সে দিন ইস্কুল থেকে পরম বেরিয়েই দেখে, মা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। মুখ ভরা মন খারাপ। পরম বলল, ‘কী হয়েছে মা?’ মা বলল, ‘পরম, কাজ করতে গিয়ে তোর বাবার চোট লেগেছে, হাসপাতালে রয়েছে। আমাকে রাতের ট্রেন ধরে কোচিন যেতে হবে। তোকে তোর বড়দিদার বাড়িতে থাকতে হবে। এখনই চল।’ মা আর পরম ইস্টিশনে এল। পরমকে ট্রেনে তুলে মা বলে দিল, আটটা ইস্টিশন পরে চকবাজার আসবে। সেখানে গুজিয়া মামা থাকবে, পরমকে নিতে। বাবার পুরনো মোবাইলটা পরমের হাতে দিয়ে মা বলল, ‘এটা কাছে রাখিস। আমি খবর দেব।’
এর আগে পরম কখনও একা একা ট্রেনে চড়েনি। তাতে কী? বুকপকেটের পোষা ব্যাংটাকে পরম বলল, ‘আমি তো আছি, তোর ভয় নেই।’ চকবাজারে নেমে পরম ভাবছে, কী করে খুঁজে পাবে মামাকে? অমনি শোনে কে জোর গলায় বলছে, ‘পর্-র-ঔম! আরে এ-এ পররৌম!’ পরম ছুটে গিয়ে দেখে, ইয়া বড় একটা লোক, হাতের মাসল যেন ডবল পাঁউরুটি। ‘আমি পরম’ বলতেই গুজিয়া মামা এক কাঁধে পরমের দুটো ব্যাগ, আর অন্য কাঁধে পরমকে তুলে নিল। তারপর একটা ভটভটি ভ্যানে চড়ে চলল ওরা। দোকান-বাজার পেরিয়ে, শহর ছাড়িয়ে, পিচের পথ ছেড়ে লাল মোরামের পথ দিয়ে ভটভটি এসে ঢুকল গ্রামে। ইটভাটার পাশ দিয়ে, হেলানো বাঁশবনের ধার দিয়ে, অনেক এঁকেবেঁকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। গুজিয়া মামা ডাক দিল, ‘হো সবেইদা।’ খুট করে দরজা খুলে গেল, মায়ের মতো দেখতে একজন বেরিয়ে এসে পরমের হাত ধরে বলল, ‘আমি তোমার সবেদা মাসি। এসো, ভিতরে এসো।’
বড় বাগানের মাঝে দোতলা বাড়ি, নিচে লম্বা উঠোনের কোণে একটা ঘরের সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে মায়ের বড়মা। সাদা চুল এলোমেলো, দুই পায়ের মাঝে একটা টুল, তাতে সাদা কাগজ, চার দিকে ছড়িয়ে রং পেনসিল আর প্যাস্টেল। বড়দিদা এক মনে ছবি আঁকছে। পরম প্রণাম করতে কেবল বলল, ‘হুঁ।’ তারপর যে কাগজে ছবিটা আঁকছিল, সেটা সবেদা মাসির হাতে দিয়ে, অন্য একটা একটা ছবি আঁকতে লাগল। পরম গলা বাড়িয়ে দেখল, একটা রোগা বেড়াল মতো কীসের ছবি, লেজটা একটু বেশি লম্বা।
সবেদা মাসি এসে পরমকে থালাভরা লুচি, বাটিভরা পায়েস দিল। খাওয়ার পরে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে মাসি বলল, ‘এ ঘর থেকে বেরিয়ো না। এ গাঁয়ের লোকজন ভাল নয়।’ এই বলে সিঁড়ির মুখের লোহার গেটে তালা দিয়ে নীচে চলে গেল। পরম বিছানায় বসে ব্যাংটাকে বলল, ‘কিছু বুঝলি?’ ব্যাং বলল, ‘গ্যাং।’ পরম হাই তুলে বলল, ‘আমিই বুঝলাম না, তো তুই বুঝবি কী?’
পর দিন ঘুম ভেঙে পরম গাঁ দেখতে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ির পিছনের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই অনেকগুলো কদবেল, কাঠবাদাম, পেয়ারা, আরও কী সব বেঁটে বেঁটে কাঁটা গাছের বন। খানিক যেতে যেতে এল একটা পুকুর। তার ধারে একটা বাবলা গাছে কে একটা নোটিস সেঁটে দিয়েছে। পরম কাছে গিয়ে পড়ল, ‘এখানে ছিপ, জাল ফেলিলে জরিমানা হইবে।’ কে বনের মধ্যে এটা লাগাল, ভাবতে ভাবতে পরম দেখে, উলটো দিক থেকে এক খুনখুনে রোগা বুড়ি আসছে, তার পিছনে অনেকগুলো হাঁসের ছানা। বুড়িটা একবার এ দিক ও দিক চেয়ে, জলের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘মাছ উড়ে এসে পড়ুক, পড়ুক, পড়ুক, হুররররর্।’
অমনি পুকুরের মাঝখানের খানিকটা জল দাঁড়িয়ে উঠল থামের মতো। ঘুরতে ঘুরতে পুকুরপাড়ে বুড়ির কাছে এল জলের থামটা, আর তা থেকে ছোট ছোট মাছ লাফিয়ে পড়তে লাগল বুড়ির কোঁচড়ে। মাছগুলো বুড়ি কোলের কাপড়ে জড়াচ্ছে, এমন সময় তড়বড় করে এল এক তাগড়াই বুড়ি, তার পিছু পিছু কয়েকটা ছাগল ছানা। বুড়িটা এসে হাঁক দিল, ‘গুগলি, ফের আমার মাছ চুরি করলি?’
গুগলিবুড়ির মোটে একটা দাঁত। তাই দেখিয়ে হেসে বলল, ‘ও লো থানকুনি, তোর মাছেরাই লাফিয়ে আমার কোলে এল, কী করব বল?’
‘তা হলে তোর হাঁসের ছানাগুলো চড়ুই হয়ে উড়লে আমি কী করব বল। হাঁসগুলো চড়ুই হয়ে উড়ুক, উড়ুক উড়ুক, ফুররররর্।” অমনি হলুদ বলের মতো হাঁসের ছানাগুলো পরমের চোখের সামনে চড়াই পাখি হয়ে ফরফর করে উড়ে গেল। তাই দেখে গুগলি চিল চিৎকার করল, ‘তবে রে! তোর ছাগলের ছা তবে বিড়াল হয়ে ঘুরুক, ঘুরুক ...’ এত দূর বলতেই পরম ছুটে গিয়ে মুখ চেপে ধরল গুগলি বুড়ির। বলল, ‘একদম না, ছাগলকে বেড়াল করা চলবে না কিছুতেই।’
তখন দুটো বুড়ি গোল গোল চোখ করে পরমকে দেখতে লাগল। থানকুনি বলল, ‘তুমি কোন বাড়ির ছেলে গো?’
পরম বলল, ‘আমি বড়দিদা আর সবেদামাসির বাড়ি এসেছি।’
শুনে দুই বুড়ির মুখ হাঁ হয়ে গেল। তারপর গুগলি একগাল হেসে বলল, ‘অ, তুমি রাবড়ি দিদির নাতি? তা, দিদার ঘরেই রাতে ঘুমোও তো?’
থানকুনি বলল, ‘কী যে বলিস গুগলি, নাতি দিদিমার পাশে শোবে না তো কোথায় শোবে? অত বড় খাট রাবড়ি দিদির, খাটের নীচে মিনিবাস ঢুকে যায়! ও খোকা, একটা সোনালি বাক্স দেখেছো খাটের তলায়?’
গুগলি বলল, ‘রুপোলিও হতে পারে। বেশ বড় মতো, রুপোলি বাক্স।’
থানকুনি বলল, ‘সবাই জানে, ওটা সোনালি।’ গুগলি বলল, ‘আমি উঁকি দিয়ে দেখেছি, রুপোলি।’ পরম গুটিগুটি পায়ে পালানোর চেষ্টা করছে, হঠাৎ খপ করে দু-জনে চেপে ধরল পরমের দুটো হাত। পরম দেখে, বদলে গেছে ওদের মুখ। রাগে চোখ লাল করে থানকুনি খসখসে গলায় বলল, ‘আজ রাতে দিদার ঘরের জানলা খুলে দিবি। না হলে তোর পকেটের ব্যাংটাকে শামুক করে দেব।’
‘তেলাপোকা করে দেব, তেলাপোকা,’ হিসহিস করে বলল গুগলি।
পরম হাঁ করে চেয়ে রয়েছে, বুকপকেটে ব্যাংটা থরথর করে কাঁপছে, এমন সময় বাজ-ডাকা গলায় কে বলল, ‘পরম!’
পরম মুখ ঘুরিয়ে দেখে, বড়দিদা! দিদাকে দেখেই গুগলি আর থানকুনি খসখস, খিসখিস করে বনের ভিতর কোথায় চলে গেল, আর দেখা গেল না। পরম দৌড়ে গিয়ে দিদাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘দিদা, ওরা অমন করছে কেন?’
পরমের হাত ধরে বাড়ির দিকে যেতে যেতে দিদা বলল, ‘ওরা লোভী। যা চাওয়ার নয়, তা চায়।’
কী চায়?
জবাব না দিয়ে পরমকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফের আঁকতে বসল বড়দিদা। সবেদা মাসি একটু পরে এসে ছবিটা নিয়ে গেল। পরম চান করে এসে দেখে, মাসি গরম ভাত, ডাল, মাছ ভাজা সাজিয়ে উঠোনে আসন পেতে পরমকে দিয়েছে। পাশে বসে গুজিয়া মামা খাচ্ছে ডাল, রুটি, সবজি। পরম খেয়েদেয়ে উঠতে ব্যাংটা এসে বলল, ‘গ্যাঙর গ্যাং, গ্যাঙর গ্যাং, হাঁড়িকড়াই নেই ক্যান?’ তখন পরম চুপিচুপি রান্নাঘরে গিয়ে দেখে, সত্যি তো, কোথাও হাঁড়ি, কড়াই, খুন্তি, হাতা, কিছুই নেই। এত ভাত-তরকারি এল কী করে?
গুজিয়া মামা খাওয়ার পর নাক ডাকাচ্ছিল, পরম তাকে ডেকে তুলল। বলল, ‘তুমারা গাঁওমে কেয়া কেয়া হো রহা হ্যায়, গুজিয়া মামা?’
মামা বলল, ‘গাঁও কা নাম আজবগাঁ। ইঁহা সব আজব।’ বলে আবার নাক ডাকাতে লাগল। বিকেলে সবেদা মাসিকে ধরল পরম। বলল, ‘তুমি মোটেই রান্না করো না। তা হলে খাবার আসে কোথা থেকে?’
সবেদা মাসি হেসে বলল, ‘ওমা, ধরে ফেলেছো?’
পরম বলল, ‘দিদা খাবারের ছবি এঁকে দেয়, তাই না? দিদা যা ছবি আঁকে, তা সত্যি হয়ে যায়। কী করে হয়?’
মাসি বলল, ‘জীবনতরুর বীজ যে পেয়েছে, সে যেমন চাইবে, তেমন হবে।
জীবনতরু কী?
তরু মানে জানো না? তরু মানে গাছ। জীবনতরু এক আজব গাছ। একশো বছর পর তার একটা ফল হয়। ফল যখন পাকে, তখন দেখা দেয় গাছ। সবার কাছে দেখা দেয় না। যে ঠিক লোক, কেবল তার কাছে দেখা দেয়।
তারপর?
তারপর সেই লোক সে গাছের ফল হাতে পায়। তখন সে পাখিকে পোকা, পোকাকে হাতিও করতে পারে।
বড়দিদা বুঝি সেই গাছের ফল পেয়েছিল?
বড়দিদা নয়, বড়দিদার মা গাছের দেখা পেয়েছিল, ফল পেয়েছিল। ভারি সরল, ভাল মেয়ে ছিল সে। তাই গাঁয়ের সব সখীদের বিলিয়েছিল ফলের বীজ। কিন্তু সবার মন কি আর ভাল? তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা বীজ হাতে পেয়ে কথায় কথায় ভেলকি দেখায়, এ ওকে ভয় দেখায়। তাই গাঁয়ের নামই হয়ে গিয়েছে আজবগাঁ। তবে আর বেশি দিন এমন চলবে না।
কেন?
বীজ ফুরিয়ে আসছে। বড়মার খাটের তলায় আর দু-চারটে রয়েছে। তাই সবার নজর এই বাড়ির দিকে।
এ বার কী হবে?
আবার গাছের ফল পেতে হবে। নইলে আজবগাঁ আর সব গাঁয়ের মতো হয়ে যাবে।
সবেদা মাসির কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে রাতে ঘুমোল পরম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে পরমের মনে হল, দেখি তো, মা কিছু লিখে পাঠাল কি না। মোবাইলটা খুলে দেখে, আরে, টাওয়ারই আসছে না। দোতলার বারান্দার এ কোণ, ও কোণ, কোথাও টাওয়ার না পেয়ে, পরম ভাবল, ছাদে গিয়ে দেখি। চাঁদের আলোয় থই থই করছে বিশাল ছাদ। ফোনে টাওয়ার পেতে এ ধার, ও ধার ঘুরছে পরম। হঠাৎ পকেটের ব্যাংটা ‘গঁ গঁ’ করে ডেকে উঠল। পরম ফোন থেকে চোখ তুলে নীচে চেয়ে থ হয়ে গেল! দেখে, বড়দিদার ঘরের ঠিক বাইরে বাগানে পায়চারি করছে একটা চিতাবাঘ। লম্বা লেজ ছায়া ফেলছে পিছনে।
পর দিন সকালে উঠে মোবাইল ফোনটা হাতে বেরোল পরম, যদি গাঁয়ের কোথাও টাওয়ার পাওয়া যায়। যেখানেই যায়, লোকে পরমকে দেখে ফিসফাস করে। একটা ময়লা লুঙ্গি পরা ছেলে এসে কানে কানে বলল, ‘আমায় একটা বীজ এনে দে না ভাই। আমার গরুগুলো রোজ আশি কিলো দুধ দিত, এখন কেবল এক গেলাস ছানার জল দিচ্ছে। তোকে পেট ভরে বিরিয়ানি খাওয়াব।’ একটা মেয়ে সাইকেলে যেতে যেতে পরমকে দেখে থেমে বলল, ‘তুমিই সেই ছেলেটা, যার দিদার কাছে অনেক বীজ আছে? আমাকে একটা দাও না, আমি ইংরেজিতে কাঁচা।’ পরম রাগ করে বাড়ি ফিরে এল। ঠিক করল, এখানে আর থাকবে না। দুপুর বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে, তখন পরম পিঠের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইট ভাটা পেরিয়ে যেই এসেছে বাঁশবনের কাছটায়, অমনি টুং টুং করে শব্দ হল ফোনে। টাওয়ার মিলেছে, কী মজা! পরম দেখে মা লিখেছে, ‘আমি বাবাকে নিয়ে ফিরছি। এই নম্বরটা বিপদে কাজে আসবে, নয় দুই নয় দুই নয়, আট ছয় আট ছয় ছয়।’
পরম নম্বরটা মুখস্থ করে নিয়ে ফোন থেকে মুখ তুলতেই দেখে, ঝড়ের মেঘের মতো মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে গুগলি আর থানকুনি। সেই লুঙ্গি-পরা ছেলেটাও হাজির, পিছনে ভিড় করে আরও লোকজন। পরমকে ঘিরে সবাই বলতে লাগল, ‘ব্যাগে করে বীজ নিয়ে পালানো হচ্ছে? বের কর শিগগিরি।’ তারপর সবাই মিলে পরমের ব্যাগ খুলে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে, বই-খাতা ছিটিয়ে খুঁজতে লাগল। বীজ না পেয়ে সবার কী রাগ! থানকুনি বলল, ‘ছেলেটাকে বেঁধে রাখ, যতক্ষণ না বড়মা বীজ বার করে দেয়, ওকে ছাড়িস না।’
বলতে বলতেই ‘ঘাঁওও’ করে বিকট গর্জন ভেসে এল। ছুটে এসে সবার মধ্যে লাফিয়ে পড়ল একটা চিতাবাঘ, তার পিঠে বড়দিদা। দিদা গলা আকাশে তুলে বলল, ‘থানকুনি, ছাড় বলছি পরমকে।’ নিমেষে পরম দেখে, গুগলি কাঁকড়ার পিঠে, আর থানকুনি বাজপাখির পিঠে বসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দিদার ওপর। তখন বাঁশবনে সে কী যুদ্ধ শুরু হল! কাঁকড়া দাঁড়া দিয়ে চেপে ধরল চিতার পা, চিতা দাঁতে ধরে তাকে উলটে দিল। বাজপাখি উড়ে এসেছে ঠুকরোয় চিতাকে, চিতা লাফিয়ে উঠে থাবা মারে তার পেটে। এর মধ্যে ভটভটি ভ্যানে এসে গুজিয়া মামা বলল, ‘পরৌম, আ যাও।’ পরম লাফ দিয়ে উঠতে গেল, কিন্তু গুগলি বুড়ির কাঁকড়া চেপে ধরেছে ওর জামা। গুজিয়া মামা হকিস্টিক দিয়ে জোরে এক ঘা মারল, তবু কাঁকড়া ছাড়ে না। এ দিকে লুঙ্গিপরা লোকটা বসেছে নেকড়ের পিঠে। নেকড়েটা জিভ, দাঁত বের করে গুঁড়ি মেরে আসছে পরমের দিকে। পরম চোখ বুজে একটা বাঁশ গাছকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল ‘মা গো!’ আর তখনই মনে পড়ল নম্বরটা, যেটা মা পাঠিয়েছে। পরম ফিসফিস করে বলল, ‘নয় দুই নয় দুই নয়, আট ছয় আট ছয় ছয়।’
অমনি কোথা থেকে একটা সাদা ময়ূর উড়ে এসে নামল ঠিক পরমের সামনে। পরমকে আড়াল করে দুপুর রোদের আলোয় মেলে দিল তার সাদা পেখম। ঝলমল, ঝকমক করতে লাগল তার কাঁপতে-থাকা সাদা পালকগুলো, ঝিরঝির, ঝরঝর আওয়াজ উঠল তা থেকে। সেই অপরূপ পাখির সামনে মাথা নিচু করে বসে পড়ল চিতাবাঘ, নেকড়ে, কাঁকড়া, বাজপাখি। মানুষরাও লড়াই ভুলে হাঁ করে চেয়ে রইল সে দিকে। আর পরম দেখে, কোথায় সেই সরু বাঁশ গাছ, কাঁটা কাঁটা পাতা? তার হাত ছুঁয়ে আছে এক বিশাল গাছকে। ফোয়ারার মতো সে গাছ উঠছে মাটি থেকে, হাজার ডালপালা মেলছে, মিনিটে মিনিটে থোকা থোকা বেগুনি, লাল, হলুদ ফুল ফুটছে সে গাছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ডালে ডালে সোনালি, রুপোলি ফল দুলছে, প্রজাপতি আর ভোমরা ঘুরছে, লাফ দিচ্ছে বাঁদর, দোল খাচ্ছে বাদুড়, শিস দিচ্ছে দোয়েল, দৌড়োদৌড়ি করছে গিরগিটি, কাঠবিড়ালি, ওড়াউড়ি করছে কাকাতুয়া, টিয়া, শালিক। আবার ফল পড়ছে, ফুল ঝরছে, খসে যাচ্ছে পাখির পালক। যা ফুল হয়ে ঝরেছিল তা পিঁপড়ে হয়ে উঠে এল, যে পালক খসেছিল তা লতা হয়ে জড়িয়ে ধরল গাছকে, যা ছিল বাকলের নীচে পোকার সারি তা হল মগডালের কচি পাতা। পরম অবাক হয়ে সেই গাছের দিকে চেয়েই রইল, চেয়েই রইল, মনে হল যেন নিজেকেও দেখতে পেল গাছের একটা ডালে। ওই তো পরমের পোষা ব্যাং ফড়িং খাচ্ছে, ওই তো মা হাসিমুখে পাকা পেঁপে তুলছে। পরম ‘মা’ বলে ডাকতে যাবে, অমনি সে গাছ টুপ করে একটা গোলাপি পেয়ারা ফেলে দিল পরমের হাতে। তারপর মিলিয়ে গেল জীবনতরু, রয়ে গেল কেবল বাঁশ গাছ।
পরম গোলাপি পেয়ারাটা বাড়িয়ে দিল সাদা ময়ূরের দিকে। ময়ূর সেটা মুখে নিয়ে উড়ে গেল বাঁশ গাছের মাথার উপর দিয়ে। সাদা ময়ূর চোখের আড়ালে যেতেই মিলিয়ে গেল চিতা, কাঁকড়া, বাজপাখি, নেকড়ের দল। রয়ে গেল কিছু হাঁ-করা মানুষ, আর গাছের তলায় একটা সাদা পালক। পালকটা তুলে ব্যাগে ভরল পরম। বলল, ‘এটা আমার মাকে দেব।’
গুগলি বলল, ‘ফলটা পাখিকে খাইয়ে দিলি, বোকা ছেলে? যা চাইতিস, তাই পেতিস ওই ফলের বীজ থেকে।’ পরম বলল, ‘মা ফিরে আসছে বাবাকে নিয়ে। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।’