বাঙালিয়ানা , কোথায়, কি ভাবে , আর কতোটুকুই বা এখন টিকে আছে- এই প্রশ্ন তুললেই আমবাঙালি বেজার হয়ে যেতে পারেন।কেউ হয়তো বলবেন, দুর্গা পুজোতে আমি ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে, আমার ঢাকাই জামদানি পরিহিতা বৌকে নিয়ে অঞ্জলি দিতে যাই রীতিমতো।আর আপনি কি না মশাই, বাঙালিয়ানা টিকে আছে নাকি- এমন বেয়াদব প্রশ্ন তোলছেন?বাঙালিয়ানা কি তাহলে এখন ধুতি আর ঢাকাই জামদানিতে সংস্তিতা হয়ে গেলেন?
ওপার বাংলার বাঙালিকে যদি বাঙালিয়ানা ঘিরে কোনো প্রশ্ন করা হয়, সে খুব গৌরবের সঙ্গে নিজের বাঙালিত্বের গরিমা প্রকাশে পহেলা ফাল্গুনে রমনার বটমূলে বাসন্তী শাড়ি পরিহিতা হয়ে পান্তাভাত খাওয়ার কথা বলবে।তাঁর কাছে বাসন্তী শাড়ি আর পান্তাভাতেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার।
সংস্কৃতিসেবী পরিচয় দেওয়া বেশ কিছু এন জি ও এপার বাংলায় বাংলাদেশের ওই পান্তাভাত আর সুঁটকি মাছ খাওয়ার অনুচিত্র আঁকতে চেষ্টা করেন কলকাতা মহানগরীর বুকে।প্রচুর মানুষ সেখানে ভিড় করেন।হামলে পড়ে পান্তাভাত খান, সুঁটকি খান।এই মানুষদের ই হয়তো একটা বড় অংশ খেতে ভালো বাসলেও পাছে কেউ দেখে ফেলে তাঁকে 'বাঙাল' ঠাওড়ায়, তাই বাজার থেকে সুঁটকি মাছ কিনতেই অপছন্দ করেন।এই মানুষগুলো ই তাঁদের পিতৃপুরুষের পূর্ববঙ্গীয় উত্তরাধিকার নিয়ে গর্ববোধ করেন।শত শত বিগের বাড়ি মুসলমানদের অত্যাচারে ছেড়ে আসার কল্পকাহিনি ছড়িয়ে বাঙালিকে হিন্দু- মুসলমানে ভাগ করেন।এঁদের কাছে বাংলাভাষী মানেই বাঙালি নন।এঁদের বেশিরভাগ ই বিশ্বাস করেন বাংলাভাষী হিন্দুই বাঙালি ।আর বাংলায় কথা বলেন, ধর্মে মুসলমান, এমন মানুষ তাঁদের কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র মুসলমান ই থেকে যান, বাঙালি আর হয়ে ওঠেন না।
পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি, যাঁদের চলতি কথায়' ঘটি' বলে, এঁদের যে নিজস্ব কিছু সামাজিক বেশিষ্ট্য ছিল, সেই সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁরা আজকের দিনে কতোটা যত্নবান, সেটা সমাজসমীক্ষার একটি বিষয় হতে পারে। খাদ্যাভাস থেকে কথ্য ভাষা-- দুইয়ের ক্ষেত্রেই বাঙালির ভিতরে পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ -- এই দুই ভৌগোলিক অবস্থান জনিত কিছু ফারাক আছে।সেই ফারাকগুলিকে খুব বড় মৌলিক ফারাক হয়তো বলা যায় না। কিন্তু সেই ফারাককে ঘিরেই বাঙালির সামাজিক আবর্ত আজ ও অনেকটাই আন্দোলিত হয়।তবে ঘটি বা বাঙাল, কেউ ই আজ তাঁদের যাপনচিত্রে , নিজেদের ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় মৌলিক ভাবে মেনে চলছেন, এমনটা দাবি করেন না। আর এই মেনে না চলার ভিতর দিয়েই কিন্তু সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের একটা সুন্দর ধারা বিকাশ লাভ করেছে।
অবিভক্ত বাংলায় রমজান, ঈদ, পয়গম্বরের জন্মদিন, শব ই বরাত, মুহররম, বেড়া ইত্যাদি দোল, দুর্গোৎসবের মতোই বাঙালির উৎসব ছিল।বিশ শতকের দ্বিতীয়, তৃতীয় দশকে ঢাকাতে মুহররমের মিছিল আর জন্মাষ্টমীর মিছিল কিভাবে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল তার বিবরণ স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ' স্মৃতির শহরে' কবি শামসুর রাহমান রেখেছেন। ' বাহারিস্থান ই গায়েরি' র লেখক মির্জা নাথান সপ্তদশ শতকে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে বাংলায় এসে পবিত্র রমজান , ঈদ পালনের পরম্পরার সঙ্গে জাতি- ধর্ম- ব্যতিরেকে বাঙালির অংশ গ্রহণের ঐতিহাসিক বিবরণ রেখে গিয়েছেন।সপ্তদশ শতকে লেখা মির্জা নাথানের সেই বিবরণের পারস্পর্যের সাথে গত বিশ শতকে র প্রথম দিকের স্মৃতি কেন্দ্রিক শামসুর রাহমানের লেখার ভিতরে কিন্তু মৌলিক সংঘাত এতোটুকু নেই। যন্ত্রণার বিষয় হল, প্রায় চারশো বছরব্যাপী পরম্পরা গত বিশ শতকের মধ্যভাগে , দেশভাগ জনিত সংঘাতের আবর্তে সেই যে হিন্দু বাঙালির উৎসব আর মুসলমান বাঙালির উৎসবে ,ভাগাভাগি- ভাঙাভাঙির হরির লুট হয়ে গেল, দুনিয়াদারির এতো অদলবদল স্বত্ত্বেও এই এবাদতের এতোটুকু অদলবদল ঘটলো না। যাঁরা শারদোৎসবে ধুতির বিবর্তন, প্রায় শাড়ির মতো পাড়ওয়ালা ,রঙিন কাপড়ে সজ্জিত হয়ে বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে উৎসুক, তাঁরাও উদ্যোগী হলেন না মুহররমের চতুর্থ দিবস থেকে শুরু হওয়া মর্সিয়া গানকে টিকিয়ে রাখতে।আমাদের মতো পশ্চিমে ঢলে পড়া জীবনের কিছু কিছু মানুষ আজো রমজান মাসে র চতুর্থ দিন থেকে এখনো ভিড় জমান মর্সিয়া গান শুনতে ইমামবাড়া তে। মর্সিয়া গানের গায়কের বিভিন্ন দল , তাঁদের নিজস্ব আলাদা আলাদা নিশান নিয়ে আসেন। অষ্টম দিনেও দেখেছি বিকেল বেলা থেকে মেয়েদের ইমামবাড়াতে সমবেত হয়ে এই শোকসঙ্গীত গাইতে।
মর্সিয়া গানের ক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলার পয়ার ছন্দের ব্যবহারই বেশি দেখা যায়। যাঁরা এখনো অল্প বিস্তর এই গানের চর্চা বজায় রেখেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পেলেও মর্সিয়া গান, যাকে বাংলায় অনেক জায়গাতেই জারি গানও বলা হয়,সেটি গাইবার সময়ে ' পয়ার ছন্দে' র উচ্চারণে এতোখানি দক্ষতার পরিচয় দেন যে, হঠাৎ করে মনে হতেই পারে, এই মানুষগুলির ছন্দ সম্পর্কে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি আছে।
শোকগাথা হিশেবে মর্সিয়া গান খুব শব্দবহুল হতো না।কিন্তু জারি গান একটু দীর্ঘ এবং শব্দবহুল।অনেকের অনুমান, মর্সিয়া গানের সঙ্গে পরবর্তীতে এই একটু শব্দবাহুল্যযুক্ত জারি গান সংযুক্ত হয়েছে। মর্সিয়া গানে ' ধুয়া' দেওয়ার যে প্রচলন আছে, সেটিকে বেশ দীর্ঘায়িত ভাবেই ব্যবহার করা হয় জারি গানে।
' জারি' শব্দটি সাংস্কৃতিক ভাষা ফার্সি থেকে এসে ক্রমে বাংলা তথা বাঙালির দহলিজে ঠাঁই করে নিয়েছে।ফার্সি তে 'জারি' শব্দের অর্থ হল, কান্না।শোকের সমার্থক এই শব্দটি।সপ্তদশ শতকের কবি মহম্মদ খানের লেখা ,' মকতুল হোসেন' সম্ভবত বাংলার জারি গানের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ। এই গ্রন্থের কেতাবি আওতায় মর্সিয়া গান আটকে থাকে নি।লোকায়ত বাংলার সর্বাঙ্গীন চেতনায় কারবালার ময়দানের শোকবহ ঘটনার যে মরমীরূপ প্রকাশ পেয়েছে নারী- পুরুষের কণ্ঠে, তা বাঙালি সংস্কৃতির এক অনবদ্য অধ্যায়। গ্রাম বাংলায় পবিত্র মুহররম কে কেন্দ্র করে ,যেভাবে এই মর্সিয়া গানের মহড়া আজও বাংলাদেশের গ্রামীণ অংশে দেখতে পাওয়া যায়, তার কিছু রেশ আমাদের এই বাংলার রাঢ় অঞ্চলেও অবশ্য আছে।রাজনীতির ভাগাভাগি যতোই ধর্মের দোঁহাই দিয়ে মানুষকে আলাদা করতে চাক না কেন, আজ ও লোকায়ত সংস্কৃতি , প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আড়ম্বরকে উত্তরীত করে, লোকাচারের আঙ্গিকে মানুষের জয়গান গেয়ে চলেছে।
এই লোকায়ত ধারাকে সংরক্ষণে বাংলাদেশে '৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে যে আন্তরিক উদ্যোগ, সরকারে যে দল ই থাকুন না কেন, ঋদ্ধ , বর্তমান বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় খোঁজবার তাগিদে কিন্তু দলীয় সঙ্কীর্ণতা সেই দেশে আমরা খুব একটা দেখি নি।দুঃখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু খুব একটা সেই পথে হাঁটে নি।শাসকের পছন্দের লোকেরাই চিরকাল হয়ে উঠেছেন' বিশেষজ্ঞ' ।এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এখানে যে রাজনৈতিক দলের পরিচালনাধীন সরকার ই ক্ষমতায় থেকেছেন, সংস্কৃতির শেকড় নিরূপনে তাঁরা নিজেদের দলীয় আনুগত্য সম্পন্ন মানুষদের বাইরে অন্য লোকেদের দেখেন ই নি।অনেকক্ষেত্রেই শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপর খবরদারি করতে সদরের শৌগিন মজদুরদের বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মাটির সঙ্গে লেপটে থাকা লোকেদের উপর।ফলে বাঙালি সংস্কৃতির হাজারো লৌকিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে কেবল শহুরে দর্শনধারী বিষয়।
এই মর্সিয়া গান, এতো আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ই একটা অঙ্গ।আমরা রাজস্থানের ' রুদালি' দের ঘিরে উৎসাহী হয়েছি মহাশ্বেতা দেবীর কাহিনি পড়ে, কল্পনা লাজমীর ফিল্ম দেখে।কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব বিষয়, যার সঙ্গে শ্রীরাধিকার কৃষ্ণবিরহের অনেক সাদৃশ্য আছে, সেই মর্সিয়া গান নিয়ে কিন্তু মহাশ্বেতার মতো ব্যক্তিত্বেরা কখনোই কলম ধরেন নি।শোককে আমরা ধার করেছি সুদূর রাজস্থান থেকে।অথচ মর্সিয়া গানের শোকের মাতমে ইমাম হাসান হোসেনের শাহাদাত বরণের সাথে বাংলা আর বাঙালির দহলিজ নিংড়ানো আঁসুয়া কীভাবে যুগ যুগ ধরে ঠাঁই করে নিয়েছিল, তার খোঁজ আমরা কেউ ই রাখার চেষ্টা করি নি।কিন্তু মহাত্মা লালন রাধাকৃষ্ণের মিলন বিরহ ঘিরে মানবরত্নের সন্ধানে প্রয়াসী হয়েছেন।কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে সেই সৃষ্টির চর্চা আজ ও পরম সমাদরের সঙ্গেই ধারাবাহিক ভাবে হয়ে চলে।
স্যার গুরুসদয় দত্ত , বিশ্ব মানব হওয়ার লক্ষ্যে যে শাশ্বত বাঙালি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেই বাঙালিত্বের আহ্বানের ভিতরে ছিল বাবুয়ানি বর্জিত , অসাম্প্রদায়িক বাঙালিয়ানার প্রতি একটা স্বতঃস্ফুর্ত আত্মনিবেদন।অন্নদাশঙ্কর কে কোচা দোলানো ধুতি পড়তে দেখে, সেই আঙ্গিকটি যে উনিশ শতকের বাবু কালচারের সমার্থক, সে বিষয়ে তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন স্যার গুরুসদয়।ফলে অন্নদাশঙ্কর আর কোনোদিন কোঁচা ঝুলিয়ে ধুতি পড়েন নি।এটি বিশ শতকের প্রথম দিকের ঘটনা।উনিশ শতকীয় বাবুয়ানির ক্ষয়িষ্ণু রেশকে ধরে রেখে যখন একাংশের ভিতরে বাঙালি হিশেবে নিজেদের মেলে ধরবার প্রয়াস প্রকীর্ণ হচ্ছে তখন আমাদের স্মরণ করতে হয় , উনিশ শতকের শেষের দিকের একটি পর্যায়।
এই পর্যায়টির কুশীলব এমন একজন মানুষ , যাঁর কোনো প্রথাগত শিক্ষা নেই।তাঁর সময়কালে কেউ তাঁকে মনে করেছিলেন হিন্দু পুনরুত্থানের প্রতিভূ।আবার সেই মানুষটিই যখন ওয়াজেদ আলি খানের ( যিনি গোবিন্দ রায় নামেও পরিচিত)কাছে প্রথাগত ভাবে ইসলামধর্মে দীক্ষা নিয়ে সাধন ভজন করেছেন, তখন তাঁকে সমন্বয়ী চেতনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে ধরার মতো মানসিক স্থৈর্য এবং উচ্চতা , খুব বেশি বাঙালির ছিল না। সেই শ্রীরামকৃষ্ণ কালোপাড় ধুতির সঙ্গে বাবুয়ানির সাদৃশ্য দেখিয়ে , বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় যে ধর্মান্ধতাতে নয়, সাংস্কৃতিক কলোচ্ছ্বাসে প্রস্ফুটিত হয়, সেটাই দেখিয়ে গেছেন।