একটি অখন্ড জাতির প্রতীক হিশেবে ' ফকির'কে সাব্যস্ত করেছিলেন সমরেশ বসু ।একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ এই ফকির।আমার আবাল্য বেড়ে ওঠা শহরের অতীতের এক প্রতিভু।যে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটি একদিন মুক্তারপুর শ্মশানে শায়িত মৃতদেহের গায়ের রঙ ঘিরে শোকাতুর সমরেশ কে প্রশ্ন করেছিল, সেই মুক্তাপুরেই রাজার বেশ ছেড়ে একদিন ফকির হয়ে ভূমিশয্যা নিয়েছিলেন সমরেশ।
আমার প্রথম ভালোবাসার মতো এই শহরে একদিন রশিদ আলি দিবসের মিছিলে পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল সেই ফকির, মানুষের সাধারণ বোধে যে ছিল একজন পাগল।মানসিক ভারসাম্তহীন বলেই মনে করত লোকে তাকে।স্টেশনের সামনে সুবেশিনীর স্বামী হ্যাট- কোট- টাই সামলে ডাব খাচ্ছে দেখে যে ফকির সুবেশিনীর গাল টিপে দেয়, যার বিনিময়ে সেই নব্য' বাবু' বিরাশিক্কায় দম নিতে কষ্ট হয় ফকিরের, সেই ফকির ই রশিদ আলি দিবসের মিছিল কে সাহস দেখায়, পুলিশের বন্দুকে একটাও গুলি নেই, তোমরা এগিয়ে এসো।
আটের দশকের শেষে নূর হোসেনকে আমরা দেখেছি ঢাকার জনপথে।কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় তা ছিল; বুক নয় , বাংলাদেশের হৃদয়।সেই হৃদয়কে আমরাস ছিন্ন হতে দেখেছি চোখের সামনে। কিন্তু ঢাকার নূর হোসেনের অনেক অনেক আগে নৈহাটি শহরের বুকে তো নূর হোসেনের সঙ্গে প্রথম দেখা সমরেশের।বিগত বসন্তের ললিতরক্ত রাগে ' নূর হোসেন' তখন' ফকির'।এই নূর হোসেনকে তো আমার শহর চেনে না।কারন, যে ইস্কুল- পোস্ট আপিস, পতিতাপল্লীর ভিতর দিয়ে গঙ্গা পেরুনো যাত্রীদের হয়ে লাগেজ বইবার কসরত করতো ফকির, সেই বেশ্যাপল্লী এখন প্রায় নেই ই।সেই বেশ্যাপল্লীতেই এক অতি বাম নেতা তাঁর শাশুড়ির বাড়িতে পত্তনী করছিলেন।সমরেশ তখন আকাশের তারা।সেই বাড়ি করতে বেনিয়মী কারবার আটকেছিল প্রশাসন।তাই সেই অতিবামবুদ্ধিবীচি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কতোখানি রক্তলোলুপ বোঝাতে ছেড়েছিলেন নাট্য আকাদেমি।ফকির তখন বেড়াকুড়া সেরে বাসার ফেরার ডানার ঝাপটানি দেয় না বলেই সেই অতিবাম নেতা আজকের শাসকদের সঙ্গে অডিটোরিয়ামের ফিতে কাটে দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে।
সমরেশ হয়তো আকাশের তারা হয়ে দেখেন।আর এই দেখাটার প্রবাহিত স্রোতের ধারাকে বুঝেই তিনি নিশ্চয় ই ফকির কে অখন্ড জাতির প্রতীক বলে ঘোষণা করেছিলেন সেই অনেককাল আগে।বেঁচে থাকুক আমার নৈহাটি।বেঁচে থাকুক আধুনিক নাট্যবীচিরা , বেঁচে থাকুক গুটিয়ে যাওয়া বেশ্যাপাড়াতে নোতুন গজিয়ে ওঠা আঙুল ফোলা কলাগাছি রেস্তোরাঁ।ফকিরদের পাগলামো, যে দধিচির হাড়ের দৌলতে, সেই হাড়ের বাষ্পশকটেই তো বাবুসাবেদের চড়া।তাতেই তো গরিফার সেনপাড়া থেকে রুবি দত্তের আসা যাওয়া।
রুবি দত্তের আদি সাকিন ঠিক কোথায়? নদিয়া জেলাতে? নাকি নৈহাটির সেনপাড়াতে?সমরেশ নৈহাটিতে থাকলে , সন্ধ্যেবেলায় তাঁর স্থায়ী ঠিকানা ছিল 'সরস্বতী বুক স্টল' । রুবি দত্ত কি আজ ও সমরেশের প্রিয় সেই বইয়ের দোকানটিতে মোসায়েব দিয়ে স্লিপ পাঠান? তবে তা কেবল বইয়ের ই রিকুইজিশন! এইসবের আবর্তনেই আজ ও ভীষণ ভাবে জীবন্ত এই আতপুর, জগদ্দল, ভাটপাড়া, নৈহাটিতে সমরেশ বসু।
'গঙ্গা' তে বসিরহাটের ধলতিতা গাঁয়ের রাম মালো কি বধুবেশি রুবি দত্ত কে নৈহাটির নন্দপল্লী থেকে যখন শ্বশুরঘরে নিয়ে গেছিল,' ত্যাখন মুক্তাপুর খালে ছেল জল।এত গেট- ফেট ছিল না।খেল্যের গাঙ দে' বেরিয়ে, হাড়োয়া খালের ভেতর দে', বোদাইয়ের পাশে মালতী বিল।মালতী আর বারুতীর বিল।তারসঙ্গে মুক্তাপুরের খাল।সেই খাল দে' ভাটপাড়ার উতোর বেলে দে' একেবারে গঙ্গা'য় পড়েছিল জীবনযৌবন? এখনো যেন বুজে আসা মুক্তাপুর খাল প্রত্যাশা করে রাম মালোর দল গলুই বেয়ে চলবে তার বুক চিরে। এখনো বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের প্রতিটি আনাচ কানাচে নীরব নিশীথিনীতে কান পাতলে কৃষ্ণ বিরহ কাতর রাধারাণীর পদচারণার মতোই যেন মনে হয় হেঁটে চলেছেন সমরেশ বসু।
নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার বাইরে সমরেশ বসু একটি শব্দ কখনো লিখেছেন বলে মনে হয় না।যে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার চিহ্ন তাঁর সৃষ্ট শুধু চরিত্রগুলি ই নয়, প্রতিটি শব্দের ভিতরে রয়েছে।প্রথম জীবনে চটকলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের অভিজ্ঞতা থেকে কেবল শ্রমিকের কথাই তিনি লেখেন নি।দেশভাগ কে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশের উচ্চবর্ণের মানুষ কিভাবে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু , বিত্তবান নিম্নবর্গের ধনদৌলত আত্মসাৎ করেছে- এই প্রসঙ্গে সমরেশের সদাগর'সম্ভবত একমাত্র উপন্যাস। বস্তুত এই প্রসঙ্গটি ঘিরে প্রতিভা বসুর একটি ছোটগল্প ' দুকুল হারা' ছাড়া গোটা বাংলা সাহিত্যে খুব একটা দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।
সমরেশের বিভিন্ন লেখা তে অমর হয়ে আছেন সত্যমাস্টার। গত শতকের চারের দশকের শেষ লগ্নে সমরেশের বিশ্বাসের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যে সাংস্কৃতিক চেতনাগত অস্থিরতা, যা বাংলায় তথা ভারতে শ্রমিক- কৃষকের মুক্তির স্বপ্নকেই কার্যত অনেকখানি অকেজো করে দিয়েছিল, সেই প্রেক্ষিত কে অবলম্বন করে তাঁর গল্প, ' মানুষ' পড়লে আজ ও বিস্ময় জাগে।এখানে সমরেশ লিখছেন;" সুজিত কঠিন গলায় আদেশ করল।ধীরেশ সামনে ফিরে চলতে আরম্ভ করল।ছাঁই ঘেঁসের উপর দুজনের পায়ের শব্দ খসখস করে বাজছে।রিভলভারের শব্দটাসশহরের কোথাও কোনোরকম সন্দেহ বা কৌতুহল সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয় না।সুজিত আবার বলল, 'আপনাকে দেখে অনেক সময় আমার ব্রিটিশ স্পাই জর্জ রিলি এর কথা মনে পড়ে যায়।সোভিয়েট বিপ্লবকে যে বানচাল করতে রাশিয়ায় ঢুকেছিল।"
রাজনৈতিক ধারাপ্রবাহের এই লোলচর্মবিহীন কালচিত্র আমাদের গোটা সমাজটাকে কোথায় পৌঁছে দিতে শুরু করেছে, সমরেশ তা যেন আপ্তবাক্যের মতো বলছেন;" পার্টি কারো শয়তানি করবার একটা যন্ত্র নয়, যদিও সাময়িক ভাবে সেই ট্রেজেডি না ঘটেছে তা নয়।" সমরেশের এই ভবিষৎবাণী মিছে হয় নি।'তিনপুরুষে' র কালোত্তীর্ণতায় এই ইঙ্গিত আঁকতে গিয়ে হয়তো মানসিক যন্ত্রণাতে দীর্ণ হয়েছেন সমরেশ।তবু কয়লায় কঠিন সত্য কে মেলে ধরেছেন এতোটুকু ভান না করে।আবার সেই সত্যকে তুলে ধরবার তাগিদে একটি শব্দেও কিন্তু বিষোদগারের ন্যুনতম আভাসটুকু ও নেই।নেই তাঁর প্রতি অবিচার জনিত কোনো ব্যক্তিযন্ত্রণার বহিঃস্ফুরণ। তাঁর একদা সহযোদ্ধা রা সমরেশের প্রতি এই স্বভাবসুলভ ঔদার্য দেখাতে পেরেছেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।পিছনপানে চাইতে গিয়ে অল্পকিছুদিন আগে ও এক প্রতামিথযশা নেতা, সমরেশের উপন্যাস অবলম্বনে পেশাদার থিয়েটারে সে গুলির অবতারণা করে , বিষোদগার করেছেন ব্যক্তি সমরেশের।মজার কথা হল, পেশাদার মঞ্চের পরিচালক একটি উপন্যাসের স্বত্ত্ব কেনবার পর, বক্স অফিসের দিকে তাকিয়ে , সেই উপন্যাসের কি গতি করবেন, তাতে লেখক সমরেশের এতোটুকু ভূমিকা থাকে কি?