যোনি কাকে বলে জানিস?
জানি-জানি, বললো অমিত, রোজ একঘেয়ে লেকচার শুনে-শুনে ওসব আংরেজি তাকিয়া-কালাম মুখস্হ হয়ে গেছে, ইসকুলে যদি রোজ কেউ অমন লেকচার দিতো তাহলে দেখতে, সব সাবজেক্টে চৌয়া-ছক্কা পেটাতুম।
বল তাহলে, কাকে যোনি বলে?
ওফ অনেক আংরেজি ঝালরবাজি, মানে-ফানে জানি না, সব ক্রান্তিকারী ঘসিটারাম, বলছি শোনো, অ্যালিয়েনেশান, অ্যাণ্টাগনিজম, অ্যারিসট্রোক্র্যাসি, বারটার, বুর্জোয়াজি, বুরোক্র্যাসি, ক্যাপিটাল, ক্যাপিটালিজম, ক্লাস, কমোডিফিকেশান, কমোডিটি, কমোডিটি ফেটিশ, কনজাম্পশান, প্রোডাকশান, কনট্রাডিকশান, ক্রেডিট, ডেমোক্র্যাসি, ডায়ালেকটিকাল মেটেরিয়ালিজম, ডায়ালেকটিকস, ডিভিজন অফ লেবার, ইকুইভ্যালেন্ট ফর্ম, এমপিরিসিজম, এক্সচেঞ্জ ভ্যালু, ইউজ ভ্যালু, ফল্স কনশাসনেস, ফিউডাল সোসায়টি, গ্লোবালাইজেশান, হেজিমনি, ইনটারেস্ট, আইডিওলজি, লেবার পাওয়ার, লুম্পেন প্রলেতারিয়েত, ল্যাণ্ড, মারকেট, মেটেরিয়ালিজম, মিনস অব প্রোডাকশান, মিডল ক্লাস, মোড অফ প্রোডাকশান, মানি, নেশান স্টেট, পিজ্যানট্রি, পেটি বুর্জোয়া, পলিটিকাল ইকোনমি, প্রোলেতারিয়েত, প্রপারটি, প্রফিট, রেন্ট, র্যাডিকাল ডেমোক্র্যাসি, সোশালিজম, স্টেট, সাবলেশান, সুপারস্ট্রাকচার, সারপ্লাস ভ্যালু, সিনথেসিস, প্র্যাকসিস, ট্রেড ইউনিয়ান, ট্রাইবাল সোসায়টি, ইউজুরি, ইউটিলিটেরিয়ানিজম, ইউটিলিটি, ইউটোপিয়া, ওয়েজ লেবার।
এক নাগাড়ে বলে দম ফুরিয়ে গিয়েছিল অমিতের, কাতলা মাছের মতন জলের ওপরে ওঠার ঢঙে শ্বাস নিয়ে বলল, কী, ঠিক বলিনি? আরে সব তাকিয়া-কালামের মানে ওই একই, যাহাঁ সঠিয়া তাহাঁ ঘটিয়া, যোনি বলো আর আলুকাবলির ঘুগনি বলো।
কিস্যু জানিস না তাহলে, অবশ্য শব্দ না জানলেও চলে, কাজটা জানলেই হলো, বললে কমরেড ডিবি বা ডাক্তার বর্মণ বা ডাক্তার ঘোষ।
ধুলো-পড়া কালো পলিথিন-তেরপল দিয়ে তৈরি, ঘনসবুজ জংলি বাঁশঝোপের ঝিরিঝিরি আড়ালে ঘেরা, মাথায় বিকেলের রোদমাখা শাল শিশু খয়ের গাছের মাঝখানে সামান্য ফাঁকা জায়গায়, তাঁর ভ্রাম্যমাণ ডাক্তারখানায় , ওষুধ আর আঘাতের রক্তের ফেলে যাওয়া ভিনিভিনি গন্ধে, জঙ্গলের বুনো প্রকৃতিকে অস্বীকার করার প্রয়াসের মাঝে, আসন্ন গোধূলির ঝিঁঝিপুরুষের ডাকে উতরোল প্রায়ান্ধকারে তাঁর সামনের ফোল্ডিং চেয়ারে তাঁর স্ত্রীর গর্ভজাত ছেলেকে বসিয়ে, প্রশ্নটা করলেন ডাক্তার ঘোষ, যাঁকে সকলে ডাক্তার বর্মণ বা কমরেড ডিবি বলে ডাকে, কেননা ওঁর স্ত্রীর নাম মানসী বর্মণ বা কমরেড জ্যোতি।
প্রশ্নটা করার জন্য বেশ কিছুকাল যাবত নিজেকে তৈরি করেছে কমরেড ডিবি, মানে ডাক্তার, নিজের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে নির্ণয়টা নিয়েছে, আর এখন, আজকেই সুযোগ, মনে হল, কেননা ওর স্ত্রীর গর্ভের ছেলের তাঁবু-গার্জেন, যে কিনা ছেলেটার বাবা হিসাবে ক্রান্তিকারীদের মধ্যে প্রচারিত, মানে কমরেড দীপক, প্রকৃত নাম অতনু চক্রবর্তী, পাশের তাঁবুতে যাঁর ক্রান্তিকারী দপ্তর, অতনু আর তার প্রেমিকা কমরেড জ্যোতি, মানে ডাক্তার বর্মণের স্ত্রী মানসী বর্মণ, দুজনেই কাছাকাছি বিধাবৌড়িয়া গ্রামে সিআরপিএফ-এর গুলিতে আহত তরুণ-তরুণীদের জমায়েতে গিয়েছে, কিছুক্ষণেই হয়তো এসে পড়বে।
নিজেকে স্তোক দেয় ডাক্তার, মানে, কমরেড ডিবি : সকলেই জীবনে অন্তত একটা মিথ্যাকে আশ্রয় করে বাঁচে, অনেকে একাধিক মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকে জীবনভর, আমি না-হয় একটাই।
দোহারা, ফর্সা, সামান্য টাক, বাইফোকাল চশমা, অলিভ-মুফতি বোতামখোলা শার্ট, গেঞ্জি নেই, ডাক্তার পরে আছেন লুঙ্গি, যার রঙ বাগবাজার ক্লাবের দেয়ালে গত বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ে আঁকা ব্রাজিলের পরাজিত জার্সির মতন, কালবৈশাখীর ফ্রি-কিক ভলি খেয়ে ফ্যাকাশে। নিজেকে নিজে নিঃশব্দে শুনিয়ে বললে, এখানে আর থাকা যাবে না, এ আমার স্বপ্নের ক্রান্তিকারী রাস্তা নয়, কেউই কোথাও পৌঁছোচ্ছে না। অবিচারের মধ্যে দিয়ে অবিচারের বিরুদ্ধে লড়া যায় না।
ব্যাস, ওইটুকুই জানিস। ওটুকু তো যোনির রস রে, ক্রান্তির ঝর্ণা। তুই তো আসল অরগ্যাজমের কথা বললি না? শেখায়নি তোর সোকলড মা-বাপ? অরগ্যাজম জানিস তো, নাকি? রিয়াল ক্রান্তি? শরীর আর মনের সুনামি, জিগ্যেস করলে ডাক্তার।
না, জানি না, সুনামি শুনেছি কোথাও, এখন যা আংরেজি বললুম, তা কনকদুর্গা শিখিয়েছে, বলেছে মুখস্হ করে রাখ, পরে বুঝতে পারলে আওড়াস। অ্যালুমিনিয়ামের নড়বড়ে চেয়ারে নড়াচড়ার মাধ্যমে অপ্রস্তুতভাব লুকোবার চেষ্টা করে, ডান হাতের মধ্যমার নখ খেতে-খেতে বলল অমিত বর্মণ যে, ওর বোন মানে প্রেমিকা ইতুকে ছত্তিশগড়ের রায়পুরে, নারায়ণপুর যাবার নৌকরওয়ালা বাসে তুলে দিয়ে, সেখানেই একটা আয়নাভাঙা সস্তা সেলুনে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিল; চুলদাড়ি আর রাখবে না ঠিক করেছে।
ইতু পাছা অব্দি দীর্ঘ কোঁকড়াটে চুল ববছাঁট করিয়ে নিলে, বাড়ি ছেড়ে উধাও হবার সময়ে নিজের খাটে চুলের কাটা আংশ দুজনের একসঙ্গে বাড়ি থেকে কেটে পড়ার গর্বোদ্ধত ইঙ্গিত হিসাবে ফেলে রেখে। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাসের তাপ দিয়ে, অমিতই কেটে দিয়েছিল ইতুর চুল, কেননা ইতু বলেছিল, যা আমার গর্বের, তা কেটে বাদ দিয়ে দে, যতটা পারা যায় গর্বহীন করে তুলি বেঁচে থাকাকে।
জানিস না কী রে! জোয়ান ছেলে, সমাজে ক্রান্তি আনার জন্য রোজ কতো পাঁয়তাড়া ভাঁজছিস, আর অরগ্যাজম কাকে বলে জানিস না? ডাক্তার ঘোষ ওরফে ডাক্তার বর্মণ, যে প্রায় প্রাগৈতিহাসিক আড়ম্বরহীনতায় বসবাস করে, বসে আছে অ্যালুমিনিয়ামের ফোল্ডিং চেয়ারে, জেনেশুনে, যে কমরেড জ্যোতি লুঙ্গি পরা বরদাস্ত করতে পারে না; সামনে এক ফুট চওড়া দু ফিট লম্বা হালকা অ্যালুমিনিয়াম টেবিল, সেটাও ফোল্ডিং, ফোল্ডিং খাটে টাঙানো মশারি চব্বিশঘন্টা পাতা, খাটে একটা চাদর, বালিশ নেই।
কিছুক্ষণের নোটিসেই পুরো পাত্তাড়ি গুটিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে তেরপল খাটাবার সুব্যবস্হা হিসাবে সব কিছুই ফোল্ডিং আর অস্হায়ী, ডাক্তার নিজেও নিজেকে পাটে পাট ভাঁজ-করা মানুষ বলে মনে করে, অস্হায়ী। প্রতিদিন উঠে পড়ে ঘষাকাচ ভোরে, তবু তখনই মশারি থেকে বেরোয় না। তাঁবুতে সৌরলন্ঠন আর ব্যাটারিলন্ঠন দুইই আছে, পোকাদের অনাহুত উড়াল আর ডানাসঙ্গীতের ভয়ে জ্বালে না সচরাচর।
বাংলা কথনি? না সংস্কৃত? হিন্দিতে কী? নখ খাওয়া মুলতুবি রেখে জানতে চাইল অমিত।
হিন্দি আর সংস্কৃততে ইয়োনি আর বাংলায় যোনি, সেই যোনি যখন মুগ্ধ হয় তখন তাকে বলে অরগ্যাজম, আসল ক্রান্তি, ডিকটেটরশিপ অব দি রেজিং ফ্লেশ, বুঝলি, বললে ডাক্তার, ওছাড়া বাদবাকি ক্রান্তি ফালতু, বুকনির বাতাসা, অরগ্যাজমের বাংলা নেই, হয়তো বাৎসায়নে সংস্কৃততে আছে, ঠিক জানি না।
নাঃ, কোনো ক্লাসের বইতেই কথনিটা ছিল না; ক্লাসমেটরাও কখনও বলাবলি করেনি; কী করেই বা জানব! তাছাড়া আমাকে তো সবচে রদ্দি স্কুলে পাঠানো হয়েছিল : গাঁঠরিচোর টিচাররা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে, নিজের ভাই হলেও ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না, নিজেরাই কিছু জানে না, সব রগড়ঘস, টিউশানির চকরলস কেটে বেড়ায়। কোনো টিচারের মুখেও শুনিনি কথাটা। বাংলা তো আর পড়ানো হয় না কোনো স্কুলে; সংস্কৃতের টিচার নেই। হিন্দি টিচার আছে, সেও কখনও ইয়োনি কথাটা ব্যবহার করেনি।
টিচাররা অমন শব্দ বলে না, বুঝলি, টিচাররা কি ছাত্রদের ক্রান্তির কথা শেখায় কখনো, গোরু হতে শেখায়, চাকরি-বাকরি করে লিটার-লিটার দুধ দেবে, জেইই, আইআইটি, আইআইএম, রাজস্হানি কোচিং, ধাঁআআআ, নিউ ইয়র্ক। যোনি, অরগ্যাজম যে ধরণের ক্রান্তিকারী বুলি, যাকে তুই কথনি বলছিস, দশ-বারো বছর বয়স থেকে বন্ধুবান্ধবরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে। টেবিলের ওপর বাইফোকাল চশমা খুলে রাখতে রাখতে বললে ডাক্তার ঘোষ, মানে কমরেড ডিবি; কণ্ঠস্বরে স্বনিত হল এক ভিন্ন সুর, নিজেকে বললে, চশমাটা বদলানো দরকার, কিন্তু কী-ই বা হবে বদলে, বদলাতে হলে চোখ দেখাতে হবে, হয়তো নাম ভাঁড়িয়ে, দূরের কোনো রাজ্যে গিয়ে, সে অনেক হ্যাঙ্গাম, যা পোষায় না। প্লাসটিক লেন্সের চশমা, স্ক্র্যাচ পড়ে লেন্সদুটো নিজেরাই মায়োপিয়ায় আক্রান্ত।
ডাক্তার, কমরেড ডিবি, এখন হাত দিয়ে তাকায়, চোখের প্রয়োজন হয় না, হাত দিয়ে নাড়ি পরখ, হাত দিয়ে ওষুধের বড়ি বের করা, হাত দিয়ে ঘায়েল শরীর থেকে বুলেট বের করা, হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। হাত যে নারীকে আদরও করতে পারে তা ভুলে গেছে হাতেরা। হাতদুটো ওর মতনই হয়ে গেছে, রুটিনবাঁধা। নতুন ওষুধের জন্য মেডিকাল ম্যাগাজিন পড়া জরুরি বলে কমরেডদের আদেশ দিয়ে ভারতীয় মেডিকাল জার্নাল আনায়, ইংরেজি জানে এমন কাউকে পড়তে বলে আর শুনে-শুনে মনে রাখে, কিংবা নিজেই পড়ে নেয়, এখানে তো মেডিকাল রিপ্রেজেনটেটিভ এসে ওষুধের বাখান করে ডাক্তারকে এটা-সেটা ঘুষ দিয়ে যাবে না, জার্নাল পড়া হয়ে গেলে ওষুধের জেনেরিক নামগুলো স্মৃতির আলমারিতে তুলে রাখে, তারপর ম্যাগাজিনগুলো সমবায়িক রান্নার উনোনে পোড়াতে পাঠিয়ে দেয়; ওষুধের কেবল স্ট্রিপ আনায়, বাক্সে প্যাক করা নয়, কাগজে মোড়া।
টেবিলের ওপর পড়ে আছে আগের বছরের মেডগেট টুডে আর ইনডিয়ান জার্নাল অফ মেডিকাল সায়েন্সের সংখ্যা, অতিব্যবহারে ময়লা, পাতাগুলো নিজেরাই কোনাগুলো ভাঁজ করে আরাম করছে। সকাল থেকে দুপুরের খাওয়ার রুটিন বাদে বেশির ভাগ সময় মশারিতে ঢুকে শুয়ে থাকে, ম্যাগাজিন পড়ে, রোগীরা এলে বা কোনো বেয়ারফুট কমরেড কিছু জানতে এলে মশারির ভেতর থেকেই নির্দেশ দেয়, কেবল ঘায়েল কমরেড এলে ওর দৌড়ঝাঁপ হয় দেখার মতন, বিশেষ করে সে যদি বুলেটফোঁড় হয়, যেন ওর কাছে পাঠাবার জন্যই আধামিলিট্রি জওয়ানরা রাইফেল চালিয়েছিল।
মানুষকে বাঁচিয়ে আবার জীবনের লাথি খেতে পাঠানোর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর নেই, মনে করে কমরেড ডিবি, যাকে কমরেড বললে মনে-মনে চটে যায় বটে, কিন্তু মৃদূ শ্লেষহাসিতে মনের অন্ধকার দমিয়ে রাখে লোকটা।
বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আমি কোনো ক্লাসেই পাইনি, পাড়াতেও কেউ বন্ধু করতে চায়নি; নিজের বাড়িতেই বোলতিবন্ধ ফেকলু, ওরা তো দেখতেই পেতো, বন্ধু করবে কেন, তাই ভিতরঘুন্না হয়ে বড়ো হয়েছি! বন্ধু বলতে শুধু ইতু। চেয়ারে দুই পা তুলে হাঁটু মুড়ে বসতে বসতে বলল অমিত।
নামিয়ে রাখলে অমিতের পা নাচাতে ইচ্ছা করে। সামনে যে বসে আছে সে মনে করে ওর পায়ে ব্যথা, ইতুও তাই মনে করে বলত, এই ডাফার, পা নাচাসনি, পা ব্যথা করছে তো পা তুলে বোস। পা নাচানোটা ওর অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার উপায়। পা নাচাতে নাচাতে জিন্সের ঘসটানি খেয়ে বসন্তকালের হাওয়ায় ওর লিঙ্গ দাঁড়াতে আরম্ভ করেছিল বলে থামিয়ে চেপে বসল। বলে উঠলো, দাঁড়াও দাঁড়াও, মনে পড়েছে, একটা কাগজে লিখে নিয়ে মুখস্হ করেছিলুম, এক্ষুনি মনে পড়ে গেল। বলব?
ডাক্তার হাই তুলতে তুলতে বললেন, বল, দেখি অরগ্যাজম বলতে কী বোঝায়, জানিস কিনা।
অমিত যতক্ষণ নিজের মগজে মুখস্হ করছিল, ডাক্তার একটা বাংলা লিফলেট টেবিল থেকে তুলে নাকের সঙ্গে সাঁটিয়ে, পড়া আরম্ভ করলে, বোধহয় ওষুধের মোড়কে এসেছিল, চোখ কুঁচকে, টাকে হাত বোলাতে বোলাতে, পড়তে বেশ ভালোই লাগছিল, সরেস লিখেছে, লাথি খাচ্ছে আর লিখে যাচ্ছে ব্যাটা বাঙালির দল, লেখা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই, “সম্প্রতি রাজ্যে রামনবমীতে তরোয়াল নিয়ে শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অস্ত্র নিয়ে মিছিল বাঙালি সংস্কৃতি নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধংদেহী মেজাজে নগরের মিছিল শাসক থেকে আম জনতাকে বিস্মিতই করেনি, পাল্টা কিছু করতে শাসক দলকে প্ররোচিতও করেছে। রাজ্যের শাসক দল রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী পালন করেছে। এলাকায় এলাকায় হনুমানের প্রতিকৃতি নিয়ে শোভাযাত্রাও করেছে। মিছিল ও পাল্টা মিছিলে ভক্তিরসের তুলনায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিদ্বেষের বীজ বপন করা হয়েছে। এই সংস্কৃতি কোনো কালেই ধর্মগুরুদের সংস্কৃতি নয়, এমনকি বাঙালিদেরও সংস্কৃতি নয়। কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ‘শ্রীরাম পাঁচালী’তে বিষ্ণুর অবতার হলেও সেখানে বীররসের প্রাধান্য ছিল না। ছিল ভক্তিরসের প্রাধান্য। কৃত্তিবাসের কাব্যের মূল সুরের সঙ্গে বৈশাখের গরমে টিনের প্যাঙপ্যাঙে তরোয়াল হাতে ছেলে-মেয়ে বুড়ো-বুড়িদের মিছিল খাপ খায় না। কৃত্তিবাস ওঝার যাঁরা অনুগামী তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গেও এই সংস্কৃতি মেলে না। অথচ কলকাতা মহানগরীতে রামনবমী উপলক্ষে অস্ত্র-মিছিলে কাতারে-কাতারে মানুষজন নগর দাপিয়ে বেড়ালো। কপালে লাল তেলক কেটে, কাঁধে চাদর, হাতে চিৎপুর অপেরার তরোয়াল, আর মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে রোদ্দুরের ভিড়কে মাতালো। বিদগ্ধজন থেকে সচেতন আমজনতা বলছেন, এটি বাংলার সংস্কৃতি নয়, এই সংস্কৃতি উত্তর ভারতের সংস্কৃতি; বিদগ্ধজন মানে যারা অণ্ডকোষ চুলকোয় আর টিভির তর্কাতর্কিতে জ্ঞান দেয়। মিছিলে বাঙালিদের সংখ্যাধিক্য ছিল না। অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। মিছিলে ওড়ানো ঝান্ডাগুলোতেও বাংলা হরফে কিছু লেখা ছিল না, যা লেখা ছিল তা কেবল নাগরী হরফে। সেগুলো সংস্কৃত না হিন্দিতে লেখা তা বোঝার উপায় ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে, এই ব্যাপক জনসমাগম কী ভাবে ঘটল? এঁরা নিশ্চয়ই পাশের রাজ্য উড়িষ্যা বা অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানা বা উত্তরপ্রদেশ থেকে আসেনি। এঁরা সকলেই এই পশ্চিমবঙ্গের। এঁরা বাঙালি হোন বা নাই হোন, পশ্চিমবঙ্গেরই নাগরিক। আমাদের এই রাজ্যে বাঙালি সংস্কৃতির ঘোর সংকট; বাঙালি বলতে যে কী বোঝায় তা বাঙালি নিজেই ভুলে গেছে। বিশেষ করে আমাদের রাজধানী যে কলকাতা, সারা রাজ্যের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কর্মস্হল, খোদ সেখানেই বাঙালিরা এখন সংখ্যালঘু। উনিশ শতকের মতন মনীষীরা আর জন্মান না এই শহরে, শুধু মাস্তান গুন্ডা আর দলদাসরা জন্মায়। কেউ কেউ হয়তো ‘আমরা বাঙালি’ প্রাদেশিকতাবোধে উষ্মা প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু বর্তমান সংস্কৃতি সুকুমার রায়ের ভাষায় ‘হাঁসজারু’ সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। কলকাতার চারিদিক ধরলে মধ্য কলকাতা বরাবরই জারজ সংস্কৃতির কেন্দ্র। এর মধ্যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রভাব কিছুটা আছে। উত্তর কলকাতা বা পূর্ব কলকাতা, বিশেষ করে সল্টলেক, এখন হিন্দিভাষী অবাঙালিদের প্রাধান্য, যা ঘটেছে বাঙালি মধ্যবিত্তের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। বিধান রায় বাঙালিদের জন্য সল্ট লেক কলোনি তৈরি করেছিলেন; বাঙালিরা সেখানে জমি কিনে বাড়ি তুলেছিল, তারপর সেই লোভী বাঙালিরা একে একে মারোয়াড়িদের বিক্রি করে শহরতলির দিকে পেছিয়ে গেছে। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ বামপন্হীদের প্ররোচনায় বাঙালি উদ্বাস্তুরা দখল করে বইয়ের আর নানা জিনিসের দোকান দিয়েছিল; তারা সেসব দোকান অবাঙালিদের বিক্রি করে একইভাবে শহরতলিতে পেছিয়ে গেছে। বাকি রইলো দক্ষিণ কলকাতা, যেখানে উচ্ছিন্ন হিন্দু বাঙালির জীবন সংগ্রামের মূল জায়গা। এককালে মুসলমানরা এই অঞ্চলে চাষবাস করতো, তাদের সরিয়ে, দাঙ্গায় মেরে ফেলে, অজস্র উদ্বাস্তু কলোনি গড়া হলো, সেসব নিয়ে প্রচুর কাঁদো-কাঁদো বেস্টসেলার লেখা হয়েছে। এক সময়ে দক্ষিণ কলকাতার উপনিবেশগুলো থেকে সংসদীয় বামপন্হীরা তাঁদের আন্দোলনের রসদ পেয়েছিলেন, তাঁরা জোর খাটিয়ে আর ভয় দেখিয়ে এই উদ্বাস্তুদের আন্দামানে যেতে দেননি, নয়তো আন্দামান আজ বাঙালি উপনিবেশ হয়ে উঠতো। সেই সমস্ত সংগ্রামের জায়গাও মুছে ফেলে প্রাক্তন উদ্বাস্তুরা জমিবাড়ি অবাঙালিদের বেচে শহরতলিতে পেছিয়ে যাচ্ছেন। বৃহত্তর কলকাতা শহরে এখনও বাঙালিদের প্রাধান্য থাকলেও, দুই প্রজন্ম জুড়ে বাঙালির পোলারা এখন বাংরেজি ও বাংদি -- বাংলা-হিন্দি মেশানো --- সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, হিন্দি ফিল্ম দেখার জন্য হুড়োহুড়ি করে মরে, বেরিয়ে এসে সালমান শাহরুখ আমির খানের সংলাপ ভাঁজে, আনোয়ার শা রোড আর মেটিয়াবুরুজ তো নবাবদের হারেমের বংশধরদের গুণ্ডামিতে থরহরি, তাদের ধারণা তাদের রক্তে বইছে টিপু সুলতান আর ওয়াজেদ আলি শাহের রক্ত। মহরমের সময়ে পাকিস্তানি ধরণের পতাকা উড়িয়ে তাজিয়া বের করে ঝাঁপাই ঝোড়ে। বড়বাজারে বরাবরই মারোয়াড়ি আর গুজরাটিদের রবরবা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় থেকে। হাওড়া শহর দখল করে নিয়েছে বিহারি আর উত্তরপ্রদেশের মাফিয়া, তাদের বিরোধিতা করলেই মুঙ্গরের দিশি পিস্তলের গুলি। সুতরাং বাংলা সংস্কৃতির অবশিষ্টাংশ সত্যিই কি পারবে এই ‘হাঁসজারু’ সংস্কৃতি রুখতে? দেড়শো বছর আগে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখে গিয়েছিলেন, ‘হুতোম পেঁচার নকশা’। রামনবমী বা রামলীলা সম্পর্কে যা বিতর্ক থাকুক না কেন, তা যে বাঙালি সংস্কৃতি নয়, তা তিনিও জানিয়েছেন। রামলীলা সম্পর্কে সেই কবে তিনি বলে গিয়েছেন, এ সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি নয়। বাঙালি সংস্কৃতি জানতে হলে আজও ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ পড়া দরকার।”
পড়া শেষ হলে, যে শব্দটা নিজের মনে নিজেকে শোনাবে ভেবেছিল ডাক্তার, তা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মুখ দিয়ে বেশ জোরেই উচ্চারিত হলো, “মাদারচোদ, গান্ডু কা জনা”।
অমিত চমকে বলে উঠলো, আরে, আমাকে গালাগাল দিচ্ছ নাকি গো? মায়ের সঙ্গে ওইসব করেছিলে বলে আমাকেই নোংরা করে দিচ্ছ!
ডাক্তার বললে, না রে, তোকে বলিনি, ওই চুতিয়াগুলোকে বলছি, যাদের পোঁদে সোভিয়েত দেশ এককালে রুবল গুঁজে দিতো, তারপরে চীন কিছুদিন লাখ লাখ রেমনিমবি ইয়ান গুঁজেছে ওদের পোঁদে, তারপর মার্কিন কোম্পানির মারোয়াড়ি এজেন্টরা গুঁজেছে, গুঁজেই চলেছে, চটকলগুলোর লালবাতি জ্বেলে, বাঞ্চোৎরা পোঁদ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ডুবিয়ে দিল পশ্চিমবাংলাকে, ময়দানে র্যালির্যালা করে ভাড়াটে পাবলিক এনে, আর লাউডস্পিকার লাগিয়ে নিজের নুনু নিজের পোঁদে ; আর কিচ্ছু হবে না, তোর মা-বাপের ক্রান্তিও পাঁক থেকে তুলে আনতে পারবে না। যাকগে, তোর মনে পড়েছে কি অরগ্যাজম কাকে বলে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ে গেছে, কনকদুর্গা আংরেজি মুখস্হ করতে শিখিয়েছে, ওই যে কমরেড কুনকি, অমিত বলা আরম্ভ করলো, ডিকটেটারশিপ অফ দি প্রলেটারিয়েট, ইনটারপেলেশান, মেটাবলিক রিফ্ট, পারমানেন্ট রিভলিউশান, প্রিমিটিভ কমিউনিজম, রিলেটিভ ডিপ্রাইভেশান, রেনটিয়ার ক্যাপিটালিজম, রিভলিউশানারি সিচুয়েশান, আলট্রা ইমপিরিয়ালিজম, বলশেভিক, বোনাপার্টিজম, ক্যাডার, শভিনিজম, ডুয়াল পাওয়ার, ইকোনমিজম, মেনশেভিক, ফ্যাসিজম, মেটাফিজিক্স, নিও লিবারালিজম, অপরচুনিজম, প্ল্যান্ড ইকোনমি, পলিটিকাল স্ট্রাইক, রিঅ্যাকশানারি। বলা শেষ করে গলা ছেড়ে হাসতে লাগলো অমিত, তারপর বললো, বুঝলে, আংরেজি ঝাড়তে পারলে এই জঙ্গলেও কদর বাড়ে। অরগ্যাজমও তো আংরেজি, ঝেড়ে দিলেই হলো সময় বুঝে, লেকচারবাজি আমি পারি না, ওরা কতো শেখাচ্ছে, আমার ভালোই লাগে না, কেন যে এলুম এখানে, ধুৎ শালা, ইসকি মাকা, বুড়মে পেল দেঙ্গে রামরতিয়া চুতিয়াপা।
কমরেড ডাক্তার বললে, অমিতের দিকে তাকিয়ে নয়, আস্তানার বাইরে প্রায়ান্ধকারের দিকে চোখ মেলে, আসল বয়সের আনন্দটাই পাসনি দেখছি। কথা বলাবলিরও আনন্দ আছে, নিজেদের মধ্যে সমবয়সি মেয়েদের নিয়ে ফিসফিস করার, নোংরা হাসাহাসি করার বুক-ঢিপঢিপ আনন্দটাই মিস করেছিস। মেয়েদের নিয়ে ফিসফিস করে কথাবার্তা হতো না? নাইন টেন টুয়েলভে? টাচিফিলি খেলাখেলি? অমিতের দুই পায়ের দিকে তাকিয়ে বললে ডাক্তার ঘোষ, যে, পিঠে ব্যাকপ্যাকে দাতব্য ওষুধ, যা নিজে কখনও খায় না যতই জ্বরজারি হোক, তাতে নিজের সিনথেটিক মশারি ঢুকিয়ে, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ক্যাডারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটে, তাকালো অমিতের দিকে, পেশার গাম্ভীর্যের সঙ্গে কথা বলার শৈলী মিশিয়ে ; বছরের কতদিন হতে চলল এই একটা ছেঁড়া রঙওঠা জিনস পরেই চালিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা, ক্যাডারদের মতন মুফতি পরতে ওর ভালো লাগে না, তা জানে ডাক্তার।
ছেলেটা ওর, মানে ডাক্তার কমরেড ডিবির ছেলে, না অতনু চক্রবর্তীর ছেলে তা মানসী বর্মণ, যে অমিতের মা, সেও নিশ্চিত নয়, ওর বউয়ের ছেলে, তবু ছেলেটা ওর মতই হয়ে চলেছে, যেমন চলছে তেমনই চলুক টাইপের। লোকে বলবে বাপ-ছেলে যেন যমজ ভাই।
এই জীবন নিজে বেছে নিয়েছে ডাক্তার, স্রেফ মানসী বর্মণের খাতিরে। মানসী যেদিন আধামিলিট্রির গুলিতে মরবে, সেদিন ওর ছুটি। ডাক্তার নিজেও উড়িয়ে দিতে পারে মানসী বর্মণ আর ওর বিয়ে-না-করা বর অতনুকে, নাইন এম এম একটা লোডেড থাকেই ওর কাছে, সাইলেন্সার লাগানো, যাতে আধামিলিট্রির কাছে আত্মসমর্পণ করতে না হয়। কিন্তু মানসী মরে গেলে বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য থাকবে না, মানসী তা জানে, তাই অস্তিত্ব দিয়ে আটক করে রেখেছে ডাক্তারকে।
অমিতকে ডাক্তার বললে, কী হলো? কী জিগ্যেস করেছিল, সেটা মনে করার চেষ্টায় বললে, কী হলো ।
নাঃ, জানি না, হতো হয়তো, আমার সঙ্গে হয়নি। যাকগে যাক, তুমিই বলো না যোনি আর অরগ্যাজম ব্যাপারগুলো আসলে কী, আর কেনই বা জিগ্যেস করছ, আমাকে এই ক্যাম্পে বাবা-মা আর ক্যাডাররা যা শিখিয়েছে, তা তো এতক্ষণ বললুম, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি বিশ্বাস করোনি। জানতে চাইল অমিত, চেয়ারে বসে হাঁটু নাচাতে নাচাতে, লিঙ্গকে কাবু করে পোষ মানিয়ে নিয়েছিল।
সেক্স করেছিস কোনো মেয়ের সঙ্গে? আই মিন কোনো ছেলের সঙ্গে করিসনি বলেই মনে হয়, বিহারে অবশ্য লালটুস ছাত্ররা হোমো টিচারদের পাল্লায় পড়ে। ডিজিটাল সেক্স হোক বা রিয়াল পেনিট্রেটিভ সেক্স, করেছিস কোনো মেয়ের সঙ্গে? কথাগুলো বলতে বলতে নিজের কাছে হাসলো, কমরেডরা ওকে সাধুসন্ত মনে করে, সংসারত্যাগী সংসারী-ক্রান্তিকারী। অন্তর্লীন হাসি, যা মুখে ফোটে না সচরাচর। কেবল তখনই মুখে মৃদু হাসি খেলে যায় যখন কোনো উপজাতি তরুণ বেয়ারফুট ডাক্তার হবার জন্য ডাক্তারের কাছে প্রথমদিন শিখতে আসে। হবু শিক্ষার্থীকে প্রথম প্রশ্ন, ‘ইমপিরিয়ালাইস্টস, কমপ্রাডর বুর্জোয়াজি আর ফিউডাল লর্ডস কাকে বলে জানিস’, আর সে, বলা কথাই যে শোনেনি, ঘাড় নাড়ে, ডাক্তার ঘোষ তাকে মাথায় হাত রেখে আদর করে বলে ‘ভালো ডাক্তার হবি তুই’।
ডিজিটাল? সেটা কী? থুতনি ওপরে তুলে প্রশ্ন করল অমিত।
গণিত নয়, ইলেকট্রনিক্স নয়, আঙুল আঙুল, তর্জনী, এই দ্যাখ, এই আঙুলটা, ঢুকিয়ে। রাশভারি কণ্ঠস্বর ডাক্তারের।
ওসব জানতে চাইছ কেন? ওর সঙ্গে তোমাদের ক্রান্তির সম্পর্ক আছে নাকি? জিগ্যেস করল অমিত, ডান হাতের কড়ে আঙুলের নখ খেতে-খেতে। নখের টুকরোটা থুঃ করে ফেলে বলল, যোনি নিয়ে আমার হবেটাই বা কি, আমি তো ক্রান্তি করতে আসিনি! সুযোগ বুঝলেই কেটে পড়ব, তোমার পিস্তলটা গেঁড়িয়ে।
তোমাদের মানে? তোর বাপ-মা তো তোকে রাইফেল আর পিস্তল চালাতে শিখতে পাঠায় মাঝে-মধ্যে। তুইও তো একজন ক্রান্তিকারী! আমি তো ক্রান্তিকারী নই ; আমি ওদের, হো-মুণ্ডা-সাঁওতাল, বিরহোর-কোরওয়া-মাহলি আর মাড়িয়া-গোণ্ড-লোহরা চিকবারিকদের ডাক্তার।
বাপ-মা? ওনারা? তোমার বউ আমার মা, আর তোমাকে আমার মা বিয়ে করেছিল, তা-ই তো জানি।
কিন্তু তোর মা যার সঙ্গে সেক্স করে তোর জন্ম দিয়েছিল সে তো কমরেড দীপক, আই মিন অতনু চক্রবর্তী, আমি নই। তোর মার সঙ্গে সেক্স করে আমি যে বাচ্চাটার বাবা হতাম সে তো জন্মাবার আগেই মারা গিয়েছিল বলে শুনেছি।
অমিত ছেলেটা তারও হতে পারে, অতনুরও হতে পারে, কিন্তু অমিতের জন্মের কাহিনি যেভাবে চাউর করা হয়েছে, সে গল্পকে অমিতের মনে চারিয়ে আপাতত সন্দেহে ভারাক্রান্ত হতে দিলো না ডাক্তার।
তোমাকে বিয়ে করলেন আর প্রেমে পড়লেন ওই লোকটার! সেক্স করার ছিল তো সেক্স করলেই হতো, আমাকে জন্ম দেবার কি দরকার ছিল? টোপি পরে নিলেই হতো, ইতু বলেছিল টোপি পরে করলে বাচ্চা-ফাচ্চার জুঠঝামেলা হয় না।
তোকে জন্ম দেবার জন্যই সেক্স করেছিল, বুঝলি, তুই হলি ওদের ভালোবাসার ফসল, ভালোবাসার প্রতীক, রাশিয়া চীন কিউবা ভিয়েৎনামে এই ধরণের অনেক প্রেমের গল্প আছে, বললো ডাক্তার, যে আজও বুঝে উঠতে পারেনি, কেন দুজনের সঙ্গে ইচ্ছানুযায়ী সেক্স করতো ওর স্ত্রী, অথচ ওকে ডিভোর্সও দিতে চায়নি, কেননা মানসী বর্মণ বা কমরেড জ্যোতি বলেছিলো, আমার দুজনকেই চাই, আমি তোমাদের দুজনকেই ভালোবাসি, শুধু একজনকে নিয়ে আর থাকতে পারবো না, দুজনের কেউ একজন যদি আমাকে ছেড়ে যাও তাহলে আত্মহত্যা করে নেবো, সে অনেককাল হলো।
ফিল্মি তক্কো দিও না। এদিকে ক্রান্তি করছি আবার ভালোবাসাবাসিও করছি, হ্যাক থুঃ। হ্যাক থুঃ করলেও, থুতু ফেলল না অমিত, গলা শুকিয়ে এসেছে বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিল। টেবিলের ওপর থেকে দুশো এমএল জলের বোতল এগিয়ে দিলো ডাক্তার ঘোষ। এক ঢোঁক খেল অমিত, জেনে গেছে যে জল এখানে, জঙ্গলের ভেতরে, মহার্ঘ।
ক্রান্তির সঙ্গে ভালোবাসার কোনো বিরোধ আছে নাকি রে? ভালোবাসাবাসি কোনো ইজম নয়। ওটার জন্যেই মানুষরা জন্তু-জানোয়ার বা কীটপতঙ্গ হয়নি, মানুষ হয়েছে। এখন তোর বয়স কম, তাই জেনে রাখ, ভালোবাসা হল মানবজীবনের মিথ্যেগুলোর প্রধানতম।
আবার জ্ঞান দিচ্ছ, ভঁয়সালোটন টিচারদের মতন। টিচাররা যা বলে নিজেরা তা মানে না, ক্লাস ফোর থেকে দেখেছি। বলে এক করে আরেক। ওই তোমার বউ আর তোমার বন্ধুর মতন।
তা তুই সেক্স করেছিস কিনা বললি না তো।
তুমিও তো বললে না যোনি কাকে বলে।
আগে বল সেক্স করেছিস কি না।
করেছি।
রেডলাইট এরিয়ায় যাসনি তো? গিয়ে থাকলে ব্লাড টেস্ট করিয়েছিস? আমার কাছে যে ব্লাড টেস্ট কিট আছে তা দিয়ে যৌনরোগ ধরা পড়ে না। একটু থেমে বললো, নাঃ, কী করেই বা যাবি, সেখানে তো টাকা ছাড়তে হবে, আর তুই বলছিস তুই ছিলি ইতুদের বাড়ির চাকরের মতন।
ফিরকি নিও না; কি আবোল তাবোল বকছ। যারা আমাকে ভালোবেসেছে আর আমি যাদের ভালোবেসেছি তাদের সঙ্গে সেক্স করেছি।
তাদের ফেলে পালিয়ে এলি এই জঙ্গলে?
না, তাদের প্রথম জনকে তোমরা ছত্তিসগড়ের অবুঝমাড় জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছ, ডাক্তারি করার জন্য, ক্রান্তিকারীদের রোগ-জখমের চিকিৎসা করার জন্য।
ইতু? ইতু ঘোষ তোর প্রেমিকা? সে তো তোর বোন হয়, তার সঙ্গে সেক্স করলি।
বোন আবার কোথায়। তবে ইতু বলেছিল যে ও যদি আমার নিজের বোন হতো তাহলেও আমাকে ভালোবাসতো, আমার সঙ্গে সেক্স করতো। আমি কিছুই করতে চাইনি। ইতুই যাবার আগে আমাকে ওর ভার্জিনিটি উপহার দিয়ে গেল, ও-ই বলেছিল যাবার আগে আমাকে আমার প্রাপ্য দিয়ে যাচ্ছে। ও কিন্তু প্রিকশান নিয়েছিল। ভার্জিনিটি, উপহার, প্রাপ্য, প্রিকশান এইসব কথা ইতুর, আমি জানতুমই না এগুলো কী ব্যাপার! আরেকজন এখানেই আছে, কনকদুর্গা, কমরেড কুনকি, ছবিলি নম্বর ওয়ান।
এবার বুঝেছি। শুনলে কেমন যেন কাব্যি-কাব্যি মনে হয়।
কী বুঝেছ?
ইতুকে তোকে দিয়ে ফুসলিয়ে কেন অবুঝমাড়ের জঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়া হল। কনকদুর্গা কি করে তোর প্রেমে পড়ল রে? আগে ইতুর গল্প করি, তারপর কনকদুর্গার করব, কী বল?
কেন? ইতু তো মানুষের সেবার জন্যে নিজেই গেল। ফোসলাবো কেন? আর কনকদুর্গাকেও আমি ফোসলাইনি, ও একদিন আমাকে ম্যাস্টারবেট করতে দেখে ফেলেছিল, তারপর হাত ধরে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে আমার গালে দুই চড় কষিয়ে মাটিতে ফেলে আমার উপর শুয়ে পড়েছিল, ওর গতর দেখেছো তো, ইয়া সলিড মাল, জড়িয়ে ধরলে ছাড়ানো যায় না, ভাঙা-ভাঙা বাংলা মিশিয়ে তেলেগু আর আংরেজি ভাষায় কি-কি সব বলতে থাকে সেক্স করার সময়ে, সারা গায়ে থুতু মাখিয়ে দেয়, ওর কাছ থেকেই তো ছিলিম টানতে শিখেছি। বলে ছিলিম টেনে সেক্স অনেকক্ষণ করা যায়, সত্যিই তাই, মাটির ছিলিম গরম হয়ে গেলে নিজের সেক্সের জায়গায় ঢুকিয়ে ঠেলাঠেলি করে বলে, নে এবার টান, ঠাণ্ডা করে দিয়েছি।
ম্যাস্টারবেট করা খারাপ নয়, যদি না করিস তাহলে আপনা থেকে মরা ধাতুরস রাতের বেলা বেরিয়ে যাবে, কম বয়সে সব ছেলেরই তাই হয়। তুই একেবারে লবড়ধোধো থেকে গেলি, পড়লিও তো কনকদুর্গার পাল্লায়, ও তো বাচ্চা হাতি, তবে দয়ামায়া নেই, ঘায়েল কমরেডদের হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে নিয়ে আসে। ওই যে তুই বললি ছিলিমটা ঠেলাঠেলি করে কনকদুর্গা, ওই ঠেলাঠেলিটা ওর আনন্দের জন্যে জরুরি, ও নিজের অরগ্যাজমের জন্যে সেটা করে, এখানকার উত্তেজনার চাপ থেকে ছাড়ান পায়।
আমায় আবার কি বলছ, নিজেও তো খাড়ুস থেকে গেছো, গুরুঘণ্টাল। মরা না জ্যান্ত ধাতু অতোশত জানি না, ম্যাস্টারবেট করতে ভাল্লাগে বলে করি, তবে এখানে জলের অভাবে ধোয়াধুয়ির ঝামেলা, কনকদুর্গা বলেছে ও যতোদিন এখানে আছে ম্যাস্টারবেট করার দরকার নেই। আসলে দলমের কেউই ওকে দেখে টান পায় না। ও আমাকে চুসকিও শিখিয়েছে। চুসকি জানো তো? অন্ধকারে টের পাই না কোথায় মুখ দিয়ে চুসকি মারছি, এমন কালো রঙের আঙুর।
ফাজলামি রাখ, যা করার করিস, আমাকে হিসেব দেবার দরকার নেই। ইতুকে তো তোর সঙ্গে এখানেই রাখতে পারত, যেমন তোর মা-বাপ রয়েছে। তোদের দুজনকে আলাদা করে দেবার প্যাঁচ মেরে ইতুকে ওই ফিল্ডে, আর তোকে এই ফিল্ডে রাখা হল।
ওই লোকটাকে আমার বাপ বানিও না। ওটা একটা স্কাউন্ড্রেল, চুতিয়া, মাদারচোদ কোথাকার। ও তো এক নম্বরের লুচ্চা-লোফার, বন্দুকবাজ লাফাঙ্গা কাঁহিকা, জানো তুমি। যেদিন আমাকে আর ইতুকে বাড়ির লোকেরা বকুনি দিচ্ছিল, সেদিন ওরা অতনু চক্রবর্তী সম্পর্কে যা-যা বলছিল , শুনলে তোমার কান লাল হয়ে ঝলসে শিক কাবাব হয়ে যেতো, বুঝলে।
অমিত বলল, ওদের, মানে অতনুদের, একটা গ্যাং ছিল যাকে ওদের অফিসের লোকেরা বলত নারী-নারকো গ্যাং, যতো তিলেখচ্চররা ছিল ওই দলে, এরিক পেজ, মাহমুদ জোহের, মলয় রায়চৌধুরী, অসীম পোদ্দার, দেবেন্দ্রবাবু, অভিজিৎ বাবু, দাশগুপ্ত সায়েব, মুদালিয়ার সায়েব, বাঙালি বিহারি পাঞ্জাবি ওড়িয়া মিলে সে নাকি লম্পটদের বিরাট কিচাইন। ওরা সবাই অফিস ছুটির পর পেছনের গলির ঝোপড়িতে বসে ভাঙ, কানট্রি লিকার, তাড়ি, চরস, স্ম্যাক নিতো। মাহমুদ জোহেরের ছিল জানলায় পর্দাটানা ম্যাটাডর ভ্যান, পেছনের দুদিকের সিট টানলে বিছানা হয়ে যেতো, আর ছুটিছাটায় ওদের পিকনিক হতো, লটারি করে যে জিততো সে ভাড়াকরা মাগিকে ওই বিছানার ওপর শুইয়ে এপিঠ-ওপিঠ যা ইচ্ছে তাই করত।
যতই যাই হোক, হি ইজ ইওর বায়োলজিকাল ড্যাড। বললো ডাক্তার, যে কথায় ওর নিজেরই সন্দেহ আছে।
এই ঘটনাগুলো যে ঘটছে, তা ওই তোর বাপের বন্ধু মলয় রায়চৌধুরী ঘটাচ্ছে, ঘটিয়ে চলেছে লোকটা, লিখেও রেখেছে। তুই যদি মলয় রায়চৌধুরীর লেখা ঘটনাগুলো একের পর এক পড়িস তাহলে অতনু চক্রবর্তী আর ওর বন্ধুদের কেলোর কিত্তি জানতে পারবি। এর আগে মলয় রায়চৌধুরী চারটে পার্ট লিখে ফেলেছে, ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ আর ঔরস। কলকাতায় গেলে খতিয়ানগুলো পাওয়া যাবে, ডাক্তার এক নাগাড়ে বলে থামলো, তারপর বললো, আমার কাছে মলয় রায়চৌধুরীর ওই সব ঘটনার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি আছে, এখন তো লোকটা বুড়ো হয়ে গেছে, আঙুলে আরথ্রাইটিসের কারণে কমপিউটারে এক আঙুলে টাইপ করে লেখে, এই যে এখনকার ঘটনাগুলো, আঙুলে টাইপ করতে-করতেই লেখে, লিখতে বসে ভাবে যে এক্ষুনি যদি মরে যায় হার্টফেল করে, কিংবা হার্নিয়া বার্স্ট করে কিংবা হাঁপানির টানে, তাহলে এই শেষ পার্টটা কমপিউটারেই থেকে যাবে, আমরা সবাই মলয় রায়চৌধুরীর কমপিউটারে থেকে যাবো, কেউ আর জানতে পারবে না, তোর, আমার, তোর মা-বাপের, ইতুর, কনকদুর্গার শেষ পর্যন্ত কী হলো। আমরা সবাই সমুদ্রের ডুবজলে লাশ হয়ে মাংসখোর মাছেদের খোরাক হয়ে যাবো।
চলো না দুজনে মিলে পাটনায় পালাই, বলল অমিত, ওখানে ভিড়ের ভেতরে ঢুকে গেলে কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না, আর আমাকে তো কেউই তেমন চেনে না। আমি কিন্তু পাটনার গরিববস্তিগুলো চিনি। যাবার সময় কলকাত্তা হয়ে যাবো; কলকাত্তা ঘুরে দেখার খুব শখ আমার, এখানে একদিন আধামিলিট্রির হাতে মরার চেয়ে কলকাত্তায় গিয়ে গাড়িতে চাপা পড়ে মরা ভালো। তোমার পিস্তলটা গেঁড়িয়ে কমরেড দীপক আর কমরেড জ্যোতিকে খাল্লাস করে চুপচাপ কেটে পড়ব, একদিন রাত্তিরে। আমি আর কনকদুর্গা এসে দেখে গেছি, নাক ডেকে ঘুমোও ।
গেঁড়াতে হবে না ; যেদিন কাজটা করবি, চেয়ে নিস।
মনে থাকে যেন, সেদিন আবার টাঁয় টাঁয় ফিস কোরো না।
কলকাতার পুলিশ মলয় রায়চৌধুরীকে ওদের ভ্যানে বসিয়ে কলকাতার অন্ধকার জগত দেখাতে নিয়ে যেতো রে। ওরা পুরোনো কলকাতার পরিবার, সেকালের ঘাঁত-ঘোঁত জানে। আর জন্মেছিল পাটনায়, তোকে ঠিক খুঁজে বের করবে, আর কী-কী করলি তা লিখে রাখবে।
অতনু চক্রবর্তী তোর বায়োলজিকাল ড্যাড, বুঝলি?
তার কোনো প্রমাণ নেই, ওটা বানানো গল্প, আমি যা জানি, আমি তোমার ছেলে, আমাকে দেখতে তোমার মতন। কী করে যে ওই লোকটা ক্রান্তিকারী কমরেড দীপক হয়ে গেল তা-ই ভাবি।
মানসী বর্মণের প্রেমে পড়ে। ওরা একে আরেকজনকে ভালোবাসে। তোর মা তো ভালো চাকরি করতো, আমিই ওকে ক্রান্তি দিয়ে সমাজবদলের স্বপ্ন দেখিয়ে এই রাস্তায় এনেছিলুম, এখন বুঝতে পারছি কতো ভুল করেছিলুম সেসময়। সমাজটা বদলায় না, মানুষগুলো বদলে যায়।
প্রেম না ঘেঁচু. যত্তো সব ঢাকোসলা। কেমন করে যে একজন লোক আরেকজন লোকের বউকে ফাঁসায়, বুঝতেই পারিনা শালা। যখন এখানে প্রথমবার এসেছিলুম, তখন মনে হয়েছিল অতনু চক্রবর্তী লোকটা আমাকে মায়ের চেয়ে বেশি পছন্দ করে, এত দিনে বুঝে ফেলেছি যে ও ভালো নৌটাঙ্কি করতে পারে, ড্রামাবাজ শালা চাপলুস চুকন্দর।
বাবার সম্পর্কে এরকম কথা বলিসনি। এইসব গল্প কক্ষনো কাউকে বলিসনি। তোর বাবাকে ক্রান্তিকারীরা শ্রদ্ধা করে।
তুমিই আমার বাবা। ইতুই তো আমাকে বলল যে তুই তোর বাবা-মার কাছে চলে যা, বাবা-মাকে যদি বাবা-মা না মনে করিস, তাহলে মনে করিসনা, কিন্তু ওনাদের সঙ্গেই থাকগে যা। আমি চলে এলুম কারণ তুমি, আমার বাবা, এখানে রয়েছ, আমার মাও এখানে রয়েছে। জানি না ওদের বাবা-মা বলে মনে করি কি না, এখনও তো আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারছি না। তোমাকে তো প্রথম থেকেই তুমি বলছি, তুমি আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করছ, অথচ ওরা আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করে না, তুমি-তুমি করে, নিজেদের ছেলে বলে মনে করে না, আমার এখানে আসাটাও ওরা ভালো চোখে নেয়নি, বুঝতে পারি, অথচ ওদের ফোসলানোতেই এলুম, ইতুটাও চলে গেল অবুঝমাড়ের জঙ্গলে।
আমি তোর লিগাল বাবা, তোর বায়লজিকাল বাবা হল অতনু চক্রবর্তী মানে কমরেড দীপক। তোর নাম অমিত বর্মণ কেন? কারণ তোর মায়ের পদবি বর্মণ। তোর মাও আমায় বিয়ে করে বর্মণ পদবি ছাড়েনি, ওটা ওর বাপের পদবি, আমার পদবি ও কোনো কালেই নিজের নামের সঙ্গে জোড়েনি।
ভালোই করেছে, আমি অন্তত ওর পদবিটা পেয়েছি, আর তো কিছু পাইনি। তোমার পদবি যদি পেতুম তাহলে অমিত ঘোষ হয়ে যেতুম আর লোকে ভাবত যে অমিত ঘোষ আর ইতু ঘোষ সত্যি-সত্যি ভাই-বোন। এমনিতেই ওদের বাড়িতে আর পাড়ায় ভাই-বোন ভাই-বোন বলে-বলে ঘিনিয়ে দিয়েছিল আমাদের, যত্তো শালা আনপড় ঘড়িয়াল-কুত্তা। আমি সেই জন্যেই আরও পালিয়ে এসেছিলুম ওই বাড়ি থেকে। ইতুও তাই অবুঝমাড়ের অজানা জঙ্গলে যেতে রাজি হয়ে গেল। মায়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কী?
ডিভোর্স তো করিনি আমরা, সেপারেটও হইনি। ওদের মা-বাবা বলার অভ্যাসটা এবার ছাড়। অতনু চক্রবর্তী হল কমরেড দীপক, আর মানসী বর্মণ হল কমরেড জ্যোতি। তোর উচিত সবায়ের মতন ওই ভাবেই ওদের নাম উচ্চারণ করা। যা সত্য আর বাস্তব তাকে ওদের অবিশ্বাস সত্ত্বেও ওরা তো আফটার অল ক্রান্তিকারী, হ্যাঁ কিনা বল? আর আমাকে বাবা বলবিনা, কমরেডও বলবি না, ডকটর বা ডাগডার সাহাব বলবি, সবাই যেমন বলে।
ধুসসসসস, ছাড়ো, বাবা বলে ডাকিই না লোকটাকে, তোমাকেও তো ডাকি না বাবা বলে, মনে-মনে বলি। যাকগে যাক। হওনি কেন? তুমি হওনি না ও হয়নি? আজব বর-বউ তোমরা। পাশাপাশি রয়েছ, কথাবার্তাও বলছ নিজেদের মধ্যে, ওই অতনু চক্রবর্তী লোকটাও রয়েছে এখানে। তোমাদের কাউকেই আমি বুঝতে পারছি না, আজ চার বছরের বেশি হয়ে গেল, তোমরা অ্যালজেব্রা না ট্রিগনোমেট্রি, ফেল মারার সাবজেক্ট?
ও তুই বুঝবি না, এখন বুঝবি না, পরে, আরেকটু বয়স হলে, কপালে বলিরেখা পড়া আরম্ভ হলে, লিঙ্গ অভিজ্ঞ হয়ে উঠলে, বুঝতে পারবি, হয়তো বুঝতে পারবি। তোর আর ইতুর মাঝে হঠাৎ কেউ এসে যদি শুয়ে পড়ে তখন টের পাবি কোথা থেকে কী ঘটে যায় মানুষের জীবনে।
হুঁঃ। যোনি কি বললে না তো? আমরা আর পাশাপাশি শোবো না, সুযোগ হবে বলে মনে হয় না, ওই জঙ্গলে পুলিশ এত বেশি হানা দেয় যে ইতু কত দিন ওখানে বেঁচে থাকবে কে জানে, বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। যোনি কী তা-ই বলো।
ওকে রাইফেলধারী দেহরক্ষী দেবার কথা, বেঁচে আছে বলেই মনে হয়। শোন, যেখান দিয়ে তুই সেক্স করেছিস আর যেখান দিয়ে তুই জন্মেছিস, তাকে বলে যোনি।
যোনি বলে? ওকে তো কোক বলে, গালাগাল দেবার সময়ে বুড় বলে, জানতুম। কতো ডায়ালগ শুনেছি, মেরে কোক সে যো পয়দা হুয়া, মা কি কোক কি কসম, হিন্দি ফিলিমে, হিন্দি টিভিতে। স্কুলে গালাগালি দেবার সময়ে যোনি বলতো না কেউ, বলতো বুড়, রেন্ডিদের বলতো বুড় মারাউনি। তো হঠাৎ এই সন্ধেবেলা যোনির লেকচার মারছো কেন? পুরোনো দিনের কথা চোখে ভাসছে বুঝি? চোখের সামনে জোয়ান বয়সের গোলাপি যোনি, ফরফরাতি বুড় কি চকাচৌঁধ আঁধি ভেসে উঠছে?
বাপের বয়সি লোকের সঙ্গে ফাজলামি করছিস? প্রশ্রয়ের চিলতে হাসি ঠোঁটে খেলিয়ে বললো ডাক্তার।
ওসব ছাড়ো, যোনির কথা বলো, জানি ভাসছে তোমার চোখের সামনে, কেন যোনির কথাটা হঠাৎ পাড়লে সেটাই বলো, কার যোনি, বুড়কে ভমচৌলা ঢাকোসলা ?
একটা বাচ্চা যার যোনি থেকে জন্মায়, সেই মায়ের বুকের দুধ খাওয়া শিশুটার মানুষের মতন মানুষ হয়ে ওঠার জন্য খুবই জরুরি, তাই প্রসঙ্গটা তুলেছি। তুই যে একটুতেই ভয় পাস, ডেডবডি দেখলে কেঁদে ফেলিস, কোনো ক্রান্তিকারী সামান্য জখম হলে তার দিকে তাকাতে পারিস না, চোখ ছলছল করে, একবার রক্তক্ষয় দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলিস, অনবরত নখ খাস, পা নাচাতে থাকিস, তা সেই কারণেই। তুই তোর মায়ের বুকের দুধ খাবার সুযোগ পাসনি, বোতলের দুধ খে্য়ে, কিংবা দুধ না খেয়েই বড়ো হয়েছিস ।
অমিত বলল, তোমাকে একটা মনের কথা বলব? যবে থেকে মানসী বর্মণকে দেখেছি, ওনার ফর্সা মাইতে চুসকি দেবার ইচ্ছে ধরে রাখতে পারিনি, স্বপ্নেও দেখেছি, ওনার গোলাপি মাইতে চুসকি দিচ্ছি, আর প্যান্ট ভিজে গেল। তোমার তো বউ ছিল এককালে, নিশ্চই অনেক চুসকি দিয়েছিলে? কনকদুর্গা আমার চুসকি খুব পছন্দ করে, চুসকি দিতে-দিতে দম বন্ধ হয়ে যায়।
তক্ষুনি কোনো উত্তর দিলো না ডাক্তার। একটু পরে বলল, ক্রান্তি হলো তার সামনে একজন উলঙ্গ সুন্দরী, তোর ইচ্ছে করবে গিয়ে জড়িয়ে ধরি, চুমু খাই, কিন্তু আমরা ক্রান্তি করছি না, নিজেদের মতন করে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছি, যদিও ক্রান্তিকারিরা জানে না যে রাষ্ট্রটা কোথায়, এই জঙ্গলে নিশ্চই নয়।
অমিত বলল, যাদের বাড়িতে কোলের শিশুকে মানসী-অতনু ফেলে দিয়ে এসেছিল, তাদের বাড়িরও কারোর বুকের দুধ খাবার সুযোগ পাইনি, রাঙাবাবা আর রাঙামা আমাকে নিজেদের ছেলে হিসেবে নিয়েছিল বলে শুনেছি, রাঙামার তো বাচ্চাই হয়নি, কতবার কাঁড়ি-কঁড়ি টাকা খরচ করে আইভি এফ করিয়েও হয়নি, বুকে দুধ আসবে কোথ্থেকে? দুধ খাওয়াবার মাসিও রাখেনি যে তার বুকের দুধ খাবো। তাদের বাড়িতে তো চাকরের মতন ছিলুম ; সেকারণেই তো গর্দানিবাগের ঘোষবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলুম, তারপর কতো চাপ খেয়ে এখানে এসে জুটেছি। শালা, ইঁদুরকল যেন। ইতু বলত, ফাকিং একান্নবর্তী পরিবার।
না, যার যোনি থেকে জন্মেছিস, তারই বুকের দুধ জরুরি, চরিত্র গড়ার জন্য জরুরি। আমি কথাটা ডাক্তার হিসেবে বলছি। মায়ের দুধে করটিজল থাকে, তার কাজ প্রায় ফেরোমোনের মতন। ফেরোমোনের মাধ্যমে একজন মানুষ আরেকজনকে সংকেত পাঠায়। ঠিক সেভাবেই করটিজলের মাধ্যমে মা শিশুকে আর শিশু মাকে সংকেত পাঠায়। করটিজল হল স্ট্রেস হরমোন। শরীরের ভেতর দিয়ে যখন করটিজল যাতায়াত করে তখন তা মানুষের মগজে ভয়, আতঙ্ক, ক্ষোভ, অপমানবোধ, গ্লানি, পরাজয়বোধ, ক্রোধ এই ধরণের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হবার জন্য তাকে আগেভাগে তৈরি করে দেয় ; মগজের গ্লুকোজ কনজাম্পশান কমিয়ে পাচনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মাসি-পিসির দুধ খেলে হবে না, কৌটোর দুধ খেলে হবে না, শৈশবে নিজের মায়ের দুধ খেতে হবে। প্রাণীর শরীরের সবরকমের লিকুইডের মাধ্যমে বার্তা গড়ে ওঠে।
কী যে মাথামুন্ডু বোঝাতে চাইছ কিছুই বুঝতে পারছি না, খোলোসা করে বলো, খাড়ুসকে খাড়ুসই রয়ে গেছো।
সেক্স করার সময়ে কী করলি? তুই তোর আর ইতু কিংবা তুই আর কনকদুর্গা যে যার নিজের লিকুইড ব্যবহার করলি , পরস্পরকে খবর পাঠালি যে একজন আরেকজনের দেহকে ভালোবাসছিস।
শুধু দেহকে ভালোবাসিনি আমরা, নিজেদের পুরোটা দিয়ে ভালোবেসেছি। ইতু বলত, কারনিভোরের মতন রক্তমাংস দিয়ে ভালোবাসা।
পুরুষ-মানুষের শরীরের ষাট ভাগ লিকুইড, বুঝলি। মেয়েদের অবশ্য একটু কম, পঞ্চান্ন ভাগ। আমাদের মগজ আর হৃদয়ে আছে তার সত্তরভাগ ; হাড়কে মনে হয় শুকনো খটখটে, তাতেও লিকুইড আছে একত্রিশ ভাগ। বাচ্চারা যখন জন্মায়, তাদের শরীরে আটাত্তরভাগ লিকুইড থাকে, মাকে খবর পাঠাবার জন্য, নাল ফ্যালে, দুধ তোলে, মাকে বার্তা পাঠায়।
শুনছি তোমার গ্যাঁজাবিদ্যে, হুলোকুমির লবডঙ্কায়, জানি আমাকে তুমি লাল্লোচাপ্পো মনে করো, লবড়ধোধো। আমার তো মা ছিল না, দুধ খাইনি, অতএব তুলিনি, নাল ফেলতুম কিনা জানি না।
তাহলে তোকে বলি, মানুষ নানারকম মিথ্যেকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে, একটু আগেই তো বললুম,তার মধ্যে প্রধান হল প্রেম। এই মিথ্যেটা বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি। সব রকমের প্রেমই কোনো না কোনো মিথ্যাকে আঁকড়ে নিজের সততা প্রমাণের চেষ্টা করে , দেশপ্রেম, সংসারপ্রেম, মানবপ্রেম, সমাজপ্রেম, ধর্মপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম এটসেটরা। দেখছিস না এখানে যেমন ক্রান্তিকারিরা, তেমনি বর্ডারে জওয়ানরা মারা যাচ্ছে, আর আরামে ঠাণ্ডাঘরে মজা নিয়ে চলেছে নেতারা। মুসলমানদের দেশে এখন জোর লড়াই চলছে স্বর্গে যাবার, শয়ে-শয়ে মানুষ বোমাবুমি করে মারা যাচ্ছে বা আত্নহত্যা করছে রোজ রোজ। বুঝিয়েও কিছু হবে না ; মিথ্যাই সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
মারো গোলি ; যে যার লুঙ্গি তুলে পুঙ্গি বাজাক, আমার তাতে কি!
চুমু খাবার সময়ে লিকুইড আদান-প্রদান করেছিলিস, খবর পৌঁছে দেবার জন্য , মুখে থুতু না থাকলে কথা বলতে পারবি না , আমি তোমায় ভালোবাসি বলতে হলেও মুখের ভেতরটা ভিজে থাকা দরকার , জড়িয়ে ধরার সময়ে ঘাম দিয়ে ফেরোমোনের দেয়া-নেয়া করেছিলিস। লোকে কাঁদে, তাতে চোখের জল কেন বেরোয়? জানাবার জন্য যে মনের অবস্হা তখন কেমন।
ডাক্তার ঘোষ পেশার মর্যাদা আর স্ত্রীর ছেলের প্রতি পিতৃত্বসুলভ আদরের মাঝে মনে-মনে দোল খেতে লাগলো। অমিতের ওপর দখল প্রসারিত করার খেলায় ছেলেটাকে জ্ঞানের জাল দিয়ে আটকে নেবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে সে এসে অব্দি।
তুমি এখানে পড়ে আছ কেন? এই জঙ্গলে? জ্ঞান তো মাঠে মারা গেল। বিপ্লবের ব-নিয়েও তোমার একরত্তি আগ্রহ নেই, তা এতদিনে বুঝে গেছি, ঝাঁটের বাল তোমার কাছে এই ক্রান্তিকারী খুনোখুনি। ক্রান্তি-ফান্তিতে তুমি বিশ্বাসই করো না, তবু এখানে পড়ে আছো! শহরে থাকলে মারোয়াড়ি হাসপাতালে ডাক্তারি করে পেল্লাই বাড়ি করে ফেলতে পারতে, গাড়ি হাঁকাতে, এখানে ফালতু জীবন নষ্ট করে ফেললে।
ক্রান্তি? নিজেকে চুপিচুপি প্রশ্ন করলো ডাক্তার, ক্রান্তির হাতছানি তো আমিই দেখিয়েছিলুম মানসীকে, সেই হাতছানির ডাকে যে আরেকজন এসে ক্রান্তির স্বপ্নটাকে হাতিয়ে নেবে, মানসীকে হাতিয়ে নেবে, তা তো তখন ভাবিনি। এখন আর সমাজবদলে বিশ্বাস করি না, জানি সমাজ কোনো দিনই বদলাবে না, বইতে সমাজ বদলের যতো গপ্পো আজ পর্যন্ত লেখা হয়েছে, সব গাণ্ডুগর্দি। সোভিয়েত রাশিয়ার মতন শেষ পর্যন্ত মাফিয়ারা হাতিয়ে নেয়, চীনের মতন পুঁজিপতিরা হাতিয়ে নেয়।
তুই যা জানতে চাইছিস তার উত্তর তুই জানিস। আমি এও জানি যে তুই সেই একই মহিলার জন্য এখান থেকে যেতে পারছিস না, যে মহিলার জন্যে আমি নিজের তৈরি করা ফাঁদে আটক পড়ে গেছি।
কে? কমরেড জ্যোতি? কমরেড দীপকের জ্যোতি? ওই মহিলা তো তোমাকে ভালোবাসে না। আমাকেও পছন্দ করে কিনা তাও নিশ্চিত নই। তবে বদলা একদিন নেবোই নেবো, ইসপার ইয়া উসপার।
না বাসলেই বা, আমি তো... যাকগে, তুই জেনে কীই বা করবি।
হুঁঃ, ছুঁতে পর্যন্ত পাও না, শেষ বোধহয় পঁচিশ বছর আগে ছুঁয়েচো।
তেইশ বছর তিন মাস আট দিন। তারপর কমরেড দীপক একবস্তা টাকা নিয়ে এসে শুয়ে পড়ল আমাদের মাঝে। আর তুই পয়দা হয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলি।
হুঁঃ, এই জঙ্গলে ক্যালেন্ডার-ট্যালেন্ডার না থাকা সত্ত্বেও এত হিসেব রেখে চলেছ। দেবদাস সেজে থাকো, চুল আঁচড়াও না, রেগুলারলি দাড়ি কামাও না, লুঙ্গিটা বোধহয় একসপ্তাহ হয়ে গেল ছাড়োনি, বুশশার্টে সবকটা বোতাম নেই। নিজেই নিজেকে লণ্ডভণ্ড করে রেখেছ, এসে থেকে দেখছি। শুধু দিনের বেলা খাও, রাতে কখনও খেতে দেখিনি তোমাকে।
ভালোবাসার জন্য ছুঁতে হয় নাকি!
আমি তো ভালোবাসি না। আমি ওই মহিলাকে আর ওনার সঙ্গীকে ঘেন্না করি বলে এখানে আছি। একটা দুহাজার টাকার প্যাকেট তো আমিও এনে দিয়েছিলুম কমরেড জ্যোতিকে, সুশান্তজেঠু দিয়েছিলেন, কীই বা করব অত টাকা, তাই দিয়ে দিলুম, একটা অবশ্য নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছি, বলা তো যায় না, যেদিন পালাবো সেদিন কাজে দেবে। কমরেড জ্যোতি কী বলেছিলো জানো? বলেছিলো যে যাক, কয়েকটা হ্যাণ্ড উইপন কেনা যাবে। ওইসব ফালতু জিনিস কেনার প্ল্যানের কথা আমি যদি আগে জানতুম, তাহলে এক পয়সাও দিতুম না। ওই বিধাবৌড়িয়া গ্রামে একটা টিউকল বসালে বরং ভালো হতো, জল আনার জন্য কত দূর যেতে হয় বউগুলোকে, মেয়েগুলোকে; ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যায় ওদের শাড়ি, কুড়ি হাত দূর থেকেও সেই মেয়েলি ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়, জানো তুমি?
একটা গ্রামে বসালে অন্য গ্রামগুলোর মানুষ মনে করবে তাদের অবহেলা করা হচ্ছে ; সরকার অমন অবহেলা করলে গ্রামবাসীরা তেমনকিছু মনে করে না, কিন্তু ক্রান্তিকারীরা যদি করে তো সন্দেহ করবে। ছেলে-মায়ের সম্পর্কটা ভালোবাসাবাসির নয়, ওটা জৈবিক, দুজনে একে আরেকজনের প্রতি চৌম্বকক্ষেত্র গড়ে তোলে; সে-সম্পর্ক কিন্তু মিথ্যা নয়। কথা বলতে বলতে ডাক্তার নিজের মনে বলতে থাকলো, এ নিউজপেপার ইজ নট ওনলি এ কালেকটিভ প্রোপাগাণ্ডিস্ট অ্যান্ড এ কালেকটিভ এজিটেটর, ইট ইজ অলসো এ সোশ্যাল অরগ্যাজম।
অমিতের জানা আছে, কথা বলতে বলতে মগজের আরেকটা ঘরে সেঁদিয়ে যায় ডাক্তার, মগজ যেন হাজারখানেক পাকানো কেঁচো দিয়ে তৈরি। সে দিকে খেয়াল না দিয়ে বলল, হবেও বা, আমার কোনো চুম্বকটান আছে কি না জানি না। যাকগে যাক, এমন কোথাও টিউকল বা কুয়ো বসালেই তো হল যেখানে কয়েকটা গ্রামের বউরা জল তুলতে আসতে পারবে। আমি নিজের চোখে দেখেছি ঘামে মুখ একেবারে থমথমে হয়ে থাকে মেয়েগুলোর।
দ্যাখ, এটুকু কথা বলতে গিয়েও তুই কাঁদো-কাঁদো হয়ে যাচ্ছিস। দেখেছিস কখনও যে তোর মায়ের ঘামের ফোঁটা কেমন জোনাকির মতন জ্বলজ্বল করে, অন্ধকারে উড়তে থাকে, তাঁবুর ভেতর আলো হয়ে থাকে?
হ্যাঁ, দেখেছি, এখন আমি ওর তেরপলে শুই, অতনু চক্রবর্তীর তেরপলে শুই না। বলেছিলুম যে আমাকে ক্রান্তিকারীদের কোনো একটা তাঁবুতে শুতে দেয়া হোক, দুজনে রাজি হল না কেন কে জানে, কনকদুর্গাও ওদের বলেছিল যে অমিতের বয়স তো কম, মেয়েদের তেরপলে শুতে পারে। ওরা রাজি হয়নি, বোধহয় কনকদুর্গার হামলেপড়ার ব্যাপার ওরা জানে, দলে এতো ছিপকিলি পুষে রেখেছে।
বলার পর, অমিতের মনে হল, মায়ের সঙ্গেই বা কেন শোবে না! মায়ের পাশে শোবার জন্মগত অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবো, মায়ের বুকের দুধ খাবার অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবো, একদিন না একদিন মায়ের বুকের দুধ আমি নির্ঘাৎ খাবো, দুধ থাকুক বা না থাকুক। গোঁফের রেখা দেখা দেয়া শুরু হয়েছে তো কি হয়েছে, আমিই তো মায়ের একমাত্র সন্তান। নিজের ফোল্ডিং খাটকে মায়ের খাটের পাশে নিয়ে গিয়ে শোবো। কোনটা বাবা তা গোলমেলে হলেও মা তো মানসী বর্মণ, এতো সুন্দরী মা, আমার পুরো ছোটোবেলা নষ্ট করে অতনু চক্রবর্তীর পেছন-পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ওরা এক আধজন মেয়ে ক্রান্তিকারীকে সন্দেহ করে। বিশেষ করে কনকদুর্গাকে।
সন্দেহ করার তো দরকার ছিল না; ওরা জানে আমি ইতুকে ভালোবাসি। যদিও জানে না যে কনকদুর্গাকেও ভালোবাসি। দুজনকে কি একসঙ্গে ভালোবাসা যায় না? আমাকে বললে আমি দুজনকেই বিয়ে করে কিংবা না করেও, ঘর করতে পারি। কমরেড মানসী বর্মণ তো তোমাকে আর অতনু চক্রবর্তীকে একই সঙ্গে ভালোবাসে।
কনকদুর্গা, মানে কমরেড কুনকি একজন ইমপরট্যাণ্ট ক্রান্তিকারী, বুঝলি। ভীষণ ডেনজারাস মেয়ে, মনে রাখিস, ওকে দল ছাড়বে না, তোকেও জোর করে ওর কাছ থেকে ছাড়াতে পারবে না। তবে কী জানিস? ডেনজারাস মেয়েরাই ভালোবাসার জন্যে জি-জান লড়িয়ে দ্যায়।
জানি, ঝাড়খন্ড থেকে পালিয়ে কলকাতায় ফিরে সারেন্ডার করবে ভেবেছিল, তাইতে নাকি দুজন ক্যাডারকে দিয়ে ওকে বডি-প্যাঁদানি দেয়া হয়েছিল, সেই দুজনকে আধামিলিট্রি মেরেছিল না কনকদুর্গা, তা জানা যায়নি। আমি তবুও ওকে ভালোবাসি, ও আমার কান্নার ওষুধ। বললে না তো, দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে ঘর করা যায় কিনা।
জানি না যায় কিনা , ওটাই আমার জীবনে প্রধান প্রশ্ন হয়ে আছে আজও। অন্য কাউকে ভালোবাসলেও, যদি কোনো তরুণী তোকে রাতের বেলায় আঁকড়ে ধরে, বুঝলি, তুই ছাড়াতে পারবি না নিজেকে, দেখবি তোর শরীরে আপনা থেকে সাড়া জেগে উঠছে, কনকদুর্গা ঠিক তাই করেছে তোর সঙ্গে, তার ওপর গাঁজা ফোঁকার নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। ক্রান্তিকারীদের কি আর দেহ-মন নেই? তোর পাশে যদি কোনো মেয়ে শোয়, তাহলে তার মাথায় সেসময়ে ক্রান্তির কথা থাকার কথা নয় , তোকে দেখতে-শুনতে যথেষ্ট ভালো, তোর বাবার হাইট, চোখ-মুখ-নাক আর তোর মায়ের গায়ের রঙ পেয়েছিস। মাঝরাতে তোর শ্বাস যদি কোনো যুবতীর মুখের ওপরে অনবরত পড়তে থাকে, ফেরোমোনের ঝাপটায় তার পক্ষে নিজেকে কনট্রোল করা কঠিন হতে পারে। ক্রান্তিকারীদের তাঁবুতে হয়, এমনকি ক্রান্তিকারীরা যখন অপারেশান করতে যায়, তখনও ক্লান্তি আর টেনশান কাটাবার জন্যে লিঙ্গ-যোনির স্মৃতিতে জড়িয়ে পড়ে, জানাজানি হলে তাদের আলাদা করার জন্য বিভিন্ন ফিল্ড-এরিয়ায় পাঠানো হয়, যেমন তোকে আর ইতুকে পাঠানো হয়েছে। তোর লিঙ্গের স্মৃতি তোর নিজের নয় রে, তা যুগ যুগ ধরে স্মৃতি ধরে রেখেছে, ডায়নোসরদের সময় থেকে। তুই না চাইলেও তোর লিঙ্গের স্মৃতি তোকে বিগড়োবার রাস্তায় নিয়ে যাবে, ইউ মে কল ইট ভালোবাসা কিংবা সেক্স বা ভালোবাসা উইথ সেক্স। কনকদুর্গার সঙ্গেও সেক্স করেছিস, আই মিন কুনকি তোর সঙ্গে সেক্স করেছে, ওতো ভীষণ ডিমান্ডিং? কপালে নাইন এমএম ঠেকিয়ে তোকে দিয়ে কাজ আদায় করে নেবে।
হ্যাঁ, প্রথমবার মুখ দিয়ে, ও-ই শিখিয়েছে, এখানে প্রিকশান নেবার কোনও ওষুধ ছিল না , তাই আমরা সেক্স দিয়ে সেক্স করতে পারিনি, ও বলে ওটা ব্লোজব, মজা একই, বরং বেশি মজা। তুমি ওকে প্রিকশানের ট্যাবলেট দাও না কেন? ওর মান্হলি ব্লিডিঙের সময়ে আমরা রোজই সেক্স করেছি, ঘাসের ওপর, বুঝলে, জোনাকি উড়তে থাকে, ঝিঁঝি ডাকতে থাকে , জঙ্গলের গন্ধর সঙ্গে ওর বুনো গন্ধ মিশে যায়, যাকগে যাক, যে কথা হচ্ছিল, কমরেড দীপক তোমার চেয়ে বেঁটে আর তুমি কমরেড জ্যোতির চেয়ে ফর্সা, অমন যুক্তি অনুযায়ী তাহলে আমি তো তোমার ছেলে, কী, কেমন দিলুম, বেশি পাঙ্গা নিও না। কিন্তু কান্না এসেই যায়, আসলে আমি একজন ইডিয়ট বাফুন, কতবার কনট্রোল করার চেষ্টা করেছি, পারি না। ইতু বকুনি দিত, কনকদুর্গা ডরপোকি কমজোর মরদ বলে চড় মেরেছিল। কনকদুর্গাকে বলে দিয়েছি যে আমি জন্মাতে ভয় পেয়েছিলুম, জন্মেও ভয় পেয়েছিলুম, সবেতেই আমি ভয় পাই।
অমিতের মনে পড়ল, প্রথমবার ও ছাদে বসে একা-একা কেঁদেছিল, পাড়ার গুণ্ডা রফিক মাসুম একটা ষণ্ডা মার্কা লোককে দশ হাজার টাকার সুপারি দিয়ে বলছিল কাউকে সাফায়া করে দিতে, ভয়ে গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অমিতের, কথাটা ইতুর সঙ্গেও শেয়ার করতে পারেনি, যা সাহসী ইতু, গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত রফিক মাসুমের ওপর, আর ওরা ওকে মুখ বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে কী করত তা তো আর ইতু জানে না, মনে হয়েছিল অমিতের।
একদিন রাতের বেলায় আওয়াজ শুনে জানলা দিয়ে দেখেছিল অমিত , পাড়ার ফুটপাতের ওপর যে গাছগুলো ছিল তাতে ছেঁদা করে কিছু করছিল ষণ্ডাটা আর তার সাকরেদরা। অমন কেন করছে তখন বুঝতে পারেনি অমিত। সপ্তাহখানেক পরে দেখল সবকটা গাছ মরে গেছে, একেবারে শুকনো, তার কিছুদিন পরেই কর্পোরেশানের লোকদের সঙ্গে এনে গাছগুলোকে কেটে কয়েকটা লরিতে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রফিক মাসুম। ইতুকে বলতে, ও বলেছিল, ইডিয়ট, তখনই বলতে হত, পাড়ায় যাদের গাড়ি আছে তারা রফিক মাসুমকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে; গাছের ডালে বসে পায়রা আর অন্য পাখি গাড়িগুলোর ওপর হাগত , গাড়ি খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, সুপারি দিয়ে গাছগুলো কাটিয়ে নিলে রফিক মাসুম, দুদিক থেকেই টাকা খেলো ব্যাটা। শুনে অব্দি কেঁদেছিল অমিত, লুকিয়ে লুকিয়ে।
দ্বিতীয়বার কেঁদেছিল ব্যানার্জি দিদা মারা যেতে। ব্যানার্জি দিদা বলতেন ওনার ছেলেরা দিল্লি মুম্বাই আর লখনউতে থাকে। নাতিদের স্কুলের আর কলেজে ফলাফল ভালো হলে মিষ্টির বাক্স এনে বাড়ির সবাইকে খাওয়াতেন ; অমিতকে বলতেন, আমার নাতিদের মতন লেখাপড়া করে বড়ো হ, কতদিন এইভাবে চালাবি। কয়েকদিন ধরে পাড়ায় কুকুর মরে পড়ে থাকার মতন পচা গন্ধ আসতে জানা গেল যে ব্যানার্জি দিদার বাড়ি থেকে আসছে। সদর দরোজায় ধাক্কাধাক্কি করা সত্ত্বেও ব্যানার্জি দিদা যখন দরোজা খুললেন না, তখন পুলিশ এসে দরোজা ভেঙে কয়েকদিন আগে মরে পড়ে থাকা ব্যানার্জি দিদার লাশ পেয়েছিল, চেয়ারে বসে বসে পচে গেছেন। কতদিন যাবত টয়লেটে যেতে পারেননি, ঘরের কার্পেটের ওপর হেগেমুতে রেখেছেন, শেষে নড়তে না পেরে রকিং চেয়ারে বসে বসে কখন যেন মরে গেছেন, কোলে হাত রেখে। সারা ঘর অগোছালো, নোংরা। পুলিশ পরে জানিয়েছিল যে ওনার স্বামী বাংলাদেশ স্বাধীন করার যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। ওনার কেউই নেই। নাতিদের গল্প সব বানানো। শুনে অনেক কেঁদেছিল অমিত। অকারণে কান্না পায় ওর।
অমিত বলল, কোনো মানে হয়, ভেবে দ্যাখো, বাংলাদেশ স্বাধীন করতে গিয়ে কী পেলেন ব্যানার্জিদাদু? নেড়েগুলো তো দিনকেদিন হেফাজতে ইসলামি না কী যেন হয়ে যাচ্ছে, হিন্দুদের আর থাকতে দেবে না ওদের দেশে, কতো লোক পালিয়ে আসছে, আর ফিরছে না, মন্দির-টন্দির দুর্গা কালীর মূর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ওসব গল্প শুনি আর আমার কান্না পেয়ে যায়।
ওটা তোর পারসোনালিটি ট্রেট হয়ে গেছে, আর তার কারণ হল তুই তোর মায়ের দুধ খাসনি, মায়ের আদর খাসনি, মায়ের গায়ের গন্ধ জানিস না।
আমাকে ওরা ডাস্টবিনে ফেলে দিলেই পারত। যে বাড়িতে ফেলে দিয়ে এসেছিল, সেখানে আমি ডাস্টবিনেই থাকতুম, নয়তো আর কি! আমার তিনটে বাবা, ডাক্তার বাবা, কমরেড বাবা, রাঙা বাবা আর দুজন মা, কমরেড মা আর রাঙা মা, কিন্তু আপন বলতে আমার কেউই নেই। বলে, অমিতও ডাক্তার ঘোষের আদলে ষেঁড়োহাসি হাসল, তারপর বলল, আমি যদি তিনজন বাপের আর দুজন মায়ের কমবাইন্ড লিকুইড দিয়ে জন্মাতুম তাহলে বোধহয় আই ইডি বানাতে পারতুম, মাইন পুঁততে পারতুম, ক্রান্তি করার জন্যে গুলি ছুঁড়তে পারতুম, বলে, অমিত চোখ মুছল দুহাতের চেটো দিয়ে।
চোখে জল আনিসনি, ট্রাই টু কনট্রোল ইওরসেল্ফ। ডাস্টবিনে কেন ফেলবে? বোকা নাকি! তোকে নিজের প্রিয় বন্ধুর বাড়িতে রেখে এসেছিল, যাতে তারা নিজের পরিবারের সদস্যের মতন গড়ে তোলে তোকে, শিক্ষিত করে তোলে। ওদের বাড়িতে পর পর এত দুর্ঘটনা ঘটে গেল যে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। ডাক্তার নিজেকে শুনিয়ে বললে, ওরা অতনুর বন্ধু, আমার বন্ধু তো নয় ; মা বেঁচে থাকলে মানসীর বাচ্চাটাকে মায়ের কাছেই দিয়ে আসতুম, কত বাচ্চা তো ঠাকুমার কোলে মানুষ হয়।
সবই জানো দেখছি, এই জঙ্গলে বসেও সব খবর রাখো। কিন্তু বন্ধু সুশান্তজেঠুই তো কিডন্যাপ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, একজন বিহারি মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই থেকে গেছেন সুশান্তজেঠু। আমি আর ইতু বাড়ি থেকে পালিয়ে ওনার আস্তানাতেই প্রথমে ডেরা ডেলেছিলুম। টাকার বান্ডিল সুশান্তজেঠুর বিহারি বউ দিয়েছিল আমাদের।
কানে আসে। আরও অনেককিছু জানি, যা তুই চলে আসার পর ঘটেছে, সুশান্ত জেঠু আত্মহত্যা করে নিয়েছে, আর ওনার ছেলে অপু খুনোখুনি করে ফেরার হয়ে গেছে।
ওফ, আর বলতে হবে না।
এখন যোনির প্রসঙ্গটা জরুরি । তুই একটুতেই ভেঙে পড়িস।
তা নয়, মানসী বর্মণের ছেলেটার জন্য অতনু চক্রবর্তীর চেয়ে তোমার টান বেশি।
হতে পারে। এখন যা, তোর মা-বাপ দুশ্চিন্তা করবে, ভাববে আমি তোকে রিঅ্যাকশানারি বক্তৃতা দিচ্ছি। আমার ডাক্তারিটা ওদের দরকার, আমাকে তো ওদের দরকার নেই। আমি বেয়ার ফুট ডাক্তার তৈরি করে চলেছি, যারা শিখে-পড়ে মেডিকাল স্কোয়াডের কাজ করছে। তোকেও করতে চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু তুই বন্দুক-পিস্তল চালিয়ে ক্রান্তিকারীগিরিতে অংশ নিতে চাস, অথচ ভিতুর ডিপো। শেখ শেখ। শিখে নে বন্দুক-টন্দুক চালানো। তোকে কিন্তু যেতে দেবে না, দেখে নিস, তোকে প্রোটেক্ট করে রাখবে।
ক্রান্তিকারীগিরিতে যেতে তো আমাকে হবেই। নয়তো আমি এরকম কাওয়ার্ড ইডিয়ট থেকে যাবো। আমি ভেবে রেখেছি। তবে ওই মুফতি-পরা ক্রান্তিগিরীতে নয়, কাউকে অযথা খুন করতে পারব না। মারার জন্য কারণ থাকা দরকার। কনকদুর্গার কারণ আছে, ও পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষের ওপর ও চটা, সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে খুন করতে পারে; বলেছিল গুলি চালিয়ে দনাদ্দন ওড়াতে ওর বেশ মজা লাগে।
জানি, তুই কী ভেবে রেখেছিস।
জানো? হুঁঃ!
জানি। তুই যা মনে মনে ভাবছিস আমি তা বহুকাল যাবত ভেবেছি।
তার মানে তুমিও আমার মতনই কাওয়ার্ড বলো?
না, আমি আহাম্মক।
আহাম্মক মানে?
বাংলা ভাষাটাও জানিস না? আহাম্মক মানে এক্সট্রিমলি ফুলিশ, ল্যাকিং ইন কমন সেন্স।
তা ঠিক। নয়তো এখানে জঙ্গলে দেবদাস হয়ে পড়ে থাকতে না।
দেবদাস? শরৎচন্দ্র পড়েছিস দেখছি।
না, পড়বো কোথ্থেকে! শাহরুখ খানের ফিল্ম দেখেছি। অইশরিয়া রায় আর মাধুরী দিকছিত ছিল। ইতু ওর ল্যাপটপে পেনড্রাইভে ফিল্ম আনতো মাঝেমাঝে।
আমি দিলীপ কুমারেরটা দেখেছিলুম। সুচিত্রা সেন আর বৈজয়ন্তীমালা ছিল।
যে-ই থাকুক, রেজাল্ট একই। এক্সট্রিমলি ফুলিশ , ওই যে তুমি বললে। ল্যাকিং ইন কমন সেন্স।
অন্ধকার হয়ে যাবে। আলো তো জ্বলবে না কারোরই তেরপলে। তোর মায়ের আস্তানায় যাবি কি করে?
কথা ঘোরাচ্ছো কেন? আমি কয়েকজন ক্রান্তিকারীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি; ওরা বিশ্বাস করে যে তুমিই মানসী বর্মণের আসলি বর, কমরেড দীপকটা নকলি স্বামী। এতদিন রয়েছ পাশাপাশি। রেপ করার মতনও সাহস যোগাতে পারোনি, আর আমাকে বলছ কাওয়ার্ড। তুমি তো তোমার মায়ের দুধ খেয়েছিলে, নাকি?
কি আজেবাজে কথা বলছিস নিজের মায়ের সম্পর্কে। মানসী বর্মণ বাইরে ক্রান্তিকারী, ভেতরে ঠুনকো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলে ও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
একদিন মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবো নিশ্চই, দেখে নিও। শ্বাস ফেলবো ওনার মুখের ওপর, শুঁকবো ওনার ঘামের গন্ধ, বুকের দুধের হারিয়ে যাওয়া গন্ধ, জবাবদিহি চাইব যে ক্রান্তি করাটা আমার চেয়ে কেন জরুরি, মায়ের দায়িত্ব আগে সন্তান না ক্রান্তি, কেন আমাকে দুধের বয়সেই ফেলে চলে এসেছিলো, তারপর কেন খোঁজ নেয়নি, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে করে পাগল করে দেবো।
ঘুমোস। ওই যে কমরেড কনকদুর্গা তোকে ডাকতে এসেছে; তোর খাবার সময় হয়ে গেল।
কনকদুর্গা মেয়েটা বাঙালি নয়, কিন্তু মহা ধাকড়নি। ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি না, তেলেগুতে, হিন্দিতে, বাংলায়, ইংরিজিতে, সব ভাষায় কথা বলতে পারে। আমি কোনো ভাষাতেই ঠিকমতন কথা বলতে পারি না। ওকে এখানে কেন এনে ফেলল বলোতো? বোধহয় কমরেডদের চুল কাটার জন্য আনিয়েছে এখানে।
অমিতের উক্তি শুনে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ অট্টহাসি হাসলে ডাক্তার ঘোষ, যা ওর চরিত্রে বিরল। অমিত বলল, হ্যাঁ, হাসো তোমার ষেঁড়ো হাসি, কতোদিন যে হাসোনি, স্টক খালি করো।
অনেকের চুল ও-ই কাটে বটে, আমার চুল আমি নিজেই কাটি, জঙ্গলে আবার চুলের কোনো দরকার আছে নাকি। যা, খেয়ে নিবি যা।
তোমাদের এইসব ফালতু ক্রান্তিকারী খাবার-দাবারের চেয়ে কিন্তু ইতুদের বাড়িতে ভালো খাবার পেতুম, চাকরের জীবনে ভালো পেটপুজো।
তুই-ই তো বোকার মতন চলে এলি।
চলে আসিনি; ওরা তাড়িয়ে দিলে।
মোটেই তাড়ায়নি ওরা। তুই আর ইতু ছাদের অন্ধকারে জড়াজড়ি করে কিছু একটা করছিলি বলে শুনেছি, মারিহুয়ানাও ফুঁকছিলি। জানি তোরা ভাইবোন নোস ; কিন্তু ওনাদের বাড়িতে ছোটোবেলা থেকে যেভাবে দুজনে বড়ো হয়েছিস, ওনাদের চোখে ভাইবোন হয়েই ছিলিস। আত্মমগ্নতার বিরতি মিশিয়ে-মিশিয়ে কথাগুলো বললে ডাক্তার ঘোষ।
এসব খবরও এসে গেছে তোমাদের কাছে? তোমাদের ছিপকিলি জাসুস ওই বাড়িতেও আছে?
আমাদের খোচর সর্বত্র আছে ; পুলিশে, প্রশাসনে, গ্রামে, হাটে, সব জায়গায়। যাকগে এখন যা, কনকদুর্গা অপেক্ষা করছে। ওর আসল নামটা জিগ্যেস করে নিস।
যাবো যাবো, তাড়া কিসের? কমরেড জ্যোতিকে ভয় পাও!
পেলে তো ভালোই হতো রে। তা তুই সেক্স-টেক্স করলে নিজেকে ক্লিন করিস তো? ক্লিন করবি, আনহাইজেনিক থাকলে যার সঙ্গে সেক্স করবি তার ইনফেকশান হয়ে যাবে ; পেনিসে লিন্ট বা ম্যাগমা জমে, এক ধরণের মোম।
কি উল্টাসিধা পাঠ পড়াচ্ছ, ফালতু।
ইহুদিরা আর মুসলমানরা সুন্নত করে কেন? যাতে ক্লিন থাকে, নোংরা না জমে।
আমার ক্লিনই থাকে। প্রায়দিনই তো মিষ্টিবিষ্টি করি, কনকদুর্গাই বলেছে, পরিষ্কার রাখতে, নয়তো ওর মুখে ঘা হয়ে যাবে তো! পুরোনো পোশাক সঙ্গে রাখে ও, তাই দিয়ে নিজেই পুঁছে দেয়।
হোয়াট ইজ দ্যাট? শুনিনি তো, মিষ্টিবিষ্টি!
ইতুদের কোড ওয়র্ড, ওর বন্ধুর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিল, তখন শুনেছিলুম। ওরা ম্যাস্টারবেশনকে বলে মিষ্টিবিষ্টি।
আই সি। হ্যাঁ, এই বয়সে ওটা করা জরুরি, বাৎসায়নও বাতলে গেছেন কী ভাবে মিষ্টিবিষ্টি করতে হবে। দ্যাখ, ওই কাজের মাধ্যমে তুই পৃথিবীকে জানাচ্ছিস যে তোর একজন নারীর দরকার, মাটিতে বার্তা ফেলছিস, মাটি তো প্রতিদান দেবে। যাকগে, কনকদুর্গা দাঁড়িয়ে রয়েছে তোর জন্য।
ওকেও যোনি-ফোনি এইসব বুঝিও না যেন।
আবার তুই বাপের বয়সি লোকের সঙ্গে ফাজলামি করছিস।
পরে আসবো, আরও কি খবর জানো খোলসা করে বোলো।
ডাক্তার নিজেকে নিজের মনের ভেতর বললে, হয়তো এ আমারই ছেলে। এ যদি জেনে যায় যে এ নিশ্চিত আমার ছেলে, তাহলে এর সঙ্গে এমন খোলাখুলি কথা বলা যেতোনাকো ; এই বরং ভালো, কমরেড দীপকের চেয়ে কাছে টেনে আনতে পারছি।
টাঙানো তেরপলের বাইরে, ক্রেয়নে বাচ্চাদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় জেতা গোধুধূলির খাপচা কমলা-হলুদ রঙ নেমে আসছে ঘন সবুজ গাছগুলোর ওপরে।
অমিতের হাত ধরে ওর কোমর বাঁহাতে জড়িয়ে, আলো-অন্ধকারের ভেতরে সেঁদিয়ে কমরেড কনকদুর্গা বলল অমিতকে, চল ডাক্তারকেও কনফিউজ করি, উনি এখনও দেখতে পাচ্ছেন আমাদের, বলে অমিতের দিকে ফিরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল।
আরে আমি এরকম আদ্দেক-প্রেম পারি না, অমিত জড়িয়ে ধরেই বলল, চুমু খাবার সময় আমার শরীর চিনচিনিয়ে সাড়া দিতে থাকে, মুখ দিয়ে আমার আশ মেটে না।
তাহলে তুই মুখ খোল, জিভ ঢোকাই।
কী করছিস কি? উত্তেজিত করে দিচ্ছিস।
চল, ওই বাঁশঝাড়ের পেছনে যাই।
চল, ডাক্তার এগিয়ে এসে উঁকি মেরে দেখছেন, পরের বার নিশ্চয়ই অন্য লেকচার শোনাবেন, সারাদিন নিজের মনে ইংরেজিতে বিড়বিড় করতে থাকেন, পাগল হয়ে যাবেন বুড়ো বয়সে।
বিড়বিড় নয়, মার্কস লেনিন মাও ওনার মুখস্হ ; ঠিকই, বুড়ো হয়ে গেলে কমিউনিস্টরা পাগল হয়ে যেতে থাকে, স্বপ্ন ধ্বসে পড়ার বিষে ক্ষয়ে যান ওনারা। উনি কমিউনিজমে বিশ্বাস করেন না, বোধহয় মানুষের সমাজকেই বিশ্বাস করেন না।
অমিত বলল, আমিও করি না।
ডাক্তার ঘোষ তাকিয়ে রইলো কনকদুর্গার চুল-চিকচিকে খোঁপার দিকে, নিজেকে শুনিয়ে ফিসফিসিয়ে বললে, ‘প্রোট্র্যাক্টেড আর্মড স্ট্রাগল টু আনডারমাইন অ্যান্ড টু সিজ পাওয়ার ফ্রম দি স্টেট, স্বপ্ন দেখে যাও দেখে যাও দেখে যাও, যতদিন না ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝিমার হয়’।
কনকদুর্গা বলল, তোকে একটা ভয়ের খবর দেবো।
অমিত : আমি তো চিরকেলে ভিতু। কী খবর?
কনকদুর্গা: আমি প্রেগনেন্ট হয়ে গেছি, তিন মাস হয়ে গেল। ওরা জানতে পারলে রাখবে না। বলবে সারেন্ডার করতে।
অমিত জড়িয়ে ধরল কনক্দুর্গাকে, যাক, রোজকার ধস্তাধস্তির ফল ফলল তাহলে। এবার এখান থেকে পালাবার পথ তুই তৈরি করে দিলি কনকদুর্গা, দুজনে পালাবো। পালাবার আগে ওই দুটোকে ওড়াতে হবে।
কনকদুর্গা : আমি ভেবেছিলুম শুনে তোর মুখ শুকিয়ে যাবে।
অমিত : আরে নাহ, এখন নিজেকে আসলি ষাঁড় মনে হচ্ছে।
কনকদুর্গা অমিতের কোমর ধরে তুলে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঘাসের ওপর নিয়ে গিয়ে ফেলল, বলল, এবার থেকে সাবধানে, নয়তো বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, পাশাপাশি শুতে হবে।
মশারির ভেতরে শুয়ে, ডাক্তার ঘোষের মনে পড়ল, মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তার শারীরিক অবস্হা বোঝার ক্ষমতা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলো, আর শিক্ষনবিশ বেয়ারফুট ডাক্তারদের সেই ক্ষমতাটি দেবার প্রয়াস করে, যাতে উপজাতি রোগীকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে বিমূঢ়াবস্হায় না পড়তে হয়। মেয়ে শিক্ষানবিশরা তা দ্রুত শিখে ফেলতে পারে, কেননা তারা জানে যে রোগীরা কোথায় হাগতে যায়, জঙ্গলে না ঘাসের ওপর না নদীর বালিতে।
মশারির ভেতরে ঢুকলেই মায়ের ঘুমপাড়ানি গানের সুর ভেসে আসে ডাক্তার ঘোষের কানে, একের পর এক, যার সাহায্যে জখম বা বুলেটফোঁড় ক্রান্তিকারীদের কান্না-কাতরানির অসহ্য স্মৃতিকে সামলায়, কিন্তু গানের কথাগুলো ইংরেজিতে, সেই একই, অ্যানিহিলেশান অফ ক্লাস এনিমিজ অ্যান্ড এক্সট্রিম ভায়োলেন্স অ্যাজ এ মিন্স টু সিকিয়র অরগানাইজেশানাল গোলস, মায়ের মুখ ভেসে ওঠে।
ইংল্যাণ্ডে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলো, রেডিওলজি। যাবার আগে, মায়ের কথা মেনে, কচি বয়সেই উচ্চমাধ্যমিকের পর বিয়ে করে নিয়েছিলো উচ্চমাধ্যমিকেরই মানসী বর্মণকে, যাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । মেয়েটি দৃষ্টিকটুভাবে সুশ্রী, আকর্ষণীয়ভাবে উন্নাসিক, ফুলোফুলো আঙুল, ঢাউস বর্তুল বুক, গভীর কালো চোখ, পাতলা কোমর আর হ্যাঁ, বেশ ফর্সা।
ফুলশয্যার রাতে, ফোম লেদারের একটা ব্যাগের জিপ খুলে বিছানার ওপর অজস্র চিঠি, তার অধিকাংশ খাম আর ইনল্যান্ড, খোলা হয়নি, ছড়িয়ে মানসী বর্মণ বলেছিলে, এই নাও, কোনোও যৌতুক চাই না বলেছিলে, এগুলো ক্লাস এইট থেকে আমাকে লেখা ঘাড়েপড়া প্রেমিকদের প্রেমপত্র; আমি কাউকে পাত্তা দিইনি। আজ রাতে তুমি যাচাই করে দেখে নাও যে আমি ভার্জিন, নয়তো পরে তোমার মনে হবে এর তো প্রেমিকদের লাইন ছিল, নিশ্চয়ই কারোর সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে তার সঙ্গে শুয়ে থাকবে। শুইনি কারোর সঙ্গে। শুতে হলে ডিজায়ারেবল হওয়া অতি আবশ্যক, তোমাকে ডিজায়রেবল মনে না হলে বিয়ে করতুম না। তুমি শোওনি তো কোনো মেয়ের সঙ্গে, খোলাখুলি বলো, আমি সবকিছু স্পষ্ট বলি, কোনো হাইড অ্যাণ্ড সিক নেই।
এই বয়সেই বিয়ে করতে রাজি হলাম ওই কারণেই, কৌমার্যটা তোমাকে সঁপে বিদেশে যাই। তাছাড়া তোমাদের বাড়ির লোকেরা খোঁজ নিয়ে জেনে গেছেন যে আমার বেশির ভাগ সময় কাটতো ছাত্র-রাজনীতি করে, দেয়ালে পোস্টার মেরে ; ভালো রেজাল্ট করতে পারিনি ক্রান্তিকারী রাজনীতির স্বপ্নে, নয়তো ভারতে কোনো মেডিকাল কলেজে সিট পেয়ে যেতাম। এখন কথা বন্ধ করে কাজে নেমে পড়া যাক, ফুলশয্যাকে বক্তৃতার মঞ্চ করে ফেলছ।
মলয় রায়চৌধুরীই অতনুকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছিল চৌমাথার দিকে, যাতে ব্যাটা সেখানে পৌঁছে ভ্যাবাচাকা খেয়ে মরে, এবারে কোন দিকে যাবে, কোন রাস্তা বেছে নেবে, বন্ধু তো, দিয়েছে ঠেলে শুকনো কুয়োর ভেতরে। অসীম পোদ্দারের দেয়া পোর্টম্যান্টো ব্যাগের ভেতরে যে গাদা গাদা টাকা ঠাসা আছে, অফিস থেকে গেঁড়িয়ে জমিয়ে রেখেছিল আর সেই টাকায় রেন্ডিবাজি করে বেড়াতো, পুলিসের রেইড পড়তেই মানসী বর্মণের হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে নিজে নৌকো থেকে ঝাঁপ মেরে পটল তুলেছিল বাঞ্চোৎ। মানসী বর্মণ চাকরি ছেড়ে চলে যাবার আগে সেটা ধরিয়ে দিলে অতনু চক্রবর্তীকে। সহকর্মী বন্ধুদের একের পর জেরার শেষে অতনুর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো প্রমাণ পেলো না, তখন, সেই দিনই, সন্দেহ হওয়াতে অতনু বাড়ি ফিরে ব্যাগটা খুলে দ্যাখে টাকায় ঠাশা, হাজার-হাজার টাকা। ব্যাস বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিল না। মলয় রায়চৌধুরী ওকে পাঠিয়ে দিল মানসী বর্মণের কাছে, ক্রান্তির মাংসল ঘুর্ণিতে।
মলয় রায়চৌধুরী এবার অমিতের জীবনকে জড়িয়ে দিল কনকদুর্গার সঙ্গে, যে অমিতের চেয়ে পনেরো বছরের বড়ো। ওরা দুজনে পাটনায় পালাবে তা মলয় রায়চৌধুরী জানে, এখন দেখার যে কাদের খুন করে ওরা পালাবে।
ডাক্তার মশারির ভেতরে ঢুকে পড়লো, পায়ের ওপর পা চাপিয়ে, মাথার তলায় দুহাত রেখে মলয় রায়চৌধুরীর বই চারটে সম্পর্কে ভাবতে লাগলেো।
ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ, ঔরস, চারটে বইতে কোথাও মলয় রায়চৌধুরী এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়নি কেন?
১. মাও সে তুঙ আর হেনরি কিসিঞ্জার, এই দুজনের দাঁত বের করা হাসি দেখার জন্যেই কি সাংস্কৃতিক বিপ্লবে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল? কিসিঞ্জার তো ওই ফোটো তোলাবার সময়েও ভিয়েৎনামে নাপাম বোমা আর কমলাবিষের ধোঁয়ায় মানুষকে পুড়িয়ে মারছিল, মনে নেই?
২. মাও সে তুঙ আর হেনরি কিসিঞ্জার দুজনেই বুঝেছিল দু দেশের বাজারের মালপত্তরের বেচাকেনা দুই দেশের জন্যে জরুরি। বাজার যতো বাড়বে, ততো জিনিস বিক্রি হবে, ততো চাকরি বাড়বে, ততো দেশ উন্নতি করবে। তাহলে লেনিন কেন আগ বাড়িয়ে বলেছিল, ফ্রিডাম ইন ক্যাপিটালিস্ট সোসায়টি অলওয়েজ রেমাইনস অ্যাবাউট দি সেম অ্যাজ ইট ওয়াজ ইন অ্যানসিয়েন্ট গ্রিক রিপাবলিকস? ছ্যাঃ।
৩. ভারতে নকশাল আন্দোলন ঘটছে জেনে তাকে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ বলার সময়ে চীন কেন পাকিস্তান আর শ্রীলংকায় অমন ক্রান্তি ঘটাবার চেষ্টা করেনি?
৪. বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়ের মূর্তির মাথা কেটে কোন ক্রান্তি ঘটাবার চেষ্টা হয়েছিল? ভারতবর্ষ মানে কি শুধু কলকাতা, শুধু পশ্চিমবাংলা? বিদ্যাসাগরের গড়ে দেয়া ভাষায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, রেড বুক, অনুবাদ করার সময়ে মনে ছিল না? সোভিয়েত দেশে বসে রুবল আর ভোদকা খেতে খেতে রুশভাষার বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করার সময়ে কেন মনে পড়েনি, ভাষাটা কারা তৈরি করে দিয়ে গেছেন! চটকলের গেটে আর গড়ের মাঠে ভাষণ দেবার সময়ে মনে ছিল না ভাষাটা কারা গড়ে দিয়ে গেছেন?
৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে চীন কেন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, নিক্সনের চামচাগিরি ছাড়া আর কীই বা বলা যায় একে? এদিকে তো গায়ে পড়ে সবাইকে মানবমুক্তির লেকচার দিতো মাও সে তুঙ! চৌ এন লাই কি ইয়াহিয়া খানের গণহত্যা আর গণধর্ষণের প্রশংসা করে প্রেমপত্র লেখেনি? তাহলে?
৬. ১৯৭১ সালে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে এসে ভিখিরির মতন রাস্তার দুধারে জীবন কাটিয়েছিল, কতো মেয়ে ধর্ষিত হয়েছিল, তার হিসেব নেই। মাও সে তুঙ আর মাওবাদীরা এ-ব্যাপারে মুখ খোলেনি কেন? চীনের সংবাদপত্রে বাংলাদেশে গণহত্যা আর গণধর্ষণের খবর চেপে যাওয়া হয়েছিল কেন?
৭. আমাকে এই জঙ্গলে মাওবাদীদের ডাক্তার বানিয়েছে মলয় রায়চৌধুরী। এতে আদিবাসীদের কোন উপকারে লাগছি আমি? ইতি গেছে অবুঝমাড়ের জঙ্গলে, সেখানে গিয়ে কোন কাজে লাগছে? তার চেয়ে অমিতের সঙ্গে ঘর বাঁধতে পারতো, সুখী হতো।
৮. ১৯৭০ সালের শীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যকে কেন খুন করা হয়েছিল? মতাদর্শ যে বুদ্ধিকে ভ্রষ্ট করে তা টের পেতে প্রজন্মকে নস্যাৎ করে ফেলতে হয়েছিল কেন?
৯. চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চরিত্র পালটে যাচ্ছে তা বুঝতে এতো দেরি হয়েছিল কেন?
কই, মলয় রায়চৌধুরী, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপা, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামে, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, অইফব, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, বিসপামা, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে লিবারেশান, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে রেড ফ্ল্যাগ, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে নিউ ডেমোক্র্যাসি, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে অরগ্যানাইজিং কমিটি, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে শান্তি পাল, জবাব দাও জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে নয়ি পহল, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে নিউ প্রলেতারিয়ান, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে সত্যেন্দ্র সিংহ, সন্তোষ রাণা, জবাব দাও জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে নকশালবাড়ি রউফ, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে জনশক্তি কুরা রঞ্জনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে জনশক্তি রণধীর, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই ভাকপামালে জনশক্তি চন্দপুলা রেড্ডি, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে মাধব মুখার্জি, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে কেন্দ্রিয় টিম, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে জনসংবাদ, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে ভাইজি, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে প্রজাশক্তি, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে প্রজাপতিঘটনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপামালে প্রতিঘটনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ইউনিটি সেন্টার মালে ডিভি রাও, জবাব চাই, জবাব দাও।
কই, ইউনিটি সেন্টার মালে আজমের গ্রুপ, জবাব চাই, জবাব দাও।
কই, কপাভারত রঞ্জন চক্রবর্তী, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, লাল ঝাণ্ডা দল, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, সুসিক, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, রিকপাই, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, সিএমপি অরবিন্দাকশন, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ইউনাইটেড ভাকপা মোহিত সেন, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, কমাপা সিপি জন, জবাব দাওম জবাব চাই।
কই, গসপা সৈফুদ্দিন চৌধুরী, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ওড়িশা কপা অজয় রাউত, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, কপাবিমা দার্জিলিঙ, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, সিআরএলআই অসীম চ্যাটার্জি, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ত্রিপুরা গণমঞ্চ অজয় বিশ্বাস, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, লাল নিশান দল লেনিনবাদী, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, মার্কসবাদী মঞ্চ আসাম জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, পিআরপিআই সুমন্ত হীরা, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, ভাকপা মাওবাদী, মুপ্পলা লক্ষ্মী রাও, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, কলিভামালে রামনাথ, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, কলিভামালে প্রতোকল্পনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, কলিভামালে রিভিশানিস্ট, জবাব দাও, জবাব চাই।
কই, মলয় রায়চৌধুরী, জবাব দাও, জবাব চাই।
মশারির ভেতরে শুয়ে ডাক্তার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো ঝিঁঝি-পুরুষরা ডানা কাঁপিয়ে বলে চলেছে, জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই….
১৭৮৯ সাল থেকেই তো যুবকেরা, যখন মানুষ যুবক থাকে, সেই বয়সে, প্রতিষ্ঠানকে বদলাবার জন্যে মতাদর্শের আশ্রয় নিয়ে খুনোখুনি করবেই, তুমি কোন বদলকারীর দলে তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। তুমিও তোমার শত্রুর আদলে গড়ে উঠবে। তোমার প্রজন্ম চলে যাবে, তারপর আরেক প্রজন্ম এসে বদলাবার চেষ্টা করবে। অথচ দুই পক্ষই জানে যে পৃথিবীর একটা বালও তুমি ওপড়াতে পারবে না।
বিপ্লব হলো একধরণের বৃত্ত, সুতো দিয়ে তৈরি।
বিপ্লব হলো শাঁখের করাত, দুদিকেই কাটে।
চিন্তার কুয়াশায়, ডাক্তার ঘুমিয়ে পড়লো বুকে দুই হাত রেখে, যেমনটা লেনিনের দেহকে মলম মাখিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে, যাতে রুশ দেশের মানুষ, তাঁর পেল্লাই মূর্তিগুলো উপড়ে ফেলে দিলেও, তাঁকে না ভুলে যায়।
মানসী ঈশ্বরে বিশ্বাস করে; বন্দুকের নলের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে; একই সঙ্গে দুজন পুরুষকে ভালোবাসায় আর বিশ্বাস করে, এককালে দুজনের সঙ্গে একই দিনে সেক্স করায় বিশ্বাস করতো।
ফুলশয্যার বিছানায়, ডাক্তারের ডাক, ওকে, শুরু করা যাক।
কাজ হয়ে গেলে স্বামী পাশ ফিরে শোবার তোড়জোড় করছে দেখে মানসী বলল, দাঁড়াও, এক্ষুনি ঘুমোতে চললে কেন। পিঁড়িতে বসে তো অনেক সংস্কৃত মন্ত্র আউড়ে ছিলে পুরুতের কথামতো; তারপর আমার শরীরের পিঁড়িতে বসে দেহের মন্তর ভাঁজলে। এবার আমার মন্তর ভাঁজার পালা, তোমার দেহের পিঁড়িতে বসে। তোমার হয়ে গেলেই হলো? আমারও তো হওয়া দরকার, নাকি?
ঠিক আছে, বোসো, বলো কী মন্তর বলতে চাও।
বসি আগে ; একি ফসকে যাচ্ছে কেন? মন ভরে গেল আর ব্যাস, তোমার মন অন্য দিকে চলে গেল।
আমি ফসকাচ্ছি নাকি? পিঁড়িতে তো তুমি বসে আছো।
দাঁড়াও, যুত করে বসি, হ্যাঁ, এইবার, আমার চোখে চোখ রেখে দ্যাখো।
সক্রিয় হও, নয়তো ফসকাবে।
এখানে যে ফিসফিসিনি-গুজগুজুনি ছাত্র-রাজনীতি করো, তা বিদেশে গিয়ে করা চলবে না, ফিরে এসে যে দলের ঝান্ডা চাও দেশে এসে ওড়াবে, ওদেশে নয়।
ফসকে যাচ্ছে, বক্তৃতা দিতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছ, এখন সক্রিয় হও , পরে না হয় বক্তৃতা দিও। মনে করো দিকিনি যে তুমি ঘোড়ায় চেপে বেড়াতে যাচ্ছ আর ঘোড়াটা দুলকি চালে হাঁটছে।
ইশশ...দুলকি চাল চাই ওনার, এই নাও রাজধানী এক্সপ্রেসের চাল। কী? হল তো?
কই! হয়নি। ওপর থেকে নামো, আমি ট্রাই করি।
না, ওপরে বসে কথাগুলো বললে তোমার মনে থাকবে, নয়তো বিদেশে গিয়ে ভুলে মেরে দেবে কী কী বলেছি, ওদেশে মেমগুলো আদেখলা।
বলো, হেল্প করব?
না, আমার গায়ে যথেষ্ট জোর আছে, তুমি পিঁড়ি হয়ে চুপ করে থাকো। টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ, কী? এখন কেমন। এবার ঘোড়াকে ছোটাচ্ছি কিন্তু, রেডি স্টেডি গো। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি, না? স্হির থাকো, নট নড়ন-চড়ন।
রইলাম।
মারো জোয়ান হেঁইও, জোরসে মারো হেঁইও, সাবাশ জোয়ান হেঁইও, মানসী জড়িয়ে ধরে ডাক্তারকে।
ডাক্তার বলে ওঠে, কী হলো, ও মাঝি তোর হাল শক্ত করে ধর।
ঠিক আছে, আবার মর্নিং শো।
অ্যাজ ইউ প্লিজ।
বিদেশে ঠিক মতন পড়াশুনা কোরো, রাজনীতি করার লোভে কোনো মেয়ের পাল্লায় পোড়ো না যেন, শেষে রোগবালাই হবে, আমি সামলাতে পারব না। রাজনীতি করতে হয় তো কার্ল মার্কসের কবরে গিয়ে প্রার্থনা কোরো যে মেডিকাল পরীক্ষায় যেন ভালো রেজাল্ট হয়, দেশে বউটা একা পড়ে আছে, দেশে ফিরে প্রয়োজন হলে ফিসফাস-রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতি যা হয় করব।
যাই তো আগে ; সত্যি ওখানে গিয়ে ফলাফল ভালো করতেই হবে, নয়তো বাবার রেখে যাওয়া টাকা নয়ছয় করা হবে, মা তা সহ্য করতে পারবেন না।
প্রেমপত্র লিখো না ; প্রেমপত্র পেয়ে-পেয়ে ঘেন্না ধরে গেছে। সাদামাটা কথা লিখবে, ফোন করবে।
পিঁড়ির কাজ সমাধা করে ফেলেছ? কাঁপছো দেখছি! আর কিছু বলার আছে?
যাওয়া না পর্যন্ত প্রতিরাতে একবার আমি পিঁড়ি হব, একবার তুমি পিঁড়ি হবে।
একবার কেন?
একবার হল কথার কথা।
ভার্জিনিটি যাচাই করে, একে আরেকের কৌমার্যের সিল ভেঙে, হবু ডাক্তার চলে গেলো লন্ডনের রয়াল কলেজ অফ রেডিওজিতে ডাক্তারি পড়তে।
কোর্স পুরো করে ফেরার আগেই লন্ডনে বসে শুনলো, স্ত্রী মানসী একাকিত্ব কাটাবার, আর শাশুড়ির উঠতে-বসতে উপদেশ এড়াবার জন্য চাকরি নিয়ে চলে গেছে পাটনা। শুনে, ডাক্তারের মনে হল, মানসীর কথা না শুনে, একটা বাচ্চা পয়দা করে বা বউকে প্রেগনেন্ট করে বিদেশে গেলে, বউয়ের একাকিত্বের নিদান দিয়ে যেতে পারা যেতো। বউ একা কী করে প্রেগনেন্সি সামলাবে, ওর অবর্তমানে বাচ্চা হলে, কোলের শিশুকে কে সামলাবে, মাকে কে দেখবে, কচি বয়সের দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে মানসীর কথামত বাচ্চা মুলতুবি রাখার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলো।
শাশুড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হবারই ছিল, দুজনেই বড্ডো বেশি কথা-কইয়ে।
ডাক্তার কলকাতায় ফিরলো, মানসী কলকাতায় ফিরলো না, করকরে মাইনের এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, বলেছিলো মানসী, তুমিই এসো যখন মন কেমন করবে, শরীর ছোঁকছোঁক করবে। দেড় বছরের মাথায় মা মারা গেলেন, তবুও মানসীর ফেরার ইচ্ছা হল না, বললো, এই তো বেশ চলছে, তুমি তো সপ্তাহে একদিন আসছ, আমিও বড়ো ছুটি পড়লে যাচ্ছি , কারোর তো অসুবিধা হচ্ছে না। মানসীকে ডাক্তার বলে ফেলেছিলো যে সপ্তাহে একদিন এসে মন ভরে না, রোজ দুবেলা সেক্স করার ইচ্ছে হয়।
মানসী বলেছিলো, ডাক্তারের থুতনি ধরে, যে ওরও অমন ইচ্ছে হয়, কিন্তু কী আর করা যাবে, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এমন মাইনের চাকরি পাওয়া যায় না, অফিস কোয়ার্টার দিয়েছে, চাইলে নানা রকম লোন দ্যায়, কতো সুবিধা। ডাক্তার যে রাতটা থাকতো, যতবার পারতো সেক্স করতো দুজনে। সপ্তাহ-শেষে, প্লেনে সন্ধ্যায় পোঁছে পরের রাতে ট্রেনে যাতায়াত, ক্লান্ত দেহে আনন্দ নেবার মতন আহ্লাদ ভরপুর থাকত না।
একটা রাত আর দিনের জন্য ঢুঁ মারতো, লুকিয়ে, যাতে কেউ না ওকে দেখে ফ্যালে। ইনটারভিউ দেবার সময়ে টেবিলের ওদিকে বসে থাকা তিন মাঝবয়সী সাক্ষাৎকার-গ্রহণকারীর মুখ দেখেই মানসী আঁচ করে ফেলেছিল যে এরা যেভাবে তাকাচ্ছে, টেবিলের তলা দিয়ে নিজেদের বিরাট বিরাট অ্যানাকোন্ডা সাপকে ওর দিকে পাঠিয়ে সাপটে জড়িয়ে ধরার জন্য লড়ে মরছে । চাকরিটা পেতে হলে বিয়ে হয়ে গেছে বলা চলবে না, চাকরির দরখাস্ততেও জায়গাটায় তাই টিক দেননি, এর আগের ইনটারভিউয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। অ্যানাকোন্ডা তিনটে ওর গলা জড়িয়ে ধরে দমবন্ধ করে বলিয়ে নিল যে, না, বিয়ে করিনি এখনও। অফিসের সকলে জানে মানসী বর্মণ অবিবাহিত। বর লুকিয়ে এসে জমানো ফোঁটাগুলো ফেলে লুকিয়ে চলে যায়, তা কেউ জানে না।
মানসী যখন প্রেগন্যান্ট হলো, তখন অফিসের ননীগোপাল বসু আর তাঁর মুসলমান স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে রটিয়ে দিতে হল যে ননীবাবুর স্ত্রীর জরায়ুর সমস্যার কারণে মানসী ওনাদের বাচ্চার সারোগেট মা হতে রাজি হয়েছে। প্রেগন্যান্ট হয়েছে শুনে আনন্দে আটখানা আর কাজে অন্যমনস্ক ডক্টর ঘোষ তার হাসপাতালে এক বিপর্যয় ঘটিয়ে বসলো, আর মানসীর নির্দেশমতো কলকাতার বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে, মানসীর অফিসের চাপরাসি রাজনৈতিক কর্মী রসিক পাসোয়ানের সঙ্গে পাটনা স্টেশানে যোগাযোগ করে ডাক্তার পালালো ওয়ারিস আলি গঞ্জের দাতব্য চিকিৎসালয়ে। রসিক পাসোয়ান লোকটা মানসীর অফিসেরই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, গরমকালেও মাথায় সর্ষের তেল চুপচুপে, অফিসের দেয়া পোশাকেও কলার তেলে চিটচিটে, মুখময় পানিবসন্তের শ্রীছাঁদ, ডান হাতের তর্জনী অর্ধেক কাটা। পরে জেনেছিলো ডাক্তার ঘোষ, আঙুল সে নিজেই অফিসের মেশিনে কাটিয়ে ফেলেছিল, অফিসের কাছ থেকে বিমার টাকা পাবার জন্য, যা ও ক্রান্তির কাজে লাগিয়েছিল।
রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি ; সুশান্ত জেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে, একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি। তুই মিশনের গেটের কাছে পোঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি। নারায়নপুরে নেটওয়র্ক ততো ভালো কাজ করে না। ছেলেটা রেসপন্ড করে বলবে, ওর নাম বীরবল মাড়িয়া। হিরো হন্দার কালো রঙের স্পেলন্ডার মোটর সাইকেলে আসবে। ও তোকে নমস্তে ইতুদিদি বললে, কোনো কথা না বলে পিলিয়নে বসে পড়িস। ও তোকে যেখানে পৌঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ। চিন্তা করিসনি, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান।
বাস ডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ পুঁছে নিচ্ছিল যাত্রীদের এড়িয়ে। বলেছিল, আর দেখা হবে না জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি। উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময়ে কাট অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল। সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থাক, থেকেও তাদের ভুলে থাক। গেট রিড অফ অল মেমরিজ।
ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করার কেডস, কাঁধে ওর রাকস্যাক। রায়পুরে দুবোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে।
যে বাসটায় চেপেছিল, সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস। কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে, স্কুলের অ্যাটেন্ডেসন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রীর কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিলো। মাসের শেষে টাকা নেবে, উপস্হিতি অনুযায়ী। প্যাসেনজারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা সদর নারায়ণপুরে ; তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল কলেজ, সিনেমা হল, মালটিপ্লেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও। ইতুকে কন্ডাক্টার বলল, দিতে হবে না।
বাস থেকে নেমে হাতে টানা রিকশোয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু।
নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সদাইকেলের পিলিয়নে বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল; উফ ফেরোমন। মুখে কাঁধের থলেটা চাপা দিয়ে সামলালো। কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারলো যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আর এক হাতে মোটর সাইকেলে হ্যান্ডেল, নয়তো সড়কের যা অবস্হা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই। ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে। ইতুর মনে পড়ল, অমিত এই ভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিল।
যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রঙ মুখের গড়ন দেখে আদিবাসী বলেই মনে হয়। ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায়।
-- না দিদি, দান্তেশ্বরী হলো বস্তারের দেবী। নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হলো কাকসার। বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে।
মেঘনাদ! মাইকেলের? ইতু নিজেকে নিঃশব্দে বলল।
যুবকটি বলল, জানেন, এখানে কেউ আসে না, বেশ দূরে দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার কিলোমিটার জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না। কেন বলুন তো? হোল ইন্ডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি। নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হলো অবুঝমাড়।
ও আচ্ছা, শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বলল ইতু।
জানেন, অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশবল আর ক্রান্তিকারীরা।
ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম? বাড়িতে কি ভালো ছিলুম না? আমি তো অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়েছি, অমিতের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কোথাও সংসার পাততে পারতুম, বস্তিতেই থাকতুম না হয়, অমিত কিছু কাজ তো করতো, অন্তত আমার ডিসপেনসারিতে হেলপার হয়ে? যাকগে, এবার নিজের জন্যে কিছু করব, ক্রান্তিকারীদের চিকিৎসা তো করতে পারব, জঙ্গলে এতো পরিচিত গাছগাছড়া রয়েছে।
বীরবল মাড়িয়া বলল, কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে ক্রান্তিকারীদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে রোগে ভুগে ভুগে হাড্ডির চামগাদড় হয়ে যায়। আপনি দেখুন কতোদিন এখানে টিকতে পারেন। জল তো নোংরা, টিকতে হলে সালফি খেয়ে চালাতে হবে।
সালফি?
হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকমের মদ। তালগাছ বা খেজুর গাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো, যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বের করে, তেমনি করে সালফি বের করতে হয়।
ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে, বীরবল বলল, চলুন আরেকটু এগিয়ে দিই।
মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নীচু চালাঘরের মতন একটা জায়গায় পৌঁছোলো ইতু আর বিরবল। উলঙ্গ কিশোর-কিশোরীরা খেলা করছে, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়তো কখনো স্নান করেনি। শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুক ঢাকা পোষাক পরে ; এদের কুঁচকির চুলও দেখা দেয়া আরম্ভ হয়েছে, বুকও উঠে এসেছে, এই বয়সে ইতু বডিস আর জাঙিয়া পরা আরম্ভ করেছিল।
কয়েকজন সিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা। বীরবল বলল, ওরা এ গ্রামের নয়, কুরসুনার গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে। এই অবস্হায় ওরা ভেতরে গেলে ক্রান্তিকারীরা ধরে ফেললে ফাইন করবে।
মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি ছিল না, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু। এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, জীবনকে যথেচ্ছ উপভোগ করতে চায়, পোশাকের পরোয়া নেই, এখনও এরা কলাকৌশলের জাঁতিকলে আটকে পড়েনি, এখনও ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু। সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে ততো বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহরের মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে। মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইলো না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে। বোধহয় এটাই মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য। সভ্যতা যতো সভ্যতর হয়ে চলেছে ততোই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ।
এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বা ক্রান্তিকারীরা বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কীসে তাদের আনন্দ। সভ্যতা মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে, মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্হ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক। কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। দেখি, কী হয়। অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্হতায় যদি জীবন কাজে লাগাতে পারি তাহলেই যথেষ্ট , তাহলে অমিতকে ভুলে যেতে পারবো।
গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হলো। দুপাশে চেনা-অচেনা নানা রকমের গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর। তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, সন্ধ্যা হয়ে এলো। আপনি প্রথমে যে গ্রাম পাবেন, সেখানে অপেক্ষা করবেন, কেউ আপনাকে নিতে আসবে। কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে যদি এগিয়ে যান, একটা বড়ো গ্রাম পাবেন, সেখানে অপেক্ষা করবেন। অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না ; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালারা সাপ হয়ে যায়, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার, নানারকম। আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে। টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয়।
-- সে কী, তুমি যাবে না? ইতু বুঝতে পারলো যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনি খাচ্ছিল। এবার থেকে ও একা। কারোর ঘাড়ে চাপার জন্যে তো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েনি।
-- না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না। মাড়িয়া-গোঁড়রা জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে। জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না ; যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন।
ইতু হাত তুলে, ফির মিলুঙ্গি জানিয়ে, এগোলো বনের পথে। বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিনস খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিলো। ওহ কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি বসানো ঘন সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দুহাত মেলে জন্মেছিল। টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল। সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে বাড়িতে নিজের ঘরে ঢুকে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।
বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখলো, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুণ জ্বালা করছিল। একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, তার শাঁস কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি জায়গায় লাগিয়ে নিলো।
বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে। দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউউ, আমি ইতান, পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন। দুদিকে দুহাত মেলে আবার চেঁচালো, আমি ইতুউউউউউ...আমি আদি মানবিইইইই...আমি ইতু...আমি ইতু...আমি ইতুউউউউ….।
শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখলো, একটা কাঠবেড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপরে উবু হয়ে বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি। কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেল, পোশাক আর জুতো পরে নিলো, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায়, জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজতে-থাকা ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে ঢুকে আসছিল। ওপর থেকে কয়েকটা ফুল ঝরঝর করে ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেলো যে এটা মহুয়ার গাছ ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত, ওকে ওর ক্রান্তিকারী মা-বাপ যেমনটা বুঝিয়েছিল, ও সেটাই বলেছে, বলেছিল হাঁটতে থেকো যতোটা পারো, পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে। তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ইতুর, গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল। সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে।
ঘুম ভাঙতে, দেখল অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয়। জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হলো সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম মাংসল, যেন ভিজে-ভিজে, তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিলো। কী করবে? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে! বিশ্বাস করি না, অথচ বিশ্বাস করে ফেলছি, ভয়ে। এককালে অমিতকে ভিতু বলে কতো ডাঁট-ফটকার দিয়েছি। কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে। হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁ হাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, ঠাণ্ডা সাপের গায়ে হাত ঠেকল, নরম। সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল। ইতু বুঝতে পারছিল ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক।
হঠাৎ ইতুর চোখের ওপর সরু নিয়নের আলোর মতন রশ্মি পড়তে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল, বুকের দামামা আরও জোরে বাজা আরম্ভ হলো। কোনো ময়ালের চোখ নয়তো? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, ইতু আবছা দেখলো, ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী। সকলের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, দেখেনি তো কখনও। আমাকেও ঝোলাতে হবে নাকি! এই উদ্দেশ্যে তো আসিনি, আদিবাসীদের চিকিৎসা করতে এসেছি।
---ডক্টর ঘোষ? ওয়েলকাম। একজন যুবক বলল।
ইতুর মুখ দিয়ে বেরোলো, থ্যাঙ্কস, ম্যায় বহুত ডরি হুই থি।
যুবতী বলল, জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর আপকো নিন্দ সে নহিঁ জগায়া। আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয়।
ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে! দেখুকগে, কীই বা এসে যায়।
যুবতী বলল, ওর নাম সোনারি, বলল, আপ হম লোগোঁকে বিচ মেঁ রহিয়ে, ইতুকে ঘিরে ওরা হাঁটা আরম্ভ করল, অন্ধকারে, টর্চ না জ্বেলে। বনপথের সহযাত্রীদের ঘেরাটোপে বোধহয় আরও ঘণ্টা দেড়েক হেঁটেছিল ইতু।
তখনই অন্ধকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল।
আচমকা গুলি চলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুকে টেনে শুকনো পাতার ওপর নামিয়ে, ওরা ইতুর দেহ ঘিরে শুয়ে পড়ল। ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ। শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর, প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল, ঠিক ওর শরীরের সম্মোহক গন্ধ।
অসংখ্য গুলি ওদের দিকে এসে ঝাঁঝরা করে দিল সবাইকে, ইতুকেও। কুণ্ডলীপাকানো ময়াল সাপের মতন পড়ে রইলো ইতুর আর ওর ক্রান্তিকারী রক্ষীদের মৃতদেহগুলো।
হাসপাতালে, এম আর আই স্ক্যান করার জন্য একজন বয়স্ক রোগীকে শুইয়ে টেকনিশিয়ানকে নির্দেশ দিচ্ছিলো ডক্টর ঘোষ, তখনই বুড়ো ওয়ার্ডবয় গোপাল নস্কর পাশের ঘরে নিয়ে যাবার বদলে একটা খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঢোকে, আর এম আর আই মেশিনের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রচণ্ড আকর্ষণে সিলিণ্ডারসুদ্ধু ওয়ার্ড বয়টা রোগীকে নিয়ে বাজপাখির ছোঁমারার মতন করে সেঁদিয়ে গেলো মেশিনের ভেতরে; রোগী তক্ষুনি মারা যায়। ভ্যাবাচাকা খেয়ে টেকনিশিয়ানটা পালালো।
মেশিনের কোয়েঞ্চিং সুইচ অফ করে ম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিঅ্যাকটিভেট করার বদলে রোগী আর ওয়ার্ড বয়কে বের করার চেষ্টা করে ডক্টর ঘোষ, কিছুই হচ্ছে না দেখে হিলিয়াম গ্যাস বের করে দিয়ে ম্যাগনেটিক ফিল্ড অকার্যকর করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না, সুইচও নেভাতে পারে না। অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর জন্য গ্রেপ্তার হয়ে একদিন হাজতে থাকার পর, পাটনায় পালিয়ে গিয়ে, মানসীর পরামর্শে, রসিক পাসোয়ানের সাহায্যে, গা ঢাকা দেয় ওয়ারিস আলি গঞ্জ। এককালে ছাত্র-রাজনীতি করিয়ে ডাক্তার উন্নীত হয়ে গেল ক্রান্তিকারীর রাজনীতিতে, যে রাস্তায় যাবার গোপন ইচ্ছে অনেককাল ধরেই ছিল।
না পালালেই হতো, পরে মনে হয়েছে ডাক্তারের , হয়তো অতিবুদ্ধিমতী সুন্দরী মানসী ওইভাবেই তাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো। টেকনিশিয়ান প্রশান্ত সরখেল গ্রেপ্তার হয়েছিল, পুলিস হাজতে ছিল চোদ্দো দিন, মেশিনটা ডিফেকটিভ ছিল বলে হাসপাতালের কর্মী ইউনিয়ান দাবি করে পালটা মামলা করার ফলে কেস ঝুলে আছে সেই থেকে। ডাক্তারও না হয় ঝুলেই রইতো, মানসীকে বাধ্য করতো কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে সঙ্গে থাকতে। ভয় ছিল যে পুলিশ শেষে বাড়িতে ঢুঁ মারলে বিপ্লবের বইপত্র দেখে অন্য মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারত, হয়তো আগে থেকেই নজর রেখে থাকবে, তার চেয়ে কাগজপত্র জ্বালিয়ে গা ঢাকা দেয়াই উচিত, ভেবেছিল ডাক্তার।
মানসীর বাচ্চাটা নির্দিষ্ট দিনের আগেই, জটিলতার কারণে, হাসপাতালে মারা গেল, জানিয়েছিল মানসী, যা আজও বিশ্বাস করে না ডাক্তার, হয়তো কোথাও কারোর জিম্মায় দিয়ে রেখেছে, যাতে বাচ্চার ঝক্কি পোয়াতে না হয়।
অফিসের কর্মীরা সুযোগ খুঁজছিল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সংঘর্ষের, মানসীকে মেটারনিটি লিভ না দেয়ায়, যেহেতু অফিসের রেকর্ডে মানসীর বিয়ে হয়নি, অফিসের অনুমতি না নিয়ে সারোগেট মাদার হতে রাজি হয়েছে, আর যেহেতু বাচ্চাটা তার নয়, হরতাল চলল বেশ কয়েকদিন।
হরতালের সুযোগ নিয়ে নারী-নারকটিক গ্যাঙের সদস্যরা নানা জায়গায় ম্যাটাডর ভ্যান হাঁকালো কিসিম কিসিম কচি-আধপাকা-পাকা যুবতীদের দেহরঙ্গের খেলা খেলতে, কখনও বা গঙ্গার বুকে পালতোলা নৌকোর ছইয়ের ফুল্লকুসুমিত জোছনায়।
অতনু চক্রবর্তীকে, যে কিনা অফিসে মানসীর পরের ব্যাচের, সে যখন অফিসের কাজে ট্যুরে মিজোরাম যাচ্ছিল, তাকে একটা পছন্দের পারফিউম আনতে বলেছিল মানসী বর্মণ। হরতালের তাঁবুতে মানসীর বাড়ি যাবার পথনির্দেশ যোগাড় করে, পৌঁছে অতনু কলিং বেল টিপতে, কয়েক সেকেণ্ডে ফাঁক হয় চেনবাঁধা দরোজা। টাঙাইল শাড়িতে মানসী বর্মণ, উদাসীন বহিরাবয়ব, সর্বোতোমুখী পরিব্রাজক চাউনি, নিঃশব্দ উলুধ্বনির বলয়ে ঘেরা উচ্চারণ উন্মুখ শরীর। দরোজা খুলে মানসী, ‘আরে আপনি; চিনতে পারিনি প্রথমটা, অনেকদিন দেখিনি তো, আসুন না ভেতরে আসুন না, বারমহল আর খাসমহল আমার এই দুঘরের ফ্ল্যাট। ওপরের ফ্ল্যাটে আগরওয়াল সায়েব থাকেন, বড় ছ্যাঁচড়া, তাই চেন লাগিয়ে রাখি।’
অতনু আঁচ করেছিল অনেক লোকজন থাকবে মানসী বর্মণের বাসায়, তার সমর্থনে হরতাল হচ্ছে যখন, থাকবে ধর্মঘটের রেশ, একাধজন নেতা সাঙ্গপাঙ্গ সুদ্দু। পুরো ঘরটা আসবাব কার্পেট কিউরিওতে ঠাসা, সামলে চলাফেরার পরিসর। কোনও অজানা প্রতিপক্ষের দুঃখ ছেয়ে আছে যেন।
মানসী : ( সোফায় বসতে বসতে ) আসুন না, ওখানটায় বসুন, জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসে। ধ্যাৎ, আপনি আপনি বলতে পারছি না। তোমাকে তুমিই বলছি। তুমি তো বেশ ছোটো আমার চেয়ে, তাই না? ( ঘাম না থাকা সত্ত্বেও আঁচল দিয়ে কপাল পুঁছে ) তুমি তো কোথাও যাও না, কারোর সঙ্গে মেশো না বলে বদনাম। উন্নাসিক, না। কৌতূহল হল বুঝি। ইউনিয়ন এমন পাকিয়ে ফেলেছে ব্যপারটা…
অতনু : ( মানসীর পাশে ধপ করে বসে, পকেট থেকে পারফিউম বের করে এগিয়ে দ্যায়; মানসী হাতে নিয়ে দ্যাখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ) পুরো ঘটনাটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য। ননীদার বিয়ে তো রূপকথার গল্প, তারপর আপনার এই দুঃসাহসী কাজ।
মানসী : ( মৃদু হাসি ঠোঁটে খেলিয়ে, মাথা নাড়িয়ে আলগা খোঁপার ঢল পড়ে যেতে দ্যায় কাঁধে-পিঠে ) ও বাবা, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানো। ( পারফিউমের ঢাকনি খুলে বাতাসে স্প্রে করে ) আর কী হবে এসবে! আমার গা থেকেই এখন মৃগনাভির গন্ধ বেরোয় ( ডান হাতের তর্জনী রাখে বুকের ওপর )।
অতনু : ( ঝুঁকে পড়ে প্রায় বুকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শোঁকে ) হ্যাঁ, সত্যি তালশাঁসের মতন গন্ধ।
মানসী : ( অতনু কাছাকাছি চলে আসায় বুক ঢিপঢিপ লুকোতে, অতনুর চুলে আঙুল বুলিয়ে ) দুর বোকা। তালশাঁসে কি মৃগনাভির গন্ধ হয়। মাস্ক পারফিউমের নাম শোনোনি?
অতনু : ( আচমকা উদাসীন ) কে জানে , গন্ধটা পেলে টের পাবো। কিন্তু আপনি এত বড়ো ঝুঁকি নিলেন যে? কিছু যদি হয়? যদি কমপ্লিকেশন হয়।
মানসী : ( খরস্রোতা ভঙ্গীতে ) কীইইই বা হবে। বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলে আমার ছেলেমেয়ে ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ত এখন। ( চিন্তিত ভ্রূযুগল )।
অতনু : ( মুখ ফসকে অথচ মানসীর দৃষ্টির গভীরে তাকিয়ে ) ছাড়লেন কেন? সবাই বলে আপনিই তালাক দিয়েছেন।
মানসী : ( গম্ভীর ) হ্যাঁ, আমিই ছেড়েছিলুম ( ক্ষুব্ধ ) হিজড়ে ছিল লোকটা।
অতনু : ( বিস্মিত ) হিজড়ে? হিজড়েরা বিয়ে করে নাকি?
মানসী : ( পরাজিত হাসি ) সে হিজড়ে হতে যাবে কেন? ছোটোবেলায় অসুখ-বিসুখ হয়েছিল কিছু, তাইতে অ্যালিগোস্পারমিয়া হয়। ডাক্তার দেখায়নি। অ্যাজোস্পারমিয়া হয়ে গিয়েছিল। ( উষ্মা ফুটে ওঠে ) অমন বর থাকাও যা, না থাকাও তা। পোকাই নেই তো ডিম ফোটাবে কী করে?
অতনু : তাতে কী হয়েছে? এখন যেমন করলেন, তখনও চুপিচুপি কারোর স্পার্ম নিয়ে নিতেন।
মানসী ( অবাক ) কী বলছ কি তুমি! এখন ব্যাপারটা আলাদা। বর থাকতে ওসব করে কখনও কোনো বউ? ঢি ঢি পড়ে যেত। কেলেংকারির একশেষ। বরও মেনে নেবে কেন? এখন যা করেছি তাতে কত গর্ব বলো ইউনিয়ানের। টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে বাংলা অ্যাকাডেমির জীবনময় দত্ত আমাকে নিয়ে ফিচার লিখেছেন, তা জানো?
অতনু : ছাড়াছাড়ির পর আবার বিয়ে করতে পারতেন।
মানসী : কুমারী মেয়েরাই বসে রয়েছে, বিয়ে হয় না, ডিভোর্সিকে কে বিয়ে করবে?
অতনু: কেন? আমি!
মানসী : ( অতনুর চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ হতবাক ) তুমি? পাগল নাকি? ভেবেচিন্তে বলছ? আগে বলোনি তো কখনও! ভালো করে কথাই বলতে না। বেশি পড়াশুনা করেছ বলে একটা ভয়-ভয় ভাবও ছিল। তোমার মা কেন মেনে নেবেন?
অতনু : ভেবেচিন্তে বলছি না। আবেগেও বলছি না। মাও মেনে নেবে না জানি। কিছুকাল আগে হলে আমিও মেনে নিতুম না। কীই বা এসে যায় তাতেও! কিছুই মানামানির দরকার হয় না মানুষের মতন থাকতে গেলে। জানেন প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা শ্রদ্ধা লোভ সবকিছুই ক্ষণস্হায়ী। মুহূর্তটা ধরুন, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিন।
মানসী : ( বিস্ময় আর শ্রদ্ধা ) কত কথা বলতে পারো, সত্যি।
অতনু : ( উঠে দাঁড়ায়। দরোজার দিকে এগোয় ) কথায় আর কাজে মিল ঘটে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না।
মানসী ( উঠে দাঁড়ায়। অতনুর হাত নিজের দুহাতে নিয়ে ) আবার এসো, অ্যাঁ, আসবে তো? চা কফি কিচ্ছু খাওয়ালুম না তোমায়।
অতনু : ( ম্লান হাসে। মাস ছয়েক আগে হলে মানসীর স্পর্শে বজ্রপাত ঘটে যেত তার স্নায়ুকেন্দ্রে )
অতনু চক্রবর্তী চলে যাবার পর তার দেহের গন্ধ ঘরের ভেতরে উড়ে বেড়াচ্ছিল। মানসী বর্মণ টের পেলো তার অরগ্যাজমের অনুভূতি আরম্ভ হয়েছে। দৌড়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো, চোখ বুজে স্বামীর মুখ মনে আনার চেষ্টা করা সত্ত্বেও অতনুর মুখ ভেসে উঠতে লাগল। দেহ কেঁপে উঠল কয়েকবার, সত্যি অরগ্যাজম ঘটে গেল, জীবনে প্রথমবার, কেবল একজন পুরুষের দেহের গন্ধের প্রতিক্রিয়ায়, তা কি এই জন্য যে লোকটা দুশ্চরিত্র বলে প্রচারিত, আর মানসী তার লাম্পট্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে আক্রান্ত হলো। প্রেগনেন্ট তো ছিলই, অতনুকে শোবার ঘরে ডাক দিয়ে তার সঙ্গে একবার শুয়ে দেখা যেত হয়তো। শুলে, ফিসফিসিয়ে জীবনের প্রকৃত অবস্হা বলা যেত ওকে, বিশ্বাস করতে অসুবিধা হতো না বলেই মনে হয়, তরল চরিত্রের যুবকদের কাছে বিশ্বাস জিনিসটা তেমন গুরুত্ব রাখে না। অফিসের শ্যামলী কর্মকার বলে, যৌনতা বাদ দিলে লম্পটদের চরিত্র আদারওয়াইজ ভালো হয়।
ভ্রুণটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হলে, আর নষ্ট বলে প্রচারিত হবার পর, মানসী ডেকে পাঠালো অতনু চক্রবর্তীকে।
সন্ধ্যাবেলা মানসী বর্মণের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর ফিরে যাবে কিনা ভাবছিল অতনু, দরোজা খুলতেই ধুপকাঠির গন্ধ আর মানসী, রোগাটে, চুলে ববছাঁট, ফ্রিলদেয়া হলুদ ব্লাউজ, তাঁতের ফিকে হলুদ শাড়ি। কই, দুঃখকষ্টের ছাপ, অফিসের বন্ধুরা বলেছিল, পেল না অতনু, চেহারায়, ঘরের আসবাবে।
আরে, অতনু!
আমি ভাবলুম, এখনও ওপরতলার আগরওয়ালের নেকনজর এড়াতে খুলতে চাইছেন না।
ও ব্যাটা বিদেয় হয়েছে এই বিল্ডিং থেকে। পুজো করছিলুম, তাই দেরি হল।
পুজো? আপনি পুজো করেন বুঝি? জানতুম না।
কেন? ঠাকুর দেবতা মানো না? বোসো না, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
মা মারা যাবার পর ঠাকুর দেবতাদের তোরঙ্গে বন্দি করে রেখেছি। একদিন গিয়ে গঙ্গা ব্রিজ থেকে বিসর্জন দেবো।
ছিঃ, অমন বলে না। কত বিপজ্জনক চাকরি, কখন কী হয় তার ঠিক আছে। ভগবানে বিশ্বাস রাখতে হয়।
এসব কী এখানে?
মানসীর ড্রইংরুমে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা ছিল তুলো, সাইকেল রিকশার ভেঁপুর মতন লাগানো রবারের হর্ন কাচের গোল বালবে, স্টেনলেস স্টিলের বাটিতে কয়েক চামচ দুধ, গোলাপি হাতলের ডিম্বাকার আয়না। মানসী বর্মণের দপ করে রং পালটানো মুখশ্রী দেখে অতনু টের পেল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। শাড়ির আঁচল সরায় মানসী। দুই বৃন্তকে ঘিরে ব্লাউজে ছড়িয়ে-পড়া দুধের ভিজে ছোপ দেখে অতনু নির্বাক। দেখিয়ে, মানসীর মনে হল, এর আগে অতনু এসে গন্ধের টোপ ফেলে চলে গিয়েছিল, তার পাল্টা টোপ ভিজে বুকের গন্ধ।
কী করি, ডাক্তার বলেছে পাম্প করে বের করে দিতে, নইলে ক্যানসার হতে পারে, বলল মানসী। নিজেকে নিঃশব্দে বলল, আমার বর যদি এখন আসতো তাহলে তাকেই বলতুম মুখ দিয়ে টেনে বের করে দাও।
রোজ পাম্প করতে হয়?
দু-বেলা। দাঁড়াও চা বসাই। আগের বার না খেয়েই চলে গিসলে। টোস্ট খাবে? চানাচুর?
মানসী রান্নাঘরে ঢুকতেই, অতনু টুক করে খেয়ে ফেলল বাটির দুধ। ঠাণ্ডা কিন্তু মিষ্টি। সোঁদা আচ্ছন্ন করা গন্ধ, সারা শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়।
অনভিপ্রেত আকস্মিকতায় থ, ও, মানসী, ‘পাগল., না মাথা খারাপ, ওঃ সত্যি, ওফ, কোন জগতের জীব তুমি?’ ভেতরের ঘরে চলে যায় মানসী, আর বুঝতে পারে যে সেই অনুভূতিটা আবার ছড়িয়ে পড়ছে দেহে, কেঁপে কেঁপে অরগ্যাজম হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে পড়ল মানসী, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে নাকি নিজের ওপর, কিংবা অন্য ধরণের প্রেমে পড়ে চলেছে, স্বামী তো রয়েছেই, তার সঙ্গে সময়-সুযোগ পেলেই সঙ্গম করে নিয়েছে, এই যুবক এসে কী ঘটিয়ে চলেছে! গায়নাককে কি জিগ্যেস করবে? নাঃ, গায়নাক কী ভাববে! যেমন চলছে চলুক, পরে আবার ঘটলে দেখা যাবে।
অসীম পোদ্দার অতনুদের লম্পট পিকনিকে নৌকো থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করার আগে একটা ঢাউস ব্যাগ রেখে গেছে মানসীর কাছে, বলেছিল, এটা প্লিজ আপনার কাছে রাখুন, আমি বাইরে যাবো কিছুদিনের জন্য, বন্ধুদের তো জানেনই কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।
ব্যাগে তালা দেয়া ছিল না, বলে কৌতূহল মেটাতে মানসী একদিন জিপ খুলে দেখেছিল, একটা ডায়রিতে পেছনের দিকে পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে প্রেমপত্র লিখে গেছে অসীম পোদ্দার, আর সামনে দিকে লাল কালিতে পাতার পর পাতা লিখে রেখেছে ওঁ রামকৃষ্ণায় নমোঃ, পোর্টম্যাণ্টো ব্যাগের ভেতরে ডায়েরির সঙ্গে ঠেসে-ঠেসে ভরা দোমড়ানো-মোচড়ানো অজস্র টাকা। নিশ্চয়ই অফিস থেকে চুরি করে রেখেছিল, সুযোগ পেয়ে গছিয়ে গেছে মানসীকে, আত্মহত্যা করার আগে। ব্যাগটা আপাতত অতনুর হাতে ধরিয়ে দেয়া যাক, ওর তো কেউ নেই বাড়িতে, মা মারা গিয়ে অব্দি ঝাড়া হাত-পা। মানসী নিজেকে বোঝালো যে অপ্রত্যাশিত অরগ্যাজমের আনন্দ দেবার জন্য অতনুকে তার দাম হিসাবে দিচ্ছি ব্যাগটা ; তারপর তো চুপচাপ বরের কাছে চলে যাব, যা করার করবে অতনু, খরচ করুক বা বিলি করুক।
অতনুকে বসিয়ে রেখে, সেজে নেয় মানসী, লালপাড় গরদ, কপালে বিশাল লাল টিপ, হাতে টাকাঠাসা আর আসীম পোদ্দারের ডায়েরি রাখা ব্যাগটা এনে রাখে অতনুর পায়ের কাছে, ‘তালশাঁসের গন্ধ পাচ্ছ না’ জানতে চায়।
না, চারিদিকে কেমন দুধ-দুধ গন্ধ। বাচ্চাটা নষ্ট হল আপনার মনখারাপ হয়নি?
এখন জানি আমার পেটে বাচ্চা হতে পারে। তোমার কথা বল। অনেক কানাঘুষো শুনি।
যা শোনেন সবই সত্যি।
সত্যি?
বোঝা গেল অমন সরাসরি সত্যি কথা আশা করেনি মানসী, তাই অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, ‘আমার এই ব্যাগটা তোমার কাছে রেখে দিও, অ্যাঁ, কিছু দরকারি কাগজপত্র আছে। আমি কিছুদিনের জন্য ওরসলিগঞ্জ যাচ্ছি।
ওয়ারিস আলি গঞ্জ? ও তো মারাত্মক জায়গা, মুসহররা থাকে, সৎযুগ মানঝি, ঝাড়ুদার, কেয়ারটেকার রাঘবের পেছন-পেছন চাবি নিয়ে ঘুরত, ও তো ওখানকার। ইঁদুর পুড়িয়ে খায়।
ইঁদুর পুড়িয়ে তো অনেক দেশেই খায়, চীনে আর থাইল্যান্ডের ভালো রেসিপি আছে ইঁদুর রান্নার, লোকে থাই ফুড বলতে অজ্ঞান, দেখেছো তো। ওতে আবার খারাপ কীসের? আসলে ওরা একেবারে একঘরে হয়ে গেছে উঁচু জাতের লোকগুলোর চাপে। কুচ্ছিত অবস্হা।
ওরা তো বিয়ে করে আর ছাড়ে। করেই না অনেক সময়ে, এমনিই থাকে। সৎযুগ মানঝির কতগুলো ছেলেমেয়ে ও নিজেই জানে না। কিন্তু আপনি অমন একটা জায়গায় যাচ্ছেনই বা কেন?
আমার এক নিকটাত্মীয় ওখানকার গান্ধি আশ্রমে মুসহরদের উন্নতির জন্য কাজ করেন।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। দ্বারভাঙা কালী বাড়ি যাচ্ছি, তুমি যাবে?
চলুন। ব্যাগটা তুলে নিল অতনু। ভাগ্যিস মোটর সাইকেল আনেনি। মোটর সাইকেলে মানসী কি বসতে চাইতো পেছনে। চাইতো না বোধহয়। মেয়েরা জানে যে ব্রেক কষলেই যে মহিলা পিলিয়নে বসে তার বুক চালকের পিঠে ধাক্কা খাবে।
রিকশয় ঠেসাঠেসি, দুধের গন্ধ পায় অতনু। রাস্তায় এত গর্ত যে ছিটকে পড়তে হবে শক্ত করে ধরে না থাকলে। রাজেন্দ্রনগর, মেছুয়াটুলি, মাখানিয়াকুঁয়া হয়ে অশোক রাজপথে পড়ে। বাঁদিকে গলিতে ঢুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিলডিং, এর ভেতরে গঙ্গার তীরে মন্দির। দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙে ঢোকার মুখে পথের দুপাশে চর্মরোগ যৌনরোগের হাসপাতাল-বিভাগ। খুঁটিতে বাঁধা গোরু-মোষ।
ছাত্র ইউনিয়ানের নির্বাচনের সময়ে যে পাম গাছটায় বেঁধে অরবিন্দ অবস্হির মাথায় লোমনাশক লাগানো হয়েছিল, অতনু দেখল, গাছটা এখনও তেমনি ঠায় একা দাঁড়িয়ে, অরবিন্দ অবস্হির স্মৃতি নিয়ে।
অন্ধকারে প্রাচীন মন্দির, কালচে ধরেছে দেয়ালে, পায়রা চামচিকে অবাধ, ফুল-পচা বেলপাতা শুকনো রেড়ির তেলের গন্ধ। মন্দিরে ঢোকার মুখে অতিগরিব ভিকিরি আর গরিব জুতোরক্ষক। জলভেজা পাথরের ঠাণ্ডা মেঝে। সিঁদুরমাখা হাড়িকাঠ, কখনও ছাগবলি হতো। পাকাদাড়ি আদুলগা বুড়োদের প্রায়ান্ধকার জটলা। ঝোঁপতোলা ঘোমটায় বউ।
‘খুব জাগ্রত এই মন্দিরের ঘণ্টা, আপনা থেকে বাজে, রাত্তির আটটায়’, জানায় মানসী। অতনু উত্তর দেয় না। ও তখন দেখছিল, নিরন্তর পরিপূর্ণতায় উপচে-পড়া নর্দমা, কুলুঙ্গির মধ্যে শ্যাওলাপোশাক দেবতাদের দুর্বল ভঙ্গি, নিরীহমুখ দেবী-দেবতা, দালানে শুয়ে নিজের কুঁই কুঁই উপলব্ধিকে প্রকাশে মশগুল কুকুর। ‘খুব জাগ্রত, মাথায় জবাফুল রাখার পর যদি পড়ে না যায়, তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়’, মানসী বোঝাল।
আপনার ফুল পড়ে যায়, না থাকে? জিগ্যেস করল অতনু।
পড়ে যাবে কেন! থাকে। একবারও পড়েনি আজ অব্দি।
নিজেকে নিজে অতনু বলছিল, বাচ্চাটার স্বাস্হ্যের জন্য কি মানত করেছিল মানসী বর্মণ? কে জানে। জিগ্যেস করা ঠিক হবে না।
অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, একদা দ্বারভাঙ্গা মহারাজের, এখন কারোরই নয়, কালী প্রতিমা। বোধহয় দুধে-চিনিতে চান করানো হয় তাই মাথার ওপরে আটকে থাকে ফুল। দর্শনার্থীরা একের পর এক ফুল চাপিয়ে, পুরুতকে টাকা দিয়ে, মনস্কামনা পুরো করার আগাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে। মানসী ব্লাউজ থেকে টাকা বের করে পুরুতকে দিল, হাত জোড় করে দেখে নিল প্রতিমার মাথার ওপর ফুল রয়েছে, পড়েনি, তার মানে ওনার বর ডাক্তার ঘোষ বহাল তবিয়তে আছেন, পুলিশ পেছু নেয়নি।
তুমি চাও না কিছু। দেখ না। হয়তো ঝট করে বড়ো অফিসার হয়ে যাবে।
একটা করকরে নতুন নোট দিল অতনু, পুরুত ফুল চাপালো হাসি মুখে, তক্ষুনি পড়ে গেল ফুলটা। মানসী গম্ভীর, পুরুত গম্ভীর। অতনু আবার একটা করকরে নতুন নোট দিল, পুরুত ঠিক মতন জায়গা বেছে ফুল রাখল যাতে না পড়ে, বেশ কিছুক্ষণ প্রতিমার মাথার চিনিমাখানো মুকুটে ফুল রেখে সরিয়ে নিল হাত, পড়ে গেল ফুলটা। দর্শকদের গুঞ্জন আরম্ভ হয়ে গেছে অতনুকে ঘিরে। তিন বার চড়ানো যায় জানাল এক ভক্তিমতী বউ। অতনু আবার দিল নতুন নোট, প্যাকেট থেকে বের করে। পুরুতের হাত থরথর। ফুল পড়ে গেল। ভিড় জমতে থাকে অতনুকে ঘিরে। মানসীর কাঁপতে-থাকা হাত ধরে বাইরে আসে অতনু, জুতো পরে যে যার, হাঁটে গলিপথ ধরে দু-জনে চুপচাপ।
প্রাঞ্জল রাজপথে পোঁছে যে যার বাড়ি যাওয়াই, কোনও কথা না বলে, উচিত মনে করে। নভেলটি বুক ডিপোর বহুতল বাড়িটার কাছে রিকশায় তুলে দিল মানসীকে। রিকশয় চাপার আগে অব্দি, অতনুর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল মানসী, নিয়ন্ত্রণহীন, এমনকি হ্যালোজেন আলোয় আবছা বেজে উঠছিল পায়ের মল।
মানসী আক্রান্ত হয়েছিল অরগ্যাজমে, মন্দিরের ভেতরেই ওর শরীরে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ঢেউ, অতনুর পাশে দাঁড়িয়ে ঘটে গেল কেঁপে কেঁপে। অতনু নির্ঘাত ভাবছে কালী প্রতিমা ফুল নিলেন না বলে মানসীর অমন প্রতিক্রিয়া ; অতনুর সঙ্গে থাকলেই কেন এমন ঘটছে, দুশ্চিন্তায় মানসী, মন্দিরের মতন জায়গাতেও ঘটে গেল। গায়নাক দেখাবে, নাকি স্বামীকে বলবে? কী করেই বা স্বামীকে বলবে যে একজন পরপুরুষের চৌম্বকক্ষেত্র মানসীকে পরপর যৌন আকর্ষনে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে!
অতনু টের পায়নি মানসীর কাঁপুনির উৎস, ও বোধ করছিল এক গোপন আনন্দ, কালী প্রতিমাকে পরাজিত করার আনন্দ, মানসীর দৈববিশ্বাস টলিয়ে দেবার আহ্লাদ। ওর আনন্দ দেখে ছুটন্ত ট্রাকগুলোর চক্ষুস্হির। মানসী অমনভাবে না কাঁপলে, কী এক অচেনা থরথর, বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসার প্রস্তাব দিত অতনু।
মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে অফিসের সহকর্মী অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, যে হিউমান রিসোর্সে কাজ করে, অতনুর সঙ্গে অফিস ফেরতা ওর বাড়িতে এসেছিল দিনকতক পরে, দুচার ফুঁক চরস খাবার গোপন সদিচ্ছা নিয়ে। পাকানো সিগারেট তামাকে মিশেল দিয়ে টেনে ঘণ্টা দুয়েক এমন একনাগাড় হেসেছিল অরিন্দম যে, অতনুর মনে হচ্ছিল, আগে একবার অপ্রকৃতিস্হ অরিন্দমের আবার বুঝি ঘটল মগজের বেগড়বাঁই, ফের ফিরে যাবে মানসিক চিকিৎসালয়ে।
পাশবালিশ টেনে, আয়েস করে ফুঁক মেরে অরিন্দম বলল, জানেন তো মানসী বর্মণ রিজাইন করে চলে গেছে ওরসলিগঞ্জের গান্ধি আশ্রমে কাজ করার জন্যে?
চলে গেছে? কবে? জানি না তো!
আপনি তো এমন বলছেন যেন আপনার অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
হ্যাঁ, খবরটা শুনে ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগল। কবে গেছে?
গত মাসের পনেরো তারিখে ; উনি বলেছিলেন, জানাজানি না করতে।
ওয়ারিস আলি গঞ্জ তো মারাত্মক জায়গা। মুসহররা থাকে। বিনোদ মিশ্রর নকশালদের গড়। একজন সুন্দরী আধুনিকা থাকবেন কী করে সেখানে গিয়ে? ওরকম একটা জায়গায় গান্ধি আশ্রম করেটাই বা কী?
আশ্রম পরিচালক ওনার স্বামী।
স্বামী? মানসী তো ডিভোর্সি?
সব বানানো গল্প। লোক দেখানো। ওনার স্বামী এম বি বি এস ডাক্তার। ডাক্তারি করেন আর নিচু জাতের লোকেদের মধ্যে বিপ্লবের প্রচার। বাচ্চাটাও ওনারই। আর, গান্ধি আশ্রম বলে কিছুই নেই ওখানে। আছে ডাক্তারখানা। শুনেছি যে মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টারের ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতির অফিস ওটা।
আপনি কী করে এতসব জানলেন?
উনি চলে যাবার পর জানতে পারলুম রসিক পাসওয়ানকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে।
অতনুর মন খারাপ হয়ে গেল শুনে।
মানসী বর্মণের জন্য মনকেমন করে অতনুর; অন্যের স্ত্রীর জন্য মনকেমন। জানা তো ছিল না, যে অন্যের স্ত্রী, কেন জানায়নি মানসী, কেন বুকের দুধ দেখিয়েছিল, কেন তালশাঁসের গন্ধ শুঁকিয়েছিল, কেন কালী মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল রিকশয় পাশে বসিয়ে, কেন তাহলে ব্যাগটা রাখতে দিয়েছিল, ওটা নিয়ে আমি কী করব, মনের গভীরে ফুঁপিয়ে ওঠে ও, অতনু।
অফিসের কর্মীদের মাঝে খবর নেয়াদেয়া হয়, মুসহর ছেলেমেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দিতে দেখা গেছে মানসী বর্মণকে, গয়া নওয়াদা অওরঙ্গাবাদ জেহানাবাদের গ্রামে, বন্দুকধারী যুবকেরা থাকে ওর পাহারায়।
বছরখানেক পরে অফিসে একদিন কি হ্যাঙ্গাম, পাগলা ঘণ্টি। বিপদ আপদ ডাকাতি সামলাবার জন্য অফিসে নানা জায়গায় অ্যালার্ম ঘন্টির বোতাম লুকানো আছে। কাচের ঢাকনি ভেঙে বোতাম টিপলে সারা অট্টালিকা জুড়ে বাজতে থাকে পাগলা ঘণ্টি। ন-মাসে ছ-মাসে একবার করে মহড়া হয়। বহুক্ষণ বাজছিল বলে টের পাওয়া গেল আজকেরটা রিহার্সাল নয়, আসল। বাইরে বেরোবার আর ঢোকবার শাটার গেট দরোজা সব বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত, তাক করে বসে গেল বন্দুকধারীরা পুরো বিল্ডিঙের বিভিন্ন ফ্লোরে, সুট-টাই পরা কর্তাদের হন-হন গট-গট, চেয়ার থেকে মুণ্ডু বার করে হাফ-কেরানি আর কেরানিদের কচাল। ঘণ্টাখানেক পরে অলক্লিয়ার ঘণ্টি বাজলে জানা যায় ব্যাপারটা। একজন অফিসার, যিনি জোড়াতালি দেয়া নোট পাস করেন এক এক করে, তিনি বাজিয়েছিলেন।
ছেঁড়া জোড়াতালি নোটের কেরানিদের খাঁচার পেছনে ওই অফিসারের কেবিন, যিনি অ্যালার্ম বেল বাজিয়েছিলেন। পাবলিক আর নোটের দালালরা ছেঁড়াপচা নোটের লট দ্যায় কাউন্টারের কেরানিকে, সে নিজের খাতায়-কমপিউটারে এনট্রি করে অফিসারকে দেয়। তক্ষুনি বদলযোগ্য হলে অফিসার নোটের ওপর সই তারিখ দিয়ে পাঠায় হাফ-কেরানির কাউন্টারে। সেখানে টোকেন দেখিয়ে নতুন নোট নিয়ে যায় পাবলিক বা নোটের দালালরা।
আপন মনে জোড়াতালি নোট পাস করছিলেন অফিসার। আচমকা একটা নোট হাতে নিয়ে তিনি স্তম্ভিত। নোটটা তিনি নিজেই বছরখানেক আগে ছাপ তারিখ সই দিয়ে পাস করেছিলেন। এটা তো শ্রেডারে শ্রেড হয়ে কাগজের মন্ড হয়ে যাবার কথা। বাজারে গেল কী ভাবে! তার মানে নিয়ম মেনে নষ্ট করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, মাঝ পথেই মেরে দিয়েছে কেউ; কিন্তু প্রক্রিয়াটা তো এমন যে, কোনো একজনের পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয় ; নিশ্চয়ই একটা দল কাজ করছে, বাতিল নোট পাঠিয়ে দিচ্ছে বাইরে সার্কুলেশানে। কবে থেকে চলছে, কত নোট বাজারে বেরিয়ে গেছে, তার মানে তার তো কোনো হিসাব নেই। এক বছর আগের নোট, তার মাঝে কত এরকম নোট চলে গেছে সার্কুলেশানে। যে লোকটা নোটটা দিয়েছে, ধরতে হবে তাকেই। ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় অফিসারের, কপালে বিনবিনিয়ে ঘাম। পেপারওয়েট তুলে সজোরে কাচঢাকা অ্যালার্মবেলের কোটরে মেরে বাজিয়ে দিলেন পাগলা ঘণ্টি। খদ্দেরটা নজর রেখেছিল, অফিসার নোটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলোয় পরখ করছেন দেখেই সে ব্যাটা হাওয়া।
পুলিশে খবর দেয়া হল। ওই নোটটা যে কর্মীশেকলের মাঝ দিয়ে একের পর এক গেছে, তাদের নামঠিকানা যোগাড় করে ঢুঁ মারতে লাগল পুলিশ। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হল। অতনু নিজেকে বলল, মানসী বর্মণ নিশ্চয়ই এই র্যাকেটের অংশ নয়, কিন্তু একটা ঢাউস ব্যাগ হুট করে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো কেন!!
বাড়ি পৌঁছে খাটের তলা থেকে মানসী বর্মণের দেয়া ব্যাগটা টেনে, ধুলো ঝেড়ে, জিপ খুলতেই অতনু হতবাক, থ। ঠিক যা অনুমান করেছিল। অগোছালো নোটে ঠাসা, ছেঁড়াকাটা নোটের সঙ্গে বদলে নেয়া হয়েছে বা পিলফারেজ করা হয়েছে। ভেতরে অসীম পোদ্দারের ডায়রি, পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে লেখা প্রেমপত্র, যৌনরোগ বা যৌনস্বেচ্ছাচার থেকে পাওয়া রোগ আর সারবে না জানিয়েছে শেষ প্রেমপত্রে। ভাগ্যিস মানসী বর্মণ চলে গেছে, নয়তো এই নোটগুলো ওর বাড়িতে যদি পুলিশ পেতো কী কেলেঙ্কারি হতো!
ভোরবেলা, বাড়িতে দরোজায় তালা ঝুলিয়ে, ওয়ারিস আলি গঞ্জ যাবার বাস ধরার জন্য বেরিয়ে পড়ে অতনু, এক হাতে টাকাঠাসা ঢাউস ব্যাগ, কাঁধে ঝোলানো থলেতে এক সেট জামা কাপড়।
ওয়ারিস আলি গঞ্জে বাস স্ট্যাণ্ডে বাঙ্গালি ডাক্টার গরিবোঁকা মাস্টারনি কোথায় থাকেন জিগ্যেস করতে একটা রিকশঅলা জানায় চলুন বাবু, আমি পৌঁছে দিচ্ছি, ওনারা তো দেওয়ি-দেওতা।
রিকশ থেকে অতনু নামলে রিকশঅলাটা বলল, ওই যে ডাগডরবাবু, রোগী দেখছেন।
এত রোগিগী? এতো ছোটোখাটো জনসভার মতন, সবাই মাটিতে বসে ওনার কথা শুনছে, বলে ফেলল অতনু।
জি হাঁ, দূর দূর থেকে আসে, ওষুধ দেন, টাকা-পয়সা নেন না।
অতনু ঘরের ভেতরে ঢুকতেই ডাক্তার ওর হাতের ব্যাগ আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চয়ই অতনু চক্রবর্তী, যিনি আমার দুধের বাটি থেকে চুমুক মেরে আমার স্ত্রীর গেলে-রাখা দুধ খেয়েছিলেন?
আপ্যায়নে স্তম্ভিত অতনু, কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। কেমন স্ত্রী? এই কথাগুলোও নিজের স্বামীকে বলেছে। শহুরে মানুষ দেখে একজন রোগী ভেতর থেকে একটা মোড়া এনে দিতে অতনু দেখল, ডাক্তারও মোড়ায় বসে আছে, টাক পড়া আরম্ভ হয়েছে, ফর্সা দোহারা চেহারা, টেবিলের ওপর নানা ওষুধের স্ট্রিপ।
অতনু মোড়ায় বসার পর ডাক্তারের বলা পরের কথায় হতবাক হয়ে গেল, ডাক্তার বলল, মানসী চলে এলো দুটো কারণে, প্রথমত বুকের বইতে থাকা দুধ, আর দ্বিতীয়ত আপনার উপস্হিতিতে ওর তিনবার অটোম্যাটিক অরগ্যাজম হয়ে গিয়েছিল; বুক থেকে দুধ গালতে গালতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, এখানে আসার পর আমিই আমার স্ত্রীর দুধ পান করার সুযোগ পেলুম, রাইট ফ্রম সোর্স। আপনি এসে ভালো করলেন, আমরা তো অনুমান করেছিলাম যে আপনি আরও আগেই আসবেন।
ডাক্তার বলা বজায় রাখলো, মানসী বলেছে আমায় যে আপনি ওর নতুন প্রেমিক আর ও-ও আপনার উপস্হিতির প্রতি এমনই আকর্ষিত হয়ে পড়েছিল যে চলে আসতে বাধ্য হল। মানসী রোঁদে বেরিয়েছে, ঘণ্টা দুয়েকে এসে পড়বে। আপনি ততক্ষণ ভেতরে গিয়ে স্নানটান করে নিন, লুঙ্গি-পায়জামা কিছু এনেছেন, না এনে থাকলে আমারই একটা পরে নিন, ভেতরে বারান্দায় তারে ঝুলছে। ওইটা টাকার ব্যাগ তো? ভালোই করেছেন এনে, বেশ কয়েকজন রোগির যৎসামান্য দামি ওষুধ দরকার, অন্য কাজেও লাগবে। অসীম পোদ্দারের প্রেমিকের ডায়েরিটাও ওতে আছে? থাকুক কখনও সময় হলে পড়ব। মানসী তো ফুলশয্যার রাতে ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত যে তিনশো প্রেমপত্র পেয়েছিল সেগুলো পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। অনেক কথা বলে ফেললাম। বাংলা বলার সুযোগ পেয়ে ছাড়তে চাইছিলাম না। যান যান, আপনি ভেতরে যান।
মলয় রায়চৌধুরী ডাক্তার ঘোষকে প্রথমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জঙ্গলমহলে আদিবাসিদের কুঁড়হা পরবের দিন, গা ঢাকা দেবার আর আদিবাসী রোগীদের সেবা করার জন্য, সেখানে মাওবাদীদের জমায়েতে ভিড়ে গিয়ে তাদের নির্দেশ মতো যাতে কাজ করতে পারে। সেখান থেকে চলে যেতে হলো ওয়ারিস আলি গঞ্জে, গান্ধি আশ্রমের নাম করে পার্টির কাজ করার জন্য, রোগীদের মধ্যে বিপ্লবের কথা প্রচারের জন্য। মানসী বর্মণ আর ডাক্তার দুজনে ভালোই ছিল ওয়ারিস আলি গঞ্জে, কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী সেখানে পাঠিয়ে দিলেন অতনু চক্রবর্তীকে, আর ডাক্তারের জীবন ওলোট-পালোট হয়ে গেল। চৈত্রসংক্রান্তির দিন জঙ্গলমহলের আদিবাসিরা মুড়ি বা ছোলার ছাতু আর আম দিয়ে কুঁড়হা উৎসব করে। আগে এই পরব কুরমি আর আদিবাসীরা করতো, ক্রমশ ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, উত্তর দিনাজপুর, ঝাড়খণ্ড রাজ্য, বিহার, উড়িষ্যা রাজ্যের জনজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কুরমি সম্প্রদায়ের মানুষরা সেই দিন সকালে গোবর গুলে ঘরের সব ঘরগুলোয় আর উঠোনে ন্যাতা দেন যাতে বাড়ি শুদ্ধ হয়ে ওঠে। মহিলারা বাড়ির দোরগোড়ায়, উঠোনে, তুলসীমঞ্চে, হরিমঞ্চে আলপনা দেন। বাড়ির কর্তা বা বড়ো বউ যিনি উপোসি থাকেন, তিনি চান করে কচি শালপাতার থালাতে আম, মুড়ি বা ছোলার ছাতু আর মহুয়া রেখে পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে তুলসীমঞ্চে প্রার্থনা করেন। পুজোর আগে যাবতীয় সমিধ বাড়িতে জড়ো করে রাখতে হয়। পয়লা মাঘ হলো আখান যাত্রা। অনেকে মানত করে পাঁঠা কিংবা মোরগ বলি দেন। পুজোর মাংস গ্রামের সবাইকে ভাগ করে দেয়া হয়। কুরমিরা মহুয়াকে নারী আর আমকে পুরুষ হিসাবে অনন্তকাল থেকে মান্যতা দিয়ে এসেছে। তারা বলে ‘আম ডাকে বান’ আর ‘মহুল ডাকে খরা’। যে বছর আম বেশি হয় সে বছর প্রচুর বৃষ্টি পড়ার কথা। যে বছর মহুয়া বেশি হয় সে বছর বৃষ্টি কম হবার কথা। এখন আমও বেশি হয় না, মহুয়াও বেশি হয় না। বৃষ্টি আর খরা নিজের ইচ্ছেমতন আসে।
ডাক্তার কুরমিদের কুঁড়হা উৎসব মনে রেখেছে, মহুয়ার মদ প্রথমবার খেয়ে বাঁধনছেঁড়া মাতলামো করেছিলো।
ডাক্তারের মনে আছে পালামৌয়ের নরসিংহপুর পাথরা গ্রামের কথা, সেখানে গিয়েছিলো মলয় রায়চৌধুরীর প্ররোচনায়, দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত গ্রামে, খরা, প্রচণ্ড গরম, জল নেই, খাবার নেই, মানুষেরা যে গাছের পাতা আর আমের আঁটি খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করে তা কলকাতায় ছাত্র-রাজনীতি করার সময়ে ভাবতেও পারেনি। সরকার খিচুড়ি বিলি করতো, যার জন্যে ছেলে বুড়ো বউ সবাই হাতের তলায় হাত পেতে খিচুড়ি নিয়ে খেতো, ব্যাস এক হাতা, তার চেয়ে বেশি খিচুড়ি যোগাতে পারতো না সরকার। গ্রামের ডিসপেনসারিতে কোনো ওষুধ ছিল না, সেখানেই শুতো ডাক্তার। অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে গেলো ডাক্তার। মানসীকেও নিজের বিশ্বাসে চুবিয়ে ফেলতে সময় লাগলো না।
তারপর থেকে ডাক্তার কেবল একবেলা খায়, রাতে খায় না কিচ্ছু।
১৯২৯ সালে লেখা মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী’ বইয়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল ডাক্তার ঘোষের। উনি লিখেছিলেন, “তখনকার দিনে অধিকাংশ লোক ভাত খাইত। সহরে লোকেরা দিনে আড়াই পোয়া চালের ভাত, রাত্রে আধসের চাল ও তদোপযুক্ত তরকারি। অনেক লোকের বাযিতে গোরু ছিল এইজন্য দুধও পাওয়া যাইত। না হইলে গয়লাদের বাড়ি হইতে দুধ আসিত, সেও সস্তা। কলকাতার দক্ষিণদেশ বা বর্ধমান হইতে আমাদের বাটীতে যখন লোকজন আসিত, তাহারা অধিক পরিমাণে আহার করিত। দুপুরবেলা তিন পোয়া হইতে এক সের চালের ভাত খাইত এবং রাত্রে কিছু কম।”
আজ, কেন ওনার মনে হচ্ছে যে অবিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে অবিচারের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আজ কেন মনে হচ্ছে মানসীকে ভুল পথে এনে মানসীকে ছাড়তে না পেরে নিজের ভেতরে নিজেই হারিয়ে গেছেন।
মনে পড়ে যাচ্ছে, মেক্সিকো অলিম্পিকে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিযোগীদের ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালিউট।
মনে পড়ে যাচ্ছে ভিয়েৎনামে ন্যাশানাল লিবারেশান ফ্রন্টের টেট আক্রমণ-প্রণালী।
মনে পড়ে যাচ্ছে চেকোসলোভাকিয়ার প্রাগ বসন্তকাল।
মনে পড়ে যাচ্ছে প্যারিসের পথে-পথে ১৯৬৮ সালের মে মাসে ছাত্রদের উথ্থান।
মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হাংরি আন্দোলনকারীদের হাতে হাতকড়া কোমরে দড়ি পরিয়ে রাস্তায় হাঁটানো।
মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৭১ সালের আগস্টে বরানগরে শয়ে-শয়ে যুবহত্যা, ঠেলায় গাদাগাদি চাপিয়ে গঙ্গায়।
মনে পড়ে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, প্যালেসটাইন, ভিয়েৎনাম।
মনে পড়ে যাচ্ছে ঈশ্বরের মৃত্যু।
মানসী এখনও ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়তে পারেনি, জানে অতনু ওর মায়ের দেবী-দেবতাকে থলেতে ভরে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল।
কী করছ কী? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আঃ, ছাড়ো।
মনে করুন আপনি আমাকে জন্ম দিচ্ছেন, তাই কষ্ট হচ্ছে, মনে করুন, মনে করুন, সেই সময়ের যন্ত্রণা, আপনি কি মনে করেন আমার জন্মাবার কোনো যন্ত্রণা হয়নি, কষ্ট হয়নি?
আর ইউ ম্যাড? কী করছ কী, নামো নামো, আমি তোমার মা, কী করছ কী, অমিত, এত জোরে জড়িয়ে ধোরো না, ছাড়ো ছাড়ো, মুখ সরাও, দাঁতও মাজো না কখনও, নোংরা জানোয়ার কোথাকার। ইট ইজ ইনসেস্ট, বাস্টার্ড!
জানি আমি জারজ, জানি আপনি আমার মা, কিন্তু জানি না আমার বাবা কে, অতনু না ডাক্তার ঘোষ? দুজনের সঙ্গেই তো শুতেন এক সময়, তাই না? এখন না হয় আমার সঙ্গেই শুলেন।
ছাড়ো, ওফ, ছাড়ো, লুম্পেন একটা। এটা আনন্যাচারাল, এটা ইনসেস্ট, ডোন্ট ডু ইট, প্লিজ, ওফ, আমার তো বয়স হয়েছে, এই বয়সে এসব, প্লিজ ছাড়ো, বয়স হলেও এখনও মেন্স হয়, আমি তোমার সন্তানের মা হয়ে যেতে পারি।
আমি তো সেটাই চাই, আপনি একই সঙ্গে আমার মা আর আমার ছেলের মা। বিপ্লব দীর্ঘস্হায়ী হোক, তাই না? আমি বিপ্লব করছি এখন,। কেন ছাড়বো, ওনাদের দুজনকে তো আপনার দুধ খাইয়ে ছিলেন, যা আমার প্রাপ্য ছিল।
কী করছ কী?
আপনার দুধ খেতে চেষ্টা করছি।
দুধ থাকে নাকি এই বয়সে, ইউ ইডিয়ট, নেমে পড়ো, ছাড়ো, ছাড়ো, কখন আমার বিছানায় চলে এসেছো! আরে কী করছ কী!
কাঁদতে আরম্ভ করেন কমরেড মানসী, ফুঁপিয়ে, যাতে কেউ না শুনতে পায়।
কাঁদুন, কাঁদুন।
কী করলে তুমি জানো?
দুধ নেই জানি, তার বদলে আপনার ঘামই খাচ্ছি, গন্ধ খাচ্ছি, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ককে গড়ে তুলতে চাইছি। মিষ্টি দুধের বদলে নোনতা ঘাম, আপনার শরীরের জোনাকিদের মুখে পুরে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে নিতে চাইছি।
পাগল নাকি? বন্ধ করো, ওফ, নাম, নাম আমার ওপর থেকে, নাম, তোকে এখানে আনাই উচিত হয়নি। মুখের ওপর থেকে মুখ সরা।
মারুন চড়। যাক তুইতোকারিতে তো এলেন, এতদিন ছিলাম আপনার সঙ্গে, যেই নিশ্বাস বন্ধ হতে লেগেছে তখন বুঝতে পারলেন যে তুইতোকারি করতে হবে।
অমিত, তুমি জানোয়ারের কাজ বন্ধ করো, ছাড়ো আমায়, ছাড়ো।
ছাড়ব না।
কী করছ, ইউ স্কাউন্ড্রেল, কী করার চেষ্টা করছ?
আপনার তৃতীয় প্রেমিক হবার চেষ্টা করছি। মুখ বন্ধ রাখুন। নিন প্রেম, নিন প্রেম, ক্রান্তি, ক্রান্তি, ক্রান্তি….।
কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, ব্যথা করছে। বয়স হয়ে গেছে, এই বয়সে হয় না ওসব, গেট ডাউন, ইউ স্কাউণ্ড্রেল কী চাই তোমার?
আপনাকে চাই। জানতে চাই, আমার বাবা কে?
তুমি অতনুর ছেলে নও , তুমি ডাক্তারের ছেলে।
হ্যাঁ, কাঁদুন, আমি চাই কষ্ট হোক, নিজের কাছে অপমানিত বোধ করুন, নিজের সম্পর্কে আপনার ঘেন্না ধরে যাক, যেমন আমার নিজের জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে। যা চাই তা্-ই তো নেবার জন্য আপনার বুকের ওপর চেপেছিলুম। বালিশের তলায় কী খুঁজছেন? সায়লেন্সার-লাগানো রিভলভার? আমার দেয়া টাকায় কিনেছিলেন, এখন আমায় মারবার জন্য চালাতে চান, তাই না? সেটা আমি আগেই সরিয়ে রেখেছি, জানি আপনার কাছে আপনি ছাড়া আর কারোর কোনো দাম নেই। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, শুনেছি, ডাক্তার ঘোষ বলেছেন আমায়, দেখুন ঈশ্বর এখন আপনাকে বাঁচাতে আসছে না। বন্দুকও আপনাকে বাঁচাতে আসছে না। চুলোয় যাক আপনার ক্রান্তি, এটা আমার বদলা নেবার ক্রান্তি। আপনি চেঁচাতেও পারবেন না, জানি, আপনার ক্রান্তিকারীরা জড়ো হলে লজ্জায় বেঁচে থাকতে পারবেন না।
কী করলে কী তুমি, ছি ছি ছি ছি।
ওই ছিছি নিয়ে আমি এতকাল বেঁচে ছিলুম, এবারে আপনি আমার সারা জীবনে জড়ো করা ছিছিক্কার নিয়ে বাঁচুন। খাট থেকে উঠবেন না, চুপ করে শুয়ে থাকুন, নয়তো মরবেন, এই দেখুন সায়লেন্সার লাগানো আপনার ক্রান্তির যন্তর, আমারই দেয়া টাকায় কেনা।
মানসী বর্মণের তেরপলের বাইরে বেরিয়ে অমিত দেখল দূরে অন্ধকারে কনকদুর্গা দাঁড়িয়ে; যন্তরটা মানসী বর্মণের তেরপলের কাছে ফেলে দিলো।
কনকদুর্গা বললো, আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট উইথ ইওর চাইল্ড, বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট হিম টো গ্রো আপ এ কিলার লাইক মি, উই আর গোইং টু পাটনা, টু গেট লস্ট ইন দি ক্রাউড।
অমিত বলল, ঠিক আছে, ইংরিজি ঝাড়িসনি, ভাল্লাগে না শুনতে, মুখস্থ করতে করতে জান হালকান হয়ে গেছে এই ক্রান্তিকা্রী ঢকোসলাবাজিতে, টাকার বান্ডিলটা রেখে নিয়েছি ; অতনু চক্রবর্তীকে মাথায় নল ঠেকিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি। মানসী বর্মণ বেঁচে থাকুক ক্রান্তি করার জন্য, সারা জীবন ভুগুক ছেলেকে অন্যের বাড়িতে ফেলে আসার পাপে, এবার ঘেন্নায় মরে যাবে কেঁদে-কেঁদে, পাগল হয়ে গেলে ভালো হয়। জানাজানি হবার আগে অনেক দূরে চলে যেতে হবে, পাটনায় চলে যাবো, ওখানকার গরিবদের বস্তিগুলো সব আমার জানা।
হ্যাঁ, ঝিয়ের কাজ করে চালাবো যতোদিন পারি, তুইও পারলে সাইকেল রিকশা চালিয়ে রোজগার করিস। আমি তোর চেয়ে পনেরো বছরের বড়ো; পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হলে তোর বয়সের ছেলে হতো। কোথাও কেউ জিগ্যেস করলে আমি বলবো তুই আমার ছেলে। তুইও তাদের সামনে মা বলে ডাকবি।
কতোবার যে জীবনে নকল মায়ের পাল্লায় পড়তে হবে কে জানে।
চল, পালাবার শর্টকাট আমি জানি।
শোন তাহলে, বৈদিক সাহিত্যে, মানে আগেকার দিনে যেসব বই সংস্কৃততে লেখা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে যে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল ইনসেস্টের মাধ্যমে, বুঝলি। ইনসেস্ট মানে মায়ের সঙ্গে ছেলের বা বাপের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক হলে যেসব বাচ্চা হয়, তারা ইনসেস্টের প্রডাক্ট।
তুমি বলতে চাইছ আমি ইনসেস্টের ফলে জম্মেছি? কী যে বলো! তুমি মানসী বর্মণের ছেলে না বাবা? নাকি ওই লোকটা, মানসী বর্মণের বাবা না ছেলে? আমি আবার তোমার ভাই হতে যাবো কেন? তুমি তো বুডঢা।
আরে ধ্যুৎ, আমি বলতে চাইছি কী আর তুই বুঝছিস কী!
ওহ, আরেকটা কাহানি চালু করছ। বলো, বলো। গ্রিস, রোম, পারস্য, আরব রাত্তিরের কাহানি তো শুনিয়েছ, কখনও ইনসেস্টের কাহানি বলোনি তো কোনো?
বলব, বলব, সেই গল্পই আজ বলব তোকে। প্রথমের ইনডিয়ার গল্প শোন। পৃথিবী শুরু হয়েছিল প্রজাপতি ব্রহ্মা যখন ওর মেয়ে উষার পেটে বাচ্চা এনে দিয়েছিল। আরেকটা ইনসেস্টের গল্প আছে বেদে, মানে ঋগ্বেদে, যম আর যমা ভাই-বোন মিলে বাচ্চা পয়দা করেছিল। ব্রহ্মার যে ছেলে ইনসেস্টের ফলে জন্মেছিল তার নাম মনু। সে, মানে মনু, বিয়ে করেছিল নিজের বোন শতরূপাকে, যাতে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ে। গুরুর বউয়ের সঙ্গে যদি করিস তাহলে সেটাও ইনসেস্ট। এর কোনো বাংলা আছে কিনা জানি না। ইনসেস্ট শব্দটা ল্যাটিন। ওটাও সংস্কৃত ভাষার মতন তামাদি হয়ে গেছে। গ্রিক ভাষায় কিন্তু আছে, যেমন মায়ের সঙ্গে ছেলের যৌন সম্পর্কে ওরা বলে মেৎরোকোইতেস, নিজের মেয়ের সঙ্গে করলে তার নাম থুগাত্রোমিকিসিয়া। কিন্তু ওরা সব ইনসেস্টকে বলতো গামোস আনাসিওস, মানে, অপবিত্র সম্পর্কে।
গল্পটা চালু করবে তো? কাকে কী বলে জেনে হাত মারবো? একদম ফাট্টুস লোক তুমি।
আসলে আগেকার দিনে ঠাকুর-দেবতার নামে গল্প চালু করেছিল যাতে নিজেরাও করতে পারে বুঝলি, ওরা করে তো আমরা করবো না কেন। ইটালির সাম্রাজ্য, যাকে ওরা বলে রোমান এমপায়ার, সেটা তো আরম্ভ হয়েছিল রোম আর ওর বোন রোমার সম্পর্কের ফলে।
কী গপপো শোনাচ্ছ ফালতু আমার তো টনটনিয়ে যাচ্ছে।