দ্বিতীয় খণ্ড
২১
যে কোনও কিছুর শুরু আর শেষের মধ্যে একটা বর্ণময় আলো-আঁধারি থাকে। থাকে এক অনন্য প্রাপ্তি। অসীম নীলাকাশ। আর সীমাহীন বারিধি। যেখানে জীবন ঢ্যালা মাটির সাথে মণিমাণিক্যও কুড়িয়ে নেয়। রোদের কস্তূরী ভেঙে ভেঙে ঐরাবত মেঘগুলো ধেয়ে আসে বাঁধনের শিকল কেটে। মুক্তি। উল্লাস। চাওয়া পাওয়ার বাষ্প জমলেই ক্লান্তি নামবে বুকের পাঁজর ঘেঁষে। রোমকূপে বাসা বাঁধে তখন মন খারাপের ঢেউ। মহাবিশ্ব জুড়ে জমতে থাকে চাপ চাপ রক্তের মতো আলকাতরা অন্ধকার। হয়তো বা এটাই সেই উলঙ্গ সত্য। নির্মম বাস্তব।
মেয়ে যখন বিয়ের পরে বাপের বাড়ি থেকে কনকাঞ্জলি করে বিদায় নেয় তখন তাকে বাড়ির বড়রা পইপই করে বলে দেয় সে যেন আর পিছু ফিরে না তাকায়। শেখরও কি তেমনটাই ভাবছে? সেই রাত থাকতে কালু বাউরিদের সাথে রওনা দিয়ে পালকি করে কলকাতার মেস বাড়িতে সূর্য নিভুনিভু বিকেলে এসে পৌঁছেছে। অত ভোরে আন্না ঘুম ঘোরে বোধহয় ঠিক ঠাহর করতে পারে নি শেখর সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে। বৈঁচি যখন নিজের মেয়েকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করে বলে, ‘ওরে মুখপুড়ি তোকে কি কালঘুমে পেয়েছে? বাবাজীবন তো চলে যাচ্ছে’, তখনও আন্না ঘুমের ঘোরে উ উ করে কি যেন বলে পাস ফিরে শোয়। বিজয় বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আঃ ওকে ছেড়ে দাও না আন্নার মা। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে, ঘুমোতে দাও’। শেখরও ভেবেছিল এই বুঝি আন্না উঠে হাত-পা ছুঁড়ে শেখরের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না করে কান্না জুড়ে দেয়। কিন্তু তা না হতে শেখরেরও পুরুষত্ব কোথায় যেন টাল খায়। স্বামিত্বে আঘাত লাগে। বৈঁচি সারারাত ধরে আঁচলে চোখ মুছে শেখরের জন্য প্রচুর মুড়ি-মুড়কী নাড়ু ফলপাকুড় গুছিয়ে দেয়। বিজয়কে সে বারবার অনুরোধ করেছিল আন্নাকে শেখরের সঙ্গে পাঠাতে। কিন্তু শেখরের নিজেরই কলকাতায় নিজস্ব ঠাই না থাকায় মেস বাড়িতে কেমন করে মেয়েকে পাঠাবে। সেজন্য বৈঁচির এই অনুরোধ বিজয় রাখতে পারে নি। তবে আশার কথা এই যে শেখর বৈঁচিকে কথা দিয়ে এসেছে যত শীঘ্র সম্ভব বাসা বাড়ি দেখে সে পত্র মারফৎ খবর দেবে। আর তখন বিজয় গিয়ে আন্নাকে সেখানে রেখে আসবে।
কলকাতা শহরে সুন্দরবনের মতো ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আঁধার ঘনিয়ে আসে না। এখানে কলকারখানার বাঁশীর সাথে বিকেল শেষ হয়। বাতাসে ধোঁয়ারা ভেসে বেড়ায়। রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসবাতির আলো রাতের কালিমাকে মুছে দিনের আলোর গরিমা দান করে। সাহেব সুবোদের ঘোড়ার গাড়ির ফিটন গাড়ির শব্দে নিস্তব্ধতা ভাঙে। কখনও কখনও বাঙালী বাবুসমাজও সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টাকার জোরে রাতকে দিন করার চেষ্টা করে। বাইজী, খ্যামটা নাচগানে হুল্লোড় তোলে বারমহল। সেখানে প্রতিযোগিতা চলে কোন বাবু বা জমিদার একরাতে কত টাকা ওড়াতে পারল। কিম্বা নিজের বাঁধা মেয়েমানুষটিকে কত দামী গয়না দিতে পারলো। বিমান একদিন রাগে দুঃখে ফেটে পড়ে বলেছিল, ‘জান ভাই শেখর, নীলকর সাহেবেরা আমাদের যত না শত্রু তার থেকে ঢের বেশি শত্রু এই আমাদের দেশীয় রাজাগজারা। তারা যদি দেশীয় মানুষদের কথা ভাবতো তবে আজ আমাদের এই দুর্গতি দাঁড়াতো না। কথায় বলে না দশের লাঠি একের বোঝা। তারা যদি একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াতো তাহলে আজ আমাদের পরাধীন থাকতে হয়? ঐ সাদা চামড়ার কতগুলো মাত্র মানুষ এসে আমাদের উপর কর্তামি ফলিয়ে যাচ্ছে আর আমরা মুখ বুজে তা দিনের পর দিন মেনে নিচ্ছি। আর তারা রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়ার জন্য ইংরেজের পদলেহন করতে ব্যস্ত। তাদের দিনের পর দিন উপঢৌকন পাঠিয়ে যাচ্ছে। ধিক এইসব রাজাগজার দলকে’। সেদিনের বিমানের উষ্মার বিষয় শেখর অনুধাবন করতে পারেনি কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিশেষত আন্নাদের বাড়িতে কয়েক মাস থাকার ফলে বিজয়ের সংস্পর্শে এসে শেখরের মনেও এক নতুন চেতনার আলোর জন্ম হয়েছে। শেখর যেন একটু একটু সাদা কালোর প্রভেদ বুঝতে শিখে গেছে। ইংরেজরা তাদের শুধু পরাধীন করে রাখে নি, পরাধীনতার আড়ালে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। সমস্ত অর্থেই শেখরের মনে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যার জন্য শেখরের এই আমূল পরিবর্তন সেই আন্না শেখরের চিন্তাভাবনার জগতে কোথাও এতটুকু আঁচড় কাটতে পারছে না। কলকাতার এইসব দেশীয় বাবুরা বেশী বেশী মুনাফা লাভের আশায় সুন্দরবনের অনাবাদী জমির লাটকে লাট ইজারা নিয়ে পত্তন করার ব্যবস্থা করছে। তারা নিজেরা সারা বছরে একবারও হয়তো যায় না। দেশীয় একজন গোমস্তাকে নায়েব হিসেবে সেখানে বহাল করে মৌমাছির চাকের বিশুদ্ধ মধুটুকু পান করে যাচ্ছে। আর এইসব নায়েবরা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় প্রমাণ করতে সেখানকার সাধারণ মানুষদের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। যত রকম অত্যাচার, লুম্পেনবাজি, শঠতা করা যায় করে যাচ্ছে। মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না। বনের পশুরাও সেখানে যেটুকু মর্যাদা পায় এই কালো কেলো, গরীব গুর্বো, অসহায় মানুষগুলো সেটুকুও পায় না। শেখরের জীবনের এই কয়েক মাসের উথাল পাতাল জীবনে বুঝতে পেরে গেছে যে এতদিন প্রকৃত অর্থেই নাবালক ছিল সে। কলকাতার হিন্দু কলেজে পড়তে আসা নবচেতনায় জাগ্রত এইসব শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়কে শেখর যেন ঠিক বুঝতে পারতো না। সে ভোগবিলাসী না হয়েও তার চেতনার জগতে কোথাও যেন ভোগেরই পাঁকে ডুবে ছিল। তার মনের ভেতর এতদিন আন্না ভিন্ন আর কেউ বাসা বাঁধতে পারে নি।
কালুর দলবল হেঁদুয়ার কাছে শেখরদের মেস বাড়ির সামনে যখন পালকি নামায় তখন সূর্য নিভুনিভু। কালু খুব আন্তরিক গলায় বলে, ‘সাবধানে থেকো গো বাবুমশাই। তোমার উপর দিয়ে খুব ঝড় বয়ে গেছে’। কিন্তু যে কথা গোপন করে তা হল কিছুদিনের মধ্যেই সে পুনরায় রোজিপুর গ্রামে ফিরে যেতে চায়। ‘ধর্মগোলা’ স্থাপনে সে বিজয়ের পাশে দাঁড়াতে চায়।
মেস বাড়ির সদর দরজার ভেতরে পা দিয়ে উঠোনের ডান দিকে বারোমেসে কাঁঠালি চাঁপা ফুল গাছের ফুলের গন্ধে শেখরের মনের ভেতরে এই দোতলা মেস বাড়িটার আনাচ কানাচ সবকিছু ছবির মতো ভেসে ওঠে। প্রথমে রাঁধুনি উড়ে বামুন বলরামের নজরে পড়ে সে। এতদিন পর শেখরকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। কয়লা ভাঙছিল সে। সেইভাবেই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে আসে, ‘ওমা শেখর বাবু যে’ বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
শেখর যেদিন এখান থেকে যায় এই রান্নার ঠাকুরটি তাকে বারবার করে সুন্দরবনের খাঁটি মধু আনতে বলে দিয়েছিল। কিন্তু শেখরের হাতে একটি তোরঙ্গ ও একটি পুটুলি ভিন্ন অন্য কিছু না থাকায় বেচারি খুব মুষড়ে পড়ে। ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করেই ফেলে, ‘শেখর বাবু আমার মধু আনো নি?’
কিন্তু শেখরের সেখানে গিয়ে অব্দি যা যা ঘটে গেছে রান্নার ঠাকুরের মধু আনার কথা বেমালুম কপ্পুরের মতো উবে গেছে। তবু এখন মনে করে যাওয়ার সময় রান্নার ঠাকুরকে সে কথা দিয়ে গেছিল মধু এনে দেবে। তাই কুণ্ঠার সঙ্গে বলে, ‘না বলরামদা। সেখানে গিয়ে পর্যন্ত আমি খুব সমস্যার মধ্যে ছিলাম। তাই মধু আনতে পারি নি। তবে তোমায় কথা দিচ্ছি এবার দেশে যাওয়ার আগে ঠিক মধু আনিয়ে দেবো। আচ্ছা বিমান ঘরে আছে?’
বলরাম জানায়, ‘হ্যাঁ, কোথায় যেন গেছিল। একটু আগেই ফিরল’।
শেখর আর এক মুহূর্ত কাল বিলম্ব না করে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে পড়িমরি করে দৌড় লাগায়।
বলরাম চেঁচায়, ‘আস্তে যাও গো। হোঁচট খেয়ে পড়বে’।
সিঁড়ির ধাপগুলো শেখরের কাছে অনন্ত মনে হয়। মনে হয় এই ধাপ অতিক্রম করে সে কি কোনোদিন তার প্রিয় সখা বিমানের কাছে পৌঁছতে পারবে!
ভুলু কুকুরটাও কোথায় ছিল। শেখরকে দেখে ছুটে এসে ঘেউউ – কেউউ করে ডেকে লেজ নাড়াতে থাকে। ভুলু এতদিন বাদেও তাকে চিনতে পেরেছে দেখে শেখরের আহ্লাদের সীমা থাকে না। ভুলু শেখরের সামনে দাঁড়িয়ে সমানে লেজ নাড়তে থাকে। শেখর আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘ওমা দেখ বলরামদা ভুলু আমাকে মনে রেখেছে’।
মধু না পাওয়ার দুঃখ তখন কিঞ্চিৎ অভিমানের রঙ নিয়েছে বলরামের। সে উনুনের মুখে তালপাতার বাতাস দিতে দিতে বলে, ‘হ্যাঁ মানুষেরাই শুধু ভুলে যায়’।
এ কথার গভীর অর্থ অনুধাবন করার মতো অবস্থা তখন শেখরের নেই। সে তার নিজের পরিচিত পরিবেশে পরিচিত মানুষদের বাড়িতে ফিরে এসে আনন্দে বিভোর। সে নিজের মনেই ভুলুকে বলে, ‘রাগ করিস না ভুলু তোর জন্যও কিছু আনা হয় নি। যে অবস্থার ভেতর দিয়ে দিনগুলো পার করলাম’।
হিতেন মজুমদার কোন একটা অফিসে ইংরেজের অধীনে খাস কর্মচারী। সে অফিস থেকে ফিরছে। হাট করা সদর দরজা দেখে বলরামের মুণ্ডুপাত করতে করতে ঢুকে রীতিমত তাজ্জব বনে যায়। খুব দিল খোলা দরাজ মনের মানুষ। হেঁকে ডেকে সবসময় কথা কয়। শেখরকে দেখে হাতে ঝোলানো শোওয়া দুই কেজি ওজনের বোয়াল মাছটাকে দিয়েই উঁচু করে অভিনন্দন করে উঠে বলে, ‘আরে ইয়ং ম্যান, কখন এলে? এদ্দিনে তোমার বাড়ির সব ভালোয় ভালোয় মিটল?’
কি বলবে শেখর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিল না। শেখরের এতদিন বাড়িতে পড়ে থাকার কারণ এখানে আর কেউ না হোক বিমান যে জানে সেটা এখানকার সকলেই জানে। কিন্তু বিমান যে এখানে সকলের কাছে শেখরের অন্তর্ধান সম্পর্কে ঠিক কি বলেছে তা শেখরের অজানা। তাই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতোই নিজেকে বোধ করে। শেখর ভাবনার আতান্তরে পড়ে, ঠিক কি যে বলেছে বিমান এখানকার সকলের সাথে কে জানে! সে কি শেখরের দ্বিতীয় বিবাহের কথা সকলকে বলে দিয়েছে, ছি ছি ছি তালে তো লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। এখানে একমাত্র তারিণী ভট্টাচার্য্য বাবু ছাড়া কেউই প্রায় কুলীন প্রথা সমর্থন করে না। এখানে তারই একমাত্র তিনটে বিবাহ। হিতেন তো মানেই না। সে প্রচণ্ডই কেতাদুরস্ত। চলনে বলনে সাহেবদের মতোই হাবভাব। সবসময় স্যুট বুট টাই পরে থাকে। ইংরেজদের গুণগান করতে পারলেই যেন জীবন ধন্য। বিমান এই বাঙালী বাবুদের টাই পরা নিয়ে প্রায় মশকরা করে বলে, ‘বুঝলে ভাই শেখর এই টাই হচ্ছে বকলেস। মনিব যেমন তার পোষা সারমেয়টির গলায় বকলেস পরিয়ে রাখে এও ঠিক তেমনি। একটু ব্যাগরবাই করেছো তো বকলেস ধরে মারো টান’। হিতেনের গলায় ঝোলানো নীল রঙের সাটিনের কাপড়ের টাইটির দিকে তাকিয়ে এসব হিবিজিবি ভেবে যাচ্ছিল শেখর।
হিতেন আবার বলে ওঠে, ‘কি ইয়ং ম্যান তা তোমার গ্র্যান্ড ফাদারের পারলৌকিক ক্রিয়াদি ভালোয় ভালোয় মিটল তো?’
শেখর কিছু বুঝতে না পেরে ঘাড় নাড়ে।
হিতেন হাতে ঝোলানো বোয়াল মাছখানা বলরামকে দিয়ে বলে, ‘নে দেখি। আচ্ছা করে কষিয়ে রাঁধ তো। তোর ঐ চারা পোনার ঝোল খেতে খেতে পেটে চরা পরে গেছে। শেখরের সৌজন্যে আজ রাতে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হোক দেখি। আমি মুখ হাত পা ধুয়ে তাস খেলতে যাব। তখন নিবারণের বৌয়ের কাছ থেকে খান কতক রুটি নিয়ে আসবো। আমি রুটি খাবো। তুই রুটি বানানো মানে ভারতবর্ষের মানচিত্র বানাস আর তা দাঁত দিয়ে ছেঁড়া মানে ভীষণ গায়ের জোরের ব্যাপার’।
বলরাম মাছটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে, ‘তা বাবু মাছ দিয়ে রুটি খেতে কি ভালো লাগবে?’
হিতেন বেশ জোরের সঙ্গেই বলে, ‘আলবাৎ লাগবে। এতবার ভাত গেলার জন্যই সাহেবরা আমাদের কি বলে জানিস? ভেতো বাঙালী’।
হিতেনের সাহেবদের নিয়ে আরও কিছু গুণকীর্তন করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তার আগেই বলরাম বলে ওঠে, ‘ওমা উনুনে তো আঁচ গনগনিয়ে উঠে গেছে। আমি চায়ের জলটা চাপিয়ে দেই। মাসীও চলে গেছে। এখন এই এত বড়ো মাছ আমাকেই কুটতে হবে কিনা’।
শেখর কাঁঠালিচাঁপা গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিশ্চিন্ত হয় বিমান তার দ্বিতীয় বিবাহের কথা কিছু বলে নি। মনে মনে সে কৃতজ্ঞ বোধ করে বিমানের প্রতি। সত্যি বিমান তার প্রকৃতই বন্ধু।
হিতেন তার বিশাল পাঞ্জার হাতের পাতাখানা শেখরের ডান কাঁধে বাঘের থাবার মতো খপ করে ধরে বলে, ‘জন্ম মৃত্যু বিধাতার লিখন। তা নিয়ে মন খারাপ করো না ভায়া। তাছাড়া তোমার গ্র্যান্ড ফাদারের তো বয়সও হয়েছিল। তবে কি জানো ঐ জলা জঙ্গলের অশিক্ষিত জায়গা বলেই মানুষ অমন টুপটাপ মরে যায়। নতুবা এখন ভেদবমিতে কেউ মরে না। তবু তোমার মায়ের পিতৃবিয়োগ বলে কথা। সব সম্পর্কে দ্বিতীয়বারের একটা সুযোগ থাকলেও বাবা মা নির্বাচনে দ্বিতীয় সুযোগ থাকে না’।
শেখর এতক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে বিমানের বুদ্ধির তারিফ করে। না, খাসা ভাবনা। শেখরের ঠাকুরদা বললে শেখরকে মুণ্ডিত মস্তক না দেখলে অনেকেরই কৌতূহল জাগত। সেখানে মায়ের বাবা বলে বিমান একরকম শেখরকে সব দিক থেকে বাঁচিয়েই দিয়েছে।
হিতেন পকেট থেকে ঘড়িটা বার করে একবার সময় দেখে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলে, ‘এ হে। কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেল। নিবারণ তাস সাজিয়ে বসে থাকবে। আমি ঘরে গেলাম ভায়া’।
উঠোনে দাঁড়িয়ে শেখর দোতলায় নিজের ঘরের দিকে তাকায়। এতক্ষণে নজরে পড়ে ঘরটায় তালা দেওয়া। ঘরের মধ্যে দুধারে রাখা দুটো চৌকিতে বিমান আর শেখর থাকে। এই মেস বাড়িতে যারা ছাত্র তারাই একমাত্র একটা ঘরে দুজন করে থাকে। নতুবা সবাই যে যার মতো আস্ত এক একখানা ঘরে নিজেদের ইচ্ছামতো সংসার পাতিয়ে নিয়েছে। যেমন তারিণী ভট্টাচার্য্য নিজের ঘরের প্রায় তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে এক দেড়শ জনকে ঠাই দিয়ে ফেলেছে নিজের ঘরে। তার ঘরে ঢুকলেই সবসময় একটা ফুল বেলপাতা ধুপ ধুনোর গন্ধ পাওয়া যায়। হিতেনের ঘরে চুরুটের সুবাস, বিলিতি মদের গন্ধ ভুড়ভুড় করে। সমর আর বিষ্ণু ডাক্তারির ছাত্র। তাদের পড়ার টেবিলে মানুষের মাথার খুলি রাখা আছে। দেওয়াল জুড়ে একটা কঙ্কালের ছবি। সেখানে প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাম টিকচিহ্ন দিয়ে লাল কালিতে লেখা। প্রথমবার মানুষের মাথার খুলি অমনভাবে দেখে শেখর শিউড়ে উঠেছিল। তারপর একটা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয়। সমর কিন্তু বেমালুম খুলিখানা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলে, ‘জানো শেখর এটা একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষের মাথার খুলি। বেঁচে যখন ছিল তখন এই মাথার চুল নিয়ে হয়তো তার কতই না গর্ব ছিল। আজ দেখো সব মিথ্যে’।
এসব কথা শেখরের ভালো লাগে নি সেদিন। ঘরে এসে বিমানকে বলেছিল, ‘আচ্ছা বিমান আমাদের ঘরে কিসের গন্ধ বাতাসে ভাসে?’
বিমান একটু সময় শেখরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে সেদিন বলেছিল, ‘দিন বদলের’।
শেখর বুঝতে পারে নি। ফের শুধিয়েছিল, ‘মানে?’
বিমান সেদিন দুহাত উপরে তুলে অদ্ভুত গলায় বলেছিল, ‘সময় আসলে একদিন ঠিক তুমি নিজেও সেই গন্ধ পাবে’।
বন্ধ ঘরের তালাটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শেখরের বিজয়ের কথা মনে হয়। চাঁপা ফুলের সুবাসকে ছাড়িয়েও সে যেন সত্যি সত্যি অন্য ধরণের গন্ধ পেতে শুরু করে। এটাই কি সেই দিন বদলের গন্ধ। নাকি নিজের ভেতরকার বদলের গন্ধ।
বলরাম এসে বলে, ‘দাদাবাবু যাও না সেই কখন এসেছ নিজের চাবি দিয়ে ঘর খুলে ভেতরে যাও’।
স্মিত হাসে শেখর। বড়ো করুণ সে হাসি। কারণ চাবিখানা তো ভবানিপুরে বাড়িতে তার ঘরের দেরাজের ড্রয়ারে রয়ে গেছে। তাই বলরামকে বলে, ‘তাড়াহুড়োয় চাবি ফেলে এসেছি বলরামদা। বারান্দাতেই বসে বিমানের জন্য অপেক্ষা করি। তুমি বরং চা হয়ে গেলে আমাকে একটু দাও। মাথাটা ধরেছে’।
আসল কথা আন্নাদের বাড়ি চায়ের পাট থাকায় এবং তা নিয়মিত এ কদিন খেতে খেতে এই উষ্ণ তরলটির প্রতি তার কিঞ্চিৎ মোহ জন্মে গেছে। বারান্দায় বসে বিমানের বলা কথাটা মাথার ভেতর ফের কয়েকবার ঢালা উপুড় করে, ‘দিন বদলের গন্ধ’।
শেখরেরও এতক্ষণে খেয়াল হয় একটু আগেই বলরাম তাকে বলেছিল বিমান ঘরে আছে। সে তাই জিজ্ঞাসা করে, ‘বলরামদা তুমি তো একটু আগেই বললে বিমান ঘরে আছে’।
বলরাম বাঁ হাত দিয়ে বাঁ কান মুলে জিভ বার করে বলে, ‘হেই জগন্নাথ শেখরবাবু, বিমানবাবু দুপুরেই বেরিয়ে গেছে বেমালুম ভুলে গেছি। আসলে এ কারণেই তো খাঁটি মধুর দরকার ছিল’।
শেখর হা হয়ে তাকিয়ে থাকে বলরামের দিকে। বলরামের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারে না। আজ দুপুরে বিমানের বাইরে যাওয়ার সাথে 'মধু'র কি সম্পর্ক। বলরাম মাথা চুলকে নিজেই খোলসা করে। বেশ গুরুগম্ভীর গলায় বলে, ‘আমার অসুখ করেছে শেখরবাবু’।
শেখরের সবকিছু ঘুলিয়ে যায়। সে এবার জিজ্ঞাসা না করে পারে না, ‘তোমার কথার কিছু বুঝতে পারছি না আমি’।
বলরাম একটু কাছে এগিয়ে এসে রহস্যময় গলায় ফিসফিস করে বলে, ‘আমার ভুলে যাওয়ার অসুখ করেছে শেখরবাবু। কিছু মনে রাখতে পারছি না’।
শেখর ভ্রূ কুঁচকে বলে, ‘তোমার ভুলে যাওয়া ......, বিমানের দুপুরে বাইরে যাওয়ার সাথে ভুলে যাওয়ার সম্পর্ক ..............., তুমি আমাকে সবকিছু একটু খোলসা করে বলতো বলরাম’।
বলরাম অভ্যস্ত দুঃখকাতর গলায় জানায়, কে নাকি বলেছে, খাঁটি কালো মধু, তুলসীপাতা, গোলমরিচ দানা একসাথে থেঁতো করে খেলে ভুলে যাওয়া অসুখ সেরে যাবে। আকাশ থেকে পড়ে শেখর, এ তো সর্দি, কাশিতে খায়। বলরাম প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় জানায়, গতকাল তারিণীবাবু নাকি বলেছিল তার জন্য আলু, উচ্ছে, পেঁয়াজ দিয়ে আচ্ছা করে ভাজতে আর হিতেনবাবু বলেছিল তার জন্য আলু, উচ্ছে সিদ্ধ করতে, আর বাকিদের জন্য উচ্ছের শুক্তো। সে নাকি সব ভুলে উচ্ছে আর পেঁপে দিয়ে তরকারি করে রেখেছিল। সে নিয়ে চরম অশান্তি। হিতেনবাবু বলে দিয়েছে সামনে মাস থেকে চাকরি নট। বিমান এসে না দাঁড়ালে এ জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তার ঠিক নেই।
বলরামের কথা শুনে শেখর হাহা করে হেসে ওঠে। বলরাম মাথার টিকিতে হাত বোলায়। হা জগন্নাথ, সে হাসির কথাটা কি বলল। তবে কি দেশে গিয়ে শেখরবাবুরও মাথার ব্যামো হয়ে গেল। মধু, তুলসীপাতা, গোলমরিচ তবে তো শেখরেরও খাওয়ার দরকার। শেখর হাসতে হাসতে সিমেন্টের টানা লাল রঙের বারান্দাটায় বসে পড়ে। বলে, 'বলরামদা তোমার জায়গায় আমি থাকলে আরও ভুল হতো। একই উচ্ছের অতরকম রান্না ভুল হওয়া তো স্বাভাবিক'।
বলরামের চোখমুখে অপার বিস্ময়।
শেখর অভয় দেয়, ‘তুমি কিছু ভেবো না বলরামদা, তোমার মাথায় ভুলে যাওয়ার কোনও অসুখ বাসা করে নি এবং এর জন্য তোমায় কোনরকম মধু, তুলসীপাতা, গোলমরিচ খেতে হবে না। তবে তোমাকে আমি মধু আনিয়ে দেবো’।
বলরামের মুখে হাসি ফোটে। ভুলু সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ‘কেউ’ করে আদরের ডাক ডেকে ওঠে। লেজ নাড়তে থাকলে শেখরও তাকায়। বেশ অনেকগুলো ঝুলি-ঝোলা নিয়ে বিমানকে আসতে দেখে শেখর ছুটে গিয়ে বিমানকে জড়িয়ে ধরে। বিমান আপ্লুত হয়ে পড়ে। চোখে জল এসে পড়ে, ‘শেখর তুমি এতদিন পরে এলে। তোমার জন্য চিন্তায় আমার অস্থির অস্থির লাগতো’।
শেখর কেঁদেই ফেলে, ‘তুমি তো সব জানো বিমান, আমি কি আতান্তরে পড়েছিলাম’।
বিমান থামিয়ে দেয় শেখরকে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আগে ঘরে চল, বিশ্রাম নাও। এতটা পথ এসেছো’।
দুই বন্ধুর এমন অন্তরঙ্গ মিলন দৃশ্যে বলরামের খুব আনন্দ হয়। সে বলে, ‘যাও যাও ঘরে যাও তোমরা, আমি চা মুড়ি, তেলেভাজা দিয়ে আসছি’।
ভুলুও লেজ নাড়তে নাড়তে তার খুশি প্রকাশ করে। অনেক অনেক দিন বাদে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গ শেখরকে যেন সত্যিকারের খুশির সন্ধান দেখায়।
এই লেখাটা কি আর এগোবে না??!! মা, ছোটমামা, খেন্তিপিসি, বুড়োদাদা, পচাকাকা, ভুটাই (যাহাদের আমি ভালো লেখা ফরওয়ার্ড করিয়া থাকি) সবাই আমায় তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কি একটু লেখিকাকে জিগাবেন?