মার্কেট স্কোয়ারে খানিকটা জায়গা ঘিরে ছবি সাজানো হচ্ছে। জয়ি চিনতো না জায়গাটা, শুনেছিলো একটা এগজিবিশনের কথা। শক্তিদা বলেছিলেন বেঙ্গল লেদারের অফিসের কাছেই। সুদেশকে জিজ্ঞেস করে জয়ি, মার্কেট স্কোয়ার চেনেন?
হ্যাঁ, পাশেই তো।
আমাকে নিয়ে যাবেন?
হঠাৎ মার্কেট স্কোয়ারে কেন?
ওপেন এয়ার এগজিবিশন হচ্ছে, আর্ট ফেয়ার। আমার একটা ছবি দেওয়া যায় কিনা দেখবো।
গিয়ে দেখলো মুখচেনা অনেকেই আছে, কফি হাউজ-টাউজে দেখেছে, কিন্তু ঠিক আলাপ নেই। ছবি সাজানো শুরু হয়ে গেছে, শিল্পী যাঁরা, নিজেরাই ঘোরাঘুরি করছেন, যথেষ্ট উচ্চগ্রামে কথাবার্তা হচ্ছে, কিন্তু সুদেশ বা জয়িকে প্রায় লক্ষ্যই করলো না কেউ।
গেরুয়া পাঞ্জাবি-ধুতি পরা দুঃখী মুখের এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন একটা কোনায়। মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে কথা বলছিলো তাঁর সাথে, চলে যাচ্ছিলো আবার, ভদ্রলোক দাঁড়িয়েই ছিলেন সেই একই জায়গায়। কোন জটলায় নেই এ ভদ্রলোক, কেমন যেন দূরে দাঁড়িয়ে আছেন বলে মনে হয় ওই পার্কের মধ্যে থেকেও। অথচ বোঝা যাচ্ছিলো সবাই চেনে ওঁকে। জয়ি সুদেশকে বললো, তুমি দাঁড়াও সুদেশদা এখানেই, আমি একটু আসছি।
ভদ্রলোকের কাছে জয়ি গিয়ে বললো, আমার নাম জয়মালিকা।
বাঃ, বেশ নাম তো, মৃদু, অতি মৃদু হেসে বললেন ভদ্রলোক। জয়ির মনে হলো এত মৃদু প্রশংসাতেও ভদ্রতার সাথে মিশে আছে একটুখানি আন্তরিক মুগ্ধতা। জয়ি কথা বললো আবার, আমিও ছবি আঁকি।
ছবি আঁকো? আর্ট কলেজে পড়ো বুঝি?
না, আমি চাকরি করি।
চাকরি করো? তুমি তো ছেলেমানুষ, কোথায় করো চাকরি?
কোথায় চাকরি করে শুনে ভদ্রলোক বললেন, আমার তো হিংসে হচ্ছে তোমাকে। প্রায় তোমারই মতো বয়েসে আমিও চাকরি করবো ঠিক করেছিলাম, খুঁজেও ছিলাম চাকরি, কাকারা করতে দিলো না, আর্ট কলেজে ভর্তি কোরে দিলো।
আপনি আর্টিস্ট, আপনার ছবি আছে এখানে?
হ্যাঁ আছে তো, বেশ কয়েকটা আছে।
আমি একটা ছবি এনেছি, এখানে রাখা যাবে?
ছবি এনেছো? আচ্ছা দাঁড়াও, দেখি কী করা যায়।
একটু মোটাসোটা, জয়ির চেয়ে খানিকটা বড়োই হবে, একটা ছেলে খুব ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছিলো, তাকে ডাকলেন ভদ্রলোক। যেমন আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন জয়ির সাথে, প্রায় সেভাবেই বললেন তাকে, এই মেয়েটি, এর নাম জয়মালিকা। একটা ছবি এনেছে, একটাই। সেটা এগজিবিট করা যাবে?
ছেলেটা বললো, খুব দেরিতে এসেছে, আমি দেখছি।
প্রায় দৌড়িয়ে ছেলেটা গেলো যেখানে, সেখানে একটা জটলার মতো, আট-দশজন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। হাত-পা নাড়িয়ে কিছু বললো সে জটলাটার উদ্দেশে, তারপর ঐ জটলার থেকেই একমুখ দাড়ি এক জনকে নিয়ে আবার চলে এলো যেখানে জয়ি দাঁড়িয়ে আছে এই ভদ্রলোকের সাথে।
ছবিটা দেখি, দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বললেন।
ঝোলার থেকে দুটো শক্ত বোর্ডের মাঝে রাখা ছবিটা বের করে ভদ্রলোকের হাতে দিলো জয়ি। জয়ি ছাড়া বাকি তিনজনই এখন আগ্রহের সঙ্গে দেখলো ছবিটা। মোটাসোটা ছেলেটার মুখ থেকে প্রায় স্বতঃস্ফুর্ত বেরিয়ে এলো, দারুণ এঁকেছে, গণেশদা।
বোঝা গেলো, জয়ি যাঁকে প্রথম বলেছিলো তিনি গণেশদা। গণেশদা মৃদু স্বরেই বললেন, হ্যাঁ, বেশ ভালো। দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বললেন, কিন্তু সাধারণ কাগজে এঁকেছেন, ফ্রেম করেননি, রাখবেন কী ভাবে?
জয়ি এসব কথা ভাবেনি। ছবি একটা এনেছে, এগজিবিশনে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে, কিন্তু কী ভাবে ছবি এগজিবিট করতে হয়, সে ব্যাপারে ধারণা নেই কিছুই। এ যেন স্কুলে বা পুজোর প্যাণ্ডেলে ছেলেমেয়েদের ছবির প্রদর্শনী ! আলপিন দিয়ে কাপড়ে সেঁটে দিলেই হলো !
দূর থেকে এতক্ষণ চুপ করে দেখছিলো সুদেশ। এবার কাছে এগিয়ে এসে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে বললো সোজাসুজি, কালকের মধ্যে যদি ফ্রেম করিয়ে নিয়ে আসি, তাহলে হবে?
কাল নয়, আজই চাই। আজ সন্ধ্যেবেলা ইনগারেশন। কিন্তু আজ সন্ধ্যের মধ্যে কী সম্ভব?
দেখি, চেষ্টা করবো।
ভূদেবদার সূত্রে অনেককেই চেনে সুদেশ। রাস্তায় বেরিয়ে জয়িকে জিজ্ঞেস করলো কী করবে সে। জয়ি তো এখন অফিসের কাজে কলকাতায়, তার পক্ষে কী সারাদিন অফিসের বাইরে থাকা সম্ভব?
জয়ির অফিস ডালহৌসি স্কোয়ারে। একটা ট্যাক্সিতে সে জয়িকে পৌঁছিয়ে দিলো তার অফিসে। বললো, কালিঘাটে এক ছবি বাঁধিয়েকে চেনে সে, কলকাতার শিল্পীরা অনেকেই তাকে দিয়ে কাজ করায়, ভূদেবদাও। সে সোজা সেখানেই যাবে। যদি না-ও করাতে পারে তবুও সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সে পৌঁছোবে মার্কেট স্কোয়ারে। জয়ি যেন সেখানেই সোজা চলে আসে অফিস থেকে। জি-পি-ও থেকে ভূদেবদার সাথে টেলিফোনে কথা বলে সোজা কালিঘাটে গেলো সে। অনেক চেষ্টা করেও ফ্রেমিংটা হলো না শেষ পর্যন্ত। ভদ্রলোক বললেন তিনি রাত্তিরে কাজটা শেষ করবেন ছবিটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে। কাছেই তাঁর বাড়ি, ঠিকানাটা দিয়ে দিলেন, পরের দিন সকাল আটটার মধ্যে তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি দিয়ে দেবেন ছবিটা।
কালিঘাট থেকে নিজের অফিস হয়ে যখন মার্কেট স্কোয়ারে পৌঁছোলো সুদেশ, জয়ি তখন ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। খালি হাতে সুদেশকে দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো তার। তবুও, সুদেশেরই আগ্রহে আর একবার দেখা করা হলো গণেশদার সাথে। কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনকে ডেকে বললেন গণেশদা, আমার ছবিগুলো আর একটু ঘেঁসাঘেঁসি করে দিচ্ছি, ওখানে কাল সকালে জয়মালিকার ছবিটা ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে, একটাই তো !
খবরের কাগজের লোকরা এসেছিলো ইনগারেশনে। অনেক ফটো তোলা হলো এগজিবিশনের। ছবিই নেই, তো জয়ির ছবির ফটো উঠবে কী করে ! ছবির ফটো নয়, কিন্তু খুব জনপ্রিয় একটা কাগজে পরের দিন বিশেষ কলকাতা ক্রোড়পত্রে প্রায়-চোখে-জল জয়মালিকারও ফটো দেখা গেলো গণেশ পাইনের পাশে।
কলকাতার অফিসে জয়ির কাজটা কাজই নয় প্রায়। ওদের স্টীল প্লান্ট এ বছর স্টীল উৎপাদন করেছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এ খবরটা জনসাধারণকে জানাতে হবে, ফলত বেশি প্রচারিত খবরের কাগজগুলোয় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। প্লান্টের পি-আর-ও উপাধ্যায় সাহেব জয়িকে পাঠিয়েছেন এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে রিজিওনাল অফিসের সাথে যোগাযোগের জন্যে। পদ্ধতিটা মোটামুটি এ রকম: দিল্লীর অনুমোদিত নির্দিষ্ট কতকগুলো এজেন্সী আছে যারা ওদের কাজ করে। এজেন্সীগুলোকে ডাকা হবে, এবং বিজ্ঞাপনের উপলক্ষ্য আর লক্ষ্য দুটোই বলা হবে এজেন্সীর প্রতিনিধিদের। এর পর তারা তাদের বিজ্ঞাপনের আর্টওয়র্ক নিয়ে দেখাবে, বোঝাবে তাদের বিশেষ আর্টওয়র্কই কেন বিজ্ঞাপনের লক্ষ্যপূরণে সবচেয়ে যোগ্য। রিজিওনাল অফিস এর থেকে গোটা চারেক প্রাথমিকভাবে বেছে নেবে। তারপর সেগুলো নিয়ে জয়ি ফিরবে প্লান্টে। উপাধ্যায় সাহেব তার মধ্যে থেকে দুটো পছন্দ করবেন। এবার সেই দুটোর মধ্যে যেটা শেষ পর্যন্ত দিল্লীর অনুমোদন পাবে সেটাই খবরের কাগজ বা পত্রপত্রিকায় ছাপা হবে। এই দীর্ঘ প্রণালীতে জয়ির কাজ কী? এজেন্সীগুলোর সঙ্গে যখন মীটিং হয় তখন সেই মীটিঙে বসে থাকা, আর – কলকাতা অফিসেরই এক বয়স্ক শুভাকাঙ্ক্ষী প্রথম দিনেই ওকে বলে দিয়েছেন – যতদূর সম্ভব নির্বাক থাকা। ব্যস, আর কাজ নেই জয়ির, এর পর যত ইচ্ছে কলকাতার পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াও, আড্ডা মারো বা বাজার করো, কেউ দেখতে যাচ্ছে না। রাতে গেস্ট হাউজে থাকে জয়ি, ক্যামাক স্ট্রীটে, সে-ও খুব আরামের, এয়ার কণ্ডিশন করা ঘর। জয়ির অবিশ্যি এতটা আরাম পাওয়ার কথা নয়, ও যদি পুরুষ হতো মেয়ে না হয়ে, তাহলে ওকে ডরমিটরিতে থাকতে হতো আরো দুজনের সাথে ভাগ করে, কিন্তু মেয়ে যেহেতু, আর যেহেতু ওদের মহিলা ডরমিটরি নেই, তাই একাই একটা ঘর জয়ির।
মার্কেট স্কোয়ারের এগজিবিশিনের পর পরিচয়ের পরিধি বেড়ে গেছে জয়ির; শিল্পীমহলে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের যারা তাদের মধ্যে, ও এখন অজানা নয়। বিশেষ কোরে এগজিবিশনে ওর ওই একমাত্র, সাধারণ কাগজে আঁকা ছবিটা, বিক্রী হওয়ার ফলে। পঁয়ত্রিশ টাকায় বিক্রী হয়েছে ওর ছবি ! গণেশদার আটখানা ছবির মধ্যে সাতখানা বিক্রী হয়েছে। একশো টাকায় এক-একটা, সেখানে ওর একটা ছবি, সেটাই বিক্রী, ভাবা যায় !
জায়গাটার কথা ভাসা ভাসাই বলেছিলেন গণেশদা, কম কথা বলেন; খোঁজ কোরে কোরে জয়ি পৌঁছিয়ে গেলো একদিন জি-সি-লাহার দোকানের উল্টোদিকে ন্যূয়র্ক সোডা ফাউন্টেন রেস্টোর্যান্টে। এখানে ওখানে নানা টেবিলে ছড়িয়ে বসে আছে অনেক চেনা মুখ। দাড়িওয়ালা যে ভদ্রলোক এগজিবিশনে ওর ছবিটাকে বাঁধিয়ে আনতে বলেছিলেন দেখা গেলো তিনি বসে আছেন গণেশদার সাথে। জয়ির অভ্যেস আছে বিনা আহ্বানে বসার, কফি হাউজে এরকম বসেছে বিস্তর, বসে গেলো।
তোমার অফিস নেই? – জিজ্ঞেস করেন গণেশদা।
অফিস তো কোরে এলাম – নিজের অফিসের কাজের ধরণটা বিশদ কোরে বুঝিয়ে দেয় জয়ি। শুনে হেসে ফেলেন গণেশদা, বাঃ বেশ তো মজার অফিস, তাহলে কলকাতায় এলে তো মজাই তোমার। সময় কাটাও কী কোরে?
যখন চাকরি করতাম না তখন মাঝে মাঝে স্টাডিতে বেরোতাম কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়।
এখনও তো বেরোতে পারো, অফিসে যখন কোন কাজই নেই।
সেই ভেবেই তো চলে এলাম গণেশদা, আপনাদের সাথে ভালভাবে আলাপ করার জন্যে, আপনাদের কাজ দেখেও তো শেখা যায়।
দেখে কাজ শিখবে বলে চলে এলে সোডা ফাউন্টেনে? এখানে কী কাজ করে কেউ? এটা নিছক আড্ডা মারার জায়গা, তা ছাড়া সেন্ট্রাল লোকেশন, যাতায়াতের পথে একটু ঢুঁ মেরে গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়ে যায়, সেটাই ! তোমার হাত ভালো, সময়ও আছে হাতে, অযথা সময় নষ্ট করবে কেন? তারপর একটু হেসে বললেন, তোমাকে ধমকাচ্ছি মনে করছো নাকি? মন খারাপ হয়ে গেলো?
জয়ি বললো, মন খারাপ হবে কেন, আপনি তো ঠিকই বলছেন।
তোমার এগজিবিশনের ছবিটা কিন্তু ভালো হয়েছিলো খুবই, ড্রয়িং হিসেবে খুবই ভালো, গণেশদা বললেন, খুব কম লাইনে ভালো ডেপ্থ্ এনেছিলে, অনেকেরই চোখে পড়েছে ছবিটা, তাই তোমাকে এতগুলো কথা বললাম।
আমি ভালো আঁকতে পারিনা গণেশদা, শুধু কম লাইনে লং শট মোটামুটি হয়। বিকাশদা খুব বকেছেন আমায়, বলেছেন চোখ তৈরি করতে হবে, ভালো ভাবে দেখতে শিখতে হবে।
বিকাশের সাথে আলাপ আছে নাকি তোমার?
হ্যাঁ, বিকাশদা আর কিসমতদির সাথে স্টাডি করতে বেরিয়েছি তো আগে, তাই ভাবছিলাম আপনাকে কাজ করতে দেখবো একটু।
আমাকে কাজ করতে দেখবে? আমি কী কাজ করি সারাদিন জানো? অ্যানিমেশনের কাজ, ফাইন আর্ট কিছু নয়। মন্দার মল্লিকের স্টুডিয়োয়। সেখানে বসে থাকতে দেবে না তোমায়।
একেবারে হঠাৎই তারপর গণেশদা বলে ওঠেন, কলকাতায় যখন আসো, থাকো কোথায়?
জয়ি বললো, কম্পানির গেস্ট হাউজ আছে, ক্যামাক স্ট্রীটে, সেখানে। খুব আরামে থাকি, এয়ার কণ্ডিশন করা ঘর।
আর খাওয়াদাওয়া?
ওখানেই। সকালে ব্রেকফাস্ট কোরে বেরিয়ে আসি, আবার রাতের খাওয়াও ওখানেই। দুপুরে অফিসে থাকলে ক্যান্টিনে, আর তা না হলে যেখানে-সেখানে।
চলো, তোমাকে কচুরি খাইয়ে নিয়ে আসি।
সোডা ফাউন্টেন থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটলেই কে-সি-দাশের মিষ্টির দোকান। মিষ্টির দোকান কলকাতায় এসেই প্রথম দেখেছে জয়ি, কিন্তু এত বড়ো দেখেনি আগে। রীতিমতো বসার ব্যবস্থা আছে, প্রায় রেস্টোর্যান্টের মতো। দোকানের লোকরা দেখা গেলো গণেশদাকে চেনে, দুজনের জন্যে কচুরির অর্ডার দিলেন গণেশদা। কচুরির পর সন্দেশ, বললেন, এটা তোমার অনারে। তোমরা যেখানে থাকো, মনে হয় না সেখানে এরকম সন্দেশ পাওয়া যায়।
এরকম কেন, কোনরকম সন্দেশই পাওয়া যায় না সেখানে। এখানে এসে তো প্রথম দৈ-ও খেলাম, বাড়ির জন্যে নিয়ে গেছিলাম, খেয়ে সবাই অবাক।
তোমাদের ওখানে কী পাওয়া যায় তাহলে ভালো?
মুরগি, সস্তায় মুরগি পাওয়া যায়। কিন্তু সত্যি সত্যি ভালো পাওয়া যায় কী, জানেন? পাহাড়-ঝর্ণা-নদী, আর শালের জঙ্গল। আর পাওয়া যায় মহুয়া, আর, আর...আমার একটা দাদু আছে, তার ভাষায় অন্ধকারের মতো কালো সত্যবতীর মেয়েরা, যাদের গায়ে হাজার বছরের মুনি ঋষি দেবতার রক্ত, জাত নেই যাদের, আর এত মুনি ঋষি দেবতাও যাদের গায়ের রং বদলাতে পারেনি ! যাবেন গণেশদা?
চুপ করে শোনেন গণেশদা, তারপর, দীর্ঘ নয়, কিন্তু সশব্দ একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমার জগৎ এখন কতটুকু জানো? উত্তরে শ্রীমানি বাজার, দক্ষিণে বৌবাজার-ওয়েলিংটন, আর তারপর পশ্চিমে হেঁটে সোডা ফাউন্টেন-কে-সি
দাশ ! আমি আর কোথাও যাই না।
কথা বলতে বলতে প্রায় জয়মালিকারই বয়েসি দু জন ছেলে এসে ঢোকে, গণেশদাকে দেখে ওদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। গণেশদা আলাপ করিয়ে দেন, এরা আর্ট কলেজের ছেলে, আর এ জয়মালিকা।
জয়মালিকা? এ-ই? – বলে ওঠে দুজনের মধ্যে একজন। মার্কেট স্কোয়ারে ওর ছবিই বিক্রি হয়েছে না পঁয়ত্রিশ টাকায়? ব্লাস্ট ফার্নেস?
এই দেখো জয়মালিকা, কলকাতায় তুমি বিখ্যাত হয়ে গেছো একটা ছবিতেই। তোমরা গল্প করো, আমি আজ যাবো।
দোকানের একটা ছেলেকে ডেকে কচুরি-সন্দেশের দাম দিয়ে হঠাৎই উঠে পড়েন গণেশদা, জয়ি একটু অবাক হয়ে যায়। গণেশদার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে জয়ি, গণেশদা কী ওকে কৌশলে সোডা ফাউন্টেন থেকে বের করে দিয়ে গেলেন !
যে টেবিলে বসে আছে জয়ি, গণেশদা চলে গেলে ছেলে দুজন বসে পড়ে সেখানেই। আলাপ বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে না বেশি। জয়ি কখনো আর্ট কলেজে যায়নি শুনে অবাক হয়ে যায় ওরা; স্কুলের পড়া শেষ করার পর কী আশ্চর্য রকম ভাবে শক্তিদার সাথে আলাপ হয়ে যায় ওর, আর তারপর একা একা কলকাতায় এসে এই ক' বছরে কতজনের সাথে ওর আলাপ, কত পত্রিকায় ও এঁকেছে, আর কী ভাবে শুধু ছবি এঁকে শুধু নিজেকেই চালায়নি, শাম্বর মতো একটা কলকাতার বাইরের পত্রিকাও চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত, শুনে শুধু
বিস্ময় নয় শ্রদ্ধাও হয়তো হয় ওদের।
ওদেরও একটা পত্রিকা আছে, বললো ওরা – প্রমিতি – আর্ট নিয়ে এই প্রথম বাংলা লিট্ল্ ম্যাগাজিন।
গত কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কিছু মিনি পত্রিকা বেরিয়েছে; কবিতার দৈনিকী, এমন কী শুনেছে ঘন্টায় ঘন্টায় একটা সংখ্যা কোরে কয়েক ঘন্টা, একটা কবিতার পত্রিকাও বেরিয়েছে নাকি। দূরে থাকে, তবুও এর মধ্যে, কলকাতায় যে কবার এসেছে তার মধ্যে, এ সব খবর পেয়ে গেছে জয়মালিকা। একবার কফি হাউজে গেলেই এই সব উন্মাদনার কথা শোনা যায়, কিন্তু কৈ, প্রমিতির কথা শোনেনি তো। শোনেনি, তাতেই কী বোঝা যায় না আর্টের একটা লিট্ল্ ম্যাগাজিনের কতটা দরকার ! শিল্প-সাহিত্যে উৎসাহ যাদের, এমনকি তাদের মধ্যেও কতজন খবর রাখে নিজেদের সময়ের আর্ট আর আর্টের কর্মীদের ! জয়ি বললো, আমাকে তোমাদের মধ্যে নিয়ে নিও। ওরা দুজনেই একসাথে হেসে বললো, নিলাম কমরেড।
জয়ির একবার ফিরতে হবে অফিসে। ও বেরিয়ে যায়।
পরের দিন জয়িকে আবার দেখা গেলো সোডা ফাউন্টেনে, এবার একা নয়, নতুন বন্ধুদের সাথে।
প্রমিতি একটা বুলেটিনের মতো। এক পাতা, দু পাতা, চার পাতা, যখন যেরকম হয়। অনেক কিছু নিয়ে লেখা হয়, শুধু যে আর্টের ব্যপার নিয়ে তাই নয়, এমনকি শিল্পীদের দাবি-দাওয়া নিয়েও। সব শিল্পীরা খুব যে পছন্দ করেন প্রমিতি আর তার দলবলদের, তা কিন্তু নয়। অনেকে রীতিমতো সন্দেহ করেন ওদের। ও সব পলিটিকালি মোটিভেটেড, এমন কথাও বলেন কেউ কেউ। আর্ট কলেজের শেখানোর কায়দা, লাইব্রেরিতে বইপত্রের দৈন্য, এ সবও আলোচনা হয় প্রমিতিতে। সরকারি আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল নাকি সাবধান কোরে দিয়েছেন ওদের, এ সব কাগজ ছেলেমেয়েদের কাছে বিক্রী করার চেষ্টা যেন না করে ওরা।
কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ছবি-টবি দিয়েও দেন অনেকে। এমনকি গণেশদার মতো নির্বিরোধী মানুষও ছবি দিয়েছেন। আজও একটা ছবি নেওয়া হলো। অবাক হয়ে দেখলো জয়ি সব ব্যাপারটা। একরকমের কাগজ আছে, সাইক্লোস্টাইল্ড্ কার্বন, সেই কাগজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো ওরা; ছবি যিনি দেবেন জয়ি জানে না তাঁর নাম, তাঁকে সে রকম কাগজ দেওয়া হলো একটা, একটা বিশেষ রকমের কলম গোছের কিছু একটা নিয়ে উনি আঁকলেন সে কাগজে, ব্যস, হয়ে গেলো। বেরিয়ে গেলো ওদের মধ্যে একজন, কিছুক্ষণ পরেই সে ফিরে এলো ছাপা ছবিটাকে নিয়ে। আর্টিস্ট ভদ্রলোক বেশ সময় নিয়ে দেখলেন ছবিটা, বললেন পছন্দ হচ্ছে না ওঁর। চারকোল দিয়ে ছবিটার সংশোধন করলেন তিনি। আর একটা সাইক্লোস্টাইল্ড্ কার্বন চেয়ে নিয়ে পুরোনো ছবিটা দেখে দেখে আবার আঁকলেন কার্বনে। আর একবার ছাপাতে নিয়ে গেলো ওরা। হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে, পছন্দ ! এক কপিই ছাপা হয়েছিলো, এবার অনেকগুলো ছাপানো হলো, তারপর আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হলো প্রমিতির শেষ সংখ্যায়।
আগামী সংখ্যার প্রমিতিতে কার ছবি ছাপানো হবে? বিকাশ ভট্টাচার্যের, বললো জয়মালিকা।
বিকাশদা? বিকাশদা দেবেন না। আগেও বলেছি অনেক কোরে, দেননি। দেব না-দেব না কোরেও গণেশদা দিয়েছেন শেষ পর্যন্ত, বিকাশদা দেবেন না, বললো রত্নময়, ওদের মধ্যে একজন।
বিকাশদা কী এখানে আসেন? – জিজ্ঞেস করে জয়ি।
হ্যাঁ, আসেন তো মাঝে মাঝেই, পেছনের দিকে একটা হাইব্যাক চেয়ার দেখিয়ে দেয় রত্নময়, এলে ওখানেই
বসেন সাধারণত।
ঠিক আছে, আমি তো আছি কয়েকদিন, আমি ঠিক ধরে ফেলব। দায়িত্ব নিচ্ছি। স্টুডিয়োয় গিয়ে কিসমতদির সামনে কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারতাম না, আমার উপর ছেড়ে দাও, এখানে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।
অফিসে আর ফিরবো না আজ, এই কথা ভেবে একটু বেলার দিকে সোডা ফাউন্টেনে ঢোকে জয়মালিকা কয়েকদিন পর। রত্নময় ছিলো, বললো, টূ আর্লি ফর বিকাশদা। চলো, কচুরি-টচুরি খেয়ে আসি, এলে ততক্ষণে এসে যাবেন।
কচুরির দাম আমি দেবো কিন্তু, আমি চাকরি করি, ঠিক হ্যে?– ঘোষণা করে জয়ি।
যথা আজ্ঞা, দেবী।
কে-সি-দাশে কচুরি আর র্যালি সিং-এর দোকানে কুলফি খেয়ে সোডা ফাউন্টেনে আবার ঢুকে দেখলো রত্নময়ের দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারটাতেই বিকাশদা, সঙ্গে সেদিনের সেই দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। রত্নময় বেরিয়ে গেলো, বললো, আমি নেই।
বিকাশদার টেবিলের সামনে দাঁড়ায় জয়মালিকা, কেমন আছেন বিকাশদা?
তুই? জয়মালিকা? খবর কী তোর? মার্কেট স্কোয়ারে নাকি ছবি দিয়েছিলি তুই, পাঠালি কী করে?
আমি তো কলকাতাতেই ছিলাম, সেই থেকে তো আছি এখনো।
যোগাযোগ রাখিস না কেন?
কী করে রাখবো বিকাশদা, আমি তো এখন চাকরি করছি।
কী চাকরি, কি ভাবে পেলো, কলকাতায় মাঝে মাঝেই আসার এবং একটানা থাকার কেমন সুযোগ, সব চুপ কোরে শুনে নেয় বিকাশদা। তারপর বলে, এখানে সময় নষ্ট করছিস কেন?
সময় নষ্ট কোথায়, প্রমিতির জন্যে একটু একটু কাজ করছি তো।
প্রমিতি-টমিতি পরে হবে, এত সুযোগ পেয়েও ছবি আঁকা অভ্যেস করছিস না কেন?
করি তো, নিজে নিজে যতটা পারি, অভেস তো করিই।
নিজে নিজে অভ্যেস কোরে তোর কোন উন্নতি হবে না জয়মালিকা, তুই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যা।
আর্ট কলেজে? কীভাবে? আমি যেখানে থাকি সেখানে আর্ট কলেজ কোথায়?
তোকে তো সেখানে ভর্তি হতে বলিনি আমি। ভর্তি হবি কলকাতায়। যতটুকু সময় তুই পাবি বললি আমাকে, ততটা পেলেই ঢের।
মানে? আমি বুঝতে পারলাম না।
তোর কাছে টাকা-পয়সা কেমন আছে?
প্রচুর বিকাশদা, আমি বড়লোক এখন।
তুই বড়লোক তা আমি বুঝেছি, কিন্তু কলকাতায় এখন তোর যথেষ্ট টাকা আছে কী?
হ্যাঁ, ব্যাঙ্কে আছে তো।
শোন্, তুই কী জানিস আমার পুরোনো কলেজে আমি পড়াই এখন? সরকারি কলেজটায় নয়, এই ধর্মতলায় যেটা। কাল টাকা নিয়ে আসবি, কলেজটা চিনিস?
আমাকে চেনার কথা বলছো, আমি ঠিক চিনে নেবো !
ঠিক আছে, কাল টাকা নিয়ে বারটা নাগাদ আসবি, ভর্তি করিয়ে দেবো। যখনই কলকাতায় আসবি, অফিসের কাজ হয়ে গেলে কলেজে চলে আসবি। টেকনিক-ফেকনিকগুলো শিখতে হবে তো, গাইডেড স্টীল-লাইফ স্টাডি, লাইভ-মডেল স্টাডি, এ সব ছাড়া চলবে? তোর ছবি আঁকার একটা স্বাভাবিক প্রতিভা আছে, কিন্তু চোখ তৈরি করতে হবে, টেকনিক শিখতে হবে, বিভিন্ন মীডিয়ম ব্যবহার করা শিখতে হবে, বুঝলি? কোয়্যাক হয়ে থাকলে চলবে?
ঠিক আছে বিকাশদা, সে সব হবে, কিন্তু তুমি প্রমিতির জন্যে একটা ছবি এঁকে দেবে?
তোকে বললাম না, এখন শুধু চাকরি আর সময় পেলেই কাজ শেখা, কলেজে গিয়ে। প্রমিতি-টমিতি এখন আর নয়। অনেক সময় অলরেডি নষ্ট হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি যে ওদের কথা দিয়েছি। কলেজে তো কাল ভর্তি হচ্ছিই।
ঠিক আছে, কলেজে আগে যেতে শুরু কর। মন দিয়ে কাজ কর, তারপর দেখবো। এমনিতে তোদের কপাল খারাপ, অরুণদার মতো গাইড তোরা পাবি না। যদি ছবি আঁকিস, ভবিষ্যতে কী আঁকবি সেটা শুধু ভবিষ্যত জানে, আর তোর চোখের আরো অনেক ভেতরের চোখটা জানে – কী সে দেখছে আর কেউ জানেনা তো – কিন্তু যা-ই আঁকিস, টেকনিকালিটিটা, ডিজাইন অ্যাসপেক্টটা, না শিখে কোন উপায় নেই। অরুণদা প্যারিসে, থাকলে আসল লোকের কাছ থেকেই শিখতিস; এখন সব ভুলে গিয়ে মন দিয়ে শেখবার চেষ্টা কর, যতটা আমি পারবো তোকে সাহায্য করবো। আর কলেজের বাইরে কিসমতের সাথে যোগাযোগ রাখিস, ওর বিশ্বাস যদি অর্জন করতে পারিস, অনেকটাই শিখতে পারবি।
পরের দিন কলেজে গিয়ে বিকাশদার সাথে দেখা করলো যেমন কথা ছিলো। টাকাপয়সা দিয়ে ভর্তিও হয়ে গেলো। ওর যাবতীয় ডক্যুমেন্টে বিকাশদা নিজেই সই কোরে দিলো, কাজেই কোন অসুবিধেই হলো না। ভর্তির পর ও বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিলো, বিকাশদা জোর করে অ্যানাটমির ক্লাশে ঢুকিয়ে দিলো ওকে।
পড়ছি।
পড়ছি নিয়মিত