হৈ হৈ করে পাহাড়ি খাড়িয়া: অ্যান আর্টিস্টস ইমপ্রেশন এগজিবিশন শুরু হয়ে যায় খুশিঝোরায়। খুশিঝোরা যেন সেজে উঠেছে উৎসবে। চার মাসের মধ্যে যাবতীয় কাজ শেষ কোরে খুশিঝোরাকে নতুন করে সাজিয়ে তুলেছে জলধর আর হেমন্ত। অতিথিদের জন্যে আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা, ছোট দরজার ওপারে খানিকটা জায়গায় সামিয়ানা খাটিয়ে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা, হেমন্তর নির্দেশ এবং তত্ত্বাবধানে সেখানে বিপুল রান্নার আয়োজন। এগজিবিশন হল দুটির পাশেই ফুলের বাগানের ধারে লাঞ্চ আর ডিনারের লোভনীয় স্প্রেড, সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যবস্থা। নদীটা থেকে খুশিঝোরার মূল কম্পাউণ্ড পর্যন্ত পুরো রাস্তাটায় নানা রঙীন ঝাণ্ডা আর বেলুনের সমারোহ। বান্দোয়ানে যে তিনটে মূল রাস্তা, মেদনীপুর-বাঁকুড়া অথবা বিহার বা ওড়িশা থেকে মানভূমের প্রবেশদ্বার যে রাস্তাগুলো, সেগুলো নানা রঙীন ব্যানারে সেজে পথিককে আদিবাসী জীবনের চিত্ররূপ দেখতে আহ্বান করছে, একই চিত্র গালুডি স্টেশনে। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন শুভেন্দুদা, তিনি ছিলেন দু দিন। ভূদেবদাও ছিলেন সঙ্গে, কিন্তু কী জানি কেন, শক্তিদা কিছুতেই আসতে রাজী হননি ! কতো মানুষ যে এলো আর গেলো পনেরো দিন ধরে ! এ কদিন অতিথি হিসেবে যারা এসেছে, থেকেছে, খাওয়াদাওয়া করেছে, তাদের কাছ থেকে থাকা বা খাওয়ার কোন মূল্য চাওয়া হয়নি, কিন্তু প্রায় সবাই নিজে থেকে ডোনেশন দিয়ে গেছেন যাওয়ার সময়। এবং অনেকের ক্ষেত্রেই সে ডোনেশনের মূল্যমান পাঁচতারা হোটেলের সাথে তুলনীয় ! কলকাতার সব পত্রপত্রিকায় – ইংরিজি বাংলা হিন্দী কোনটা বাদ যায়নি – দীর্ঘ আলোচনা বেরিয়েছে খুশিঝোরা আর জয়িকে নিয়ে। সব আলোচনাই যে শিল্পী হিসেবে জয়িকে নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত এমনটা নয়, কিন্তু মানুষ জয়মালিকা, দরদী জয়মালিকার নাম এখন কলকাতা এবং আশপাশের অঞ্চলে মুখে মুখে। এগজিবিশনের শেষ দিকে এক ভদ্রলোক এলেন যিনি আগে একটা কলেজে পড়াতেন, কিন্তু ইদানিং যারা এ দেশের সমাজসেবামূলক কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত অর্থসাহায্য কোরে থাকে, সেই রকম কোন একটা বিদেশী সংস্থার প্রধান। সাধারণত দিল্লীতে থাকেন, কলকাতায় কাজে এসেছিলেন, এখানে এসে বন্ধুবান্ধবের কাছে খুশিঝোরার কথা শুনে নিজের চোখে দেখতে এসেছেন। ভদ্রলোকের নাম অরুণ চৌধুরি।
এতখানি জমি কীভাবে একটা প্লটে পাওয়া গেলো, আর এতো অল্প সময়ে কীভাবে এরকম একটা সংস্থা তৈরি হয়ে গেলো, জয়ির কাছে সেই কাহিনী শুনলেন অরুণ চৌধুরি। এখনও সমস্ত সম্পত্তিটা জয়ির ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে ট্রাস্টকে ট্রান্সফার করার ব্যাপারটা হয়ে ওঠেনি শুনে ভদ্রলোক জয়ি অনলাভ আর সুকান্তকে কলকাতায় আসার পরামর্শ দিলেন। ওঁর বিশেষ একজন বন্ধু, যিনি এসব ব্যাপারে খুবই অভিজ্ঞ এবং নামজাদা লোক, তাঁর সাথে যোগাযোগ কোরে ক্যালকাটা ক্লাবে একেবারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়ে গেলো। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ওরা সবাই মিলে যাবে।
স্থানীয় লোকদের মধ্যেও খুব প্রভাব পড়লো এগজিবিশনটার। প্রথম কয়েকদিন এখানকার মানুষরা অবাক হয়ে এতো বাইরের লোকের আনাগোনা লক্ষ্য করেছে, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে সাহস করেনি। কিন্তু জলধর আর হেমন্ত সে সঙ্কোচ ভেঙে দিলো। কয়েকটা বাচ্চাকে ছবি দেখাতে নিয়ে এলো জলধর। তারা এতো ছবি এক জায়গায় দেখে অবাক। ধীরে ধীরে আসতে শুরু করলো তাদের বাড়ির লোকরা, বাবা-মা, ভাইবোন, সবাই। হেমন্তর উদ্যোগে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের একটা 'বসে আঁকো' প্রতিযোগিতাও হয়ে গেলো, এবং প্রতিযোগিতার ছবিগুলোর থেকে গোটা দশেক ছবি প্রদর্শনী কক্ষেও লাগিয়ে দেওয়া হলো। জয়ি বুঝলো শুভেন্দুদা কেন আদিবাসীদের মধ্যে এই ছবির প্রদর্শনী করতে বলেছিলেন।
কলকাতায় আসার জন্যে এমনিতেই আনচান করছিলো জয়ির প্রাণ। লোকের মুখে যা-ই শুনুক, খবরের কাগজে যা-ই পড়ুক, নিজে যতক্ষণ না কলকাতায় যেতে পারছে, পুরোনো বন্ধুবান্ধব কলেজ স্ট্রীট কফিহাউজ খালাসিটোলায় যতক্ষণ না পৌঁছোতে পারছে, এগজিবিশনের সত্যিকারের ইমপ্যাক্ট বোঝা যাবে না। অনলাভ আর সুকান্তদা রওনা দেওয়ার দুদিন আগেই পৌঁছিয়ে গেলো ও। সুদেশকে জানিয়ে আসেনি, এমনিতেই সুদেশের ওপর খানিকটা অভিমান হয়েছে ওর – এতো লোক এলো কলকাতা থেকে আর সুদেশ এলো না – গেস্ট হাউজে ঢুকে চানটান সেরে ব্রেকফাস্টের পর সুদেশকে ফোন করলো ও।
কোথা থেকে কথা বলছো, কলকাতায় এসেছো নাকি?
হ্যাঁ, কলকাতায়। অফিসে বুড়ি-ছোঁয়াটা হয়ে গেলেই ফোন করবো তোমায়। তারপর তুমি গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেলের নীচে দাঁড়াবে। গ্রেট ইস্টার্ণে চাইনিজ খাবো আমরা।
ও বাবা, ভয় করবে আমার। চাং-ওয়া জিমিজ কিচেন-টিচেন ছেড়ে আবার বড়ো হোটেলে কেন?
সেলিব্রেশন সেলিব্রেশনের মতোই হওয়া উচিত বলে। তোমার পদধূলি না পড়লেও এগজিবিশনটা মোটামুটি সাকসেসফুল।
সে তো জানি। তুমি তো এ ক'দিন সংবাদপত্রের শিরোনামে। এমনকি আকাশবাণীও বাদ পড়েনি।
আকাশবাণীটা নতুন খবর দিলে। তোমার মুখে রসগোল্লা পড়া উচিত। গ্রেট ইস্টার্ণ থেকে বেরিয়ে সোজা হেঁটে কে-সি দাশে যাবো। এখন ছাড়ছি, আমার ফোন পেলেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়বে।
গ্রেট ইস্টার্ণের নীচেই দাঁড়িয়েছিলো সুদেশ। জয়ির ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াতেই বললো, ট্যাক্সিটা ছেড়ো না, সোজা পার্ক স্ট্রীট-ফিটে কোথাও যাই, বড়ো হোটেলের ভেতর কিন্তু হারিয়ে যাবো।
একবার চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে জয়ি নেমে সোজা সুদেশের হাত ধরে বললো, চলো ভিতরে।
আসলে নিম্ন মধ্যবিত্তসুলভ আত্মসচেতনতা লজ্জা বা সঙ্কোচ জয়ির একেবারেই নেই, যা সুদেশের মধ্যে ভরপুর। সোজা ভিতরে গিয়ে রিসেপশনে জিজ্ঞেস করে জয়ি, আপনাদের চাইনিজ রেস্টোর্যান্টটা কোথায়?
নির্দেশ অনুযায়ী জয়ির পিছন পিছন বারওয়েল সাহেবের পদচিহ্ণ-অঙ্কিত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে সুদেশ।
টেবিলে বসেই সুদেশ ব্যাগ খুলে একতাড়া খবরের কাগজ বের করে, যা কিছু বেরিয়েছে এ ক'দিন তোমাকে নিয়ে, সে কলকাতার যে কাগজই হোক, আছে এখানে।
যত্ন করে সব সংগ্রহ কোরে রাখার জন্যে ধন্যবাদ, কিন্তু তুমি নিজে এলে না কেন একদিনের জন্যেও?
আমি কী তোমাকে বলেছিলুম, আসবো?
বলোনি, তার কারণ আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি; আমি জিজ্ঞেস করিনি তার কারণ আমি ভাবিইনি এটা হতে পারে। আমার এগজিবিশন আর তুমি নেই?
তুমি তো জানোই জয়ি আমি এইসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে কেমন অস্বস্তি বোধ করি। আগের দুটোয় ছিলুম কারণ সেখানে আমার থাকাটা জরুরি ছিলো। এখানে তোমার ছবিগুলো আমি পাঠিয়ে দিয়েছি, তারপর তো আর আমাকে দরকার নেই।
আমার এখন মাঝে মাঝে ভয় হয় তোমার এই শিল্পীদের সান্নিধ্যের ভয়টা এমন জায়গায় পৌঁছিয়ে যাচ্ছে যে এর পর আমার সান্নিধ্যেও তোমার ভয় হবে।
সে তো এখনই হয়, হেসে বলে সুদেশ, অর্ডারটা দাও। আমি সী-ফুড স্যুপ খাবো।
খেতে খেতে জয়ি ওর এ ক'দিনের পুরো প্ল্যানটা বলে। আজ সন্ধ্যেবেলা আমি খালাসিটোলায় যাবো, তোমার থাকার দরকার নেই, মাতাল হবো না। একাই গেস্ট হাউজে ফিরতে পারবো। কাল আর পরশুদিন তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে না। কাল আমি সব পুরোনো ঠেক ঘুরবো, ইনক্লুডিং দুটো কফি হাউজ। আর পরশু সারাটা দিন জেঠুর বাড়িতে। অনেকদিন ওঁদের সাথে দেখা হয়নি, কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে এটা অন্যায় হচ্ছে। আমি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি, পরশু একেবারে সকালে ওঁদের বাড়ি যাবো, ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার পর্যন্ত ওঁদের সাথে থেকে, খেয়ে, সারাদিন কাটিয়ে, একেবারে রাত্তিরে ফিরবো। আজ খাওয়া হয়ে গেলে এখান থেকে বেরিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো সোজা গড়িয়াহাট। ঢাকেশ্বরী থেকে একটা শাড়ি কিনবো জ্যাঠাইমার জন্যে, তুমি পছন্দ করে দেবে।
তার পরের দিন দুপুর একটার সময় ক্যালকাটা ক্লাবে লাঞ্চ। অনলাভদা আর জুঁইদির হাসব্যাণ্ড সুকান্তদাও থাকবেন। একজন লয়্যারের সাথে মীটিং। খুশিঝোরার প্রোপার্টিটা আমার নাম থেকে একটা ট্রাস্টে ট্রান্সফার করা হবে। মীটিংটা সেই ব্যাপারে। সেই মীটিঙের পর তোমাকে ফোন করবো। পরের প্ল্যান পরে।
বেশ লাগলো ভালোবাসার বেড়ে ওঠা