‘আমার জার্মানি’ বইটা পড়ে শেষ করার পর খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ বলেন যে আমি এই বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি তাহলে তাঁকে বলতেই হবে যে ক্ষমা করবেন মহোদয়, আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে’, কারণ ওটা সম্ভব নয়। এ বই পড়তে হবে থেমে থেমে, রসিয়ে রসিয়ে, অনুভব করে করে, প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের মর্ম অনুধাবন করে।
যে কথা গুলো প্রথমেই মনে হচ্ছে, সেগুলো বলি।
প্রথমত, লেখকের স্মরণশক্তি। প্রত্যেকটি ঘটনার এ রকম সন তারিখ সহ বিস্তৃত বর্ণনা দিতে যে অকল্পনীয় স্মৃতিশক্তির প্রয়োজন তা খুব কম মানুষের থাকে। কুর্ণিশ।
দ্বিতীয়ত, রসবোধ। মুজতবা আলী সাহেবের কথা মাথায় রেখেই বলা যায় তাঁর একজন উত্তরসূরি বোধহয় খুঁজে পাওয়া গেল। সময় তা বলবর, কিন্তু আশা পোষণ করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে।
তৃতীয়ত, সাহিত্যের সঙ্গে অনুভূতির মেল বন্ধন। জলপাইগুড়িতে ব্যাংকিংএর প্রথম পাঠ নেওয়ার স্মৃতি আজও অমলিন -জলের ধারে বসে থাকার স্মৃতি কখনো কি মুছে যায়! আমাদের একসাথে বসে সেই শক্তি -সুনীল- তারাপদ রায়ের কবিতা পড়া! শুধু সেই সব কবিতা নয়, সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই, যাযাবর এমনকি বঙ্কিমও আছেন। এসব মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে অজস্র।
কিন্তু বইটা শেষ করার পরে যে রেশটা মনের ভেতরে অনুরণিত হতে থাকে সেটা ভাষা, বর্ণনা এবং অনুভূতির একটা অনবদ্য মিশ্রণ। পদুমা গ্রাম, মায়ের কথা, জলপাইগুড়ির দিনগুলো, জার্মানিতে প্রথম কাটানো সেই শীতার্ত রাত্রি, ইজারলোন, হেলমুটের কাছে বসে নুরেমবেরগের নাৎসি কংগ্রেসের স্টেডিয়াম বানানোর গল্প, শহরের ধ্বংস ও পুনরুত্থান, নির্বিচারে ইহুদি নিধন, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বীভৎসতা, জার্মানির বঙ্গ সমাজ, অক্টোবর ফেসটের জাঁকজমক, চেকোস্লোভাকিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে অরটউইনের জন্মভূমির খোঁজে অভিযান -অসাধারণ সব বর্ণনা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমার মনের মধ্যে যে তিনটে দৃশ্য দাগ কেটেছে তা এইরকম-
প্রথম দৃশ্য - ফ্রাঙ্কফুর্টের এক পানশালায় গুলতানি জমে উঠেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মান। সেখানে সহসা হাজির হীরেনের বসের পিতৃদেব, অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান সেনাধ্যক্ষ, ডেভিড। বয়স্ক মানুষ, উঁচু আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজি বলেন, যুদ্ধকে ঘৃণা করেন। জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম সাক্ষাৎকার এবং যুদ্ধের গল্প বলতে শুরু করলেন। সবাই শুনছে, যারা ইংরেজি খানিকটা জানে তারা মোটামুটি বুঝতে পারছে, বাকিরা পারছে না। এক সময়ে একজন বয়স্ক জার্মান এগিয়ে এলেন, হীরেনকে বললেন আমি ওঁর সব কথা বুঝতে পারছি না, কিন্তু একটা কথা জানতে চাই -অমুক দিন অমুক যুদ্ধের সময় উনি কি সেখানে উপস্থিত ছিলেন? ডেভিডকে বলা হলে তিনি বললেন, হ্যাঁ। পরের প্রশ্ন- উনি কি মনে করতে পারেন সেদিন একজন শত্রুপক্ষের সৈন্যকে গুলি না করে গ্রেপ্তার করেছিলেন? উত্তরে ডেভিড বললেন যদিও গুলি করাই দস্তুর কিন্তু আমার কাছে সব যুদ্ধই অর্থহীন। সুতরাং আমি কাউকেই গুলি করিনি। তবে সেদিন একজন নিরস্ত্র জার্মান সৈনিককে আমি আমার উপরওলার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বয়স্ক জার্মান ভদ্রলোক এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি সেই সৈনিক। ডেভিড উঠে দাঁড়ালেন। দুজনে দুজনের দিকে এগিয়ে গেলেন। চার দশক আগের দুই শত্রু একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন।
দৃশ্য দুই। ইয়েন্সের সঙ্গে পরিচয় হল বার্লিনে। অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুত্ব, আলাপ জমে উঠলো - চলুন আপনাকে ওই বই পোড়ানর জায়গাটা দেখিয়ে আনি। নানা গল্প। হীরেন একটু বিস্মিত, পুলকিত। একসময়ে ইয়েন্স বললেন আসুন আপনাকে আমার একটা খুব প্রিয় দৃশ্য দেখাই। খানিক এগিয়ে হঠাৎ একটা ফ্ল্যাট বাড়ির দরজা ঠেললেন, দরজা খুলে গেল। সামনে সিঁড়ি। ম্লান মৃদু একটা আলো। ইয়েন্স বললেন আসুন। সিঁড়ি বেয়ে চার তলা। ল্যান্ডিঙে একটা কাঁচহীন বড়ো জানলা। ইয়েন্স বললেন, বাইরে তাকান। হীরেন দেখলেন সামনে একশ মিটার দূরে বার্লিন ওয়াল। চোখের সামনে আধো অন্ধকারে আশ্চর্য অপরিচিত সব দৃশ্য; ওপারে পশ্চিম বার্লিনের অজস্র ঝলমলে আলো, এপারে কাঁটা তার, পরিখা, অন্ধকার। সাম্যবাদের সঙ্গে ধনতন্ত্রের মুখোমুখি দেখা। ইয়েন্স বললেন, জানেন এটা আমার ফ্ল্যাট নয়, তবু আমি এখানে আসি। সন্ধ্যেয় যখন ওদিকে আলো জ্বলে ওঠে, এই জানালায় দাঁড়াই আর ওদিকে তাকিয়ে থাকি। দেখি আরেকটা উজ্জ্বল জগৎ আছে, মুক্তি আছে। হয়তো একদিন আমি সেখানে যাবো।
হীরেন নিশ্চুপ। ধনীর দুয়ারে দাঁড়ায়ে কে গো ওই কাঙ্গালিনীর মেয়ে? সংযোজন অনবদ্য।
দৃশ্য তিন। ইউরোপে হীরেনের প্রথম গুরু অরটউইন, পরবর্তীকালে অভিন্নহৃদয় বন্ধু, মন্ত্রণাদাতা ও পথ প্রদর্শক। অরটউইনের সঙ্গে কাজ শেখা, কাজ করা, পারিবারিক সম্পর্কের মতন তৈরি বন্ধুত্ব। প্রায় চার দশক জুড়ে সেই সম্পর্কের পরিধি। অরটউইনের জন্মস্থান চেকোস্লোভাকিয়ার এক গণ্ডগ্রামে শেকড়ের সন্ধানে একত্রে অভিযান। কেটে গেল মাস বছর -চাকরি বদল, কিন্তু সম্পর্ক অটুট, আরও আরও গভীর। তারপর নেনডরফের সানাটোরিয়ামে অরটউইনের ভর্তি হওয়া (কোন গুরুতর অসুখ নয়, হাড়ের ব্যথা, গাঁটের ব্যথা সারানোর জন্যে উষ্ণ প্রস্রবণের জলে স্নান এবং সঙ্গে চিকিৎসা) সেখানে তাকে দেখতে যাওয়া এবং থাকার নানা কৌতূহলোদ্দীপক গল্প। দিন কেটে যায়। পাকস্থলীতে সঙ্কট ধরা পড়লো অরটউইনের। সাল ২০০১। বাদ বেরকা সানাটোরিয়ামে ভর্তি। খবর পেয়ে হীরেন দৌড়ালো সেখানে। অরটউইনের সঙ্গে দেখা হল। যে মানুষটা এক সময় একটার পর একটা সিগারেট খেতো তার এখন সিগারেট খাওয়া বারণ। অরটউইন জানাল ফ্রাঙ্কফুর্টের ডাক্তাররা তাঁর রোগ নির্ণয় করেছেন। কোলনে ক্যান্সার। কেমো থেরাপি চলছে। তার পরেও লড়াই চলেছে আরও চোদ্দ বছর। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে জীবন হার মানলো। চলে গেল অরটউইন।
হীরেন আরও লেখো?
পরিশিষ্ট
কিছু মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়লো। জলপাইগুড়ির বন্যা একজায়গায় লেখা হয়েছে ১৯৬৮ তারপরেই ১৯৭২। অরটউইনের নামের বানান বইয়ের ভেতরে লেখায় এবং ছবিতে আলাদা। একটা এত ভালো বইয়ে এটুকু খুঁতই বা থাকবে কেন? দেড়শ সার্চলাইটের মধ্যে একটা ফিউজ হয়ে গেলে আলো একটুও কমে না কিন্তু তাই বা হবে কেন?
এবার হাড়িকাঠে গলা দেওয়ার জন্য তৈরি হই।
কমলহীরের কাছে আমরা কী প্রত্যাশা করি? ভার না দীপ্তি? নাকি ভারসাম্য?
ভার কি একটু বেশি হয়ে গেছে?