কিশোরগঞ্জ তুমি কোথায়? কত দূরে?
তুমি কি এসেছিলে আমার স্বপ্নে?
নাকি ছিলে কল্পনায়?
নাকি ছিলে গত জন্মে,
কে জানে কোথায় ?
তোমার কি মনে পরে কিশোরগঞ্জ
একদিন আমি তোমার মাটিতে
শুয়েছি বসেছি, হেটেছি, খেলেছি।
আমাদের বাড়ির পুকুর ধারে
বকফুল আর মাদার গাছের ডালে
যখন বুলবুলি টুনটুনি পাখিরা নাচত,
তখন আমি গাছের নিচে খেলাঘর সাজাতাম।
হাইয়াকোকা পাখি চুপি চুপি হেটে আসত,
বনকলমীর গাছ পুকুরে জলে নুয়ে থাকত,
মাছরাঙা পাখি পুকুরে জলে নেমে আসতI
রোদ এসে পরত পুকুরের জলে,
হটাৎ হটাৎ গোসাপ আসত।
আমি ভয়ে ঠাকুমার কাছে চলে যেতাম ঘরে।
কিশোরগঞ্জ তুমি নৱদুৰ্ব্বাদল,
তাই তুমি এতো সুন্দর।
কিশোরগঞ্জ তুমি আসতে একদল গরু বাছুর নিয়ে
সুপারি ফুলের মালা দিয়ে বাধা ছিল তোমার মাথার চূড়া।
গলায় থাকত চামেলি ফুল আর বকফুলের মালা,
তারপর কিশোরগঞ্জ তুমি চলে যেতে
কলা বাগান ছাড়িয়ে, তিলক্ষেত আর ধানক্ষেত
পার হয়ে অনেক দূরে।
কিশোরগঞ্জ তুমি কোথায় যেতে ?
তুমি কি যেতে নলখাগড়ার বনে
নাকি হাওরে?
কিশোরগঞ্জ তুমি কি যেতে জঙ্গলবাড়ী ?
যেখানে আছে ঈশাখাঁর দূর্গ।
ঘরা ভর্তি আছে সোনার মোহর
সাপেরা পাহারা দেয়।
তারপর ধীরে ধীরে সূর্য যেত ডুবে,
চারিদিকে অন্ধকার,
আমার ঠাকুমা কুপি জ্বালিয়ে আমাকে
ভাত খাওয়াতো আর হোমরা বাইদ্যার গল্প করত।
কিশোরগঞ্জ তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
আমি ঘুমিয়ে পরতাম।
কিশোরগঞ্জ তুমি কোথায় ? কত দূরে ?
আছে আছে তোমার কিশোরগঞ্জ
তোমার মনের মণিকোঠায়।
কে তুমি ? কে তুমি ?
ও স্মৃতি তুমি আবার এসেছ
স্মৃতি তুমি বেদনা,
তুমি যন্ত্রনা,
তুমি কখন স্পষ্ট আবার কখন অন্ধকার।
তুমি কখন আনন্দ কখন কল্পনা
জীবনের অতীতকে টেনে আন বারবার।
কবিতাটি নিয়ে কিছু কথা।
আমি ভারতবর্ষের মতো গণতান্ত্রিক ধৰ্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক বলে গর্ব্বিত। আমি কলকাতার মতো প্রাণবন্ত ও প্রতিবাদী শহরের বাসিন্দা বলে আমি আরও গর্বিত। কিন্তু কিশোরগঞ্জ আছে আমার মনের মণিকোঠায়।
কিশোরগঞ্জ আমি তোমারে ফিরে পেতে চাই। আমি তোমার মাটিতে দুর্ব্বায় খালি পায়ে হাটতে চাই। আমি সুপারি গাছের পাতার খোলে বসে চিতই পিঠে গুড় দিয়ে খেতে চাই। আমাদের ঢেকিঘরে ঠাকুমার কোলে বসে পাড়ার বৌদের চিড়েকোটা দেখতে চাই। আমাদের কূয়োর পারে আতা গাছে হাঁড়িচাচা পাখির সাথে আমার মনের কথা বলতে চাই।। কিশোরগঞ্জ আমি তোমারে ফিরে পেতে চাই।
সিজনস অব বেট্রয়াল সিজন ১ লেখিকা দময়ন্তীর লেখা বইটির পাতা খুলে প্রথম পরিচ্ছেদে কিশোরগঞ্জ ময়মনসিংহ - এই দুটি শব্দ দেখার পর আমার মনে তীব্র যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। কতকাল কতযুগ পরে এই দুটি স্থানের নাম কিশোরগঞ্জ ময়মনসিংহ একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছি। আমার শৈশব কালের সমস্ত স্মৃতি আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ছবির মতো একের পর এক আসতে থাকে।
[কিশোরগঞ্জে আমার বাবার পৈতৃক বাড়ি ছিল। আমার বাবা পেশায় ছিলেন ডাক্তার। ময়মনসিংহ শহরে বাবা ডাক্তারি করতেন। আমার মার্ বাপের বাড়ি ময়মনসিংহ শহরে ছিল। কিশোরগঞ্জের বাড়িতে আমাদের ঠাকুমা (বিধবা) ও বাবার ঠাকুমা (বড়মা বিধবা) থাকতেন।আমরা ভাই বোনেরা অনেক সময় কিশোরগঞ্জের বাড়িতে থাকতাম। যতদূর মনে পড়ে ৩/৪ বৎসর বয়সে আমি কিশোরগঞ্জের বাড়িতে ঠাকুমার কাছে অনেক দিন ছিলাম। ১৯৫০ সালে ঠাকুমা কিশোরগঞ্জ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। তার আগে আমার মা আমাদের সব ভাইবোনদের নিয়ে কলকাতা বেহালা অঞ্চলে চলে আসে। ঠাকুমাও কিছুদিন পরে কলকাতা বেহালায় আমাদের কাছে চলে আসে। আমরা কলকাতা শহরের বাসিন্দা হয়ে যাই। ]
সেই সময়ের সমস্ত ঘটনা মনে পরে যায়। আতঙ্ক, ভয়, অনিশ্চিয়তার মধ্যে আমাদের দিন পার হয়েছে। আমরা কিসের মধ্যে দিয়ে গেছি তা শুধু আমরাই জানি। সব ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু এই বইটা কিশোরগঞ্জর সমস্ত স্মৃতি নিয়ে এল। আমি কিশোরগঞ্জে স্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিশোরগঞ্জের স্কুল, হাসপাতাপ, নদী, দূরে ধানের ক্ষেত, সব যেন আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমার মনে হতে লাগলো আমি কিশোরগঞ্জের মাইয়া আমি কি কইরা এখানে পর্ণশ্রীতে? যা ভুলে গিয়েছিলাম তাই আবার এল মনে তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে। হায় কিশোরগঞ্জ তুমি কোথায়?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।