আগে মশলা মাখতে গেলে “হাতে জ্বালা করছে” বলে কাঁদত মেয়েটা। আজকাল ঐ কচি হাত ও লঙ্কা আর মশলার ঝাঁজ সহ্য করে নিয়েছে। কড়াইয়ের তপ্ত তেলের তাপে নাকের ওপর ঝকঝক করে হীরের মত ঘামের ফোঁটা।
ন’ বছরের মেয়ে। কিন্তু চেহারা লিকলিকে। বছর ছয়-সাতের বেশি দেখতে লাগে না। স্কুলের শেষে বাড়ি ফিরে সেদ্ধ আলু ছাড়ায়। চপের পুরও তৈরি করা শিখে গেল দেখতে দেখতে।
সন্ধেবেলা এই তেলেভাজার ভ্যানটা নিয়ে আসে মা-মেয়েতে মিলে। দুটো সাতমহলার মাঝের গলিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যেই দেখতে দেখতে আলুর চপ, বেগুনি আর পেঁয়াজি শেষ হয়ে যায়। কিছুদিন হল একটা বড় ফ্লাস্কে চা-ও রাখতে শুরু করেছে কুসুম। লোকে পেঁয়াজির সঙ্গে চা খেতে চায়। ঝুপড়িতে একটা ফ্রিজ থাকলে ডিমের চপও বানানো যেত। টিভি-রেডিও আছে, এবার একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্রিজ কিনতে হবে।
বিক্রি-বাটা সেরে ফেরার আগে, রাস্তা ঝেঁটিয়ে ময়লা এক জায়গায় জড়ো করে ফেলে বাচ্চা মেয়েটা। কুসুম হাঁড়ি, কড়াই, ডেকচি ভ্যানে তুলতে তুলতেই মামণি বালতিতে রাখা বাসন ধোয়া জলটা নাচতে নাচতে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় ছিটিয়ে দেয়।
কুসুম হাসে।
তারপর ল্যাম্পপোস্টের আলোর দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে – “তোকে এবার নাচের স্কুলে দেব’খন কেমন, মামন?”
আজও শাড়ি বিক্রির টাকাটা পেল না নীলু।
সাড়ে ছয় মিটার তসরের শাড়ি। ভালো কোয়ালিটি – তেরোশ’ টাকার থান। বাইশ শ’তে বিক্রি করতে হল। অন্য কেউ হলে সাতাশ শ’ বলত। তসরের শাড়ির ওপর ফ্যাব্রিক পেন্ট করে নীলু। ওর হাতের কাজের কদর হচ্ছে একটু একটু করে। এই শাড়িটা এত কমে বিক্রি করার ইচ্ছে ছিল না। কিছু করার নেই।
যাকে বিক্রি করেছে, সে পাশের ফ্ল্যাটের ডিভোর্সি লেডি ডাক্তার। একে ডাক্তার, তায় পড়শি। পাড়াতেই নীলিমার ছোট বুটিক। শাড়িটা দেখেই উনি লাফিয়ে উঠে বললেন – “এই শাড়িটা নেব।” টাকাটা আর দিচ্ছে না – এক হপ্তা হয়ে গেল।
এ ভাবে যে কি করে ব্যবসা চলবে!
এই কথাটা নীলু যত না ভাবে, নীলুর বর অমল তার চেয়ে বেশিবার বলে।
অমল নামকরা তবলচি। কলকাতার দু’জন নামকরা ওস্তাদের সঙ্গত করে। মাসের পনেরো দিনই বাইরে। আর বাকি যতদিন বাড়ি থাকে, নীলুকে গালমন্দ করে সন্ধেবেলা মদের বোতলে ডুবে যায়৷
অমল আর নীলুর ছ’ বছরের মেয়ে তুষ্টি।
দু’ বছরের যখন হল, তখন থেকেই তুষ্টি খালি দোলে। পশ্চিমের ব্যালকনির এক কোণায় বসে মুখে বুড়ো আঙুল পুরে দুলতেই থাকে, দুলতেই থাকে। তুষ্টিকে নাম ধরে ডাকলে শোনে না। বকলে কাঁদে না৷ মারলে যেন ওর গায়েই লাগে না।
সন্ধেবেলা তুষ্টিকে ফ্ল্যাট থেকে বার করে, বুটিকে নিয়ে আসে আজকাল নীলু। কুসুমের তেলেভাজার ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে উল্টো দিকে।
নীলু খেয়াল করে না, চপ ভাজতে ভাজতে কুসুমের মেয়ে মামণি ‘এই তুষ্টিইইই’ বলে ডাকলেই তুষ্টির ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ে।
আজ বিকেলে অমল বেরিয়ে গেছে। শিলিগুড়ি তে আসর। “কবে ফিরবে” – এ কথাটা আর জিজ্ঞেস করে না নীলু। অমলও বোধহয় আশা করে না যে নীলিমা জিজ্ঞেস করবে। ঝাপসা হয়ে আসা চোখে নীলু দেখে, তুষ্টি আজ কেন জানি না, খুব খুশি। ওকে একটা ময়ূরকন্ঠী রঙের স্টোল আর পেন্টব্রাশ নিয়ে বসিয়ে দিল নীলু। আর স্বপ্নমাখা চোখে দেখতে থাকল, কি সাবলীল ভঙ্গিতে তার ‘স্পেশাল’ ন’ বছরের মেয়ে আর একটি মেয়ের অবয়ব ফুটিয়ে তুলছে কাপড়ের ওপর।
-“এইটা কার মুখ রে, তুষ্টুসোনা?”
প্রায় ছ’ সপ্তাহ বাদে আবার কথা বলল তুষ্টি।
-“মা-ম-ন.... মা-ম-ন... মা-ম-ন....”
আজ তসরের শাড়িটা পরে বেরিয়েছিল শ্রেয়সী। কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, নানা রঙের মেয়েদের মুখ আঁকা আঁচলে। কিন্তু দূর থেকে দেখতে লাগে ফুলের মত। একবার দেখেই শাড়িটা পছন্দ হয়ে গেছে। তখন বাজার-ফেরত ব্যাগে অত ক্যাশ ছিল না। নীলিমার ব্যবসা এখনো এত বড় হয়নি, যে কার্ড-এর জন্য মেশিন রাখবে। আজ অন্তত টাকাটা মিটিয়ে দেওয়া উচিত।
সন্ধের পর মিন্টিকে ছেড়ে আর কোথাও বেরোতে চায় না শ্রেয়সী। মিন্টি অভিমান করে আজকাল। বড় হচ্ছে। আট বছর হয়ে গেল। বাবার ন্যাওটা ছোট থেকেই। মাসে দুটো উইক-এণ্ড ও বাবার সঙ্গে থাকে। ডিভোর্সের সময়কার ফয়সালা। শ্রেয়সী ভেবেছে ধীরে ধীরে নাইট অন কল করাই বন্ধ করে দেবে এবার। শুধু দিনের কাজ। যত বেশি সময় পারা যায় মেয়েটার সঙ্গে কাটাতে হবে।
তবু আজ বেরোতেই হত। অনেকদিন বাদে উদয়ন এসেছে কলকাতায়। দেখা করতে চেয়েছিল। উদয়ন সারাক্ষণ শুধু শাড়িটারই তারিফ করল। যেন শাড়িটা দেখতেই কলকাতায় এসেছিল। শেষে বলল:
-তোকে আমি শাড়ি পরতে কম দেখেছি, কলেজে একদিনও পরিসনি।
-সামলাতে পারতাম না রে!
-তোর বিয়ের সময় তুই প্রথম শাড়ি পরেছিলি। দেখে খুব আফসোস হয়েছিল, জানিস।
-আফসোস কিসের?
-আগে শাড়ি পরে দেখলে আমিই তোকে বিয়ে করে নিতাম। তোর সময়, পরিশ্রম সব বাঁচত।
যেন দারুণ হাসির পাঞ্চলাইন বলে ফেলেছে, এমন বলে হাসার চেষ্টা করে উদয়ন।
-তাই কি,উদয়ন? আমি শাড়ি পরে নিলেই সব হত?
এ কথায় উদয়নের হাসির ফাঁপা বেলুন চুপসে যায়। মাথা নত করে রাখে উদয়ন। আগেও বলা হয়নি যে কথাগুলো – সময়মত, সাহস করে – আজও হল না। কোনোদিন কি হবে?
পৌনে ন’টা বাজে। উদয়ন ওকে ছাড়তে এসেছিল। এবার ফিরতে হবে। ক্যাব বুক করছে। ইচ্ছে করেই শ্রেয়সীর মুখের দিকে দেখছে না একবারও।
শ্রেয়সী প্রাণপণ চেষ্টা করল যাতে পরের প্রশ্ন করতে গিয়ে গলা না কাঁপে।
-আবার কবে আসবি?
-জানি নাহ্। দেখি... আসব, শিগগিরই আসব।
-চা খাবি?
-এই তো চলে আসবে এখুনি ক্যাবটা!
-খেয়ে দ্যাখ, কুসুম বৌদি আজকাল চা বানায়। ভালো চা। ক্যাবে খেতে খেতে যা।
-আচ্ছা, খাওয়া।
-এই রে, দাঁড়া! ও তো দোকান গুটিয়ে ফিরছে দেখছি... ও বৌদি, চা হবে?
শ্রেয়সী আর উদয়নকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসে কুসুম।
-হবে গো ম্যাডাম। এক কাপ মত আছে। তবে একটুখানি ভালোবাসলেই দু’ কাপ হয়ে যাবে। হিহি।
এ কথায় কুসুমের ন’ বছরের মেয়ে মামণি কি বুঝল কে জানে, শুধু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। আর ওর নাকের ওপর হীরের মত ঘামের ফোঁটাগুলো ঝকঝক করে উঠল আবার।