বেলা ডুবে যাবার ঠিক আগে ডালিম গাছের মাথায় দিনের শেষ রোদটুকু জিরিয়ে নেয়। সোনারঙা সে রোদে তেজ নেই মোটেও। নেই ফুরিয়ে যাবারও তাড়াহুড়ো। বরং পলকা হাওয়ায় সে রোদ নিভে যাবার অনেকটা আগে থেকেই শিনশিনে একটা ভাব গায়ে জড়িয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে যায়।তাই দিন ডুবে সন্ধ্যা নামার আগের সময়টুকু থেকেই বুঝে নেওয়া যায় কড়া রোদ আর গুমোট গরমের দিন ফুরালো।
তবে এসব দিনের শুরুটা কিন্তু এরকম নয়।
সকালের রোদকে মিঠে মনে হলেও বারবেলার বেশ আগেই তেড়েফুঁড়ে ওঠে রোদ। ভেতরবাড়িতে সে রোদ এগাছ ওগাছের ছায়া এড়িয়ে ঠিকই জায়গা করে নেয় উঠোনে। কিন্তু বাইরবাড়িতেই যত বিপত্তি। দেবদারু বাগানের মাথা গলিয়ে বা সুপারি বাগানের আনাচকানাচ দিয়ে একটু আধটু যা রোদ আসে, তা চিরছায়ায় থাকা স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে পড়তে না পড়তেই উঁধাও হয়ে যায়। তা বলে কিন্তু বাইরবাড়ি মোটেও শীতল নয়। বরং গুমোট একটা গরম সারাদিন আগ বাড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে।
বাইরবাড়ি থেকে ঘেমেনেয়ে ফিরতেই চলে যেতে হয় সোজা কলতলায়। টিউবওয়েলের ঠান্ডা জল গায়ে পড়তেই শিনশিনে একটা ভাব আবারও জানান দেয় কার্তিক মাস ফুরিয়ে আসছে।
কয়েকদিন আগে আইনুল চাচা এসেছিলো। পান খাওয়া সবগুলো দাঁত বের করে খুশির জানান দিতে দিতে বলেছে,
‘বাবু, জমির আমন ধানে রঙ ধরিছে।’
এই সময়ে আইনুল চাচা খুব ঘনঘন আসে। কোনোদিন আসে ধান কাটতে কতজনের জোগান লাগবে তা হিসেব করতে, আবার কোনোদিন আসে হাঁটে চটের বস্তা কিনতে। তবে যে কারণেই আসুক না কেনো আইনুল চাচার এ বাড়িতে আসা মানেই আমার আনন্দের নিত্য নতুন উপলক্ষ। সে আনন্দ কখনো গুড়ের নইয়ের বাহানায় আবার কখনও কুড়মুড়ে চাল ভাজার বাহানায়। আর সে আনন্দ দ্বিগুণ করতে কখনও কখনও আইনুল চাচার পাঞ্জাবির পকেট থেকে উঁকি দেয় কাগজের ঠোঙায় ভরা ঝুরিভাজা।
ও আইনুল চাচা, ঝুরিভাজা কোথায় পেলে?
পানের রসে ঠোঁট ভিজিয়ে আইনুল চাচার উত্তর,
আম্মার জইন্যি তার চাচিআম্মা তৈয়ার করিছে।
চাচিআম্মা ডাকটিও আইনুল চাচার শিখিয়ে দেওয়া। আবেদা চাচির মরে যাওয়া মেয়েটি নাকি ছোটবেলায় হুবহু আমার মতো দেখতে ছিলো। তাই আইনুল চাচা আমাকে আম্মা ডেকেই ক্ষান্ত হয়না, আবেদা চাচির সাথেও আম্মা যুক্ত করে দিয়ে বলে, চাচিআম্মা ডাকলি অধিকার বাড়ে আম্মা।
অধিকার, দায়িত্ব শব্দগুলো খুব শক্ত ঠেকলেও আইনুল চাচার আর আবেদা চাচির আলুথালু আদর বুঝে নিতে আমার এতটুকুও সমস্যা হয় না।
আমি ঠোঙায় মোড়ানো সেই ঝুরিভাজা মুখে পুড়তে পুড়তে কল্পনার চোখে আরেকবার দেখে নিই নাকে বড়ই ফুলের মতো নাকফুল আর ঘোমটা টানা ছিপছিপে শ্যামলা রঙা আবেদা চাচিকে। যার হাসি ঠোঁট ছাপিয়ে সবসময় চোখে ভাসে।
আজ আইনুল চাচা হাট শেষ করে তারপর আমাদের বাড়িতে এসেছে। দুপুরে আইনুল চাচা থানাঘাট থেকে ডুব দিয়ে আসার সময় ঠাকুমার অনুরোধ মতো ক’খানা কলার মাইজ নিয়ে এলো।
কলার মাইজগুলো লাল বারান্দায় পড়তেই আমার মনে এলো আজ ভোরের কথা।
হ্যাঁ, তখন ভোরই। বড়ইগাছের তলায় চাপ ধরা অন্ধকার। সে অন্ধকারে রান্নাঘরের বেড়ায় ঝুলানো টিমটিমে হলুদ ইলেকট্রিক বাতিটা যতই আলো ফেলার চেষ্টা করুক না কেনো, তা নিমেষেই তলিয়ে যাচ্ছে আঁধারে। আর বড়ঘরের দোচালায় নিঃশব্দে পড়ে থাকা আকাশটা বুক থেকে একটি একটি করে তারা হারিয়ে আরোও স্তব্ধ হয়ে আছে। শব্দ বলতে শুধু প্রাচীন বড়ইগাছের কোঠর থেকে তক্ষক ডেকে উঠছে একটু পর পর। তা যেন ভোরের নিশুতি বাড়িয়ে দিচ্ছে আরোও।
ও ঠাকুমা, এতো ভোরে উঠতে তোমার ভয় লাগে না?
বড়ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই একটা শিনশিনে হাওয়া ছুটে এলো।
ঠাকুমা ততক্ষণে উঠোনের অন্ধকারে একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে।
আমি ভোরের নিঃস্তব্ধতার সাথে গলা মিলিয়ে আবার ডেকে উঠি,
ঠাকুমা…ও ঠাকুমা…
আমার কেঁপে ওঠা স্বরে আশঙ্কাটুকু ঠাকুমা ঠিক ধরতে পারে,
দিদি, দরজা চাপিয়ে মনিপিসির কাছে যাও… আমাকে ঘাটে যেতে হবে।
তা কীভাবে হয়? ঠাকুমাকে অন্ধকারে ফেলে আমি কোথাও যেতে পারি।
তক্ষক ডেকে ওঠে আবার।
আমি দু’পা পিছিয়ে দরজা ধরে দাঁড়াই। কলতলা থেকে জলের শব্দ আসে। অন্ধকারে ছায়ার মতো ঠাকুমা গোয়াল ঘরের দিকে যায়। একটু পর ভেসে আসে ছরা পড়ার শব্দ। শব্দ মেপে মেপে বুঝতে পারি ঠাকুমা কখন রান্নাঘরের সামনে বা মাঝ উঠোনের তুলসীতলায়।
উঠোনের অন্ধকারে আস্তে আস্তে আলো পড়ছে আকাশ থেকে। প্রকাণ্ড বড়ইগাছের প্রাচীর এড়িয়ে আকাশের বুকে জাগা ভোরের আলোয় ঠাকুমা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে আমার কাছে।
গায়ে জড়ানো লাল-সাদা চেকের গামছা আর পেতলের কলসি কাঁখে নিয়ে ঠাকুমা ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে।
দিদি, মনিপিসির কাছে যাও; আমি ঘাটে যাচ্ছি ঘটের মাটি আনতে।
ঠাকুমা ফটক না পেরোতেই ঘাড়ের ওপর মনিপিসির হাত,
‘আজ সংক্রান্তি, বেলা ওঠার আগেই উনুনে আঁচ দিতে হবে।’
কলতলা থেকে ভেজা কাপড়ে মা এসে দাঁড়ায়,
‘ঠাকুরঝি উপরতলা থেকে চাল ভেজানো মাটির মালসা নামিয়ে দাও তো।’
কাল রাতে ঠাকুমা মাটির মালসায় চাল ভিজিয়ে রেখেছে। মালসায় ভেজানো আমন চাল আজ উনুনে উঠবে সবার আগে।
সেই চালের সাথে পাঁচরকম ডাল আর সবজিও সেদ্ধ হবে। ঘি মিশিয়ে তা পড়বে সকালের পাতে।
তবে আজ সকালে সবার পাত পড়বে না। ঠাকুমা, মা আর মনিপিসির আজ উপোস।
রান্নাঘরের উনুনে আঁচ পড়ে গেলো। সারারাত জলে ভিজে থাকা চালের মালসায় সে আঁচ লাগতেই চালগুলো ফুলতে শুরু করেছে। লালচে আমন চালের ঘ্রাণ বাড়ির বাতাসে একটু একটু মিশে যাচ্ছে।
সকালের পাত উঠে গেলেও অন্যদিনের মতো উনুনের আঁচ আজ নিভলো না।
দুপুরের রান্না উঠবে যে তাতে। আজ দাদুর বাজারে যাওয়া বারণ। বাজার থেকে এ মাছ ও মাছ কিনে দাদু রান্নার তালিকা বানিয়ে পাঠায় রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে। সেসব রান্না করতে প্রতিদিন ঠাকুমার বেলা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু আজ তো এমন করলে হবে না।
বারবেলায় পূজা সেরে ফেলতে হবে তো।
দুপুরের পাতে আজ তাই মোড়ের দোকানের হাঁসের ডিম কষা, বেগুন ভাজা, নারকেল দিয়ে মুগডাল আর শুকনো বড়ইয়ের চাটনি।
উনুন নিভে যেতেই দুপুরের পাত পড়ার তাড়াহুড়ো আজ। এজন্যই আইনুল চাচা কলার মাইজগুলো লাল বারান্দায় রাখতেই মনিপিসি পাত পাড়তে শুরু করলো।
একে একে সব পদ শেষে শুধু আইনুল চাচার পাতেই পড়লো একটু দুধ-কলা।
আজ দুপুরের পাত উঠে গেলোও তাড়াতাড়ি। হবেই বা না কেন, বাড়ির তিনজন মানুষ উপোস যে।
পুর্নির মা উঠোন লেপতে শুরু করেছে এঁটেল মাটি দিয়ে। মনিপিসি চালবেটে পিটুলি বানিয়ে নিয়েছে আল্পনার জন্য। আর মা ঘটের ভেতর নদীঘাটের মাটি দিয়ে তাতে ছড়িয়ে দিলো পাঁচ কলই।
উঠোনের খোলা উনুনে আঁচ পড়লো আজ অনেকদিন পর। তাতে উঠেছে পেতলের খাবড়ি। জল ফুঁটছে তাতে। ঠাকুমা অল্প একটু লবণ দিয়ে দিলো। এরপর কাল বিকেলে করা আতপ চালের গুঁড়ো পড়লো সেই ফুটন্ত জলে। গুঁড়ো ভালোভাবে সেদ্ধ হতেই ঠাকুমা উনুন থেকে খাবড়ি নামিয়ে নিলো।
উঠোনে মনিপিসি আল্পনা আঁকছে। আঁকছে চালতেলতা, শঙ্খলতা, ফুলকারি। তুলসীতলায় এঁকেছে লক্ষ্মীর প্যাঁচা। আর মা একটা মালসায় এঁটেল মাটিতে পুঁতে দিলো একটি হলুদ গাছ আর বাঁশের কঞ্চি। সেই কঞ্চির মাথায় আইনুল চাচার আনা রঙ ধরা আমন ধানের শীষ।
খোলা উনুনে এবার ঠাকুমা দুধের হাঁড়ি বসিয়েছে। তাতে মিশিয়ে দিয়েছে ঝোলাগুড়। দুধ ফুটছে। সেদ্ধ আতপ চালের মণ্ড ঠাকুমা খুব ভালভাবে মেখে নিলো আর তা থেকে বানালো ছোট ছোট লেচি। লেচিগুলোর মধ্যে গুঁজে দিলো অনেকটা করে পাটালি গুড়। হাতের তালুতে ঘুরিয়ে নাড়ুর মতো গোল হলেই লেচিগুলো দুধের হাঁড়িতে পড়তে শুরু করলো।
ডালিম গাছের মাথায় দিনের শেষ রোদের আয়েশি আড্ডা জমেছে। তুলসীতলায় জ্বলে উঠেছে প্রদীপ। ঘটে সিঁদুর গোলায় আঁকা হয়েছে পুতুল। চাল-কলা, পাঁচ কলই ভাজা আর সিধে সামনে নিয়ে মা উলু যোগার দিয়ে শুরু করলো,
অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপত্র ধরে ।
ইতুকথা একমনে শুন প্রাণ ভরে।।
খোলা উনুনের গনগনে খড়ি বের করে আঁচ কমিয়ে রেখে ঠাকুমা দু’টো দূর্বা হাতে নিয়ে বসলো কথা শুনতে।
গুড় আর আতপ চালের ঘ্রাণ মিশে যাচ্ছে চাল-কলা আর ধূপের সুবাসে। বাড়ির উঠোন উৎসবে জমজমাট।
এককোণে আইনুল চাচা পান মুখে নিয়ে একমনে শুনে চলেছে ইতু ব্রত কথা।
বেলার শেষ আলোটুকু আস্তে আস্তে এসে জড়ো হচ্ছে তুলসীতলার টিমটিমে প্রদীপে।
মা উলুযোগার দিয়ে কথা শেষ করলো।
মাখানো চাল-কলা একে একে সবার হাতে পড়লো। তবে আইনুল চাচার হাতে তা পড়লো দু’বার।
‘মা, চাল-কলার সোয়াদ খুব ভালো।’
তবে শুধু চাল-কলা নয়, এরপর আইনুল চাচার সামনে বাটিতে করে হাজির হলো দৈলা পিঠা। বেলা ডুবে আঁধার নামছে। আইনুল চাচা আর বেশি সময় থাকবে না তো।
আকাশের আলো হুট করে ফুরিয়ে গেলো। উঠোনে যেটুকু আলো তা ওই প্রদীপের। অল্প আলোয় অস্পষ্ট হতে শুরু করলো উঠোনের মানুষগুলো, তা বলে কিন্তু অচেনা নয়।
ঘটের একটু মাটি আর ঘট ছোঁয়ানো পাঁচ কলই গামছায় বেঁধে নিলো আইনুল চাচা। বাইরবাড়ির তাঁতঘরের বেড়ায় জ্বলে উঠলো ইলেকট্রিক বাতি। সে বাতিতে আর কতটুকুই বা আলো হয়।
আবছা দেবদারু তলা দিয়ে আস্তে আস্তে আইনুল চাচা বড় রাস্তার অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে।
ঠাকুমা দু’হাত কপালে ঠেঁকিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে,
দুর্গা... দূর্গা…
কাল ভোরে জমিতে ঘটের মাটি আর পাঁচ কলই ছড়িয়ে দেবে আইনুল চাচা।