ভোরের আকাশ থেকে তারারা হারিয়ে যাবার আগেই কোনো-কোনোদিন আমাদের বাড়ির দিন শুরু হয়ে যায়। উঠোনে গোবরজলের ছড়া আর কলতলায় জল তোলার শব্দ, বাড়ির গাছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিগুলোকেও জাগিয়ে তোলে। তখনও থেমে থেমে পাখিদের শিস আড়াল পড়ে যায় একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকার শব্দে। তবে সেসব কোলাহলে আওজানো দরজার এপার থেকে বোঝার উপায় নেই বাইরে কতটা আলো ফুটলো।
আমি গায়ের লেপ সরিয়ে মেঝেতে পা রাখি। খাটের সামনে লাল মেঝেয় এই সময়গুলোতে ফুল-তোলা চট পাতা থাকে। ঠান্ডা মেঝেতে তাই আর পা দিতে হয় না।
মনি, উঠে পড়লি?
আমি মনিপিসির কথার উত্তর দিই না। অন্ধকারটুকু চোখ সওয়া হতেই পা বাড়াই দরজার দিকে। কাঠের সিঁড়ির নীচে অন্ধকারে জড়ো হয়ে আছে মুড়ির টিন, গুড়ের কলস।
ঠাকুমা সব গুছিয়ে রেখেছে।
আমি আলগোছে দরজা খুলতে চাই। পারি না। ক্যাঁচ করে একটু আওয়াজ হয়। সাথে সাথেই দাদুর গলা ভেসে আসে,
‘গিন্নি, ঠান্ডা লাগিও না।
অন্যদিন হলে ঘুম ভেঙে গেলেও দাদু পাশ ফিরে আরও কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিত। উঠোনের সব অন্ধকার কেটে গিয়ে বরইগাছের মাথায় রোদ্দুর ভেসে ওঠার পরেই বিছানা ছাড়ত। কিন্তু আজ তা হল না।
আমার পেছন পেছন দাদুও বড়ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
উঠোনের অন্ধকারে জেঁকে বসে আছে কুয়াশা। ভেজা গায়ে কলতলা থেকে সেই কুয়াশা কেটে বেরিয়ে এল ঠাকুমা,
‘দিদি, আজ অনিয়ম কোরো না। কিছু গায়ে জড়াও। ঠান্ডা লেগে গেলে বাবা রাগ করবে।’
বরইগাছের তলায় শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড় আজ অজস্র ফুলে সাদা হয়ে আছে। সেখান থেকে কয়েকটা ফুল তুলে ঠাকুমা বড়ঘরে উঠে পড়ল।
আজ ঠাকুমার ফুল তুলতে যাওয়া নেই।
পূর্ণির মা গোবরজলে তুলসীতলা লেপছে। কিন্তু বরইগাছের পাতা থেকে চুঁইয়ে পড়া নীহারে সে জায়গা শুকোবার ফুরসত পাচ্ছে না।
ঠাকুমা সেই ভেজা উঠোনে পায়ের ছাপ ফেলে তুলসীগাছের মাথায় জল ঢালতে যায়।
অন্ধকার একটু একটু করে কাটছে। সাদা কুয়াশার বাড়বাড়ন্ত এখন উঠোনজুড়ে।
‘কীরে মনি, আমাগের কথা মনে থাকবিনি তো?’
পূর্ণির মায়ের এ কথা আমার ভালো লাগে না। আমি ঘাড় গুঁজে লাল বারান্দায় জমা শিশিরে আঁকিবুকি করতে শুরু করি।
আজ ঠাকুমার নিত্যপূজাতেও খুব একটা সময় লাগে না। পূজা শেষে অমৃতবাণীও পাঠ করে না আজ ঠাকুমা।
‘দিদি, এই নাও।’
ঠাকুমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে গুড়ের কদমা। আমি অন্যদিনের মতোই গুড়ের কদমা নিয়ে মনিপিসির কাছে যাই,
‘ও মনিপিসি, প্রসাদ নেবে না?’
গুড়ের কদমা প্রসাদে মনিপিসি সবসময় ভাগ বসায়। কিন্তু আজ তা হল না।
‘আমি খাব না, তুই খেয়ে নে।’
মনিপিসির কথায় আমার খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু তা না হয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
মনিপিসি কী বোঝে কে জানে? আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
‘মা, গুড়ের কদমা দিয়ে দিয়েছে মুড়ির টিনের ভেতর।’
সিঁড়ির দিকটা ইশারায় দেখায়।
সেখানে জড়ো হয়ে থাকা কৌটা, হাঁড়ি, কাঁথা থেকে আমি চোখ সরিয়ে নিই,
‘ও মনিপিসি, নদী কী অনেক বড়? আর স্টিমার? সেটাও কী অনেক বড়?’
মনিপিসি উত্তর দেবার সুযোগ পায় না। দাদু রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে উত্তর দেয়,
‘শীতে করতোয়া মরা নদী দিদি, দু’পাশে বালু জেগে ছোট হয়ে গেছে।’
আমার মনে সাহস জাগে। ছোট নদী পার হয়ে তাহলে ইচ্ছে হলেই আমি যখন তখন বাড়ি আসতে পারব।
আজ রান্নাঘরের উনুন জ্বলে উঠেছে বেড়ায় ঝুলানো মিটমিটে বালবটা নেভার আগেই।
উনুনে উঠেছে ভাতের হাঁড়ি, তাতে ফুটে ওঠা জলে পড়েছে ঝিঙেশাইল চাল। আর মনিপিসি লাল বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভে বসিয়ে দিয়েছে চায়ের জল।
শুক্লাদের ঠাকুরঘর থেকে ভেসে আসছে ঘণ্টার শব্দ। পাড়া জেগে উঠছে একটু একটু করে। তাঁতঘরের তালায় চাবি পড়বে। মানিক কাকু ফটকে এসে দাঁড়িয়েছে,
‘মনি, চাবি লাগবি, ঠাকুমা কই?’
ঠাকুমা রান্নাঘর থেকে এর মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। ভেজা হাত আঁচলে মুছে বড়ঘরের বারান্দায় উঠে আসে,
‘মানিক, হরিপদ ঘোষকে কাল বিকেলে খবর পাঠিয়েছিলাম। আজ খুব সকালে মাঠা দিতে বলেছিলাম। এখনও এল না।’
‘আমি যাবোনি ঘোষপাড়া, কয় হাঁড়ি আনতি হবি?’
তাঁতঘরের চাবি মানিক কাকুর দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে ঠাকুমা বলে,
‘বেশি করে মাখন দেওয়া এক হাঁড়ি এনো।’
ঠাকুমা আর মানিক কাকুর কথার মাঝেই আমি দেবদারু বাগানের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। হাতে গামছায় বাঁধা খাবার আর গায়ে চাদর জড়িয়ে সাদা কুয়াশার ভেতর ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে তাঁতিরা। সেই ছায়া থেকে আমি খুঁজে খুঁজে বের করি কলিম তাঁতি, মকবুল তাঁতি, পরেশ তাঁতি, নিবারণ তাঁতি, মান্নান ড্রাম মাস্টার সবাইকে।
আজ অন্যদিনের মতো এগিয়ে গিয়ে আমি ওদের সাথে গল্প জুড়ি না। আমি পা বাড়াই গোলেনূর দাদির বাড়ির দিকে। সে বাড়ির উঠোনে এখনো নিঃস্তব্ধতা। শুধু গোলেনূর দাদির বড়ঘরের টিনের বেড়ায় ঝুলানো কবুতরের খোপ থেকে ভেসে আসছে ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
নিঃস্তব্ধ সে বাড়ি থেকে আমি আস্তে আস্তে চলে আসি আমাদের বাইরবাড়ির বারান্দায়। সেখানে কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে দাদু।
‘গিন্নি, শহরের স্কুল অনেক বড় হয়, জানো? কত বন্ধু পাবে ওখানে। তখন আর এই দাদুর কথা মনেই থাকবে না দেখো।’
বড় স্কুল, কত বড় স্কুল? সেখানে আমি কীভাবে আমার ক্লাস খুঁজে পাব? সেখানে তো কেউ আমাকে চেনে না, তাহলে কীভাবে আমার বন্ধু হবে সবাই? আর ইতু, শুক্লা ওরা কি আর আমার বন্ধু থাকবে না – এত এত প্রশ্নে আমার শুধুই কান্না পায়।
আমি দাদুর গা ঘেঁষে বসি,
‘বাবা আবার কবে এখানকার অফিসে ফিরে আসবে দাদু?’
‘শহর ছেড়ে কেউ গ্রামে ফেরে নাকি, দেখবি এখানে আসতেই ইচ্ছে হবে না আর।’
মনিপিসি দাদুর দিকে চা বাড়িতে দেয় এটা বলে।
আমার কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না, কিচ্ছু না। আমি কুয়াশায় ঢাকা আবছা সুপারি বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকি।
আজ কিছুতেই কুয়াশা সরছে না।
রান্নাঘরের উনুনে এখন মটর ডাল ফুটছে। মানিক দাদু ঘোষপাড়া থেকে এক হাঁড়ি মাঠা নিয়ে আসার পথে নদীর পাড় থেকে কুঁচো চিংড়ি আর কাতল মাছ নিয়ে এসেছে।
‘বাবু, শ্যামল হাতে ধরাইয়্যা দিলো। মাছগুলান চকচক করতিছে, খুব তাজা।’
রান্নাঘরে ব্যস্ততা বেড়ে গেল। ঠাকুমা চলে গেল সবজি বাগানের দিকে। আর মনিপিসি বসে গেল নারকেল কোরাতে।
ঠাকুমা লাউয়ের মাচা থেকে বেছে বেছে কচি লাউপাতা তুলল, সাথে একটা গাঢ় সবুজ লাউও। জিরা ফোড়নে লাউ-মটর হবে, লাল করে ভাজা হবে ক’খান কাতল মাছের পেটি। আর হবে লাউপাতায় চিংড়িমাছের বড়া।
ব্যাগ গোছানো শেষ করে মা এসে হাত লাগাল রান্নাঘরে। ভিজিয়ে রাখা মটর ডাল আর আতপ চাল শিলপাটায় বাটা শেষ করল। এরপর চন্দনের মতো সর্ষে কাঁচামরিচ বেটে ঠাকুমার দিকে এগিয়ে দিল মা।
পূর্ণির মা’র বেছে দেওয়া কুচো চিংড়িগুলোতে ঠাকুমা কোরানো নারকেল আর সর্ষে কাঁচামরিচ বাটা মেশাল। এর সাথে অল্প হলুদ, লবণ আর চিনি। একপাশে তা সরিয়ে রেখে কচি লাউপাতার আঁশ ছাড়িয়ে ধুয়ে নিল ঠাকুমা। সবুজ পাতাগুলোর বুকে চিংড়ি-নারিকেলের পুর ভরে ঠাকুমা পাতাগুলো মুড়িয়ে নিল। বেটে রাখা মটর-আতপে ঠাকুমা লবণ-হলুদ মিশিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিল।
লোহার কড়াই থেকে নেমে এল লাল করে ভাজা কাতলের পেটি। মাছ ভাজা তেল বাটিতে ঢেলে কড়াই ধুয়ে নিল ঠাকুমা।
‘ও ঠাকুমা, তোমার চা জুড়িয়ে গেল তো।’
উনুনে কড়াই চাপিয়ে তাতে সর্ষের তেল দেয় ঠাকুমা,
‘জুড়াক দিদি, তোমাদের স্টিমারের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।’
পুর ভরা লাউপাতাগুলো একটা একটা করে ফোটানো গোলায় ডুবিয়ে কড়াইয়ের তেলে ফেলে ঠাকুমা। উনুন ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছে। সেই অল্প আঁচে বেশ অনেক সময় নিয়ে ঠাকুমা ভেজে চলেছে পাতাবড়া।
উঠোনের কুয়াশা আরও ঘন হয়। দেখে বোঝার উপায় নেই বেলা কত হল।
বাবা তাড়া দেয়।
লাল বারান্দায় আজ মাত্র তিনটা পাত পড়েছে। পাতে ঝিঙেশাইল চালের ভাত, মাছ ভাজা, পাতাবড়া আর কাঁসার বাটি ভরা মটরডাল।
আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। শুধু মুচমুচে বড়ায় কামড় বসায় ঠাকুমার জোরাজুরিতে।
আমাদের জন্য ক’খানা রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছে বাইরবাড়িতে। আর সেখানেই দাঁড়িয়ে গোলেনূর দাদি আর কোহিনূর ফুপু।
মাঠার হাঁড়ি, ব্যাগ, বিছানা-বালিশ – একে একে সব রিক্সায় ওঠে। সাথে মনিকাকুও। আরেকটা রিক্সায় আমি বাবা-মা’র সাথে। নলকা ঘাটে যাবে রিক্সাগুলো। সেখান থেকে স্টিমার। পার হলেই শহর।
রিক্সার প্যাডেল ঘুরতে শুরু হয়েছে। পেছনে ঠাকুমা, মনিপিসি, দাদু, গোলেনূর দাদি, কোহিনূর পিসি, তাঁতঘর, দেবদারু বাগান, বাইরবাড়ি। সাদা কুয়াশায় ওরা সবাই আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
আমি পেছন ফিরে বারবার দেখি। একটু একটু করে ওদের সবার আবছা ছায়াগুলোও দূরে সরে যাচ্ছে।
আমি সামনের দিকে এগোতে থাকি। রিক্সা কালিবাড়ির মোড়ে আসতেই ওরা সবাই পেছন থেকে হুট করে হারিয়ে যায়। কুয়াশার ভেতরে মিশে যেতে যেতে আমি ভাবি,
‘আবার ফিরে আসব আমরা। বাগানের সুপারিগুলোয় রঙ ধরার আগে, দেবদারু গাছে ফল আসার আগে, তাঁতে নতুন নকশা শাড়ি ওঠার আগে, শুক্লাদের বাতাবি গাছে ফুল আসার আগে, জেঠিঠাকুমার উঠোনের রোদে ধান পড়ার আগে, বড়ঘরের লাল বারান্দায় ঠাকুমা নতুন কাঁথায় ফুল তোলার আগেই আমরা ফিরব। আমরা ফিরবই।’
বড় রাস্তায় প্রাচীন বটগাছ ছাড়িয়ে যাওয়া রিক্সাতে বসা বছর ছ’য়েকের মেয়েটি তখনও জানত না – পেছনে ফেরার মন্ত্রটা আসলে কারোরই জানা থাকে না।