এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো  ইদের কড়চা

  • উত্তরকালের অপেক্ষায়

    দীপেন ভট্টাচার্য
    গপ্পো | ১৩ মে ২০২২ | ২০৭৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • তন্ময় ভট্টাচার্য | প্রতিভা সরকার | হেমন্ত দাস | শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় | মৃণাল শতপথী | কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় | দেবাশিস মল্লিক | মণিশংকর বিশ্বাস | সুকান্ত ঘোষ | সাদিক হোসেন | ডাঃ সেখ নূর মহাম্মদ | মোহাম্মদ সাদেকুজ্জামান শরীফ | সোমনাথ রায় | রুমা মোদক | জয় গোস্বামী | দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় | সুপর্ণা দেব | সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় | স্বাতী রায় | অনিন্দিতা গোস্বামী | ফারুক আব্দুল্লাহ | খান শামিমা হক | নীলু ইসলাম | সারিকা খাতুন | দময়ন্তী | সাদাত হোসাইন | গোলাম রাশিদ | মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় | শারদা মণ্ডল | অমর মিত্র | হামিরউদ্দিন মিদ্যা | ইমানুল হক | নীলাঞ্জন দরিপা | চিরশ্রী দেবনাথ | সায়ন কর ভৌমিক | কৌশিক বাজারী | ঐন্দ্রিল ভৌমিক | চৈতালী চট্টোপাধ্যায় | যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা | মোজাফ্‌ফর হোসেন | অনুরাধা কুন্ডা | মাজুল হাসান | জগন্নাথদেব মন্ডল | যশোধরা রায়চৌধুরী | কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায় | শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী | দীপেন ভট্টাচার্য | মৌ সেন | পায়েল দেব | তনুজ | রুখসানা কাজল | পার্থসারথি গিরি | ইদের কড়চা
    ছবিঃ ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক




    ১. পূর্বকথা

    কোনো এক অতীতে, এক জলযানে পুরাবিদ মৃত্তিকা তার সাত বছরের মেয়ে দিতাকে নিয়ে যাচ্ছিল রাজধানী থেকে তুরা শহরে। রাজধানী থেকে পালাচ্ছিল সমতল ভূমির মানুষেরা, পালাচ্ছিল চিতা বাহিনির হাত থেকে। জলযানে মৃত্তিকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিজ্ঞানী ও ঘড়িনির্মাতা অসিতোপলের সাথে। দেখা হয়েছিল বলছি, কিন্তু মৃত্তিকা অন্ধ ছিল। তুরার পথে, দুলারী নদীর ওপর, সেই জলযান প্রবেশ করেছিল এক গোলকধাঁধায় যেখানে দেশ-কাল ভাগ হয়ে যায়। সেই সময়রেখার একটি ধারায় জলযানটি দুর্ঘটনায় পড়ে, মৃত্তিকা ও দিতাকে অসিতোপল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এরও পনেরো বছর পরে চিতাদের সঙ্গে হয় এক চূড়ান্ত যুদ্ধ। চিতাদের যুদ্ধ ছিল সময় নিরূপণের বিরুদ্ধে, সমস্ত ধরণের ঘড়ি ও ঘড়িনির্মাতাদের বিরুদ্ধে, সমতলের মানুষেরা যাতে আর সময়কে গুণতে না পারে তার জন্য। সমতলের মানুষেরা অবশেষে জয়ী হয়, যদিও সেই জয় যে স্থায়ী হয়েছিল তা বলা যায় না, কারণ সমতলের বহু মানুষই চিতা বাহিনির আদর্শের প্রতি অনুগত ছিল। এরপরও পনেরো বছর কেটে গেছে। দুলারী নদীর বুক থেকে আমরা যে সময়রেখা অনুসরণ করছিলাম তাতে মৃত্তিকা আর অসিতোপল আর নেই, কিন্তু দিতা আছে।

    ২. দিতার বাগান

    পুকুরের পাশ দিয়ে যেখানে ছোট রাস্তাটা বাঁশঝাড়ে শেষ হয়েছে লোকটি সেখানে বসেছিল, ঝাড়ের পাশে একটা পাথরের ওপর। চমকে ওঠে দিতা। বাইরের সদর দরজা ছাড়া বাগানে ঢোকার দ্বিতীয় পথ নেই। মনে হল একটা আবছায়া মেঘ ভেসে গেল ওপর দিয়ে। অথচ চোখ না তুলেও সে জানে সূর্য জ্বলছে একা, গ্রীষ্মের আকাশ থেকে মেঘেরা উধাও হয়েছে, আজ নয়, গত ছ’মাস এক গনগনে সূর্য পৃথিবী পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে রেখেছে।

    মানুষটিকে এক পলক দেখে দিতা বোঝে সে তুরাবাসী নয়, বয়স হয়তো পঞ্চাশের কাছাকাছি। ঋজু চেহারা, ঘন কালো চুল। মুখে ছিল একধরনের তীক্ষ্ণতা যা প্রথম দৃষ্টিতে থাকে অলক্ষিত। দিতা আঙুলগুলো মুঠিবদ্ধ করে, চিৎকার করে উঠতে চায়। সেই মুহূর্তেই মানুষটি তার দিকে তাকায়, হাসে।

    কেন জানি দিতার প্রথম আতঙ্ক কেটে যায়। মানুষটির হাসির মধ্যে অতি দূর অতীতের পরিচয়ের ইঙ্গিত ছিল। লোকটির বসার ভঙ্গিতে ছিল এমন একটা স্বাচ্ছন্দ্য যা তাকে স্বস্তি এনে দেয়। কয়েকটি গাছের শাখা লোকটির কাঁধ ছুঁয়ে থাকে, বাতাসে দোলে। বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে দিতা জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী চান? কী করে এখানে ঢুকলেন?”

    লোকটি উঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথেই উত্তর দেয় না, সূর্যের ছটা দু’চোখ থেকে প্রতিবিম্বিত হয়ে ফিরে আসে। দিতার দিকে চেয়ে মৃদু হাসে, তারপর বাগানের রাস্তায় হেঁটে যায়। দিতা বুঝে পায় না কী করবে, নিরুপায় হয়ে তাকে অনুসরণ করে।

    দিতার এই ছোট বাগানটুকু আছে। শহর যেখানে পরাক্রমে প্রকৃতিকে অধিকার করে আছে তার একটি কোনায় সে বাগানটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে। ভায়োলেট ও হাস্নাহানা, রক্তজবা আর কনকচাঁপা। আর বাহারি গোলাপের ঢল। দুদিন আগে তাকে এক বন্ধু একটি কবিতা পাঠিয়েছে, লিখেছে কবিতাটির রচয়িতার নাম গারসিয়া লোরকা। কে গারসিয়া লোরকা আর কবে আর কোথায়ই বা ছিল তার বাস তা দিতা জানে না, তিষাণও বলতে পারে নি, কিন্তু কবিতাটিতে গোলাপের কথা লেখা ছিল।

    সেই গোলাপ
    সন্ধান করছিল না সূর্যোদয়ের,
    তার শাখায় প্রায় চিরন্তন থেকে
    সে সন্ধান করছিল অন্য কিছুর।

    সেই গোলাপ
    সন্ধান করছিল না অন্ধকার কি বিজ্ঞানের,
    শরীর ও স্বপ্নের মাঝামাঝি থেকে
    সে সন্ধান করছিল অন্য কিছুর।

    সেই গোলাপ
    সন্ধান করছিল না অন্য গোলাপের,
    আকাশের মাঝে নিথর থেকে
    সে সন্ধান করছিল অন্য কিছুর।

    তুরায় এখন কেউ কবিতা পড়ে না, কিন্তু দিতা কবিতা ভালবাসে। আগন্তুককে অনুসরণ করতে করতে সে কবিতাটি মনে করে।

    ঝলমলে অর্কিড, বাহারি প্রলম্বিত লতা, দীর্ঘ চিকন পাতার গাছ। ছোট মসৃণ পাথরের রাস্তা চলে গেছে সেই সুন্দর ঝোপের পাশ দিয়ে, পৌঁছেছে ছোট্ট একটি পুকুরে যেখানে জেগে আছে শাপলা আর পদ্ম। পুকুরের একপাশ ঘিরে অশোক, শিমুল, সেগুন আর সাইপ্রেস।

    পুকুরের পাড়ে পৌঁছে লোকটি ঘাসের ওপর বসে। তারপর সময় নিয়ে প্রশ্ন করে, “অবাক হয়েছ, না?” অবাক হয় দিতা, অবাক হবারই কথা, মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারে।

    লোকটি আবারো হাসে, একটি ছোটো পাথর কুড়িয়ে নিয়ে পুকুরে ছুড়ে দেয়। অনেকক্ষণ ধরে জলে ছড়িয়ে পড়া ঢেউয়ের চক্রাকার রেখাগুলো দেখে সে। তারপর বলে, “আমার নাম নিষাদ, কিন্তু যারা আমাকে চিনত তারা আমাকে এক জলযানের ক্যাপ্টেন বলে জানত। তবে এমন নয় যে অনেকে আমাকে চেনে। চেনার কথা নয়। আমাকে চিনতে হলে ভবিষ্যতে থাকতে হবে, ক’জন সেটা পারবে বল? আর কী করে আমি এই বাগানে ঢুকেছি সেটা জানা খুব প্রয়োজনীয় নয়। মনে হয়েছিল তোমার বাগান আমার ভালো লাগবে, ভুল হয় নি। তোমার ফুলের সমারোহ, পুকুরের নিষ্কম্প জল, মসৃণ সবুজ ঘাস আমাকে অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে।"

    দিতা কী বলবে ভেবে পায় না। ‘জলযানের ক্যাপ্টেন’ কথাটি তার মনে ভুলে যাওয়া কোনো স্মৃতির অনুরণন তোলে। অচেনা অজানা লোকের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হয় সেটা তার জানা, অন্তত তাই আগে সে ভাবত, কিন্তু এই লোকটির সাথে, যে নিজেকে নিষাদ বা ক্যাপ্টেন বলে পরিচয় দিল, তাকে কী বলতে হবে দিতা ভেবে পায় না। নিষাদের মাঝে একটি সচেতন আত্মপ্রত্যয় ছিল যা কিনা দিতাকে অন্য কিছু ভাবতে দিচ্ছিল না। নিষাদ বলে, "তুমি কি বৃষ্টি চাও, দিতা?"

    সচকিত হয় দিতা। এই লোকটি তার নাম জানে। কিন্তু সে পুরোপুরি আশ্চর্য হতে পারে না, তার মনে হয় নিষাদের অনেক কিছুই জানা।

    বৃষ্টি দিতা পছন্দ করে। বাগানের জন্য, নিজের জন্য। অথচ কতদিন বৃষ্টি হয়নি। গতকাল এক বন্ধু একগাদা রজনীগন্ধা দিয়ে গেছে, বলেছে রজনীগন্ধা বৃষ্টির ফুল। দিতা জানে তার বাগানে ফুলেরা মরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে। তার লাল বেগুনি হলুদ লাইলাক পাপড়ি তৃষ্ণার্থ হয়ে ঝরে পড়ছে। আজ শুকিয়ে গেছে তার শেষ গোলাপের চারাটি।

    নিষাদ যেন দিতার মনের কথাকেই ভাষা দেয়, “তোমার বাগানের সবুজ ফিকে হয়ে এসেছে। অগভীর শিকড় তৃষ্ণায় দুর্বল হয়েছে, জলপ্রবাহ হয়েছে ক্ষীণ।"

    হঠাৎ সন্ধ্যা নামে, আসন্ন যবনিকার সূত্র ধরে সূর্য হেলে পড়ে পশ্চিমে। রক্তিম ছটায় যেন আগুন ধরে দিতার গাছগুলোয়, নিষাদের মুখ হয়ে ওঠে অয়স্কঠিন, বলে, "তোমাকে হয়তো আমি সাহায্য করতে পারব, দিতা।"

    এরপর ঠাণ্ডা শীতল বাতাস আসে বাগানে, শিরশির করে ঝাউয়ের পাতা। গভীর অবোধ্য অনুভূতিতে ভরে ওঠে মন। কেন জানি অবিশ্বাস করে না দিতা নিষাদের কথা। গতকালের বৃষ্টির রজনীগন্ধা আজ কোথায় কত দূরে। পায়ের নিচে সবুজ নরম ঘাস শুষ্ক ভঙ্গুর হয়ে যায়।

    নিষাদ উঠে দাঁড়ায়, কোন বিদায় অভিভাষণ ছাড়াই দূরে সরে যায়। পুকুরের পাড় দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় ঝাউয়ের আড়ালে। এরকমই যেন হবার কথা, নিষাদের এই অন্তর্ধানে দিতা আশ্চর্য হয় না।

    শহরের ধোঁয়া সারাদিন আকাশ ঢেকে রাখে, সুউচ্চ অট্টালিকা হারিয়ে যায়, সেই বাদামি মেঘে সন্ধ্যার দিগন্ত রক্তলাল হয়ে থাকে ধোঁয়াশার মাঝে বিক্ষিপ্ত সূর্যের আলোয়। তুরা শহরের দাঁড়ানোর সময় ছিল না। সভ্যতার ফসল বইতে তার নাগরিকেরা উদয়াস্ত বিচরণ করছিল কোন এক অস্থিরতায়। দিনের বেলায় তাদের অভিযান ছিল ধূসরিত রাস্তায়, বদ্ধ ঘরের মাঝে অর্থহীন দলিলের আলোচনায়, রেস্তোরাঁর স্বাদহীন চা পানে। সন্ধ্যার অপস্রিয়মাণ আলোতে ক্লান্ত মনে তারা বাড়ি ফেরে, কিন্তু দিনের খতিয়ান করে না, টেলিভিশনের সস্তা রঙিন ফোটনে তাদের বসার ঘরের দেয়াল হয়ে ওঠে বিচিত্র, তাদের শোবার ঘর থাকে পরিত্যক্ত, রান্নাঘরে পড়ে থাকে গতকালের আধোয়া বাসন, মেঝেতে ছড়ানো পেঁয়াজের খোসা, নিশুতি রাস্তা থাকে প্রমত্ত যুবকদের দখলে। এই শহরে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, স্থপতি, নির্মাতারা ছিল না। এই শহর তৈরি হয়েছিল ধার-করা মাথা আর হাত দিয়ে।

    তুরার সাধারণ নাগরিকেরা বাস করছিল ইতিহাসের আর একটি সন্ধিক্ষণে। তাদের গৌণ রাজনীতি বারে বারে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সঙ্কট মুহূর্তে, করেছে ধ্বংসোন্মুখ। পৌরসভায় ক্ষমতা বদলেছে বারেবারে, সময়ের গতিতে জীবনও বদলেছে। কিন্তু এই সন্ধিক্ষণ ইতিহাসোত্তর। শুধু তুরার সাধারণ নাগরিকেরা তা জানে না। তুরা শহরের শেষ গ্রীষ্মে রাস্তায় পিচ গলে যাচ্ছিল।

    অথচ বহু অতীতে এই সমতলভূমিতে বাস করত এক সৃজনশীল গোষ্ঠী যারা পরিচিত ছিল যান্ত্রিক নামে, এই যান্ত্রিকেরাই সমতলভূমিকে চিতাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সেই যান্ত্রিকেরা এখন আর নেই, সমতলভূমিতে শেষ যান্ত্রিক ছিল অসিতোপল যে কিনা দিতাকে বড় করেছে।

    তুরা কোথায় আমরা জানি না যদিও আমি বলেছি সেটি ছিল সমতলভূমির উত্তরে। তারও উত্তরে ছিল পাহাড়শ্রেণী। এই কাহিনীর স্রোতে তুরার বিশেষ স্থান আছে, কিন্তু শুধু এই শহরের মাঝে আমাদের কাহিনী প্রবাহিত নয়। আমাদের কাহিনির প্রটাগনিস্টদের মন ও দেহ স্থান ও কালে নিমজ্জিত, কিন্তু তারা আবিষ্কার করবে সেই স্থান ও কালের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা সবাই সময়কে জয় করতে চাই, আমাদের চরিত্ররাও তাই চায়, কিন্তু সময়ের বহমান অথচ অনিশ্চিত দেয়ালে তারা বন্দি। তাই আমাদের কাহিনীও সময়ের কাছে সমর্পিত।

    ৩. রাজধানীর গলি

    রাজধানীর অসংখ্য গলির মাঝে আজ সন্ধ্যায় তিষাণ হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজেছে সেই পুরোনো বইয়ের দোকানটা যার মালিক তাকে ছয় শতাব্দী আগের একটি সংখ্যাতত্ত্বের বই দেখাবে বলেছিল। গতকাল সন্ধ্যায় এক চায়ের দোকানে তার সাথে তিষাণের আলাপ হয়েছিল। অনেক কথা হয়েছে তার—বিজ্ঞানের ইতিহাস, চিরায়ত আধ্যাত্মিকতা, অতীতের দিগ্বিজয়ী নৃপতির নৃশংসতা ইত্যাদি। সে তিষাণকে বলেছিল তার কাছে পুরাতন গণিত-সাহিত্যের কিছু সংগ্রহ আছে।

    রাজধানীতে বড় হয়েও সেই শহরের বিশালতা সম্বন্ধে তিষাণের কোনো ধারণা ছিল না। গত পঁচিশ বছরে রাজধানীর জনসংখ্যা বেড়েছে পাঁচগুণ। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে শহরতলীতে উপচে পড়েছে মানুষ, বেখাপ্পা অপরিকল্পিত দশ-কুড়িতলার বাড়ি দখল করে নিয়েছে পাঁচ বছর আগের ফাঁকা জমি। তাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ছোট গলি যার বেড়াজালে এই শহরে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা নেই। কেউ জানে না সেই বেড়াজালের মানচিত্র। ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি কোনাকে মানচিত্রে আবদ্ধ করে আজ জরিপবিভাগ শহরের গলির কাছে পরাজিত। পর্যটকেরা সাহস পায় তার সংকীর্ণ পরিসরে ঢোকার।

    এক অন্ধকার গলির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে তিষাণ। রাস্তার বাতি জ্বলে তার মাথার অনেক ওপরে, দিনের ধোঁয়া ঠাণ্ডায় নেমে আসে সব আবছায়া করে। কোন অদৃশ্য অন্ধকার গলি থেকে ভেসে আসে অস্ফুট অশরীরী বাজনা। মাটির গন্ধের সঙ্গীত এক নিরাবয়ব স্পন্দিত কণ্ঠের পরিব্যাপ্তিতে তিষাণকে মূহ্যমান করে রাখে। একটা ছোট খাবারের দোকানে ঢোকে সে, এক কাপ চা নিয়ে বসে পরবর্তী পদক্ষেপ ভাবতে।

    আবারো এক মাটির সঙ্গীত ভেসে আসে রেস্তোরাঁর জানালা পেরিয়ে। তিষাণের মনে হয় এই রেস্তোরাঁতেই গতকাল দেখা হয়েছিল সেই পুস্তক-বিক্রেতার সাথে, অথচ সেই রেস্তোরাঁ ছিল শহরের অন্যপ্রান্তে। মনে হয় এই সমস্ত ঘটনাই আগে ঘটেছে, কোনো এক অতীতে, এটা শুধু de-ja vu নয়, এই বোধ যেন তাকে বলে দিচ্ছে এরপর কী ঘটবে। দূর গলি থেকে ভেসে আসে করুণ গানের সুর, ভারি করে দেয় তিষাণের হৃদয়। তার নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত চোখ অতীতের দূরাকাঙ্ক্ষার রাস্তায় বিচরণ করে যেখানে ধোঁয়ায় কুণ্ডলী আবর্তিত হয় গলির ছোট করিডোরে — আর এক জগতে আর এক মাত্রায় — যা মিশে যায় তার উষ্ণ চায়ের বাষ্পে। সময়ের গতি অধিকার করে তার মন। চা শেষ করে রাস্তায় বেরিয়ে সে হেঁটে যায় গলির কুয়াশায় —আর এক জগতে আর এক মাত্রায়।

    গলির কুয়াশা জমাট বেঁধে আসে, তার শেষ প্রান্তে হলুদ বাতি জ্বলে অন্য বোধের ইশারায়। হঠাৎ কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে আসে তিনটি চেহারা, আলোর ব্যাপ্ত প্রতিফলনে তাদের শরীরের রূপরেখা মিশে যায় কুয়াশার পার্থিব নীহারিকায়। ফিরে তাকায় তিষাণ গলির অন্যপ্রান্তে — সুরঙ্গের প্রবেশপথ যেন চাঁদের অদৃশ্য পিঠ, পালানোর উপায় নেই। de-ja vu-এর শত প্রপঞ্চে আবারো তিনটি চেহারা এগিয়ে আসে নিশ্চিত পদক্ষেপে। তাদের প্রতিটি আচরণ তার চেনা। ঘটনার পৌনঃপনিকতা তাকে বেদনার হতাশায় ম্রিয়মাণ করে দেয়।

    অনেক দূরে গলির শেষ প্রান্তে হলুদ বাতি জ্বলে। তিনটি অশরীরী শরীর ঘিরে ধরে তিষাণকে। তাদের মধ্যে একজন, যাকে সে কর্ণিক বলে জানে, পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে আনে। কর্ণিকের কণ্ঠস্বর মৃদু কিন্তু দৃঢ় — "আবার আমাদের দেখা হলো তিষাণ। অথচ তোমাকে আমি বলেছিলাম এই পাড়া থেকে দূরে থাকতে।"

    তিষাণ জানে কর্ণিককে উত্তর দেয়া বৃথা। যতবারই সে এই শহর থেকে পালাতে চেয়েছে ততবারই অদৃষ্ট ফিরিয়ে এনেছে তাকে কর্ণিকের গলিতে। প্রতিবারই সে নিজেকে আবিষ্কার করেছে তার ছুরির সামনে। সময়ের চক্রে কর্ণিক, তার ছুরি, এবং তিষাণ রাজধানীর গলির ধোঁয়ায় এক ছকের আবৃত্তিতে নিমগ্ন থাকে।

    তাই এবারো কর্ণিক আলতো করে তার পেটে ছুরিটা ঢুকিয়ে দেয়, ঠাণ্ডা ধাতুর স্পর্শে মাংসপেশীতে টান পড়ে। কর্ণিকের চোখ অন্ধকারে দেখা যায় না, তার দুই সঙ্গী নির্বাক নিস্পন্দ থাকে, তারা মানুষ নয় যেন, দুটো প্রেত। কোনোরকম ব্যস্ততা ছাড়াই কর্ণিক ছুরিটা বার করে আনে। একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা পেটের নিচে পাক দিয়ে আছড়ে পড়ে মস্তিষ্কে। নতুন রক্তে ভিজে যায় জামা, সেঁটে যায় গায়ের সঙ্গে। শরীর উন্মুক্ত হয়ে যাবার ভীষণ যন্ত্রণায় বিবর্ণ হয়ে যায়, নতজানু হয়ে বসে পড়ে তিষাণ।

    তারপর কর্ণিক চলে যায় তার দুই সঙ্গী নিয়ে গলির সীমানা ছাড়িয়ে — টিমটিমে হলুদ নক্ষত্রলোকে। তাদের জীবনে তিষাণের স্থান নেই। এই বিশাল শহরের লক্ষ উপগলির নায়কেরা তাদের যাযাবার ক্ষেত্রে কোনো অপরিচিতকে বাঁচিয়ে রাখে না।

    ধুলোর ওপর রক্ত কোথাও জমাট বাঁধে। ওপরে, অনেক ওপরে বোধহয় দেখা যায় একফালি রাতের আকাশ, নক্ষত্রবিহীন, ধোঁয়াশে ফ্যাকাশে মহানগরীর নিয়ত আলোর প্রতিবিম্বে। তার নিচে দশ থেকে কুড়ি তলার বাড়ি, তার জানালায় জানালায় আলো, দেখা যায় মানুষের ছায়া। সেইসব মানুষ চোখে দেখে না, বধির। তাদের দেহ-মন যেন বদলে দিয়েছে ভিন-গ্রহের আগন্তুকেরা, উপহার দিয়েছে টেলিভিশন সেট, ভিডিও ফোন, আপাতদৃষ্টির বাস্তবতা যন্ত্র। পৃথিবীর কোনায় এই কালরাতে তাদের সাহায্যের আশা করা বৃথা। তারা সবাই বসে আছে ঈশ্বর প্রেরিত দূতের অপেক্ষায়। কিন্তু কোথায় যেন দূত বসে থাকে ঈশ্বরের অপেক্ষায়, ঈশ্বর খোঁজে মহাঈশ্বর আর মহাঈশ্বর সময় জয় করার অভিলাষে অতিক্রম করতে চায় মহাকালকে। কিন্তু মহাজগতের অমোঘ কালের গতি ও বন্ধন – মানুষ ও মহাঈশ্বরের অভিলাষকে বিচূর্ণ করে – বিচরণ করে স্থান-কালের বিস্তৃতিতে। আর পৃথিবীর কোনায় মহানগরীর লোকেরা সময়ের বোধ ছাড়া বসে থাকে নিতান্তই নির্বোধ হয়ে।

    ৪. তুরায়

    রাজধানীর বিশাল শহরতলীর মাঝ দিয়ে চলে তুরা এক্সপ্রেস। তার এক কামড়ায় আর এক দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা থেকে জেগে ওঠে তিষাণ। দুহাত দিয়ে চেপে ধরে সে পেট, কিন্তু কর্ণিকের আঘাতের চিহ্ন মিলিয়ে গেছে কোথায়। জানালার ওপাশে এক শহরতলীর আবছা আলো দ্রুত সরে যায় পেছনে। স্বপ্ন ও বাস্তবতা একসাথে মিলিয়ে যায় দূর অন্ধকারে। কতবার কর্ণিকের ছুরির সম্মুখীন হয়েছে সে জানে না। জাড্যরেখায় ছুটে চলে ট্রেন আলোর গতিতে, জীবনের মুহূর্তের পুনরাবৃত্তি করে।

    তার মন অনেক অতীতে ভ্রমণ করে। শৈশবের ক্ষণস্থায়ী চিত্রণ, দুরন্ত বালকের দৌরাত্ম্য, মা-বাবার স্নেহ, গ্রামের শীতের সকাল, পল-অনুপল কৈশোরের স্মৃতি, প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা, অসংখ্য ভুল সিদ্ধান্তের আবছায়া জাল হাতের মুঠোর আঙুলের ফাঁক দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়। এরপর আসে যুদ্ধের স্মৃতি, অসিতোপলের নির্দেশে সে দিতার কাছ থেকে একটি ঘড়ি নিয়ে এসেছিল, সেই ঘড়িটি চিতাদের বিরুদ্ধে সমতলের মানুষকে জয়ী হতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এর সঙ্গে একটা বেদনাবোধ জড়িয়ে আছে। রাতের ধাবমান ট্রেনের কাচের জানালায় বৃষ্টির জল ঝরে পড়ে। জানালায় মুখ লাগিয়ে পড়তে চায় সে না-থামা স্টেশনের ঝাপসা নামফলক, স্মৃতির স্টেশন থাকে থামতে দেয় না। ট্রেন থামানোর সুযোগ থাকলে সে নেমে সঙ্কেত বদলে দিত, এই লাইনে তার ভ্রমণ করার কথা নয়। এক অসীম ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

    পরদিন সকালে তার ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন রাজধানীর শহরতলী অনেক পেছনে, এক মৃদু সর্পিল গতিতে গিরিখাত ধরে চলে ট্রেন। দু-পাহাড়ের মাঝে ধেয়ে আসা বাতাসে ট্রেন কাঁপে। গাছের মাথা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে খাড়া লাল পাথরের দেয়াল উঠে গেছে— আকাশের প্রান্তে সেই দেয়ালের ওপর ধূসর প্রস্তরখণ্ড ছড়ান। মুহূর্তের জন্য তিষাণের মনে হয় সেই খাড়াই দেয়ালের ওপর বিন্দুবৎ কোন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলকে সেই মানুষ মিলিয়ে যায়। মনের ভ্রম?

    তুরায় ট্রেন থামলে সে নামে সবার পরে। প্ল্যাটফর্মে দূরে সে দিতাকে বসে থাকতে দেখে। ভিনদেশী গুঞ্জনের ভেতর সেই পরিচিত মুখ দেখে তিষাণ স্তস্তি বোধ করে, অনেকক্ষণ সে ভ্রমণ করেছে অবাস্তবতার সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে। দিতার ঋজু শরীর বাতাসে ভর দিয়ে এগিয়ে আসে, একরাশ হাসি ঠোঁট ছাড়িয়ে চোখে ফুটে ওঠে। জিজ্ঞেস করে "শেষ পর্যন্ত তোমার তুরায় আসা হলো?"

    পাঁচটি বছর কেটে গেছে দিতাকে শেষ দেখার পরে।

    সন্ধ্যার বাতাস ঠাণ্ডা নিয়ে আসে পাহাড় থেকে। প্ল্যাটফর্মে বাতি জ্বলে ওঠে। যুদ্ধের সময় নয় এটা, তবু তিষাণের মনে হয় তুরায় ঘোষণা করা হয়েছে সান্ধ্য-আইন, ব্ল্যাক-আউট। আবারো দিতার হাসিমুখ তাকে স্বস্তির পরিসরে নিয়ে আসে।
    "অনেক লম্বা পথ তোমাদের এখানে আসতে। আমি তো ভাবলাম ট্রেন পাহাড়ের চড়াইয়ে উঠতেই পারবে না,” হাত বাড়িয়ে দিতার সাথে করমর্দন করে সে।

    "আর আমি এই লম্বা পথ কতবার পাড়ি দিলাম বলো। তোমার রাজধানীর লোকেরা বড় আরামপ্রিয়। আমাদের পাহাড় তোমার ভালো লাগলো না?”
    "বেশ লাগলো। কিন্তু আমার ধারণা ছিল না রাজধানীর শহরতলী কত বড়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন চলল সেই জনপদের মধ্যে দিয়ে।”

    দিতা একটু সময় নেয় উত্তর দিতে। ভেবে নেয়। বলে, “পৃথিবীর লোককে তো কোথাও থাকতে হবে।"

    নিশ্চয়। রাজধানীর শহরতলীর অন্ধকার গলিতে তিষাণের মন হারিয়ে যায়।

    দিতা তাকে নিয়ে আসে বাগানবাড়িতে। পথে যেতে যেতে তিষাণ তুলনা করে রাজধানীর সঙ্গে তুরাকে। একসময় ছিল যখন তুরাকে সুখের শহর বলা হতো, রাজধানী লোকেরা তুরাকে ঈর্ষা করতো, অনেকেই বেড়াতে আসতো তুরার বিশাল উৎসবে অংশগ্রহণ করতে। তারপর পনেরো বছর আগে চিতাদের আক্রমণে তুরা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে তুরাবাসীরা তাদের অতীত সুখকে উদ্ধার করতে পারে নি।
    মনে হয় তারা এক বিশাল শূন্যতায় পূর্ণ, পনেরো বছর আগে কোন রক্তিম দিনে তার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি হারিয়েছে। এক প্রচণ্ড গ্রীষ্মের খরায় তুরার রাস্তায় ধুলো উড়ছিল, ঢেকে দিচ্ছিল পলেস্তারা খসা-বাড়িগুলোকে যার অধিবাসীরা বাইরে জটলা বাঁধছিল কোন নির্দিষ্ট নিজেদের বাঁধতে না পেরে।

    শহরের এক প্রান্তে দিতার বাগানবাড়ি। তুরা শহরের রুক্ষতার এক বিরুদ্ধ চিত্র হচ্ছে দিতার ঝলমলে বাগান। তার গাছের ঘাসের সবুজে, ফুলের রঙে তিষাণ মুগ্ধ হয়ে যায়, অগাধ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, "কেমন করে তুমি এই বাগান এতো সুন্দর করে বাঁচিয়ে রেখেছ?" দিতা হাসে, তার চোখের কালোতে যে বেদনাটুকু মুহূর্তে এসে উবে যায় তিষাণের কাছে তা অলক্ষিত থাকে। পুকুরের কাছে এলে নিচু হয়ে বসে দিতা জলে হাত ডোবায়, চক্রাকারে, ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে তরল তলে। তিষাণের দিকে মুখ তুলে সে যখন তাকায় তার মুখে কৌতুক, তারপর বলে, "ভালোবাসায়।” তারপর বলে, “আসলে না, ভালবাসায় এই বাগান বাঁচেনি, এই বাগান মরে যাচ্ছিল, তারপর …।” এটুকু বলে দিতা থেমে যায়। দিতাকে বুঝতে চায় তিষাণ, ভাবে, অপেক্ষা করতে হবে তাকে।

    পুকুরের এক পাশে একটি ছোটো বাঁশের ঘরে ঢোকে তারা। তিষাণ বুঝতে পারে না কোথায় বসবে। দু-তিনবার মাঝখানে জড়ো করে রাখা চেয়ারগুলোর চারদিকে ঘুরপাক খায়, তারপর এক কোনায় গিয়ে মেঝের ওপর আসন করে বসে। দিতা একটু অবাক হয়ে চাইলে সে মৃদু হাসে। বলে, "ভূকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ খুঁজছিলাম।"

    "পেলে?" দিতা প্রশ্ন করে আধোকৌতুকে।

    "বোধহয় না। কেন্দ্রের শক্তির অক্ষির সঙ্গে যোগাযোগ তখনই সম্ভব যখন সমস্ত ইচ্ছাকে বিসর্জন দেয়া যাবে। আমার এখনো অনেক শখ আছে।"

    "তুমি যে এরকম দার্শনিক সেটা প্রথমে দেখে আমার মনে হয় নি।"

    তিষাণ আবারো হাসে, "দৃষ্টির ওপর আস্থা রাখতে নেই। তোমাকে দেখে কি আমার মনে হয়েছিল তুমি এত ভালো মালিনী? আর দৃষ্টির বাইরের দর্শন কিছুটা আমার বানানো। তার সত্যতা যাচাই করা সহজ নয়। তোমাকে একটা কাহিনী বলার আছে, সে কাহিনী একাধারে বাস্তব ও অবাস্তব, তার ঘটনার অনুক্রম নেই, অথচ আমার শরীর ও মন তার মাঝ দিয়ে গেছে। অন্তত তাই আমার মনে হয়।”

    কৌতূহলী দিতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সামনে বসে। তিষাণ বলে, "আমি প্রায়ই একটি স্বপ্ন দেখি, অথচ জোর দিয়ে বলতে পারবো না সেটা শুধু স্বপ্নই। শেষবার সেটা দেখেছি গতকাল, ট্রেনে। প্রতিবারই নিজেকে আষ্কিকার করি রাজধানীর শহরতলীর এক অন্ধকার গলিতে পথ হারিয়ে, প্রতিবারই আমি সম্মুখীন হই পাড়ার উন্মুত্ত যুবকদের সামনে, তাদের সঙ্গে কোনো যুক্তিতর্ক করা চলে না। কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাদের দলনেতা, যাকে আমি কর্ণিক বলে চিনেছি, আমাকে আঘাত করে ছুরি দিয়ে। তারপর তারা অদৃশ্য হয়ে যায় অন্ধকারে। আমি পড়ে থাকি রক্তাক্ত গলির মাটিতে।”

    এক বিপর্যস্ত মায়ায় দিতার দুটো ভুরু কুঁচকে ওঠে। তিষাণকে সে চেনে না ভালোমতো, কিন্তু তিষাণের কথার মাঝে কোনো তির্যকতা নেই, সহজেই তার সাথে একাত্মতা বোধ করে দিতা।

    তিষাণ বলে চলে, "ব্যথায় অবশ হয়ে যাই আমি, কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ বেরিয়ে আসে না কোনো বাড়ি থেকে। যুদ্ধোত্তর সময়। জনসংখ্যার চাপে, জীবনধারণের সঙ্কটে মানুষ হারিয়েছে সাধারণ বোধ। কোনোরকমে ছেঁচড়ে আমি গলি থেকে বেরিয়ে আসি বড় রাস্তায়। সেখানে ছিল অনেক মানুষের ভিড়, কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করে না। বরং তারা ঘিরে দাঁড়ায় আমার চারদিকে অনেকটা তামাশা দেখার জন্য। আমি ছিলাম ডাঙায় তোলা মাছ, আমার অসহায়ত্ব তাদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না।

    "অবশেষে আমি এক ট্যাক্সির সন্ধান পাই, কিন্তু চালক আমাকে সাহায্য করে না গাড়িতে উঠতে। পেছনের সিটে উঠে গা এলিয়ে দিতেই সে আমার পকেট হাতড়ে যা টাকা ছিল নিয়ে নেয়। তারপর প্রশ্ন করে, ‘হাসপাতাল?’ আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিই, তারপর চেতনা থাকে না।

    "আমার সংজ্ঞা ফিরে আসে চালকের ক্রূঢ় সম্ভাষণে, হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে। এবারো আমাকে কেউ সাহায্য করে না। কোনোরকমে ভেতরে ঢুকে এক খালি বিছানায় শুয়ে পড়ি। কোনো ডাক্তার বা সেবিকা আসে না আমার কাছে। আবারো আমি চেতনা হারিয়ে ফেলি।

    "চেতনা যখন ফিরল তখন বড় জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়ছে। প্রথমে মনে হলো পুরোটাই স্বপ্ন, কিন্তু পরক্ষণেই পেটের ব্যথাটা প্রচণ্ড পাক দিয়ে মাথায় আছড়ে পড়ল। আমি হাত দিয়ে বুঝলাম রাতে কেউ ওপর দিয়ে আলগাভাবে সেলাই করে দিয়েছে, কিন্তু তাতে ভেতরের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। এরপর হাসপাতালে থাকার কোনো মানে ছিল না। আমি ভাবলাম শহরে আমার বাসায় যদি পৌঁছাতে পারি তবে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাব গ্রামে মা-বাবার কাছে। হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। ভর দুপুরে লোকজন পার্কে বসে বড় পর্দায় ছবি দেখছে। অ্যাবসার্ড! আর কি দেখছে জানো? সুখের ছবি। বিশার সবুজ ফুলে ভরা উপত্যকা নীল পাহাড়ের পাদদেশে। অদ্ভুত! তার মাঝেই একটি লোক আমার পকেট কাটার চেষ্টা করলো। তার হাত আমি ধরে ফেললাম, কিন্তু সে একটা বিষণ্ণ হাসি হেসে হাত ছাড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে চলে গেল।

    "বাস ধরতে ধরতে বিকেল হয়ে গেল। সেই বাস দু’ঘণ্টা ধরে শহর আর শহরতলীর রাস্তা ঘুরে আমার বাসার কাছে এক গলিতে যখন আমাকে নামিয়ে দিল তখন সন্ধ্যার অন্ধকার জমাট হয়ে এসেছে। আমার ব্যথাটা সারাদিন ধরে এক তীক্ষ্ণতার দিকে ভ্রমণ করেছে। হাতে বেশি সময় ছিল না, জিনিসপত্র নিয়ে আমাকে মাঝরাতের ট্রেন ধরতে হবে।

    "কিন্তু অত চেনা গলিটা আমার জন্য হঠাৎ অচেনা হয়ে গেল, আমি বাসার পথ খুঁজে পেলাম না। আর একটি মোড় ঘুরতেই সেই জটলা পাকানো কুয়াশার মাঝে তিনটি চেহারা বেরিয়ে আসে। আবারো আমি শুনি কর্ণিকের কঠিন স্বর – ‘তোমাকে আমি কত বার নিষেধ করেছি এই পাড়ায় আসতে।’ এক বিশাল বেদনাবোধে আমি নতজানু হয়ে তাদের সামনে বসে পড়ি।"

    তিষাণ মাটি ছেড়ে উঠে জানালার কাছে যায়। ঘরের দুটো মৃদু বাতিতে একটা বিশাল ইউক্যালিপটাস আবছায়া ছায়া ফেলে দূরের মাঠে। মাঠের অন্যদিকটি মিশে গেছে অন্ধকারে। সেদিকে তাকিয়ে তিষাণ বলে, "আমার স্বপ্নের শেষ এখানেই। এবার আমি বোধহয় হাত থেকে পালাতে পারি না। আমার দেহ পড়ে থাকে সেই অন্ধকার গলিতে ধোঁয়ার নিচে। এই স্বপ্নটা দেখি প্রায়ই। দু-একটা খুঁটিনাটি বাদ দিলে ঘটনার অনুক্রম বদলায় না।"

    দিতা তাকায় তিষাণের চোখে, সে বিচলিত হয়েছে এই কাহিনী শুনে। জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি অনুভব করেছ সেই আঘাতের যন্ত্রণা? তোমার কি মনে হয়েছে সেই সবকিছু স্বপ্ন নয়?"

    তিষাণ বলে, "যতবারই আমি এর মধ্য দিয়ে গেছি সেই আঘাতের তীক্ষ্ণতা আমাকে অবশ করে দিয়েছে। ঘটনা পরম্পরা আমার আগে থেকেই জানা, কিন্তু তাকে বদলাতে পারি না কোনো মতেই, শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও। যখন আমি ফিরে আসি এই বাস্তবে এক বিশাল অসহায়ত্বে ভরে থাকে মন।"

    দিতা উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে যায়। তিষাণের ব্যথার পরিমাপ করতে গিয়ে তার মন এক সহমর্মিতায় ভরে ওঠে, তিষাণ তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়। মাঠের দিকে তাকিয়ে দিতা বলে, "কর্ণিকের কথা তুমি ভুলে গেছ তিষাণ। তোমার স্বপ্নের কর্ণিকের কথা বলছি না। পনেরো বছর আগে আর এক কর্ণিক ছিল, চিতা সেনাবাহিনির অফিসার, তার ওপর দায়িত্ব ছিল ধরা-পড়া পার্টিজান যোদ্ধাদের টর্চার করা।”

    যুদ্ধের দশ বছর পরে তিষাণকে তুরার মাঠে পাওয়া যায়, তিষাণ যুদ্ধের সময় এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিল, কিন্তু সেটি করতে গিয়ে তার জীবন থেকে দশটি বছর হারিয়ে গিয়েছিল।

    দিতা বলতে থাকে, “আমাদের দৃশ্যমান জগৎ বদলে যাচ্ছে তিষাণ। এই পরিবর্তন আমাদের বোধের বাইরে, হয়তো সময়ের ঊর্ধ্বে। চিতাদের হাত থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি, কিন্তু প্রকৃতি যখন অস্থিত হয় তার থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। কিন্তু এখন এমন যেন শুধু প্রকৃতি নয় মহাবিশ্বের স্থান-কালের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। জীবনের অন্য তলে আজ আমরা অনুভব করি অতিজৈবিক অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা, চেতনার উত্তরণে আমরা চেষ্টা করি এই দৃশ্যজগতের পশ্চাদপটের ভিত্তিকে অনুধাবন করতে। সেই চেষ্টা চারিদিকে দৃশ্যমান মায়াজাল ভেদ করার প্রচেষ্টা, কিন্তু যদি আমরা তাতে সফল হই, আমরা যদি এই আপাতদৃষ্ট জগতের প্রেক্ষাপটকে বুঝতে সক্ষম হই হবে সেই অনুভূত বোধ আমাদের অনুসরণ করে এই সাধারণ জগতকে বদলে দেবে—বাস্তব ও অতিবাস্তবের যোগসূত্রে আমাদের জীবন যাবে বদলে।"

    দিতার কথা বুঝতে তিষাণের অসুবিধা হয়। কিন্তু সে জানে দিতাম উচ্চারণে যুক্তি আছে, আছে দৃঢ় প্রত্যয়, তাই সে নিজেকে সময় দেয়। জানালার কাছ থেকে সরে এসে দিতা চেয়ারে বসে। তারপর বলে, "প্রকৃতি যে বদলাচ্ছে তা তো আমরা দেখছিই, তিষাণ। প্রচণ্ড গ্রীষ্মে জলের অভাবে ধুঁকছে তুরা। তুমি নিজেই এসেছ তুরার জন্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে। বৃষ্টি হয় নি কতোদিন বলতে পার? হয়তো আমরা প্রকৃতির পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে গলে যাচ্ছি সময়ের ফাঁকে?"

    এবারো তিষাণ বোঝে না দিতাকে। প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে তার শহরতলীর গলির স্বপ্নের সাথে কোনো যোগসূত্র দিতা খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু সেই সূত্র তিষাণকে এড়িয়ে যায়।

    সেই রাতে তুরা শহরের এক পুরোনো হোটেলে তিষাণ ঘুমায় আর এক বিপর্যস্ত স্বপ্নের মাঝে। স্বপ্ন দেখে পনেরো বছর আগের যুদ্ধের। রাজধানী থেকে পালাচ্ছিল সবাই মিলে। অসংখ্য শরণার্থীর সারিতে হেঁটে যাচ্ছিল তিষাণ ও ক্রান্তিক। পেছনে জ্বলছিল দুঃস্বপ্নের শহর রক্তিম শিখায়। চিতাদের বিশাল সামরিক অভিযানে ভেঙে পড়েছিল নাগরিক জীবন। অসংখ্য মৃতদেহে ভরে গিয়েছিল শহরের সঙ্কীর্ণ গলি। পালাতে হবে তাদের, পালাতে হবে এই দুঃস্বপ্ন থেকে। কিন্তু সব স্বপ্নের মতোই তিষাণের মন এক বিশাল ভারে আক্রান্ত ছিল সেই পলায়নদৃশ্যে। তার পা যেন ভারি হয়ে গিয়েছিল বিশাল লোহার শৃঙ্খলে। স্বপ্নের মধ্যে যেমন হয়।

    হঠাৎ অন্ধকারে উল্টো দিক থেকে প্রায় যেন বাতাসে ভর করে আসে এক দল কালো আলখাল্লা পরা মানুষ। অতি দ্রুত চলে যায় তারা সেই ধ্বংসের শহরের দিকে। তাদের মুখ ছিল ঢাকা, কিন্তু তাদের চলন ছিল স্পষ্ট। এক বিভীষিকায় ভরে যায় তিষাণ। কিন্তু ক্রান্তিক ঘুরে দাঁড়ায়, হাঁটতে শুরু করে শহরের দিকে। তিষাণ তাকে ফিরাতে যায়, কিন্তু খুঁজে পায় না। এক পলকে ক্রান্তিক উধাও হয়ে যায়।

    ৫. নিষাদ

    তিষাণকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে দিতা বাড়ি ফিরে আসে। শোবার আগে বাগানের দিক থেকে একটা শব্দ শোনে সে, দিতা বারান্দায় বেরিয়ে আসে। দূরে বাগানের সেই ছোটো পাথরটির ওপর বসে ছিল নিষাদ। শুক্লা তিথির চাঁদের উপচে পড়া আলোয় তার দীর্ঘ ছায়া মিশে থাকে অন্ধকার ঘাসের সাথে। সেই ছায়া আজ দিতার মনে হয় পরিচিত। নিচে নেমে দিতা নিষাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

    নিষাদের মুখ উত্তরমুখী, সে দিতার দিকে না তাকিয়েই বলে, "তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে, দিতা। তোমার কাজ এখানে শেষ।"

    প্রথম দিনের মতো আবারো দিতা চমকে যায়। এই অজানা লোকটি তাকে কোন একটি প্রস্তাব দিচ্ছে যেন সে দিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়। নিষাদই তার হয়ে যেন উত্তর দেয়, "তুমি নিশ্চয় ভাবছ কী অদ্ভুত এই প্রস্তাব! কিন্তু আমরা বাস করছি এক অদ্ভুত সময়ে যখন যা-কিছু অটল অনড় বলে ভাবা হত তা ভেঙে যাচ্ছে সমস্ত বোধকে বদলে দিয়ে। আর নতুন বোধকে আকৃতি দিতে যে কাঠামো তৈরি হচ্ছে সেটি বর্তমান স্থান-কালের বাইরে। তোমাকে আমি একটা সুযোগ দিচ্ছি সেই নতুন কাঠামোর অংশীদার হতে।"

    দিতা যেন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে নিষাদের কথা। এ আর এক ধরনের বোধোদয়। অস্ফুট স্বরে বলে, "বর্তমানে যা আছে তা বুঝতেই আমার এই জীবন যাবে। এর বাইরে বা ভেতরের ভিত্তি বোঝার সময় আমার নেই।"

    এক বিশাল অট্টহাস্য প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে পুকুরের ঐ পাশের বাঁশঝাড় থেকে। হাসিতে নিষাদের মুখ বিকৃত হয়ে যায়। এই প্রথম একটা বিভীষিকাবোধ দিতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, কিন্তু সে বোঝে সহজে পালানোর কোনো রাস্তা নিষাদের হাত থেকে নেই। নিষাদ বলে, ‘নির্বোধ মানব তুমি, অন্য দশ-পাঁচটির মতো। তোমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বিরাট জিনিসকে অনুধাবন করতে পারে না। আমি তোমার দক্ষতায় আস্থা রেখেছিলাম, তুমি নিরাশ করলে। আমি এখানে বসে তোমাকে মত পরিবর্তন করানোর চেষ্টা করব না। সেই সময় বা ধৈর্য আমার নেই। এক অর্থহীন বর্তমানে তোমার বাস, সেই বর্তমান ভঙ্গুর, ক্ষণস্থায়ী, আধারহীন। তোমার যুক্তি ও বুদ্ধি সেই বর্তমানেরই ফসল, সীমাবদ্ধ ও অদূরদর্শী।"

    পাথর থেকে উঠে নিষাদ বাগানের গভীরে যেতে থাকে। দিতা জানে সে অন্তর্হিত হবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। দিতা অনেক প্রশ্ন করতে চায় কিন্তু সাহস হয় না। নিষাদ প্রতিবারের মতোই দিতার মনকে সরাসরি সম্ভাষণ করে, "তোমার বাগান ও তুরা শহর, তোমার বন্ধু ও আত্মীয়রা, তোমার জাগতিক মাধ্যম সমস্তই এক সঙ্কীর্ণ বর্তমানে। তুমি ভাব বর্তমানকে জানলেই অতীত ও ভবিষ্যৎ অলৌকিকভাবে নিজেদের উন্মোচিত করবে। তুমি ভাব সময় হচ্ছে গাছের বীজ, যার মাঝে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ ও অতীতের মহীরুহ। তুমি ভাবো না বীজ থেকে গাছ ছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে। দিতা, তোমার যুক্তি ও শিক্ষা এমন সময়ের কাছে হার মানাবে যা তোমার বোধের বাইরে।”

    গাছের আড়ালে নিষাদ প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়, তবু তার ভরাট স্বর ঘন অন্ধকার ছাপিয়ে দিতাকে শিহরিত করে তোলে, "আমি চলে যাচ্ছি, দিতা। উত্তরে, পাহাড়ে। এই গ্রীষ্মের শেষ এত সহজে হবে না। তোমার বাগানও শেষাবধি বাঁচবে না। কিন্তু সেটা খুব প্রয়োজনীয় নয়। বাগানের মতো তুচ্ছ একটা জিনিস নিয়ে তুমি কালক্ষেপ করো না। যদি বুদ্ধিমান হতে তোমার জন্য অবারিত জগৎ অপেক্ষা করতো। ঠিক এই সময়টা মনে রেখো, দিতা, তোমার জগৎ এই সময় থেকে কখনই আর এক হবে না – যেমন আমার জগৎ বদলে গিয়েছিল ত্রিশ বছর আগে, দুলারী নদীর ওপরে এক জলযানে।"

    নিষাদের কথা গাছের পাতার শিরশির শব্দে মিলিয়ে যায় দিতাকে নিষ্পন্দ রেখে। চতুর্দশীর ভরাট চাঁদ হেলে পড়ে পশ্চিমে হলুদ চক্রে গাছের পাতাকে চমকে দিয়ে।

    দুলারীর কথা শুনে দিতা চমকে যায়। ত্রিশ বছর আগে দুলারীর বুকে এক জলযান দুর্ঘটনায় তার মা ও তাকে অসিতোপল উদ্ধার করেছিল, কিন্তু নিষাদ নামে এই মানুষটি কে? তারপর মনে পড়ে – নিষাদ বলেছিল তার আর একটি নাম আছে – ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন, সেই জলযানের পরিচালক। তার কথা পিতা অসিতোপলের কাছ থেকে শুনেছে সে, দুর্ঘটনার পরে তাকে আর পাওয়া যায়নি।

    ৬. তুরার খরা

    সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্রান্তিকের কথা ভাবে তিষাণ। ক্রান্তিক পার্টিজান যোদ্ধা ছিল, চিতা বাহিনির হাতে ধরা পড়ে, তাকে চিতারা টর্চার করে মেরে ফেলে। কর্ণিক? কর্ণিকই ক্রান্তিককে হত্যা করে। এখন সব মনে পড়ে তিষাণের। আজ পনেরো বছর পরে ক্রান্তিকের অনুপস্থিতি অনুভব করে সে। কিন্তু স্বপ্নের কালো আলখাল্লার মানুষেরা কারা ছিল? কী ছিল লুকোনো তাদের ঘোমটার পেছনে? রাতের ছুরিধারী কর্ণিক আর দুঃস্বপ্নের আঙরাখা পরা মানুষের অভিযান কি আর এক বাস্তবতার জগতে? – যে জগতের সঙ্গে তার জগৎ মিশছে এক সমচ্ছেদে? সব জগৎ থেকে কি সময়ের বাঁধন ঢিলে হয়ে যাচ্ছে?

    সকালের এক চিলতে উষ্ণ সূর্য হলদে পর্দার ফাঁক দিয়ে মেঝের ওপর ছড়িয়ে থাকে। আর্দ্র বাতাসে পর্দা নড়ে, গুমোট গরম পড়বে আজ, ভাবে তিষাণ।

    পোশাক পরে, তৈরি হয়ে সে যখন পৌঁছায় পৌরসভায় নতুন মেয়র পদপ্রার্থী বক্তব্য শুরু করেছে। তুরা শহরের পৌরসভার নির্বাচন হবে খুব শীঘ্রই। তুরার অনেক সমস্যা, রাজধানী থেকে তুরা অনেক দূরে। রাজধানীর সময় নেই দূরের তুরার সমস্যার সমাধানের। আজ পৌরসভার বক্তৃতায় আমন্ত্রিত হয়েছে রাজধানীর কয়েকজন প্রকৌশলী, তাদের মাঝে তিষাণও রয়েছে। তাদের নিয়ে এসেছে নতুন মেয়র পদপ্রার্থী। তার উচ্চকণ্ঠে হলের ভেতর গম গম করতে থাকে, "বন্ধুগণ, আবার আমাদের শহর অসুখে ধুঁকছে। আমাদের তরুণেরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে কাজের খোঁজে। রাজধানী আমাদের সাহায্য করতে অপারগ। ইতিহাসের সর্বকঠিন খরায় আমাদের জলের ভাণ্ডার শুকিয়ে গেছে। পাহাড়ের ওপর হ্রদে জল আছে, সেখান থেকে জল নয়ে আসতে হবে। আমি বাধ্য হয়েছি রাজধানী থেকে প্রকৌশলীদের আমন্ত্রণ করতে। আমাদের মেয়র তার অধীনস্থ প্রকৌশলীদের কী করাচ্ছে আমি জানি না। আমাদের বুদ্ধিমানেরা কী করছেন?"

    সভায় মৃদু গুঞ্জন ওঠে। তিষাণের পাশে গুরুত্বপূর্ণ মুখ নিয়ে এক প্রকৌশলী পাহাড়ের ওপর থেকে নিচু ভূমিতে জল বয়ে নিয়ে আসবার মাইলের পর মাইল বিস্তৃত নালার নকশা নিয়ে বসে থাকে। মরুভূমিকে উর্বর করার অনেক পরিকল্পনা তার রয়েছে। এক গুমোট গরমে বক্তৃতা চলে। তিষাণের খাতায় লেখা নম্বর কয়েক বছরের জল দিলেও শেষ শুষ্কতাকে বাঁচাতে পারবে না। গুমোট গরমে সে ঘামতে শুরু করে। তুরার সময় শেষ হয়ে আসছে, বাকি পৃথিবীর ভাগ্য কি খুব একটা পৃথক হবে?

    সভাকক্ষের হলুদ জানালা পার হয়ে সকালের নীল আকাশ ধূসর হয়ে আসে।

    দুপুরের খাবারের সময় সভা ভাঙলে তিষাণ পৌরসভার বাইরে বের হয়। দিতা ছিল বাইরে দাঁড়িয়ে, "তুমি এখানে?" সে বলে। দিতার চোখ-মুখ জুড়ে ছড়ানো উত্তেজনা। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মোছে দিতা, সেই হাত কাঁপে। "তিষাণ, তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।" "কোথায়?" দিতা হাতের মুঠোয় একটা কাগজ মোচড়ায়, ভেবে পায় না কথাটা কীভাবে বলবে, "পাহাড়ে, এখনই।"

    সভার লোকজন পাশ দিয়ে চলে যায়, তিষাণ চোখ কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকায়। দিতাকে সে এখনও ঠিকমত চেনে না, অথচ তার চেনা উচিত ছিল। যুদ্ধের সময় দিতার পিতা অসিতোপল তাকে এক বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিল, দিতার কাছে রক্ষিত একটি ঘড়ি নিয়ে আসার জন্য। তিষাণ সেটি করেছিল, কিন্তু যুদ্ধের অনেক কথাই তার মনে নেই, কারণ যুদ্ধের শেষে সে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল তুরার এক মাঠে। চিকিৎসকরা নির্ধারণ করেছিল তার হয়েছিল রেট্রোগ্রেড অ্যামনেসিয়া। অবশেষে রাজধানীতে অসিতোপল ও দিতার সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন দশটি বছর কেটে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। তারপরে দিতার সঙ্গে আর দেখা হয়নি, অসিতোপলের মৃত্যুর পরে, দিতা তুরায় চলে আসে।

    গতকাল সন্ধ্যায় দিতা নিজ স্বভাবসিদ্ধ বিচক্ষণতায় তার গলির স্বপ্নের কোন অর্থোদ্ধার করতে পেরেছে, অন্তত তিষাণের তাই মনে হয়েছে, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততাকে কতোখানি প্রশ্রয় দেয়া সম্ভব?

    দিতা বোঝে তিষাণের সঙ্কট, বলে, "চল, কিছু খেয়ে নিই।"

    এক অন্ধকার রেস্তোরাঁয় ঢোকে তারা। খাবার শেষ না করবার আগে দিতা একটি কথাও বলে না। তারপর টেবিলের মাঝখানে রাখা শুকনো ফুলের দিকে তাকিয়ে থেকে শুরু করে, "তোমাকে আমি বলেছিলাম আমার বাগানকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি ভালোবাসায়। কথাটা ঠিক নয়। আমার ভালোবাসা হেরে গিয়েছিল এই প্রচণ্ড খরার কাছে। কয়েক মাস আগে আমার শেষ গোলাপ চারাটি যেদিন শুকিয়ে গিয়েছিল সেদিন আমার বাগানে একটি লোক এসেছিল, সে এক অদ্ভুত লোক। তার নাম সে বলে নিষাদ। এমন আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ আমি জীবনে দেখি নি, তিষাণ। তার চোখে ছিল স্ফুলিঙ্গের ঝলক, সাধারণ মানুষের মতো শূন্য নয়। নিষাদ বলে আমার বাগান সে বাঁচিয়ে দেবে। এটুকু বলেই সে চলে যায়। আমি তাকে বুঝতে পারি নি।

    "তারপর সমস্ত তুরা যখন জলের কষ্টে ধুঁকছে আমার বাগান ধীরে ধীরে সজীব হয়ে ওঠে। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারতো, কিন্তু সেই কয়মাস আমি বাগানের কোনো যত্ন করি নি। সমস্ত কেয়া, বকুল, লিলি, ডালিয়া, আর পপি ফিরে এল ঋতুর বাঁধন না-মেনে বিপুল সমারোহ নিয়ে। পোড়া হলুদ রঙ ঝেড়ে ফেলে সবুজ হয়ে এলো ঘাস। মনে হলো তুরা যখন গ্রীষ্মের নিদাঘে চিরকালের জন্য সমর্পিত, আমার বাগান স্থানান্তরিত হয়েছে নাতিশীতোষ্ণ আর্দ্র-মণ্ডলে। তারপর, গতকাল গভীর রাতে সে আবার আসে, আমাকে তার সাথে পাহাড়ে যেতে হবে। সে বলে আমার বাগান আর বাঁচবে না, আর আমি যা-কিছু আঁকড়ে আছি – যা অবলম্বন করে জীবনের অর্থ গড়ছি – তা অতি শীঘ্রই বদলে যাবে। আমি যে তার পুরো কথা বুঝেছি এমন নয়, কিন্তু জানো তিষাণ তার কথা আমি অবিশ্বাস করি নি।

    "আমাকে অনেকেই বলত আমার নাকি কোনোরকম যুক্তি ছাড়াই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার একটা স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা আছে। মা বলতেন, পরে বাবাও এটাও বলেছেন। অনেকে এটাকে স্বজ্ঞা বলে থাকে। অথচ আমি জীবনে এমন কিছুই করিনি যেখানে আমার স্বজ্ঞা কোনো কাজে লেগেছে। কিন্তু জানো তিষাণ, আমি জানি না আজ হয়তো সেই সহজাত অনুভূতিই আমাকে পাহাড়ে যেতে বলেছে। এই প্রসারিত গ্রীষ্মের সূচনা ও সমাধানের যদি কোনো সূত্র থেকে থাকে তা ঐ পাহাড়েই আছে।"

    তিষাণ দিতার কথা বুঝতে একটু সময় নেয়। তারপর বলে, "জানো দিতা, আমি খুব খুশি হয়েছি যখন কাল সন্ধ্যায় তুমি মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যায় যাও নি। কর্ণিকের ছুরিকে তুমি বলতে পারতে আমার নিরাপত্তাহীনতা, কিন্তু বলনি, না বলে ভাল করেছ। আর গতরাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি ক্রান্তিককে। ক্রান্তিক ছিল আমার সহযোদ্ধা, যুদ্ধে আমাদেরই এক সহযোদ্ধার বিশ্বাসঘাতকতায় তাকে চিতা সেনারা ধরে ফেলতে সক্ষম হয়, চিতাদের অত্যাচারে সে মারা যায়।”
    "আমি জানি ক্রান্তিকের কথা,” অস্ফূট কন্ঠে বলে দিতা, “বাবা আমাকে ক্রান্তিকের কথা বলেছে।”

    অসিতোপলের কাছে তো দিতার এটা শুনবারই কথা, ভাবে তিষাণ, বলে, “তুমি বলতে পার ক্রান্তিককে স্বপ্নে নিয়ে এসেছে আমার অপরাধবোধ। কিন্তু এই ধরনের বিশ্লেষণ মেনে নিতে আমার দ্বিধা হয়। এক কঠিন সময়ে বাস করছি আমরা, দিতা। চিতাদের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের সময়বোধ বদলেছে, পরিচিত পরিবেশ রূপান্তরিত হয়েছে সীমাহীন অরণ্যে। স্বপ্ন ও বাস্তবতার সীমারেখা মুছে গেছে।"

    দিতার মুখাবয়ব ক্ষণিকের জন্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তারপরই এক কালো মেঘে যেন মলিন হয়ে যায়। বলে, "আমার যখন সাত বছর বয়স তখন মা’র সঙ্গে রাজধানী থেকে দুলারী যাচ্ছিলাম চিতাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে, তখনই বাবার সঙ্গে দেখা হয় মা’র। সেই জলযান এক দুর্ঘটনায় পড়ে। বাবা বলতেন সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন নাকি তাঁকে বলেছিল শাল্মলী নামে একটি জায়গায় স্থান ও সময় ভাগ হয়ে যায়। জাহাজডুবির পরে সেই ক্যাপ্টেনকে কেউ খুঁজে পায়নি, হয়তো দুলারীর জলের গভীরেই তার দেহ আটকা পড়েছিল।
    "তিষাণ, আমার মনে হয় এই নিষাদ হল সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন, সে বেঁচে আছে। শুধু বেঁচে আছে নয়, সে স্থান ও সময়ের উর্ধে উঠেছে, অন্তত তাই আমার মনে হয়। সে কি সময়কে জয় করেছে? কালজয়ী? আমি জানি না আমি কী বলছি, কিন্তু তিষাণ এটি আমাদের একটা সুযোগ। যদি নিষাদের সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন হবার বিন্দুমাত্রও সম্ভাবনা থাকে তবে আমাদের দেখা উচিত সে কী করতে পারে। নিষাদ আমাকে কী বলেছে জানো? বলেছে, আমরা নাকি ভাবি সময় হচ্ছে গাছের বীজের মতো, যার মধ্যে ভবিষ্যৎ ও অতীতের গাছ বাস করে। তারপর বলেছে, আমরা ভাবি না বীজ থেকে গাছ ছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে। অর্থাৎ সময় থেকে সময় নয়, সময় ছাড়া অন্য কিছু? সময়ের আর কি বিকল্প হতে পারে? আমার মনে হয় নিষাদের কাছে এর উত্তর আছে। তিষাণ, ভুলে যাও এই সামান্য শহরসভা। তুমি জানো তুরার জলের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না এই সভা। তুমি যে জলের জন্য সংগ্রাম করছ তার হয়তো সহজ কোনো উত্তর আছে ক্যাপ্টেনের কাছে। আমার সাথে পাহাড়ে চলো, তিষাণ।"

    ৭. পাহাড়ে

    পরদিন সকালে তারা পার হয়ে যায় পাইনের নিচে সুকোমল হ্রদে প্রতিবিম্বিত পাথরের কম্পন, অতি প্রাচীন হিমবাহের চিহ্ন। দুপুর নাগাদ তারা চড়াই ধরে উঠতে আরম্ভ করে। একদিন পুরো লাগবে নীল পাহাড়ের প্রথম গিরিশ্রেণী পার হতে। তুরাবাসীরা সেই পথকে প্রথম আলোর গিরিপথ বলে, বিষুবায়নের ভোরে প্রথম সূর্যের ছটা তুরা শহরে এসে পড়ে সেই পথ দিয়ে। দুটি গিরিশৃঙ্গের মাঝখানে খাড়া পথটি উঠে যায় ঝাউ আর বার্চের পাশ দিয়ে। বিকেলে পড়ন্ত রোদের মাঝে দিতা ও তিষাণ এসে পড়ে এক সবুজ হ্রদের ধারে, তার এক পাশে খাদ, প্রথম আলোর গিরিপথ দেখা যায় খুব দূরে নয়। হ্রদের পারে রাতের জন্য ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

    নিজের তাঁবু খাটিয়ে তিষাণ হ্রদের পারে গিয়ে একটা পাথরের ওপর বসে। হ্রদের ঐ পাশে সন্ধ্যার সূর্য অনেক ওপরে গিরিপথকে লাল করে রাখে। সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তিষাণের মনে হয় গিরিপথের ওপর একটি কাল বিন্দু যেন দেখা যায়। অতিদূরে গিরিপথের সরু পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে কালো আলখাল্লা পরা এক মানুষের অবয়ব, গিরিপথের প্রচণ্ড বাতাসে তার পোশাক ওড়ে। সে তাকিয়ে আছে তাদের ক্যাম্পের দিকে। তিষাণের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়। তার মনে পড়ে ট্রেনে আসবার সময় চোখের পলকে দেখা বিশাল পাথরের দেয়ালের ওপর সেই বিন্দুবৎ মানুষ। নিষাদ কি ভ্রমণ করছে তার সাথে? দিতাকে ডেকে বলে দূরবীন দিয়ে দেখতে, কিন্তু সেই কালো আঙরাখা ততক্ষণে অন্তর্হিত হয়েছে।
    "নিষাদ?’, শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করে তিষাণ। দিতা মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু হ্যাঁ বলতে পারে। তাহলে সে প্রথম থেকেই জানে আমরা তার খোঁজে আসছি, তিষাণ ভাবে।

    সূর্য ডুবে গেলে তারা আগুন জ্বালায়। আগুনের আয়নিত শিখা চমকাতে থাকে তাদের পেছনে কালো গাছের ওপর। নিষাদের অদৃশ্য উপস্থিত তাদের দুজনকে মৌন করে রাখে। অবশেষে দিতা বলে, "কেন আমার কাছে নিষাদ এসেছিল? কেনই বা আমাকে সে তার সাথে যেতে বলেছিল? এর কারণ হয়ত সেই জলযানে অসিতোপল, আমার মা ও আমি ছিলাম। পিতা অসিতোপল ছিলেন সমতলের শেষ যান্ত্রিক, হতে পারে তার সঙ্গে জাহাজের ক্যাপ্টেন অর্থাৎ নিষাদের কোনো যোগসূত্র হয়েছিল।”

    সামনের আগুনে কাঠপোড়ার শব্দ রাতের আপাত নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিতে থাকে। দিতা বলতে থাকে, “সময় এক অদ্ভুত জিনিস। গত বছর যখন রাজধানীতে সেই সম্মেলনে যাই আমি গিয়েছিলাম আর্ট-গ্যালারিতে। অনেক তৈলচিত্র ছিল সেখানে, তিন শ চার শ বছরের পুরোনো। একটি চিত্রে বহু মানুষ ছিল, সেই অতীতের মুখাবয়বগুলো স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। সময় পেরিয়ে, ইতিহাস পেরিয়ে তাদের চাহনি আমাকে ধরে রেখেছিল। তাদের চোখ যেন আমাকে বলছিল তোমার মতো একটি মেয়ে এক শ বছর আগে ঠিক এমনিভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, তুমি কি জানো সে আজ কোথায়? সবাই তাকিয়ে ছিল, শুধু একজন বৃদ্ধ ছাড়া, সে যেন জানত আমি আসব, তাই স্বেচ্ছায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বলার ছিল তার, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে নিজেকে কোনো কারণে সামলে নিয়েছিল। চার শ বছর আগের কোনো চিত্রশিল্পীর অসীম ইচ্ছা সূক্ষ্ম হাতের কারুকাজে. রঙের দানার মাঝে, সেই বৃদ্ধের চাহনির মধ্যে নিজেকে ব্যক্ত করেছিল, আজো তা বেঁচে আছে। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে উপেক্ষা করে সেই শিল্পী তার সর্বব্যাপী ইচ্ছার কথা আমাকে জানিয়ে গেল।"

    অন্ধকার গাছের পেছন দিয়ে চাঁদ উঠতে শুরু করে। পূর্ণিমা চলে গেছে গতকাল। তিষাণ আগুনের দিকে তাকিয়ে সম্মোহিত হয়ে দিতার কথা শোনে।

    "আমি ঘুরছিলাম সেই আর্ট গ্যালারীর ঘরটিতে। তারপর হঠাৎ মনে হল সেই ঘরের সব চিত্রের সব মুখাবয়ব এক পরিবারের অন্তর্গত। তারা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শতাব্দীতে, অথচ ফ্রেমের মধ্যে তাদের জীবন তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছে এক সময়ের পরিবারে যেখানে বর্তমানের হাত থেকে মুক্তি নেই। জানো তিষাণ, আমরা হয়ত দুই ধরণের মহাবিশ্বে বাস করি, যেখানে এক বিশ্বে বিভিন্ন অতীত মিশে থাকে এক বর্তমানে, যেমন ছিল সেই আর্ট গ্যালারির ঘরটির তৈলচিত্রগুলো। আর এক বিশ্বে বর্তমান ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ভবিষ্যতে। যেমন তুমি আর আমি, এই মুহূর্তে অধিকার করে আছি সময়ের একটি অংশ, তারপর হয়ত আমরা চলে যাব আগামীকালের বিভিন্ন কামরায়।”

    হঠাৎ এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ রাতের আকাশ ভেদ করে ভেঙে পড়ে তাদের মাঝে। তিষাণ ভয়ে অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে, হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। লাফ দিয়ে উঠে সে যায় খাদের পাশে। আলো ফেলে খুঁজতে চায় গভীরের উৎস। গাছের পাতায় টর্চের আলোর প্রতিফলন যেন সৃষ্টি করে অসংখ্য চোখ। সে অনুভব করে বহু নিচে বনের পাতার পেছনে কারো উপস্থিতি, তার দৃষ্টির রেখা ধরে রাখে তিষাণকে। ফিরে আসে সে ক্যাম্পের আগুনে। দিতা সেখানে বসে ছিল নিষ্পলক আগুনের দিকে চেয়ে।

    পরদিন খুব ভোরে তারা রওনা দেয়। শেষ সকালে তারা পার হয়ে যায় প্রথম আলোর গিরিপথ। পৌঁছায় এক সমতল পাহাড়ী ফুলে-ঢাকা তৃণভূমিতে যার পাশ ঘেঁষে ছিল একটি নীল হৃদ। তৃণভূমির পর বাঁয়ে সবুজ ঘন বিশাল গাছের বন ঢেকে রাখে দৃষ্টি। বহু দূরের ও বহু নিচের তুরার গ্রীষ্ম এখানে নেই, বাতাসে ঠাণ্ডা ভাব তাদের বাধ্য করে শীতের পোশাক পরতে। সকালের কুয়াশা ছুঁয়ে থাকে হ্রদের জল, তারপর ধীরে ধীরে রোদের সাথে উবে যেতে থাকে, হ্রদের মাঝে দু-একটি দ্বীপ দেখা যায়। সমস্ত আশঙ্কামুক্ত সেই সোনালি সকালে তিষাণের সন্দেহ জাগে তাদের অভিযানের যৌক্তকতা নিয়ে। নিষাদ নামে আসলেই কি কেউ আছে? আর থাকলেই তার সঙ্গে তুরার গ্রীষ্মেরই বা কী সম্পর্ক? হয়তো এতদিনে তুরায় হেমন্ত এসে গেছে, ঝরে পড়ছে শীতের পাতারা। থেমে যায় সে, মুখ ফিরিয়ে দিতাকে প্রশ্ন করতে চায়।

    আর তখনই একটা ছোট দ্বীপের পাশ দিয়ে দুটো মানুষ বেরিয়ে আসে দুটো ছোট নৌকোয়। ছোট নৌকো ক্যানুর মতো। তাদের কোনো তাড়া ছিল না। সকালের রোদে জল চিকচিক করছিল। তাদের ছোট বৈঠার আঘাতে জল-ছলকানো শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিল শান্ত বনের পাশে প্রাচীন পাথরের ওপর। তাদের ক্যানু ছিল গাছের বাকলের, গলুই ছিল ওপরে ওঠানো। দূর থেকে শুধু তাদের শরীরের রেখা দেখা যায়। হঠাৎ পুব থেকে জল ছুঁয়ে কুয়াশা ভেসে আসে। দুটো ক্যানু তাতে হারিয়ে যেতে থাকে। সূর্যের বিচ্ছুরিত আলোয় তাদের ছায়ার নৌকোগুলো চলে যায় আর এক রহস্যের জগতে।

    দিতার হাতের আঙুল মুঠিবদ্ধ হয়ে যায়। অস্ফুট স্বরে সে বলে, "নিষাদ!"

    তিষাণ আশ্চর্য হয়ে তাকায় দিতার দিকে। "দু’জন? দু’জন কেন? নিষাদের সাথে কে থাকতে পারে?" তিষাণ জিজ্ঞেস করে পরম বিস্ময়ে।

    মাথা ঝাঁকায় দিতা, সে জানে না। তার চোখ স্থিরদৃষ্টিতে ভেদ করতে চায় কুয়াশার বেড়াজাল। কিন্তু তিষাণ প্রশ্নটা করলেও তার মনে হল সে যেন চিনেছে দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কে, কিন্তু সেটা এমনই এক অসম্ভব ব্যাপার যে সে মন থেকে মুছে ফেলে সেই সম্ভাবনাটা।

    সন্ধ্যায় বড় জলপ্রপাতে পৌঁছলে তারা জিনিস নামিয়ে বিশ্রাম করে। রাতে আগুনের পাশে বসে দিতা বলে, "ছোটবেলায় আমি মা’র সাথে এখানে প্রায়ই আসতাম। আমাদের এই পথটুকু পাড়ি দিতে দিন তিনেক লেগে যেত। মা খুব সাহসী ছিলেন, এখনো আছেন। তুরার পশ্চিমে নীল পাহাড় পার হয়ে এক আদিবাসী গ্রামে মা শিক্ষকতা করতেন। খুব স্বাধীনচেতা ছিলেন। পুরাবিদ ছিলেন, কী করে মানুষের উদ্ভব হয়েছিল, পুরাতন মানুষ কেমন জীবনযাপন করতো, কী ভাবত সেই রহস্য তাকে সবসময় অধিকার করে রাখত। কিন্তু এক অদ্ভুত অসুখে অন্ধ হয়ে গেলেন।

    "জীবনে আমি নিজের হাতে দুটো জিনিস ভালো করে করতে শিখেছি। মা’র কাছ থেকে আমি গাছের পাতার ওপর উজ্জ্বল ধাতুর চিকন প্রলেপ দিয়ে দিয়ে মনোহরী অথচ রুচিশীল অলঙ্কার করতে শিখি তার দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাগান। দেখ, এই পাতাটি আমার নিজের হাতে করা।"

    দিতা গলায় পরা একটা মালার সাথে লাগানো ছোটো একটি স্বর্ণালী পাতা দেখায়। তিষাণ বলে, "কী সুন্দর!" দিতার নমনীয় আঙুল সেই ছোট সুন্দর লকেটটি ধরে থাকে তিষাণের জন্য। তারপর সেই আঙুলগুলো দিয়েই গায়ের ওপর পড়ে থাকা চুল সরিয়ে দেয়। সেই ধরে থাকার ক্ষণিক ভঙ্গি আর চুল সরানোর মাঝে তিষাণ খুঁজে পায় অন্তরঙ্গতা ও বিশ্বাস। "আর বাগান? তোমার বাগান কী করে করলে?" তিষাণ জিজ্ঞেস করে।
    দিতা মৃদু হাসে। তার চোখে দূর দুঃখের কোনো ছায়া ভেসে থাকে। সে বলে, "সে আর এক কাহিনী, কাল বলব তোমায়।"

    দিতা তার তাঁবুতে চলে গেলে তিষাণ কিছু পাথর বেয়ে উঠে জলপ্রপাতের খুব কাছে গিয়ে বসে। পূর্ব থেকে গিরিখাত তৈরি করে জল এসে আছড়ে পড়ছে এই বিশাল প্রপাতে কয় হাজার বছর ধরে কে জানে! চাঁদ উঠে এলে গিরিখাতের দু পাশে পাইন আর রেডউড গাছের মৃদু ছায়া ফুটে ওঠে বনের ওপর। তিষাণের মনে হয় চাঁদ পিছলে পড়বে আকাশ থেকে সেই আদিম প্রপাতে, আবর্তে তলিয়ে যাবে নিচের জমা জলে, তার হলুদ আলো ম্লান হয়ে জ্বলবে জলের দেয়াল পেরিয়ে অন্ধকার রাজত্বে। নেকড়ের ডাক ভেসে আসে, নিচু থেকে উঁচু স্বরে উঠে সেই ডাক ছড়িয়ে পড়ে চারপাশের দিগন্তে। চমকে ওঠে তিষাণ, বুঝতে পারে না নেকড়েরা কোথায় জটলা পাকাচ্ছে।

    ৮. নিখোঁজ

    রাতে তাঁবুতে শুয়ে তিষাণ ভাবে দিতার সঙ্গে কেন তার সম্পর্ক দানা বাঁধতে পারেনি। কেন পারেনি সে জানে, যুদ্ধের সময় থেকে দশটি বছর তার জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল। সেটি গিয়েছিল অসিতোপলের জন্যই, অসিতোপলের তৈরি এক ঘড়ি নিয়ে সে রাজধানীর এক সুড়ঙ্গ দিয়ে চিতা ক্যাম্পে যাচ্ছিল। সেই ঘড়ির সংকেত চিতা ক্যাম্পকে ধ্বংস করে, কিন্তু তিষাণকে এমন এক সময়ের এক আবর্তে নিক্ষেপ করে যার ফলে তার জীবন থেকে দশটি বছর মুছে যায়, নিজেকে আবিষ্কার করে যুদ্ধ শেষ হবার দশ বছর পরে তুরা শহরের এক মাঠে।

    অসিতোপল জানত এমনটি হতে পারে, কিন্তু তার এক্সপেরিমেন্টটাই এমন ছিল যেখানে তিষাণ যদি অসিতোপলের পরিকল্পনাটি পুরোপুরি জানত তবে সেটি কার্যকর হত না। চিতা ধ্বংসের সফলতা নির্ভর করছিল তিষাণের অজ্ঞতার ওপর। যুদ্ধের দশ বছর পরে তিষাণ যখন যুদ্ধ-জয়ে তার বিশাল ভূমিকার কথা জানল, এর জন্য একদিকে যেমন তার শ্লাঘা হল অন্যদিকে জীবনের দশটি বছর হারানোর জন্য অসিতোপলের ওপর অভিমানও হল। অসিতোপল ও দিতার সঙ্গে যে তার সম্পর্কটা হবার কথা ছিল সেটি আর হল না। কিন্তু এই ক’দিন দিতার সান্নিধ্য তাকে দুর্বল করেছে, সে যে আকর্ষিত হচ্ছে তা বুঝতে পারছে। তুরা আসার পর তার প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে দিতার কথাগুলোর অর্থ বুঝতে চেয়ে। দিতার অন্তর্দৃষ্টি তাকে এক অপরিচিত জগতের সম্মুখীন করেছে, অচেনা বিপদসঙ্কুল জগৎ, যে জগৎকে বোঝা একমাত্র দিতার সাহায্যেই হতে। এই অভিযানে দিতা তার ওপর নির্ভর করছে, এই নির্ভরতা তিষাণকে পূর্ণ করে রাখে। সেই রাতে তুষার পড়ে পাহাড়ে। কনকনে শীতের মাঝে তিষাণ কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করে। সকালে তার তাঁবুর সামনে পেঁজা তুষার জমে থাকে। তুষার সরিয়ে সে পৌঁছায় দিতার তাঁবুর কাছে।

    কিন্তু ওই ঠাণ্ডা সকালে দিতাকে খুঁজে পায় নাসে। তিষাণ খোঁজে দিতাকে জলপ্রপাতের পারে, বরফ-জমা গিরিখাতের ভেতরে। তারপর সারা সকাল বসে থাকে দিতার অপেক্ষায়, কিন্তু দিতা ফেরে না। এই পাহাড়ের সঙ্গে যোগসূত্র ছিল দিতা, তার অনুপস্থিতিতে তিষাণ নিজেকে অসহায় অনুভব করে দিতাকে হারানোর বেদনাবোধ তার গলার ভেতর একটা দলা পাকিয়ে থাকে। কোথায় গেছে, দিতা? কেন জানি তিষাণের মনে এ ব্যাপারে কোনো দ্বদ্ন্ব থাকে না যে, নিষাদ নিয়ে গেছে তাকে? খুঁজে বার করতে হবে তাকে। মাথা ঠাণ্ডা করে জিনিসপত্র গুছিয়ে তিষাণ রওনা হয়ে যায়। সে জানে না ঠিক কোথায় যেতে হবে, কিন্তু তার মনে হয় পাহাড়ের ওপরে, অনেক ওপরে কোনো উত্তর রয়েছে।

    তুষারঝড় কাটিয়ে সূর্য উঠে আসে প্রথম দিনই। তারপর দু’দিন ধরে তিষাণ হাঁটে সরু এক শৈলশিরার ওপর দিয়ে। গাছের রেখা পার হয়ে শুরু হয় পাথরের রাজত্ব, চিকন বরফের আবরণে তা থাকে পিছল। বাতাস হয়ে যায় শুষ্ক। দূরে, কুজ্ঝটিকার আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে নীল পাহাড়ের উঁচু চুড়োগুলো শুভ্র তুষারে ঝলকাতে থাকে, চুড়োর তুষার প্রচণ্ড বাতাসে উড়ে যেতে থাকে পশ্চিমে। রাতে আগুন জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে করতে তিষাণ ভাবে দিতার কথা, তার চোখের গভীরতা, ঠোঁটের মৃদু কম্পন, কপালের বিস্ময়ের রেখা। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ক্ষয়ে যেতে থাকে। নিঝুম রাতে প্রাণহীন পাহাড়ের হিম-জ্যোৎস্নায় তিষাণ তার অনিশ্চিত অভিযানের খতিয়ান করতে চায়, কেন জানি বুঝতে পারে দিতার সঙ্গে কোন স্থায়ী সম্পর্ক তার কখনই হবার নয়।

    তৃতীয় দিন বিকেলে তিষাণ দেখা পায় দিতার। চুড়ো পেরিয়ে পথ নেমে যায় নিচে এক সুগভীর গিরিখাতের পাশ দিয়ে। পথের বাঁকটা পার হতেই দিতাকে দেখা যায়। দিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নিষাদ, দাঁড়িয়ে ছিল পেছন ফিরে, কালো আঙরাখা পরে। দূরে অনেক নিচে সূর্য ডুবে যাচ্ছি আর একটি দিনের শেষে। তার মুখ দেখা যাচ্ছিল শুধু পাশ থেকে, সেই মুখবয়াব লাল হয়ে থাকে। মুখ না ফিরিয়েই নিষাদ বলে ওঠে, "শেষ পর্যন্ত তুমি আসতে পারলে তিষাণ? তোমার অপেক্ষায় অনেক দিন আমাকে বসে থাকতে হল।"

    তিষাণ এই ধরনের অভিভাষণের আশা করে নি। সে কোনো কথা বলতে পারে না। নিষাদ ঘুরে দাঁড়ায়। তিষাণ তার মুখ দেখতে পারে না, সূর্যের আলো ঢেকে রাখে নিষাদের মাথা। আর তার একটু দূরে সেই গভীর গিরিখাতের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দিতা, তেমনি নমনীয় ও দৃঢ়।

    "আজ আমাদের দ্বৈরথ, তিষাণ", বলে নিষাদ। "তুমি হয়তো ভাবছো এতো হেঁয়ালির দরকার কী ছিল? এত রহস্যের উদ্দেশ্য কী? কিন্তু এই অভিযানের প্রয়োজন ছিল, তিষাণ। এই অভিযান তোমাকে প্রস্তুত করবে ভবিষ্যৎ মাৎস্যন্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে।"

    নিষাদের অতিপরিচিত ভাবে তিষাণ কথা খুঁজে পায় না। সে আশা করেছিল এক খলনায়কের, কিন্তু নিষাদের কথা ছিল সমস্ত অভিব্যক্তির ঊর্ধ্বে।

    এই সময়টা জুড়ে দিতা নিশ্চুপ থাকে। গিরিখাতের দিকে চেয়ে সে নিবিষ্ট মনে কী যেন ভাবে। নিচে জমা মেঘের সমুদ্রের পাশ দিয়ে সূর্য ডুবে যেতে থাকে। প্রচণ্ড বাতাসে তার চুল উড়তে থাকে দিগন্তের সাথে সমান্তরাল হয়ে। দিতা যেন এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো ভূমিকাই পালন করে না। বাতাসটা একটু পড়লে সে ঘুরে দাঁড়ায়, তিষাণকে দেখতে পায়।

    তিষাণ দেখতে পায় দিতার মুখমণ্ডলে আশ্চর্য ভাব।

    ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে দিতা। কাছে এসে তিষাণের মুখ নিরীক্ষণ করে বলে, "আপনাকে খুব চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি আপনাকে?"

    আর এক বিহ্বলতায় তিষাণ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গত কয়েকদিনের পরিশ্রম অবশেষে ক্লান্তি নিয়ে আসে। অস্ফুট শব্দে ঠোঁট নড়ে ওঠে তার, "দিতা! আমি তিষাণ। তিন দিন আগে এক জলপ্রপাতের ধারে তুমি ছেলেবেলার কথা বলেছিলে।"

    দিতা বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, "আপনি তিষাণ? যুদ্ধের সময় আপনি আমার কাছ বাবার তৈরি ঘড়িটা নিতে এসেছিলেন, আর যুদ্ধের দশ বছর পরে আপনাকে তুরায় পাওয়া যায়, আপনার অতীতের কিছু মনে ছিল না, তারপর রাজধানীতে আর একবার দেখা হয়েছিল আমাদের। তারপরও তো পাঁচটি বছর কেটে গেল। আপনি এখানে কেন? আর তিনদিন আগে কী হয়েছিল?”

    সম্ভাব্য ঘটনাকে অবিশ্বাস করা চলে, কিন্তু বাস্তবতার পরিধির বাইরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিমাত্রিকতার বিলুপ্তি ঘটে। দিতার কথা আগে কখনো তিষাণ অবিশ্বাস করেনি, এখনো করল না। আশাবাদী তিষাণ ভাবে দুটি প্রশ্ন করে সে মীমাংসা করে নেবে সত্যাসত্যের। জিজ্ঞাসা করে সে, "দিতা, মনে পড়ে এক সপ্তাহ আগে তুমি এসেছিলে তুরা স্টেশনে আমাকে নিয়ে যেতে? আমরা নিষাদের খোঁজে পাঁচদিন আগে একসাথে তুরা থেকে রওনা হয়েছিলাম। তুমি আমাকে রাজধানীর সেই আর্ট-গ্যালারির কথা বলেছিলে। মনে পড়ে প্রথম দিন আমরা এক হ্রদের ধারে ক্যাম্প করেছিলাম, দ্বিতীয় দিন এক জলপ্রপাতের ধারে? যেখানে তুমি বলেছিলে গাছের পাতার ওপর ধাতুর প্রলেপ দিয়ে অলঙ্কার তৈরির কথা।"

    দিতার গলার সেই পাতার লকেটটি বিকেলের মৃদু আলোয় ম্লান-সোনালি হয়ে জ্বলে। তিষাণ সেটার ইঙ্গিত করতে গিয়ে দিতার চোখের দিকে তাকিয়ে হাত নামিয়ে নেয়।

    দিতার চোখে অবিশ্বাস ছিল না, সেই চোখে ছিল এক নিরুত্তাপ নিস্পৃহতা। দিতা ঘুরে নিষাদের দিকে তাকায়। নিষাদ তাদের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে মাথা নিচু করে। তারপর তিষাণের দিকে মুখ তুলে বলে, "সেই দিতা চলে গেছে।" এই প্রথম নিষাদের মুখ দেখে তিষাণ। চল্লিশোর্ধ্ব মুখের তার প্রতিটি রেখা জটিল ইতিহাসের ভার বহন করে, চোখে ভাসে দাবানলের অঙ্গারকণা। তার প্রায় চতুষ্কোণ মুখ মিশে থাকে কঠিন চোয়ালে। "দুটি দিতার জন্য এই পৃথিবী ছোটো জায়গা," বলে নিষাদ, "সময়োত্তীর্ণ দিতা আজ মাস কয়েক হল ভ্রমণ করেছে নতুন পরিসরে আর যে দিতা শুধু পৃথিবীর পথে আবদ্ধ ছিল সে চলে গেছে, রেখে গেছে তাকে যে সময়ের সাধারণ গণ্ডী পার হতে পেরেছে।"

    তিষাণ ভাবে, এক কুয়াশার হ্রদে দুটি মানুষ ভেসে গিয়েছিল দুটি ছোটো নৌকো করে। সময়ের এক প্রান্তে বসে দেখেছিল দিতা তার দ্বিতীয়াকে, চিনতে পারে নি। আর এখন তিষাণ চিনতে পারে না দিতাকে। কারন এই দিতা হল সেই দ্বিতীয় দিতা যে হ্রদে নৌকো বাইছিল। এক বিশাল বেদনাবোধে সে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে, কারণ তার দিতাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। কে তাকে অন্ধকার গলির রহস্য বলে দেবে, সময়ের কথা, স্বপ্নের কথা, পাহাড়ের কথা? এক দিকচিহ্নহীন চান্দ্রীয় সমুদ্রের দিকভ্রান্ত হয়ে যায় তিষাণের পদক্ষেপ।

    নিষাদ দিগন্তের দিকে মুখ তুলে বলে, "আপাতদৃশ্যের অন্তরালে কাজ করে অনিশ্চয়তা। সেই অনিশ্চয়তাই মহাবিশ্বকে করে সৃজনশীল, কিন্তু একদিন অনিশ্চয়তার দ্রুত বৃদ্ধি হলে সময়ের গঠন ভেঙে যায়। সময়ের ভাঙনে ভারসাম্যহীন স্থান-কালে ঋতুর বাঁধন থাকে না। তুরার গ্রীষ্ম সেই সময়হীন পথের প্রথম নির্দেশ। তোমাদের জগৎ এখন থেকে বদলাবে, সেই বদলানোকে আটকে রাখা মানুষের পক্ষে কঠিন হবে যদিও মানুষই এই প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিল। আমি দিতাকে সেই অমোঘ পরিণতির বাইরে নিয়ে যাচ্ছি, বলতে পার সমতলের মানুষের অসিতোপলের কাছে যে ঋণ ছিল তা শোধ করতে।”

    নিষাদকে এবার যেন তিষাণ বুঝতে শুরু করে, কিন্তু সে দিতার কাছ থেকে কিছু শুনতে চায়। দিতা কিছু বলে না, তার আকাশচুম্বী মৌনতায় তিষাণ অস্থির হয়ে ওঠে। প্রতিটি কথার জন্য একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত রয়েছে, সেই মুহূর্তটি পার হয়ে গেলে কথাটি যত প্রয়োজনীয় হোক না কেন তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায়। এই কয়েক মাসে দিতা অনেক কিছু দেখেছে। সময়ের গণ্ডীর বাইরে সে ভ্রমণ করেছে, তার ভবিষ্যতে কোনো সঙ্কীর্ণতা নেই। তার জগৎ বিশাল। সমস্ত পার্থিব মুহূর্ত দিতার জন্য অতীত হয়েছে, তিষাণ এখন অপ্রাসঙ্গিকতার মরুভূমিতে পর্যবসিত।

    "এই শেষ দেখা তিষাণ", বলে নিষাদ, "আশা করি তুমি বুঝেছ যা বোঝার।" পাহাড়ের ধারে খাদ ধরে সে চলে যেতে থাকে। দিতা বলে, "বিদায়"। তার সম্ভাবনার বিশাল, সেই অসীম জীবনে তিষাণের কোনো স্থান নেই।

    ‘দাঁড়াও’ প্রাণপণে গলার কাছে জমে থাকা কান্নার দলাটিকে গিলে, শেষ একটি প্রশ্ন করে তিষাণ। শুধু একটি প্রশ্নে যদি স্থান, কালের পরিব্যাপ্তি অতিক্রম করে ছোঁয়া যায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের সুপ্ত চেতনাটি, তন্দ্রার সীমায় নিভন্ত আগুনটি যদি জেগে ওঠে একটি সঙ্কেতের ইশারায়। দিতা ঘুরে দাঁড়ায়। "তিন দিন আগে জলপ্রপাতের ধারে আমি তোমাকে... সেই দিতাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম কেমন করে সে তার বাগানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দিতা বলেছিল পরে বলবে। তুমি কি আমাকে তার হয়ে সেটা বলতে পারবে?"

    "নিশ্চয়", দিতা উত্তর দেয়। তার উত্তর সংক্ষিপ্ত, তাতে ছিল না অগ্নিশিখার উত্তাপ। "কয়েক মাস আগে নিষাদ আমার কাছে আসে, সে বলে সেই একমাত্র মানুষ যে কিনা আমার বাগান বাঁচাতে পারবে, কিন্তু এর বদলে তার সাথে আমাকে যেতে হবে। আমি রাজি হই, তার পর থেকেই – প্রচণ্ড খরা মধ্যেও – আমার বাগান প্রাণ পায়।”

    এই বলে দিতা চলে যেতে থাকে। তিষান চিৎকার করে, “তাহলে অন্য দিতা? অন্য দিতা কী করে আবির্ভূত হল? সে কোথায় এখন?” দ্বিতীয় দিতা উত্তর দেয় না, এইসব পার্থিব প্রশ্নের বাইরে তার বাস এখন। সেই সর্পিল গিরিপথে দিনের সূর্যের শেষ রক্তিম রেখা মুছে যাওয়ার সময় তার শরীর অদৃশ্য হয়ে যায় মেঘের মাঝে।

    ৯. বৃষ্টি

    কিন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে তোমার হৃদয়ের ধ্বনি শোনো ‒ তার স্পন্দন ধাবিত হয় কোন শান্ত তুষারপাতের
    রাতে, মৃদু বাতাসে ঝাউগাছের মাঝে চিন্তার গভীরে কোনো গিরিখাতের পারে। তোমার হৃদয় কোনো মহাকালের নায়ক, তুমি এক অশ্বারোহী যাত বিস্তৃত আঙরাখা উড্ডীয়মান হেমন্তের উদার বাতাসে। অঙ্গারকণা ভাসে রাতের আকাশে, ঝলকিত করে হৃদয়ের মুখ। ঘোড়াসোয়ার তোমার হৃদয় উড়ে যায় মহাসমুদ্রের উপকূলে আলোয় আঁধারে, মরুভূতির শুষ্কতায় বরফের স্ফটিকখণ্ডে। দূরে তুষারমুক্ত আকাশে উত্তরী আলো ঝলকায়, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বদলায়, সূর্যের কণা আছড়ে পড়ে আরো দক্ষিণে‒এই নিম্ন দ্রাঘিমায়, শক্তি পায় বায়ুমণ্ডলের অণু, ঝলকে ওঠে লাল ও সবুজ রঙে। বিচ্ছেদের বেদনা তোমার বুকে, কিন্তু তবু তুমি মহাকালের নায়ক, তিষাণ!

    বৃষ্টির মাঝে বসে থাকে তিষাণ। নিষাদ বলেছিল অনিশ্চয়তার দ্রুত বৃদ্ধি হলে সময়ের গঠন ভেঙে যায়। পাহাড় থেকে ফেরার পরই সারা পৃথিবী জুড়ে হয়েছে এক ভূমিকম্প। তারপর শুরু হয়েছে বৃষ্টি যে বৃষ্টি চলবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে দশটি বছর – তিষাণ সেটা এখনো জানে না। বিধ্বস্ত তুরার এক কোনায় এক অটুট বাগানবাড়িতে সে আজ বসে থাকে তুমুল বর্ষার মাঝে। ভেজা চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ে মাটিতে, সিক্ত জামায় শীতল হয়ে আসে শরীর। পুকুরের জলে বৃষ্টি পড়ে। সামনের টেবিলে পড়ে থাকে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা, তার সাথে একটা চিরকুট: "দিতা! কোথায় তুমি? ফুল নিয়ে এসেছিলাম। বৃষ্টি নেমেছে। তোমার বাগান আবার বাঁচবে।" এক বন্ধুর উপহার। বৃষ্টির জল পুকুর ছাপিয়ে বাগানে ঢোকে। বন্ধুটির চিরকুটে একটি কবিতাও ছিল –
    সময় আমাদের ঢেকে রাখে মৃদু বৃষ্টির মতো
    শেষহীন ও দুঃখময় সময়
    লবণের পালক ছুঁয়ে
    আর তারপর — যখন পৃথিবী গ্রহণ করবে আমাদের আলিঙ্গন
    মিশে যাবো আমরা একটি অভিন্ন মৃত্যুতে।
    অসীম কালের জন্য — একটি চুম্বনের অসীমতার মাঝে।
    —পাবলো নেরুদা


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    তন্ময় ভট্টাচার্য | প্রতিভা সরকার | হেমন্ত দাস | শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় | মৃণাল শতপথী | কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় | দেবাশিস মল্লিক | মণিশংকর বিশ্বাস | সুকান্ত ঘোষ | সাদিক হোসেন | ডাঃ সেখ নূর মহাম্মদ | মোহাম্মদ সাদেকুজ্জামান শরীফ | সোমনাথ রায় | রুমা মোদক | জয় গোস্বামী | দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় | সুপর্ণা দেব | সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় | স্বাতী রায় | অনিন্দিতা গোস্বামী | ফারুক আব্দুল্লাহ | খান শামিমা হক | নীলু ইসলাম | সারিকা খাতুন | দময়ন্তী | সাদাত হোসাইন | গোলাম রাশিদ | মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় | শারদা মণ্ডল | অমর মিত্র | হামিরউদ্দিন মিদ্যা | ইমানুল হক | নীলাঞ্জন দরিপা | চিরশ্রী দেবনাথ | সায়ন কর ভৌমিক | কৌশিক বাজারী | ঐন্দ্রিল ভৌমিক | চৈতালী চট্টোপাধ্যায় | যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা | মোজাফ্‌ফর হোসেন | অনুরাধা কুন্ডা | মাজুল হাসান | জগন্নাথদেব মন্ডল | যশোধরা রায়চৌধুরী | কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায় | শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী | দীপেন ভট্টাচার্য | মৌ সেন | পায়েল দেব | তনুজ | রুখসানা কাজল | পার্থসারথি গিরি | ইদের কড়চা
  • গপ্পো | ১৩ মে ২০২২ | ২০৭৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঘন্টাঘর - একক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • প্রতিভা | 203.163.***.*** | ১৪ মে ২০২২ ১২:২৫507608
  • এ তো গভীর অভিনিবেশ দাবী করে! 
  • প্রতিভা | 203.163.***.*** | ১৪ মে ২০২২ ১২:৩৮507610
  • সত্যি কথা বলতে কী, পাঠক হিসেবে অনেক সংকীর্ণ ছিলাম। বিজ্ঞানভিত্তিক বা কল্পবিজ্ঞানের লেখা তেমন টানত না। আমার সংকীর্ণতাকে বাড়িয়ে তুলেছিল কেবলই নীরস তথ্যমুখিনতা। সাহিত্যগুণ সম্পন্ন কল্পবিজ্ঞান পড়া আমার শুরু হয়েছে গুরুচন্ডা৯র পাতায়। এবং এইবার আমি অভিভূত। 
    সুপ্রযুক্ত কাব্যখন্ডগুলি নিশ্চয়ই লেখকের নিজস্ব অনুবাদ! 
    অভিবাদন ! 
  • পাঠক | 2405:8100:8000:5ca1::1ff:***:*** | ১৫ মে ২০২২ ১০:২৪507645
  • এত এত টাইপো ছাপার আগে একবার দেখে নিলে ভাল হয়।
  • Sandipan Majumder | 45.249.***.*** | ১৬ মে ২০২২ ১২:৪৬507712
  • দুর্দান্ত  লেখা। সমকালের অন্যতম সেরা বাংলা  গল্প।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন