বাবাকে ইদানিং যতই দেখি, অবাক হই। তার তেমন কোন সমস্যা ছিল না। একটু আধটু জ্বর, আর মাঝে মধ্যে একটা দুটো দীর্ঘকাশি, এই বয়সে কার না হয়! তাও তিনি হাসপাতালে যেতে চাইলেন। তার নাকি কিছু বিশেষ টেস্ট করানোর আছে। সর্বশেষ যেবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন, ডাক্তার নাকি বলে দিয়েছেন, এক বছর পর পরীক্ষাগুলো ফের করাতে হবে, শরীর খারাপ করুক বা না করুক।
বিগত ট্রিটমেন্ট হিস্ট্রি দেখে ও কিছু রিসেন্ট কন্ডিশন শুনে নিয়ে ডাক্তার যখন আগের টেস্টগুলোর সাথে আরো দুয়েকটা যোগ করে নতুন প্রেসক্রিপশানটা লিখে দিলেন, বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেয়া যায়?” প্রশ্নটা করার সময় বাবার মাথায় সম্ভবত ঘুরছিল - ভর্তি রোগী হিসেবে উনি হাসপাতাল-বেডে চড়েই টেস্ট ল্যাবগুলিতে পৌঁছে যাবেন, আর পাশেই খরগোশের মত কান ও মাথা তোলা সাধারণ রোগীদের দীর্ঘ লাইন তা চেয়ে চেয়ে দেখবে। তাছাড়া, আরও একটা ব্যাপার মনে হয় ছিল যা বাবার মধ্যে ভর্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল! সাধারণত ভর্তি থাকা অবস্থায় অবস্থায় করা টেস্টগুলোর পুরো ইন্সুরেন্স কভারেজ পাওয়া যায়; আর বাবার নিজের এরকম কোন স্কিম না থাকলেও তার মেয়ের ছিল!
সংগত কারণেই ডাক্তারের কাছে যুক্তিগুলো পেশ করেননি বাবা, যদি সব শুনে যদি ডাক্তার তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন! কিন্তু বাবার ভয় নিতান্তই অমূলক ছিল। হাসপাতালে সিট খালি আছে, আর ডাক্তারের কাছে এডমিশন চেয়েও পায়নি, এমন তো দুনিয়ার কোথাও ঘটে না। সুতরাং, ডাক্তার কিছু জিজ্ঞাসা-টিজ্ঞাসাও করলেন না, এমন কি কিঞ্চিৎ ভ্রূকুঞ্চন - তাও ফুটে উঠতে দেখা গেল না তার চকচক করা দেয়ালটিতে! অচিরেই এডমিশান রিকমেন্ডশানটা হাতে করে বাবা একটি বড়সড় কেবিন বেছে নিলেন যেখান থেকে একটি বিরাট মাঠ আর বৃক্ষরাজী চোখে পড়ে। এরপর ডিউটি নার্সকে বিদায় করে দিয়ে বাসা থেকে পরে আসা জামা-কাপড় বদলে হাসপাতালের অ্যাপ্রোনে দ্রুতই সুসজ্জিত করে নিলেন নিজেকে।
খবর পেয়ে মা, আর আমি ছুটে এলাম হাসপাতালে। কিন্তু খানিকটা সময় আমরা তার সাথে কাটাই, এ বাবার একদম পছন্দ নয়। তাই একরকম জোর করেই বের করে দিলেন আমাদের। ওদিকে আমার বড় বোন অফিস থেকে উদ্বিগ্ন ফোনে কেবিন নাম্বার জানতে চেয়েছিল, সেই তাকেও তিনি পণ করিয়েছেন না আসার জন্য। এমনকি রাতে একজন কাউকে সাথে রাখার জন্য অনেক বলেকয়েও রাজী করানো গেল না তাকে। তার সেই এক কথা - হাসপাতাল কি সুস্থ মানুষদের জায়গা! কাজ-কর্ম ফেলে এখানে এসে পড়ে থাকার মানে হয়!
কিন্তু বাবা ঠিকই পড়ে থাকেন; প্রতি বছরই অন্তত একটিবার করে হাসপাতালে কাটিয়ে আসেন। বাবার শরীর থেকে এখন পর্যন্ত সিরিয়াস কোন অসুখের হদিস বের করতে পারেনি ডাক্তার। তাও বাবা সারাক্ষণ কঠিন এক অসুখের চিন্তায় ধ্যানস্থ থাকেন। বলা যায়, হাসপাতালে যে ক’টা দিন থাকেন, তখনই বাবা সব থেকে ভাল থাকেন। বাকী বছরটা তার কাটে বিছানায় শুয়ে; একদম মৃত মানুষের মত নির্জীব দেখায় তখন তাকে!
বাবার বয়েস হয়েছে; কিন্তু তার চেয়ে বেশী বয়েসীরাও তো হেসে-খেলে, ঘুরে-ফিরে জীবন যাপন করছে, সমাজ-সেবা, ওরশ-মাহফিলে মশগুল থাকছে। কিন্তু বাবা আরো বছর পাঁচেক আগে থেকেই যেন কবর দেখতে পাচ্ছেন সামনে! তার কোথায় কি আছে, আর কিভাবে সেগুলো ভাগ হবে, তা নিয়ে আমাদের ভাইবোনদের সাথে বেশ কয়েকবার বসা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। গেল বছর, যত দেনাপাওনা আছে, তাও চুকিয়ে ফেললেন। শুধু এক পাওনাদারকে নিয়েই ঘটে গিয়েছিল বিপত্তি। প্রায় তিরিশ বছর আগে বিপদে পড়ে সামান্য ক’টা টাকা হাওলাৎ করেছিলেন; কিন্তু দিনের পর দিন খুঁজেও পাওয়া গেল না লোকটিকে। পরে যখন জানা গেল, তিনি মারা গেছেন, আর তার কোন ওয়ারিশও নেই, তখন কিছু অভাবী মানুষ খুঁজে নিয়ে তাকে দান করে দিতে হল সেই টাকাটা!
সব সময় যিনি বলতে থাকেন শরীর ভাল নেই, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, সেই তিনিই যখন গ্রামের বাড়ি যেতে চাইলেন, আর তাও আমাদের সবাইকে ছেড়ে, একা একা, তখন পরিবারের সবাই আঁৎকে উঠল এবং গোল টেবিল বৈঠকে বসল। কিন্তু যেতে না দেবার সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে নিজের ব্রিফকেসটা হাতে একদিন বাসে চড়ে বসলেন আর ঠিক ঠিক পৌঁছেও গেলেন। আমার দাদাদাদি যে জায়গায় শুয়ে আছেন, সে জায়গাটা বেদখল হয়ে গিয়েছিল। আসলে বাবা তো আর দেশের বাড়িতে থাকতেন না; ঈদ-পার্বনে কালে ভদ্রে যাওয়া হলেও দিনে দিনে ফিরে আসতেন। কিন্তু এবার বাবা বেশ কদিন কাটালেন, এলাকার মান্যি-গুণ্যি লোকজনকে নিয়ে বিচারসালিশি করে জায়গাটা দখলে নিয়ে এলেন, এবং ঢাকায় ফিরে আমাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখলেন যেন তাকে তার বাবা-মা’র কবরের উপর রেখে দেয়া হয় মৃত্যুর পর। আমাদের বুকটা হাহাকার করে উঠলো, আর একই সঙ্গে একটা বিষ্ময়ও জাগালো। আচ্ছা, বাবাকে কি কেউ বলেছে যে, তার মৃত্যু আসন্ন! কিন্তু সে কী করে সম্ভব! পৃথিবীর কোন ডাক্তার তো কোন রোগীকে মৃত্যুর দিন তারিখ বলে দেয় না; এমনকি সে যদি হয় জটিল ক্যান্সারে আক্রান্ত!
বাবা কখনোই মরতে চাননি, না হলে চল্লিশ বছর বয়সেই একজন চেইন স্মোকার রাতারাতি সিগারেট ছাড়তে পারে? একদিন যখন তার একটু বুকে ব্যথা হল, আর ডাক্তারের মুখে হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকির কথাই শুনলেন না শুধু, চেম্বার জুড়ে হাঁপাতে থাকা পেশেন্টও দেখতে পেলেন, বাসায় এসে সেই যে ছাড়লেন, আর কেউ ধরতে দেখেনি এখন পর্যন্ত। তবে শুধু সিগারেট না, আরো অনেক কিছুকেই ছাড়লেন তিনি মৃত্যুদূতকে দূরে সরিয়ে রাখতে। পুরো এক বল মাংস সাবাড় করে দিতে যিনি ওস্তাদ, তিনি রেড মিটকে যমের মত ভয় পেতে শুরু করলেন।
এই সময়টা তাকে দেখে যে কারো ভ্রম হতেই পারত যে, এই বুঝি আজরাইল ফেরেশতা তার ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, যে কোন সময় হামলে পড়তে প্রস্তুত! আর তিনি প্রবল এক সাধনায় একটার পর একটা হার্ডল টপকে আজরাইলকে এড়িয়ে যাচ্ছেন! কখনো কখনো বুঝি আজরাইল তার সমর-কৌশল ধরে ফেলত, আর এই সময়টায় বাবাকে আবার পাল্টা ডজ দিতে হত; যেমন, একটু আধটু মিষ্টি খেয়ে ফেলতে হত, আর কিছু অনিয়ম, যেমন, লাল মাংসে মুখ ডোবানো - যা মরণফেরেশতার চোখে ঝিকঝিক ধাঁধা লাগিয়ে দিত, আর বাবাও সেই অবসরে নিরাপদ ডেরায় লুকিয়ে পড়তেন।
তিনি অনেক কিছু যেমন ছেড়েছিলেন, তেমন অনেক কিছু গ্রহণও করেছিলেন। ডাক্তার যখন বললেন, আর কিছু লাগবে না, শুধু ডায়াবেটিসটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেই হচ্ছে, তখন তিনি খাবারদাবার এমন করে বদলালেন যা দেখে হাসপাতালের রোগীরাও নিশ্চিত লজ্জা পেয়ে যাবে! তার নিরামিষের ব্যাঞ্জনটি ছিল দেখার মত; ডাক্তারি চার্টের সাথে মিলিয়ে অক্ষরে অক্ষরে তাতে সবজি ও ফলমূল পুরে দেয়া চাই। ব্যাঞ্জনটি তার মনমত বানাতে মা’কে প্রথম দিকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। তারপর যখন অনেকটাই রপ্ত করে এনেছেন, তখন আবার মিক্সচার চেঞ্জ করতে হল, প্রয়োজন পড়ল নতুন ব্যাঞ্জন। এভাবে বাবার রক্তে সুগারের মাপ এবং এর উচ্চ বা নিম্ন চাপের সাথে সাযুজ্য রেখে নিত্য নতুন আইটেম জোগাড়যন্ত্র হয়ে দাঁড়াল আমাদের বাসার নিত্য যুদ্ধ, যার সাথে যুঝতে যুঝতে মায়ের সাথে সাথে আমাদেরও শরীর অকেজো হয়ে পড়তে লাগল দিন দিন।
কিন্তু তবু বাবাকে বাঁচাতে হবে, কোনভাবেই তাকে পৃথিবীর মায়া কেটে যেতে দেয়া যাবে না। বাবার এই মৃত্যু-প্রতিরোধী যুদ্ধে আমরা ভাইবোনেরা সবাই অংশ নিতাম, যতটা পারতাম সহযোগিতা করতাম। তবে তিনি যে আমাদের উপর খুব ভরসা করতে পারতেন, তা না। হল কি, তখন করোনাকাল শুরু হয়ে গেছে - একটা ভাইরাস সারা পৃথিবীর সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। তখনো টিকা এসে পৌঁছেনি দেশে। সেই সময় মাঝে মাঝে সংবাদ বেরুতো - এক গ্রাম্য বৈদ্যের হাতে রয়েছে করোনাকে ঘায়েল করার মহৌষধ!
তো দিনরাত সংবাদে আকণ্ঠ গুঁজে থাকা বাবা ব্যাকুল হয়ে পড়লেন ঐ বেদ্যের পড়া খেতে। আমরা যখন খবরগুলির অসারতা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, তিনি ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকান শুধু, আর নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকেন একটু একটু করে। সেই ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ সময়ে একখানি বেড পাওয়া হাসপাতালে - সাত জনমের ভাগ্যি ছিল। তারপরও আমরা সবাই মিলে চেষ্টা চরিত্র করে বাবাকে পৌঁছে দেই একটি নামি হাসপাতালের বেডে। কিন্তু করোনার প্রচুর সিম্পটম পাওয়া গেলেও করোনাকে হারিকেন ধরেও খুঁজেও পাওয়া গেল না। বাসায় ফিরিয়ে আনার সব পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলেছি, এই সময় বাবা করুণ চোখে ব্যক্ত করলেন, “আরেকটাবার…মানে, কইছিলাম কি… টেস্টটা আবার করাইলে ভাল হইত না?”
সব সন্দেহকে উড়িয়ে দিয়ে এরপর যেদিন করোনার টিকা ল্যান্ড করল বাংলাদেশে, সেদিন থেকে শুরু হল বাবার নতুন এক যুদ্ধ। রেজিস্ট্রেশানের সাথে সাথেই টিকা কার্ডের জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। দিনে কয়েকবার করে চেক করতে হত আমাকে; কিন্তু যেই বলতাম ‘আসে নাই দেখাইতেছে’, একটা প্রবল অস্বীকৃতি ভেসে উঠত তার চোখের কোণে, “…ঠিকমত এনআইডি নাম্বারটা বসাইছিলা তো? কম্পুটারে নাকি আজকাল ভাইরাস…” একদিন অবশ্য টিকা কার্ড এল এবং বাবা সেই সুবহে সাদিকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমরা ভাইবোনেরা কিছুটা আতংকেই ছিলাম - কী জানি কী রিয়াকশ্যান দেখা দেয়, তাই একটু সবুর করতে চাইছিলাম! কিন্তু বাবা টিকা দিয়ে এসে সময়মত নামায পড়লেন, আহার সারলেন, এবং ঘুমোলেন। আমরা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। কিন্তু দিন দুয়েক না যেতেই আবার আমাদের অস্থির হতে হল, এবার টিকার দ্বিতীয় ডোজের জন্য তোড়জোড়। এরপর তা চলতেই লাগল … তৃতীয় ডোজ, চতুর্থ …।
বাবা এভাবে বেঁচে ছিলেন, বা, বলা ভাল, মৃত্যুকে সাফল্যের সাথেই ঠেকিয়ে রাখছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর সাথে লড়া সহজ কথা নয়, চিরদিন লড়া যায়ও না! বাবা যতই দিন যাচ্ছিল, স্বাস্থ্যহীন হচ্ছিলেন। তার শরীর ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিল। যেখানে হাঁটাকে তিনি করে নিয়েছিলেন জীবনের একমাত্র ব্রত, সেখানে মসজিদে যেয়ে নামাযটুকু সারতে পারছিলেন না, বাজার যাওয়া তো দূরের কথা। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, বল পাচ্ছেন না। যে ব্যাঞ্জন তিনি সাব্যস্ত করে নিয়েছিলেন নিজের জন্য, তাও আর মুখে তুলতে পারছিলেন না। মা জোর করলে বলতেন, “পেডে গন্ডগোল!”
বাবা কী যত্ন নিয়েই না স্বাস্থ্য ভাল রাখার খবরগুলি পড়তেন, টিভিতে ‘আপনার ডাক্তার’ প্রোগ্রামটা কখনোই মিস্ হত না তার। কিন্তু এখন তিনি আর ড্রইইংরুমেই বসেন না, শিয়রেও থাকে না কোন পত্রিকা বা বই। জিজ্ঞেস করলে বিড়বিড় করতে শোনা যায়, “চোখ জ্বালা করে, পানি পড়ে।“ ঘরের দেয়ালে বা ফার্নিচারে কোন খুঁত দেখা দিলে, তিনি হাতুড়ি, বাটালি নিয়ে নেমে পড়তেন। বলা যায়, তিনিই ছিলেন আমাদের বাসার রাজমিস্ত্রি! এখন ভাঙ্গা চেয়ার আর সোফাগুলো মলিন ব্যাদানে তাকিয়ে থাকে, আর বাবা খালি ঝিমান; কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই বলেন, “হাত-পা কাঁপে!“
বাবার মুখটা যেন এই সময় বয়সের তুলনায়ও বেশী কুঁকড়ে যেতে থাকে। তার চামড়া এতটা ঝুলে যায় যে, কখনো ভূত দেখার মত চমকে উঠতে হয়! যিনি সারাজীবন লিখে গিয়েছেন সরকারী বড় বড় রেজিস্টারগুলোতে, তার হাতের আঙ্গুলগুলো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে থাকে। একটা সময় ছিল, রাতে উত্তম সূচিত্রর সিনেমা না দেখে তিনি ঘুমোতে যেতেন না। আর সে কি ভলিউম! আমরা কেউ ঘুমোতে পারতাম না, কিছু বলতেও পারতাম না। এখনো অবশ্য আমরা ঘুমোতে পারি না, কারণ প্রতিদিনই তার একটা না একটা ‘যায় যায়’ অবস্থা তৈরী হয়!
এরই মাঝে একদিন খবর এল, বাবার এক বাল্য বন্ধু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। আমরা সবাই ভয় পাচ্ছি, বাবা হয়ত খবরটাতে আরো ভেঙে পড়বেন। কিন্তু বাবা যেন হঠাৎ শরীরে বল ফিরে পেলেন, আর হাতে ফোনটা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বললেন বন্ধুর সাথে। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সটান বন্ধুর বাসায় গিয়ে হাজির হলেন। যৌথ স্মৃতিতে থাকা মজার গল্পগুলোকে তুলে এনে তাকে সাহস দানের পাশাপাশি অনেক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ প্রদান করে প্রায় একটি দিন কাটিয়ে বাবা যখন ফিরে এলেন, তখন তাকে এক তরতাজা যুবকের মতই লাগছিল। কিন্তু কদিন যেতেই বাবা আবার নির্জীব হয়ে পড়লেন, চোখ-মুখ-হাত-পা-অংগ-প্রত্যংগ সব শুকোতে লাগল পাল্লা দিয়ে!
এই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখা সম্ভব ছিল না! আগেই বলেছি, বাবার মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার মিশনে বাবার সাথে আমরাও ছিলাম। তো সেই মিশনের অংশ হিসেবেই একদিন কক্সবাজারে সমুদ্র পাড়ে একটি স্বাস্থ্যনিবাস দিন পনেরোর জন্য ভাড়া করলাম। ভাবলাম, বাবা বুঝি সমুদ্রের বাতাসে তাজা হয়ে উঠবেন। কিন্তু প্লেন থেকে নামার পর সেই যে বাবা বিছানায় গেলেন, এরপর হাজার বলে কয়েও তাকে সি-বিচে একটুখানি হাঁটার জন্য নিয়ে যাওয়া গেল না। বাবার কন্ডিশন শুধু খারাপের দিকেই যেতে লাগল; এমনকি চোখ-মুখ খুলে সাড়া দিতেও যেন কষ্ট হতে লাগলো তার!
সমুদ্রের বাতাস হু হু করে বয়ে যেত আমাদের ঘিরে, আর অজানা সব আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠত আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়! এই রকম যখন দিন কাটাচ্ছিলাম, একদিন একটি সংবাদ এল। বাবার সেই বন্ধুটি, মানে, সেই যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত চলে গিয়েছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আমরা শিউরে উঠলাম! একদিকে বাবার এই অবস্থা, অন্যদিকে বাল্যবন্ধুর চিরবিদায়।
তাকে জানানো উচিৎ হবে কিনা এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে লম্বা বৈঠকে বসল পরিবারের সদস্যরা। খবরটা না জানানোর পক্ষেই জোরাল মত ছিল। তবে একটা বিষয় আমাদের খুব ভাবালো - আমরা না হয় খবরটা চেপে যেয়ে বাবার মৃত্যুটাকে বিলম্বিত করলাম, কিন্তু অন্তর্যামীকে তো আর চেপে যাওয়া যাবে না। আমাদেরও যখন মৃত্যু হবে, আর দাঁড়াতে হবে সৃষ্টিকর্তার সামনে, তখন তিনি এই চেপে যাওয়া বিষয়টি নিয়ে আমাদেরই চেপে ধরবেন না?
বাবাকে যখন শেষমেশ বলা হল, তখন প্রথমে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল; আমরা বুঝতেই পারছিলাম না খবরটা ঠিকঠাক পৌঁছুলো কিনা! কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি উঠে বসলেন, আর ‘ইন্নালিল্লাহি’ দোয়াটা তিনবার পড়ে ফেললেন। এবার আর তার কণ্ঠ ঘোলাটে ছিল না। অচিরেই তিনি জানতে চাইলেন - কখন ঘটনাটা ঘটেছে…কোথায় ঘটেছে…কোথায় কবর দেয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সবটা মনযোগ দিয়ে শোনার পর কারো সাহায্য ছাড়া একা একাই বাথরুমে চলে গেলেন তিনি, এবং অনেকটা সময় নিয়ে ওযু করলেন। তারপর জায়নামাজে বসে দীর্ঘ সময় নিয়ে নামায পড়লেন। বন্ধুর জন্য যখন দোয়া করছিলেন আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে, তার দুচোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এসেছিল, আর চিক্ চিক্ করছিল জায়নামাযের মখমল!
ঠিক কতদিন পর বাবা বিছানা ছেড়েছিলেন মনে নেই, কিন্তু সেদিনের পর অমন বিছানামুখি আর বাবাকে দেখিনি! হাত- পায়ে পুরো বল পাচ্ছেন এখন, চোখ আর জ্বালা করছে না, পেট রয়েছে শান্ত। তিনি এখন ফরয নামাযগুলো মসজিদেই আদায় করেন আধা কিলো পথ হেঁটে, নিয়ম করে তার ব্যাঞ্জনগুলো সেবন করেন, ড্রইয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়েন, আর বাসার ফার্নিচার বা দেয়াল বা গৃহস্থালি উপকরণে কোন গোলমাল দেখা দিলে হয়ে পড়েন মিস্ত্রি।
আজকাল বাবাকে যত দেখি, ততই অবাক হই! আর মনে হয়, বাবা নিজেও ব্যাপারটা জানেন যে তিনি পুরোই জীবিত এখন, আগের মত মৃত নন!
(সমাপ্ত)
…………………………………….
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।