের তাঁদের সন্তানদের সাথে বন্ধুর মত মেশা উচিত। সন্তান যদি নিজের বাবা মা কে বন্ধুর মত করে পায় তাহলে ওদের জীবনটাও অনেক সহজ হয়ে যায়। ওরা একটু মন খুলে হাসতে পারে। ওরা একটু নিজদের মত করে বাঁচতে পারে। গুরুগম্ভীর হয়ে ওদের সব চাওয়া পাওয়া গুলোর থেকে ওদের বঞ্চিত করে লাভের লাভ কিছু হয়না। বরং এতে ওরা নিজেরা নিজেদের দমিয়ে রাখে। ভিতরে পুষে রাখে অসহ্য এক ক্রোধানল। সেই অনল যখন দাবানলে পরিণত হয় তখন তার ফল হয় মারাত্মক - ঠিক যেমনটা কৃষ্ণেন্দু'র হল!
     
    সন্তান কে সময় দেওয়া, তাদের সাথে মেশা, তাদের ছোট ছোট আবদারগুলো পূরণ করা, তাদের নৈতিক বোধ শেখানো, তাদের হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো - এগুলোই তো বাবা-মা'র কর্তব্য! তার বদলে আপনি যদি সন্তানকে তার অপরাধ কী সেটা না জেনেই দোষারোপ করেন, তার পাশে না দাঁড়ান, তাহলে দেখবেন একদিন আপনার আর আপনার সন্তানের মধ্যেকার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে আর তার মাঝে ঢুকে গেছে শুভঙ্করের মত 'সিভিক',অসভ্য, দোকানদারেরা! নাহলে দায় কিন্তু আমাদের সকলেরই থেকে যাবে......!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • PRABIRJIT SARKAR | ২৪ মে ২০২৫ ১৮:৪৬731636
  • সত্যি এক মর্মান্তিক ঘটনা। যারা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ছেলেটিকে আত্ম হত্যার দিকে নিয়ে গেল তাদের বিচার করে জেল জরিমানা করা হোক।
  • MP | 2401:4900:3f0f:52c9:96ce:2995:cdb5:***:*** | ২৪ মে ২০২৫ ১৮:৫১731637
  • বাঙালী চিরটাকাল সেন্টিমেন্টাল আর অভিমানী রয়েই গেলো l ছেলেটার বাবা মার উচিত ছিলো দোকানদারের দোকানটাই জ্বালিয়ে দেওয়া l কিসের এতো সেন্টিমেন্ট আর অভিমান বুঝেই পাইনা l 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন