এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • নাড়িভুঁড়ি

    পার্থসারথি গিরি লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৭ মে ২০২০ | ১৭০৪ বার পঠিত
  • #

    গতরাতে একবার কেউ যেন ঢুকরে কেঁদে উঠেছিল। কে শব্দ উৎপাদন করেছিল কেউ জানে না।

    এখন ঠিক মতো ভোর হয়নি। ঝিক্কুটি আঁধার ঝুপড়ির আলেকালে। উঠোনে, কৃষ্ণচূড়া গাছে। এখন আকাশ ছাগলের চেরা পেট মেলে দেওয়া থলির মতো প্রকাশমান। নীলচে। মাংসল।

    খেনুবুড়ি নির্ঘুম রাতশেষে প্রায় উদলা গায়ে গলির ওপর দাঁড়িয়ে দেখছে। কী দেখছে সে জানে না। খোলা নর্দমার ওপর কংক্রিটের ভাঙা স্ল্যাবটা শূন্য। বুঢ্ঢা লাঠি হাতে দিন নেই রাত নেই বসে থাকত। চোখে তার দেশীয় তমিস্রা ছিল হয়ত। ছানির সাদা কানাত পিঁচুটিতে জমে জমে ফর্সা। খেনুবুড়ি একবার চোখটা পরণের গামছাটা টেনে মুছল। এবং গামছাটা টানতে গিয়ে প্রায় ন্যাংটোই হয়ে গেল।

    শেষটায় খকখক কাশত। দুদিন গায়ে জ্বর ছিল। কোত্থেকে একটা ছেঁড়া কানি খুঁজে মুখে বেঁধে রাখত। ঝুপড়ির বাসিন্দারা সব জেনে গিয়েছে গত তিন হপ্তাভর ঢিভি দেখে দেখে। কেউ কাজে যায় না। সরকার নাকি কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজে বেরোলে মরণ। ঘরে সেই মরণ ঢুকে পড়বে চুপিসাড়ে। সবকে থেকে থেকে কামড়াবে।
    বুঢ্ঢা সারাদিন সারারাত নর্দমার ওপরে বসে থাকত। গত পরশু ভোরে উল্টে পড়ে শুয়ে ছিল ওখানেই। খাবার নাই। আধপেটা খেতে পেলে ভাগ্যি। এক বাটি খেচড়ি। ব্যস। শরীরে সাড় ছিল না। হাসপাতাল থেকে কিম্ভূত জামা পরা লোকজন এসে তুলে নিয়ে গেছে গাড়িতে। সে গাড়ি দেখবার মতো। চকচকে। কাচ ঢাকা। উঁই উঁই সাইরেন। আহা বুঢ্ঢার গতি হল বটে। ঝুপড়ির অধিবাসীগণ কপালে জোড়াহাত ঠেকিয়ে রাম রাম হরি হরি স্মরণ করেছিল।

    বুঢ্ঢার ছেলে রতন চটকলের পাঁচিলের গায়ে ফোকর করে হাঁড়িয়া বেচত। হাঁড়ি থেকে পাউচে ভরে ভরে দিত। কাস্টমার ওখানেই আমআদার কুচি দিয়ে ঢকাঢক মারত। এক সন্ধ্যায় আমদানি নয় নয় করে দুশ টাকা।

    সে সব এখন বন্ধ। বউকে বেধড়ক মারতে হয় তবে। কে মার দেয়, কে মার খায়। এখন যে খাবে সে কাল দেবে। সে কাল খাবে তো আজ দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে হা হা কাঁদে। রোগা ধুকধুকি বউ কোথায় যেন পালিয়েছে মুখে গামছার টুকরো বেঁধে।

    রতন বাপকে দেখতে সাগর দত্তের গেটে বসেছিল। ঢুকতে দেয়নি। মেরে ঠেলে কম্পাউন্ডের বাইরে হটিয়ে দিয়েছে। বেরো। হটো হিঁয়াসে। ভাগ শালা হারামি কা অওলাত। করোনা লেকে আগয়া। মার শালে কো।

    রতন বেড়ালের স্বরে বলেছিল, আমার বাপ ভর্তি আছে গো কত্তা। কেউ সে কথায় কর্ণপাত করেনি। গতকাল বিকেলে মোবাইলে কেউ ঝটিতি বলল, বাপ নেই। কাউকে আসার দরকার নেই। বডি হাসপাতালের জিম্মায় থাকবে আপাতত। লট পুরা হলে ধাপার মাঠে চলে যাবে। কোনো ক্রিয়াকরম চলবে না।

    বাপ কেমন ছিল কে জানে। পোকায় নাকি কুরে কুরে খেয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল বাপের শ্বাস। সে সব পোকা খুব দামী পোকা। এক রাতে সব খেয়ে ফেলতে পারে। সরকারের চেয়েও দামী? সরকার কি সবচেয়ে দামী পোকা? একরাতে সব ভাত সব তড়কা মেরে খেয়ে নেয়? রতন ভ্যাবলা মেরে একটা মাত্র দশ ফুট বাই আট ফুটের দরজায় থম মেরে বসে থাকে।

    #

    আকাশে ছাগলের পেটে রঙ লাগছে। লাল রঙের আলো। মাংসের মতো গন্ধ। দীপালি কোমর বেঁকিয়ে বেশ বড়ো ঢঁ করে পেটের আধপচা বায়ু বার করে গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। খেনুবুড়ির চোখে জল জল মতো ভাব।

    আ মোলো যা! কাঁদতিছ নাকি?
    খেনুবুড়ি পরণের খাটো জ্যালজেলে গামছাটা টেনে শরীরে ভদ্রস্থ করে।
    বুঢ়াকে শেষ দেখা দেখতে দিলনি।
    দিলনি তো তোমার কি হয়া গেল? গেছে তো মঙ্গল। নইলে সবকে সব কাশীপুর চলি যেত জান সে কথা?
    কেনে? মরা বুঢ়া কী খেতি করত?

    এর উত্তরে দীপালির প্রগাঢ় পায়খানার বেগ এল। কলোনির বারোভাতারি কলতলায় এখনও ভিড় লাগেনি। এই মাহেন্দ্রক্ষণে সশব্দে পেট সাফ করতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। কদাপি কপালে জোটে। দীপালি হুঁ হাঁ করে ফের পিছনের দিকে দৌড় লাগাল।

    আকাশে লাল রঙ গাঢ় হচ্ছে ক্রমে। পরেশ জমাদার একটা ঢাউস ব্যাগ হনহনিয়ে গলির মুখে আসছে। শ্রীকৃষ্ণপট্টি কলোনির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে জনাকয়। ট্যাঁকে মাস্ক গুঁজে ওষ্ঠে দাঁতনকাঠি কামড়ে কী একটা ঔৎসুক্যে গুঞ্জরিত।

    পেলি পরেশ?
    হ। পাইছি।
    দর কত নিল?
    পঁচ্চাশ টাকার কমে দিবেনি কয়। আমিও তেরিয়া। দিতে হবে। কে সাফ করে তোমার দোকান বছরভর? ছাল ক্ষুরা রক্ত ছিনে ছিনে এই শর্মা সাফ করে।
    দিল?
    দিবেনি? তার বাপ দিবে। কইলাম, মুর্শেদ ভাই কাম নাই। ঘরে বালবাচ্চা বউ মা বাপ। কত্তদিন সাদা ভাত খাইনি। খালি ঘ্যাঁট আর ঘ্যাঁট। মালটা দিন বটে। কাজকাম করে মিট্যা দিব।
    তো?
    তিরিশটা টাকায় রফা করলাম। বললাম, বস্তির ঘরপরতি একটাকা চাঁদা তুইলা এই পাইসি। এই লও। সদয় হও বাপজান।
    দিলো ক?
    হ। দিল।

    কথায় কথায় তিরিশ চল্লিশটি মানবদেহের মতো প্রাণী হৈ হৈ করে উঠল। খেনুবুড়ি শুধু একবার কী যেন খেঁকিয়ে বলতে গেল। বুঢ়ার ক্রিয়াকরম?
    হৈ হৈ রবে সে শব্দ হারিয়ে গেল। এত খর শব্দে লাগোয়া আবাসনের জানালায় জানালায় বিরক্তিভরা মুখশশীসকল। এই আকালে অশিক্ষিত ছ্যাঁচড়দের উল্লাস সাতসকালে। আধো নিমিলিত নয়নে আবাসন উঁচু থেকে দেখছে আশ্চর্য এক দৃশ্য।

    কলতলায় পরেশ ব্যাগ থেকে উজড়ে ফেলেছে একটি ছাগলের প্রকাণ্ড ভুঁড়ি। মাটিতে পড়ে সে থলথলে বস্তুটি যেন ধুকপুক। নীলরঙের ফ্লুরোসেন্ট আলো বেরোচ্ছে বস্তুটি থেকে। সঙ্গে একতাল নাড়ি। লার্জ ইন্টেস্টাইন এবং স্মল ইন্টেস্টাইন। যেন একটি মাইক্রোচিপ থেকে সহস্রপদ কন্ডাক্টরস্ পাক খাচ্ছে নীল স্ফুলিঙ্গে। এলিয়েনের মতো কতগুলো উন্মাদ অর্ধোলঙ্গ মাইক্রোচিপের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। চোখে নীল নীল সব সিগনাল। চকচক করছে লালাভরা সহস্র জিহ্বা।

    খেনুবুড়ি চোখের জলে নীল রঙ ছলক মারছে। ক্রিয়াকরম কী কে জানে। মুখে চুক চুক মিঠে শব্দ। আঃ। সাদা ভাতের ওপর লাল রঙের আলোর ঝোল।

    কলতলায় ছাগলের ভুঁড়ির ওপর আকাশ অভিনিবিষ্ট ঝুঁকে দেখছে তার প্রতিবিম্ব।

    ভূমি ও আকাশে এখন এক রঙ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ১৭ মে ২০২০ | ১৭০৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একলহমা | ১৯ মে ২০২০ ২৩:১১93486
  • এই চাবুকের মত গল্পটায় কোন মন্তব্য নেই! 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন