লেখার মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে একটু বলি কেন এই বিষয়টা নিয়ে লেখবার কথা মাথায় এল। সম্প্রতি এক বিখ্যাত বাঙালী শিল্পীর আঁকা একটি ছবিকে অবলম্বন করে কলকাতার কোন পুজোতে মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়। এ নিয়ে কিছু অদ্ভুত জটিলতার সৃষ্টি হয় মূলত আমরা যাকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি’ বলি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে। একদিকে যেমন প্রাথমিকভাবে যে শিল্পী মূর্তি নির্মাণ করেছেন তিনি তার রেফারেন্সের সোর্স সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি , যদিও তাঁর কাজটিকে একধরনের ভিস্যুয়াল কোটেশন বলা যেতেই পারে যেখানে মুল ছবিটি শিল্পকলার দুনিয়ায় পরিচিত ইমেজ। আবার অন্য দিকে এই কাজের সমালোচনা করে অনেকে ‘কপি করা’ বা ‘কপিরাইট আইন’ ভঙ্গ করবার অভিযোগ তুলেছেন।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোন বিখ্যাত লেখকের বহুল পরিচিত লেখার অংশ কোটেশন হিসেবে অন্য কেউ তাঁর নিজস্ব প্রেক্ষিতে ব্যবহার করছেন এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। আবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক বিখ্যাত গান রয়েছে যার সুর আইরিশ বা স্কটিশ লোকসঙ্গীত থেকে সরাসরি নেওয়া। কিন্তু শিল্পকলার অন্য ক্ষেত্রে, মানে ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া বা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি কেউ এই ধরনের রেফারেন্স বা কোটেশন ব্যবহার করেন তাহলে কি সেটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে গণ্য হবে ? আমার উত্তর হচ্ছে ‘না’। যদি কোন শিল্পী তাঁর পূর্বজ আরেকজন শিল্পীর কোন আইকনিক কাজকে অন্য ভাবে অন্য কনটেক্সটে বা অন্য মাধ্যমে ব্যবহার করে আলাদা কোন বার্তা দিতে চান, তাহলে সেটাও শিল্পের একটা ভ্যালিড পদ্ধতি বলেই ধরে নিতে হবে। এই পদ্ধতিতে সাধারণত শিল্পী তাঁর রেফারেন্স সোর্সকে গোপন রাখতে চান না বরং সেটাকেই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির একটা এন্ট্রি পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করবার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে সেরা উদাহরণ হচ্ছে পিকাসোর পঞ্চাশের দশকের বেশ কিছু ছবি, যেখানে তিনি ভেলাস্কেথ, গোইয়া, এদুয়ার মানে প্রমুখ শিল্পীর আঁকা কিছু বিখ্যাত মাস্টারপিস ছবির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এটা কতকটা পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীর থিয়োরিকে ব্যবহার করে পরবর্তী প্রজন্মের কোন বিজ্ঞানীর নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার বা প্রতিষ্ঠা করবার মতই।
শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পী কীভাবে কোটেশন ব্যবহার করবেন সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে কনসেপ্ট এবং কনটেন্টের ওপরে। কখনো অন্য শিল্পীর বিখ্যাত কোন কাজের একেবারে সরাসরি উপস্থাপনার সাহায্যে এটা হতে পারে, আবার তার একটা আভাস বা ইঙ্গিত রেখেও বিষয়টা বোঝানো যেতে পারে। মাধ্যম বা শিল্পের মিডিয়াম এক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি মূল শিল্পী এবং রেফারেন্স ব্যবহারকারী শিল্পীর প্রকাশের মাধ্যম একই হয় তাহলে ব্যাপারটা একরকম হয় (যেমন পিকাসোর ক্ষেত্রে ঘটেছে) আবার যদি দুই শিল্পী দুটি ভিন্ন মাধ্যমে কাজটি করেন তাহলে মিডিয়ামের পরিবর্তনের কারণেও মুল রেফারেন্সের থেকে পরবর্তী কাজটির মধ্যে একেবারে অন্য মাত্রা প্রযুক্ত হতে পারে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে যদি দুজনেই হন নিজ নিজ ক্ষেত্রে দিকপাল শিল্পী। এ বিষয়ে একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। প্রখ্যাত ফরাসী ভাস্কর ও মূর্তিকার রঁদ্যার একটি মাস্টারপিস শিল্পকর্ম হল ‘দ্য থিঙ্কার’ নামক ভাস্কর্যটি। ইউরোপীয় শিল্পকলার যে কয়েকটি উদাহরণ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বিপুল পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই থিঙ্কার হচ্ছে তার অন্যতম। রঁদ্যা ১৯০৪ সালে এই মূর্তি তৈরি করবার ছত্রিশ বছর পরে ১৯৪০ সালে চার্লি চ্যাপলিন তৈরি করেন তাঁর মাস্টারপিস চলচ্চিত্র ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। এই ছবির একটি দৃশ্যে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য তিনি রঁদ্যার থিঙ্কার নামক ভাস্কর্যটিকে ভিস্যুয়াল কোটেশন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এবং সেখানে আবার তিনি এই বিখ্যাত মূর্তিটির মধ্যে এমন একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছেন যা মূল কাজটিকে একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ছবির একটি দৃশ্যে হিঙ্কেলের (চ্যাপলিন) রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে আসবার সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে রাস্তার ধারে সাজানো দু একটা মূর্তি আমাদের চোখে পড়ে। এর একটি হল বিখ্যাত গ্রীক ভাস্কর্য ‘ভেনাস ডি মিলো’। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে রঁদ্যার থিঙ্কার। কিন্তু ভেনাস তো বটেই থিঙ্কারের মূর্তিরও বাঁ হাতটি আমরা দেখি কাঁধ থেকে সোজা সামনের দিকে প্রসারিত। ঠিক যে কায়দায় নাৎসিবাদীরা পরস্পরকে অভিবাদন এবং আনুগত্য জানাতেন ‘হাইল হিটলার’ (এক্ষেত্রে হাইল হিঙ্কেল) বলে। সামনে গাড়িতে বসা নাৎসি রাষ্ট্রনায়ক আর ব্যাকগ্রাউন্ডে আনুগত্যের ভঙ্গিতে হাত তোলা থিঙ্কার, এই কয়েক সেকেন্ডের ভিস্যুয়ালের মধ্যে দিয়ে চ্যাপলিন বুদ্ধিজীবীদের চাটুকারিতা এবং দেউলিয়াপনার একটা অসাধারণ উপস্থাপনা করে বেরিয়ে যান। আর এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে রঁদ্যার থিঙ্কার মূর্তিটির ভিস্যুয়াল কোটেশন এখানে না ব্যবহার করলে চ্যাপলিনের পক্ষে এত অল্পকথায় মুক্তচিন্তার দৈন্যের মত একটি বিরাট বিষয়কে ধরা সম্ভব হত না।
এদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও বেশ কয়েকটি ভিস্যুয়াল কোটেশনের অসাধারণ ব্যবহার আমাদের চোখে পড়ে। যেহেতু চিত্রকলার সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং সত্যজিতের কাজকর্মের শুরু চিত্রকর হিসবেই ফলে তাঁর ছবিতে বিভিন্ন চিত্রকলার রেফারেন্স এবং কোটেশন তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু অন্য চলচ্চিত্র পরিচালকের তৈরি ছবির এলিমেন্টও তিনি তাঁর ছবিতে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ বিষয়ে বলতে গেলে গোড়াতেই উল্লেখ করতে হয় সত্যজিতের প্রথম ছবি পথের পাঁচালীর। মনে রাখা দরকার ১৯৪০ সালে তিনি শিল্পকলার ছাত্র হিসেবে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে যোগদান করেছিলেন। যদিও শেষপর্যন্ত তিনি কলাভবনের পঠন অসমাপ্ত রেখেই কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ডি জে কিমার নামক বিজ্ঞাপন সংস্থায় জুনিয়ার ভিস্যুয়ালাইজার পদে যোগ দেন, কিন্তু একথা বহুবার বলেছেন যে শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর তত্বাবধানে এবং শিল্পী রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারীর সান্নিধ্যে যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব তাঁর কাজের ক্ষেত্রে পড়েছিলো। শান্তিনিকেতন স্কুলের সবথেকে জোরালো প্রভাব অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায় সত্যজিতের প্রথম ছবি পথের পাঁচালীতে। এ ছবি তৈরি করবার কিছুকাল আগেই তিনি অলঙ্করণ করেছিলেন ‘আম আঁটির ভেঁপু’ নামে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসের কিশোর পাঠ্য সংস্করণের। এই সাদা কালো অলঙ্করনের ক্ষেত্রে নন্দলাল বসুর করা সহজ পাঠ বইটির সাদা কালো লিনোকাট গুলির প্রভাব পড়েছিল সত্যজিতের কাজে। পরবর্তীকালে যখন তিনি এই উপন্যাস অবলম্বনে ফিল্ম নির্মাণ করবার কথা ভেবেছিলেন, নন্দলালের লিনোকাটের সাদা কালোর বিন্যাস এবং কম্পোজিশন তাঁর ফিল্মের ফ্রেমিং এবং সাদা কালোর বিন্যাসকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রন করেছিল। কিন্তু একেবারে সরাসরি ভিস্যুয়াল কোটেশনের ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা করবার জন্য এখানে তাঁর তৈরি অন্য দুটি ফিল্মকে বেছে নেবো। এর মধ্যে একটি ছবিতে তিনি একজন পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি মাস্টারপিস ছবিকে সরাসরি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে নির্বাক যুগের একটি ল্যান্ডমার্ক চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ এলিমেন্টকে প্রায় কাছাকাছি প্রেক্ষিতে ভিস্যুয়াল কোটেশন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
১৮০৭ সালে ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ান স্পেন আক্রমণ করেন। স্পেনের রাজা সপ্তম ফার্দিনান্ডকে ক্ষমতাচ্যুত করে নেপোলিয়ান তাঁর ভাই যোসেফ বোনাপার্টকে স্পেনের শাসক বলে ঘোষণা করে দেন। এর ফলে স্প্যানিশ জনগনের বিরাট ক্ষোভের উদ্রেক হয় এবং তাঁরা ফরাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহ চরম আকার নেয় ১৮০৮ সালের ২রা মে, যখন বিদ্রোহী স্প্যানিশ জনতা ফরাসী সৈন্যদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর পরের দিন অর্থাৎ ৩রা মে, ১৮০৮ তারিখে স্পেনের বিভিন্ন জায়গায় ফরাসী সৈন্যরা নিরস্ত্র স্প্যানিশ জনতাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। এই ঘটনার ফলশ্রুতি হিসেবে শুরু হয় পেনিনসুলার যুদ্ধ এবং শেষপর্যন্ত ১৮১৪ সালে স্প্যানিশ জনতা ফরাসীদের হটিয়ে দিয়ে পুনরায় স্বাধীনতা অর্জন করে। এই ঘটনাটিকে নিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত স্প্যানিশ শিল্পী ফ্রান্সিসকো গোইয়া একটি ছবি এঁকেছিলেন যার নাম ‘৩রা মে ১৮০৮’। পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মাস্টারপিস ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হয় গোইয়ার আঁকা এই ছবিটিকে। সাড়ে আট ফুট বাই সাতাশ ফুট সাইজের এই প্রকাণ্ড ক্যানভাসের বাম দিকে রয়েছেন নিরস্ত্র স্প্যানিশ জনতা। আর ছবির ডানদিকে সারিবদ্ধভাবে জনতার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফরাসী সৈন্যদল। এটি হচ্ছে জনতাকে গুলি করে মারবার মুহূর্তের চিত্রায়ন। ছবির মধ্যভাগে রয়েছে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়া একটি রক্তাপ্লুত মৃতদেহ। অনেক ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ এবং ঐতিহাসিকদের মতে গোইয়ার আঁকা এই ৩রা মে, ১৮০৮ ছবিটি হল শিল্পকলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম বর্বরতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদের ছবি। এই ছবি পরবর্তীকালে ইউরোপ এবং পৃথিবীর বহু দেশের অনেক শিল্পীর কাজকে প্রভাবিত করেছে। এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল ১৯৫১ সালে পিকাসোর আঁকা ম্যাসাকার ইন কোরিয়া নামক ছবিটি। ১৯৭১ সালে অস্থির রাজনৈতিক পটভূমিকায় সত্যজিৎ রায় যখন কলকাতা ট্রিলজির অন্যতম ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নির্মাণ করেন সেখানে একটি স্বপ্নদৃশ্য ছিল। সেই দৃশ্যের একজায়গায় গল্পের মূল চরিত্র সিদ্ধার্থ স্বপ্ন দেখে যে সমুদ্রের সৈকতে বালির ওপর তার বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছোট ভাইকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হচ্ছে আর পর্দার ডান দিকে বন্দুক উঁচিয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে উর্দিধারী পুলিসের দল। এই পুরো দৃশ্যটি নির্মাণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ গোইয়ার আঁকা ৩রা মে ১৮০৮ ছবিটিকে সরাসরি ভিস্যুয়াল কোটেশন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে যেভাবে বন্দুক উঁচিয়ে ধরা সারিবদ্ধ পুলিসের দল কে দেখানো হয়েছে এবং যে অ্যাঙ্গেল থেকে ক্যামেরাকে ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরপুরি গোইয়ার আঁকা ছবির কম্পোজিশনের অনুসারী। কনটেক্সটের দিক থেকে দেখতে গেলেও গোইয়ার সঙ্গে সত্যজিতের অনেক মিল আছে। ফরাসী শাসকের বিরুদ্ধে স্পেনের সাধারন জনতার বিদ্রোহ ছিল গোইয়ার ছবির বিষয়বস্তু , আর সত্যজিতের ছবিতেও দেখানো হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এক বিদ্রোহী তরুণকে যে ঘটনাচক্রে ফিল্মের কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভাই। এ ছবিতে সত্যজিৎ তাঁর রেফারেন্সটিকে সেইভাবেই উপস্থাপনা করেছেন যাতে করে যেসব দর্শকের গোইয়ার আঁকা এই বিখ্যাত ছবিটির সঙ্গে পরিচয় আছে তারা যেন ছবিটি দেখামাত্রই রেফারেন্সের মূল সোর্স ও তার কনটেক্সটের সঙ্গে নিজেদের ভাবনাকে সংযুক্ত করে নিতে পারেন।
১৯২৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধত্তর জার্মানিতে চলচ্চিত্রকার ফ্রিটজ ল্যাঙ তৈরি করেন কল্পবিজ্ঞান নির্ভর এক্সপেশনিস্ট ছবি ‘মেট্রোপোলিস’। একশো বছর পরের ২০২৭ সালের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ছবি দেখাতে গিয়ে ল্যাঙ কিন্তু শুধু সায়েন্স ফিকশনেই থেমে থাকেন নি। সেই সঙ্গে তিনি টেনে এনেছেন ক্যাপিটালিস্ট সমাজের ভোগবাদী যাপন এবং শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি শোষণ ও অত্যাচারের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। তিরানব্বই বছর আগে তৈরি এই নির্বাক চলচ্চিত্রে যে মেট্রোপলিসের বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে মাটির ওপরের স্তরে প্রকাণ্ড সব হাইরাইজ বাড়িতে ধনীরা বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপন করেন। আর এই শহরের সমস্ত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় ভূগর্ভস্থ বিরাট বিরাট যন্ত্রের সাহাজ্যে যেগুলিকে চালনা করবার কাজটি করে থাকে হাজার হাজার দরিদ্র শ্রমিক যাদের জীবন কাটে মাটির নিচে। এখানে মাটির ওপরের স্তর এবং নিচের স্তর কে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের দুটি স্তর হিসেবেই প্রতীকী উপস্থাপনা করেছেন পরিচালক। এই ছবির একটি প্রধান চরিত্র উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি ফ্রেডের। জন্মসুত্রে উচ্চবিত্ত হওয়ার কারনে সে মাটির তলায় ঘটে চলা শোষণ এবং অত্যাচারের কথা কিছুই জানে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে একদিন পৌঁছে যায় মাটির নিচে এবং সেখানকার পরিস্থিতি দেখে তার বিরাট মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ব্যাপারটি উপস্থাপন করতে গিয়ে পরিচালক একটি স্বপ্নদৃশ্যের অবতারণা করেন যেখানে ফ্রেডের বাইবেলে বর্ণিত ‘মুলক’ (বা মুলচ) এর দেখা পায়। মুলক একজন রাক্ষস বা দানব যাকে তুষ্ট করতে মানুষ ভোজন করাতে হয়। ফ্রেডের স্বপ্নে দেখতে পায় মাটির নীচে প্রবেশ করবার দরজাটি আসলে এক মানুষখেকো দানবিক যন্ত্র যা মুলকের মত হাঁ করে থাকে আর হাজার হাজার দরিদ্র শ্রমিককে গিলে খায়। এই যান্ত্রিক দানবের হাঁ করে শ্রমিকদের গিলে খাওয়ার যে উপস্থাপনা সেটাকে ভিস্যুয়াল কোটেশন হিসেবে সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেন তাঁর ১৯৮০ সালে নির্মিত ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে। আশ্চর্যজনক ভাবে এই হীরক রাজার দেশে ছবির মূল বিষয়বস্তুও হল শোষক এবং অত্যাচারী রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রমিক ও দরিদ্র শ্রেণীর সংঘাত। এই ছবিতেও মাটির নীচে হীরার খনিতে চাবুক মেরে শ্রমিকদের কাজ করানো হয় এবং মাটির ওপরে সেই হীরার অর্থনীতির জোরে রাষ্ট্র ব্যবস্থার জাঁকজমক এবং উৎসব চলতে থাকে। মেট্রোপলিস ছবির মতই হীরক রাজার দেশে ছবিতেও শাসকের মাইনে করা বৈজ্ঞানিক শ্রমিকদের বিদ্রোহকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য যন্ত্র আবিস্কার করে। এক্ষেত্রে সেই সেই যন্ত্রটি হল ‘মগজ ধোলাই যন্ত্র’ যা বসানো হয় বৈজ্ঞানিকের যন্তর মন্তর ঘরে। আর যখন কোন কৃষক , শ্রমিক বা ছাত্রদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য এই রাক্ষসের মুখের মত যন্ত্রটির সামনে নিয়ে আসা হয় তখন তার মুখের নিচে একটি বিরাট দরজা খুলে যায়। একে একে মানুষগুলিকে গিলে নেওয়ার পর সেই দরজা আবার বন্ধ হয়ে যায়। এবার সেই যন্ত্র রাক্ষসের মুখের ভিতরে আলো জ্বলে ওঠে এবং মন্ত্র বলা শুরু হয়। মগজ ধোলাই যন্ত্রের গঠন এবং দৃশ্যায়নের সঙ্গে ফ্রিটজ ল্যাঙ নির্মিত মেট্রোপলিস ছবির ‘মুলক’ এর সাদৃশ্য এতটাই ঘনিষ্ঠ যে এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না যে সত্যজিতের ভাবনা এবং পরিকল্পনা খুব সচেতন ভাবেই বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম এই জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ছবিকে চলচ্চিত্রের ভাষায় সরাসরি ভিস্যুয়ালি কোটেশন হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে।
এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে , সেটা হল যে দর্শকের জন্য ছবিটি তৈরি হয়েছে তারা যদি মুল রেফারেন্সের সোর্স সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকেন তাহলে সেক্ষেত্রে পরিচালকের কাজ তদের ভাবনাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারবে। এর উত্তরে যা বলা যেতে পারে তা হল প্রথমত সমস্ত দর্শককে শিখিয়ে পড়িয়ে গ্রুমিং করবার কাজটি অবশ্যই স্রষ্টার নয়। দর্শক তার নিজস্ব চর্চা এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিজেই শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। এই সমঝদার দর্শক হয়ে ওঠাও একটি ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া। এটা সকলের ক্ষেত্রে একইরকম ভাবে বা সমান ভাবে ঘটবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। দ্বিতীয়ত চলচ্চিত্র বা যেকোনো শিল্পকর্ম যা বার বার করে বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখবার সুযোগ রয়েছে সেখানে স্রষ্টার ব্যাখ্যা বা টেক্সট বা ন্যারেশন একমাত্র সত্য হতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন স্থান কাল পাত্র ভেদে সেই শিল্পের আলাদা আলাদা ইন্টারপ্রেটেশন হতেই থাকবে এবং স্বয়ং স্রষ্টাকেও সেটা খোলা মনে গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শিল্পে ভিস্যুয়াল কোটেশন হচ্ছে এমনই একটি প্রক্রিয়া যা পূর্বজ কোন শিল্পীর শিল্পকর্মকে যেমন রিইন্টারপ্রেট করবার সুযোগ করে দেয় ঠিক তেমনই পরবর্তী প্রজন্মের দর্শক বা শিল্পীদের জন্যও তাকে বিনির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করবার পথ খুলে দেয়।
আমি একেবারেই সাধারণ দর্শক। আপনার লেখা থেকে অনেক কিছুই জানলাম। জানতাম না আগে।
বক্তব্য ও বলার ভঙ্গিতে শেষ প্যারাটি মনে থাকে আলাদা করে।
লেখাটি চমৎকার ও চিন্তার খোরাক জোগায়। সত্যজিৎ ভিশুয়াল ডিজাইনার হওয়ার কারণে ছবিতে ভিশুয়াল আর্টের যে এলিমেন্ট উঠে এসেছে সেগুলো নিয়ে বড় লেখা পড়ার ইচ্ছে জানিয়ে গেলাম।
এই দুটো দৃশ্য দেখিয়ে দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। প্রতিদ্বন্দীর সিনটা তো মনেই থাকেনা । আমার জানা ছিল ঋত্বিকের সুবর্ণরেখায় ফেলিনির লা দোলচে থেকে কোট করা , দৃশ্য নয় , বাজনা। সেটা ব্যবহার করে কমেন্ট করা ।
আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হল, যেটা বেশী করে বেরিয়ে আসছে, সেটা এক ধরণের গ্রাফিক intertextuality | বিকাশ ভটচায্যির ছবি আর দুর্গাপ্রতিমা পাশাপাশি রাখলে এইটা বিশেষ করে মনে হয় যে ছবিটাই মা দুর্গার রূপকল্পনার উৎস | ছবিটা না হলে এই রূপকল্পনা হয়ত হত না। তাই যদি হয়, একে কি অনুপ্রেরণা বলা উচিৎ নয়? এখন একে উদ্ধৃতি বলবেন না গ্রাফিক intertextuality বলবেন?
এই বিষয়গুলো একেবারেই জানা ছিল না৷ লেখক কে ধন্যবাদ পরিচয় করানোর জন্য৷
খুব ভাল একটা বিষয়। দারুণ সব তথ্য। অনেকটা অজানা।
মেইন স্ট্রিম পাতি সব ছবিতেও কত এমন ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি বা আপনার ভাষায় ভিশুয়াল কোটেশন দেখি। জানা থাকলে মজা পাই। যে যত জানবে সে তত আনন্দ পাবে। না জানিলেও কিছু না। রূপক বা দৃশ্য গত ইমপ্রেশনস এর জোর ও কিছু কম না।
যেমন, ওম শান্তি ওম নামে শাহরুখ স্টারার মূল ধারার ছবিতে একবার হিচককের ভার্টিগোর বেশ কিছু সিকয়েন্সের রিপিট দেখে আনন্দ পেয়েছি।
দেবরাজ দা, অনেক কিছু জানলাম।
চমৎকার লেখা। অনেকগুলো পরত খুলে দিল। ভিশ্যুয়াল কোটেশন বা গ্র্যাফিক ইন্টারটেক্সুয়ালিটি যেভাবেই দেখিনা কেন এত প্রকৃতপক্ষে এক শৈল্পিক পুনর্নির্মাণ।
এই পুনর্নির্মাণ আবার নতুন নির্মাণের সম্ভাবনার উৎসমুখ খুলে দেয়।
অত্যন্ত ভালো লেখা। খুব থট প্রোভোকিং।
ছবির সাথে প্যান্ডেলের মূর্তির সম্পর্ক নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। আমার নিজের পছন্দ- দেবারেজের দেখাটিই। উপস্থাপনা ও বিশ্লেষণ ভালো লেগেছে।