'শাকান্ন' শব্দটা মধুময় ধূলিমাখা নিপাট পার্থিব শব্দ। একটু ছাপোষা যেন, অথবা সহজিয়া।
শাক-ভাত আমার প্রিয় আহার এবং আক্ষরিক অর্থে আমি শুধু শাক দিয়ে পরিতৃপ্ত থাকতে পারি ভোজনে।
চোদ্দশাকের দিনটি স্বভাবতই আমার কাছে একটি পার্বণ। এইদিন শুধু শাক নামভূমিকায় থাকে না হয়ত, তবু বাঙালির শাক-ভাতের আনুষ্ঠানিক দিন।
আমি পুঁইশাকের প্রতি অবেসসড্। আমাদের বাড়ির চারতলার ছাদ থেকে লম্বিত ঝুলন্ত পুঁইলতা দেখে আমার ভারি পুলক জাগে। আমি পুঁইমাচার স্বপ্ন পৌনঃপুনিকভাবে দেখি, দেখি যে কচি সবুজ পুঁইব্যাপ্ত মাঠে আমি শুয়ে আছি, আমার বুকে পেটে মুখে পুঁইলতা দুলে দুলে সোহাগ করছে। আর যেহেতু ব্যাপ্ত সবুজের প্রান্তর, তাই সবুজ যেন ভেজা কাগজে জলরঙের মতো বাধাহীন। এই স্বপ্ন আমি আগে দেখেছি, এখনও দেখি।
কুচো চিংড়ি সহযোগে পুঁইশাক আর মিঠে চালের ভাত, এই যুগলবন্দি অমৃতস্য পুত্রাঃ। পুঁইডাঁটার ঝোল খেয়েছেন কি? তেলাপিয়া মাছ দিয়ে কচুমুখী দিয়ে সে এক দিব্য স্বাদের ঝোল হয়। পুঁইডাঁটার আচার হয়, খেয়ে দেখতে পারেন।
যারা একটু ঝাল পছন্দ করেন তাদের জন্য আমার নিজস্ব একটি রেসিপি দিই। এর সঙ্গে উড়িষ্যার কিছু যোগ রয়েছে। বাকিটা আমার ইম্প্রোভাইজেশন।
পুঁইডাঁটা কেটে নিন। চালতা কেটে নিন। সর্ষে কাঁচালংকা বেটে নিন। তেল গরম হলে সব কিছু একসঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ সাঁতলে, চিনি দিয়ে জল দিয়ে সেদ্ধ করুন। সঙ্গে কুচো চিংড়ি হলে সোনায় সোহাগা। গরম ভাতে খান।
রবীন্দ্রনাথের রামকানাইয়ের সারল্য মনে আছে তো? তার দাদা গুরুচরণের মৃত্যুকালে তার স্ত্রী এক পায়ের ওপর বসে দ্বিতীয় পায়ের হাঁটু চিবুক পর্যন্ত উঁচু করে কাঁচা তেঁতুলের ডাঁটা চচ্চড়ি দিয়ে মনোযোগ সহকারে দুপুরের পান্তাভাতের আহার সারছিল। এতে ওইরকম স্বাদ পেতে পারেন।
শ্যামবাংলা ছেয়ে আছে কত কত রকম শাকে। বাঙালি অধিকাংশই পাতে তুলে নিয়েছে এবং তাদের বাহারি আদুরে নামও দিয়েছে। নটে, ঘেঁটু, হাতি, কালকাসুন্দা এসব রয়েছে। রয়েছে মুলো, কচু, পালং, বেথো, মেথি, লাল নটে, হিংচে, গিমে, সর্ষে, ছোলা, মটর, খারকোল ইত্যাদি। আলুর গাছটি শাক হিসেবে খাই। পাট গাছের পাতা পাট শাক হিসেবে খাই।
আমি অধিকাংশই খেয়েছি। শাক ছাড়া ভাত যেন সিঁদুরহীন এয়োতিবিলাস লাগে। যে বাড়িতে যারা শুরুর পাতে আমাকে শাক দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন, তাদের আমি মনে মনে শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিয়েছি। বেঁচে থাকুন সুখে থাকুন আবাদী থাকুন তারা।
বিভূতিভূষণের পুঁইমাচা চিরকালীন একটি গল্প, যেখানে গরীবের লোভী কিশোরী মেয়ে পুঁইশাক পেলে চাট্টি বেশি ভাত খেত। সেই কিশোরী বিয়ের পরে আতুঁড়ে অকালে মারা যায়। তার মৃতসংবাদ পেয়ে মা দেখছেন বৃষ্টির নবধারাজলে কচি পুঁইয়ের ডগা মাচায় ঝিলমিল করে উঠেছে। সেই কিশোরীর সব নোলা নিয়ে অনন্তকাল ঐ সব পুঁইডগারা দুলবে কোনো না কোনো মাচায়।
তো,শাকান্নের গল্প বলি কিছু মিছু।
শাক হিসেবে বিবেচিত হয় না, অথচ শাকের মতো রেঁধে খাওয়া হয়, এমনও তো হয়।
যেমন ধরা যাক, পেঁপে গাছের নরম ডগা। পাতা সমেত কেবল নুন হলুদে সেদ্ধ করে খেতে দেখেছি। খুব উপাদেয়। বা ধরুন, তেঁতুল গাছের কচি ফুলপাতার চচ্চড়ি, অল্প সর্ষে দিয়ে। সে তো অমৃততুল্য। অমৃততুল্য তো বললাম। অমৃতের স্বাদ কি কেউ জানি? আসলে স্বাদ একটা মানসিক ঘরানা। সেই ঘরানা অনেকটা লম্বা ছোট ছোট পুঁতির মতো স্মৃতির গাঁথা মালার মতো গলায় দোলে। অনুষঙ্গ, উপাদান, স্মৃতি মিলে তার কারিগরি।
তাই গল্পগাছা হোক।
কালবোশেখি হয়ে গিয়েছিল গত বিকেলে। তছনছ হয়ে গিয়েছে গাছপালা আনাজের ক্ষেত কলাবাগান পুকুরপাড় ঘরবাড়ি গেরস্থি । ঘরবাড়ি বলতে অধিকাংশই খড়ের চালা, মাঝে সাঝে টালির চাল। সেগুলো কোনোটিই যথাযথ নেই। আর ছিল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অট্টালিকা। বিগতকালের জমিদারবাবুদের। আর সেটিই ছিল আমার জন্মদেহলি।
তখনও সামন্ততন্ত্রের ঘন ছায়া, যেটি এখন ছদ্মবেশী চোরাবালি, তখন প্রকট প্রকাশ্য। ব্রিটিশ-উত্তর ঔপনিবেশিকতার ঝুটা কড়ির সাজের জ্যালজেলে চিকনাই।
তখন বামফ্রন্টের অজস্র ভুলভ্রান্তির মাঝে একটিই কাজের কাজ শুরু হচ্ছে। আমাদের মত কিছু জরদ্গব রাঘব বোয়াল ভূস্বামীদের ভূমি কেড়ে পাট্টা বর্গা বিলির শুরুর দশক। আমার শৈশবের সকালবেলা। আমার সেই সকালগুলোতে ক্ষুদ্র চাষিটি তার নিজের আপ্রাণ আবাদির ওপর ধীরে ধীরে নিজের পা রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে।
এমন দিনের ঝড়ে এলোমেলো একটি সকাল। ঝকঝকে রোদ্দুরে লোকজন ঘরের চালা মেরামতির কাজে নেমেছে। হৈ চৈ আয়োজন।
দড়িটা বাতায় কষে বাঁধবি বরেন, খুলে না যেন।
আর এক কিলো বাবুই লাগবে ছোড়দা।
এইবার ঝড় আসতে দে, বট গাছ উড়ি যাবে, চালা যাবেনি।
আমার এক অতি দরিদ্র দোসর ছিল। নাম রঞ্জন পরামাণিক। তার বাবা নাচিন্দা বাজারের ফুটপাথে ইঁট পেতে ক্ষৌরকর্ম করতেন। আর আমাদেরই এক চিলতে জমিতে ভাগচাষ করে সারাবছরের চাল কোনোক্রমে জোগাড় করতেন। তাঁদের ভরা-ঘর অনটন। রঞ্জনের হাসিটি শুধু কোটি টাকার।
আমার মা আমাকে বলেছিলেন, বাবাকে ভেবো দেউলিয়া। বাপের একটি কানাকড়ির দিকে তাকিও না, তোমার বাপের মতো। নিজে যা পার করে দেখাও। নিজেকে মনে করবে অনাথ।
ফলত আমি রাস্তার মানুষ। আমার গর্ভধারিণীর ওপর আমার প্রগাঢ় মায়া এ কারণে যে, আমাকে ঠিক সময়ে ঘরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। নইলে এ জীবন এ ধরিত্রী এ জার্নি বেরঙ হয়ে থাকত। এই যে আমার ভুবন এত বিচিত্রিত রসে রভসে পথের হর্ষ অশ্রুতে টই টই টম্বুর টম্বুর, সে কেবল আমার জননীর দান।
কালবোশেখির পরের দিনের কথা হচ্ছে।
ঠাকুমা আমাকে ডেকে বললেন, একবার দেখ তো রঞ্জনদের কী অবস্থা। এক ছড়া কলা দিলেন আমাকে। এটা দিয়ে দেখে আয় ওদের।
পাশের গ্রামে রঞ্জনদের খড়ের চালার ঘর। গৃহমুখে মাথা অনেকখানি নিচু করে ঢুকতে হয়। নইলে কপালে আলু!
আমি বাবুর বাড়ির ছেলে। তটব্যস্ত রঞ্জনের শীর্ণকায় অপুষ্টির মা। আমার হাতের চাঁপাকলার ছড়াটি দিলাম। অতি ক্ষুদ্র উঠোনময় প্যাচপেচে কাদা ভাঙা গাছের ডাল পাতাপুতা নারকোল ডোকলায় দাঁড়াবার জায়গা নেই। ঘরের চালার অর্ধেক হাঁ।
ঘরে কিছুই নেই বাবুর বাড়ির ছেলেকে দেবার মত। কিছু নেই মানে কিছু নেই। জলের ঘড়াও নেই।
রঞ্জন আর রঞ্জনের বাবা নাকি এ দুর্যোগে একমাত্র একজনের কাছেই যেতে পারে।
তারা আমার বাবার কাছে গেছে ঘর সারাবার রসদ জোগাড় করতে।
জীবনের একটি একটি পাঠশালার দিন আসে আর যায়।
রঞ্জনরা ফিরে আসার পর বাবুর বাড়ির ছেলে দুপুরে খেতে বসেছে। হ্যাঁ ঠিক, এ একেবারে ধ্রুব যে, জীবনের শেষ সুখাদ্যটি আমি সেদিন রঞ্জনের জননীর হাতে খেয়েছিলাম। অথচ গৃহস্বামীর কী কুণ্ঠা!
"এ মানুষে খায় নাকি? এ তো আমরা খাই। এ তুমি কী করিকি খাব গো?"
কাদা কাদা ভেজা মাটির ওপর পেতে দেওয়া রঞ্জনের মায়ের পরণের শাড়ির ওপর খেতে বসেছে তিনটি মানুষ। সামনে গালে হাত রঞ্জনের মা।
লাল আকাঁড়া ডুমোচালের ফেনাভাত। ঝড়ে ভেঙে পড়া পেঁপেগাছের ডগার কোঁড়ের তরকারি। তেঁতুলফুল পাতার চচ্চড়ি আর ডোবা-ভাসা ধেনো চিংড়ির টক। এই মাত্র খাদ্যতালিকা। চিরজাগরুক অমৃতের জিহ্বাস্নান।
স্বাদ কী বস্তু? রন্ধনশৈলী কেমন হলে স্বাদকে জাপটে ধরা যায়? রন্ধন কাকেই বা বলে?
আমি শাকান্ন রন্ধনে আনন্দ পাই। যে-শিল্পের দোষে আজও বাবুর বাড়ির ছেলে হতদরিদ্র বন্ধুজননীকে মনে রেখেছে, তাতে আমি মজে গেছি এ জীবনের মতো। যে মুখ কেলিয়ে বলে, খেতে ভাললাগে অথচ রান্না করাটা বোগাস ব্যাপার, তার প্রতি করুণা করা উচিত। তাকে ডেকে পিঁড়ি পেতে বলি, দুদণ্ড বসো, পাতের চারদিকে মিছিমিছি জলের ছড়া দাও। জিহ্বা সেইক্ষণে রসস্থ হোক। এই যে জুঁইফুলের মতো সিদ্ধ শস্যদানার পাশে সবুজ ব্যঞ্জনটি, এই হল আদিঅন্তহীন ঘরানা, মাইহার বাজের মতো। এর গায়ে অনেক শিশিরের আলাপ, অজস্র রোদের রাগ।
সেদিনের সেই একটি কালবোশেখি শিখিয়েছে, নিজেকে ভাল রাখতে গেলে যদি কিছু না পারো, কাউকে অন্তত দু'পদ রেঁধে খাইয়ে সুখ দিও। সে সুখে শাকান্নে প্রাণ শান্তি পেতে পারে।
(অনেক পরে জেনেছি রঞ্জন বিহারের মাফিয়া বেল্টে ফেরার। কেউ তার খোঁজ জানে না।)
যাই হোক, শাক ততদিন থাকবে, যতদিন মানুষ নিঃশেষে না মাংসাশী হয়ে যাবে। ততদিন শাক বাঙালির পাত আলো করে থাকুক, আর এই চোদ্দটি শাকের পার্বণ বাঙালির মর্মে ফোড়নের গন্ধে ম ম করুক। হেমন্তের দূর আকাশদীপে শ্যামাপোকারা জড়ো হবে, মৃত পূর্বজদের ছায়া ছায়া কুয়াশার অবয়বে কুট কুট করে দংশন করবে। এ কি সুখের দংশন? নাকি ফিরে ফিরে আসার না-আসার ব্যথার দাঁত? কে জানে।