এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • যোজনগন্ধ্যা - দ্বিতীয় খণ্ড

    Tanwi,. Halder লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০২ মার্চ ২০২০ | ৫০০৮ বার পঠিত
  • যোজনগন্ধ্যা

    দ্বিতীয় খণ্ড

    ২১

    যে কোনও কিছুর শুরু আর শেষের মধ্যে একটা বর্ণময় আলো-আঁধারি থাকে। থাকে এক অনন্য প্রাপ্তি। অসীম নীলাকাশ। আর সীমাহীন বারিধি। যেখানে জীবন ঢ্যালা মাটির সাথে মণিমাণিক্যও কুড়িয়ে নেয়। রোদের কস্তূরী ভেঙে ভেঙে ঐরাবত মেঘগুলো ধেয়ে আসে বাঁধনের শিকল কেটে। মুক্তি। উল্লাস। চাওয়া পাওয়ার বাষ্প জমলেই ক্লান্তি নামবে বুকের পাঁজর ঘেঁষে। রোমকূপে বাসা বাঁধে তখন মন খারাপের ঢেউ। মহাবিশ্ব জুড়ে জমতে থাকে চাপ চাপ রক্তের মতো আলকাতরা অন্ধকার। হয়তো বা এটাই সেই উলঙ্গ সত্য। নির্মম বাস্তব।
    মেয়ে যখন বিয়ের পরে বাপের বাড়ি থেকে কনকাঞ্জলি করে বিদায় নেয় তখন তাকে বাড়ির বড়রা পইপই করে বলে দেয় সে যেন আর পিছু ফিরে না তাকায়। শেখরও কি তেমনটাই ভাবছে? সেই রাত থাকতে কালু বাউরিদের সাথে রওনা দিয়ে পালকি করে কলকাতার মেস বাড়িতে সূর্য নিভুনিভু বিকেলে এসে পৌঁছেছে। অত ভোরে আন্না ঘুম ঘোরে বোধহয় ঠিক ঠাহর করতে পারে নি শেখর সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে। বৈঁচি যখন নিজের মেয়েকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করে বলে, ‘ওরে মুখপুড়ি তোকে কি কালঘুমে পেয়েছে? বাবাজীবন তো চলে যাচ্ছে’, তখনও আন্না ঘুমের ঘোরে উ উ করে কি যেন বলে পাস ফিরে শোয়। বিজয় বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আঃ ওকে ছেড়ে দাও না আন্নার মা। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে, ঘুমোতে দাও’। শেখরও ভেবেছিল এই বুঝি আন্না উঠে হাত-পা ছুঁড়ে শেখরের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না করে কান্না জুড়ে দেয়। কিন্তু তা না হতে শেখরেরও পুরুষত্ব কোথায় যেন টাল খায়। স্বামিত্বে আঘাত লাগে। বৈঁচি সারারাত ধরে আঁচলে চোখ মুছে শেখরের জন্য প্রচুর মুড়ি-মুড়কী নাড়ু ফলপাকুড় গুছিয়ে দেয়। বিজয়কে সে বারবার অনুরোধ করেছিল আন্নাকে শেখরের সঙ্গে পাঠাতে। কিন্তু শেখরের নিজেরই কলকাতায় নিজস্ব ঠাই না থাকায় মেস বাড়িতে কেমন করে মেয়েকে পাঠাবে। সেজন্য বৈঁচির এই অনুরোধ বিজয় রাখতে পারে নি। তবে আশার কথা এই যে শেখর বৈঁচিকে কথা দিয়ে এসেছে যত শীঘ্র সম্ভব বাসা বাড়ি দেখে সে পত্র মারফৎ খবর দেবে। আর তখন বিজয় গিয়ে আন্নাকে সেখানে রেখে আসবে।

    কলকাতা শহরে সুন্দরবনের মতো ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আঁধার ঘনিয়ে আসে না। এখানে কলকারখানার বাঁশীর সাথে বিকেল শেষ হয়। বাতাসে ধোঁয়ারা ভেসে বেড়ায়। রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসবাতির আলো রাতের কালিমাকে মুছে দিনের আলোর গরিমা দান করে। সাহেব সুবোদের ঘোড়ার গাড়ির ফিটন গাড়ির শব্দে নিস্তব্ধতা ভাঙে। কখনও কখনও বাঙালী বাবুসমাজও সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টাকার জোরে রাতকে দিন করার চেষ্টা করে। বাইজী, খ্যামটা নাচগানে হুল্লোড় তোলে বারমহল। সেখানে প্রতিযোগিতা চলে কোন বাবু বা জমিদার একরাতে কত টাকা ওড়াতে পারল। কিম্বা নিজের বাঁধা মেয়েমানুষটিকে কত দামী গয়না দিতে পারলো। বিমান একদিন রাগে দুঃখে ফেটে পড়ে বলেছিল, ‘জান ভাই শেখর, নীলকর সাহেবেরা আমাদের যত না শত্রু তার থেকে ঢের বেশি শত্রু এই আমাদের দেশীয় রাজাগজারা। তারা যদি দেশীয় মানুষদের কথা ভাবতো তবে আজ আমাদের এই দুর্গতি দাঁড়াতো না। কথায় বলে না দশের লাঠি একের বোঝা। তারা যদি একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াতো তাহলে আজ আমাদের পরাধীন থাকতে হয়? ঐ সাদা চামড়ার কতগুলো মাত্র মানুষ এসে আমাদের উপর কর্তামি ফলিয়ে যাচ্ছে আর আমরা মুখ বুজে তা দিনের পর দিন মেনে নিচ্ছি। আর তারা রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়ার জন্য ইংরেজের পদলেহন করতে ব্যস্ত। তাদের দিনের পর দিন উপঢৌকন পাঠিয়ে যাচ্ছে। ধিক এইসব রাজাগজার দলকে’। সেদিনের বিমানের উষ্মার বিষয় শেখর অনুধাবন করতে পারেনি কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিশেষত আন্নাদের বাড়িতে কয়েক মাস থাকার ফলে বিজয়ের সংস্পর্শে এসে শেখরের মনেও এক নতুন চেতনার আলোর জন্ম হয়েছে। শেখর যেন একটু একটু সাদা কালোর প্রভেদ বুঝতে শিখে গেছে। ইংরেজরা তাদের শুধু পরাধীন করে রাখে নি, পরাধীনতার আড়ালে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। সমস্ত অর্থেই শেখরের মনে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যার জন্য শেখরের এই আমূল পরিবর্তন সেই আন্না শেখরের চিন্তাভাবনার জগতে কোথাও এতটুকু আঁচড় কাটতে পারছে না। কলকাতার এইসব দেশীয় বাবুরা বেশী বেশী মুনাফা লাভের আশায় সুন্দরবনের অনাবাদী জমির লাটকে লাট ইজারা নিয়ে পত্তন করার ব্যবস্থা করছে। তারা নিজেরা সারা বছরে একবারও হয়তো যায় না। দেশীয় একজন গোমস্তাকে নায়েব হিসেবে সেখানে বহাল করে মৌমাছির চাকের বিশুদ্ধ মধুটুকু পান করে যাচ্ছে। আর এইসব নায়েবরা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় প্রমাণ করতে সেখানকার সাধারণ মানুষদের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। যত রকম অত্যাচার, লুম্পেনবাজি, শঠতা করা যায় করে যাচ্ছে। মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না। বনের পশুরাও সেখানে যেটুকু মর্যাদা পায় এই কালো কেলো, গরীব গুর্বো, অসহায় মানুষগুলো সেটুকুও পায় না। শেখরের জীবনের এই কয়েক মাসের উথাল পাতাল জীবনে বুঝতে পেরে গেছে যে এতদিন প্রকৃত অর্থেই নাবালক ছিল সে। কলকাতার হিন্দু কলেজে পড়তে আসা নবচেতনায় জাগ্রত এইসব শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়কে শেখর যেন ঠিক বুঝতে পারতো না। সে ভোগবিলাসী না হয়েও তার চেতনার জগতে কোথাও যেন ভোগেরই পাঁকে ডুবে ছিল। তার মনের ভেতর এতদিন আন্না ভিন্ন আর কেউ বাসা বাঁধতে পারে নি।

    কালুর দলবল হেঁদুয়ার কাছে শেখরদের মেস বাড়ির সামনে যখন পালকি নামায় তখন সূর্য নিভুনিভু। কালু খুব আন্তরিক গলায় বলে, ‘সাবধানে থেকো গো বাবুমশাই। তোমার উপর দিয়ে খুব ঝড় বয়ে গেছে’। কিন্তু যে কথা গোপন করে তা হল কিছুদিনের মধ্যেই সে পুনরায় রোজিপুর গ্রামে ফিরে যেতে চায়। ‘ধর্মগোলা’ স্থাপনে সে বিজয়ের পাশে দাঁড়াতে চায়।
    মেস বাড়ির সদর দরজার ভেতরে পা দিয়ে উঠোনের ডান দিকে বারোমেসে কাঁঠালি চাঁপা ফুল গাছের ফুলের গন্ধে শেখরের মনের ভেতরে এই দোতলা মেস বাড়িটার আনাচ কানাচ সবকিছু ছবির মতো ভেসে ওঠে। প্রথমে রাঁধুনি উড়ে বামুন বলরামের নজরে পড়ে সে। এতদিন পর শেখরকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। কয়লা ভাঙছিল সে। সেইভাবেই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে আসে, ‘ওমা শেখর বাবু যে’ বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
    শেখর যেদিন এখান থেকে যায় এই রান্নার ঠাকুরটি তাকে বারবার করে সুন্দরবনের খাঁটি মধু আনতে বলে দিয়েছিল। কিন্তু শেখরের হাতে একটি তোরঙ্গ ও একটি পুটুলি ভিন্ন অন্য কিছু না থাকায় বেচারি খুব মুষড়ে পড়ে। ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করেই ফেলে, ‘শেখর বাবু আমার মধু আনো নি?’
    কিন্তু শেখরের সেখানে গিয়ে অব্দি যা যা ঘটে গেছে রান্নার ঠাকুরের মধু আনার কথা বেমালুম কপ্পুরের মতো উবে গেছে। তবু এখন মনে করে যাওয়ার সময় রান্নার ঠাকুরকে সে কথা দিয়ে গেছিল মধু এনে দেবে। তাই কুণ্ঠার সঙ্গে বলে, ‘না বলরামদা। সেখানে গিয়ে পর্যন্ত আমি খুব সমস্যার মধ্যে ছিলাম। তাই মধু আনতে পারি নি। তবে তোমায় কথা দিচ্ছি এবার দেশে যাওয়ার আগে ঠিক মধু আনিয়ে দেবো। আচ্ছা বিমান ঘরে আছে?’
    বলরাম জানায়, ‘হ্যাঁ, কোথায় যেন গেছিল। একটু আগেই ফিরল’।
    শেখর আর এক মুহূর্ত কাল বিলম্ব না করে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে পড়িমরি করে দৌড় লাগায়।
    বলরাম চেঁচায়, ‘আস্তে যাও গো। হোঁচট খেয়ে পড়বে’।
    সিঁড়ির ধাপগুলো শেখরের কাছে অনন্ত মনে হয়। মনে হয় এই ধাপ অতিক্রম করে সে কি কোনোদিন তার প্রিয় সখা বিমানের কাছে পৌঁছতে পারবে!

    ভুলু কুকুরটাও কোথায় ছিল। শেখরকে দেখে ছুটে এসে ঘেউউ – কেউউ করে ডেকে লেজ নাড়াতে থাকে। ভুলু এতদিন বাদেও তাকে চিনতে পেরেছে দেখে শেখরের আহ্লাদের সীমা থাকে না। ভুলু শেখরের সামনে দাঁড়িয়ে সমানে লেজ নাড়তে থাকে। শেখর আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘ওমা দেখ বলরামদা ভুলু আমাকে মনে রেখেছে’।
    মধু না পাওয়ার দুঃখ তখন কিঞ্চিৎ অভিমানের রঙ নিয়েছে বলরামের। সে উনুনের মুখে তালপাতার বাতাস দিতে দিতে বলে, ‘হ্যাঁ মানুষেরাই শুধু ভুলে যায়’।
    এ কথার গভীর অর্থ অনুধাবন করার মতো অবস্থা তখন শেখরের নেই। সে তার নিজের পরিচিত পরিবেশে পরিচিত মানুষদের বাড়িতে ফিরে এসে আনন্দে বিভোর। সে নিজের মনেই ভুলুকে বলে, ‘রাগ করিস না ভুলু তোর জন্যও কিছু আনা হয় নি। যে অবস্থার ভেতর দিয়ে দিনগুলো পার করলাম’।

    হিতেন মজুমদার কোন একটা অফিসে ইংরেজের অধীনে খাস কর্মচারী। সে অফিস থেকে ফিরছে। হাট করা সদর দরজা দেখে বলরামের মুণ্ডুপাত করতে করতে ঢুকে রীতিমত তাজ্জব বনে যায়। খুব দিল খোলা দরাজ মনের মানুষ। হেঁকে ডেকে সবসময় কথা কয়। শেখরকে দেখে হাতে ঝোলানো শোওয়া দুই কেজি ওজনের বোয়াল মাছটাকে দিয়েই উঁচু করে অভিনন্দন করে উঠে বলে, ‘আরে ইয়ং ম্যান, কখন এলে? এদ্দিনে তোমার বাড়ির সব ভালোয় ভালোয় মিটল?’
    কি বলবে শেখর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিল না। শেখরের এতদিন বাড়িতে পড়ে থাকার কারণ এখানে আর কেউ না হোক বিমান যে জানে সেটা এখানকার সকলেই জানে। কিন্তু বিমান যে এখানে সকলের কাছে শেখরের অন্তর্ধান সম্পর্কে ঠিক কি বলেছে তা শেখরের অজানা। তাই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতোই নিজেকে বোধ করে। শেখর ভাবনার আতান্তরে পড়ে, ঠিক কি যে বলেছে বিমান এখানকার সকলের সাথে কে জানে! সে কি শেখরের দ্বিতীয় বিবাহের কথা সকলকে বলে দিয়েছে, ছি ছি ছি তালে তো লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। এখানে একমাত্র তারিণী ভট্টাচার্য্য বাবু ছাড়া কেউই প্রায় কুলীন প্রথা সমর্থন করে না। এখানে তারই একমাত্র তিনটে বিবাহ। হিতেন তো মানেই না। সে প্রচণ্ডই কেতাদুরস্ত। চলনে বলনে সাহেবদের মতোই হাবভাব। সবসময় স্যুট বুট টাই পরে থাকে। ইংরেজদের গুণগান করতে পারলেই যেন জীবন ধন্য। বিমান এই বাঙালী বাবুদের টাই পরা নিয়ে প্রায় মশকরা করে বলে, ‘বুঝলে ভাই শেখর এই টাই হচ্ছে বকলেস। মনিব যেমন তার পোষা সারমেয়টির গলায় বকলেস পরিয়ে রাখে এও ঠিক তেমনি। একটু ব্যাগরবাই করেছো তো বকলেস ধরে মারো টান’। হিতেনের গলায় ঝোলানো নীল রঙের সাটিনের কাপড়ের টাইটির দিকে তাকিয়ে এসব হিবিজিবি ভেবে যাচ্ছিল শেখর।
    হিতেন আবার বলে ওঠে, ‘কি ইয়ং ম্যান তা তোমার গ্র্যান্ড ফাদারের পারলৌকিক ক্রিয়াদি ভালোয় ভালোয় মিটল তো?’
    শেখর কিছু বুঝতে না পেরে ঘাড় নাড়ে।
    হিতেন হাতে ঝোলানো বোয়াল মাছখানা বলরামকে দিয়ে বলে, ‘নে দেখি। আচ্ছা করে কষিয়ে রাঁধ তো। তোর ঐ চারা পোনার ঝোল খেতে খেতে পেটে চরা পরে গেছে। শেখরের সৌজন্যে আজ রাতে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হোক দেখি। আমি মুখ হাত পা ধুয়ে তাস খেলতে যাব। তখন নিবারণের বৌয়ের কাছ থেকে খান কতক রুটি নিয়ে আসবো। আমি রুটি খাবো। তুই রুটি বানানো মানে ভারতবর্ষের মানচিত্র বানাস আর তা দাঁত দিয়ে ছেঁড়া মানে ভীষণ গায়ের জোরের ব্যাপার’।
    বলরাম মাছটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে, ‘তা বাবু মাছ দিয়ে রুটি খেতে কি ভালো লাগবে?’
    হিতেন বেশ জোরের সঙ্গেই বলে, ‘আলবাৎ লাগবে। এতবার ভাত গেলার জন্যই সাহেবরা আমাদের কি বলে জানিস? ভেতো বাঙালী’।
    হিতেনের সাহেবদের নিয়ে আরও কিছু গুণকীর্তন করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তার আগেই বলরাম বলে ওঠে, ‘ওমা উনুনে তো আঁচ গনগনিয়ে উঠে গেছে। আমি চায়ের জলটা চাপিয়ে দেই। মাসীও চলে গেছে। এখন এই এত বড়ো মাছ আমাকেই কুটতে হবে কিনা’।
    শেখর কাঁঠালিচাঁপা গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিশ্চিন্ত হয় বিমান তার দ্বিতীয় বিবাহের কথা কিছু বলে নি। মনে মনে সে কৃতজ্ঞ বোধ করে বিমানের প্রতি। সত্যি বিমান তার প্রকৃতই বন্ধু।
    হিতেন তার বিশাল পাঞ্জার হাতের পাতাখানা শেখরের ডান কাঁধে বাঘের থাবার মতো খপ করে ধরে বলে, ‘জন্ম মৃত্যু বিধাতার লিখন। তা নিয়ে মন খারাপ করো না ভায়া। তাছাড়া তোমার গ্র্যান্ড ফাদারের তো বয়সও হয়েছিল। তবে কি জানো ঐ জলা জঙ্গলের অশিক্ষিত জায়গা বলেই মানুষ অমন টুপটাপ মরে যায়। নতুবা এখন ভেদবমিতে কেউ মরে না। তবু তোমার মায়ের পিতৃবিয়োগ বলে কথা। সব সম্পর্কে দ্বিতীয়বারের একটা সুযোগ থাকলেও বাবা মা নির্বাচনে দ্বিতীয় সুযোগ থাকে না’।
    শেখর এতক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে বিমানের বুদ্ধির তারিফ করে। না, খাসা ভাবনা। শেখরের ঠাকুরদা বললে শেখরকে মুণ্ডিত মস্তক না দেখলে অনেকেরই কৌতূহল জাগত। সেখানে মায়ের বাবা বলে বিমান একরকম শেখরকে সব দিক থেকে বাঁচিয়েই দিয়েছে।
    হিতেন পকেট থেকে ঘড়িটা বার করে একবার সময় দেখে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলে, ‘এ হে। কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেল। নিবারণ তাস সাজিয়ে বসে থাকবে। আমি ঘরে গেলাম ভায়া’।

    উঠোনে দাঁড়িয়ে শেখর দোতলায় নিজের ঘরের দিকে তাকায়। এতক্ষণে নজরে পড়ে ঘরটায় তালা দেওয়া। ঘরের মধ্যে দুধারে রাখা দুটো চৌকিতে বিমান আর শেখর থাকে। এই মেস বাড়িতে যারা ছাত্র তারাই একমাত্র একটা ঘরে দুজন করে থাকে। নতুবা সবাই যে যার মতো আস্ত এক একখানা ঘরে নিজেদের ইচ্ছামতো সংসার পাতিয়ে নিয়েছে। যেমন তারিণী ভট্টাচার্য্য নিজের ঘরের প্রায় তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে এক দেড়শ জনকে ঠাই দিয়ে ফেলেছে নিজের ঘরে। তার ঘরে ঢুকলেই সবসময় একটা ফুল বেলপাতা ধুপ ধুনোর গন্ধ পাওয়া যায়। হিতেনের ঘরে চুরুটের সুবাস, বিলিতি মদের গন্ধ ভুড়ভুড় করে। সমর আর বিষ্ণু ডাক্তারির ছাত্র। তাদের পড়ার টেবিলে মানুষের মাথার খুলি রাখা আছে। দেওয়াল জুড়ে একটা কঙ্কালের ছবি। সেখানে প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাম টিকচিহ্ন দিয়ে লাল কালিতে লেখা। প্রথমবার মানুষের মাথার খুলি অমনভাবে দেখে শেখর শিউড়ে উঠেছিল। তারপর একটা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয়। সমর কিন্তু বেমালুম খুলিখানা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলে, ‘জানো শেখর এটা একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষের মাথার খুলি। বেঁচে যখন ছিল তখন এই মাথার চুল নিয়ে হয়তো তার কতই না গর্ব ছিল। আজ দেখো সব মিথ্যে’।
    এসব কথা শেখরের ভালো লাগে নি সেদিন। ঘরে এসে বিমানকে বলেছিল, ‘আচ্ছা বিমান আমাদের ঘরে কিসের গন্ধ বাতাসে ভাসে?’
    বিমান একটু সময় শেখরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে সেদিন বলেছিল, ‘দিন বদলের’।
    শেখর বুঝতে পারে নি। ফের শুধিয়েছিল, ‘মানে?’
    বিমান সেদিন দুহাত উপরে তুলে অদ্ভুত গলায় বলেছিল, ‘সময় আসলে একদিন ঠিক তুমি নিজেও সেই গন্ধ পাবে’।
    বন্ধ ঘরের তালাটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শেখরের বিজয়ের কথা মনে হয়। চাঁপা ফুলের সুবাসকে ছাড়িয়েও সে যেন সত্যি সত্যি অন্য ধরণের গন্ধ পেতে শুরু করে। এটাই কি সেই দিন বদলের গন্ধ। নাকি নিজের ভেতরকার বদলের গন্ধ।
    বলরাম এসে বলে, ‘দাদাবাবু যাও না সেই কখন এসেছ নিজের চাবি দিয়ে ঘর খুলে ভেতরে যাও’।
    স্মিত হাসে শেখর। বড়ো করুণ সে হাসি। কারণ চাবিখানা তো ভবানিপুরে বাড়িতে তার ঘরের দেরাজের ড্রয়ারে রয়ে গেছে। তাই বলরামকে বলে, ‘তাড়াহুড়োয় চাবি ফেলে এসেছি বলরামদা। বারান্দাতেই বসে বিমানের জন্য অপেক্ষা করি। তুমি বরং চা হয়ে গেলে আমাকে একটু দাও। মাথাটা ধরেছে’।
    আসল কথা আন্নাদের বাড়ি চায়ের পাট থাকায় এবং তা নিয়মিত এ কদিন খেতে খেতে এই উষ্ণ তরলটির প্রতি তার কিঞ্চিৎ মোহ জন্মে গেছে। বারান্দায় বসে বিমানের বলা কথাটা মাথার ভেতর ফের কয়েকবার ঢালা উপুড় করে, ‘দিন বদলের গন্ধ’।

    শেখরেরও এতক্ষণে খেয়াল হয় একটু আগেই বলরাম তাকে বলেছিল বিমান ঘরে আছে। সে তাই জিজ্ঞাসা করে, ‘বলরামদা তুমি তো একটু আগেই বললে বিমান ঘরে আছে’।
    বলরাম বাঁ হাত দিয়ে বাঁ কান মুলে জিভ বার করে বলে, ‘হেই জগন্নাথ শেখরবাবু, বিমানবাবু দুপুরেই বেরিয়ে গেছে বেমালুম ভুলে গেছি। আসলে এ কারণেই তো খাঁটি মধুর দরকার ছিল’।
    শেখর হা হয়ে তাকিয়ে থাকে বলরামের দিকে। বলরামের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারে না। আজ দুপুরে বিমানের বাইরে যাওয়ার সাথে 'মধু'র কি সম্পর্ক। বলরাম মাথা চুলকে নিজেই খোলসা করে। বেশ গুরুগম্ভীর গলায় বলে, ‘আমার অসুখ করেছে শেখরবাবু’।
    শেখরের সবকিছু ঘুলিয়ে যায়। সে এবার জিজ্ঞাসা না করে পারে না, ‘তোমার কথার কিছু বুঝতে পারছি না আমি’।
    বলরাম একটু কাছে এগিয়ে এসে রহস্যময় গলায় ফিসফিস করে বলে, ‘আমার ভুলে যাওয়ার অসুখ করেছে শেখরবাবু। কিছু মনে রাখতে পারছি না’।
    শেখর ভ্রূ কুঁচকে বলে, ‘তোমার ভুলে যাওয়া ......, বিমানের দুপুরে বাইরে যাওয়ার সাথে ভুলে যাওয়ার সম্পর্ক ..............., তুমি আমাকে সবকিছু একটু খোলসা করে বলতো বলরাম’।
    বলরাম অভ্যস্ত দুঃখকাতর গলায় জানায়, কে নাকি বলেছে, খাঁটি কালো মধু, তুলসীপাতা, গোলমরিচ দানা একসাথে থেঁতো করে খেলে ভুলে যাওয়া অসুখ সেরে যাবে। আকাশ থেকে পড়ে শেখর, এ তো সর্দি, কাশিতে খায়। বলরাম প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় জানায়, গতকাল তারিণীবাবু নাকি বলেছিল তার জন্য আলু, উচ্ছে, পেঁয়াজ দিয়ে আচ্ছা করে ভাজতে আর হিতেনবাবু বলেছিল তার জন্য আলু, উচ্ছে সিদ্ধ করতে, আর বাকিদের জন্য উচ্ছের শুক্তো। সে নাকি সব ভুলে উচ্ছে আর পেঁপে দিয়ে তরকারি করে রেখেছিল। সে নিয়ে চরম অশান্তি। হিতেনবাবু বলে দিয়েছে সামনে মাস থেকে চাকরি নট। বিমান এসে না দাঁড়ালে এ জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তার ঠিক নেই।
    বলরামের কথা শুনে শেখর হাহা করে হেসে ওঠে। বলরাম মাথার টিকিতে হাত বোলায়। হা জগন্নাথ, সে হাসির কথাটা কি বলল। তবে কি দেশে গিয়ে শেখরবাবুরও মাথার ব্যামো হয়ে গেল। মধু, তুলসীপাতা, গোলমরিচ তবে তো শেখরেরও খাওয়ার দরকার। শেখর হাসতে হাসতে সিমেন্টের টানা লাল রঙের বারান্দাটায় বসে পড়ে। বলে, 'বলরামদা তোমার জায়গায় আমি থাকলে আরও ভুল হতো। একই উচ্ছের অতরকম রান্না ভুল হওয়া তো স্বাভাবিক'।
    বলরামের চোখমুখে অপার বিস্ময়।
    শেখর অভয় দেয়, ‘তুমি কিছু ভেবো না বলরামদা, তোমার মাথায় ভুলে যাওয়ার কোনও অসুখ বাসা করে নি এবং এর জন্য তোমায় কোনরকম মধু, তুলসীপাতা, গোলমরিচ খেতে হবে না। তবে তোমাকে আমি মধু আনিয়ে দেবো’।
    বলরামের মুখে হাসি ফোটে। ভুলু সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ‘কেউ’ করে আদরের ডাক ডেকে ওঠে। লেজ নাড়তে থাকলে শেখরও তাকায়। বেশ অনেকগুলো ঝুলি-ঝোলা নিয়ে বিমানকে আসতে দেখে শেখর ছুটে গিয়ে বিমানকে জড়িয়ে ধরে। বিমান আপ্লুত হয়ে পড়ে। চোখে জল এসে পড়ে, ‘শেখর তুমি এতদিন পরে এলে। তোমার জন্য চিন্তায় আমার অস্থির অস্থির লাগতো’।
    শেখর কেঁদেই ফেলে, ‘তুমি তো সব জানো বিমান, আমি কি আতান্তরে পড়েছিলাম’।
    বিমান থামিয়ে দেয় শেখরকে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আগে ঘরে চল, বিশ্রাম নাও। এতটা পথ এসেছো’।
    দুই বন্ধুর এমন অন্তরঙ্গ মিলন দৃশ্যে বলরামের খুব আনন্দ হয়। সে বলে, ‘যাও যাও ঘরে যাও তোমরা, আমি চা মুড়ি, তেলেভাজা দিয়ে আসছি’।
    ভুলুও লেজ নাড়তে নাড়তে তার খুশি প্রকাশ করে। অনেক অনেক দিন বাদে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গ শেখরকে যেন সত্যিকারের খুশির সন্ধান দেখায়। (ক্রমশ)

    ২২

    নিজেদের ঘরে ঢুকে বিমান শেখরকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে, “শেখর এই প্রবন্ধখানা লিখেছি, শোনো। তোমার মতামতের আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে ...... মুঘল তথা দেশীয় শক্তিসমূহের অবক্ষয়ের সহিত ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বে সমগ্র পৃথিবীতেই ভারতীয় নীলের বাজার বিস্তৃত হয়। ফরাসী বণিক লুই বোর্ণড ছিলেন হুগলী অঞ্চলের প্রথম নীলকর। ১৭৮০ অব্দের মধ্যভাগে কোম্পানির উদ্যোগে প্রায় একডজন ইউরোপীয় নীলকর বাংলায় নীল উৎপাদনের কাজে যুক্ত হইয়াছিলেন। ১৭৯০-এ গভর্ণর ইন কাউন্সিলকে লেখা চিঠিতে একজন নীল কুঠিয়াল ক্যারল ব্লুম সরকারের নিকট হইতে নীল চাষ সম্পর্কে সকল প্রকার সহযোগিতা প্রার্থনা করেন ও তা মঞ্জুর হয়। সে সময়কার নবজাগরণের অন্যতম মুখ রাজা রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর চাহিয়াছিলেন নীল চাষের মাধ্যমে জনগণের উন্নতি হউক।
    প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিত প্লীনি প্রভৃতি মনীষীরা ইন্ডিকাম বলিয়া নীলের বর্ণনা করিয়াছিলেন। নীল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Indigofera tinctoria। Indigo নামের সহিত হিন্দুস্থান নামের একটি সম্পর্ক আছে। ইংরেজ আমলে প্রথম ভাগে আমেরিকা হইতে নীল উৎপাদনের নূতন প্রণালী এদেশে আসে এবং উহার প্রবর্তক ফরাসী বণিক লুই বোর্ণড। তিনি ১৭৩৭ অব্দে ফ্রান্সের অন্তর্গত মাসেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে গিয়া দৈবক্রমে নীলের ব্যবসা শিক্ষা করেন। তিনিই ১৭৭৭ অব্দে বঙ্গদেশে আসিয়া চন্দননগরের নিকটবর্তী তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় দুইটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। ক’বছর পর মালদহে একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। সেখানে চুনের অভাব দেখিয়া একটি মুসলমান কবরখানা হইতে মনুষ্যাস্থি উঠাইয়া পুড়াইয়া চুন প্রস্তুত করেন।
    এমন কি ১৮১৫-১৬ অব্দে বঙ্গদেশ হইতে সমস্ত পৃথিবীতে নীল সরবরাহ হইত, বিশেষত নদীয়া, যশোহর জেলার নীল ছিল সে সময় জগতের ভেতর বিখ্যাত। প্রথম দিকে জমিদারদের অধীনে অল্প জমিতে নীলকর সাহেবেরা রায়তের সাহায্যে নীলের চাষ করিত। ১৮১৯ অব্দের অষ্টম আইনে জমিদারদিগের পত্তনী তালুক বন্দোবস্ত করিবার অধিকার দেওয়ায় এক এক পরগণার ভেতর অসংখ্য তালুকের সৃষ্টি হয়। দেশের ধনী ব্যক্তিরাও নিজের অথবা পরের জমিদারির মধ্যে পৃথকভাবে পত্তনী লইয়া নীলের ব্যবসায় যোগ দিতেন। নড়াইয়েলের জমিদার ‘সাহেব’ ম্যানেজার পর্যন্ত রাখিয়াছিল”।
    শেখর বড়ো উশখুশ করছিল কিছু বলবার জন্য। তা লক্ষ্য করে বিমান বলে, ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও শেখর?’
    শেখর এতটা পথ পরিশ্রমে সত্যি ক্লান্ত ছিল। এছাড়া সে বিমানের মতো সত্যি বাইরের জগতের খবর খুব কিছু রাখে নি কোনদিন। তবু বিমানের সঙ্গে তার অদ্ভুত বন্ধুত্ব ছিল। বিমানের প্রতি মুগ্ধতাও আছে শেখরের। বিমানের মধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু বিমানের চৌখস জ্ঞান, বাস্তব বুদ্ধি, অপরিমেয় পৌরুষের দৃঢ়তা সবসময় আকৃষ্ট করে শেখরকে। অর্থ, বিত্তে প্রাচুর্যের মোড়কে ঢাকা থেকেও বিমানের পাশে শেখর যেন এলেবেলে দুধভাত। তবে বিমান শেখরকে পছন্দ করে তার সহজ সরল মনোবৃত্তির জন্য। অত প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও বড়ো সাধারণ, নিরহংকার। মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে, ভালোবাসে।
    শেখর বলে, ‘না বিমান আমি তেমন কিছু বলতে চাইছি না। শুধু বলতে চাইছি নীল চাষ তো আইন করে বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে তুমি এই প্রবন্ধ লিখছ কেন? এখন কি দরকার এসব দিয়ে?’
    বিমান নিজের বিছানার ওপর আধশোওয়া হয়ে বলে, ‘ভায়া নিজের ব্যক্তিজীবনের বাইরে তো কোনও কিছুর খোঁজ রাখলে না, এখনও নদীয়া, যশোহরে কত চোরাগোপ্তা নীল চাষ হচ্ছে জানো? নীলকুঠিগুলো দেখলে আমার বুকের ভেতর আগুন জলে শেখর। তবে সব থেকে যন্ত্রণার কথা কি জানো, বাংলার রায়তরা যখন নীলকরদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল তখনও কিন্তু দেশীয় জমিদাররা কৃষকের লড়াইয়ে তার পাশে দাঁড়ায় নি। নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হ্যাসেল নীল কমিশনে সাক্ষ্যে এইসব জমিদারদের নোংরা ভূমিকাকে লক্ষ্য করে বলেন - তারা ইচ্ছা করলে কৃষকদের সাহায্য করতে পারতো কিন্তু তা না করে নীলকরদেরই সাহায্য করে। ভাবতে পারো নদীয়ার কুখ্যাত নীলকর লারমুরকে বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করে জমিদার শ্যামচন্দ্র পাল ও হাবির উল হোসেন’।
    এ আলোচনা হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলতো, বাধ সাধল বলরামের এক হাতে খোপ খোপ পাত্রে ঝোলানো চায়ের গ্লাস আর অন্য হাতে বেগুনি মুড়ির সুগন্ধ। বিমান, শেখর দুজনেই উসখুস করে ওঠে। বিদ্রোহ ভুলে দুজনেই বলরামের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে। বলরাম অভিভাবকের সুরে বলে, ‘অনেক দিন বাদে দুই বন্ধু একে অপরকে পেয়ে গল্প আর শেষ হচ্ছে না তাই তো? তা বেশ। কিন্তু একজন সেই কত পথ এয়েছে পথে কি পেটে পড়েছে জগন্নাথই জানে। আর একজন তো কলেজের পড়া কি করে জানি না তবে দেশ উদ্ধার করে বেড়ায় মুখ্যু সুখ্যু হলেও বেশ বুঝি। পেটে কিল মেরে ঘোরা তো তার অভ্যাস। নাও এখন এগুলোর সদগতি করে আমাকে উদ্ধার করো দিকি। মেলা কাজ আমার। ওদিকে তারিণীবাবু ফিরেছে। তিনি তো আমাকে চোখে হারান’।
    বলরামের বলার ধরনে শেখর, বিমান দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। বিমান বলে, ‘না বলরামদা, এত বছর কলকাতায় থেকে থেকে তুমি বাংলা ভাষাটা এত ভাল শিখে গেছো যে যেকোনও বাঙালীর কান কেটে নেবে’।
    বলরাম ‘না বাপু আমার ধাই কিরিকিরি আছু’ বলে একপ্রকার ছুট লাগায়। বিমান শেখর দুজনেই আর এক প্রস্থ হেসে ওঠে। চায়ে চুমুক দিয়ে বিমান বলে, ‘তুমি চলে এসে খুব ভাল কাজ করেছো শেখর, এমনিতেই তুমি পরীক্ষার পড়ায় অনেক পিছিয়ে গেছ। তাছাড়া এমন তাড়াহুড়ো করে চলে গেলে যে দুচারটেও বই যে নিয়ে যাবে তাও করতে পারলে না। আমি মাঝে মাঝে তোমার বই খাতাগুলো মুছে রাখতাম। নচেৎ এমন ধুলোর আচ্ছাদন তৈরি হচ্ছিল যে তুমি আঙ্গুল দিয়ে তার উপরে আন্নাকালির নাম লিখতে পারতে’।
    বিমান কথাটা রসিকতা করে বললেও শেখর বিমানের দু’হাত চেপে ধরে, ‘সত্যি বিমান তোমার সাথে আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক, গত জন্মের কোনও পুণ্যফলে তোমায় বন্ধু হিসাবে পেয়েছি এ জন্মে। আমি তোমার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। তুমি যদি আমাকে চিঠি না লিখতে এখনও হয়তো ...............’। কথা শেষ করে না শেখর। বিমানের এমন লঘু পরিহাসে শেখরের আবেগ তাড়িত হয়ে পড়া দেখে বিমান ভারী অবাক হয়ে যায়। সে শেখরের হাতের পাতা দুটি চেপে ধরে বলে, ‘থামলে কেন? হয়তো কি শেখর। বল .........’।
    শেখরের গলা বুজে আসে, কোনরকমে বলে, ‘হয়তো আন্নাকালিতেই বুদ হয়ে থাকতাম ..................। আমাকে তোমার সাথে নাও বিমান। আমিও দেশের কাজ করতে চাই’।

    সমাজ পরিবর্তন, বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষজনেরও সাজ-পোশাক, চিন্তা-ভাবনা সব কিছুরই পরিবর্তন ঘটে চলেছে। কিন্তু শেখরের ভেতর এ পরিবর্তন যেন অচানক। যে শেখরকে বিমান চিনতো তা যেন বদলে গেছে। শেখরের দেশের জন্য কাজ করতে চাওয়ার এমন আকুল প্রার্থনায় বিমান খুশি হলেও ভেতরে একটা ধন্দ থেকে যায়। সত্যি কি দেশমাতার এই দুর্দিনে তার পাশে বিমান, শেখরদের মতো যুবকের থাকা প্রয়োজন বলেই এই মানসিক পরিবর্তন? নাকি দুই স্ত্রীকে নিয়ে হাঁসফাঁস করা জীবনে থিতু হতে না পেরে এই পলায়ন মনোবৃত্তি। যাই হোক বিমান খুশিই হয়।

    রাতে সেই বোয়াল মাছের ঝাল দিয়ে আহারের পর শেখর বলে, ‘বিমান তোমার প্রবন্ধের সবটুকুতো শোনা হল না’।
    বিমান খুব মন দিয়ে কি যেন একটা কাগজ দেখছিল। সে বলে, ‘আর একদিন শোনাবো’।
    শেখর আবার শুধোয়, ‘আচ্ছা বিমান এই যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় যে নীলচাষকে সমর্থন করলেন, কেন? তারা প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ মানুষ ছিলেন’।
    বিমান তার বন্ধুবরটির মুখের দিকে তাকায়। কি যেন পড়বার চেষ্টা করে। তারপর নিজের মনেই বলে, না শেখরের ভেতর সত্যি একটা পরিবর্তন ঘটেছে। নতুবা এতটা পথ এসে যার ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসার কথা তার কিনা মনে এখন এ সব প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। হাতের কাগজটা বিমান যত্ন করে দেরাজে তুলে রেখে উঠোনের দিকের জানলাটা খুলে দিয়ে দাঁড়ায়। জানলা দিয়ে এক ঝলক কাঁঠালিচাঁপার সুবাস ভেসে আসে। বিমান এসে নিজের বিছানায় পা মুড়ে বসে। তারপর বলতে শুরু করে, “দেখো শেখর, দিনেমারদের হাত থেকে সিংহল যখন ইংরেজদের হাতে গেল তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতেই সিংহলের শাসনভার ন্যস্ত হল। আর অমনি সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি এমন আইন করলো যাতে কোম্পানির সাহেব ব্যতীত সিংহলে আর কেউ ব্যবসা–বাণিজ্য ও বসবাস না করতে পারে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট সিংহলের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে নিজের হাতে নিল। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার জন্‌স্টনের দেওয়া রিপোর্টে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট জানতে পারে সিংহলের যদি ব্যবসা, বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতি সাধন করতে হয় তাহলে বিজ্ঞান, যান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালী ও ইউরোপীয় মূলধনের প্রয়োজন সিংহলে। তারজন্য সকল ইচ্ছুক ইউরোপীয়বাসীকে সিংহলে এসে বসবাস ও বাণিজ্যের অনুমতি দিতে হবে।
    ১৮১০ সালে সিংহলে অবাধ বাণিজ্যনীতি প্রবর্তনের আর একটি নাম ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’। ঠিক তেমনি বাংলাতেও অর্থনৈতিক জীবনের সম্প্রসারণের সব পথঘাট বন্ধ করে দিয়েছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮২৪ সাল পর্যন্ত এই বাঁধন একটুও আলগা হল না। নীলকর সাহেবদের জমির মালিকানা পাওয়ার জন্য বারবার আর্জি বিফল হল। শেষে তারা বাংলাদেশে কফির চাষ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু জমির মালিকানা না দিলে কিছুতেই তা হওয়া সম্ভব নয় বুঝতে পেরে কোম্পানি অনেক রকম শর্ত দিয়ে জমির মালিকানা দিতে রাজি হয়। শুরু হল কফি চাষ। আবার দেখো শেখর, ঠিক তার তিন বছর পরে ৭ই নভেম্বর কলকাতাবাসী ইউরোপীয়রা একটা সভা ডাকে টাউন হলে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, বাণিজ্যের উন্নতি ও কৃষির উন্নতি সাধন করতে ইংরেজ বণিকরা যে সাহায্য করছে তার উচ্ছ্বসিত বর্ণনা নিজেরাই করলো। কিন্তু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইশারাতেই তখনও গভর্ণমেন্ট ওঠে বসে। এই মিটিং-এর মাস তিনেক পরে ১৮২৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ‘একজন জমিদার’ এই স্বাক্ষরযুক্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ হয় ‘সংবাদ কৌমুদী’ পত্রিকায়। এই একজন জমিদারটি আর কেহ নন - স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লেখেন, ‘এদেশে যাঁর ভূসম্পত্তি আছে এবং যিনি নিজে তাঁর জমিদারী দেখাশোনা করেন তাঁরই কাছে একথা সুবিদিত যে নীলচাষের জন্য কি বিরাট পরিমাণ পতিত জমিতে আবাদ হয়েছে এবং নীলচাষের মালিকরা যে দেশ জুড়ে টাকা ছড়াচ্ছেন তাতে দেশের নিম্ন শ্রেণীরা কেমন স্বচ্ছন্দে দিনপাত করছে। আগেকার দিনে যেসব চাষি জমিদারের জবরদস্তিতে বিনামূল্যে বা অল্প পরিমাণ ধানের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হত তাঁরা এখন নীলকরদের আওতায় খানিকটা স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছে। তাঁরা প্রত্যেকেই নীলকরদের কাছ থেকে মাসিক চার টাকা বেতন পাচ্ছে এবং অনেক মধ্যবিত্তও যাঁরা নিজেকে ও পরিবারকে প্রতিপালন করতে পারতো না, তাঁরা নীলকরদের দ্বারা উঁচু বেতনে সরকার প্রভৃতি পদে নিযুক্ত হচ্ছে। এখন তাঁরা জমিদার বা বেনিয়ার খামখেয়ালী ও মর্জি দ্বারা নির্যাতিত হয় না। অবশ্য এই অবস্থা আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর জমিদারদের নিশ্চয়ই দুঃখের কারণ হবে কেন না তাঁরা নিজ নিজ গণ্ডিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নিপীড়িত করতেই ইচ্ছুক। সে সময়কার সরকারের কাছে বিচারকরা যে রিপোর্টগুলি দাখিল করেছেন তা দেখলেই রায়তদের প্রতি জমিদারদের নিষ্ঠুর আচরণের কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে। এছাড়া খুব কম জমিদার আছেন যাঁরা ক্বচিৎ নিজের জমি পরিদর্শনে যান। ম্যানেজারের উপরই তাঁদের যত বিশ্বাস। আর ম্যানেজাররা সেই বিশ্বাসের অপব্যবহার করে এবং নিজেদের সুবিধার জন্য রায়তদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত করে। চাষিরা ভয়ে গ্রামান্তরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ম্যানেজাররা তাঁদের মনিবের কাছে যে মিথ্যা অজুহাত দেয় তা হচ্ছে এই যে নীলকরদের অত্যাচারে খাজনা কমে গেছে, চাষ হচ্ছে না। এভাবেই মনিবদের অন্ধকারে ফেলে রাখে। এ অবস্থায় আমার এ কথা বলা নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত যে ব্রিটিশ সরকার এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেক ইয়োরোপীয় যে এ দেশের লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করছেন এরা তার বিরোধী অথবা যে ইয়োরোপীয়দের এদেশে অবাধ বসবাসের বিরুদ্ধাচরণ করে, এই বসবাস অবশ্য বিচার পদ্ধতির কতকগুলি পরিবর্তন সাপেক্ষ, সে লোক এ দেশের লোকদের এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের শত্রু’।
    দেখো শেখর দ্বারকানাথ নিজে একজন জমিদার হয়েও জমিদারদের অত্যাচারের কথা অকপটে বলেছেন। নীলকর সাহেবদের যখন অত্যাচারের কথা চারিদিকে ছিছিক্কার তুলছে, সে সময় দ্বারকানাথ বলছেন নীলকর সাহেবরা ‘মহাজন যেন গত সহি পন্থা’ এই মহামন্ত্র জপতে জপতে চাষিদের জিভ বার করে দেবে তাঁদের বুট জুতোর চাপে এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? জমিদারদের নাগরা জুতোর জায়গায় নীলকর সাহেবদের বুট জুতো চাষির বুকে, মুখে লাঞ্ছনা চিহ্ন আঁকছিল এই যা তফাৎ। দ্বারকানাথের সত্যনিষ্ঠ মনের দৌলতেই এ তথ্য জানতে পারি আমরা”।
    শেখর বন্ধু বিমানের দিকে চেয়ে একটা কথা ভাবতে থাকে তা হল বিমানের ভেতরও একটা পরিবর্তন ঘটেছে। যে বিমান নীলকরদের অত্যাচারে মুখর ছিল সে আজ এ কি কথা বলছে। বিমান বুঝি শেখরের মন পড়তে পারে। তাই বলে, ‘দেখো শেখর যেখানে ঝড়ের প্রয়োজন সেখানে কি দখিনা বাতাস দিলে চলে? অন্ধ কুসংস্কার আর মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণায় আমাদের দেশের মানুষের যখন নাভিশ্বাস উঠছে তখন তো নবজাগরণের দরকার। আর তারজন্য চাই একটা জোর ধাক্কা। বলতে পারো উলোটপুরাণ রচনার দরকার। আমাদের সবকিছুকে নবজাগরণের আলোকে আলোকিত করে দেখা উচিত’।
    শেখর বিমানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই আঁধার রাতেও বিমানের মুখে যেন নতুন ভোরের আলোর দীপ্তি। (ক্রমশ)

    ২৩

    কাঁচপোকা গ্রামটায় কমলার রাধামাধবের মন্দির প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় গ্রামের সবার কাছে এক ধাপে সে মানবী থেকে দেবীতে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সে নিয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। বদু বেটাও আজকাল শ্মশানের চৌহদ্দি মাড়াতেই চায় না। কোত্থেকে দু’খানা চাঁড়ালের বাপ-মা’হারা ছেলে জোগাড় করে মড়া পোড়ানোর কাজে শিক্ষে দেওয়া শুরু করেছে। ছেলেগুলো কাজের। অল্প সময়ের মধ্যেই কাজ বেশ রপ্তও করে ফেলেছে। শুধু খুলি ফাটানোর সময়টা বদুকে হাঁক পাড়ে, ‘অ বদুদাদা, দেও দিনি মোক্কম একখান বাড়ি’। বদুর আর এসব একদম ভালো লাগে না। তার মন সারাক্ষণ কমলার শ্রীচরণের তলায় পড়ে থাকতে চায়। মনে কি ভয় কম? ভদ্দর নোকের মুখোশ পরা ঐ যে কায়েত বাবুটা যোগেন না কি নাম যেন যে কিনা বিধবা পুকুর ধারে বদুর জিনিসে ভাগ বসাতে এসেছিল লোকটা মোটেও সুবিধের নয় কো। মা জননীর পাশে পাকা কাঁঠালের মাছির মতো সারাক্ষণ ভনভনিয়ে বেরাচ্ছে। বদুর খুব ইচ্ছা লাশের খুলি ফাটানো তেল চুকচুকে গড়ান গাছের লাঠিটা দিয়ে দেয় মাথাটা দুভাগ করে। কিন্তু সাহসে কুলায় না। তাইতো সে তার মা জননীকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাহারা দিয়ে রাখে। কমলা বদুর দেওয়া এই পাহারাটুকু মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছে। সত্যি বলতে কি যোগেনকে তার আর প্রয়োজন নেই। যতটুকু ছিল ততটুকুর কাজ ফুরিয়েছে। ছেলে দুটো শঙ্করীর জীবন। আর শঙ্করীও ওদের কাছে মা বই কিছুই না। এই একটা ব্যাপার বুকের ভেতর নিশপিশ করলেও দেবীর মহিমা অর্জনের জন্য সেটুকু ত্যাগ করতে রাজী কমলা।

    আর এদিকে যোগেন অস্থির চিত্তে ছটফটিয়ে মরছে। এ কোন কমলা বৌঠান। মানুষ এত বদলে যেতে পারে! যোগেন যে কমলার কোনও নাগালই পাচ্ছে না। যত ধরতে যাচ্ছে পারদের মতো ততই কমলা পিছলে যাচ্ছে। আর ঐ শ্মশানের ডোম হারামজাদা বদু সারাক্ষণ শকুনের মতো দৃষ্টি মেলে রয়েছে কমলার দিকে। যোগেন যেন ওর কত জন্মের শত্তুর। একটা শ্মশানের ডোমকে নিয়ে এই আদিখ্যেতা মোটেই কেউ ভালো চোখে নিচ্ছে না সেটা বোঝাতেই পারছে না যোগেন কমলাকে। এখন তো নাকি বাবুর আবার কমলার পেসাদেই অন্ন ভোজন হয়। সে নাকি মদ মাংস তো দূরের কথা পেঁয়াজ রসুনটুকুও খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ভণ্ডামি। ভণ্ডামি। হার বজ্জাত। যোগেনের সমস্ত শরীর গায়ে ছারপোকা ওঠার মতো চিরবিরিয়ে ওঠে শয়তানটাকে দেখলে। সেই জন্য যোগেন ঠিক করে গয়ায় পিণ্ড দিতে যাওয়ার আগে এ নিয়ে সরাসরি কমলা বৌঠানের সাথে কথা বলবেই বলবে। ওদিকে ঘোষাল মশাইয়ের সঙ্গে যে কিছু শলা করবে তারও উপায় নেই। ফোকটে বিষ্ণুর ত্রিপাদ ভূমি দর্শন করতে যেতে পারবে, ফল্গুর জল মাথায় ছেটাতে পারবে, অক্ষয় বটে ধাগা বাঁধতে পারবে, নিজের পূর্বপুরুষের জন্য বালির পিণ্ড দিতে পারবে - সেই আহ্লাদেই খোঁড়া পা সোজা হয়ে জগাই মাধাইয়ের মতো নেত্য করে বেরাচ্ছে। আরে বাবা প্রেত শিলায় তো যেতে হবে সেই যোগেনকেই। মহিমের পিণ্ড তো প্রেত শিলা ছাড়া অন্য কোথাও দেওয়া যাবে না। তখন বুড়ো বামুন তুই কি ভাঙবি পাথরের অতগুলো সিঁড়ি? এই ধরনের চিন্তা মাথায় উদয় হতেই যোগেনের মনে হয় শালা বদু বেটার কথা সারাক্ষণ চিন্তা করতে করতে মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। নতুবা বৃদ্ধ ঘোষাল মশাইয়ের সম্পর্কে এই ধরনের ভাষা প্রয়োগ করে কিছু ভাবতে পারতো না।

    সকাল সকালই যোগেন ঘোষাল মশাইয়ের উঠোনে এসে উপস্থিত হয়। খুব আন্তরিক গলায় ডাক দেয়, ‘কাকা বাড়ি আছেন নাকি?’
    মনের ভেতরকার সুপ্ত ইচ্ছা বদুর ব্যাপারটা ঘোষাল মশাইকে দিয়েই কমলা বৌঠানকে বোঝাতে হবে।
    ঘোষাল মশাই হাতে একটা লম্বা ফর্দ নিয়ে বাইরে আসে। এসে হাসিমুখে বলে, ‘এই যে বাব যোগেন, তুমি এসেছো? খুব ভালো হয়েছে। নতুবা আমিই যেতাম তোমার কাছে। ফর্দটা করেছি। কিছু জিনিস বসিরহাট বাজার থেকে আনতে হবে। কিছু জিনিস কলকাতা থেকে নিতে হবে। গয়ায় পিণ্ড দেওয়া বলে কথা। চাড্ডিখানি ব্যাপার না’।
    যোগেন উশখুশ করে ওঠে, ‘আসলে আমি বলছিলাম কি ঘোষাল কাকা আমরা দুজনেই এতগুলো দিন গ্রামে থাকবো না, বৌঠানের কি ব্যবস্থা করে যাবেন কিছু ভেবেছেন?’
    বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ফোকলা দাঁতে দ্বিতীয় শৈশবের হাসি হাসে, ‘চিন্তা করো না। বদু তো রইলোই’।
    এমন একটা উক্তি শুনে যোগেনের মুখে একগাল মাছি। তার বিস্ময়ের আর শেষ থাকে না। হা মুখ আর চোখের পলক দুটোই বন্ধ করতে ভুলে যায়।
    ঘোষাল মশাই নাতিকে নিমগাছতলায় চাটাই বিছিয়ে দিয়ে গুড় মুড়ি দিতে বলে। উৎসাহের সঙ্গে যোগেনকে বদুর বীরত্ব নিয়ে বলতেই থাকে, ‘তুমি একদম ভেবো না যোগেন। বদু থাকতে আমার মায়ের ধারেপাশে পিঁপড়েটিও ঘেঁষতে পারবে না’।
    তবু যোগেন শেষ বারের মতো মরীয়া চেষ্টা করে, ‘কিন্তু কাকা, সারাদিন শ্মশানের মড়া ঘাঁটাঘাঁটি করে মহিমের মতো সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের বাস্তুতে ঐ চাঁড়ালের আনাগোনায় কি পাপ হচ্ছে না?’
    হাই হাই করে ওঠে ঘোষাল মশাই, ‘বলো কি যোগেন, মা আমাদের বলেই দিয়েছে তো রাধামাধবের মন্দির হবে সকল জেতের জন্য। তুমি ওসব নিয়ে কিছু ভেবো না। এই ফর্দটা রাখো। আমি পঞ্জিকা দেখে যাত্রা কবে করা যায় দিনক্ষণ খুঁজে বার করি। ও আর যদি খুব অসুবিধা মনে করে সে তোমার বউ তো রইলোই। তবে বদু আমাদের একাই একশো। তুমি জানো নি, মড়া পোড়ানোর কাজ থেকে ও ক্রমশঃ হাত গুটিয়ে নিয়েছে। দুটো চ্যালা তৈরি করছে। শুধু খুলি ফাটানোয় তারা পোক্ত হয়ে গেলে বদু চিরকালের মতো শ্মশান ছেড়ে তার মা জননীর আঙিনার এক কোণে পড়ে থাকবে’।
    আঁতকে ওঠে যোগেন, ‘কি সর্বনাশ!’
    বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সে কথায় খেয়াল না করে বলে, ‘খাও যোগেন খাও। টাটকা মৌ-ঝোলা গুড়। গতবারের জিরেন রসে বানানো। এই শেষ এক কলসি ছিল। মুড়ির সাথে বড়ো ভালো খেতে লাগে। আমিতো দাঁত নেই বলে পারি না’।
    জীবনে এমন বিস্বাদ তেঁতো মৌ-ঝোলা গুড় এই প্রথম যেন খাচ্ছে বলে মনে হয় যোগেনের।

    নদীর যখন এক পাড় ভাঙে তখন অন্য পাড় গড়ে। এ হল প্রকৃতির খেলা। মানুষের অন্তরাত্মার ভেতরেও অমন প্রকৃতি বাস করে। যে কিনা ঠিক সময়ে সময়ে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন ঘটিয়ে দেয়। নতুবা মহিমের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কাঁচপোকা গ্রামের এই দরিদ্র চট্টোপাধ্যায় পরিবারে যে ভাঙন দেখা দিয়েছিল তা হাবির বিয়েকে কেন্দ্র করে কমলার মানসিক উত্তরণের মাধ্যমে জোড়া লাগতে শুরু করে। এক সময়কার কুচুটে, মুখরা, কলহপ্রিয় কমলা যেন শীতঘুমের মাধ্যমে পুরনো খোলস ত্যাগ করে নতুন ভাবে জেগে উঠেছে। কিন্তু এই জেগে ওঠায় বিষতোলা ফণার হিসহিসানি শব্দ নেই। যা আছে তা বড়ো মিঠে। নতুবা গাঁয়ের মানুষ কাতারে কাতারে কমলার আঙিনার ধুলো মাথায় ঠেকাতে চাইছে কেন! একেই বোধহয় বলে নদীর এক পাড় গড়া।
    কিন্তু যোগেনের অন্তরাত্মা গুলি খাওয়া ঘুঘুর মতো ছটফটিয়ে মরে। সে তার নিজের মনের কোণে জমে থাকা কালো মেঘের চাদরে এ পাড় থেকে ও পাড়টা দেখে। তাই বদুর মধ্যে মাংসাশী মনই খুঁজে পায়। বড় অসহ্য এই আখাম্বা চাঁড়ালটা। তার থেকেও বেশী অসহ্য কমলা বৌঠানের এই অতিরিক্ত বদুপ্রীতি।
    হনহন করে যোগেন মহিমের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে। কিন্তু খানিক দূর গিয়ে তাকে থমকে যেতে হয়। কেননা কমলা বৌঠান কিছু একটা নিয়ে খিলখিল করে হাসছে। তার হাসিতে যোগেনের সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়। কতদিন বাদে সে কমলা বৌঠানের এমন ভুঁইয়ে লুটিয়ে পড়া হাসি শুনতে পাচ্ছে। আর উঠোনে ইয়া বড়ো পেল্লাই সাইজের একটা গভ্‌ভ মোচা নিয়ে বদু ব্যাটা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে। কমলা তাকে ফুলে ফুলে হেসে হেসে বলছে, ‘ও বদু তুই এটা করেছিস কি? এত বড়ো মোচা আমার তো সাতজন্ম খেলেও ফোরাবে না’।
    তারপরেই যোগেনকে খেয়াল হয়ে কমলা বলে, ‘যা বদু এই মোচাখানা কায়েত ঠাকুরপোর বাড়ি দিয়ে আয়। সেখানে মেলা লোক, সৎব্যবহার হয়ে যাবে। আমি না হয় শঙ্করীকে বলবোখুনি আমাকে একবাটি তরকারি পাঠিয়ে দিতে। তুই এসে সেটা পরে নিয়ে যাসখোনে’।
    বদু বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে পিঠে গন্ধমাদন পর্বত তোলার মতো করে মাটি থেকে মোচাখানা কাঁধে তুলে নেয়। কিন্তু যোগেন হাইহাই করে ছুটে এসে আগল দিয়ে বদুর সামনে দাঁড়ায়, ‘এই খবরদার না। ও মোচা আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় নিয়ে যাবি না’। তারপর কমলাকে কটাক্ষ করে বলে, ‘কিছু মনে কোরো নে বৌঠান, আমি তোমার মতো পুণ্যির লোভে উদার হতে গিয়ে ম্লেচ্ছ, ডোম, চাঁড়ালের ছোঁয়া জিনিস খেতে পারবো না। আর পরিবারকেও খাওয়াতে পারবো না’।
    কয়েক মুহূর্ত স্থির, অপলক তাকায় কমলা যোগেনের দিকে। তারপর মিঠে হেসে বলে, ‘বেশ তো নাই বা পুণ্য কুড়োলেন। যা বাবা বদু মোচাখানা তাহলে উঠোনের উই কোণে সুপুরি গাছতলায় রেখে যা। বৃহস্পতিবার ছোলা নারকোল দিয়ে রাধামাধবের ভোগেই লাগিয়ে দেবো’।
    মোচার এ হেন গৌরবময় উত্তরণে যোগেনের সর্বাঙ্গে যেন কে জলবিছুটি লেপে দেয়। সে প্রায় তিড়িংবিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে। স্থানকাল ভুলে চীৎকার করতে লাগে, ‘এ তোমার ভারী অন্যায় কমলা বৌঠান। তুমি এ মোচা দিয়ে রাধামাধবের ভোগ দেবে! গ্রামের সবাই তোমাকে মান্যি করতে শুরু করেছে বলে ধরাকে সরা জ্ঞানে দেখবে নাকি?’
    কমলা শান্ত গলায় বলে, ‘বদু তুই এখন যা। হ্যাঁ আর শোন, তোর চ্যালাদুটোকে যত তাড়াতাড়ি পারিস দাহকার্যে দড় করে আমার উঠোনে পাকাপাকি উঠে আয় তো বাবা। একা মেয়েমানুষ থাকি। সোমত্ত ব্যাটা পাহারা দিলে আর কোনও ভয় নেই। গাঁয়ে যত লোকসংখ্যা বাড়ছে শেয়ালের গর্তগুলো বুজে গিয়ে শেয়ালের উপদ্রব বেড়ে চলেছে’।
    পাথরের মূর্তির মতো বদু নিরুত্তর থেকে ঘাড় নেড়ে ফের সায় দিয়ে রাস্তামুখো অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাঁটতে শুরু করে। দুপা গিয়েও কায়েত বাবুমশাই লোকটার চিন্তায় সে আবার তার মা জননীর কাছে ফেরত আসে।
    কমলা শুধায়, ‘কিছু বলবি বাবা?’
    ঘাড় নাড়ে বদু, ‘হ্যাঁ, মা তুমি কাটারীখানা পাশে নিয়ে বোসো’।
    এক গাল হাসে কমলা, ‘আচ্ছা। তাই হবে’।
    এদিকে যোগেনের মাথার ভেতর জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝাঁঝালো রোদ বগবগিয়ে জ্বলে ওঠে। কোনরকম শালীনতার ধার না ধেরে সে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে কমলার মাটির বারান্দায় উঠে এসে খপ করে কমলার ডান হাতটা চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, ‘এটা তুমি কি শুরু করেছো বৌঠান? এই চাঁড়ালটাকে নিয়ে কেন তোমার এতো বাড়াবাড়ি? এতো দূর ভেবে ফেলেছো যে সে এ বাড়ির উঠোনের পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে যাবে?’
    কমলার ধৈর্যচ্যূতি ঘটে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘হাত ছাড়ুন কায়েত ঠাকুরপো। আপনারা আমার ছেলেদুটোকে মানুষ করছেন, বিপদে-আপদে পাশে থাকেন। তা বলে মাথা কিনে নেন নি। আমার বাড়িতে আমি কাকে আশ্রয় দেব আর কাকে দেব না সেটা আমিই ঠিক করবো। নাঃ যাই দেখি ঘর থেকে কাটারীটা নিয়েই আসি। বদু ঠিকই বলেছে। ওটাকে এবার থেকে আমার কাছাকাছিই রেখে দিতে হবে’।
    অপমানে যোগেনের কান মাথা ঝাঁঝাঁ করতে থাকে। কমলার চোখে চোখ রেখে আগুন হেনে বলে, ‘কাজটা তুমি ঠিক করলে না বৌঠান’।
    কমলা যেখানে কাঁঠাল গাছটা ছিল সেই শূন্য স্থানটার দিকে তাকায়। কি যেন ভাবতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথার ভিতরটা বরফের চাঙড়ের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সে খুব বিনীত গলায় বলে, ‘আচ্ছা ঠাকুরপো, ঘোষালমশাইয়ের সাথে আপনাদের গয়ায় পিণ্ড দিতে যাওয়ার তিথি নক্ষত্র দিনক্ষণ নিয়ে কিছু কথা হল?’
    যোগেনের এতক্ষণে সেই ফর্দের কথা মনে পড়ে। বলে, ‘হ্যাঁ, আমি সেখান থেকেই আসছি’।
    খুশীতে কমলার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ‘যত তাড়াতাড়ি পারেন যাত্রা করুন আপনারা। মানুষটার আত্মা বড়ো কষ্ট পাচ্ছে। পিণ্ড দেওয়া হলে পড়ে পাপের বোঝা কিছু লাঘব হবে আমার’।
    কমলার দুচোখে জল টলটল করে। সেদিকে চেয়ে যোগেন বাক রহিত হয়ে যায়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। একটু আগে বৌঠানের সঙ্গে কি অমার্জিত, অসভ্য, নির্দয় ব্যবহারখানাই না করে ফেলেছে। অলক্ষ্যে বিধাতা পুরুষ পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে চোখ-কান খোলা রেখে মনেমনে হেসে উঠে বলে – হায় মানুষের মন! (ক্রমশ)

    ২৪

    গাছের যখন পাতা ঝরে যায় তখন তাকে খুব বেশী শূন্য লাগে। মনে হয় এ শূন্যতা বুঝি কোনোদিন কাটবে না। বড়ো রিক্ত, শীর্ণ, দীর্ণ মনে হয়। বড়ো হাহাকার করে। সোহাগীর মৃত্যু রামতনুর লাটে এমন এক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। যে মৃত্যু শশীর কাছে এত প্রয়োজনীয় ছিল, এত কাম্য ছিল, সে মৃত্যু শশীকে এক উলঙ্গ সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তা হল রামতনুর প্রলাপ। বিকারের ঘোরের মতো সে বকেই চলেছে, ‘সোহাগী আমি আসছি, তুমি কোনও চিন্তা করো না। তোমার চুল কেটে দিয়ে শশী খুব অন্যায় করেছে। শশী বরাবর খুব নিষ্ঠুর। আমরা এই বাদার নোনা দেশ ছেড়ে চলে যাব সোহাগী’। কখনও বা হাসছে। বলছে, ‘বাঃ আলতা পরলে তোমার পা দুটি বেশ সোন্দর দেখায় তো। এবার বসিরহাট গেলে আমি তোমার জন্য মাথায় মাখার গন্ধ তেল, মুখে মাখার স্নো এনে দেব’। আবার কখনও বা বাচ্চা ছেলের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, ‘তোমাকে কতবার বললাম সোহাগী বেশী করে খয়ের দিয়ে পান খেয়ে শশীর মতো ঠোঁট জোড়া রাঙিয়ে আমার সামনে আসবে, তুমি একবারও তা করলে না’। একটা কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু শশীকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়েছে। শশীর বুকের ভেতর কামারশালার লাল আগুনের মতো ধক্‌ ধক্‌ করছে কাঁচা ঘায়ের যন্ত্রণা। কিন্তু তা এমন বেআব্রু যে কিছুতেই কারও সামনে কোনোদিন দেখানো যাবে না। শুধু মাঝে মাঝে টগরমণিকে বুকের ভেতর চেপে ধরে গোঙানির মতো শব্দ করে কি সব বলে, ছোটো বালিকার পক্ষে কিছু বোঝা সম্ভব হয় না। শুধু মনে হয় মা, সাবুর মা পিসিকে কত ভালোবাসতো। তার মায়ের মতো মা আর কোত্থাওটি নেই। কাঁচপোকা গ্রাম, সেখানে ফেলে আসা তার জীবনটা আস্তে আস্তে করে একটা ধূসর চাদরের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতে থাকে। ব্যথা ভোলানোর প্রকৃতির আশ্চর্য মলম সময়। সময়ের প্রলেপ পড়তে পড়তে সব দগদগে ক্ষত একদিন শুকিয়ে যায়। হয়তো কোথাও কোথাও দাগ থেকে যায়। যেমন থেকে গেছে হাবির মনে মহিমের স্মৃতি। সেই সঙ্গে দুঃসহ অভিমান – বাবা তাকে একটিবারও দেখতে আসে না, এমন কি যোগেন কাকাও না। ঠিক আছে হাবিও যাবে না বাবার কাছে। আবার মনে হয় বাবা তাকে বলেছিল বিয়ে হয়ে গেলে মাছ, মণ্ডা খেতে দেবে। কিন্তু বরটা পালিয়ে যেতেই তো সব গোল বাঁধলো। বাবার কি দোষ। আর তাছাড়া মাছ, মণ্ডা খেতে খেতে সত্যি অরুচি ধরে গেছে। বরং সাবুর এনে দেওয়া টকটক গাব, খেতের থেকে টাটকা তেউড়ির দানা অনেক সুস্বাদু, লোভনীয়।
    সাবুকে ফেলতে পারে নি শশী। অন্তর্দাহে পুড়ে খাক হতে হতে কোথায় একটা প্রায়শ্চিত্য করতে মন চায়। নিঃসন্তান, বিধবা নাপিত বউকে এ বাড়ির দক্ষিণ কোণে চারচালা মাটির ঘর তুলে থাকতে দিয়েছে শশী। বলেছে, ‘ছোটো ছেলে একা শুতে রাতে যদি ডরায়, নিশিতে ডাকে, বোবায় ধরে, তুমি ছেলেটাকে নিয়ে থাকো নাপিত বৌ। মা মরা ছেলে, তোমারও কোল ভরবে’। নাপিত বৌ মহা খুশি। সাবু, সাবুর মাকে থাকতে দেওয়া ঘরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শশী সেখানে নিজে দাঁড়িয়ে হরেক রকম ফুল গাছ লাগিয়েছে। না হলে জায়গাটা কেমন খাঁ খাঁ করছিল। শশীর এ ধরনের আচরণে গ্রামের লোক, এ বাড়ির ঝি চাকর কেমন বিস্মিত হতে থাকে। আহা ঠাকরুনের কলজেটা যে বাদার কাদার মতো নরম তা কেউ বুঝতেই পারে নি এতদিন। শুধু রামতনু নামে এ বাড়ি, এ লাটের মনিবটিকে কেউ আর দেখতে পায় না। কি করে সে। ঘুমায়। হ্যাঁ শশী তাকে চব্বিশ ঘণ্টাই আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে দেয়। ঘেন্না করে শশী এই লোকটাকে। ঘেন্না করে শশী তার স্বামীকে। ঘেন্না করে শশী তার সন্তানের বাবাকে। আর যত ঘেন্না করে তত তার সিঁথির সিঁদুর চওড়া হয়। পায়ের আলতা লক্ষ্মীমণি জবার রঙকেও হার মানায়। মানুষ ভাবে আহা সতী লক্ষ্মী। সাক্ষাৎ জগৎজননী মা। শশীর ‘কলা’ উপচে পড়ে। শশী বলে, ‘সাবু তো আমার সন্তান বৈ কিছু তো নয়। হতভাগী তো আমার কাছে রেখেই নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পেরেছে। আমি আমার ঘরেই মাটিতে ছোঁড়ার বিছানার ব্যবস্থা করতে পারতাম, কিন্তু বুঝিস তো ছেলের বৌ নে থাকি ঘরে। আজ শোকে তাপে লোকের মুখ বন্ধ থাকলেও খুলতে কতক্ষণ’। নাপিত বৌ হাতে চাঁদ পায়। সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পর্কও বদলায়। এই যেমন মহিমের দ্বিতীয় পক্ষ তুচ্ছ কমলা তার বোন হল। নিজের একমাত্র সন্তান পর হল। ছেলের বৌ হাবিরানী থেকে সাধের প্রাণের কোলজোড়া সন্তান টগরমণি হল। আবার এখন টগরমণি থেকে ছেলের বৌ হল।

    কবিরাজ মশাই একদিন অন্তর তার শেকড়, বাকড়, পাচন বড়ির ঝুলিখানা নিয়ে আসেন রামতনুকে দেখতে। তখন রামতনুর ঘরে একমাত্র শশীর হুকুম ছাড়া কারও থাকার হুকুম নেই। এমন কি টগরমণিরও তখন সে ঘরে ঢোকা নিষেধ। একদিন খেলতে খেলতে বেখেয়ালে ঢুকে গিয়েছিল রামতনুর ঘরে। শশীর প্রচণ্ড বকুনিতে প্রথমটা জড়সড় হয়ে যায় বেচারি। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শশী তাকে কক্ষনও বকে না। হয়তো কখনও কখনও শাসন করে। কিন্তু সে শাসনের ভেতরেও থাকে প্রশ্রয়, আদরের সুর। টগরও জানে শশী তার সত্যিকারের মা। এ বাড়িতে এসে এই প্রথম টগরের ভেতর থেকে হাবি জেগে ওঠে। বাগানের বাতাবীলেবু গাছটার নীচে যেখানে হাবির আর সাবুর খেলনা বাটির সংসার পেতেছে সেখানে এসে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। আজ সকালেই সাবু বাবলা গাছের আঠা আর ছোটো ছোটো ইটের কুচি এনে দিয়েছে। মাংস, বাবলা গাছের আঠা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাংস আর ইটের কুচি দিয়ে হাড়গোড় হবে। আহা ছোট ঠাকরুন কাদা জল দে কি সোন্দর করি রাঁধবে আর সাবু মিছিমিছি সেগুলো তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাবে।
    ছোট ঠাকরুন হেসে বলবে, ‘আর একটু দিই সাবু’। সাবু হেসে ঘাড় কাৎ করবে আর টগর সাবুর কলাপাতায় বালির ভাত আর বাবলা গাছের আঠার তৈরি মাংস ঢেলে দেবে। এ বড়ো তৃপ্তির খেলা তাদের, পরম শান্তির খেলা। শশীর কঠিন নিষেধ আছে, ‘খবরদার সাবু, ছোট ঠাকরুনের সঙ্গে খেলা করবি, দেখাশোনা করবি, ও যা বলে ফাইফরমাশ খাটবি কিন্তু আঙুল দিয়েও ওকে কক্ষনো ছুবি না। তালে বলো মা কালী ঘুমিয়ে থাকলে যে হাত দে ওকে ছুবি সে হাত কেটে নেবে’। সাবু তাই কক্ষনো ছোট ঠাকরুনের সাথে ধরাধরি খেলে না। ছোট ঠাকরুন একটু ছুটোছুটি করে খেলতে ভালোবাসে। বেচারি তো গাঁয়ের আর কোনও বাচ্চার সাথে খেলবার সুযোগ পায় না। শশীর নিষেধ। তাই শুধু সাবুর সাথেই খেলে। সাবুও তাই এখন এ বাড়ির সীমানার বাইরে আর খুব একটা যায় না। একমাত্র ছোট ঠাকরুনের কিছু আদেশ হলে তখন যায় বাড়ির বাইরে। এ বাড়ির বাগানে গাব গাছটা নেই কিন্তু টগর টকটক গাব ফল খুব পছন্দ করে। সেই গাব ফল সংগ্রহের জন্য মাঝে মাঝে চণ্ডী খুঁড়োর বাগানে ঢুঁ দিতে হয়। সেই গাব ফল ভেঙে নুন দিয়ে জিভ দিয়ে টাগরায় চকাস চকাস শব্দ তুলে চোখ বন্ধ করে কেমন সুন্দর করে চোখ বুজিয়ে বুজিয়ে খায়, তা দূরে উবু হয়ে বসে সাবুর দেখতে ভারী ভালো লাগে। ছোট ঠাকরুন সাবুর কাছে পরম বিস্ময়, মুগ্ধতার খনি।
    শশীর কাছে বকুনি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে টগরের সব রাগ গিয়ে পড়ে ঐ খেলনা বাটির সংসারটার উপর। একটা একটা করে টান মেরে মেরে সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এমন কি সাবুর এনে দেওয়া সেই বাবলা আঠার মাংস। টগরের ভেতর থেকে এক ঝটকায় হাবিরানী বেরিয়ে আসে। বে’র পরদিন সেই যে কাঁচপোকা গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিল, সেই গ্রামটার সব সবকিছু, বাবা, মা, ভাই দুটো, যোগেন খুঁড়ো, শঙ্করী খুঁড়ি, ওবাড়ির ঠাকমা, খেলার সাথী মানী, বেঁচু, গাছগাছালি, পাখপাখালি, ঘরবাড়ি সবকিছু। সাবু কি কারণে যেন বাগানে ঘুরঘুর করছিল। দূর থেকে ছোট ঠাকরুনকে কাঁদতে দেখে ছুটে আসে। এমন দৃশ্য সাবুর চোখে দেখা প্রথম। সে কোনোদিন ছোট ঠাকরুনকে কাঁদতে দেখে নি। শুধু হাসতেই দেখে। তাছাড়া তাদের খেলনা বাটির সংসারটার ছত্রখান অবস্থা দেখে আরও কষ্ট পায়। এ সংসারখানায় সে কে সে জানে না, শুধু জানে কিন্তু সংসারখানা সাজাতে তার মেহনতও তো কম নয়। তার খুব ইচ্ছা করে হাত দিয়ে ছোট ঠাকরুনের চোখের জল মুছিয়ে দিতে। কিন্তু ঘুমের ঘোরে মা কালী হাতখানা কেটে নিয়ে গেলে সে খাবে কোন হাত দিয়ে। তাই না ছুঁয়েই শুধোয়, ‘এমন করে কানছো কেন ছোট ঠাকরুন?’
    শুধোতে গিয়ে তার নিজেরই কান্নায় গলা বুজে আসে। সাবুকে কাছে পেয়ে টগরের দুঃখ দ্বিগুণ হয়। সে হিক্কা দিয়ে কেঁদে ওঠে। কান্নার দমকে তার ছোট্ট ফর্সা টুলটুলে মুখখানা লাল হয়ে যায়। সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, ‘আমি এ বাড়ি থাকবো না সাবু, তুমি আমাকে কাঁচপোকা গ্রামে আমাদের বাড়ি দিয়ে এস। আমি বাবার কাছে যাব, ভাইদের কাছে যাব’।
    সাবু ছোটো হলেও টগরের থেকে বড়ো। তাছাড়া বিভিন্ন জীবন অভিজ্ঞতা তাকে পরিপক্ক করে দিয়েছে। সে শুধোয়, ‘তোমার কি হয়েছে ছোট ঠাকরুন?’
    টগর নিজেই নিজের আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বলে, ‘মা বকেছে’।
    সাবু বলে, ‘তুমি নিশ্চয়ই কিছু করেছিলে। ঠাকরুন তো শুধু শুধু বকবে না’।
    টগর আত্মপক্ষ সমর্থন করে, ‘আমি কি জানতাম বলো, বাবার ঘরে কবরেজ এসেছে তা আমি কেমন করে জানবো। আমি তো পুতুলের কাপড় খুঁজতে গিয়েছিলাম’।
    সাবু বেশ বয়স্ক অভিভাবকের মতো করে বলে, ‘সে তো তুমি অন্যায় করেছিলে বটে ছোট ঠাকরুন। তুমি জানো না ঠাকুরের কঠিন ব্যামো। ঠাকরুনের কত মনে কষ্ট। তাকে একা সব সামলাতে হয়। এত বড়ো তালুক সামলানো কি চাড্ডিখানি মুখের কথা। কবরেজ মশাই দেখতে এয়েছেন। কত জরুরী কথা, কাজ সেখানে। আর তুমি কিনা সেখানে পুতুলের শাড়ি খুঁজতে গে গোল করছিলে। ঠাকরুন বলে তোমাকে বকুনি দিয়েছে আমার মা হলি তো দু ঘা ......’। কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই দু’চোখ জলে ভরে যায়।
    টগর নিজের দুঃখ ভুলে ছুটে আসে। ছোট ছোট আঙুল দিয়ে সাবুর চোখের জল মুছিয়ে দিতে চায়। সাবু লাফ দিয়ে দু’পা সরে যায়। আতঙ্কিত মুখে বলে, ‘করতেছো কি ছোট ঠাকরুন, আমাকে ছুঁয়ো নে। ঠাকরুনের নিষেধ আছে’।
    টগর দুষ্টু হাসি হেসে বলে, ‘জানি তো সাবু। কিন্তু সে তো তোমার। তুমি আমারে ছুঁয়ে দিলি, মা কালী ঘুমের মধ্যি এসি তোমার হাত কেটে দেবে’।
    অগত্যা হার স্বীকার করতে হয় সাবুকে। টগর তার কচি কচি আঙুলগুলো দিয়ে সাবুর চোখের জল মুছিয়ে দেয়। আর সাবুর সমস্ত শরীর-মন জুড়ে নাম না জানা এক অদ্ভুত শিহরণে শিহরিত হতে থাকে। প্রচণ্ড দিনের পর দিন দাবদাহের পর মাটিতে জল পড়লে যেমন সোঁদা গন্ধ বের হয় এও তেমনি। কিন্তু ভবী ভোলবার নয়। শশীর বকুনি এক ঝটকাতে টগরমণির খোলস ভেঙে হাবির জাগরণে সে আবার বলে, ‘আমি আমার গাঁয়ে যাব সাবু’।
    সাবু বলে, ‘এটাই তো তোমার গাঁ’।
    টগরমণি এক বগ্‌গা, ‘না, কাঁচপোকা গ্রামই আমার গাঁ। সেখানে আমার বাবা, ভাইরা, মা, যোগেন খুঁড়ো, শঙ্করী খুঁড়ি, ঠাকমা সবাই আছে’।
    সাবু আবার অভিভাবকের ভূমিকা নেয়, ‘ওমা তুমি জানো না ছোট ঠাকরুন, মেয়েদের বে হয়ে গেলে সেটাই তার নিজের বাড়ি, সে গাঁই তার নিজের গাঁ’।
    কপাল কুঁচকে তাকায় টগর – বে? হ্যাঁ। তা বটে, বে’র মতো কি যেন একটা ঘটেছিল তার জীবনে। কিছুই তো মনে নেই। শুধু ঐ মাছ মণ্ডার কথা ছাড়া। কিন্তু সেও তো অরুচি ধরে গেছে।
    সাবুই উপায় বাতলে দেয়, ‘তোমাকে সেখানে নে যাওয়া কোনও মতেই সম্ভব না। তাই আমিই একদিন সেখানে গে সেখানকার সব খোঁজ এনে দেব তোমাকে’।
    হাসি ফোটে টগরমণির মুখে।
    সাবু এবার অভিমান করে, ‘তবে তুমি আমাদের খেলাঘরটা ভেঙে দে ঠিক করো নি ছোট ঠাকরুন’।
    ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা খেলাঘরটার দিকে টগরেরও খুব খারাপ লাগে। দু’হাতে কান ধরে দুধের দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে, ‘আর কোনও দিন আমাদের খেলাঘর ভাঙবো নি সাবু’।
    হাসিমুখে অবুঝ দুই বালক-বালিকা নিজেদের খেলনাবাটির ভাঙা ঘর গোছাতে বসে। পাকা গিন্নীর মতো টগর বলে, ‘কি আর করা যাবে, মাংসটা তো ফেলে দিয়েছি। আজ ডাল-ভাত খাও। কাল আবার মাংস এনোখনে, রেঁধে দেব’।

    কবিরাজ নিয়মিত আসে। এটা সবাই দেখে। কিন্তু কি ওষুধ দেয় সে সবার অজানা। অবশ্যি জানার কথাও নয়। মাঝখানে গৌরি এসেছিল খুঁড়োকে দেখতে। বাপ সমান খুঁড়োর এ হেন দুর্দশা দেখে স্থির থাকতে পারে নি। চীৎকার চ্যাঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করেছিল। বারবার শশীকে বলেছে, ‘ও তোমার কবরেজ কি ভুসি ওষুধ দিচ্ছে যে খুঁড়ো আমার রাতদিন মরার মতো পরি থাকে। তুমি অন্য কবরেজ দেখাও। বসিরহাট নে যাও। আর তাছাড়া মানের গুমোরে তালা না মেরি রেখে শেখরকে খপর দেও। তোমাদের জামাইকে গে বলি আমি। সে নিজে গে কলকাতা থেকি ভায়েরে ধরি আনবানে। কোথাকার কোন ছুঁড়িকে বউ করি এনি গলার মালা করি ঝুলায়ে রেখেছো। কেন আমি সেই ছোট্ট বয়স থেকি সতীন নে ঘর করছি, তাতি কি আমি পচে গলে গেছি? কম ঠ্যাঙানি খেয়েছি বরের কাছে। সেখানে শেখর তো শিব ঠাকুরটি’।
    শশী নিজের অন্তর্দ্বন্দে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। সেও গৌরীর এই ঠোনা মারা কথা সহ্য করতে পারে না। তুলোধোনা করে গৌরীকে। গৌরী স্পষ্ট জানিয়ে যায় তার এবার বাপের বাড়ির সম্পত্তি চাইই চাই।

    রামতনু ঢুলুঢুলু চোখে শশীর দিকে তাকায়। শশীর দুচোখে হিস্রতার আগুনের ফিনকি দিয়ে আগুন ছোটে। রামতনু ছোট ছেলের মতো টলমল করে উঠে বসে। শশীর দিকে চেয়ে বলে, ‘তুমি শশী না?’
    শশীর ভেতরে আগুনে জল পড়ে ভাপ সৃষ্টি হয়। আঁচল দিয়ে রামতনুর মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘কেন আমারে চিনতে পারতেছো না?’
    ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় প্রতাপশালী মানুষটা। বলে, ‘চলে যাও, চলে যাও তুমি। তোমার কথা শুনে আমার ছেলে আমার একমাত্র সন্তানকে আমি ত্যাজ্য করেছি। তুমি সোহাগীকে বিধবা বানিয়ে চুল কেটে দিয়েছো। তুমি নিষ্ঠুর’।
    শশীর অন্তরাত্মা ছটফটিয়ে মরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘বড়ো দরদ না তোমার ঐ মাগীর প্রতি’।
    রামতনু একটু ঝুঁকে শশীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘দরদ হবে বইকি। আমি যে তাকে ভালোবাসি। তোমার তো খালি শরীর আছে। আর তার যে শরীর মন দুটোই আছে’।
    শশী হাতের পুড়িয়ায় রাখা আফিমের ঢ্যালাখানা রামতনুর মুখ চেপে ধরে ভরে দেয় হা-মুখে। হাসে। বলে, ‘ন্যাও এবার স্বপন দেখো সে মরা মাগীর’। (ক্রমশ)

    ২৫

    বিমানের একটা কথা ঘুরে ফিরে শেখরের ভেতর ঢালাউপুড় হতে থাকে। সত্যি যেখানে ঝড়ের প্রয়োজন সেখানে দখিনা বাতাস দিলে কি চলে? বিমান সাতসকালে কোথাও যেন গেছে। শেখরের তখন ভালো করে ঘুমও ভাঙে নি। যাওয়ার সময় শেখরকে ডেকে বলে যায়, ‘আর শুয়ে থেকো না শেখর। কলেজের পড়ায় তুমি এমনি অনেক পিছিয়ে গেছো’।
    তারপর সত্যি আর বেশীক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে নি শেখর। মুখ হাত পা ধুয়ে বাসি ধুতি, ফতুয়া ছেড়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে বসে। কিন্তু তার মাঝেই দূর থেকে একটা হল্লা শুনতে পায়। মন উতলা হয়ে ওঠে। জপে বিঘ্ন ঘটে। দূর থেকে আসা মিছিলের ধ্বনি ক্রমশ স্পষ্ট হয়। জপ অসমাপ্ত রেখে রাস্তার দিকে জানলার কাছে ছুটে যায়। হ্যাঁ মিছিলের শব্দ ধ্বনি স্পষ্ট হয় ...
    ‘ভারতমাতা কি জয়। বন্দেমাতরম্‌। ইংরেজ ভারত ছাড়ো’।
    শেখরের নিজের ভেতরটাও কেমন উত্তেজনায় ছটফটিয়ে ওঠে। মনে হয় এই জানলার গরাদ ভেঙে এক ছুটে গিয়ে সামিল হয় ঐ অজগর সাপের মতো মিছিলের ভেতরে। চিৎকার করে বলে, ‘বন্দেমাতরম্‌’। নিজের অজান্তেই শেখরের ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করে ওঠে, ‘বন্দেমাতরম্‌। ইংরেজ ভারত ছাড়ো’।
    বলরাম চা আর রুটি তরকারি নিয়ে ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি দিয়ে ঘরে এসে হাই হাই করে চিৎকার করে ওঠে, ‘ও শেখর দাদাবাবু, শিগগিরি জানলা বন্ধ করো গো। দেখছোনি মিছিল আসচে। উদিকে গুলিগোলা শুরু হইচে। এই রইলো তোমার জলখাবার। আমি ছুটে গে আগে সদর দরজায় খিল দেই গে’।
    শেখর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘না না বলরামদা। বিমান সাতসকালেই কোথাও গেছে। বোধ করি ঐ মিছিলেই আছে সে’।
    বলরাম বলে, ‘ঠিক আচে, আমি তালে শুধু ভেতর দে দোর ভিজিয়ে রাখি। গোরা সৈন্যদের আমার বড়ো ভয় করে গো শেখর দাদাবাবু। তারা বড়ো নিষ্ঠুর। এই তোমার জলখাবার রেখে গেলুম, খেয়ে নিও’।
    শেখর ঘরময় বড়ো অস্থির হয়ে পায়চারি করে আর আপন মনে বলে, ‘না এখন আর ভয় পেলে চলবে না বলরামদা। আর আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার হয় মরো নয় মারো। কিন্তু বিমান সে কোথায়?’
    শেখরের দুচোখ জলে ভরে আসে। বলে, ‘ফিরে এসো বিমান। তোমার কিছু হলে আমি বাঁচবো না’।

    উনিশ শতকের বাংলার জাগরণের যুগধর্মী মানসিকতার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে সমকালীন পত্রপত্রিকায়। স্বয়ং হিন্দু কলেজের অধ্যাপক ডিরোজিও এবং তার ছাত্রগণ ইয়ংবেঙ্গল সম্প্রদায় ছিল এই জাগরণের পুরোভাগে। তারা তাদের সংস্কারমুক্ত ও অগ্রসর চিন্তাকে ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাহায্য নিয়েছিলেন। যেমন ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা। এটি ১৮৩১ সালে প্রকাশ হয় এবং ১৮৪০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। মধ্যযুগীয় অজ্ঞানতা, অন্ধ কুসংস্কারের বদলে বিজ্ঞান ও যুক্তিধর্মী জ্ঞানকে ইয়ংবেঙ্গল সম্প্রদায় আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন এ দেশের মানুষের ভেতর সঞ্চারিত করে দিতে। অজ্ঞানতা ও সামন্ততান্ত্রিক পশ্চাৎপদতার অবসান ঘটিয়ে ইউরোপের উন্নত বিজ্ঞান ও যুক্তিসম্মত জ্ঞানকে এদেশে বিস্তার করতে। তারাই প্রথম অনুভব করেছিলেন দেশমাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে এদেশের মানুষের ভেতর পুনর্জাগরণ দরকার। ‘জ্ঞানান্বেষণ’-এর একাধিক প্রবন্ধের মাধ্যমে তাদের এই মানসিকতার পরিচয় মেলে। তারা বিশ্বাস করতেন ভারতের মতো অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন দেশে জ্ঞানের বিস্তারই দেশপ্রেমের সবচেয়ে মহান নিদর্শন। তারা বিশ্বাস করতেন প্রগতিশীল পাশ্চাত্য দেশের জ্ঞানবিজ্ঞানকে এদেশের জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে অনুবাদের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। এদেশে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের ফলে ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান ও নীতিবোধের প্রসার এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই সম্পর্কে গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করে তারা এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যে এদেশের জাতীয় পুনর্জাগরণ আসন্ন প্রায়। স্বদেশে প্রচলিত পাঠশালাগুলির দুরবস্থা ও শিক্ষার অবনতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রিয় স্বদেশভূমির হিতসাধনে ইংরেজি কলেজ ও সেমিনারির আদর্শে এদেশে নতুন ধরনের পাঠশালা প্রয়োজন। সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে এই জ্ঞান পৌঁছে দেবার উপায় হল সুলভে পুস্তক প্রকাশ ও বিতরণ। এই উপলক্ষে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’র উদ্যোগকে তারা সাধুবাদ জানান। ‘দ্য হিন্দু ম্যানুয়াল অফ লিটারেচার এন্ড সায়েন্স’ থেকে একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছে, ‘ব্রিটেনরা যখন বর্বরতার স্তরে ছিল তখন তারা বহু দেবদেবীর আরাধনা করত এবং আমাদেরই মতো নানারকম অর্থহীন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করত। কিন্তু জ্ঞান, সভ্যতা, শক্তি ও সম্পদের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তারা এইসব অন্ধবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানকে পরিহার করেছে’।
    কিন্তু খ্রিষ্টান মিশনারিরা এদেশে এসে স্কুল কলেজের পরিবর্তে উপাসনা গৃহ স্থাপনে মনোনিবেশ করে। তাদের এই মনোভাবকে সমালোচনা করে জ্ঞানান্বেষণে লেখা হয়েছে যে ধর্মপ্রচারের আগ্রহে মিশনারিরা একথা বিস্মৃত হয়ে যান যে একমাত্র শিক্ষাই মানুষের মনকে পবিত্র ও নমনীয় করে তুলতে পারে। এই ইয়ংবেঙ্গল ছাত্রগোষ্ঠীর মতে বিশুদ্ধ ধর্ম কোনও একটি বিশেষ ধর্মমত বা উপাসনা নয়, তা হল সার্বজনীন যার মূলকথা হল মানব ও ঈশ্বরের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা। যে ধর্মে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টানে প্রভেদ নেই।
    মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান প্রভৃতি বিভিন্ন প্রবন্ধে তীক্ষ্ণ সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বিবাহ অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ কুলীন প্রমুখদের তুষ্ট করার জন্য নানা রুচিহীন আমোদ প্রমোদে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হত তা নিছক অপচয় ভিন্ন আর কিছু না। সে সময় সমাজে নারীদের যে হীন ও লজ্জাজনক পরিস্থিতি ছিল তার নির্মমতা অবর্ণনীয়। সে সময় জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘স্ত্রী লোকদিগকে অবশ্য মনুষ্য বলিয়া গণনা করিতে হইবেক। ইহারা সর্বতোভাবে পুরুষের সঙ্গে সমান কিন্তু আমার দিগের ব্যবস্থা ও ব্যবহারের দ্বারা তাহাদের অবস্থা এক প্রকার নীচ করাতে তাহারা যে মনুষ্য এমত প্রকাশ পাইতেছে না বরং আমাদিগের নিষ্ঠুর ব্যবহারেতে তাঁহারদিগের মনুষ্য বোধ করি না এমন প্রকাশ হইতেছে’। সতীদাহ প্রথা তাঁহার চোখে নারী হত্যা ছাড়া কিছুই নয়। সতীদাহ নিবারণ আইনের বিরুদ্ধে ‘ধর্মসভা’ যে আবেদন করেছিল তা প্রত্যাখ্যান করায় তারা সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যে ‘ধর্মসভার সমর্থকরা’ যতই ক্ষুব্ধ হন না কেন ‘নারী হত্যার’ অধিকার তারা আর কোনদিন ফিরে পাবেন না। বহুবিবাহ প্রথার অভিশাপ সম্পর্কেও আলোকপাত করে লেখা হয় সমাজের বুক থেকে এই কুপ্রথার প্রায় অবসান ঘটেছে বলে কোনও কোনও মহল দাবী করা সত্ত্বেও নানা তথ্যের ভিত্তিতে এই কুপ্রথার ব্যাপক প্রচলন আছে বলে দাবী করা হয়। তারা বিধবা বিবাহের যে কোনও উদ্যোগকেই সানন্দ সমর্থন জানিয়েছেন। বাল্যবিধবাদের অতিশয় দুর্গতি, লাঞ্ছনা তাহাদের বুকে যন্ত্রণার ডমরুর ধ্বনি তুলেছিল।
    ডিরোজিও-র অনুগামীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অ্যাডাম স্মিথের চিন্তাধারা মুক্ত বাণিজ্যনীতির পক্ষে ছিল বরাবরই। সেসময় ইউরোপে মার্কেন্টাইল মতবাদ বনাম অবাধ বাণিজ্যনীতি নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল ইয়ংবেঙ্গল সেই বিতর্কে ছিল অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে একচেটিয়া লবণ ও আফিমের বাণিজ্যের অধিকার বজায় রাখার তাঁরাও ছিলেন বিরোধী। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষক সমাজের অসহায় অবস্থার কথা বর্ণনা করে ইয়ংবেঙ্গলের অনুগামীরা বলেন যে এই নীতি গর্হিত না হলেও এর বাস্তব প্রয়োগের দিনগুলি অত্যন্ত নিন্দনীয়। কারণ এর দ্বারা কৃষক সম্প্রদায়ের স্বার্থকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। একদিকে জমিদারদের অবাধে কৃষক শোষণের অধিকার আর অন্যদিকে কোম্পানির পক্ষপাতদুষ্ট বিচার ব্যবস্থা, বিচারের নামে প্রহসন, কৃষকদের এই অবর্ণনীয় দুর্দশার জন্য দায়ী। আদালতগুলি ছিল দরিদ্র রায়তদের একেবারে নাগালের বাইরে। মফস্বলের আদালতগুলি তো তখন বিচারের নামে অবিচারই হতো। আদালতগুলিতে বিচারে অহেতুক বিলম্ব, বিপুল অর্থব্যয় ও আরও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার ফলে দরিদ্র রায়তদের আদালতে যাওয়ার বদলে সবরকম অন্যায় মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি থাকতে পারে।

    এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে ফের বিমানের চিন্তায় শেখরের বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে ওঠে। প্রায় জানলার কাছে রাস্তার উপর গুলির শব্দ শুনে জানলার কাছে ছুটে যায় শেখর। মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, গুলি ছুঁড়ছে। ‘বন্দেমাতরম্‌’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে।
    হিতেনবাবু হন্তদন্ত হয়ে শেখরদের ঘরে ঢুকে জানলার কাছে শেখরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রায় রে রে করে তেড়ে আসেন – ‘আরে আরে করছো কি ভায়া, দেখছো না গুলিগোলা চলছে। আর তুমি জানলা খুলে প্রকৃতি দেখছো? বন্ধ করো আগে জানলা বন্ধ করো। একটা গুলি যদি ছিটকে এসে গায়ে লাগে তো বাবা মায়ের দেওয়া প্রাণটা নিয়ে আর সুন্দরবনে ফিরতে হবে না। এখানেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। বউ বেচারি বেধবা হবে’।
    হিতেনের বাচালতায় শেখর বাধ্য হয়ে জানলার খড়খড়ি তুলে দেয়।
    হিতেনের দিকে ফিরতেই, হিতেন দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘ব্যাটাদের সাহস বলিহারি, ইংরেজদের সাথে পাঙ্গা লড়তে যাচ্ছিস! আরে ওরা আমাদের মনিব। আগে ওদের মতো সভ্য, ভদ্র হ, তারপর না যাবি লড়তে’।
    মুখচোরা, লাজুক, শান্ত স্বভাবের শেখরের মুখেও ভাষা ফুটে ওঠে, তার সমস্ত শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘এ দেশটা কাদের হিতেনবাবু? আমাদের, না ঐ সাদা চামড়ার মানুষগুলোর? কেন তারা আমাদের মনিব সেজে আছে? আপনাদের খারাপ লাগে না ওই লোকগুলোর দাসত্ব করতে? ওরা এক একটা ছারপোকা। আমাদের রক্ত চুষে খেয়ে ওরা নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। যীশুখ্রিষ্টকে ভজনা কর আর আমরা নেটিভ, আমাদের আচার, ধর্ম সংস্কার, কৃষ্টি সব খারাপ? সব খারাপ। তাই কি হতে পারে হিতেন বাবু? আপনিই বলুন না’।
    হিতেন মজুমদারের খেতে বসলে পাতের উপর গেছো ব্যাঙ লাফিয়ে এসে পড়লে বুঝি বা এতো চমকে উঠত না, শেখরের কথায় যেভাবে চমকে ওঠে। মনে মনে ভাবে বলে কি ছোঁড়া! এ তো বড়লোকের দুগ্ধ পোষ্য। ননীর তাল। যেখানে ঢেলা মাটি, কাঁকরের আঁচড়টুকু নেই সেখানে এমন ধারালো ইস্পাতের ফলা গজালো কি করে!
    শেখরকে যেন আজ কথায় পেয়েছে। তাদের সুন্দরবনের নদীনালার দেশে ভরা বর্ষায় যখন পুকুর দীঘির জল উপচে পড়ে তখন নালা কেটে দিতে হয়। সেই নালা বেয়ে কলকলিয়ে পুকুর, দীঘির জল নদীতে গিয়ে পড়ে। নদী থেকে সাগরে। সাগর থেকে মহাসাগরে। কূলকিনারাবিহীন এক অনন্তের দেশে। শেখরের ধবধবে ফর্সা মুখ ক্রোধের আগুনের তাপে লালচে হয়ে উঠেছে। গলার শিরাগুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত। তবু এক কিসের যেন ঘোরে প্রলাপের মতো বলে চলেছে এই সুদর্শন তরুণ যুবক – ‘শুনুন হিতেন বাবু, এই দেশের মূল শত্রু ঐ সাদা চামড়ার খ্রিস্টানরা না। আমরা নিজেরাই নিজেদের আসল শত্রু’।
    কথা হয়তো আরও গড়াতো। কিন্তু তার আগেই বলরাম ছুটতে ছুটতে এসে কোনরকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘ও শেখর দাদাবাবু, তুমি এখানে বক্তিমে করছ? শিগগিরি নিচে এসো সবাই। কি সর্বনাশ হয়েছে দেখবে এসো’।
    জাতপাতের দূরত্ব ভুলে শেখর বলরামের দুহাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে, ‘শিগগিরি বল বলরাম দাদা, বিমানের কি হয়েছে?’
    কেঁদে ফেলে শেখর। কান্নার বাষ্প রুদ্ধ গলায় বলে, ‘বিমানের গায়ে কি গুলি লেগেছে। না ঐ ঘাতক গোরা সৈন্যরা লাঠির বাড়ি মেরে তার মাথাটা ফাটিয়ে দিয়েছে?’
    বলরাম শেখরের এহেন আচরণে আপ্লুত হয়ে ওঠে, ‘না গো শেখর দাদাবাবু। আমাদের বিমান দাদাবাবু নয় এ এক অন্য অচেনা ছেলে। তোমাদেরই বয়সি হবে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গো শরীর। আমার রান্না ঘরের সামনে এসে হাতজোড় করে বলে – ‘দয়া করে একটু আশ্রয় দিন। আমাকে বাঁচান। আমি মরতে ভয় পাই না। কিন্তু এখনই মরতে চাই না। দেশের জন্য অনেক কাজ বাকি’।
    হিতেন মজুমদার এতক্ষণে কথা কয়ে ওঠে, ‘যাচ্চলে, এ আবার কোন আপদ। সব জ্বালিয়ে মারলে দেখছি’। তারপর বলরামের দিকে ফিরে দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে, ‘হতভাগা তুই সদর দরজাটা বন্ধ করে রাখতে পারিস নি? তোর জন্যই এই বেপত্তি’।
    বলরাম কাঁদকাঁদ মুখে হাতজোড় করে বলে, ‘বাবু আমাকে আপনি মারবেন, কাটবেন আপনার প্রাণে যা চায় তাই করবেন। এখন দয়া করে একটিবার নিচে চলুন’।
    শেখর বলে, ‘তুমি সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছ তো বলরাম দা?’
    বলরাম বলে, ‘না গো সে ছেলে নিজে ঢুকেই সদর দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়েছে’।
    ‘হুঁ’ করে নাক দিয়ে একটা শব্দ করে হিতেন বাবু বলে, ‘সেয়ানা মাল’।
    শেখর বিরক্তি চেপে না থাকতে পেরে বলে, ‘আঃ হিতেন বাবু, দয়া করে আপনি আপনার শ্রীমুখটি এবার বন্ধ করুন। নিচে নামতে ইচ্ছে না হয় নিজের ঘরে গিয়ে দোর বন্ধ করে থাকুন’।
    তারপর বলরামকে বলে, ‘তাড়াতাড়ি নিচে চলো বলরামদা’।
    হিতেন জোরে না বলে ফিসফিসিয়ে স্বগতোক্তি করে, ‘চলো তোমাদের পাল্লায় পড়ে আমিও না হয় একটু দেশ উদ্ধার করে আসি’।

    রান্নাঘরের সামনের লাল রঙের লম্বা টানা বারান্দাটায় ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে সেই গুলিবিদ্ধ যুবক। রক্তে লাল রঙের সাথে মেঝের লাল রং মিশে আরও তার গাঢ়ত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে তবু যেন ছেলেটি বিড়বিড় করে কি বলছে। শেখর হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। ঝুঁকে গিয়ে ছেলেটির মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে শোনবার চেষ্টা করে কি বলছে সে। শুনতে পায় ছেলেটি বলছে, ‘বন্দেমাতরম্‌। বন্দেমাতরম্‌। ভারতমাতা কি জয়’।
    শিউড়ে ওঠে শেখর। দেশমাতার এ কোন বীর সন্তান! কি এর পরিচয়? কোনরকমে জিজ্ঞাসা করে, ‘ভাই তোমার নাম কি? কি পরিচয়?’
    বলরাম বয়েসে প্রবীণ না হলেও জীবন অভিজ্ঞতায় প্রবীণ। সে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। বলে, ‘আঃ শেখর দাদাবাবু। এসব পরে শুধিয়ো খন। আগে মানুষটাকে বাঁচাতে হবে’।
    শেখরেরও যেন সম্বিৎ ফেরে। বলে, ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছ। তুমি একটু গরম জল বসাও তো বলরামদা’।
    হাঁটুর উপরে বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। ধুতিখানা রক্তে লাল হয়ে গেছে। ফতুয়াতেও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
    শেখর আবার বলরামকে বলে, ‘দেখো তো বলরামদা, সমরদা বা বিষ্ণুদার মধ্যে কেউ ঘরে আছে কিনা?’
    বলরাম জানায়, ‘হ্যাঁ সমরদা মনে হয় আছে। দাঁড়াও গরম জলটা বসিয়ে আমি গিয়ে ডেকে আনছি’।
    হিতেন এতক্ষণে হাই তুলে বলে, ‘আমার বাপু আর রঙ্গ ভালো লাগছে না। তোমরা দেশমাতার সেবককে বাঁচাও। আমি ঘরে গিয়ে একটু চুরুটে টান দেই। ও হ্যাঁ। সমর ছোড়াকে ডেকে দিচ্ছি’।
    শেখরের জিবের ডগায় আলটপকা একটা কড়া কথা এসে গেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে সামলে নিয়ে চুপ করে থাকে।

    হিতেনবাবু বেশ দুলকি চালে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ওপরে উঠতে থাকে। সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে শেখর প্রায় স্বগতোক্তি করে ফেলে, ‘এনারা কি মানুষ?’
    বলরাম বলে ওঠে, ‘ওসব নি ভেবো না শেখর দাদাবাবু। তুমি নতুন দাদাবাবুর ক্ষতটা ধুইয়ে দাও তো, আমি যাই গে দেখি সমরদাদাকে খবরটা করলেন কিনা উনি’।
    কিন্তু তখনই সদর দরজায় ঘা পড়ে – গুম, গুম, গুম।
    নতুন ছেলেটির ভয়ে চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আতঙ্কে, যন্ত্রণায় তার গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে শব্দ বার হয়। কোনরকমে বলে, ‘দরজাটা দয়া করে খুইলবেন না বটে। গোরা সৈন্যরা হামাকে ধইরতে আসছেক’।
    ছেলেটার মুখের ভাষাগুলো বিজাতীয় শোনায় শেখরের কানে। সে বলে, ‘তোমার ভয় নেই ভাই। আমরা ঐ বদমায়েশগুলোর হাতে তোমাকে কিছুতেই তুলে দেব না। কিন্তু আমার এক বন্ধু সেও বাইরে। হতে পারে ঐ মিছিলে সেও ছিল। সেও তোমার মতোই স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে সামিল। আমি তার চিন্তায় খুব অস্থির হয়ে আছি। আমাকে একবার গিয়ে দেখতেই হবে’।
    সমর ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। এসে রক্তাক্ত ছেলেটিকে দেখে আঁতকে ওঠে।
    শেখর সদর দরজার সামনে ছুটে চলে যায়।
    আবার সদর দরজায় ঘা পড়ে। চাপা কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘বলরামদা দরজা খোলো’।
    বিমানের গলা শুনে কোমল হৃদয়ের শেখর কেঁদে ফেলে। তাড়াতাড়ি সদর দরজার ছিটকিনি, খিল খুলে আপ্লুত গলায় বলে, ‘বিমান তুমি? ফিরেছো? আমি চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি কি মিছিলে ছিলে ভাই? আমাদের মেসবাড়ির সামনেই তো গুলি চলেছে। এদিকে দেখো কি অবস্থা। একটা ছেলে গুলি খেয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে’।
    বিমান নিজেই দরজার ছিটকিনি তুলে খিল লাগিয়ে দিয়ে বলে, ‘শিগগিরি চলো শেখর, গিয়ে দেখি কে সে? কি অবস্থা তার?’
    শেখর তবু বলে, ‘তুমি ঠিক আছো তো বিমান?’
    ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা বিমানের। শেখরের পিঠে সে তবু হাত রেখে বলে, ‘তুমি আমাকে নিয়ে একদম ভেবো না শেখর, আমি একদম ঠিক আছি। চলো গিয়ে দেখি কে সে?’

    সমর ক্ষতস্থান ধুয়ে দিচ্ছে। বিমান সামনে গিয়ে উপস্থিত হতেই জখম হওয়া ছেলেটি যন্ত্রণায় চোখমুখ ভাঙচুর হতে হতে কেঁদে ওঠে, ‘বিমানদা’।
    বিমানও ‘গৌর তুমি? হা ভগবান!’ বলে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। বিমানের মতো ছেলেকেও দুর্ভাবনার কালো মেঘ ঘিরে ধরে। ছলছল চোখে বলে, ‘কি হবে সমরদা? গুলি তো ভিতরে আছে’।
    সমর বলে, ‘ওকে ধরাধরি করে আমাদের ঘরে নিয়ে চলো। ফার্স্ট এড বক্সও এই সময় নেই। তারিণীবাবুও একটু পরে ফিরবে। জবাবদিহি করতে করতে জীবন বেরিয়ে যাবে। তাছাড়া চিকিৎসার যেটুকু যা আছে ও ঘরেই আছে’।
    ব্যথায় ককিয়ে ওঠে গৌর নামের তরুণ ছেলেটি। বিমান গৌরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘একবার ভগবান যখন তোমাকে এখানে এনে ফেলেছে, আমরা তোমাকে সুস্থ করে তুলবোই। তুমি শুধু দাঁতে দাঁত চেপে একটু কষ্ট সহ্য করো। আমি জানি তুমি পারবে এ লড়াই লড়তে। তোমার অদম্য সাহস, মনের জোর আমরা জানি। বল গৌর – বন্দে মাতরম্‌’।
    শুধু গৌর না সকলেই বলে ওঠে ‘বন্দে মাতরম্‌’। এমনকি বলরামও। সবাই মিলে গৌরকে তুলে ধরে। ‘বন্দে মাতরম্‌’ ধ্বনি দিতে দিতে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। (ক্রমশ)

    ২৬

    মাস চারেক দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল। কোথা দিয়ে সময় যেন হুঁশ করে চলে গেল। আসলে সময় তো বাতাস। বয়ে যায় কিন্তু কেউ তাকে দেখতে বা ধরতে পারে না। অনুভবেও আসে না। কি অদ্ভুতভাবে সঙ্গে নিয়ে চলে জীবন্ত সংসারকে। তবু তাকে ধরা যায় না। তেমনি চারটে মাস যে কাউকে বুঝতে না দিয়েই চলে গেল। কিন্তু টাকির রোজিপুরের আন্নাকালি? তার কি হল? শেখরের সাথে মাস দুই তিনের যে দাম্পত্য জীবন গড়ে উঠেছিল, সেখানে সংসার-সংসার খেলা হয় নি বটে কিন্তু শরীর তো খেলেছিল, মনও। শেখর এই চার মাসে না বিজয়, না আন্না কাউকেই কোনও পত্র লেখে নি। শেখর এমনই। সব সম্পর্ক, দায়িত্ব একসাথে সামলাতে পারে না। হতে পারে তার গভীরতা নিয়ে ভাববার প্রয়োজনও মনে করে না। ছোটো থেকে শশীর আদর, আশ্রয়, আশকারায় বেড়ে ওঠা শেখরের ব্যক্তিত্বটা এমন ভাবেই গড়ে উঠেছে। আর টগরমণি? তাকে তো সেই বিয়ের রাতেই ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এসেছে। এখন দেশপ্রেমের ওমে জারিত হচ্ছে তার সত্ত্বা। কিন্তু বিজয়ের আদর্শে গড়ে ওঠা আন্নার ভেতরে স্বামীসঙ্গ আমূল তার চেতনার ভিত টলিয়ে দিয়েছে। যে মেয়ে এক সময় চুলের খোঁপার ভেতর রিভলবার লুকিয়ে রেখে বাবার দেশের কাজে সাহায্য করতো তার জঠরে আজ পালিত হচ্ছে ভ্রূণ। শেখরের ঔরসে মা হতে চলেছে। মাতৃত্ব কি জিনিস আন্না জানে না। সেজন্য সে নিয়ে তার মাথাব্যথাও নেই। শুধু সর্বক্ষণের কথা বলার সঙ্গীটি না থাকায় বড়ো ফাঁকা লাগছে। শূন্য লাগছে ঘরখানা। পাখির খাঁচার কাছে গিয়ে পাখিকে লঙ্কা খাওয়াতে খাওয়াতে আনমনা হয়ে যাচ্ছে। কিংবা ভাবছে এই বুঝি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শেখর। বলছে – আমাকে একটা লঙ্কা দাও তো, পাখিকে খাওয়াই। পাখির ‘আন্‌না’ ডাকে ঘোর কাটছে। আর তখনই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে চোখদুটো জলে ভরে ওঠাতে এক ছুটে ঘরে গিয়ে দোরে খিল তুলে বিছানার উপর উপুড় হয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মনে পড়তে থাকে এ ঘরটা জুড়ে একটা মানুষের আদর ভালোবাসার খুনসুটি। তবে আন্না অনভিজ্ঞ হতে পারে কিন্তু বৈঁচি তো নয়। তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি থেকে মেয়ের সন্তান সম্ভবার আভাস ঠিক টের পেয়ে যায়। আর টের পেয়েই সে সমস্ত শালীনতা, সম্ভ্রম, শ্রদ্ধাবোধ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয়ের উপর। বিজয় অবশ্য শেখরের চলে যাওয়াতে গোপনে কোথাও খুশিই। আন্না তার আবার একার। অধিকার বোধে কোনও প্রতিপক্ষ নেই। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেমের পাঠ পড়ানোর জন্য এমন উপযুক্ত আধার আর কোথায়ই বা আছে। সেই ছোট্ট মেয়েটি। যে কিনা একদিন বাবার গলা জড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘বাবা, আমার তবে কি দুটো মা?’
    বিস্ময়ে বিজয় চমকে বলে ওঠে, ‘সে কি কেন? কে বলেছে তোমাকে এসব কথা?’
    আন্না বিজয়কে আরও অবাক করে দিয়ে বলে, ‘কেন তুমিই তো বল দেশ আমাদের মা। তালে তো দুটো মা-ই হবে’। হেঁশেলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘উই ওখানে একটা মা রান্না করছে আর দেশ একটা মা’।
    মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রাণখোলা হাসিতে বাড়ি কাঁপিয়ে তোলে বিজয়। চীৎকার করে বলে, ‘শিগগির শুনে যাও আন্নার মা, কি বলছে তোমার মেয়ে?’
    বৈঁচি সব শুনে মুখ টিপে হেসে বলে, ‘দাও দাও মেয়েকে আরও প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোল’।
    সে সব দিনগুলো কোথায় গেল? এ বড়ো প্রশ্নটা কুরে কুরে খায় বিজয়কে। ঘুরে ফিরে সব রাগ যেন গিয়ে পড়ে ঐ শেখরের উপর। সেই সাথে সমাজ তথা নিজেকেও ধিক্কার দেয়। বিজয় তার সাধের বহু স্বপ্নের ধর্মগোলা স্থাপন করেছে। চণ্ডীমণ্ডপে তা শোভা পাচ্ছে। একটা নয়, এত ধান জমা পড়েছে যে দু’দুটো গোলা বানাতে হয়েছে। এভাবে গ্রামের সব মানুষকে পাশে পেলে মন করি কতগুলোই না তৈরি করাতে হবে। আহা ধানের গর্ভে সে যেন আসন্ন পোয়াতি মা। বিজয়ের কি ইচ্ছা করে এইসব বৃত্তান্ত মেয়েটাকে ফলাও করে শোনায়। কিন্তু মেয়েটা যেন কেমন মিইয়ে থাকে সবসময়। ঘরের ভেতর সারাক্ষণ সেধিয়েই থাকে। একদিন গলা তুলে বলেছিল, ‘আয় তো মা আন্না, এখন তো শেখর নেই, তোর বই, সেলেট, চকগুলোয় ধুলো পড়ে গেছে, ঝেড়ে পুছে নিয়ে আয়। বাপ-মেয়েতে আবার লেখাপড়া শুরু করি। জানিস তো বলির রাম দাও ফেলে রাখলে জং ধরে যায়। তাকেও মাঝেমাঝে বালিতে ঘষে শান দিয়ে নিতে হয়। তেমনি জীবনটাও অমনি। মাঝেমাঝে শান না দিলে জং পড়ে যায়’।
    কিন্তু বৈঁচি ফস করে বলে, ‘খবরদার না। ওর বে হয়ে গেছে। ও এখন আর কচি খুকিটি নেই। তার চে বরং ঘরকন্যার কাজ শিখুক। এইখানে বাবা মায়ের কাছে চিরটাকাল থাকবে? ওকে যেতে হবে তো কলকাতায়, সেখানে নিজের সংসার করতে হবে না?’
    বৈঁচির কথায় চমকে উঠেছিল বিজয়। আন্না চলে যাবে! চলে যাবে মানে। এই ঘর দুয়ার শূন্য করে তার প্রাণপাখি উড়ে যাবে! কিন্তু বৈঁচির ঝাঁঝের কাছে সে আর মুখ খোলে না। চুপ করে থাকে।
    বৈঁচির আজকাল কি হয়েছে। সারাক্ষণ যেন টগবগিয়ে ফুটছে। আর যত রাগ যেন বিজয়ের উপর।
    বৈঁচি মেয়ের রকমসকম দেখে যা আন্দাজ করার করেছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছল সেদিন উঠোনের উনুনটা গরম ছিল বলে ছাই বার করে লেপে মুছে রাখতে পারে নি, ভেবেছিল বিকালে সে কাজটা করবে। নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে একটু চোখ লেগেও গিয়েছিল। কিন্তু কি একটা স্বপ্ন দেখে তড়াক করে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙ্গেই মনে হয় মেয়েটা কি করছে একটিবার দেখে আসি তো। দরজার কপাট খুলে বাইরে আসতেই দেখে মেয়েটা কোঁচরে করে কি যেন লুকিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছে।
    ‘কি নিয়ে যাচ্ছিস রে আন্না?’ বলতেই কেঁপে উঠে কোঁচর থেকে ছাই পড়ে যায়।
    আন্নার মুখের ভেতরও ছাই। সে কোনরকমে বলে, ‘আমি মাত্র দুদিন খেয়েছি মা’।
    যে ঘটনা অনুধাবন করে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কথা সে ঘটনা বৈঁচির চোখে জল এনে দেয়।

    ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ‘মহকুমা’ হিসেবে বসিরহাটের গড়ে ওঠা হয়তো সম্ভব হতো না যদি সোলাদানার ওপর ইছামতী তার আগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়তো। নিমক পত্তনের অধীনে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো টাকির কিছুদূরে যমুনা – ইছামতীর তটে সোলাদানা নামক রম্যস্থানে সুন্দরবন অঞ্চলের এক চৌকি বসেছিল উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে, সাহেবদের বসবাসের কারণে সোলাদানার ‘অপূর্বশ্রী’ হয়েছিল।
    রামমোহনের ইংল্যান্ড গমনের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের নিকট থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুর, ‘নিমক পোত্তানের’ অথবা সল্টবোর্ডের দেওয়ানের পদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সল্টবোর্ডের দেওয়ানি পাওয়ার জন্য আবশ্যিক শর্ত হিসেবে জামিনদারের প্রয়োজন হতো। টাকির তৎকালীন জমিদার কালীনাথ মুন্সি এ ব্যাপারে নির্দ্বিধায় দ্বারকানাথের জামিনদার হয়েছিলেন।
    সোলাদানায় নিমক পত্তনের দেওয়ান হওয়ার কারণে দ্বারকানাথকে প্রায়ই সোলাদানায় আসতে হত। রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালিনাথ মুন্সির সঙ্গে সজিব যোগাযোগ ছিল। সোলাদানা এলেই দ্বারকানাথ টাকি আসতেন। আবার কখনও কখনও একসঙ্গে সোলাদানার বাগান হয়ে টাকি যেতেন। তাই টাকির রোজিপুর গ্রামের শ্রীবৃদ্ধিও দিনে দিনে বাড়তে থাকে। যখন চারদিক সুজলা-সুফলা হয়ে উঠতে লাগে তখনই বিজয়ের সংসারে দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসতে থাকে। তার প্রধান কারণ তার স্নেহের পুত্তলির জীবনের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যদি শেখর ঘরজামাই থেকে যেত তাহলে এতো টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হত না। সেক্ষেত্রে হয়তো জামাইকে গড়েপিঠে ঘরের ছেলে বানিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু তার এই কলকাতা থাকার ব্যাপারটি সব দিক থেকে এ পরিবারটিকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।
    বৈঁচি আন্নার সন্তান সম্ভাবনার বিষয়টি বুঝেও যেন বুঝতে পারে না। তাই সে চুপিচুপি মঙ্গলাকে দিয়ে দাইকে খবর করে। দাই এসে নানারকমভাবে পরীক্ষা করে বলে, ‘হ্যাঁ গো মা, খুকি আমাদের সত্যি মা হতে চলেছে। বাবুকে বলে মোটা বকশিশ দিতি হবে গো। পেত্থম বাচ্চা বলে কথা’।
    বৈঁচির মাথায় তখন হাজার ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
    মঙ্গলাই বলে, ‘বৌদি দাইকে সিধে দিয়ে এখন বিদেয় দাও’। তারপর দাইকে বলে, ‘ও দাই তুমি বখসিস পাবে গো ও নে চিনতে করো নি’।
    দাইকে বিদায় করে মঙ্গলা বলে, ‘বৌদি তুমি দাদাকে আগে জানাও। এত্ত বড়ো খবর তো নিজের ভেতর রাখতে পারবে নি। তাছাড়া ক’মাস পরেই তো তা ফুটে বের হবে’।
    আর আন্না সে বেচারি কিছুই বুঝতে পারছে না। সে একবার মা, একবার মঙ্গলা পিসির দিকে বারবার তাকাচ্ছে। মা হওয়ার মতো আনন্দের বিষয় শরীর চেনা হলেও তার কাছে অজানা। সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওমা, ও পিসি আমার কি হয়েছে? দাই এসে কি বলে গেল? তোমরা বাবাকে এট্টিবার ডাক না। আমার ভয় করছে’।
    গরম তাওয়ায় জল পড়ার মতো ছ্যাঁক করে ওঠে বৈঁচি, ‘দেখছ মঙ্গলা, কি বাপ সোহাগী মেয়ে। কোথায় এখন সোয়ামীর কথা মনে পড়বে, তারে খবর দিতে মন চাইবে। তা না বাপকে ডাকো’।
    আন্না মায়ের মূর্তি দেখে ভয়ে সিটিয়ে যায়।
    মঙ্গলা বৈঁচিকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘চুপ মারো বৌদি, ও ছেলেমানুষ। আমি বুঝিয়ে বলতেছি’।

    দাইকে সিধে দিয়ে বিদায় দিতে গেলে দাই বলে, ‘মা ঠাকরুন, খুকি পেত্থমবার পোয়াতি হয়েছে, বাচ্চা বিয়োবার সময় আমাকে কিন্তু মোটা বখশিশ, নতুন একখান শাড়ি আর বেটা হলে সোনার নাকফুল দিতি হবে, এই বলে রাখলাম কিন্তু। তুমি কিচ্ছুটি চিন্তে করো নি মা ঠাকরুন। আমি মাঝে মাঝে এসি খুকির সরীলের খপর নে যাবোখন। তবে মেয়ে কিন্তু তোমার বড্ড দুব্বল’।
    বৈঁচির মাথার ভেতর হাজারো ঘুঘরো পোকার ডাক। সে ‘আচ্ছা’, ‘ঠিক আছে’, ‘তাই হবে’ এসব বলে বিদায় করে দাইকে।
    আর ওদিকে মঙ্গলা আন্নার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আন্না তুই মা হতে চলেছিস। মনে থাকে যেন তুমি আর সেই ছোট্ট আন্নাটি না। তোমার এই শরীলটার ভেতর আর একডা শরীল এট্টু এট্টু করে বাড়তেছে। একদম লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করবে না’।
    আন্না খুব অবাক হয়ে বলে, ‘পুকুরে নাইতে গে সাঁতরাবো না?’
    বৈঁচি ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ ঝামটে বলে, ‘হ্যাঁ তা যাবে বৈকি। খুব যাবে। বাপ সোহাগী মেয়ে তুমি, তোমার বাপ জানলে পরে এক্ষুনি কইবে খনে – আহা ও বলছে যখন, দু’একবার গেলে কিচ্ছু হবে না’।
    মঙ্গলা থামায় বৈঁচিকে, ‘আঃ বৌদি তুমি এমনভাবে খুঁড়ছো কেন বল তো? এই তুমিই তো আমাকে কতবার বলেছো – মঙ্গলা, মেয়েটার বোধহয় আমার সংসার, স্বামীসুখ আর হল না। ওকি সারাজীবন বাপের ঘরেই থাকবে! এখন না হয় ছোটো কিন্তু যখন বড়ো হবে! যেদিন আমরা থাকবো না সেদিন কি হবে আমার মেয়েটার?’
    মঙ্গলার কথায় ডুকরে কেঁদে ওঠে বৈঁচি, ‘হ্যাঁগো ভাই একশোবার, হাজারবার চেয়েছি। ভগবানের থানে থানে মাথা ঠুকে ঐ একই কথা কয়েছি, কিন্তু এ কেমন স্বামীসুখ হল ওর? আর সংসার? তার কি হবে। শেখর সেই যে কলকাতা গেছে একটা পত্তর পর্যন্ত দেয় নি। দ্বিতীয় বের দিন নদী সাঁতরে পলায়ে আসলো। তখন সেদিন সে মেয়েটার কি হল একবারও তার মনে হয় নি। শেখরের সেদিন এই মনোভাবকেই খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু আজ যদি ঐ একই ঘটনা আমার মেয়ের ক্ষেত্রে ঘটে! যদি কলকেতা গিয়ে শেখর আন্নাকে বেমালুম ভুলে যায়!’
    মঙ্গলা আন্নার মুখের দিকে একবার নজর করে চাপাস্বরে ধমক দেয় বৈঁচিকে, ‘আঃ বৌদি মেয়েটার সামনে কি অলুক্ষুনে কথা বলছো তুমি! সে লেখাপড়া করে। কলেজে পড়ে। এদ্দিন লেখাপড়ার ক্ষেতি হয়েছে। তাই সেসপ নে ব্যস্ত। তুমি দাদার কানে খপরটা দেও। আনন্দ করো। আর ক’দিন বাদে কচি গলার হাসি-কান্নায় কলকল করবে এ বাড়ি। মা বিশালাক্ষ্মীর থানে মানত করো। সপ ঠিক হয়ে যাবেনে’।
    এমন কথায় বৈঁচির গ্রীষ্মের দাবদাহে দখিনা বাতাসের মতো সামান্য স্বস্তি মিললেও ভেতরে উচাটন ভাবটা থেকেই যায়। আর আন্না। সে বেচারি আলো আধারির ছায়াময় জগতে কিছু না বুঝলেও তার পেটের ভেতর আর একটি প্রাণের হদিশ বুঝতে পারে। মা, মঙ্গলা পিসি ঘরের বাইরে চলে গেলে সে নিজের পেটের ওপরে হাত রাখে। বয়স তার কম হলেও সতীন ব্যাপারটা সে বোঝে, জানে। শেখরের সেই কলকাতা চলে যাওয়ার পর থেকে একটা পত্র না লেখাকে সে ভালোভাবে মেনে নিতে পারে না। আচ্ছা শেখর যদি ঐ সতীনটার কাছে ফিরে যায়। যদি আর কোনদিন আন্নার কাছে ফিরে না আসে। অজানা এক শঙ্কা, অভিমানে আন্নার ভেতরটা টলটল করতে থাকে। তার চোখ বেয়ে জল নেমে আসে। ঘরটার চারপাশে তাকায়। ঘরময় মানুষটার স্মৃতি। আন্না আর নিজেকে সামলাতে পারে না। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আন্না আর থামতেই চায় না, কি করবে সে। খুব যে কষ্ট হচ্ছে, কেউ যে নেই যাকে সে এ কষ্টের কথা বলতে পারে।

    সেই ধর্মগোলা স্থাপন হওয়ার পর থেকে বিজয় সে সব নিয়ে একেবারে নাওয়া, খাওয়া ভুলে গেছে। ঘরে তার একটু মন বসে না। আসলে শেখরের চলে যাওয়ার পর বিজয় ভালো করে বুঝতে পেরেছে তার সংসারে খুব বড়ো রকম একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। সবথেকে কাছের মানুষটির নাগাল সে যেন আর পায় না। তার স্নেহের পুত্তলি যেন তার কাছ থেকে অনেক দূরে। ভালো লাগে না কিছু বিজয়ের। সবই করছে কিন্তু সব যেন দায়সারা গোছের। প্রাণ নেই কিছুতে।

    টাকির জমিদার কালীনাথের সময়ে বসিরহাটের অদূরবর্তী বাদুড়িয়ার পূঁড়ায় তিতুমিরের নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়, একটা পর্যায়ে এই বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক চরিত্র বিশিষ্ট হলেও পরবর্তীতে এই চরিত্র অপসৃত হয়। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই বিদ্রোহ হয়ে ওঠে উনিশ শতকের প্রথম ব্রিটিশশাসন বিরোধী, নীলকর বিরোধী সশস্ত্র গণবিদ্রোহ। পূঁড়া-গোবরডাঙ্গা প্রভৃতি অঞ্চলের জমিদাররা যেমন এই বিদ্রোহে সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন, টাকির জমিদাররা সরাসরি সে পথে হাঁটেন নি। এই বিদ্রোহের আগুণ টাকিতে ছড়ায়ও নি। জমিদার হিসাবে এ হেন প্রজা বিদ্রোহকে জমিদার কালীনাথ মুন্সি মেনে নিতে পারেন নি। বিজয়ের বাবা সেই তিতুর দলে নাম লিখিয়ে শহীদ হওয়ার প্রথম থেকেই ভালো চোখে দেখে নি জমিদার পরিবার। সেই থেকে জমিদার পরিবারের উষ্মা বিজয়দের পরিবারের প্রতি। ধর্মগোলাকে স্থাপন করে রোজিপুর গ্রামের মানুষের কাছে ক্রমশ মাথার মণি হয়ে ওঠা বিজয়কে ঈর্ষা হওয়াটাই জমিদার বাড়ির মানুষের কাছে স্বাভাবিক। মুন্সি জমিদার বাড়ি থেকে ডাক পড়ে বিজয়ের। অকুতোভয় বিজয় কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা জমিদার বাড়ি এসে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চায়, ‘আমাকে ডেকে পাঠানো হল কেন?’
    উত্তরে শুনতে হল, ‘তোকে লেঠেল দিয়ে রাস্তা দিয়ে নাকখত দিতে দিতে নিয়ে আসিনি এই তোর বাপের ভাগ্যি ভালো’।
    দৃঢ়চেতা, অকুতোভয় দেশমাতার এই সন্তান বিজয় হাসিমুখে বলে, ‘এটাই স্বাভাবিক। জমিদার রমানাথ মুন্সিও তো ঐ জন্য লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে সমর্থন করেছিল’।
    এমন সপাট উত্তরে সেদিন বুঝি কালীনাথ মুন্সির বংশধরের সাধের গড়গড়ার গুরগুরানির আওয়াজের সাথে থেমে গিয়েছিল পায়রাদের বকবকম বকবকম ধ্বনি। লেঠেল সর্দার শুধু অপেক্ষায় ছিল এক ইশারায় বিজয়ের মাথাটা লাঠির বাড়িতে দু’ভাগ করে দেওয়ার। কিন্তু ঈশান কোণে এক টুকরো মেঘও অনেক সময় ঝড়ের পূর্বাভাস বহন করে। তাই থেমে গেছিল জমিদারী রক্ত। রাজনীতির আঙিনায় কখনও কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই। তা জেনেছিল পিতা পিতামহদের কাছ থেকে। বৃটিশ অনুরাগী মুন্সি জমিদার সেদিন থেমে গিয়ে শুধু গমগমে গলায় জানায়, ‘শোন হে বিজয় মাতব্বর সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদে শ্রদ্ধেয় কালীনাথ মুন্সির সমর্থন ছিল’।
    বিজয় বিনয়ের সঙ্গে শান্ত, নম্র ভদ্র গলায় বলে, ‘জানি। তাইতো উনি বলেছিলেন – By our rulers this load of disgrace has been removed from us and why therefore should we not declare that this British Majesty is unequalled in preservation of the lives, property and honour of his subjects’।
    বিজয়ের এই উদাত্ত কণ্ঠে ইংরাজি উচ্চারণ বড়ো চিন্তিত করে তোলে জমিদার রক্তকে। তিনি আদেশ দেন, ‘তুমি বাড়ি যাও’। মনে মনে বলে – তোমার বিনাশ একটু হিসাব কষেই করতে হবে।
    বিজয়ও বুঝতে পারে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য দশজন লোক পেলেও জমিদার পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য পাঁচজনও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আনুগত্য এমন জিনিস যে অন্যায়ও সেখানে ন্যায়।

    আন্না ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে আজ খুব বমি করেছে। ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে গেছে বেচারি। বৈঁচি রাগে দুঃখে ক্ষোভে আজ সাঁঝবাতিটুকুও দেয় নি। কুপি জ্বালায় নি। সারাদিন পার করে সন্ধ্যা উতরে বিজয় উঠোনে পা দিলেই বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বৈঁচি বিজয়ের উপর, ‘কোথায় ছিলে এত সময়? বলো কোথায় ছিলে? যাওয়ার সময় আমাকে একবার বলবার কথা মনে হয় না না? তোমার কাছে দেশ উদ্ধারই সব! বাড়ির মানুষগুলো মরলো কি বাঁচলো কিস্যু যায় আসে না তোমার না?’ রাগে, দুঃখে, অভিমানে, উত্তেজনায় কেঁদে ফেলে বৈঁচি।
    বিজয় দাওয়ায় বসে পড়ে। মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘আমাকে জমিদার বাড়ি থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল বৈঁচি। তারা ধর্মগোলা স্থাপনকে ভালো চোখে দেখেন নি’।
    বৈঁচি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কি বলবে সে, মানুষটাকে তো ঝড়ে ভাঙা পাখির মতো অসহায় লাগে। মানুষটাকে কেমন অচেনা লাগে। এখন কিভাবে বলবে সে তার অসহায়ত্বের কথা, আন্না, আন্নার অনাগত সন্তান, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা।
    বিজয় হঠাৎ বৈঁচির দু’হাত চেপে ধরে বলে, ‘কি হয়েছে বৈঁচি? আন্না কোথায়?’
    বৈঁচি নরম গলায় বলে, ‘আন্না ঘুমোচ্ছে’।
    ‘এমন অসময়ে!’
    আন্নার ঘরের দরজার দিকে তাকায় বিজয়। স্নেহের পুত্তলির জন্য তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা জেগে ওঠে।
    বৈঁচি গলায় প্রশ্রয়ের সুর এনে বলে, ‘পা ভারী হলে প্রত্থম প্রত্থম এমনটা শরীর খারাপ হয়’।
    বিজয় উঠে দাঁড়ায়, ‘তালে কবিরাজকে ডেকে আনি’।
    বৈঁচির গলা বুজে আসে। ডুকরে আসা কান্নাটাকে সামলে নিয়ে কোনরকমে বলে, ‘হ্যাঁ গা তুমি কি সংসারের ভেতরকার জলে এট্টুসও গা ভেজাবে না! বলি, আন্না মা হতে চলেছে। আমি দাইকে ডেকে ছিলাম’।
    বিজয় মুহূর্তকাল থমকে উল্লাসে ফেটে পড়ে, ‘বল কি গো আন্নার মা, আমি দাদু হতে চলেছি!’
    বৈঁচি শত চেষ্টা করেও উষ্মা গোপন রাখতে পারে না, ‘বলি এত যে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাচ্ছো, আন্না আর তার ভবিষ্যতের কথা একবারও ভেবেছো? কি হবে তাদের? শেখর কোথায়? (ক্রমশ)

    ২৭

    কাঁচপোকা গ্রামের পশ্চিম আকাশের রূপসী চাঁদ কমলার মাটির ঘরের সেগুন কাঠের গরাদ দেওয়া চৌখুপী ধরনের জানলা দিয়ে জ্যোৎস্নার ওড়না হয়ে লুটিয়ে পড়েছে কমলার শরীরের উপর। বর্ষা পার হয়ে গেলেও আকাশে ভেজা ভাব এখনও আছে। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা দিয়ে যায় কমলার চোখে মুখে। শরীর জুড়ে চেনা শিহরণ জাগে কমলার। দেবী কমলা থেকে মানবী কমলার খোলসে কমলা ক্রমশ ঢুকে পড়তে থাকে। মহিমের প্রতি রাগ, দুঃখ, ঘেন্না, অভিমানে ভেতরটা টাটায়। একবারও মানুষটা কমলার কথা ভাবল না। এমন কি যে শিশুপুত্র দুটি আছে তারা তো মহিমেরই সন্তান। তাদের কথাও মহিম একটিবার ভাবল না। কমলার দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে কান্না নেমে আসে। মনে মনে কমলা একটা সিদ্ধান্তে থিতু হয়। যে শঙ্করী সাক্ষাৎ জননী হয়ে কমলার লব-কুশকে বুক দিয়ে মানুষ করছে সেই শঙ্করীকে কমলা কোনও মুহূর্তেই আর ঠকাবে না।
    ঠিক এমন সময় জানলার কাছে কে যেন লাফ দিয়ে পড়লো। ঝুপ করে আওয়াজে বিছানায় উঠে বসে কমলা। জানলার গরাদ বলতে তিনটে কাঁঠাল গাছের ডাল। যে কোনও সময় উপড়ে ফেলে দেওয়া যায়। মনে মনে রাধামাধবের স্মরণ নেয় কমলা। ঠিক সে সময় স্পষ্ট জানলার পাশ দিয়ে একটা ছায়ামূর্তিকে সরে যেতে দেখে কমলা। বালিশের পাশে রাখা কাটারিটা শক্ত করে ধরে। জোরে বলতে গিয়েও গলা দিয়ে আস্তে করে বের হয় – কে? কে ওখানে?
    ছায়ামূর্তি স্থির হয়ে দাঁড়ায় জানলার অদূরে।
    কমলা এবার প্রাণপণ রাধামাধবের নাম নিয়ে বলে ওঠে – আমি কিন্তু চেঁচাবো।
    ছায়ামূর্তি ফিসফিস করে ওঠে – বৌঠান, আমি।
    কমলার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে। যে বাক্য একসময় ছিল বরাভয় আজ তা ভয়ের পাহাড় হয়ে নেমে আসে কমলার মাথায়। যোগেন ঠাকুরপো! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না কমলার। সে ঠিক শুনছে তো! না ঐ তো ছায়ামূর্তি জানলার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে। যোগেনই। কমলা ভয় পায়। এই প্রথম সে ভয় পায়, তাও আবার যোগেনকে। বিছানায় বসেই সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে – এত রাতে ঠাকুরপো আপনি? কি চাই?
    যোগেন একদম জানলার কাছে – দরজাটা খোলো বৌঠান।
    কমলা কোনরকমে বলে – এত রাতে কি দরকার আমার কাছে?
    যোগেনকে যেন আজ কোনও প্রেতাত্মা ভর করেছে – লক্ষ্মী কমলা দরজাটা একবার খোলো।
    হা রাধামাধব, এ কি শুনছে। নিজের কানকে যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না। বড়ো কুৎসিত, ক্লেদময় লাগে কথাগুলো শুনতে। একসময় যে কমলা ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ছলাকলার আশ্রয় নিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতো না তার কাছে এই আন্তরিক বাক্য কদর্য ঠেকে, কান্না পেয়ে যায় কমলার। হে রাধামাধব, তুমিই বাঁচাও আমাকে।
    যোগেন অনুনয় বিনয় ছেড়ে উষ্মা প্রকাশ করতে থাকে – ও বুঝেছি আজ তো তোমার মান, যশ, টাকা সব গড়াগড়ি খাচ্ছে। আজ আর এই যোগেন ঠাকুরপোকে দরকার থাকবে কেন? স্বার্থ তো ফুরিয়েছে। তুমি তো বরাবর স্বার্থপর, আমারই ভুল। মহিমকে মরতে বাধ্য করেছো তুমি, তুমি হলে বিষকন্যা। তোমার দৃষ্টিতে বিষ, সর্বাঙ্গে বিষ।
    কমলা হাপুস কান্না কোনরকমে সামলে বলে – এসব কি বলছেন কায়েত ঠাকুরপো?
    যোগেন জানলার কাঠের গরাদ সজোরে চেপে ধরে। বড়ো বিষণ্ণ দেখায় তার মুখখানি। সে গলিত লাভার মতো উগরে দেয় – আমাকে এখন তোমার ভালো না লাগাটাই তো স্বাভাবিক। ঐ চাঁড়াল ডোমটাতে তো তোমার এখন মন মজেছে। তাই তো মহিমের ধুতি, পিরান পরিয়ে তাকে ভদ্দরলোক বানাতে চাও। নষ্ট মেয়েছেলে ......।
    কমলা আর সহ্য করতে পারে না। স্থান, কাল সবকিছু ভুলে চীৎকার করে ওঠে – ঠাকুরপো!
    রামদাটা হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। এলো চুল, আলুথালু সাদা থানে তাকে ভয়ঙ্কর লাগে। জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। আলো অন্ধকারের সান্ধ্য ভাষার মতো রহস্যময়তায় যোগেনের চোখে চোখ রাখে। সে চোখে আলেয়ার আলো যেন দপদপ করছে। মা দুর্গার দশ মহাবিদ্যার ছিন্নমস্তার মতো রূপ নিয়ে সে যেন যোগেনের রক্ত পান করতে উদ্যত। হিসহিস করে বলে – আপনি আর এক মুহূর্ত এখানে থেকেছেন বা কোনও কথা বলেছেন তো মহা অনর্থ হবে, আমি দরজা খুলে বাইরে গেলে কিন্তু .........।
    কথা শেষ করতে পারে না কমলা। কমলার এ হেন রূপ, আচরণে ভয় পেয়ে যায় যোগেন। জানলার কাছ থেকে সে সরে দাঁড়ায়। ভয় পেয়ে যায়। তারপর নির্লজ্জ, অসভ্যের মতো রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খানখান করে চীৎকার করে বলতে থাকে – আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই কমলা। তোমাকে আমার চাইই চাই।
    রাত্রির নীরবতাকে সমর্থন করে বদুর শ্মশানে শিয়াল ডেকে ওঠে। শিয়ালের সাথে সাথে একপাল কুকুরও। মাটির মেঝেতেই বসে পড়ে কমলা। শরীর, মন মুচড়ে তার কান্না আসতে থাকে। দুই দুধের শিশুকে নিয়ে কমলাকে একলা করে দিয়ে মহিমের অকালমৃত্যু কমলাকে যত না অসহায় করে দিয়েছিল তার থেকে বেশি অসহায় করে দিল আজকের যোগেনের এই কুৎসিত আচরণ। কাঁদতে থাকে কমলা। কাঁদতেই থাকে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ঘুমিয়েও পড়ে।
    ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে। এক সাধু এসে বলছে - তোমাকে যে অনেক পথ যেতে হবে। অনেক কাজ করতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে? ওঠো। আমার সাথে সাথে এসো।
    কমলা একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছে। আর দূর থেকে কি যেন এক উল্লাস ভরা চীৎকার ভেসে আসছে। প্রথমটা ঠাওর হয় না কি বলছে লোকগুলো। তারপর শুনতে পায় - ভারত মাতা কি জয়, বন্দে মাতরম্‌।

    কাঁচপোকা গ্রামে হিঙ্গলগঞ্জ থেকে বেশ কয়েকটি পরিবার এসে বাস করতে শুরু করেছে। সেখানে নাকি বিপদ আপদের শেষ নেই। নদীনালা গাছপালায় ভরা ব্লকটিতে প্রথম আবাদ শুরু করেছিল যশোরের জেলাশাসক টিলম্যান হেঙ্কেল সাহেব। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে বৃক্ষ নিধন যজ্ঞ দিয়ে শুরু হয় তার কর্মকান্ড। প্রথম পর্যায়ে সাত হাজার একর জায়গা আবাদ করেন। তার নাম অনুসারে ঐ বিস্তীর্ণ আবাদি জায়গার নাম হয় হেঙ্কেলগঞ্জ। বর্তমানে এই অঞ্চলের নাম হিঙ্গলগঞ্জ। বর্তমান সীমানা হল উত্তরে হাসনাবাদ, ইছামতী নদী এবং বাংলাদেশ সীমানা। দক্ষিণে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্ট এবং রায়মঙ্গল নদী। পূর্বে কালিন্দী নদী এবং বাংলাদেশ সীমানা, পশ্চিমে সন্দেশখালি ব্লক। এখানে সামসের নগরে মাত্র ৪০ ফুট দূরত্ব থেকে সাদা বক, লাল বক, কুঁচ বক, গোবক, পাতিকাক, দাঁড়কাক, চড়ুই, পানকৌড়ি, বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, শালিক, গাঙ শালিক, ঘুঘু, চিল, শকুন, মদনটাক, কাক, টিয়া, তাল বড়া, বালি হাঁস ইত্যাদি পাখি দেখা যায়।
    ১৮১৬ সালে ২৪ পরগণা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মিঃ সুজল্যান্ড। তাঁর সময়ে কলকাতার জলপথে দ্রুত যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য ১৮১৭ সালে উইলিয়াম মরিশনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ডামরালি গ্রাম থেকে প্রতাপাদিত্য নগর বা বাদরখাল, অধুনা ভাণ্ডারখালি পর্যন্ত অর্থাৎ কালিন্দী নদী থেকে রায়মঙ্গল ও গৌড়েশ্বর নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত খাল কাটা হয়েছিল যা সাহেবখালী নদী নামে পরিচিত হয়।
    হিঙ্গলগঞ্জে আবাদের কাজে বিভিন্ন লাটদারদের আগমন ঘটে। ১৮৮৮ খ্রী কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় লাটদারী বন্দোবস্তে যে জায়গায় আবাদ করেছিলেন তাঁর নামানুসারে আবাদি জায়গার নাম হয় কালীতলা। বাংলার প্রায় ৪০ শতাংশ লবণ রায়মঙ্গল নদী থেকেই তৈরি হতো। তাই এই লবণের নাম হয়ে যায় রায়মঙ্গল সল্ট। প্রতি ১০০ মণ লবণের জন্য ১০ টাকা হিসাবে দেওয়া হত। যারা লবণ তৈরি করতো তাদের সল্ট মাহিন্দার বলা হত। হেঙ্কেল সাহেব রায়মঙ্গল সল্ট এজেন্সির লবণ উৎপাদকদের কম টাকায় সারাজীবন লবণ তৈরির কাজে নিযুক্ত থাকা বন্ধ করিয়েছিলেন। ১৮১৩ সালে রায়মঙ্গলের চর বন্দোবস্ত হয়। বসবাসের প্রথম দিকে সেখান থেকে ব্যাপকভাবে নোনা মাটি সংগ্রহ করে লবণ সংগ্রহ করা হত। ৮০ শতাংশ পরিবার প্রায় নিজেদের ব্যবহারের লবণ নিজেরাই তৈরি করে নিত।

    কমলার জীবনে এমন একটা দিন আসতে পারে তা কমলা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। রক্ষকই যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে তখন তার থেকে ভয়ঙ্কর আর কিছু হয় না। কেঁদে কেঁদে কমলার চোখ মুখের লক্ষীশ্রী বলতে আর কিছু নেই। ভীষণ দুর্বল আর অসহায় লাগছে নিজেকে। নিজের মনে কেবলই বলে চলেছে, ‘হে রাধামাধব, পথ দেখাও। পথ দেখাও’। অন্যদিন এ সময়ের মধ্যে বদুটাও এসে পড়ে। আজ তারও টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে কমলা। ঘর বার করতে করতে দেহ মন এলিয়ে পড়েছে। খিদে তৃষ্ণার কথাও ভুলেছে। কাঁঠালগাছটার জায়গাটা বড়ো শূন্য, নেড়া নেড়া দেখাচ্ছে। খা খা দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে কমলা। মহিমের জন্য হু হু করে ওঠে মনটা। তারপর নিজেকেই নিজে বোঝায়, ‘কেন এত কষ্ট পাচ্ছো কমলা? মহিমের তুমি ঐ দুটি সন্তানের মা ভিন্ন কোনোদিন কি কিছু ছিলে! মহিমের মন জুড়ে ছিল তার প্রথমা স্ত্রী তরুলতা আর তার মেয়ে হাবি। তুমি তো তুমি তোমার ঐ দুধের শিশুদুটোর কথাও যদি মহিম একবার ভাবতো তাহলে এমন সব্বনেশে কাজ সে কখনই ঘটাতে পারতো না’।
    ঘোশালমশাই কোত্থেকে এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে আসে যে তার ধুতির কোঁচা মাটিতে লুটোপুটি খেতে থাকে। কমলার দাওয়ায় এসে কোনোরকমে দম ফেলে বৃদ্ধ মানুষটি। অন্যদিন হলে কমলার চোখ মুখের চেহারা দেখেই জিজ্ঞাসা করতো, ‘আমার মায়ের চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন! কি হয়েছে তার?’ কিন্তু আজ উল্টে কমলাকেই শুধোতে হয়, ‘কি হয়েছে ঘোষালমশাই? এমন করে ছুটতে ছুটতে এলেন যে বড়ো? কারও কোনো বিপদ, আপদ হয়নি তো?’
    ঘর থেকে একটা বাটিতে চারটে গুড়ের বাতাসা নিয়ে এসে দেয়। কালো কুঁজো থেকে বড়ো কাঁসার গ্লাসে করে জল। বলে, ‘নিন দেকি এটুক মুখে দিয়ে কথা কন। ইস ঘেমে একেবারে নেয়ে গেছেন। এভাবে হুড়মুড়িয়ে কেউ আসে। পড়ে গেলে কি হতো!’
    কমলা লাল পাড় ঝালর দেওয়া তালপাখার পাখাটা নিয়ে এসে হাওয়া দিতে থাকে ঘোষালমশাইকে। অন্যদিন হলে হয়তো মানুষটা হাই হাই করে উঠতো, ‘করো কি, করো কি মা’ বলে। আজ যেন সত্যিই মানুষটার কোনোদিকেই খেয়াল নেই।
    কমলা আস্তে আস্তে বলে, ‘এবার বলেন দেখি কি হয়েছে? আর বদুটাও এতবেলা হল একটিবার দেখা দিয়ে গেল না তো!’
    ঘোষালমশাই এতক্ষণে বলবার মতো কিছু পান। বলেন, ‘সে আসবে কি করে গো মা। গ্রামে ঐ যে হিঙ্গলগঞ্জের দিক থেকে যে কালো কালো ইয়া ইয়া দানবের মতো মানুষগুলো এয়েচে। যারা যা পায় তাই খায়, তাদের নাকি ঘরে মৃত্যুর মিছিল লেগেছে। দেখোগে যাও শ্মশানে শবের লাইন পড়ে গেছে। কিন্তু গাঁয়ের শ্মশানে তাদের নাকি দাহ করা যাবে না। কি কান্নাটাই না কাঁদছে তাদের পরিবারের মানুষগুলো’।
    ছিটকে ওঠে কমলা, ‘কী? দাহ করতে দেবে না! কে দেছে এমন বিধান। মরার আবার জাত!’
    মুখ নীচু করে ঘোষালমশাই। চুপ করে থাকে।
    একে তো কাল রাত থেকে ঐ জঘন্য ঘটনার অভিজ্ঞতা তারপর এখনও পর্যন্ত দাঁতে কুটোটি কাটে নি। বিরক্ত হয়ে ওঠে কমলা, ‘কে বলবেন তো?’
    একপ্রকার কমলার কাছে ধমক খেয়ে ঘোষাল মশাইয়ের মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে আসে, ‘যোগেন বাবাজী’।
    কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধ।
    ‘বাসি মড়া। কত যে দোষ পাচ্ছে তা রাধামাধবই জানে। বোধ করি কোনোটা কোনোটা পচতে শুরু করেছে’।
    সটান উঠে দাঁড়ায় কমলা। মনে মনে ভাবে, ‘এতদূর! ন্না। এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে’। মুখে বলে, ‘আমি একটিবার শ্মশানে যাবো’।
    ঘোষালমশাইয়ের আর কথা ফোটে না মুখে। দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছা করে। কি মরতে সে এখানে ছুটে এসেছিল।
    কমলা উঠে দাঁড়ালে বাধ্য হয়ে ঘোষাল মশাইকেও উঠে দাঁড়াতে হয়। খুব অসহায় লাগে নিজেকে। ধুতির কোচা ঠিক করে বলে, ‘চলো। তোমাকে তো সেখানে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমিও যাব’।
    কমলা নিরুত্তর থাকে।
    দরজার আগলটা টেনে দিয়ে উঠোনে নামে কমলা। রাধামাধবের মন্দিরে একটিবার যায়। প্রণাম করে মনে মনে বলে, ‘আমাকে শক্তি যোগাও প্রভু। শক্তি দাও। আমি যেন আজ তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি’।

    শ্মশানের কাছাকাছি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই খবর হয়ে যায় কমলার আগমনের কথা। ঐ আদিবাসী মানুষগুলোর আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা ছুটে এসে কমলার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে। অসহায় মানুষগুলোর আকুল রোদনে আকাশ বাতাস ধ্বনিত হতে থাকে।
    ‘মাগো আমাদের বাঁচাও। মাগো তুমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই রক্ষে করবার। ওমা এ তো তুমার দেশ। মরা মানুষগুলোরে ইবার চিল শকুনে খুবলে খাবে গো মা’।
    কমলা হতভম্ব হয়ে যায়।
    ‘ছি ছি কায়েত ঠাকুরপো কি মানুষ! মানুষের শরীর থেকে আত্মা বেরিয়ে গেলে তারে নিয়ে কি কোনোরকম অনাসৃষ্টি করা যায়। কমলার উপর রাগ, বদুকে শত্রু ঠাউরে এ কোথায় নিজেকে নামালেন আপনি কায়েত ঠাকুর পো!’
    ঘোষাল মশাই লোকগুলোকে একটু মৃদু ধমক দিয়ে বলে, ‘এই তোরা সরে যা। মাকে ভুলেও ছুঁয়ে দিস নে যেন। হাত পুড়ে যাবে কিন্তু!’
    লোকগুলো ভয়ে তফাৎ হয়ে গিয়ে এক জায়গায় জড়সড় হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে যায়। দেখে মনে হয় যেন কয়লার স্তুপ। কিন্তু কয়লার খনিতেই তো সোনা মেলে। কমলা সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে সাবধানী। অধিকারবোধ বড়ো সাংঘাতিক। সেটি আর কাউকে দেওয়া যাবে না। পথ চলতে গেলে ওজন কমিয়েই চলতে হয়। নতুবা গন্তব্যে পৌঁছানো সমস্যা হয়ে যায়। ঘোষাল মশাইকে একপ্রকার ধমক দিয়ে ওঠে, ‘আঃ আপনি চুপ করুন। ওদের কেন ঠাটছেন? দেখছেন তো মানুষগুলো তো মরেই আছে। আর আমাকে ছুঁলে পড়ে কে বলেছে হাত পুড়ে যাবে! আমি একজন মেয়েমানুষ। মন্দিরের রাধামাধব তো নই। আর তাছাড়া রাধামাধব তো সকলেরই’।
    মানুষগুলোকে অভয় দেয় কমলা।
    ‘না, তোমাদের কোনো ভয় নেই। আমি এয়ে পড়েছি যখন’।
    একজন বৃদ্ধমানুষকে ডেকে বলে, ‘বাবা তুমি এসে বলো তো ঠিক কি কি হয়েছে?’
    কমলার মুখে বাবা ডাক শুনে আপ্লুত হয়ে ওঠে মানুষটা। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে একটু সামনে এসে উবু হয়ে বসে। তার কান্নায় হেচকি উঠে আসছে। নাক থেকে শিকনি গড়িয়ে আসে।
    কমলার গলার স্বরও বাষ্পারুদ্ধ হয়ে আসে। আবেগে কাছে যেতে গিয়েও কি ভেবে দু’পা এগিয়ে থেমে যায়। কোনোরকমে বলে, ‘বলো বাবা’।
    বৃদ্ধ ভয়ে ভয়ে একবার ঘোষাল মশাইয়ের দিকে তাকায়।
    বুঝতে পেরে কমলা আবার অভয় দেয়, ‘বলো বাবা, বলছি তো কোনো ভয় নেই। আমি আছি’।
    বৃদ্ধ ডুকরে উঠে চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে যা বলে তা পুরোটা বোঝা না গেলেও যেটুকু বোঝা যায় তা হল, গ্রামের শেষের দিকে খাল বরাবর যে পতিত জমি আছে, সেখানে তারা এসে বসত শুরু করেছিল। হিঙ্গলগঞ্জের জঙ্গল কাটাইয়ের কাজে নিয়ে গিয়ে মানুষগুলোকে অমানবিক শোষণ করছে। সামান্যতম প্রতিবাদ যারা জানায় তাদের কপালে নেমে আসে অপরিসীম দুর্ভোগ। দৈহিক নির্যাতন হয় পুরুষদের উপর আর মেয়েদের উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। এদের ঘরের মেয়েগুলোকে তারা যেন সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়াদের মতোই সহজলভ্য বলে মনে করে। এই মানুষগুলো সেই অত্যাচারেরই স্বীকার। তাই তারা প্রাণের দায়ে এখানে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখানে এসেও তাদের মরণ, সর্বনাশ কেউ রুখতে পারলো না।
    কমলা খুব নরম করে বলে, ‘তোমার নাম কি বাবা?’
    বৃদ্ধ বলে, ‘চুড্ডি সোরেণ মাই’।
    কমলা আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমাদের গাঁ ঘর ছাড়লে কেন বাপ? কথায় বলে জানো তো পর ভাতি হয়ো, পর ঘরি হয়ো নে’।
    বৃদ্ধ পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাতে থাকে, ‘হ হ হ মাঈ তুই ঠিকই বুলেছিস বটে। বোঙ্গাবুরু, কেরামাঈয়ের রোষ লাগিছে মুদের’।
    এই বোঙ্গাবুরু, কেরামাঈ শব্দগুলো কমলার কানে নতুন ঠেকে। সে একবার চুড্ডির দিকে আর একবার ঘোষাল মশাইয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
    ঘোষাল মশাই তখন মুখ বিকৃত করে বলে, ‘ওগুলো ঐ ছোটোলোকগুলোর ঠাউর-দেবতার নাম গো মা জননী’।
    চুড্ডি সোরেণের মুখের বলি রেখার ভাঁজে ভাঁজে শতাব্দী লালিত যাবতীয় বঞ্চনার স্বরলিপি ফুটে ওঠে। শুধু ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে। তাতে শোনা যায়, ‘বোঙাবুরু, কেরামাঈ খুব জাগরত দেবতা বটে’।
    কমলা রুদ্র মূর্তিতে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ঘোষাল মশাই, সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ হয়ে এসব কি বলছেন আপনি! ছোটোলোকদের দেবতাদের নাম মানে? জেত কি মানুষের গায়ে লেখা থাকে নাকি। জেত তো মানুষের সৃষ্টি’।
    ঘোষাল মশাই হা করে তাকিয়ে থাকেন কমলার দিকে। বিস্ময়ে তার ঘাম ছুটে যায়। এ কাকে দেখছেন তিনি! গাঁয়ের সেই মুখফোঁড়, কুচুটে মেয়েটা কবে হল এমনতর সাধ্বী! কেমন যেন ভয় ভয় করে ঘোষাল মশাইয়ের। গাঁয়ের পুরুষ মাতব্বরেরা মানবে তো কমলার মানে মেয়েলোকের আধিপত্য।
    চুড্ডি সোরেণ উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে অলীক কোন শক্তিতে ভর করে ধ্বনি দিয়ে ওঠে, ‘জয় কমলা মাঈয়ের জয়। জয় বোঙ্গাবুরুর জয়। জয় কেরামাঈয়ের জয়’।
    অদ্ভুত আরামে কমলার চোখ বুজে আসে। আহা এ কি শুনছে সে! মানুষ তার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। ঐ তো দলে দলে না না কাতারে কাতারে লোক আসছে কমলার রাধামাধবের মন্দিরে। কমলা স্মিত মুখে আস্তে করে বলে, ‘জয় রাধামাধবের জয়’।
    সাগর লহরীর মতো সঙ্গে সঙ্গে রব ওঠে, ‘জয় রাধামাধবের জয়’।
    ঘোষাল মশাইও এবার দোহারকি দেয়, ‘জয় রাধামাধবের জয়। জয় কমলা মায়ের জয়’।
    সুচারু ভাবে বোঙ্গাবুরু, কেরামাঈ নামল অর্বাচীন দেবতারা ক্রমশঃ পিছু হটতে থাকে। প্রতিষ্ঠা পায় কুলীন দেবতা রাধামাধব।

    শ্মশানে খবরটা যেতেই বদু পরিত্রাহে ছুটে আসে। তার হাতে তখন মড়ার মাথার খুলি ফাটানো তেলালো গরান কাঠের তেলালো লাঠিটা। কমলাকে দূর থেকে দেখেই সাষ্টাঙ্গে আছাড় খেয়ে উপুর হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বজ্রপাতের মতো হুঙ্কারে বলে, ‘আদেশ দেও মা’।
    কমলাও ভয় পেয়ে আঁতকে ওঠে, এ কোন বদুকে দেখছে সে! এ তো ভূতনাথের রুদ্ররূপ। ভয়াল। ভয়ঙ্কর।
    যোগেনও ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয়। কমলাকে দেখে কদর্য ভঙ্গীতে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘কমলা!’
    শিউড়ে ওঠে বৃদ্ধ ঘোষাল মশাই। ছি ছি ছি যোগেনের কি পরকালের ভয় নেই! মা জননীকে নাম ধরে বলছে।
    কমলাও চণ্ডীরূপ ধারণ করে। কিন্তু দু’চোখে আগুনের ফুলকি হেনে বলে, ‘বাপ চুড্ডি’।
    চুড্ডি বলে, ‘হ মা’।
    কমলার দু’চোখ তখন যোগেনের দু’চোখে। কিন্তু মুখে বলে, ‘কায়েৎ ঠাকুরপোকে প্রেতাত্মারা ভর করেছে। এত্তগুলো মরা মানুষের আত্মা। তাই ওনার মাথার ঠিক নেই। বাপ, তোমার ঘরের ছেলেদের বলো ঐ জারুল গাছটার গায়ে ওনাকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখতে যতক্ষণ না দাহ কাজ শেষ হয়। আর বদু, তুমি যাও বাপ তোমার কাজ করো’।
    যোগেনের মুখে চোখে রাগ, কামনার কুৎসিত তেলালো ছবি ফুটে ওঠে। সে চীৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই চুড্ডির নির্দেশে নিমেষে কালো কুঁদো কিছু পুরুষ নিজেদের মাথায় বাঁধা গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে যোগেনেকে। অসম্ভব এক ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজটা হয়ে যায়। আবার একবার, দুবার, বারবার কমলার নামে জয়োধ্বনি ওঠে।
    যোগেন মারণ হুঙ্কার দেয়, ‘কমলা!’
    কমলা এবার বলে, ‘বাছা কেউ একজন ওঁর মুখটা বেঁধে দাও তো’।
    একটা কমবয়েসী ছেলে খুব আনন্দের সঙ্গে কাজটা করে।
    কমলা বদুকে বলে, ‘তুমি যাও বদু। আজকের পর থেকে দাহ কাজ তুমি আর করবে না। আমার ভুঁইতে তোমার ঠাই হবে’।
    বদু ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘মা গো’।
    কমলা অর্থপূর্ণ চোখে তাকায় বদুর দিকে।
    বদু বলে, ‘বলো মা’।
    কমলা বলে, ‘আজকেই সব হিসেবের নিকেশ করে দিও বাছা’।
    কথা শেষ করে যোগেনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। বলে, ‘তালে আসি কেমন কায়েত ঠাকুর পো’।
    ঘোষালমশাই সব দেখে, সব শুনেও বিশ্বাস করতে পারে না। এও কি সম্ভব! যোগেনের জন্য প্রাণটা টাটায়। কিন্তু তিনি যেন মূক হয়ে গেছেন।
    কমলা বলে, ‘আমি এবার ফিরবো কাকাবাবু’।
    কাকাবাবু! এ কি শুনছে ঘোষাল মশাই। স্বয়ং কমলা তাকে পিতৃব্যের সম্মান দিয়েছে। ঘোষালমশাইয়ের আর পিছু ফিরতে ইচ্ছা করে না। কমলার পেছন পেছন চলতে থাকে। যোগেনের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় একটা শব্দ, ‘বৌঠান’। কিন্তু মুখ বাঁধা থাকায় শুধু গোঁ গোঁ শব্দ কান্নার সুর হয়ে বেরিয়ে আসে। (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০২ মার্চ ২০২০ | ৫০০৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Tanwi,. Halder | ০৯ এপ্রিল ২০২০ ১২:৪৮92115
  • ২২

    নিজেদের ঘরে ঢুকে বিমান শেখরকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে, “শেখর এই প্রবন্ধখানা লিখেছি, শোনো। তোমার মতামতের আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে ...... মুঘল তথা দেশীয় শক্তিসমূহের অবক্ষয়ের সহিত ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বে সমগ্র পৃথিবীতেই ভারতীয় নীলের বাজার বিস্তৃত হয়। ফরাসী বণিক লুই বোর্ণড ছিলেন হুগলী অঞ্চলের প্রথম নীলকর। ১৭৮০ অব্দের মধ্যভাগে কোম্পানির উদ্যোগে প্রায় একডজন ইউরোপীয় নীলকর বাংলায় নীল উৎপাদনের কাজে যুক্ত হইয়াছিলেন। ১৭৯০-এ গভর্ণর ইন কাউন্সিলকে লেখা চিঠিতে একজন নীল কুঠিয়াল ক্যারল ব্লুম সরকারের নিকট হইতে নীল চাষ সম্পর্কে সকল প্রকার সহযোগিতা প্রার্থনা করেন ও তা মঞ্জুর হয়। সে সময়কার নবজাগরণের অন্যতম মুখ রাজা রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর চাহিয়াছিলেন নীল চাষের মাধ্যমে জনগণের উন্নতি হউক।
    প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিত প্লীনি প্রভৃতি মনীষীরা ইন্ডিকাম বলিয়া নীলের বর্ণনা করিয়াছিলেন। নীল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Indigofera tinctoria। Indigo নামের সহিত হিন্দুস্থান নামের একটি সম্পর্ক আছে। ইংরেজ আমলে প্রথম ভাগে আমেরিকা হইতে নীল উৎপাদনের নূতন প্রণালী এদেশে আসে এবং উহার প্রবর্তক ফরাসী বণিক লুই বোর্ণড। তিনি ১৭৩৭ অব্দে ফ্রান্সের অন্তর্গত মাসেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে গিয়া দৈবক্রমে নীলের ব্যবসা শিক্ষা করেন। তিনিই ১৭৭৭ অব্দে বঙ্গদেশে আসিয়া চন্দননগরের নিকটবর্তী তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় দুইটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। ক’বছর পর মালদহে একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। সেখানে চুনের অভাব দেখিয়া একটি মুসলমান কবরখানা হইতে মনুষ্যাস্থি উঠাইয়া পুড়াইয়া চুন প্রস্তুত করেন।
    এমন কি ১৮১৫-১৬ অব্দে বঙ্গদেশ হইতে সমস্ত পৃথিবীতে নীল সরবরাহ হইত, বিশেষত নদীয়া, যশোহর জেলার নীল ছিল সে সময় জগতের ভেতর বিখ্যাত। প্রথম দিকে জমিদারদের অধীনে অল্প জমিতে নীলকর সাহেবেরা রায়তের সাহায্যে নীলের চাষ করিত। ১৮১৯ অব্দের অষ্টম আইনে জমিদারদিগের পত্তনী তালুক বন্দোবস্ত করিবার অধিকার দেওয়ায় এক এক পরগণার ভেতর অসংখ্য তালুকের সৃষ্টি হয়। দেশের ধনী ব্যক্তিরাও নিজের অথবা পরের জমিদারির মধ্যে পৃথকভাবে পত্তনী লইয়া নীলের ব্যবসায় যোগ দিতেন। নড়াইয়েলের জমিদার ‘সাহেব’ ম্যানেজার পর্যন্ত রাখিয়াছিল”।
    শেখর বড়ো উশখুশ করছিল কিছু বলবার জন্য। তা লক্ষ্য করে বিমান বলে, ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও শেখর?’
    শেখর এতটা পথ পরিশ্রমে সত্যি ক্লান্ত ছিল। এছাড়া সে বিমানের মতো সত্যি বাইরের জগতের খবর খুব কিছু রাখে নি কোনদিন। তবু বিমানের সঙ্গে তার অদ্ভুত বন্ধুত্ব ছিল। বিমানের প্রতি মুগ্ধতাও আছে শেখরের। বিমানের মধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু বিমানের চৌখস জ্ঞান, বাস্তব বুদ্ধি, অপরিমেয় পৌরুষের দৃঢ়তা সবসময় আকৃষ্ট করে শেখরকে। অর্থ, বিত্তে প্রাচুর্যের মোড়কে ঢাকা থেকেও বিমানের পাশে শেখর যেন এলেবেলে দুধভাত। তবে বিমান শেখরকে পছন্দ করে তার সহজ সরল মনোবৃত্তির জন্য। অত প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও বড়ো সাধারণ, নিরহংকার। মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে, ভালোবাসে।
    শেখর বলে, ‘না বিমান আমি তেমন কিছু বলতে চাইছি না। শুধু বলতে চাইছি নীল চাষ তো আইন করে বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে তুমি এই প্রবন্ধ লিখছ কেন? এখন কি দরকার এসব দিয়ে?’
    বিমান নিজের বিছানার ওপর আধশোওয়া হয়ে বলে, ‘ভায়া নিজের ব্যক্তিজীবনের বাইরে তো কোনও কিছুর খোঁজ রাখলে না, এখনও নদীয়া, যশোহরে কত চোরাগোপ্তা নীল চাষ হচ্ছে জানো? নীলকুঠিগুলো দেখলে আমার বুকের ভেতর আগুন জলে শেখর। তবে সব থেকে যন্ত্রণার কথা কি জানো, বাংলার রায়তরা যখন নীলকরদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল তখনও কিন্তু দেশীয় জমিদাররা কৃষকের লড়াইয়ে তার পাশে দাঁড়ায় নি। নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হ্যাসেল নীল কমিশনে সাক্ষ্যে এইসব জমিদারদের নোংরা ভূমিকাকে লক্ষ্য করে বলেন - তারা ইচ্ছা করলে কৃষকদের সাহায্য করতে পারতো কিন্তু তা না করে নীলকরদেরই সাহায্য করে। ভাবতে পারো নদীয়ার কুখ্যাত নীলকর লারমুরকে বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করে জমিদার শ্যামচন্দ্র পাল ও হাবির উল হোসেন’।
    এ আলোচনা হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলতো, বাধ সাধল বলরামের এক হাতে খোপ খোপ পাত্রে ঝোলানো চায়ের গ্লাস আর অন্য হাতে বেগুনি মুড়ির সুগন্ধ। বিমান, শেখর দুজনেই উসখুস করে ওঠে। বিদ্রোহ ভুলে দুজনেই বলরামের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে। বলরাম অভিভাবকের সুরে বলে, ‘অনেক দিন বাদে দুই বন্ধু একে অপরকে পেয়ে গল্প আর শেষ হচ্ছে না তাই তো? তা বেশ। কিন্তু একজন সেই কত পথ এয়েছে পথে কি পেটে পড়েছে জগন্নাথই জানে। আর একজন তো কলেজের পড়া কি করে জানি না তবে দেশ উদ্ধার করে বেড়ায় মুখ্যু সুখ্যু হলেও বেশ বুঝি। পেটে কিল মেরে ঘোরা তো তার অভ্যাস। নাও এখন এগুলোর সদগতি করে আমাকে উদ্ধার করো দিকি। মেলা কাজ আমার। ওদিকে তারিণীবাবু ফিরেছে। তিনি তো আমাকে চোখে হারান’।
    বলরামের বলার ধরনে শেখর, বিমান দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। বিমান বলে, ‘না বলরামদা, এত বছর কলকাতায় থেকে থেকে তুমি বাংলা ভাষাটা এত ভাল শিখে গেছো যে যেকোনও বাঙালীর কান কেটে নেবে’।
    বলরাম ‘না বাপু আমার ধাই কিরিকিরি আছু’ বলে একপ্রকার ছুট লাগায়। বিমান শেখর দুজনেই আর এক প্রস্থ হেসে ওঠে। চায়ে চুমুক দিয়ে বিমান বলে, ‘তুমি চলে এসে খুব ভাল কাজ করেছো শেখর, এমনিতেই তুমি পরীক্ষার পড়ায় অনেক পিছিয়ে গেছ। তাছাড়া এমন তাড়াহুড়ো করে চলে গেলে যে দুচারটেও বই যে নিয়ে যাবে তাও করতে পারলে না। আমি মাঝে মাঝে তোমার বই খাতাগুলো মুছে রাখতাম। নচেৎ এমন ধুলোর আচ্ছাদন তৈরি হচ্ছিল যে তুমি আঙ্গুল দিয়ে তার উপরে আন্নাকালির নাম লিখতে পারতে’।
    বিমান কথাটা রসিকতা করে বললেও শেখর বিমানের দু’হাত চেপে ধরে, ‘সত্যি বিমান তোমার সাথে আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক, গত জন্মের কোনও পুণ্যফলে তোমায় বন্ধু হিসাবে পেয়েছি এ জন্মে। আমি তোমার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। তুমি যদি আমাকে চিঠি না লিখতে এখনও হয়তো ...............’। কথা শেষ করে না শেখর। বিমানের এমন লঘু পরিহাসে শেখরের আবেগ তাড়িত হয়ে পড়া দেখে বিমান ভারী অবাক হয়ে যায়। সে শেখরের হাতের পাতা দুটি চেপে ধরে বলে, ‘থামলে কেন? হয়তো কি শেখর। বল .........’।
    শেখরের গলা বুজে আসে, কোনরকমে বলে, ‘হয়তো আন্নাকালিতেই বুদ হয়ে থাকতাম ..................। আমাকে তোমার সাথে নাও বিমান। আমিও দেশের কাজ করতে চাই’।

    সমাজ পরিবর্তন, বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষজনেরও সাজ-পোশাক, চিন্তা-ভাবনা সব কিছুরই পরিবর্তন ঘটে চলেছে। কিন্তু শেখরের ভেতর এ পরিবর্তন যেন অচানক। যে শেখরকে বিমান চিনতো তা যেন বদলে গেছে। শেখরের দেশের জন্য কাজ করতে চাওয়ার এমন আকুল প্রার্থনায় বিমান খুশি হলেও ভেতরে একটা ধন্দ থেকে যায়। সত্যি কি দেশমাতার এই দুর্দিনে তার পাশে বিমান, শেখরদের মতো যুবকের থাকা প্রয়োজন বলেই এই মানসিক পরিবর্তন? নাকি দুই স্ত্রীকে নিয়ে হাঁসফাঁস করা জীবনে থিতু হতে না পেরে এই পলায়ন মনোবৃত্তি। যাই হোক বিমান খুশিই হয়।

    রাতে সেই বোয়াল মাছের ঝাল দিয়ে আহারের পর শেখর বলে, ‘বিমান তোমার প্রবন্ধের সবটুকুতো শোনা হল না’।
    বিমান খুব মন দিয়ে কি যেন একটা কাগজ দেখছিল। সে বলে, ‘আর একদিন শোনাবো’।
    শেখর আবার শুধোয়, ‘আচ্ছা বিমান এই যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় যে নীলচাষকে সমর্থন করলেন, কেন? তারা প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ মানুষ ছিলেন’।
    বিমান তার বন্ধুবরটির মুখের দিকে তাকায়। কি যেন পড়বার চেষ্টা করে। তারপর নিজের মনেই বলে, না শেখরের ভেতর সত্যি একটা পরিবর্তন ঘটেছে। নতুবা এতটা পথ এসে যার ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসার কথা তার কিনা মনে এখন এ সব প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। হাতের কাগজটা বিমান যত্ন করে দেরাজে তুলে রেখে উঠোনের দিকের জানলাটা খুলে দিয়ে দাঁড়ায়। জানলা দিয়ে এক ঝলক কাঁঠালিচাঁপার সুবাস ভেসে আসে। বিমান এসে নিজের বিছানায় পা মুড়ে বসে। তারপর বলতে শুরু করে, “দেখো শেখর, দিনেমারদের হাত থেকে সিংহল যখন ইংরেজদের হাতে গেল তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতেই সিংহলের শাসনভার ন্যস্ত হল। আর অমনি সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি এমন আইন করলো যাতে কোম্পানির সাহেব ব্যতীত সিংহলে আর কেউ ব্যবসা–বাণিজ্য ও বসবাস না করতে পারে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট সিংহলের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে নিজের হাতে নিল। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার জন্‌স্টনের দেওয়া রিপোর্টে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট জানতে পারে সিংহলের যদি ব্যবসা, বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতি সাধন করতে হয় তাহলে বিজ্ঞান, যান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালী ও ইউরোপীয় মূলধনের প্রয়োজন সিংহলে। তারজন্য সকল ইচ্ছুক ইউরোপীয়বাসীকে সিংহলে এসে বসবাস ও বাণিজ্যের অনুমতি দিতে হবে।
    ১৮১০ সালে সিংহলে অবাধ বাণিজ্যনীতি প্রবর্তনের আর একটি নাম ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’। ঠিক তেমনি বাংলাতেও অর্থনৈতিক জীবনের সম্প্রসারণের সব পথঘাট বন্ধ করে দিয়েছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮২৪ সাল পর্যন্ত এই বাঁধন একটুও আলগা হল না। নীলকর সাহেবদের জমির মালিকানা পাওয়ার জন্য বারবার আর্জি বিফল হল। শেষে তারা বাংলাদেশে কফির চাষ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু জমির মালিকানা না দিলে কিছুতেই তা হওয়া সম্ভব নয় বুঝতে পেরে কোম্পানি অনেক রকম শর্ত দিয়ে জমির মালিকানা দিতে রাজি হয়। শুরু হল কফি চাষ। আবার দেখো শেখর, ঠিক তার তিন বছর পরে ৭ই নভেম্বর কলকাতাবাসী ইউরোপীয়রা একটা সভা ডাকে টাউন হলে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, বাণিজ্যের উন্নতি ও কৃষির উন্নতি সাধন করতে ইংরেজ বণিকরা যে সাহায্য করছে তার উচ্ছ্বসিত বর্ণনা নিজেরাই করলো। কিন্তু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইশারাতেই তখনও গভর্ণমেন্ট ওঠে বসে। এই মিটিং-এর মাস তিনেক পরে ১৮২৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ‘একজন জমিদার’ এই স্বাক্ষরযুক্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ হয় ‘সংবাদ কৌমুদী’ পত্রিকায়। এই একজন জমিদারটি আর কেহ নন - স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লেখেন, ‘এদেশে যাঁর ভূসম্পত্তি আছে এবং যিনি নিজে তাঁর জমিদারী দেখাশোনা করেন তাঁরই কাছে একথা সুবিদিত যে নীলচাষের জন্য কি বিরাট পরিমাণ পতিত জমিতে আবাদ হয়েছে এবং নীলচাষের মালিকরা যে দেশ জুড়ে টাকা ছড়াচ্ছেন তাতে দেশের নিম্ন শ্রেণীরা কেমন স্বচ্ছন্দে দিনপাত করছে। আগেকার দিনে যেসব চাষি জমিদারের জবরদস্তিতে বিনামূল্যে বা অল্প পরিমাণ ধানের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হত তাঁরা এখন নীলকরদের আওতায় খানিকটা স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছে। তাঁরা প্রত্যেকেই নীলকরদের কাছ থেকে মাসিক চার টাকা বেতন পাচ্ছে এবং অনেক মধ্যবিত্তও যাঁরা নিজেকে ও পরিবারকে প্রতিপালন করতে পারতো না, তাঁরা নীলকরদের দ্বারা উঁচু বেতনে সরকার প্রভৃতি পদে নিযুক্ত হচ্ছে। এখন তাঁরা জমিদার বা বেনিয়ার খামখেয়ালী ও মর্জি দ্বারা নির্যাতিত হয় না। অবশ্য এই অবস্থা আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর জমিদারদের নিশ্চয়ই দুঃখের কারণ হবে কেন না তাঁরা নিজ নিজ গণ্ডিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নিপীড়িত করতেই ইচ্ছুক। সে সময়কার সরকারের কাছে বিচারকরা যে রিপোর্টগুলি দাখিল করেছেন তা দেখলেই রায়তদের প্রতি জমিদারদের নিষ্ঠুর আচরণের কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে। এছাড়া খুব কম জমিদার আছেন যাঁরা ক্বচিৎ নিজের জমি পরিদর্শনে যান। ম্যানেজারের উপরই তাঁদের যত বিশ্বাস। আর ম্যানেজাররা সেই বিশ্বাসের অপব্যবহার করে এবং নিজেদের সুবিধার জন্য রায়তদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত করে। চাষিরা ভয়ে গ্রামান্তরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ম্যানেজাররা তাঁদের মনিবের কাছে যে মিথ্যা অজুহাত দেয় তা হচ্ছে এই যে নীলকরদের অত্যাচারে খাজনা কমে গেছে, চাষ হচ্ছে না। এভাবেই মনিবদের অন্ধকারে ফেলে রাখে। এ অবস্থায় আমার এ কথা বলা নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত যে ব্রিটিশ সরকার এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেক ইয়োরোপীয় যে এ দেশের লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করছেন এরা তার বিরোধী অথবা যে ইয়োরোপীয়দের এদেশে অবাধ বসবাসের বিরুদ্ধাচরণ করে, এই বসবাস অবশ্য বিচার পদ্ধতির কতকগুলি পরিবর্তন সাপেক্ষ, সে লোক এ দেশের লোকদের এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের শত্রু’।
    দেখো শেখর দ্বারকানাথ নিজে একজন জমিদার হয়েও জমিদারদের অত্যাচারের কথা অকপটে বলেছেন। নীলকর সাহেবদের যখন অত্যাচারের কথা চারিদিকে ছিছিক্কার তুলছে, সে সময় দ্বারকানাথ বলছেন নীলকর সাহেবরা ‘মহাজন যেন গত সহি পন্থা’ এই মহামন্ত্র জপতে জপতে চাষিদের জিভ বার করে দেবে তাঁদের বুট জুতোর চাপে এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? জমিদারদের নাগরা জুতোর জায়গায় নীলকর সাহেবদের বুট জুতো চাষির বুকে, মুখে লাঞ্ছনা চিহ্ন আঁকছিল এই যা তফাৎ। দ্বারকানাথের সত্যনিষ্ঠ মনের দৌলতেই এ তথ্য জানতে পারি আমরা”।
    শেখর বন্ধু বিমানের দিকে চেয়ে একটা কথা ভাবতে থাকে তা হল বিমানের ভেতরও একটা পরিবর্তন ঘটেছে। যে বিমান নীলকরদের অত্যাচারে মুখর ছিল সে আজ এ কি কথা বলছে। বিমান বুঝি শেখরের মন পড়তে পারে। তাই বলে, ‘দেখো শেখর যেখানে ঝড়ের প্রয়োজন সেখানে কি দখিনা বাতাস দিলে চলে? অন্ধ কুসংস্কার আর মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণায় আমাদের দেশের মানুষের যখন নাভিশ্বাস উঠছে তখন তো নবজাগরণের দরকার। আর তারজন্য চাই একটা জোর ধাক্কা। বলতে পারো উলোটপুরাণ রচনার দরকার। আমাদের সবকিছুকে নবজাগরণের আলোকে আলোকিত করে দেখা উচিত’।
    শেখর বিমানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই আঁধার রাতেও বিমানের মুখে যেন নতুন ভোরের আলোর দীপ্তি। (ক্রমশ)
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ০২ জুন ২০২০ ০০:২৬93878
  • পড়ছি। টানটান উত্তেজনা। কবে পরের পর্ব আসবে সেই অপেক্ষায় থাকি।
  • | ০২ জুন ২০২০ ১৫:২৭93891
  • পড়ছি।

    কিন্তু কমেন্টে এসে গেছে পর্বটা। মূল লেখার সাথে যোগ হলে ভাল হয়।
  • শঙ্খ | 116.206.***.*** | ০২ জুন ২০২০ ১৭:০২93892
  • বাহ নতুন পর্ব, খন্ড এসে গেছে দেখে ভালো লাগলো।
  • সুজাতা গাঙ্গুলী | 27.6.***.*** | ০৭ জুন ২০২০ ১১:৪০94076
  • এই ধারাবাহিকটি পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। 

  • সুজাতা গাঙ্গুলী | 27.6.***.*** | ০৭ জুন ২০২০ ১১:৪০94075
  • এই ধারাবাহিকটি পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। 

  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ০২ জুলাই ২০২০ ০০:০২94806
  • পরেরটার জন্য অপেক্ষা !

  • স্বাতী রায় | 2402:3a80:aba:4083:f93d:8642:f4d5:***:*** | ১৪ আগস্ট ২০২০ ২৩:২৫96250
  • ভালো লাগছে। তবে বড্ড দেরীতে আসে তো একটু খেই হারিয়ে যাচ্ছে। 

  • সুজাতা গাঙ্গুলী | 2405:201:a602:d747:1499:d9f2:eb97:***:*** | ১৪ আগস্ট ২০২০ ২৩:২৭96251
  • অসাধারণ । অনেকদিন পরে লিখলে তন্বী । 

  • | ১৫ আগস্ট ২০২০ ১১:৫৬96271
  • পড়লাম।

    হয়ত অনেকদিন বাদে বাদে আসার জন্যই, খানিক অতি দীর্ঘ মনে হচ্চে, খেই হারিয়ে যাচ্ছে ।
  • Kaktarua | 2607:fea8:4a9e:b685:a59a:2243:decb:***:*** | ১৯ অক্টোবর ২০২২ ১৮:০৫513012
  • এটা আর লেখা হবে না ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন