স্টীল প্লান্টের গেস্ট হাউজে বসেই জয়ির ছবিগুaলো দেখছিলো ওরা। নিলীন বললো, আমার লেখার সাথে ইলাস্ট্রেশন হিসেবে আপনার কয়েকখানা ছবি দেওয়া হলে বaইটার ভ্যালু বেড়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু আপনার ওপর খানিকটা অন্যায় হবে মনে হচ্ছে। যত ছবি আপনি এঁকেছেন, এ তো পুরোপুরি একটা পিকচার-এসে। আমার মনে হয় আপনার ছবি দিয়েই একটা পুরো বই হতে পারে, মূল্যবান বই, আর তার সাথে এক-আধটা বাচিক মন্তব্য। এ ধরণের বইয়ের রেওয়াজ আমাদের দেশে খুব একটা নেই, কিন্তু বিদেশে বিস্তর আছে। স্বাভাবিক ভাবেই ছাপার খরচ একটু বেশি, আর্ট পেপারে ছাপতে হবে, প্রিন্টিং কোয়ালিটি খুব উঁচু মাপের হওয়া চাই।
জয়ি বললো, যা এ দেশে হতে পারে তা-ই হোক আপাতত।
কয়েকদিন থেকে গেলো ওরা স্টীল প্লান্টের এই শহরে। সুদেশের একান্ত ইচ্ছেয় প্লান্টের একজন সীনিয়র মেটালার্জিস্টের সাথে কথা বলে প্লান্টটা ওদের ভালো কোরে দেখাবার ব্যবস্থা করে দিলো জয়ি, আশপাশের পাহাড়-জঙ্গলেও ঘোরাঘুরি হলো খানিকটা। সুদেশেরই বিশেষ আগ্রহে একদিন জয়ির কোয়ার্টারে গিয়ে ওর মায়ের সাথেও দেখা করে এলো সুদেশ, যদিও কথাবার্তা হলোই না প্রায়। জয়ির ছোট ভাইবোনরা, যারা জয়ির আগ্রহে এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, স্কুলেই ছিলো তারা, কাজেই তাদের সাথেও দেখা হলো না সুদেশের।
মেদনীপুরে যেবার নিলীনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো ওরা দল বেঁধে, নিলীনকে বলেছিলো পুরুলিয়ার জমিটার কথা। এ বার নিলীন খোঁজ নিচ্ছিলো জমিটার কী হলো। জমিটা কেনার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, শাম্বর দলবলই কিনবে ওটা, শুনে নিলীন বলে, ফেরার সময় ট্রেনে না গিয়ে যদি পুরুলিয়ার ঐ জায়গাটা ঘুরে যাওয়া যায়, কেমন হয়?
মন্দ নয়, গেলে তো ভালোই লাগবে, তবে আপনারা সোজা চলে যাবেন ওখান থেকে, আমি কী করবো তারপর?
আপনি না হয় থেকেই যাবেন দুদিন বাবার কাছে, তারপর ফিরে আসবেন।
দেখা গেলো সুদেশেরও আগ্রহ পুরুলিয়ায় যাওয়ার।
বাবাকে কিছু জানানো হয়নি, ভর দুপুরে পৌঁছিয়ে খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে জানা নেই। মানবাজারে দুপুরের খাওয়া সেরে যখন আবার গাড়িতে উঠলো ওরা, নিলীন বললো, যাওয়ার পথে বান্দোয়ান পড়বে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, পড়বে তো, বলে ড্রাইভার। বান্দোয়ান হয়েই তো যাবো আমরা।
বান্দোয়ানে নামবেন নাকি একবার, ওখানে আমার পরিচিত একটি ছেলে আছে, সাঁওতালি আর বাংলা মিলিয়ে একটা দ্বিভাষিক পত্রিকা চালায়, গেলে ভালো লাগবে আপনাদের।
এই বান্দোয়ান, বলে গাড়িটা যেখানে থামালো ড্রাইভার, সেখানে জনবসতি বিরল। একটা ছোট পাহাড়ের ঠিক নীচে, যেখানটা পাহাড়টা হঠাৎ যেন মিলিয়ে সমতল ভূমির সাথে মিশে গেছে, জায়গাটা এরকম। পেছনে ফিরে তাকালে শাল জঙ্গলটা মনে হয় গভীর থেকে গভীরতর হতে হতে ওপরের দিকে সোজা উঠেছে, নীচের জমিটা লাল, শেষ পর্যন্ত হয়তো স্বর্গ পর্যন্তই পৌঁছিয়ে যাবে, না হলে হতে পারে এত সুন্দর !
নিলীন বললো, আমি একবারই এসেছি আগে, কিন্তু যেখানে এসেছিলাম সে জায়গাটা তো এত সুন্দর ছিলো না, খানিকটা বাজার-বাজার দেখতে ছিলো !
ড্রাইভার বললো, হ্যাঁ বাজারটা একটু এগোলেই পেয়ে যাবো, বেশ বড়ো বাজার।
ব্লক শহর বান্দোয়ান, কিন্তু আর পাঁচটা ব্লক শহরের তুলনায় একটু বেশি বড়ো বলেই মনে হয়। এই ভরদুপুরেও রাস্তায় যথেষ্ট লোকজন। রাস্তার দুধারে দোকান, তাতে নানারকমের পশরা। ওদের গাড়িটা যেখানে এসে দাঁড়ালো, সেটা চারটে রাস্তার সংযোগস্থল, তার মধ্যে একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি লরি। ড্রাইভার বললো, এখান থেকে একটু এগিয়ে গেলেই বিহারের সীমানা, কাজেই বাংলা-বিহার, দু রাজ্যের ব্যাপারীদের ভিড় লেগেই থাকে এখানে। তাছাড়া, বিহারে ট্যাক্স কম, কাজেই এ রাজ্যের লরিওয়ালারা বান্দোয়ানে ঢোকার ঠিক মুখেই বিহারের যে পেট্রোল-পাম্পটা আছে, সেখান থেকে তাদের ট্যাঙ্ক ভর্তি করে নেয়, আর বিহার থেকে যারা আসে তারাও ট্যাঙ্ক ভর্তি করেই ঢোকে এখানে, তাই এতো লরির ভিড়। তা ছাড়া ঝাড়খণ্ড মুক্তি আন্দোলনের জঙ্গী কর্মীরাও সহজেই এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পালিয়ে যেতে পারে বান্দোয়ানের মধ্যে দিয়ে, পুলিশ এখানে তাই জঙ্গীদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত, তার ফলে অন্যরকমের অসামাজিক কাজ করে যারা, তারা খানিকটা নিশ্চিন্ত বান্দোয়ানে।
একটা মিষ্টির দোকানে একটু জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে অলগুরু প্রিন্টিং ওয়র্কস পাওয়া গেলো। নিলীন বললো, আসুন, এখানেই আমার বন্ধুকে পাওয়া যাবে।
ছোট একটা পায়ে চালানো মেশিনে কাজ করছে বয়স্ক একজন লোক, তার পাশেই টুলে বসে একজন কম্পোজিটার আপন মনে একটা একটা অক্ষর তুলে তুলে কম্পোজ করছে কিছু একটা, তার পেছনেই একটা টেবিল, চেয়ার, এবং অতিথিদের বসবার জন্যে ছোট একটা বেঞ্চ। সব কটাই খালি। নিলীন জিজ্ঞেস করলো কম্পোজিটারকে, জলধর নেই?
আছে। একটু বাইরে গেলো, বসুন, এখনই এসে পড়বে।
অন্ধকার প্রায়, ঘুপচি, আলোহাওয়া-প্রায়-আসে-না, এইরকম ঘরটায় ছাপার মেশিনের ঘট-ঘটাং শব্দের মধ্যে বেশিক্ষণ বসতে হলো না ওদের, একটু পরেই জলধর মুর্মু হাজির। হঠাৎ নিলীনকে এখানে সে যে একেবারেই আশা করেনি তা তার কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেলো। জয়মালিকা আর সুদেশের সাথে নিলীন পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরে, যে মিষ্টির দোকান তার প্রেসটা চিনিয়ে দিয়েছিলো, সেখানে প্রায় জোর করেই ওদের নিয়ে এলো জলধর: শক্তিগড়ের সাথে পাল্লা দিতে পারে এরকম ল্যাংচা খেয়ে যান আমাদের জঙ্গলের দেশে !
সাঁওতালদের ভাষা যে কতো প্রাচীন তা নিয়ে তর্ক আছে ভাষাবিদদের মধ্যে। অন্তত বাংলার তুলনায় যে এ ভাষা অর্বাচীন নয়, তা তো প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু এতো সমৃদ্ধ এবং এতো প্রাচীন ভাষার নিজস্ব কোন লিপি নেই। সংস্কৃতের কন্যা নয়, অতএব উত্তরভারতীয় ভাষাগুলোর মতো দেবনাগরী-সম্ভূত লিপি গড়ে ওঠেনি সাঁওতালি ভাষার জন্যে। লিপিহীন এই কথ্য ভাষা তাই হোঁচট খেতে খেতেই চলতে বাধ্য হচ্ছে ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে। এই অবস্থার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালাচ্ছেন ভাষাবিদ এক শিক্ষিত লড়াকু সাঁওতাল, তাঁর নাম রঘুনাথ মুর্মু। শুধু লিপি তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, ছাপাখানার কাজ শিখে, একটা একটা করে তৈরি করেছেন সাঁওতালি অক্ষর – জন্ম নিয়েছে অলচিকি লিপিমালা। তাঁর একনিষ্ঠ শিষ্যদের মধ্যে জলধর একজন, সে সাঁওতালি এবং বাংলা, দুটি ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ, দুটি ভাষাতেই কবিতা লেখে। রঘুনাথ নামে একটি মাসিক পত্রিকা চালায় সে, পত্রিকাটি দ্বিভাষিক – সাঁওতালি আর বাংলা – সে-ই সম্পাদক এবং প্রকাশক। এই পত্রিকায় মাঝে মাঝে লেখে নিলীন এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহকর্মী কয়েকজন। নিলীন সাঁওতালি ভালোই জানে, কিন্তু অলচিকি যেহেতু জানে না, অতএব জলধরের অনুরোধ সত্ত্বেও সাঁওতালিতে লেখেনি এখনো পর্যন্ত। জয়মালিকার সম্বন্ধে শোনার পর তাকে বলে জলধর, আপনার ছবি দিন না আমাদের পত্রিকায়, এটা তো আরেকটা ভাষা, আমাদের পত্রিকার তাহলে দ্বিভাষিক থেকে ত্রিভাষিকে উত্তরণ হবে !
লাক্ষার কারখানাটা চেনে জলধর, বান্দোয়ান থেকে ট্রেন ধরতে হলে যে স্টেশনে যেতে হয় তার নাম গালুডি, গালুডি যাওয়ার পথে অনেকবারই সে লক্ষ্য করেছে কারখানার চৌহদ্দিটা। এই কারখানার জমিটা শাম্বর দলবল কিনবে খবরটা পেয়ে অবাক হলো সে। শাম্বর নাম সে জানে, বললো জামশেদপুরের এক বইমেলায় সে শাম্বর একটা সংখ্যা দেখেওছিলো, কিন্তু এতটা জমি দিয়ে কী করবে শাম্ব ! জয়ি বললো, আমরা যারা শাম্বর সভ্য, সবাই মিলে একটা ট্রাস্ট তৈরি করবো শাম্বর নামে, সেখানে শাম্বগ্রাম তৈরি করা হবে, আর সেই গ্রামের এক একটা কুটিরে এক একজন সভ্য থাকবে !
শুনতে খুব রোম্যান্টিক লাগছে ঠিকই, বললো জলধর, কিন্তু ঐ চল্লিশ-পঞ্চাশ বিঘে জমিতে কী আর গ্রাম হয়?
একটা গ্রামীণ হাউজিং কমপ্লেক্স হতে পারে বড়ো জোর, বললো নিলীন, তা-ও তার ম্যানেজমেন্ট সহজ হবে না।
প্রায় চুপ করেই ছিলো সুদেশ এতক্ষণ, এবার বলে উঠলো, তুমি যেটা বললে জয়ি, সেটা আড্ডার টপিক হিসেবে মন্দ নয়, কিন্তু সত্যিই কী এরকম প্ল্যান তোমাদের? আমি স্পয়েলস্পোর্ট হতে চাইনা, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে এই প্ল্যান তোমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব ভেঙে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট !
জলধরের সাথে যোগাযোগ থাকবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন আবার রওনা দিলো ওরা ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমের দিকে অনেকটাই।
যে রাস্তা দিয়ে চলছে ওদের গাড়ি সেটা নাকি স্টেট হাইওয়ে, কতদিন আগে এই রাস্তায় পিচ পড়েছিলো বোঝা যায় না; মাঝে মাঝে খোয়া উঠে গেছে, কোথাও কোথাও বিরাট গর্ত, আলোর তো প্রশ্নই নেই ! কিন্তু তবুও রাস্তার দুদিকের অসবুজ রুক্ষতা, মাঝে মাঝে এক একটা জলাশয়, ছোট ছোট পাহাড় যেগুলো রুক্ষ থেকে সবুজ, আরো সবুজ, সবুজতর হতে হতে ওপরে উঠে যায়, আর সব কিছুর ওপর লালচে হয়ে আসা সূর্যর মায়াময় রং, ওদের নেশাগ্রস্ত বাক্যহারা কোরে রাখে।
হেমন্ত বললো, কিছু না জানিয়ে এভাবে চলে এলি !
তোমাকে অসুবিধেয় ফেললাম, বাবা !
নাঃ অসুবিধে নয়, তোদের খাওয়া-দাওয়াটা ভালো হবে না।
তবুও, মন্দ হলোনা খাওয়া। হেমন্ত গোরু কিনেছে দুটো, দুটোই দুধ দিচ্ছে এখন। ডাংলাজোড়ার যে মেয়েটা গোরুর দেখাশোনা করে, সে দুধ দোয়া হয়ে গেলে রঘুনাথকে সঙ্গে কোরে নিয়ে গিয়ে তাদের গ্রাম থেকে আলু আর ডিম কিনে পাঠিয়ে দিলো, রাত্তিরে খিচুড়ি, ডিম ভাজা আর খাঁটি দুধের পায়েস ! অফিস ঘরগুলো খালিই থাকে আজকাল। টেবিলগুলো জড়ো করে সুদেশ আর নিলীনের বিছানা হয়ে গেলো, ড্রাইভার শুলো রঘুনাথের সাথে, জয়ি আগের বারের মতোই। ভোরবেলা গাড়িটা নিলীন আর সুদেশকে গালুডি স্টেশনে পৌঁছিয়ে দিয়ে ফিরে গেলো সেখান থেকেই।
জয়ি থেকে গেলো তিন দিন।
দারুণ