পপলার গাছ এখানে আসবার আগে কখনও চোখে দেখেনি আন্নু।... সরু সরু ডালপালা আকাশের দিকে খাড়া হয়ে আছে যেন আঙুল তুলে গাছগুলো কাউকে অভিশাপ দিচ্ছে। ওদের পায়ের কাছে উজ্জ্বল সর্ষেখেত না থাকলে একদলা জমাট কান্নার মতো লাগত পপলার গাছগুলোকে।" (জল) গল্প শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই লেখকের এমন অসাধারণ চিত্রকল্প রচনায় পাঠককে মুগ্ধ হতেই হয়। গল্প একটু এগোতেই আন্নু, গাছেদের অভিশাপ আর একদলা জমাট কান্না একাকার হয়ে যায় কোথায় যেন। এমন উপমা-চিত্রকল্প খুব সহজ স্বচ্ছন্দভাবে এসেছে বারবার মাত্র ১০৫ পৃষ্ঠার সীমারেখা জুড়ে।
প্রকৃতিকে বারবার প্রতিভা ব্যবহার করেছেন অসামান্য তুলির টানে। "সূর্য ডুবছে, সবুজ, কমলা, লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ছে লঞ্চের নীচে পেষাই হওয়া ঢেউগুলোর গায়ে..."। ( জন্মান্তর) এমন নমুনা অঢেল।
বিষয় নির্বাচনের অভিনবত্বের চেয়ে অনেক বড় হল শিল্পীর দেখার চোখ, দৃষ্টিভঙ্গি। আর সেদিক থেকে প্রতিভা যথার্থই প্রতিভাধর। 'ফরিশতা' বিশেষত 'আত্মজা' যথার্থই ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। 'আত্মজা' যেকোন মানদণ্ডেই বিশ্ব সাহিত্যের তাবড় ছোটগল্পের প্রতিযোগী না হলেও সহযোগী তো বটেই।
বইটির বেশিরভাগ গল্পই নারীকেন্দ্রিক। কিন্তু প্রতিভার গল্প বারবার মনে করিয়ে দিতে পেরেছে যে তিনি শুধুই একজন 'লেখিকা' নন, লিঙ্গ-পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে তিনি এক শিল্পী, একজন মানুষ। সামাজিক ট্যাবু ছেড়ে যৌনতাকে যখন যেভাবে দরকার তখন সেভাবেই ব্যবহার করেছেন তিনি। সমাজমানসিক গঠনের কারণেই হয়তবা বহুক্ষেত্রে মহিলা গল্পকারেরা নারীর হৃদয়বৃত্তিজনিত সমস্যার আলোচনায় যতটা স্বচ্ছন্দ, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াসমূহকে প্রকাশ করতে কোথায় যেন রয়ে যায় একটু দ্বিধা। যেন দুনিয়ার সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ছে নিজেরই যৌনাঙ্গ। আর ঠিক এই সমাজমনেরই উর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন প্রতিভা।
প্রতিভা সরকারের গল্পের বিশ্লেষণ আমার উদ্দেশ্য নয়, তাঁর লেখনীর প্রতি মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধার অনুভূতি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যই এই লেখা। সেই মুগ্ধতা ভালোবাসায় পরিণত হয় শেষ গল্প 'মরণ'এ পৌঁছে। "আসলে মনটা বোধ হয় একটা গভীর কুয়োর মতোই।" কিছুই ঘটে না গোটা গল্প জুড়ে। জানিনা এ গল্প প্রতিভার ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলন কিনা-- মনে তো হয় তাইই। সত্যি বলতে কি, পরিবারে সমাজে সব থেকেও একলা কিংবা কিছু না থেকে একলা যেসব মানুষজন, যাঁদের একমাত্র পুঁজি ফেলে আসা দিনের স্মৃতি, অকারণ নোনা জল আর অজানার জন্য অপেক্ষা-- তাঁদের নিশ্চয়ই ছুঁয়ে যাবে এ গল্প। প্রতিভা যখন লেখেন, "ওকে বলি কি করে মায়ের জন্য যতটা, ততটাই আমি তো নিজের জন্যও কাঁদছি। আমার জন্য রুদালি ভাড়া করার দরকার হয়না যেন।" চল্লিশোর্ধ আমার সঙ্গে ঠিক এই মুহূর্তেই গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায় মাত্র দুদিন আগের অচেনা, অজানা প্রতিভার সঙ্গে, প্রতিভা সরকারের সঙ্গে।
সুকন্যার লেখা পড়ে লেখিকার গল্প পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে...