নটেন দিনকয়েক হল ব্যাপারটা নজর করছে বটে, কিন্তু আসলে হয়ত বছরটাক। কিংবা এক দশকও হতে পারে হয়ত। যখন কিছু একটা নজর করে দেখলে স্পষ্ট হয়, তার আগে লম্বা একটা সলতে ভুঁয়ে পড়ে থাকে।
নটেনের পিঠে একটা চিরস্থায়ী কার্বাঙ্কল। বাড়ে না, কমে না। প্রথমে ব্যথা ছিল। কোটাল পুন্নিমেতে কটকট করত। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মধু ডাক্তর বলেছিল, কার্বাঙ্কল নাকি মরণের আগাম সংকেত। ভয়ের কিছু নেই কিন্তু পৃথিবীর দিনরাত কমে আসছে, এ তার প্রাথমিক লক্ষণ।
দোক্তারসে ক্ষয়ে যাওয়া ধুঁধুলের বীজের মতো সব ক'টা দাঁত বার করে নটেন সেদিন হেসেছিল। বিষফোঁড়া দিগন্তের দিকে আঙুল দেখাতে পারে নাকি? আজব কথা বটে ! দিন কতক গঞ্জের তারা মা মেডিক্যালের হাবু কম্পাউন্ডারের দেওয়া অ্যান্টিব্যাকট্রিন তুলো দিয়ে লাগিয়ে রাখল। কষাটে রক্ত গড়াল রাতভর। বিছানার চাদরে লাল লাল পাপড়ির মতো ছোপ। কার্বাঙ্কল কিছু শুকিয়ে ঢিবি হয়ে রইল পিঠে। ক্রমে ক্রমে নটেন ভুলে গেছে তার পিঠের একদা।
সামবেড়িয়ার দক্ষিণ কোণায় সাঁপুইপাড়ার এককোণে নটেনের একচালা ঘরদালান। বাড়ির পিছনে লাগোয়া এক ছটাক জমিতে কলার গাছে কাঁদি ঝুলছে। কচু জঙ্গল।জমিজিরেত নেই। গোপাল সাহার দেড় বিঘে জমিতে ভাগচাষ করত একসময়। সেও প্রায় বছর আষ্টেক আগে। লতুন সরকার আসা ইস্তক গোপাল সাহা ঝটাকসে রঙ বদলে লতুন পার্টির চাষীকে জমি ভাগে দিয়ে দিয়েছে। এখন রেশনের চালে নটেনের পেট চলে। কলা বেচে দুচার টাকা আমদানি হয়। ডোবার পাড় ঘিরে তিনটে সোনামুখী ডাবগাছ। ডাব নারকোল বেচে দেয়। ডোকলা পাতা জ্বালনের কাজে লাগে।
নটেনে ডোবায় হরেক মাছের আখড়া এবং নটেনের নক্কিসতী রোগা হাবা বউ আরতি চার সন আগে ঘোর বর্ষার রাতে এমনি এমনি মরে গেছে। দুটো ছেলে কে কোথায় কাজেকম্মে পালিয়েছে নটেন জানে না। বড় ছেলে সত্যেন প্রথমে কলকেতা গিয়ে আর আসেনি। তিন চার বছর পর ছোট বটুক পশ্চিমে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে গিয়ে সেও আর বাপের খোঁজ নেয়নি। দুজন দ্বিতীয়বার ঘরের পথ মাড়ায়নি। বউয়ের কী একটা ব্যারাম হল, এক রাতে হাত-পা বেঁকে বেঁকে গোসাপের মতো। দু'দিন দু'রাত পার করে ভোর নাগাদ সে মরে যায়। তখন নটেন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল, জানতেও পারেনি। সকালে উঠে দেখে বউ অনেকটা শক্ত হয়ে গেছে।
কেন কে জানে নটেনের খুব কিছু শোক হয়নি। ডোবার পাড়ে একটা গাব গাছের বড়সড় চারটা পাঁচটা লগ কেটে বউকে দাহ করেছে। শ্রাদ্ধশান্তিতে শ্মশানযাত্রীদের তিন পদ রেঁধে খাইয়েছে। ডোবা থেকে ধরা রুইয়ের মাথা দিয়ে শাক ছ্যাঁচড়া, মাছের ঝোল আর চিংড়ি-চালতার ঝাল টক। শেষ পাতে বলিহারি যাই, নারকোল ফালি গুটিকয়। নটেন অবশ্য অভ্যাগতদের ঘটি থেকে নিজে হাতে জল ঢেলে হাত ধুইয়ে দিয়েছে। বিদায়কালে সবার জন্য জম্পেশ হুঁকোর সুখটান।
একটা শিরিষ গাছের ছায়ায় টালির চালার নিচে এখন নটেন স্বপ্নহীন ঘুমোয় জাগে কাশে, টেরি কাটে। রেডিওতে সন্ধেবেলা যাত্রাপালাগান শোনে। সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ শিরিষের ফাঁকে শুকতারা মুটুর মুটূর জ্বলতে শুরু করলে নটেনের রাত গভীর মনে হয়। কুপিটা রোজ ঘন্টাটাকের বেশি জ্বালে না। যা হোক দু'গাল খেয়ে, দু'টান তামুক টেনে, পাতনিটা ফটাস ফটাস ঝেড়ে শুয়ে পড়ে। সেদিনের নটেনের এইখানে আসন্ন সুষুপ্তি বটে, কিন্তু শোয়ার আগে দোর লাগানোর সময় ঘাটের দিকে এক পলক তাকালে কয়েকদিন যাবত তার কী একটা অস্বস্তি হচ্ছে, সে ঠিক ঠাহর পায় না।
নিঝুম দুপুরে নটেন ডোবার পাড়ে ছিপ ফেলে আলসে ঘুমিয়ে পড়ে। ডেঁয়ো পিঁপড়ে কামড়ালে ঘষে ঘষে মারে। একটি ডেঁয়ো পিঁপড়ে কোনো এক নিরালা দুপুরে নটেনের পিঠে ঢুকে রয়ে গেছে। সেই দুপুরে সে হয়ত প্রথম স্বপ্ন দেখেছিল, ডোবার ডুবন্ত জলে তার পিঠের দাগে গাঙতাড়া দীঘল ঠোঁট ঠুকরোচ্ছে। পুঁজ চেটে চেটে নিচ্ছে। মৃদু কিনকিনে ব্যথা। তা কি সত্যি কোনো ব্যথা নাকি কী একটা ভুতুড়ে অব্যক্ত, নাকি কোনো বিস্মৃতির মরা আঁশ, নটেন জানে না।
নটেনের আজকাল কিছু ভালোলাগে না। ভালোলাগা বলতে নটেন কী কী সব বিস্মৃত হয়। কিছু যেন চোখের আশেপাশে ছিল, আলবোলা লাগত বটে। কিছু যেন নেই অথচ কী নেই, নটেন অন্যমনস্ক। ভালোলাগা না-লাগার মাঝে সীমারেখা মুছে গেছে।
ফাৎনার ওপর শিরিষের শুকনো পাতা ঝরে ঢেকে দিলেও ছিপ নাড়িয়ে পাতা সরাতে তার ইচ্ছে করে না। কইছানা কেঁচোর টোপ খেয়ে পালায়। ধরা দেয় না। নটেন বিড়বিড়িয়ে গালও পাড়ে না আজকাল।
রোদ ঝিমিয়ে আসে হেমন্তের বাতাসে। সর সর সর সর হাওয়া লাগে ছায়াজলে। ঘাই খেয়ে জু প্লাঙ্কটনের বাদামী সর জলের আয়নায় পুনরায় জোড়া লেগে যায় আলগোছে। নটেনের কিছু ভালোলাগে না।
নটেনের শীত করে আসন্ন সন্ধ্যায়। ঘরের দিকে হেঁটে আসতে আসতে পিঠে হাত বেড় করে বোলায়। এই হাত বোলানোটা নটেন দিনকয়েক নজর করেছে। অজান্তে হাত চলে যায় পিঠে। নটেনের ইচ্ছে করে খেজুরকাঁটা দিয়ে ঢিবিটা গেলে দিতে। ভিতরে কী আছে? কী রেখেছিল একদা? এখন কী?
বেড়ার আগল খুলে উঠোনে এলে নটেনের আদুরে মধ্যবয়সের শীত অনাদর যাচ্ঞা করে নাছোড় দাগে। একা রাখো আমাকে। একাই রাখো অনাদরে। আমাকে ডোবার পাড়ে ফের গিয়ে শুকনো মুথাঘাসে শুইয়ে রাখো। আমি একা একা কথা বলতে শিখে গেছি। সবার পিঠেই দ্যাখো একটা করে ঢিবি জন্মায় দীর্ঘ অববাহিকায়। তাকে অনাদর দিতে হয়। অবহেলে পশ্চিমের মরা রোদদুরে সে সঙ্গ বর্ণনা করে একটানা সুরে।
নটেন এককালে খুব খেউড়গান শুনতে যেত এদিক ওদিক। ডোবার চারদিকে ঘুরে ঘুরে পায়ে মল পরে কারা যেন এখন অকথা কুকথার খেউড় গাইছে কীর্তনাঙ্গে। নটেন কতক টলমল করে দাওয়ায় বসে। ছায়া ছায়া সিল্যুয়েটে ডোবার জল ছেড়ে উঠে পোষা মাছগুলো নিরাবয়বে ঘুরে ঘুরে নাচে, ক্লান্ত মাথুর গায় হাত পা ছড়িয়ে। নটেনের মাথা টলমল করে। মৌজ করে একটা বিড়ি ধরালে বেশ হয় যেন।
নটেনের হঠাৎ মনে পড়ে গেল সে বহুকাল হল কাঁদেনি। নয়নে নয়নপাতে কিঞ্চিত নুন গেঁথে থাকা জরুরী, মৃত্যু পর্যন্ত ঠিকঠাক হেঁটে যেতে। গাছগাছালির মধ্যে সন্ধ্যার আবছায়া ঘন হয়েছে। শিরিষের পাতার ফাঁকে ফাঁকে হীরের কুচি আকাশে চিক চিক। নটেন অন্ধকারে দেশলাই হাতড়াচ্ছে আলো জ্বালবে বলে।
নটেন দোরের পাশে দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখা কৌটো থেকে দেশলাই বার করে। দেশলাই বড়ো সেঁতড়ে যায়। কৌটোতে রাখলে তেজাল থাকো। কুপি খুঁজে পায় না। বাইরের দালানে এসে কুপিতে আলো ধরিয়ে দেখে বাঁশের খুঁটির গায়ে কে একজন যেন হেলান দিয়ে বসে আছে। নটেন ঈষৎ চমকে ওঠে।
কুপি তুলে ধরে মুখের কাছে। ন্যাড়া মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। কোটরগত চোখ বন্ধ। চেনা চেনা কেউ যেন। মাথা ঈষৎ হেলে পড়েছে। চোখে কুপির আলো পড়তে মানুষটা ধীরে অল্প চোখ খোলে।
"তুমি কে গা বাপ?"
আগন্তুক চুপ। নটেন কাঁপতে থাকে। খুব কাঁপতে কাঁপতে হাঁফায়। নটেনের চোখে চালশে হলেও দৃষ্টি খুব কমজোরিও নয়। মুখের কাছে কুপি নিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। চেনা চেনা লাগে যেন।
"সত্যেন? সতু না? এ কে? সতুই তো!"
নটেনের জিজ্ঞাসায় মনুষ্য দেহটি নীরব।
"সতু? তোর এ কী শরীর হইছে? তোরে চিনতি পারতিছি না তো। কোথায় ছিলি এত্তাদিন?"
ধীরে ধীরে কুপির আলোয় প্রতিভাত হয় সত্যেন। জিরন শিরন কাঁটাসার দেহ। পরণে দু তিন জায়গায় ছেঁড়া হাতা-খোলা শার্ট। মলিন প্যান্ট। পায়ে জুতো নেই। সবচেয়ে ধক করে চোখে লাগে যেটা, ভূতের মতন সাদা মুখে কোটরগত দুটো চোখ ফটকিরির মতো। চোখের ভুরু নেই। মাথা রূহহীন। মড়ার খুলির মতোই প্রায়।
সত্যেন মুখের কাছে হাত নিয়ে কিছু খাবারের ইশারা করে যেন।
এই সব বৃত্তান্তে নটেনের চেতনা হারিয়ে যায়নি। বহুকাল সে শকড্ হয়নি। শরীরের স্নায়ু থেকে চমকের তীব্রতা হারিয়ে গিয়েছে অনেককাল। কঙ্কালসার ভুতুড়ে বড় ছেলেকে দেখে তার চেতনা এলোমেলো হয়েছে মাত্র। সে সত্যেনের ইশারা প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারেনি।
"কী?"
সত্যেন হাতে গরাস তোলার মুদ্রা দেখায়।
এবার নটেন উঠে দাঁড়ায় নীরবে। তাকে কী করতে হবে ভাবার চেষ্টা করে। ঘরের ভিতরে গিয়ে পুরোনো আরেকটা ভাঙা জঙধরা কুপিতে তেল ভরে জ্বালায়। ওবেলার ভাতে জল ঢালা আছে। কড়াইতে ছিপে-ধরা গোটা দশেক পুঁটি মাছ ভাজা পড়ে রয়েছে। কলমিশাক কাঁচা রয়ে গেছে। সেদ্ধ করা হয়নি।
নটেন একটা কানা-উঁচু থালা জল দিয়ে ধুয়ে জল ছেঁকে নিংড়ে তাতে ভাত বাড়ে। কড়াই থেকে সব ক'টা মাছ নেয়। পাতের পাশে নুন দিয়ে কুপি ধরে দালানে এসে দেখে সত্যেন মাটিতে শুয়ে পড়েছে।
নটেন মাটিতে থালা রেখে সত্যেনকে ঠেলে বসায়।
"খা সতু। ভাত ক'টা মাছ দিয়ে খেয়ে লে।"
পাতের পাশে নুন পড়ে থাকে। সত্যেন মাছের সঙ্গে ভাতের দু তিন গরাস মুখে ঠুসে দিয়ে বার কতক চিবোয়। জল চায়। নটেন জল এনে দিলে ঢক ঢক জল খায় এবং দমকে দমকে হড় হড় করে বমি করতে থাকে, করতে থাকে পাতের ওপর, মাটির ওপর নিজের ওপর। মাটির দাওয়া বমির রস সঙ্গে সঙ্গে শুঁষে নিলে স্পষ্ট হয় আধচিবোনো ভাত, বোধহয় ভ্যাদভেদে পাঁউরুটি জাতীয় কিছু, মাংসের ছেঁড়া ফাইবার, ডালের হলদে রস। সত্যেন বমির দমকে নেতিয়ে পড়ে। তার চোখ দুটো কোটর থেকে ফেটে ফুটে ছেতরে ছিটকে উঠছে।
নটেন হাঁ করে বড়ো ছেলেকে দেখতে থাকে, দেখতে থাকে নির্নিমেষ। সে একবার ভাবল বাকি ভাত ক'টি কি সত্যেনকে খাইবে দেবে? ফের ভাবে থাক, ভাতটা ঢাকা দিয়ে এখন ছেলেকে খাটে শুইয়ে দেবে? সত্যেন কি অসুস্থ? নাকি ক্ষুধায় মুমূর্ষুপ্রায়? সত্যেনের ওয়াক ওয়াক স্তিমিত হয়েছে। সাপের নিশ্বাসের মতো ফ্যাঁসফেসে শব্দ বেরোচ্ছে এখন মুখ দিয়ে।
নটেন কুপি তুলে ধরে সত্যেনের মুখের কাছে ধরতে গেলে তেল ফুরিয়ে যাওয়া কুপির শিখার টুপ করে নিভে-যাওয়া নিপূণ অন্ধকার। ঘরের ভেতরের কুপিটির আলোয় মাটির দেয়ালে আবছা দেখা যাচ্ছে সত্যেনের মা আরতি মরার পর কাগজের ওপর নটেনের নেওয়া পদতলের আলতার জোড়াছাপের ফটো।
আধো আলোয় অন্ধকারে দূর থেকে প্রাচীন মথের মতো দেওয়ালে সে পদচিহ্ন। লাফিয়ে পড়বে যেন মাটিতে। এই সময় অকস্মাৎ নটেনের ঘাড়ের ওপর কেউ যেন লাফিয়েই পড়ে। হঠাৎ ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে নটেন দাওয়া থেকে উঠোনে পড়ে গেলে কেউ তার শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে ঝাঁকিয়ে ধামসে অনন্তযোজন বিস্তৃত স্বরে হিস হিস করে। কাঁদেও যেন। কামড়ায় আঁচড়ায় দাপায়। নটেনের বাহুতে কারা সব হুল বিঁধিয়ে দেয়। ধস্তাধস্তিতে নটেন সংজ্ঞা হারালে এখন সাঁপুইপাড়া জুড়ে নিশ্চিদ্র নিশ্চিন্ত অন্ধকার।
শিরিষের ডালে ঘুমভাঙা লক্ষ্মীপেঁচা রাতের প্রথম দীঘল চোখ মেলল।
চারদিন পরের সকাল। সারারাতের হিমে দাওয়া ভিজে ভিজে। তখনও পুবের রোদ উঠোনে আসেনি। সত্যেনকে জড়িয়ে বগলের নিচে হাত বেড় করে নটেন বাইরে নিয়ে আসে। দাওয়ায় একটা শীতলপাটি পেতে সত্যেনকে বসায়।
এই সময় তিন চারটে শালিখ পিঠে রোদ নিয়ে উঠোনে টুক টুক হেঁটে হেঁটে দানা খোঁটে। সত্যেনকে তারা মাঝে মাঝে গলা তুলে দেখে। ঘাসের ভিতর ঢুকে যেতে যেতে তারা নীরবতা ভেঙে কিচির কিচির ডেকে উঠলে সত্যেন কেঁদে ওঠে।
"বাহ্যি করবিনি সতু?"
সত্যেন মাথা নাড়ে। হ্যাঁ বা না, দুরকম হতে পারে।
"একলা পারবি যেতে? নালায় জল নেই। ওখনে বসতে পারবি তো?"
নটেন জল-ভরা গাড়ু আনে। সত্যেনকে পাটি থেকে তুলে ঘরের পিছন দিকে কচু জঙ্গলের পেরিয়ে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে নালার পাড়ে বসিয়ে দেয়। পাশে গাড়ু রেখে বলে, "হয়ে গেলে ডাকবি সতু।"
ফিরে যেতে যেতে তিন চারটে কচুগাছ উপড়ে নেয়। শেকড়ের মাটি ঝাড়ে। খেপলা জাল ফেলে দশ বারোটা বেলে মাছ ধরেছিল। ওই দিয়ে আজ ঝোল হোক।
ঝপ করে একটা শব্দ। নটেন চকিতে পিছু ফিরে দেখে সত্যেন নেই। দৌড়ে এলে দেখে সত্যেন নালায় গড়িয়ে পড়েছে। হাতে পাছায় পুরীষ মাখামাখি। গোঁ গোঁ করছে। নটেন শরীরে সব বল জড়ো করে সত্যেনকে হিঁচড়ে পিঁছড়ে নালা থেকে তোলে। তার গায়ে পুরীষ লেপটে যায়। ধরে ধরে ডোবার ঘাটে এনে উলঙ্গপ্রায় চব্বিশ বর্ষীয় সত্যেনকে বসায়। জল ঢেলে ঢেলে সাফা করে। সেই শালিখগুলো ডোবার পাড়ে পোকা খুঁজে পাবে ভেবে এখানে শোরগোল করে।
ঘাট বলতে গাছের মোটা দুটি গুঁড়ি একটু উপরে নিচে রেখে খুঁটি পোঁতা। একটি তার আধজলে। গেঁড়ি গুগলি শ্যাওলা গায়ে কালচে সবুজ। তার ওপরে একটি মানব শরীর স্থির মূর্তিবৎ। অন্য দেহটি কোমর অবধি জলে নেমে কর্মরত। ঘাটের পাশে কাঁটা ট্যাংরা, চারা রুই মৃগেল জড়ো হয়েছে ভাতের লোভে। তারা নটেনকে বিরক্ত করলে নটেন গাল পাড়ে।
"আঃ শালাগুলো জ্বালাইল দেখছি!"
সত্যেনের মাথা মোছায় রয়ে সয়ে। গামছা পরায়। হেঁচড়ে পেঁচড়ে ধরে তুলে ঘরের দিকে মুখ ফেরালে দেখে পাড়ে একটি ঘুমচোখের যুবক। লুঙ্গি পরা, খোলা গা। বেশ গাট্টাগোট্টা। বয়স সত্যেনের মতোই হবে।
যুবকটির নাম সন্তোষ। সে বড়ো হাঁ করে সকালের আদুরে হাই তোলে।
নটেন বারুই বহুদিন কাঁদেনি। কান্নার কোনো উপকরণ ছিল না। হয়ত উদাসীনতার নানা উপাদান ছড়ানো ছিল ঘরদুয়ারে পুকুরঘাটে। টালির চালার নিচে একরৈখিক দিনগত ছিল। নটেনের এখন কিছু কিছু জরুরী পলাতক চারপাশে ঘোরাফেরা করে বলে নটেন এখন শরীরে কিঞ্চিত বলধর্মী কিছু খুঁজে পেয়েছে।
নটেন ডোবায় খেপলা জাল ফেলছিল। পাড়ে সত্যেন বসে থেকেছে। সন্তোষকে জাল মাড়াতে বলেছিল নটেন।
"চারধার জালের ঘাই পায়ে ভালো করে মাড়িয়ে দে সন্তোষ। মাছ আছে মনে লয়। একটা দুটো ভেটকি ছানা গত বানে ভেসে এসে ঢুকেছে। ছোট মাছগুলা সব সাবাড় করে দিচ্ছে। ওইটা আছে মনে লিচ্ছে।"
সন্তোষ উৎসাহে ডুবে ডুবে পাঁকে জালের ঘাই দেবে দিয়েছে।
"আছে কাকা? আছে মনে হয়। পায়ে ঠেকল যেন। ঝাপটা মারল।"
"পায়ে ঠেকল? কী বলেছি? আরে বাপ এ মুরুব্বির আন্দাজ।"
সন্তোষ হা হা হাসে। জলে কুলকুচি ছোঁড়ে। নটেন জালের দড়ি গুটোয়। পাড়ে সত্যেন ফ্যাকাসে চোখে সে সব দেখে। জালে এক সেরি ভেটকি উঠেছে। তিনটি মানুষ হৈ হৈ করে ওঠে। সত্যেনকে নটেন দেখে। সত্যেনের চোখে কী যেন এক রূপালি আলো ফুটি ফুটি করে মাছের আঁশের মতো। সন্তোষ ঘুঁটের ছাই আনে। বঁটিতে মাছ কাটা হয়। ঝুড়িতে কচলে কচলে জলে ধুলে রুপোর মাংস উজ্জ্বল। সেই সব উজ্জ্বলতায় চড়ুইভাতিতে মশগুল প্রাণগুলি।
উনুনের ঝিঁকে-ত্রয়ীতে নতুন গোবরের জল লেপে চকচকে। কড়াইতে চোঁ চোঁ করে মাছ ভাজার গন্ধ। মশলার সাঁতলানোর গন্ধ। ভাতের নবীন গন্ধ। সন্তোষ উঠোনের লংকাগাছ থেকে ফটাফট আট দশটা নধর কাঁচালংকা ছিঁড়ে আনে।
তিনটি মানুষ মাটিতে আসন পেতে দুপুরে খেতে বসেছে। জলে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে সন্তোষের সফেন ক্ষুধা। সে হাপুস হুপুস তৃপ্তিতে আঙুল চেটে ভাতে আরো ঝোল মাখায়। সত্যেন দু গাল খেয়ে বমি করে। আসনেই শুয়ে পড়লে নটেন নিজে খেয়ে হাত ধুয়ে ছেলের গা মুছিয়ে দেয়।
বিকেল গড়িয়ে আসছে। সন্তোষ ঘরের ভেতরে জলচৌকিতে ভাতঘুমে। নটেন ছেলেকে ডোবার পাড়ে শীতলপাটিতে গাছের ছায়ায় শুইয়ে নির্লোম করোটিতে হাত বোলাতে থাকে, বুকে পাঁজরে কান পেতে আয়ু নিরীক্ষণ করে। ডুক ডুক ডুক ডুক। এখন সিস্টোলিক ডায়াস্টোলিক কামরাঙা গাছের পাতার আড়ালে কুবো পাখি কুব কুব কুব কুব ডাকের সঙ্গে সিঙ্ক্রোনাইজড্। জলে রোদের হলুদ ছায়া পড়েছে। মাছেরা ঘাই দেয়। পাঁকের পচা বুড়বুড়ি উর্ধে জলতলে এসে ফেটে গেলে ঝরা পাতা সে সব ছোট ছোট তরঙ্গে তরঙ্গে নাচে।
নটেন ছেলেকে ঘটি থেকে জল খাওয়ায়। রোদ মরে এলে পাতনি গায়ে দিয়ে দুজন শীতলপাটিতে জড়িয়ে শুয়ে হয়ত ঘুমোয়। কিংবা ঘুমোবার মতো নিশ্চুপে পড়ে থাকে।
"বাবা, আমি বাঁচবনি?"
"ধুর বাপ, ঠিক বাঁচবি।"
"না বাবা। মা চলে গেছে। আমিও এবার যাব। আমার মরাই ভালো।"
"কপালের ভোগান্তি যা, গেলে ঠিক সেরে উঠবি।"
"টাকাপয়সা আর নাই। ওষুধ ডাকতরে সব শেষ করে ফেলিছি।"
"তুই সবরে যা দিকিনি। হাওয়া বাতাস জল পেলে ও এমনি এমনি সেরে যাবে। এ সব শহরের কালি। দুদিনে ধুয়ে গেলে গত্তি পাবি।"
সত্যেন অবসন্ন হাসে।
নটেনের পিঠে দোসর। কার্বাঙ্কলে কে যেন নড়ে চড়ে কৌটোর ভেতরে কড়ি। উসখুস করে নটেন। পাতনির নিচে দুটি দেহ পরষ্পরের যতটুকু উদ্বৃত্ত কিংবা অভাব, বিনিময় করে বদ্ধ ওমে। নটেন বহুকাল কাঁদেনি। নয়নে নয়নে কিঞ্চিত নুন থাকা জরুরী বলে নটেনের এখন যেন কান্না পায়। নটেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। নটেনের যেন মনে হয় সে ক্রমশ বেঁচে উঠছে সত্যেনের আয়ু নিয়ে। বাপ ছেলের আয়ু শুঁষে নিয়ে অশ্রুতে লুকিয়ে জমা করে চোখের অন্দরে।
ছায়া ঘন হলে শীতলপাটি গুটিয়ে সত্যেনকে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে এলে সন্তোষ তেল দিয়ে মুড়ি মাখে। কাঁচালঙ্কা কচড় কচড় করে চিবিয়ে হুস হাস খায়। নটেনের সাধ হয় আরো ক'টা মুড়ি নিয়ে বেশ করে খায়। সত্যেন বমি করে। নটেন মুড়ির থালা খালি করে হুঁকো ধরায় আর ছেলের পরিচর্যা করে। আর দুদিন গেলে মাটির খোলায় কেজি দুয়েক চালের মুড়ি ভেজে রাখবে ভাবে।
"না যদি হারিয়ে যেতিস বাপ, আমার যা হোক ক্ষুদকুঁড়োয় ঠিক বেঁচে থাকতিস সতু রে। শহরের কালে ধরেছে তোকে। আর যাবিনি। আমি ঠিক তোকে বাঁচিয়ে রাখব।" নটেন ছেলের মাথায় হাত বোলায়। মাথার খুলিতে চুমু খায়।
আসলে নটেন যেন নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া। তার কী যেন একটা দুঃখের মতো কিছু, বা, অনুভূতির তীক্ষ্ম কাঁটা ছিল না। মাছ ছিল। আঁশটে গন্ধ ছিল না। কচুশাক ছিল। ঝালে পোড়া নিদারুণ ছিল না। হুঁকো ছিল, বাস ছিল না। হলই বা নবীন অশ্রু! মৃত্যু পর্যন্ত হেঁটে যেতে দুঃখও পুলকের মতো জরুরী বৈকি!
শিরিষের ডালপালা থেকে সন্ধ্যা নেমেছে নটেনের চার ছটাক বাস্তুতে। নটেন দূর থেকে ডোবার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে কিছু নাই। কেউ নাই। ছায়ামূর্তি গুলান কেউ নাই। কেউ নাকি সুরে জানান দেয় না। আঁধারে চাঁদ উঠেছে বাঁশঝাড়ের আড়ে। নুতন সুন্দর চাঁদ। বউ অনেককাল মরে গেছে বলে আজ যেন জোছনা পড়বে উঠোনে। তার সতুর মুখের উপর, খুলির উপর, দেহের উপর।
সত্যেন ক্লাস এইটে পড়তে পড়তে সামবেড়িয়া ছেড়ে পালায়। গাঁয়ের চারটি কিশোর কলকাতা যায়। শহরের রোশনাই তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। একে একে কাজ জুটে গিয়েছে সবার। সত্যেন ডালহৌসির আপিসপাড়ার ফুটপাতের হোটেলে রাঁধত, থালা বাসন ধুত। উড়িয়া মালিকের হোটেলেই থাকত শুত। বছর চারেকের কাজ। তারপর পার্ক সার্কাসের একটি মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই একটা চালাঘর ভাড়া নিয়ে সংসার পাতে।
থেকে থেকে বমি হত সত্যেনের। মাথা ঘুরত। চোখে কদাচিৎ আঁধার। একসময় কাজ চলে যায়। চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের আউটডোরে কিউনিতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। রেডিয়েশন চলে। দুটো কেমোর পর টাকাকড়ি ফুরোলে বউ অন্য কারুর সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
সন্তোষ ডালহৌসিতে ক্লাইভ স্ট্রিটের ফুটপাতে চায়ের দোকানে কাজ করত। সত্যেনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ছিল। সত্যেন খেপে খেপে হাজার পাঁচেক টাকা ধার নিয়েছিল। শোধের কোনো উপায় তার আর ছিল না।
সত্যেন পালাবার মনস্থ করে। কোথায় যাবে বা কার কাছে থাকবে? শরীর রাজরোগে কুরে কুরে ঝাঁঝরা। সন্তোষ টাকার তাগাদা দেয় প্রায়শ। মারের হুমকি দেয়। সত্যেন কোনো এক অসাবধানী মুহূর্তে তাকে বাড়ি ফেরার কথা বলেছিল।
সত্যেন যেদিন কলকাতা ছাড়ে ধর্মতলার বাসস্ট্যান্ড থেকে সন্তোষ তার পিছু নিয়েছে। নামখানার বাসের টিকিট অবধি কাটতে দেখেছে। কিন্তু লাইনের ভিড়ে গোলমালে সত্যেনকে আর দেখতে পায়নি। সত্যেনের বাসের পরের বাসে সে চাপে। সামবেড়িয়ার নাম সত্যেনের মুখে শুনেছে। কোনো একটা বনবিবির মন্দিরের একটু দূরে নাকি তার বাড়ি।
সত্যেনের বাড়ি খুঁজে পেতে কিছু হয়রানি। কুপি নিভে গেলে দুটি মানবদেহকে আঁধারে সে ঠাহর করেছিল। অন্দরের ক্ষোভ খিদে ক্লান্তিতে সন্তোষ আকস্মিক পূর্বাপর ভুলে আকণ্ঠ ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাওয়ার একটি শরীরে। সে শরীর নটেনের। সত্যেনও ঝটিতি পাল্টা ঝাঁপায় সন্তোষের ওপর। সন্তোষ কামড়ে দেয় কাউকে। নটেন কামড় খেয়েছে। বুকের ওপরে একটি ঘুঁষি পড়তে সে সংজ্ঞা হারায়।
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হলে ক্রমে সন্তোষের ক্রোধ প্রশমিত। তখন পরিপার্শ্ব নজরে আসে। একটি অসহায় রুগ্ন দেহ এবং একটি আধবুড়ো বাপ। তার নিজের বাপ নেই বলে সে এইসময় হাঁটুতে মাথা রেখে অবিরল কাঁদে। নটেন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে তিনজনের জন্য রাতের ভাত তরকারি রেঁধেছিল। কুপির আলোয় সন্তোষ সেদিন চারটি বেশি ভাত খেয়ে ফেলে। যেন বহুকাল সে ভাতই খায়নি। সত্যেন বমি করলে দুজনে সাফ করে। নটেনের কৌটো থেকে একটা বিড়ি চুরি করে উঠোনে ধরায়। বাইরে তখন নিশুতি বহমান। গাছগাছালি ভেদ করে শান্ত বাতাস এসে কপাল ছুঁলে তার বড়ো আরাম বোধ হয়। ঘুম পায় পোড়া চোখে। একটা শীতলপাটিতে সে রাতে সে প্রথম নিশ্ছিদ্র ঘুম ঘুমিয়েছিল।
এখন চাঁদ বাঁশঝাড়ের মাথা ডিঙিয়ে শিরিষের পাতা গলে নেমে নটেনের চিলতে উঠোনের ভুঁয়ে ক্রীড়ারত। উনুনের পাশে কুপির আলোটি আজ বেশি উজ্জ্বল। কাঠকুটা পাতাপুতা ফুট ফুট শব্দে শিখায় উচাটন। নটেন বলে বলে দিচ্ছে। সন্তোষ খুন্তি নাড়ছে। সত্যেন চৌকিতে শুয়ে আলোর দিকে পতঙ্গের মতন। আজ কাঁকড়ার ঝোল আর ভাত। থালায় ডোবার সাতটা কেলে কাঁকড়া নুন হলুদে মাখানো। শেষ হেমন্তের হিমে ঘাটের ধারে ভাত খুঁটে খেতে আসে ওরা। নটেন কাঁটা পেতে ধরেছে। ওদের শরীরে এখন বর্ষাজলের ক্ষীরগতরমাংস।
এখন তবে ভাতের গন্ধ ব্যপ্ত। পেঁয়াজের গন্ধ মিশেছে তাতে। সন্তোষের জিভ সড়সড় করে। নটেন সন্তোষকে আড়চোখে দেখে। সন্তোষ কাঁকড়ার থালা থেকে মুখ তুলে নটেনকে দেখে অপলকে। সে চোখে নতুন চাঁদের পক্ষ। চোখে চোখে জোছনাসাঁঝের সাঁকো।
"কাকা, আমি আর ফিরে যাবনি। তুমি আমাকে রাখবে?"
সত্যেন তাই শুনে অন্ধকারে মৃদু হাসল। তার হাসিটা কেউ খেয়ালই করেনি।