আজ সকালে নিনিকে ফোন করেছিল পৃথা। সকালে মানে খুব সকালে না। খুব সকালে নিনিকে পাওয়া যায় না। ঘুম থেকে উঠবে। কাজকর্ম সারবে। মোবাইল অন করবে, তবে না! ততক্ষণে পৃথার সকাল মাঝপথে। আবার বেশি দেরি করলেও হবে না। তাহলেই কন্যে নিজের কাজ নিয়ে বসে যাবে। তখন আর তিনি ফোন ধরবেন না। এত সব মেপেজুকে কাজ করা যায়? একটুও ভাল লাগে না পৃথার। তাই সকালে ওকে পারতপক্ষে ফোন করে না।
কিন্তু কাল রাতে একটা জব্বর নাম এসেছে মাথায়। সেটা নিনিকে বলতে হবে। আর দশটা কাজে জড়িয়ে পড়ার আগে। তাই অপেক্ষা করে পৃথা। মেপে মেপে ক্যারাফেতে জল ঢালে। বসিয়ে দেয় বার্নারে। তারপর গ্যাসের নব ঘোরায়। খোলা জানলা দিয়ে চুইয়ে আসে ভোরের তরল, পাতলা অন্ধকার। এক দৈবী আলোর মত গ্যাসের শিখারা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। হাইড্রোকার্বনের অণুগুলো ক্যারাফের তলা ছোঁয়। পৃথার মনে পড়ে যায়, ওর মায়ের কথা। প্রথম যেদিন ওকে কাঁচের ক্যারাফে গ্যাসের আগুনে বসাতে দেখেছিল, কি ভয়টাই না পেয়েছিল! যদি আগুনের শিখায় কাঁচ ফেটে যায়! ওই ভয়টা! ভয়টাও ওদের পোর্টফোলিওতে চাই। মনে মনে নোট করে পৃথা। হয়ত এক্ষুণি কাজে লাগবে না। কিন্তু ইটস ইউনিক। কিছুটা না-জানা, ফ্লেম প্রুফ ব্যাপারটাই মা বোঝে না, কিছুটা মেয়েকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া, সব কিছুর একটা পারফেক্ট পাঞ্চ।
কিন্তু তারও আগে নিনির সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তারপর আজ আবার দিল্লি যাওয়া! কাজের কি আর শেষ আছে! একটা কোম্পানি খোলার তোড়জোড় মানে কম কাজ! তার উপর এমন একটা অশ্রুতপূর্ব সার্ভিস দেওয়ার জন্য। এক্কেবারে নতুন বাজার। নতুন খেলাধুলা। কোথাও কোন প্রতিযোগিতা নেই। অবশ্য সেজন্য ওদের খুব সাবধানও থাকতে হচ্ছে। আইডিয়া ফাঁস হয়ে গেলে খুব মুশকিল। ফার্ষ্ট মুভার অ্যাডভ্যান্টেজটুকুর পুরো ফায়দা তুলতে হবে। তবে তারই মধ্যে রেখে ঢেকে বাজার সমীক্ষা করিয়েছে। বেশ আশাব্যঞ্জক ফলাফল। মনে হচ্ছে, বাজার বেশ পেকেই আছে। শুধু টুক করে ফল পেড়ে নেওয়ার যা বাকি।
সত্যি বলতে কি, এই বিজনেসের শুরুর আইডিয়াটা ওদের নিজস্ব না। নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন সন্ধ্যেতে প্রথম চোখে পড়েছিল গল্পটা। নামেই বাজিমাত। স্ট্যান্ডার্ড লোনলিনেস প্যাকেজ। কে একজন চার্লস ইয়ুর লেখা। লোকটা কে, কে জানে! নামই শোনে নি আগে। সে অবশ্য পৃথিবীর কজন লেখকেরই বা নাম শুনেছে পৃথা! কিন্তু গল্পের নামটা ওকে টানছিল। আর পুরোটা পড়ে তো একদম ফিদা। ঘ্যামা গল্প তো! নাহ গল্পের দর্শন, বক্তব্য এইসব না। ও সবে গোলি মারো! বাট আইডিয়াটা! হোয়াট অ্যান আইডিয়া স্যারজি! উৎসাহের চোটে তক্ষুনি নিনিকে ভিডিওকল করলো। গল্পটা শুনে নিনিও বেশ চনমনে হয়ে উঠল। নিনিই প্রথম বলল,
“ওয়াও! গ্রেট! লেটস মেক ইট ফুললি দেশি! ইট উইল বি আওয়ার অন রুদালি টু ডট ও।”
পৃথা ঠিক বুঝতে পারেনি। “হোয়াট? রুদালি? মানে?”
ওর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ দেখে উল্টোদিকে নিনি হেসে কূল পায় না।
“ওহ, তোর এক্সপ্রেশনটা যা দারুণ হল না! লেটস স্টার্ট বিল্ডিং আ পোর্টফোলিও ইয়ার! ট্যাগলাইন দেব, হ্যাভ এ ইমোশন? উই শ্যাল ডেলিভার ইট পারফেক্টলি!”
তারপর অবশ্য দেবীর প্রাণে দয়া হল। বলল, “আরে এই জন্যেই তোকে ওল্ড মুভি-টুভি দেখতে বলি। একটু কষ্ট করে রুদালি মুভিটা দেখে নে, তাহলে বুঝতে পারবি কেন বললাম।”
সেইদিনই সিনেমাটা দেখেছিল পৃথা। আর দেখতে দেখতেই আইডিয়াটা মাথায় জমাট বাঁধতে লাগল। দুধ জমে যেমন কুলপি হয়। তারপর দুজনের মধ্যে কত, কত অডিও–ভিডিও কল। লম্বা, লম্বা আলাপ-আলোচনা। চার্লস ইয়ুর আইডিয়ার সুতো ধরে তৈরি হল খড়ের কাঠামো। কাঠামোর উপরে পরতে পরতে মাটি পড়ল। শেষমেষ যে চেহারাখানা দাঁড়ালো, তা একেবারে আগমার্কা দেশি – এক্কেবারে ইউনিক। পৃথা, নিনির খুশি ধরে না।
দে উইল সার্ভ ইমোশনস। এ সাবস্টিটিউটেড ম্যানুয়াল সার্ভিস! হেভি ফি’র বিনিময়ে। যা কিছু করতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু করা দরকার সেসব আউটসোর্স করে দাও। বসের আলসার অপারেশন, মালটা হেভি তিকরমবাজ, মনে মনে খুব ইচ্ছে, ওটিতেই মালটা টেঁসে গেলে ভাল, কিন্তু সবাই জানে ও মাল এত সহজে খালাস হবে না। কাজেই ওটির বাইরে সারাদিন ডিউটি দাও। না হলেই পরের প্রোমোশন ভোকাট্টা। প্রদীপ গুপ্তা ড্যাংডেঙ্গিয়ে মাথার উপর চড়ে বসবে। লো, আর এসব ঝামেলা নেই! এসে গেছে নতুন সার্ভিস! শুধু সার্ভিস বুক করে তারিখ-সময় জানিয়ে দিলেই হবে। প্রফেশনাল লোক গিয়ে একদম নিক্তি মেপে অধস্তনের সমবেদনা নিঁখুত ভাবে ডেলিভার করে আসবে। গ্যারান্টি সহকারে। বসের বৌ পরে বসের কাছে পঞ্চমুখে প্রশংসা করবে। সেই সঙ্গে বাজারে একটু হালকা করে এই সার্ভিসের মহার্ঘতার ব্যাপারটা ছড়িয়ে দিতে হবে। দ্য ফিজ উইল শো হাউ মাচ আই কেয়ার ফর ইউ। ব্যস কেল্লা ফতে। পরের প্রমোশনে প্রদীপ গুপ্তা ফুটে যাবে। আবার নিজেরও নিজেকে আর হিপোক্রিট মনে হবে না। মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি।
এই রকম অনেক অনেক বিজনেস কেস জমা হয়েছে গত একমাসে। আবার অনেক কেস বাতিলও হয়েছে। লো এন্ড মার্কেটে ওরা ঢুকবে না। এটা দুজনেই একমত। লো-এন্ড সেক্টরে বাজার অনেক বড়। কিন্তু সেখানে প্রফিট মার্জিন কম। নো, নো। দ্য মিডল ক্লাস ক্যান্ট পে। লেটস কীপ ইট এক্সক্লুসিভ । যত এক্সক্লুসিভ, তত প্রফিট।
নিনির একটা হাই প্রোফাইল চাকরি আছে। পৃথা এখন ফাঁকা, কি করবে, কি করবে ভাবছিলই। আইডিয়াটা পেয়ে লাফিয়ে উঠল। মন দিয়ে চটপট একটা বিজনেস প্ল্যান ছকে ফেলল। আর ওই বিজনেস প্ল্যান বানাতে বসেই গিয়েই কথাটা উঠল।
লেট আস গেট ওয়ান রিয়েল রুদালি, ইয়ার! অ্যান্ড অলসো লেটস ড্র আপ আ টিম! ওয়ান্স উই ফাইন্ড দ্য লেডি, উই শ্যাল আস্ক হার টু পাস দ্য বেসিক ট্রেইনিং টু আদার্স! হাউ টু ফিল ইমোশন আন্ড ডেলিভার অন ডিম্যান্ড।
পৃথা শুনে আঁতকে ওঠে! “আরে! ওদের পারফর্ম্যান্স তো ভয়ানক গ্রাম্য, নো, নো, দ্যাট ওন্ট ডু! উই নীড সফিস্টিকেশন! ডোন্ট ফরগেট আওয়ার টার্গেট মার্কেট সেগমেন্ট।"
নিনি ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছিল পৃথাকে। ইট মাস্ট বি এ পিওর সায়েন্স, আদারঅয়াইজ হাউ ডু দে প্র্যাকটিস ইট ফর সো লং? হাউ ডু দে ক্রাই? তাছাড়া একজন প্রফেসনাল রুদালি টিমে থাকলে সেটা একটা বড় ইউএসপি হবে। প্যাকেজিংটা ঠিক হতে হবে। সফিস্টিকেশন আমরা শিখিয়ে দেব। সাজ পোশাক, কোন ভল্যুমে কোন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সঙ্গে কিভাবে কাঁদবে – সব কাস্টমাইজড হবে। ফুললি কনট্রোলড বাই দ্য ক্লায়েন্ট। বাট ইউ সি, এটা একদম আমাদের, কি যেন বলিস তুই, তুরুপ, তুরুপ … পৃথাই শেষ করে বাক্যটা, তুরুপের তাস। “ইয়েস ইয়ার, দ্যাট উইল বি এ নভেলটি! আওয়ার স্টার্টিং অফারিং। আমরা প্রফেশনালি শোক ও সমবেদনা ডেলিভার করব। যে কোন উপযুক্ত পরিস্থিতিতে। এই সব আর্ট-ফিল্ম দেখনেওয়ালা কালচার্ড ক্লাস লোকেরা না উইল লাইন আপ টু ইউজ হার সার্ভিস! শুধু যদি আমরা মার্কেটিংটা ঠিক ভাবে করতে পারি!”
করবে, প্রাণ ঢেলে মার্কেটিং করানোর ব্যবস্থা করবে। না হলে পৃথা এতদিন বৃথাই জগত-বিখ্যাত কোম্পানির ইন্ডিয়ার মার্কেটিং হেডের পোস্টে ছিল! নেহাত আগেই প্ল্যান করেছিল, পঁয়তাল্লিশ হলেই আর চাকরি নয়, অন্যের চরকায় আর তেল নয়, এবার নিজের সাম্রাজ্য তৈরি করা দরকার, তাই চাকরি ছাড়া। না হলে ওদের কান্ট্রি হেড তো ওকে ছাড়তেই চাইছিল না। বার বার বলেছিল, “মিস ব্যানার্জী, এনি টাইম, ইউ থিঙ্ক অফ রিকন্সিডারিং ইয়োর ডিসিশন, প্লিজ গিভ মি এ রিং”। কিন্তু না, পৃথা তখন চাকরি ছাড়ার জন্য মরিয়া। বেলা হয়ে যাচ্ছে। এখনও শুরু না করলে আর কবে!
এতদিনে মোটামুটি প্ল্যানিং করা হয়ে গেছে। অনেক, অনেক মাথা ঘামানোর সেশনের পর। এইবার কাজে নামার পালা। টিম তৈরি করতে হবে। টিমকে ট্রেইন আপ করতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের এক্সপ্যানশনের কথাটাও ভুললে চলবে না। ফাইনেস্ট ইমোশনাল একসপ্রেশনস দিয়ে একটা পোর্টফোলিও তৈরি করতে হবে। তার সিলেকশন, ফিল্টারিং, সেটাকে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ন বানানো - সব মিলিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ! সেই সঙ্গে একটা পার্ফেক্ট এন্ড ইউনিক মার্কেট পজিশনিং তৈরি করা। বাজারও হাতের মুঠোয় থাকবে। এখন তো আবার গলির মোড়ে মোড়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে যেন কেউ ওদের কাজটাকে গুলিয়ে না ফেলে! সেটাও কড়া নজরে রাখতে হবে।
কাজ শুরু হয়েছে। কলকাতায় বসে রুদালির খোঁজ পাওয়াই কঠিন হচ্ছিল। অবশেষে নিনির কোম্পানির একজন খবর দিয়েছেন। ভদ্রলোক শেখাওয়াতি রাজপুত। তাঁর মুলুকে নাকি একজন আছে। দেহাতি বুড়ি। নেহাতই গরীব। ওই রুদালিরা যেমন হয় আর কি! এখন তো আর ওইসব কারবারও চলে না। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে সেই গ্রামে যেতে হবে। অতএব। পর্বত মহম্মদের কাছে না এলে, মহম্মদকেই পর্বতের কাছে যেতে হবে। নিনির অফিসে চাপ চলছে একটু, এখন ছুটি পাওয়া মুশকিল। তাই পৃথা একাই যাবে।
ও ইচ্ছে করেই সন্ধ্যের টিকেট কেটেছে। রাতটুকু দিল্লির হোটেলে কাটাবে। তারপর ভোর ভোর গাড়ি নিয়ে গন্তব্যের দিকে রওনা দেবে। তার আগে আজকের দিনটা একদম কাজে ঠাসা। অনেকগুলো ইন্টারভিউ নিতে হবে। ভেন্যু বুক করে রাখা আছে। একেবারে তৈরি হয়ে ভেন্যুতে চলে যাবে। ওখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট। একবার মায়ের কাছে যেতে হত। অনেকদিন দেখা হয় না। ফোনের মারফত আঁচ পায়, অভিযোগের পাহাড় জমছে। কিন্তু আজ আর সময় হবে না। বরং একবার ভিডিওকল করে নেবে। এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে। সেই ভাল। তাতে মা খুশি হবে না। পৃথা জানে। তবু মা’র মুখটা তো দেখা হবে।
একটানা গোটা ছয়েক ইন্টারভিঊ। কোন ব্রেক নেই। জান নিংড়ে নেওয়া। কিন্তু এত করেও কাউকেই পছন্দ হল না। অবশ্য ওদের তরফেও কাজের একটা ফাঁক রয়ে গেছে। অনেক মাথা ঘামিয়েছে। তবু একটা আইডিয়াল প্রোফাইল খাড়া করতে পারেনি। ঠিক কেমন যে লোক চাই! অথচ এইটা খুব জরুরী। নাহলে ক্যান্ডিডেট বাছাই করাই মুশকিল। পরের দফার ইন্টারভিউ এর আগে এইটা মাস্ট। এইসব ভাবতে ভাবতে গাড়ির সিটে যখন বসল পৃথা। একেবারে হাক্লান্ত! তবু ফোনটা হাতে নিল। মা’কে আগে একবার জানিয়েছিল। এই দিল্লি যাওয়ার কথা। সেটা মা ভাল করে রেজিস্টার করেনি। কদিন থাকবে যে না, সেটা আবার বলে দিতে হবে। অবশ্য নমিতা দি জানে যে ও থাকবে না। নমিতাদি থাকতে অবশ্য ওর কোন চিন্তাও নেই। বছরভর মাকে সেই সামলায়। তবে এই বয়সে একটাই ভয়। আচমকা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তারের সঙ্গে কথাবার্তা বলা বা দরকারে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটা একা নমিতাদি পারবে না। সে দরকারে নিনি আছে। সেও সব জানে। ইন্স্যুরেন্স এর কাগজপত্র । ডাক্তারদের সব প্রেসক্রিপশনের স্ক্যানড কপি। এসব গুগুল ড্রাইভে তোলাই আছে। দরকারে নিনির সঙ্গে শেয়ার করে দিলেই হবে।
ফোনটা রিং হচ্ছে। হয়েই যাচ্ছে। ধরছেই না। অনেকক্ষণ বাজার পরে ভিডিওকলটা কেটে দিল পৃথা। ততক্ষণে গাড়ি উঠে গেছে ব্রিজের মাথায়। টকটকে কমলা রং এর সূর্যটা এসে গেছে একদম হাতের নাগালে। ঘন নীল বিষাদচাদর স্টার্টিং পয়েন্টে অপেক্ষমান। অনেকটাই নিচে। রেডি, স্টেডি, অন ইয়োর মার্ক - হুইসল বাজলেই এক নিমেষে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। পৃথার মাথার মধ্যে অবসন্নতা চারিয়ে যায়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ও জানে, কি হতে যাচ্ছে। তবু আবার কল করল। এবার সাধারণ অডিও কল। মা ধরল।
- কি হল? ভিডিওকল করলাম হোয়াটস অ্যাপে – ধরলে না কেন?
- ভুলে গেছি কি করে ধরতে হয়!
- নমিতাদি তো জানে, ওকে বললে না কেন? ও তো ধরে দিত পারত।
- তোর যেমন কথা, নমিতা লোকের বাড়ি কাজ করে খায়, ও কি করে এসব জানবে?
দাঁতে বালি পড়ার মতন অনুভূতি হল পৃথার। মাকে আগে অনেক বুঝিয়েছে। নমিতাদির সামনেই এমন করে বলো, লোকটার কেমন লাগে! একবার ভেবে দেখেছ? তাছাড়া তুমি জানো না যে নমিতাদির এখন আর কাজ না করলেও চলে? তুমিই তো তার ব্যাংকের একাউন্ট রে, তার টাকা পয়সা তোলা, জমা দেওয়া সব করে দাও । তাহলে? শুধু তোমাকে দেখাশোনা করার জন্য লোকটা এখনও রয়ে গেছে। শুধু কৃতজ্ঞতাবোধের দরুণ। তাকে মিনিমাম একটু রেসপেক্ট তো দাও। অনেক বলেছে। বলে বলে পৃথা হাল ছেড়ে দিয়েছে। মার সেই এক কথা। কাজের মেয়ের আবার কাজ না করলেও চলে! চলে যাক না, কদিন ঘটি গড়িয়ে খাবে! কি যে অপমানজনক মনোভাব!
- মা, এরকম করে বল কেন? তাছাড়া নমিতাদি তো এগুলো ভালই জানে, আমি তো মাঝে মাঝেই কল করি, বেশ তো ধরে। তুমিই তো বরং ভুলে যাও খালি।
- তোর যেমন কথা। কাজের লোকের থেকে আমাকে শিখতে হবে! তুই নিজে শেখাতে পারিস না , তাই বল! যাক গে, ফোন করলি কেন?
- শোন, তোমাকে সেই যে বলেছিলাম না, আমি আজ দিল্লি যাচ্ছি। ক’দিন সময় লাগবে। কবে ফিরব এখনও ঠিক হয়নি। ঠিক হলে তোমাকে জানিয়ে দেব। কটা দিন একটু সাবধানে থেকো।
- দিল্লি যাচ্ছিস কেন? সেই যদি হিল্লিদিল্লি করে নেচেই বেড়াবি, তাহলে চাকরি ছাড়লি কেন?
- মা, তোমাকে বলেছি না যে নিনি আর আমি একটা বিজনেস করার চেষ্টা করছি। এটা সেই কাজেই যাওয়া।
- আবার বিজনেস করবি কেন? এত টাকার লোভ কেন তোর? কত ভাল চাকরি করতিস – শুধু শুধু ইচ্ছে করে ছাড়লি, কেন যে ছাড়লি কে জানে! তোর যতসব অনাসৃষ্টি কান্ড!
একটু চুপ করে থাকে পৃথা। জোরে একটা দম ছাড়ে। নিজের ফ্রাস্ট্রেশনটা শরীর থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করে। মা’র কয়েক বছর আগের বলা কথা মনে পড়ে। নিত্য চেঁচাত, সকাল থেকে মাঝরাত অবধি চাকরির পেছনে খেটে মরিস কেন? এর থেকে তো নিজে একটা কিছু করতে পারিস! এই মা-ই বলেছে আগে! কিন্তু এখন আর সেকথা মনে করিয়ে দেওয়া বৃথা। মনে করিয়ে দিলে উল্টে নির্বিবাদে বলে, কি যে বলিস! তোর সব বানানো কথা। আগে হলে তর্ক করত। এখন আর করে না। কথা বাড়িয়ে কি লাভ! অন্য কথায় চলে যায়। টুকটাক এ-কথা, ও-কথা বলে। তারপর একসময় এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায়। কথা শেষ করে। আর শেষ করতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
ক্লান্ত লাগে নিজেকে! তুমুল ক্লান্ত। ওয়েব চেক-ইন করাই ছিল। যন্ত্রের মতন লাইনে দাঁড়ায়। সিকিউরিটি চেক সারে। সোজা গেটের কাছে চলে যায়। একটা বসার জায়গা পেয়ে যেতে স্বস্তি। মা-বাবার সঙ্গ সবার কাছে কেমন একটা ছাতার মতন হয়। অথচ ওর ক্ষেত্রে কেন যে এমন বিষিয়ে উঠল! আজকাল কথা বলাটাও যে কী পরিমাণ ট্যাক্সিং হয়ে উঠেছে ! আজ বলে তো না। বহু, বহুদিন ধরে এমন চলছে। নিজের ইচ্ছে মত করে ঘটনা পাল্টে ফেলা। আজ ব্যবসা করায় আপত্তি, কালই হয়ত বলবে, কি যে সারাদিন বাড়িতে বসে থাকিস! একটু নিজের মত করে ছোটখাট একটা ব্যবসাও তো শুরু করতে পারিস! অথচ সেসব নিত্য পরিবর্তনশীল কথার প্রতিবাদ করা যাবে না। করলেই অশান্তি। রৌদ্ররস থেকে করুণরস, সবই বেরিয়ে আসবে গলন্ত লাভার মতন। বাবা থাকতে থাকতে তাও একটু মাকে সামলাতে পারত! এখন তো পৃথাকে দড়ির উপর হাঁটতে হয়! সারাক্ষণ! কোন কথা থেকে যে কোথায় চলে যাবে! প্রতি কথা মেপে বলা, মেপে রিঅ্যাক্ট করা! তাও কি আর সবসময় পারে! এক একটা তিক্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েই যায়!
পৃথার হারমোনিয়ামটাতে একটা সমস্যা ছিল। মাঝে মাঝেই গানের সঙ্গে বাজাতে বাজাতে কড়ি মা ছুঁতে হলেই রিডটা চেপে আটকে যেত। তাকে আবার টেনে তুলে দিতে হত। নাহলেই চিত্তির। একটা বিশ্রি বেসুরো স্বর বেরোতেই থাকত। মূল গানের সুরটাই মাটি। মা যেন ঠিক ওই হারমোনিয়ামটা। আর সকলের সঙ্গে মসৃণ সম্পর্ক। একটি মাত্রাও এদিক-ওদিক নেই। শুধু নমিতাদি বা ওকে ছুঁয়ে ফেললেই যত সমস্যা। কথার আঘাতে এদের ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়। একটা অকারণ হিংসা যেন সারাক্ষণ ছুরিতে ধার দেয়। দিতেই থাকে, দিতেই থাকে। দমবন্ধ হয়ে আসে পৃথার। তন্দুরের আঁচের উপর ঘূর্ণায়মান শিকে গাঁথা মাংসের টুকরোর মতন লাগে নিজেকে। দোকানির ছুরি চালানোর বিরাম নেই মোটে।
পৃথা অবশ্য পালিয়েছে। বাঁচার জন্য। নিজের আলাদা ফ্ল্যাটে চলে গেছে। একা থাকে। শান্তিতে থাকে। নিজের মানসিক স্থৈর্য ওর কাছে দামী। জননী, জন্মভূমিশ্চ ইত্যাদি ইত্যাদি যে বলে বলুক। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। দায়িত্ব ভোলেনি, কিন্তু নিজের চারপাশে কড়া পাহাড়া বসিয়েছে। ওর স্পেসে কাউকে ঢুকতে দেয় না। চেষ্টা করে, কোন কথাই গায়ে না মাখার। হেসে উড়িয়ে দেওয়ার। তবু সবটা পারেনা তো! আগে আগে ঝগড়া করেছে, কেঁদেছে, মাকে বুঝিয়েছ। সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। মা উল্টে পৃথাকে বলেছে, কেন, আমাকে পাগল প্রমাণ করে তোর কি লাভ হবে?
হাল ছেড়ে দিয়েছে পৃথা। তাই বলে কষ্ট তো কমে নি। মা তার ছোটবেলার রোল মডেল। চূড়ান্ত রক্ষণশীল পরিবেশে থেকেও নিজের জেদে পড়াশোনা শেষ করা মা। সব বাধা ঠেলে, ঘর-সংসার ও বিরূপ শ্বশুরবাড়ীর একশটা দায়িত্ব হাসি মুখে নিখুঁতভাবে সামলেও অতি দায়িত্বশীল উচ্চপদে চাকরি করা মা। অতি আধুনিক, উদার-মনস্ক, সমদর্শী, তীব্র ব্যক্তিত্বশালিনী। ব্যানার্জী বাড়ির বড়বৌ পরিচয় ছাড়িয়ে যাওয়া মা। মিসেস নন্দিনী ব্যানার্জী। এটাই তার পরিচয়। সেই মা’র এই বদল, ব্যবহারিক ক্ষুদ্রতা, অযৌক্তিক কথা পৃথার ভাল লাগে না একটুও।
এয়ারপোর্টের চকচকে আলোর বৃত্তে বসে ছিল পৃথা। বহমান উচ্ছ্বলতার মাঝে বেমানান রকমের চাপ-ধ্বস্ত চেহারা। মা’র ভাবনা মাথা জুড়ে! কেন যে করে মা এমন! অন্য সবার কাছে এক রকম, শুধু ওদের দুজনকে নিয়েই মা'র যে কিসের সমস্যা! মাঝে মাঝে মনে হয় যে কি জানি! হয়ত মায়েরই ঘনিষ্ঠ বৃত্তে দুজন মানুষ রয়েছে, যারা বিয়ে থা করেনি, নিজের উপার্জনে নিজে সুখে আছে, যে অপার স্বাধীনতা এত কিছু পাওয়ার পরেও মায়ের অধরাই থেকে গেছে, এ কি সেই অপ্রাপ্তির প্রকাশ? জানে না পৃথা। তবে কারণ যাই হোক, ও শুধু জানে যে প্রতিটা তিক্ত বাক্য বিনিময় হয় আর ওর মনের একটুখানি করে অংশ মরে যায়। প্রতিবার। একটু একটু করে। আর ও আরও একটু বেসাহারা হয়ে পড়ে। মা বলতে যে ছায়া ছায়া আশ্রয়, সেটা আরও একটু সরে যায়। এখনও কি আছে কোথাও একটুও ছায়ার আশ্রয়? তাহলে কেন ওর মাঝে মাঝেই মনে হয় যে ও একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে একাকী অপেক্ষমান? গ্রীষ্ম-ভর দহনক্লান্ত, আসন্ন বর্ষার রুদ্র বজ্রের প্রতীক্ষারত? একা। একদম একা।
হঠাৎ আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে ও। একটা তুমুল শীতবোধ ঘিরে ধরে। আর সেই সঙ্গে প্রাণপণে যুঝতে থাকে ভিতর থেকে উঠে আসা একটা কান্নার ঢেউকে। এয়ারপোর্টে বসে একজন পূর্ন বয়স্ক মানুষ কাঁদতে পারে নাকি! নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই মাথায় বিদ্যুৎ ঝলকের মতন ঝলসে ওঠে কথাটা। এই তো তাদের আইডিয়াল ক্যান্ডিডেট প্রোফাইল। এ পার্সন উইথ এ ডেড রিলেশন উইথ এ লিভিং পার্সন। মানুষ উপলক্ষ্য মাত্র। দেহ থাকে, দেহ যায়। কিন্তু প্রিয় সম্পর্ক যখন মরে যায়, তখন যে সর্বব্যাপী বিষাদ জড়িয়ে ধরে, সেই বিষাদই একমাত্র পারে অনন্ত অশ্রুর উৎস হতে। কখনো সে অশ্রু বাইরে ঝরে, কখনও অন্তসলিলা ফল্গু হয়ে নিরন্তর বয়। সেই মানুষগুলোকেই তাদের চাই। পৃথা, নিনির ইমোশনওয়ালার প্রথম টিম হবে তাদের নিয়ে।