বাংলার সামাজিক জীবনের সূফীদের প্রভাব অসামান্য। বাংলা তথা বাঙালির সম্যক বিকাশের ক্ষেত্রে সুফিদের অবদান বাঙালিকে এক অসামান্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। পীর শব্দটির অভিধানগত অর্থ প্রাচীন বা বৃদ্ধ। প্রধানতঃ আধ্যাত্মিক গুরু এই অর্থে সুফি - পীর এই শব্দগুলি ব্যবহৃত হতে থাকে। এই শব্দটির উৎস হচ্ছে ফারসি ভাষা। ফারসি ভাষায় পীর শব্দটির যে দ্যোতনা, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই বৌদ্ধরা যে অর্থে থের শব্দটি কে ব্যবহার করে, অর্থাৎ বৃদ্ধ, হিসেবে শব্দটিকে ব্যবহার করে, সেই একই রকম শব্দগত অর্থে এটি ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃত ভাষাতেও স্থবির শব্দের অর্থ হলো কিন্তু বৃদ্ধ।
পীরেরা হলেন পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রচারক । এই পীরদেরই সুফি নামে অভিহিত করা হয়। ফারসি শব্দ থেকে এই পীর শব্দটি এলেও সুফি শব্দটি কিন্তু আরবি ভাষার তাসাউওফ্ শব্দ থেকে প্রচলিত হয়েছে। আরেকটি অর্থ সুফ্ ও এই তাসাউওফ্ শব্দের। এই শব্দবন্ধের অর্থই হলো পবিত্রতা। সুফ শব্দের অর্থ হলো কিন্তু পশম। অনেকে মনে করেন, যাঁরা পশমের কাপড় চোপড় ব্যবহার করতেন, তাঁদের থেকে সুফি শব্দটি এসেছে। আবার অনেকের ধারণা, হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর সময়ে যাঁরা মসজিদের মাটিতে বসে সাধনা করতেন, উপাসনা করতেন, তাঁদের থেকেই এই সুফি শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সামনের সারিতে বসে যাঁরা নামাজ আদায় করতেন, তাঁদের থেকে এই সুফি শব্দটির উৎপত্তি।
বিশিষ্ট সুফি সহল তস্তুরী বলেছেন, যিনি মালিন্য থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন, অর্থাৎ ; মালিন্য মুক্ত মানুষই হলেন সুফি। তাঁর মতে যে কোনো মানুষই নিজেকে যদি মালিন্য থেকে দূরে রাখতে পারেন তাহলে তিনি সুফি হিসেবে পরিগণিত হন। ভারতীয় আধ্যাত্বসাধনার ভক্তিমার্গ, সেই পথের সঙ্গে কিন্তু সুফি সাধনার একটা ভীষণ রকমের সাদৃশ্য আছে। ভক্তিমার্গের আধুনিকতম সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে সুফি ভাবধারাতে সাধনা করেছিলেন।
মারুফ্ আল কর্ খী, বাগদাদের এই প্রসিদ্ধ সুফি-সাধক, ভক্তিকেই সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ পথ, মুক্তির পথ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, এই ভক্তি মানুষের সাধনায় মেলে না, এটি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার দান। সৃষ্টিকর্তাকে যাঁকে করুণা করেন, তাঁকেই ভক্তি অর্পণ করেন। এভাবেই তিনি সুফি সাধনার যে ধারা, তাকে ব্যাখ্যা করেছেন। আর একজন প্রসিদ্ধ সুফি সাধক জুনিদ বাগদাদীর মতে সুফি হলেন পবিত্রার ঋষি। সূফি তরিকাকে তিনি মাটির মতো একটি বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করবার কথা বলেছেন। এই মাটি থেকেই সমস্ত কল্যাণের ধারা বিকশিত হবে এটাই ছিল তাঁর ধারণা। সংসারের নির্লিপ্ততাকেই সুফি হিসেবে পরিগণিত করার কথা তাঁর মতে এই তরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা।
বাগদাদ শহরের পতন(১২৫৮) গোটা বিশ্বেই সুফি ভাবধারার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। বাগদাদ শহর ধ্বংস হওয়ার পর ভারতে সুফিবাদের ধারা বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বাঁধনহারা প্রভাব আমরা দেখতে পাই। যদিও এই কথা মনে করা ঠিক নয় যে, বাগদাদ শহর ধ্বংসের আগে ভারতের সুফি ভাবধারার কোন প্রভাব বা প্রসার ছিলনা। বাগদাদ শহর ধ্বংসের আগে ভারতের সুফি ভাবধারার যে প্রভাব ছিল সেটি একটি নদীর শীর্ণতোয়া প্রবাহমান স্রোতের মতো ছিল। স্রোতের একটা প্রভাব অবশ্যই ছিল। তবে সেই প্রভাবটি ছিল বড়োই অপ্রতুল।
সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় একাদশ শতককে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি ভাবধারা প্রভাবের যুগ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। কিন্তু তবুও জোরের সঙ্গেই বলতে হয় যে, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে বাগদাদ শহরের ধ্বংসের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি ভাবধারার কয়েকজন সাধক এসেছিলেন। তাঁরা তাঁদের চিন্তাধারাকে এই দেশে প্রসারিত করেন। তাঁদের ভাবনায় বেশকিছু মানুষ প্রভাবিত হয়ে সুফি তরিকার প্রতি আকৃষ্ট হন।
তেমনই একজন সাধক হলেন আদম পীর। আদম পীরের প্রভাব অবিভক্ত বাংলায়, সামাজিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আদম পীর ছাড়াও কিন্তু খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের আগে আরও বেশ কয়েকজন সুফি সন্ত ভারতে আসেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন; শাহ সুলতান রূমি, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, মখদুম শেখ জালালউদ্দিন তাবরেজী ইত্যাদি। আরো বহু সুফি-সাধক এই বাগদাদ ধ্বংসের আগে ভারতে এলেও মইনুদ্দিন চিশতী প্রমুখের প্রসিদ্ধি ছিল সব থেকে বেশি।
বাংলায় আদম পীরের প্রভাব সেই একাদশ শতকের পূর্ববর্তী সময়কালে থেকে আজও সমানভাবে বিদ্যমান। হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ী সংস্কৃতির এক অসামান্য ভাবধারা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে আদম পীর বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছেন। আদম পীর সম্পর্কে খুব সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যথেষ্ট মুশকিলের ব্যাপার। আদম পীরকে অনেকেই হযরত পীর আদম বলে অভিহিত করে থাকেন। কেউ কেউ বলেন বাবা আদম শহীদ। কিন্তু তাঁর জন্ম কোথায়, তাঁর তিরোধানই বা কোথায়, কিভাবে হয়, মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট তারিখ --এই সব কোনো কিছুই সঠিকভাবে জানতে পারা যায় না। তাঁর পারিবারিক পরিচয়ও কিন্তু খুব সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। খানিকটা অনুমান এবং অনুরাগীদের রেখে যাওয়া পরম্পরাগত বিবরণ এবং তাঁদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন গল্পগাছাকে নির্ভর করেই আদম পীর সম্বন্ধে কিছু কিছু ধারনা আমাদের সামনে উঠে আসে।
ঢাকা সন্নিহিত অঞ্চলে সুফি ভাবধারার প্রচারের ক্ষেত্রে, প্রসারের ক্ষেত্রে এই আদম পীরের ঐতিহাসিক অবদান আছে। তবে একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, ঢাকা সন্নিহিত অঞ্চলে পবিত্র ইসলামের প্রচার, প্রসারের ক্ষেত্রে একমাত্র আদম পীরেরই ভূমিকা আছে। তিনি ব্যতীত আরো বহু সুফি-সাধক ছিলেন, যাঁরা ঢাকা সন্নিহিত অঞ্চলে পবিত্র ইসলামের ভাবধারা বিশেষ করে সমন্বয়ী চেতনা, হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনার প্রসারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সুফি ভাবধারা সম্পর্কে গবেষণার ফলে আজ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশজন সুফি সাধকের নাম জানতে পারা যায়, যাঁরা ঢাকা সন্নিহিত অঞ্চলে খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের আগের সময় থেকে পরবর্তী দীর্ঘ কয়েক শতক ব্যাপী পবিত্র ইসলামের প্রচার-প্রসারের ভেতর দিয়ে সমন্বয়ী ভাবধারার এক আশ্চর্য ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। সেই নির্মাণের উপরে দাঁড়িয়েই কিন্তু পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতির সমন্বয়ী ভাবধারার প্রচার, প্রসার ঘটেছে। সেই প্রভাব বাংলাকে ছাপিয়ে গোটা ভারতে বহুত্ববাদী দর্শনকে প্রসারিত করেছে, প্রভাবিত করেছে।
যে প্রায় চল্লিশজন সুফি সন্তের সংখ্যা উল্লেখ করা হল, যাঁরা ঢাকা সন্নিহিত অঞ্চলে সুফি ভাবধারার মরমী সাধনার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই পীর হজরত আদম শহীদ। ঢাকা সন্নিহিত মুন্সিগঞ্জের রামপাল নামক স্থানে আদম পীর সুফি ভাবধারার প্রচার-প্রসারের প্রাথমিক কাজটি শুরু করেছিলেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা সন্নিহিত অঞ্চলে সুফি ভাবধারার প্রচারের সবথেকে প্রাচীনতম ব্যক্তিত্ব। নিজের জীবনকে বাজি রেখে সমন্বয়ী চিন্তা ধারা, মরমী সাধনার সুফি দর্শন প্রচার, প্রসার এবং প্রবৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে পবিত্র ইসলামের ভাবধারার বিকাশে আদম পীর হলেন সর্বকালের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
আদম পীরের সময় বাংলায় সুফি ভাবধারার প্রচার ও প্রসারে ব্রতী হন, সেই সময়কালটা বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার ভয়ঙ্কর প্রকোপ। গোটা বাংলার সামাজিক পরিবেশ তখন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার প্রকোপে ভয়ঙ্কররকম ভাবে জর্জরিত। তুর্কি বিজয়ের পূর্ববর্তী সময় সেটা। সনাতন ধর্মের এক ধরনের অপব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং তান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বীরাচারি সাধনার ধারা (সুরা আর নারী যেখানে সাধনার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিল) বাংলার আকাশ-বাতাসকে এক ভয়ঙ্কর রকমের প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছিলো।উচ্চবর্ণের সনাতন ধর্মের মানুষজন ছাড়া প্রান্তিক সনাতনী যাঁদের চলতি অর্থে নীচুজাত, অন্ত্যজ বলে অভিহিত করা হয়, তাঁরা সমাজে সবরকম ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন।
এইরকম একটা সময়ের ভেতরে কিন্তু আদম পীর খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের আগে ঢাকা সন্নিহিত অঞ্চলে সুফি ভাবধারার প্রচার ও প্রসারের ভেতর দিয়ে ইসলামের মরমিয়া দৃষ্টিভঙ্গিকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। আদম পীরের সম্বন্ধে যত টুকু জানতে পারা যায় তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, তাঁর সময়কালে, তাঁকে ভয়ঙ্কর রকম ভাবে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী, উচ্চবর্গীয়, সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির লোকেদের সঙ্গে লড়াই করে, নিজের চিন্তা চেতনার প্রসার ঘটাতে হয়েছিল।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরা আজকের দিনে পবিত্র ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরান আর কৃপাণের যে তত্ত্বের অবতারণা করে, সেই তত্ত্বের অসারতার প্রাথমিক লক্ষণই হলো কিন্তু আদম পীরের জীবন। বাংলায় পবিত্র ইসলামের প্রচার ও প্রসারের একদম প্রাথমিক লক্ষনেই ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের সঙ্গে সংঘর্ষের ভিতর দিয়ে সমন্বয়ী চিন্তা-চেতনার মরমিয়া সাধনার ধারাকে আমাদের এই বাংলার বুকে পরিবেশন করতে হয়েছিল আদম পীরের মতো বহু সুফি সন্তকে।
এই সময়কালের সুফি সাধকদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক এবং সমাজে প্রভাব বিস্তার করা মানুষদের সংঘর্ষকে ঘিরে আজও বাংলার আনাচে কানাচে বহু লোককাহিনী পাওয়া যায়। এইসব লোককাহিনীগুলিকে পরবর্তীকালে কিন্তু ইসলামের আগ্রাসন হিসেবে দেখানোর জঘন্য রাজনৈতিক চেষ্টা চলে আসছে। এই সমস্ত লোককাহিনীর উৎস হচ্ছে, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজপতিদের দ্বারা সুফি ভাবধারার প্রচার ও প্রসারের উপর আক্রমণ।
বাংলায় তুর্কি বিজয়ের পূর্ববর্তী সময়কালে এই যে আক্রমণের মুখে সুফি সাধকদের পড়তে হয়েছে, এটি কিন্তু পরবর্তীকালে ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে বেশিরভাগ অংশই গোপন করে যান। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতো স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ, যাঁর একদিকে ছিল ঈর্ষনীয় ইতিহাস প্রজ্ঞা আর অপরদিকে ছিল আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী দর্শনের প্রতি একটা প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আর হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। এ হেন ঐতিহাসিক মধ্যকালীন ভারতের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে, বাংলার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে, সুফি ভাবধারার সাধকদের যে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছিল, সেই সমস্ত বিষয়গুলি একেবারেই গোপন করে গিয়েছেন।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলায় নিম্নবর্গীয়, সনাতন চিন্তাধারার বিশ্বাসী মানুষজন যাঁরা ছিলেন, যাঁদের এককথায় নিম্নবর্গীয় হিন্দু বলা হয়, এই অংশের মানুষদের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উপরে আস্থা ছিল না, বৈদিক দেবদেবতার উপর আস্থা ছিল না বরং তাঁদের বিশ্বাস, আস্থার জায়গাটা বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে ভীষণ রকম ভাবে নিবন্ধ ছিল। আর এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারা যায় এই লৌকিক দেব-দেবীদের ঘিরে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক এবং সমাজপতিদের মানসিক অবস্থানের ভেতর দিয়ে।
আমাদের মঙ্গলকাব্য, বিশেষ করে মনসামঙ্গলে যে চাঁদ সদাগরের কাহিনী আছে, তার ভিতর দিয়েই এই বৈদিক দেবতা আর লৌকিক দেবতার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আমরা বুঝতে পারি। এই উপাখ্যানের ভিতর দিয়েই মধ্যযুগের বাংলার সামাজিক প্রেক্ষিতটাও আমাদের সামনে পরিষ্কার ফুটে ওঠে।
লৌকিক দেব-দেবীদের গৌণ দেব-দেবী বলে অভিহিত করা হয় আধুনিক সমাজের সমাজবিজ্ঞানীদের দ্বারা। এই সব গৌণ দেবতারা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজপতিদের দ্বারা সমাদৃত হতেন না মধ্যযুগের বাংলাতে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থা এই গৌণ দেব-দেবীদের অবজ্ঞার ভেতর দিয়ে দেখতো। এই দেখার ভিতর দিয়েই সে যুগের সামাজিক বিন্যাসের দিকটাকে খুব পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। পরমতঅসহিষ্ণুতা, যেটা ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারা এবং উচ্চবর্গীয় হিন্দুসমাজের চিন্তাধারার সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য, সেই চিন্তাধারার প্রসার কিন্তু তুর্কি বিজয়ের পূর্ববর্তী সময়ে বাংলায় ভয়ঙ্কররূপে বিস্তার ঘটে ছিল। যার ফলে আদম পীর পবিত্র ইসলামের সুফি তরিকা ভাবধারার প্রচার ও প্রসারের জন্য সেই সময়কালে সমাজপতিদের দ্বারা বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজপতিদের দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের হাতে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। মরমিয়া সমন্বয়বাদী চেতনার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তিনি হলেন প্রথম শহিদ। সেই কারণে তিনি আজও বাংলায় হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার বাইরে বাবা আদম শহীদ বলে সকলের কাছে সম্মানিত এবং মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।
ইদের কড়চার দ্বিতীয় কিস্তিতে সমাপ্য
"জুনিদ বাগদাদী" নামটা কোথা হতে পাইলেন ? জুনায়েদ কবে থেকে জুনিদ হল ?
জুনিদ-- এই বানান টি বাংলার সুফি দের নিয়ে অন্যতম প্রাচীন আলোচক গিরীন্দ্রনাথ দাস ব্যবহার করেছেন।আমি নোতুন করে এই বানান লিখি নি।গিরীন্দ্রনাথের সংগ্রহ কে অনুসরণ করেছি মাত্র।
বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী তো মূলত উচ্চবর্গীয়। নিম্নবর্ণের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞা ছিল এবং এখনো আছে। আবার তাঁরা উদারনৈতিক মনোভাব ও পোষণ করেন। তাঁরা হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করেন। সুফিবাদ এঁদের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল মনে হয়। তাঁদের উচ্চবর্ন এই ক্ষেত্রে বাধা হইনি।
পরের কিস্তির অপেক্ষায়