সেসব দিনে অগ্রহায়ণ মাস শেষ না হতেই ভোর বেলার কুয়াশা সুপারি গাছের মাথায় কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকতো। আর নীহারে ভেজা উঠোনের মাটিও কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে উঠতো। তবে বরইগাছের পাতা চুইয়ে সবচেয়ে বেশী স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে উঠতো আমাদের উঠোনের ঢেঁকি।
আমাদের বাড়িতে আলাদা কোনো ঢেঁকিঘর ছিল না। রান্নাঘরের সামনে প্রকান্ড বরইগাছের গোঁড়ায় বসানো ছিল ঢেঁকিটি। আর বলতে গেলে সারাবছরই ঢেঁকির গড়ে চাল থেকে শুরু করে মশলাপাতি পড়তো।
অগ্রহায়ণের হিম হিম ভোরে আমি যতই ঠাকুমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি না কেন, আমাকে ফাঁকি দিয়ে ঠাকুমা ঠিক আবছা অন্ধকারেই বিছানা ছাড়তো। না ছেড়ে উপায় আছে? আরেকটু পরেই গৌর আঙিনা থেকে নগরকীর্তন বের হবে। ওপাড়া থেকে এপাড়ায় আসতে আর কতইবা সময় লাগে।
বাইরবাড়ি থেকে তাড়াহুড়োয় কাঠটগর ফুল বাঁশের সাজিতে লাল বারান্দায় রেখেই ঠাকুমা কলতলায় যায়। উঠোনের গোবরের ছড়া পড়ার সাথে সাথেই ঠাকুমা বালতিতে গুলিয়ে এঁটেল মাটি নিয়ে আসে।
সবার আগে ঢেঁকির গড়ের চারপাশ এঁটেল মাটি দিয়ে লেপে ঠাকুমা। এরপর তুলসীতলা লেপে ঠাকুমা হুড়োহুড়ি করে স্নান সারে। ঠাকুমার ভেজা কাপড়ে কুয়াশা জড়িয়ে কেমন ধোঁয়া উঠছে, ও ঠাকুমা কীর্তনের আওয়াজ পাওয়া যায়। লাল বারান্দায় আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে ঠাকুমা বলে, সরে যা দিদি, সাহাপাড়া ছেড়ে এসেছে নগরকীর্তন। ঠাকুমার ভেজা কাপড়ের জল লালবারান্দায় বিন্দু বিন্দু নকশা আঁকে। আমি পায়ের আঙুল দিয়ে বিছিন্ন জলবিন্দুগুলো সংযুক্ত করি।
মনিপিসি বড় কাঁসার বাটি ভরে খেজুরের গুড় নিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে যায়, মনি ঠান্ডা পড়েছে জল নিয়ে খেলিস না। মনিপিসির কথায় আমার সত্যিই অল্প অল্প শীত লাগে। আমি দৌড়ে গিয়ে বড় ঘরের আলনা থেকে ঠাকুমার নস্যি রঙের পাতলা চাদরটা গায়ে জড়ায়। আর ঠিক তখনি আমাদের উঠোনে খোল করতালের সুর,
' জাগো হে এই নগরবাসী,
মুখে জয় রাধা শ্রী রাধা বইলা
পোহাইলো নিশি জাগো হে'
আমি ছুটে ঘর থেকে বের হবার আগেই নগরকীর্তনের দল পৌঁছে যায় আমাদের তুলসীতলায়। আর আমাকে ফাঁকি দিয়ে ঠাকুমা ঠিক ঠিক ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি লাল বারান্দা থেকে উঠোনে নামতেই কীর্তনের দল দুলে দুলে তুলসীগাছের চারপাশ প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। ঠাকুমাও ওদের সাথে সাথে প্রদক্ষিণ করছে। দশ বারোজন মানুষের সে ভীড়ে ঠাকুমা কেমন যেন মিলেমিশে গেছে।
আমি পা বাড়াই দ্রুত, ঠাকুমা যদি ভুল করে ওদের সাথে চলে যায়। প্রায় দৌড়ে গিয়ে দলের মধ্যে মিশে ঠাকুমার আঁচল প্রায় ধরেই ফেলেছি, তখনই মনিপিসি পাশ থেকে এসে হাত ধরে। এরপর আমাকে একটু আলাদা করে নিয়ে বলে, বাসি কাপড়ে ওদের ছুঁতে হয় না। তবুও আমার চোখ ঠাকুমার সাথে লেপ্টে থাকে, পেছন থেকে আমাকেই তো ডাকতে হবে ঠাকুমাকে।
তুলসীতলার প্রদক্ষিণ শেষ হতেই ঠাকুমা গুড়ের বাতাসা দেয় ওদের কোঁচড়ে। ওরা চিলতে গলি পেরিয়ে শুক্লাদের বাড়ি চলে যেতেই আমি ঠাকুমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, ও ঠাকুমা সব বাতাসা ওদের দিয়ে দিলে?
দু'টো গুড়ের বাতাসা হাতের মুঠো খুলে আমাকে দেখিয়ে ঠাকুমা বলে, আমার দিদির জন্য রেখে দিয়েছি তো।
গুড়ের বাতাসা হাতে নিয়ে উঠোনের আমগাছের নীচে যেতেই রান্নাঘর থেকে খেজুরের গুড়, ঘি আর সুজির মিশ্র একটি ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দেয়। বুঝে যাই আজ তিনকোনা পরোটাও হবে। তবে এসবের সাথে আর যেটা হবে তাতে অবশ্য আমার ভাগ নেই।
শীতের দিনগুলোয় আমাদের বাড়িতে দুধ, আদা আর খেজুর গুড় দিয়ে চা হতো। সাদা রঙের ছোট ছোট কাপে ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে সেই চা যখন মা কাকিমারা খেতো, আমার লোভাতুর চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকতোনা।
অগ্রহায়ণ মাস জুড়েই ঠাকুমা নিরামিষ খেতো। তাই দাদুর পাঠানো বাজারের ব্যাগ আসার আগেই ঠাকুমার নিজের বাগানের সবজী এসে উঠতো রান্নাঘরে।
বাইরবাড়ির তাঁতঘরের সামনে শিমের মাঁচাতেও ফুল চলে এসেছে বেশ কিছুদিন আগে। অগ্রহায়ণের নীহার মেখে দু'একটি শিমও তিরতির করে ঠান্ডা বাতাসে কাঁপছে। দেবদারু গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াই আমি আর ঠাকুমা। তাঁতঘর থেকে অনবরত খটাস খটাস শব্দ ছাপিয়ে ভেসে আসছে,
' তান ডোলে মেরা মন ডোলে মেরা দিল কা গ্যায়া কারার রে
ইয়ে কোন বাজায়ে বাঁশুরিয়া।'
সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম গানের সুরও এমন দুলে দুলে বাতাসে ভাসে।
ঠাকুমা কালো পাথরের বাটি ভরে কচি শিম তোলে। আর মরিচগাছের লাল হয়ে যাওয়া মরিচও। ওদিকে আমি শিমের বেগুনী ফুল আর দেবদারু ফলের বিচি কুড়াই, আমারও তো খেলনাবাটিতে আজ নিরামিষ হবে। দু'হাত উপচিয়ে সেসব নিয়ে যখন ঠাকুমার পিছন পিছন আসছি, তখন ঠিক বাড়ির সামনে দাদুর পাঠানো বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাজির রিক্সাওয়ালাও।
আর বাজারের ব্যাগ বাড়িতে আসা মানেই উনুনে আঁচ পড়া। আমিষ আর নিরামিষ এই দু'পদের রান্নায় বারবেলা গড়িয়ে যাবে আজ নির্ঘাৎ।
উনুনে আমিষ পদ উঠতেই আমি চলে যাই বাইরবাড়ি, গোলেনুর দাদীর সীমানায়। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে উনুন বানিয়ে আমার জন্য অপেক্ষায় করছে সুমি। আমরা আজ খেলনাবাটিতে পূজোর ভোগ রান্না করবো। আমাদের রান্নার বাহার দেখে গোলেনূর দাদীও এসে দাঁড়ায়, কীরে তোদের এত রান্না কে খাবে? আমি তাড়াহুড়ো করে কাঁঠাল পাতা কুড়িয়ে এনে কয়েকটি শিমের ফুল দিয়ে বলি, দাদী দেখো তো ভোগে লবণ ঠিক আছে নাকী?
গোলেনূর দাদী ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে সে ভোগ খায়য়, আরেকটু ঘি দে মনি। ভোগের স্বাদ তো ঘিয়ের ঘ্রাণেই আসে। সুমি খুব উৎসাহ নিয়ে খানিকটা মাটি তুলে রান্নার পাতিলে দিয়ে বলে, এবার ঘ্রাণ ছুটবো দাদী।
আমাদের ভোগ রান্না শেষ হতেই মনিপিসির হাঁক, মনি বেলা হয়েছে স্নান করে খেয়ে নে।
কীভাবে খাবো? ঠাকুমার নিরামিষ রান্না এখনো হয়নি। আমি দৌড়ে স্নান করে ঠাকুমার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমিষ রান্না শেষে ঠাকুমা উনুন মুছছে তখন, দিদি তুমি খেয়ে নাও নিরামিষ রান্নায় বেলা যাবে।
তা আমি শুনলে তো, আমার ওই নিরামিষ রান্না চাই-ই।
ঠাকুমা তাড়াহুড়ো করে উনুনে নিরামিষ কড়াই বসায়। তাতে সর্ষের তেল, আর কালোজিরা ফোড়ন। এরপর সবগুলো শিম পড়ে কড়াইয়ে। হলুদ আর লবণ সেই কচি শিমে পড়তেই তাদের রঙগুলো আরোও সবুজ হয়ে ওঠে। এরপর লম্বা ফালি করে রাখা আলুও ঢেলে দেয় ঠাকুমা কড়াইয়ে। অল্প সময় ঢেকে ঢেকে সেই শিম আর আলু মজায় ঠাকুমা। শিম আর আলুগুলো মজে আসতেই চন্দনের মতো মিহি করে বাটা সর্ষে আর কাঁচামরিচ বাটা পড়ে তাতে। এরপর একটু সেই সর্ষে বাটার বাটি ধোয়া জল।
সর্ষে বাটা দিয়ে ঠাকুমা বেশী সময় এই চচ্চড়ি উনুনে রাখতেন না। একটু নেড়েচেড়ে অল্প চিনি আর সর্ষের তেল ছড়িয়ে নামিয়ে নিতেন উনুন থেকে।
আর এসবের মাঝেইই মা নারিকেল কুড়িয়ে দিয়েছে। ঠাকুমা সে কুড়ানো নারিকেলে সর্ষে বাটা, হলুদ, লবণ, ময়দা, চালের গুড়া, কালোজিরা আর কাঁচামরিচ মিশিয়ে নেয়। মেশানো নারিকেল অল্প অল্প করে হাতে নিয়ে আঙুলের চাপে চ্যাপ্টা করে ছেড়ে দেয় পেতলের কড়াইয়ের তেলে। ডুবো তেল নয়, অল্প তেলে ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে ভেজে নেয় ঠাকুমা এই নারিকেলের বড়া।
বাড়ির সবার পাত উঠে গেলে রান্নাঘরের বারান্দায় পড়তো আমার আর ঠাকুমার পাত। ঠাকুমার পাতের সাদা ভাতে অবেলার মরা শীতরোদ এলিয়ে পড়তেই, আমি বায়না ধরতাম আরোও দু'টো নারিকেলের বড়ার জন্য। নিজের পাত থেকে আমার পাতে নারিকেলের বড়া ঠাকুমা তুলে দিতেই দাদুর রেডিও থেকে ভেসে আসতো,
'খুঁজি তারে আসমান জমিন
আমারে চিনি না আমি,
কী বিষম ভ্রমের ভ্রমি
আমি কোন জন, সে কোন জনা।‘
স্মৃতি, তোমার এই লেখা গুলি ভীষণ মন ছুঁয়ে যায় । মনে হয় যেন সব ছবির মত দেখতে পাচ্ছি ।
স্মৃতি, তোমার এই লেখা গুলি ভীষণ মন ছুঁয়ে যায় । মনে হয় যেন সব ছবির মত দেখতে পাচ্ছি ।
খুব ভালো লাগছে এই সিরিজ
স্মৃতি বা মণি যে নামেই ডাকি না কেন, তুমিই যে তোমার সেই কুয়াশামোড়া স্বপ্নমাখা জীবনের জলছবির অব্যর্থ রুপকার সন্দেহ নেই...
আমি একথা মানি যে আমরা সবাই কোন এক পরিণত সময়ে নিজ নিজ জীবনের " নায়িকা" হয়ে যাই। তখন এমনটি হয় যে, জীবন বা জীবনপ্রবাহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সবকিছুই যেন সেই "আমিত্ব" কে ছাপিয়ে উঠতে পারে না....
কিন্তু তোমার সবকিছুই যেন অন্যরকম.... অন্য কথা কয়।...
তাই তোমার সেই সোঁদাগন্ধমাখা শিউলিভেজা অস্পষ্ট অথচ চিরন্তনী গল্পের নায়িকা কিন্তু "ঠাকুমা".....!!!
মায়াময় । বড় সুন্দর লেখা - অক্ষরেই ঘ্রাণ আসে, নিরামিষ রান্নার আস্বাদ। বাটি ধোয়া জলের ডিটেইলিং মুগ্ধ করে।
বাঘু বেকারের সিরিজ , ইন্দুবালার ভাতের হোটেল, যদি এই ভাবে সিরিজ করে ধরে রাখা যায় - না হয় পুনর্দর্শনই হল -
কত পুরানো কথা মনে পড়ে গেল।আমার ঠাকুমাকে আমি দেখিনি। আমার বড় পিসিমা অল্প বয়সে বিধবা। বছরের বেশিটা থাকত আমাদের বাড়ী। উনি আমার বড়োমা বনাম ঠাকুমা
বড্ড মায়াভরা লেখা।
বড়ো ভালো লাগলো ।শীতের রাতে গ্রামের বাড়ী তে আমি ওমনি চারটে বেড়াল নিয়ে দিদুন কে জড়িয়ে ঘুমাতাম আর দিদুন আবছা অন্ধকারে উঠে মুড়ি ভাজতে চলে যেত .
পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল
স্মৃতি দেবীর স্বাদু গদ্য শৈলীতে এক অনন্য চলমান ছবিতে মূর্ত রূপ পেলো এক বিশেষ দেশ ও কাল। সেই চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ড ও সময়ের জন্য এক অন্তর্লীন বেদনা ভিতরে বাজতে থাকে। তখনকার মানুষগুলির জীবনে সরলতা ও আন্তরিকতা লক্ষ্যণীয়।
জমিয়ে রেখে আজ পড়তে শুরু করলাম। জানতাম কি পেতে চলেছি, তার পরেও ভালো লাগা উপচে পড়ে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। নিজের ছোটবেলাটিকে ফিরে পাওয়ার আনন্দও হয়ত এই উপভোগে তার ভূমিকা রেখেছে।
প্রথম বার প্রথম পরবো পড়েই মন জুড়িয়ে গেল। কী অনবদ্য ।এ জীবন যেন গাছপালা, পাখপাখালি,উঠোনে লতানো পুঁই,কুমড়ো লতা, আম-কাঁঠালের ছায়ায় কোলে মেটে রঙা তুলসী মঞ্চ আরো অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া যাপনের নিপুণ ছবিটি।চোখ বুঁজলেই দেখতে পাই।
তারপর অন্য লেখা গুলি র জন্যে খুঁজতে গিয়ে আর পেলাম না।আজ হঠাৎই নিবেদিতা র পোস্টে চোখ পড়তেই খুঁজে পেলাম।আবার বলি অপূর্ব।আরো লিখুন।ভালোবাসা।
চোখে জল আসে। কেন ? ব্যাথামেশা একটা ভালোলাগায় মন ভরে যায়। জমিয়ে রাখছি, আবার, বারবার, পড়বো।
কি অনবদ্য লেখনী! লেখার কি অসামান্য গতি। আমি baakaruddh.
বাইরবাড়ি, শিম-সর্ষে, নগরকীর্তন - সবই খুব চেনা লাগে। আমার নিজস্ব কথকঠাকুরটির কথা মনে পড়ে ।