বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ বাংলাদেশ। বন্যা, খরা, মড়ক, দুর্ভিক্ষ, বর্গির আক্রমণ, মগ, হার্মাদ – এমনকি এই সময়ের করোনা – এইসব ভয়ঙ্কর দুর্যোগ বুকে নিয়েও, উৎসবের আনন্দ থেকে বাঙালিকে কেউ বিরত করতে পারেনি। আর সাত সমুদ্র-তেরো নদী পেরিয়ে যেদিন ইউরোপীয়রা এসে জাহাজ থেকে নামল এই বঙ্গদেশে, তার কিছুকালের মধ্যেই তারাও মজে গেল বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণে। বিদেশীদের সঙ্গে বাণিজ্য করে সদ্য বড়লোক হওয়া দিশি বাঙালি বাবুরাও চট করে বুঝে ফেললেন, বিভিন্ন উৎসবের বাহানায় এই সাহেব-মেমদের আমোদ-ফুর্তি, খানাপিনা, বাইজি-নাচের আমোদে টেনে নিতে পারলে তাদের ব্যবসার বিলক্ষণ সুবিধে। অতএব হোলি, চড়ক, গাজন অথবা জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গোৎসবের রবরবা শুরু হয়ে গেল গোটা বাংলা জুড়েই। গোড়ার দিকে এইসবের কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ, তারপর কালে কালে কলকাতা শহরই হয়ে উঠল আমোদ ফুর্তির পীঠস্থান।
ব্যবসায়ী আর ভাগ্যের সন্ধানে আসা ইউরোপীয়দের সঙ্গেই এদেশে আসতে আরম্ভ করেছিলেন প্রশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত চিত্রকরের দল। আর এদেশে এসেই তাঁরা প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং স্থাপত্যের সঙ্গে সঙ্গে আঁকতে আরম্ভ করেছিলেন নানা দেশীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎসবের ছবি। ফটোগ্রাফি-পূর্ববর্তী যুগে আঁকা এইসব ছবির শিল্পমূল্য যাই-ই হোক না কেন, ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। আর কালক্রমে এইসব সাহেব-শিল্পীদের সঙ্গে দেশীয় শিল্পীদের নানা আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছিল আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার ধারণা।
একই বিষয়বস্তু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আঁকা দেশী ও বিদেশী চারজন শিল্পীর ছবি থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করব – শিল্পীদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে কেমন ভাবে বদলে গেছে দেখার পরিপ্রেক্ষিত। ১৮৪১ সালে বাংলায় এসেছিলেন রুশ রাজকুমার আলেকজান্ডার স্যাল্টিকভ (১৮০৬ – ১৮৫৯)। তিনি ছিলেন একাধারে চিত্রকর এবং লেখক। ভারতবর্ষ ছাড়াও পারস্য এবং মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। আর সেই অভিজ্ঞতাকে ধরে রেখেছিলেন নিজের আঁকা ছবিতে এবং লেখায়। পরবর্তীকালে এইসব ছবি এবং লেখা নিয়ে প্যারিস থেকে প্রকাশ করেছিলেন একটি বই। সেই বইতেই আমরা দেখতে পাই, ১৮৪১ সালে স্যাল্টিকভের আঁকা বাংলায় কালী-প্রতিমা বিসর্জনের মিছিলের ছবি (ছবি – ১)।
চিত্রকলা হিসেবে তো বটেই, ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও স্যাল্টিকভের আঁকা ছবিটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও আকর্ষণীয় – এই ছবির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। মনে রাখতে হবে, স্যাল্টিকভ যখন এদেশে এসেছেন, তখনও ভারতবর্ষ সম্পর্কে ইউরোপিয়ানদের ধারণা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ইউরোপের বহু মানুষ তখনও মনে করেন ভারতবর্ষ জঙ্গলাকীর্ণ, আদিম, সাপ-বাঘে পরিপূর্ণ একটি বিপজ্জনক ভূখণ্ড। এই ধারণা ইউরোপে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে ইংরেজদের ভূমিকাও কিছু কম নয়। তারা ভালভাবেই জানত, ভারতবর্ষের বিষয়ে যত বেশি ভুল ধারণা ইউরোপীয়দের মনে তৈরি হবে, ততই তাদের মুনাফার ভাগীদারের সংখ্যা কমতে থাকবে। স্যাল্টিকভের মনেও যে এই ধারণা পুরোদস্তুর কায়েম ছিল, তা খুব ভাল করে বোঝা যায় তাঁর ১৮৪১ সালে আঁকা কালী প্রতিমা বিসর্জনের ছবিটি দেখে। প্রথম দর্শনে ছবিটি দেখে মনে হয়, এ যেন আফ্রিকার আদিম অরণ্যের গভীরে, কোন নরখাদক আদিম উপজাতির উৎসবের ছবি। তারপর, রাতের বেলায় জঙ্গলের মধ্যে, মশালের আলো এবং ধোঁয়ায় মিছিলের কয়েকজনের কাঁধে প্রকাণ্ড কালী-প্রতিমাটি দেখে বোঝা যায় – এ ছবি, এদেশের তো বটেই, একেবারে বাংলার দৃশ্য। কালীর দুই হাতে ঝুলে থাকা দু’টি মুণ্ডু এবং মশালের আলোর পিছনে প্রতিমার বিরাট ছায়া যেন ছবিটিকে রহস্যময়তার সঙ্গে সঙ্গে ভীতিপ্রদও করে তোলে। ছবিটিতে আঁকিয়ের নিজের অবস্থানও বেশ রহস্যময়। দৃশ্যটি দেখে মনে হয়, শিল্পী যেন গাছপালার ফাঁক দিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব গোপন রেখে, দৃশ্যটি দেখছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলায় আফ্রিকার আদিম অরণ্যে অ্যাডভেঞ্চারের যেসব কিশোর-পাঠ্য গল্প উপন্যাস প্রকাশিত হত, তার অলঙ্করণের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে স্যাল্টিকভের আঁকা ছবির আশ্চর্য মিল। কৈশোরে এইসব গল্পে আফ্রিকার আদিম উপজাতিদের যে রোমাঞ্চকর কাহিনী পড়ে আমরা শিহরিত হয়েছি, স্যাল্টিকভের ছবিতে আমাদের কয়েক প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষদেরই সেইভাবে চিত্রিত হতে দেখা যায়। এইটাই মানব সভ্যতার বিরাট আয়রনি।
স্যাল্টিকভের কালী প্রতিমা বিসর্জনের ছবিটি আঁকার চৌষট্টি বছর পরে ১৯১৫ সালে একজন বাঙালি চিত্রকর একটি দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের ছবি আঁকেন। এই ছবির নাম ‘প্রতিমা বিসর্জন’ (ছবি -২)। শিল্পীর নাম গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার প্রধান পথপ্রদর্শকদের মধ্যে অন্যতম। আর ‘প্রতিমা বিসর্জন’ ছবিটিকে তাঁর আঁকা একটি মাস্টারপিস হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। গগনেন্দ্রনাথের আঁকা এই ছবিটিও রাত্রের দৃশ্য। ছবির বাঁ-দিকে উত্তর কলকাতার রাস্তা মশালের আলোয় আলোকিত। সেখানে প্রকাণ্ড দুর্গা মূর্তির সামনে জড়ো হয়েছেন অনেক মানুষ। খুব সম্ভবত বিসর্জনের শোভাযাত্রার আগে দেবীর বরণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই আলোকিত অংশের প্রতিফলিত আলো এসে পড়েছে ছবির বাকি অংশে, আবছা রহস্যময় অন্ধকারে থাকা কয়েকটি বাড়ির ওপরে। তেমনই একটি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্তঃপুরের মহিলারা দেবীর বরণ দেখছেন। চৌষট্টি বছর আগে স্যাল্টিকভের ছবিতে যে প্রায় আদিম জনগোষ্ঠীর ছবি দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, তার সঙ্গে সামাজিক উপস্থাপনায় এই গগনেন্দ্রনাথের ছবি প্রায় বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। এখানে একটি আপাদমস্তক শহুরে পরিবেশের মধ্যে, বাড়ির মহিলাদের বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিসর্জনের দৃশ্য দেখার মধ্যে, ইতিমধ্যেই বাংলায় ঘটে যাওয়া সামাজিক বিপ্লবের ইঙ্গিত রয়েছে। এই বাংলা, নবজাগরণের সমকালীন বাংলা। আবার, এই ছবির দৃশ্য কল্প রচনা, উপস্থাপনা এবং উজ্জ্বল আলো ও অন্ধকারের যুগপৎ প্রয়োগে নির্মিত রহস্যময়তা, আমাদের মনে করিয়ে দেয় আর একটি পৃথিবী বিখ্যাত ছবির কথা। আমস্টারডামের রাইখস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এই মাস্টারপিস ছবির নাম ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ বা রাত পাহারার টহল (ছবি -৩)। এই ছবি এঁকেছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী রেমব্রান্ট।
এইবার যে ছবিটির কথা লিখব, সে ছবি আমি নিজে কোনোদিন চোখে দেখিনি। সেই ছবির বর্তমান অস্তিত্ব সম্পর্কেও কেউ কিছু জানেন না। কেবল শিল্পীর পুত্র এবং সমসাময়িক কয়েকজন শিল্পীর স্মৃতিচারণায় ধরা আছে এই ছবির ইতিহাস। ছবিটি সম্ভবত আঁকা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, তিরিশ অথবা চল্লিশের দশকে। আশ্চর্য ভাবে, এই ছবির বিষয়বস্তুও স্যাল্টিকভের আঁকা ছবির সঙ্গে মিলে যায়। রাতের অন্ধকারে শহরের রাস্তা দিয়ে চলেছে কালী প্রতিমা বিসর্জনের মিছিল। সেই মিছিলের আলো আঁধারিকে অসাধারণ দক্ষতায় ক্যানভাসে ধরেছিলেন এই ছবির চিত্রকর শিল্পী প্রহ্লাদ কর্মকার। ১৯৪৬ সালে, মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসে, প্রয়াত হন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের শিক্ষক এই গুণী শিল্পী। সেই বছরেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় শিল্পীর স্টুডিও এবং অধিকাংশ ছবি। হয়তো চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় এই লেখায় উল্লিখিত ছবিটিও। কিন্তু প্রহ্লাদ কর্মকারের আঁকা এই বিসর্জনের ছবিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাস যেমন আমাদের বিস্মিত করে, তেমনই আত্মবিস্মৃত জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিতও করে। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে সারা পৃথিবীর চিত্রকরদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকায়। সেইখানে অন্যতম প্রতিযোগী হিসেবে এই বিসর্জনের ছবিটি পাঠিয়েছিলেন শিল্পী প্রহ্লাদ কর্মকার। এই প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে তিনি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেছিলেন। আর প্রথম হয়ে স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন মহান আধুনিক ফরাসি চিত্রকর অঁরি মাতিস। বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসে মাতিসের যে গুরুত্ব এবং সম্মান, তার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশও পাননি প্রহ্লাদ কর্মকার। আধুনিক সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির স্মৃতিতে তিনি প্রায় অবলুপ্ত। কিন্তু বলার কথা এই, যে একজন ইউরোপীয় চিত্রকর স্যাল্টিকভ যে বাঙালিকে প্রায় অর্ধ- নগ্ন আদিম জনগোষ্ঠীর ভূমিকায় চিত্রিত করেছিলেন, মাত্র একশ’ বছর পরে, তাদেরই এক উত্তরসূরির প্রায় একই বিষয়বস্তু নিয়ে আঁকা ছবি বিশ্ব-শিল্পকলা প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হচ্ছে ফরাসি শিল্পী মাতিসের সঙ্গে এক মঞ্চে।
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে, উত্তর কলকাতার সাধারণ বাঙালি ঘরের নারী হিসেবে ত্রিনয়নী দুর্গার ছবি এঁকে, আলোড়ন তুলেছিলেন শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। এই দুর্গা সিরিজের অনেকগুলি ছবির মধ্যে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল ‘বিসর্জন’ (ছবি -৪)। সেই ছবিতে বিকাশ দেখিয়েছিলেন, একটি বনেদি বাড়ির পিছনের পুকুরের টলটলে জলে ভেসে রয়েছে দুর্গা-রূপী এক বধূর মৃতদেহ। জলের ওপরে ভেসে থাকা মুখমণ্ডলের কপালে জ্বলজ্বল করছে তৃতীয় নয়ন। জলের ওপরে বাড়ির উল্টো প্রতিবিম্ব, আর ভেসে রয়েছে সবুজ কচুরিপানা। হয়তো অপমান বা অত্যাচারে আত্মঘাতী হয়েছে এই দুর্গা, অথবা চিরদিনের মত মুখবন্ধ করে তার মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে পুকুরের জলে। এই ছবিতে এসেই যেন বিসর্জনের চিত্রকলার একটা পূর্ণ-বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
স্যাল্টিকভের ছবিতে অর্ধ-নগ্ন আদিম বাঙালির মাতৃ-আরাধনা, গগনেন্দ্রনাথের নবজাগরণের নারীমুক্তির ভেতর দিয়ে, প্রহ্লাদ কর্মকারের আধুনিক বিশ্ব-শিল্পকলার ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। কিন্তু এই সবকিছুর পরেও নারীজাতির প্রতি চরম অসম্মান, অবহেলা, অত্যাচার এবং অন্যায়, কোথায় যেন আবার আমাদের ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। বিকাশ ভট্টাচার্যের আঁকা বিসর্জনের বিষাদ-ঘন ছবি যেন আমাদের প্রশ্ন করে – স্যাল্টিকভের ছবির আদিমতাকে অতিক্রম করে সত্যিই আমরা আসলে কতটা সভ্য হতে পেরেছি?