এঁটেল মাটিতে লেপা উঠোনে দীঘা ধান রোদ পোহায়। বাতাসে ভাদুরে ভ্যাপসাভাব একটু একটু করে ফুরিয়ে আসে। আর খারজলে ফুটিয়ে ধুয়ে নেওয়া বিছানার চাদরের ভেজা ভেজা ঘ্রাণ বাতাসে মিলতেই ভেসে আসে ঠাকুমার গলা, মুড়ির টিনগুলো উপর থেকে পাড়তে হবে।
বড়ঘরের দোতলায় ঠাকুমার আনাগোনা বেড়ে গেলেই বুঝতাম আশ্বিন মাস চলে এসেছে। বড়ঘর আসলে ঠাকুমার ঘর। সে ঘরের একমাত্র বিশেষত্ব নকশা করা কাঠের জানালা আর দরজা। আর লোহার শিকবিহীন সে জানালায় হুড়কা নয়, পড়তো ডাঁসা। সে জানালা ডিঙিয়ে ঘরবাহির করা ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের খেলা।
আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে ঠাকুমা বলে, দিদি ওভাবে ডিঙ্গায় না হড়কে পড়ে গেলে ব্যাথা পাবে।
তখন আমি সবে বাঁধা ডিঙোতে শিখেছি। বাঁধা ডিঙানোয় আনন্দ পেয়ে যাওয়া আমি ঠাকুমার বারণ শুনলে তো। আমি কয়েকবার এপাড় ওপাড় করতেই এবার সত্যি সত্যিই হড়কে যাই। একদম ধপাস!
দিদি তুমি কথা শোনো না, তাড়াহুড়োয় মুড়ির টিনগুলো বড়ঘরের দরজায় ফেলেই ঠাকুমা আমাকে টেনে তুলছে। ঠাকুমার নিষেধ শুনিনি, তাই হাঁটুতে ব্যথা পেলেও কান্না করা যাবে না। ও ঠাকুমা, জানালা উঁচু বলেই তো আমি পড়ে গেলাম।
আমার হাত পায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ঠাকুমা বলে, দিদি উঁচু জানালা জেনেও তুমি কেনো ডিঙোতে গেলে? উত্তরহীন আমি অপরাধী চোখে ঠাকুমার দিকে তাকাই।
আমাকে বিব্রত দেখেই কীনা জানি না; ঠাকুমা উঠোনে রোদ পোহানো দীঘা ধান দেখিয়ে বলে, দিদি ধানগুলো একটু পা দিয়ে নেড়ে দেবে? সব ব্যথা ভুলে আমি উঠোনে নেমে যাই। বলকানো ধান সারারাত ঠান্ডা জলে ভিজে সকালেই রোদে পড়েছে। ও ঠাকুমা, ধান এখনো ভেজা।
ঠাকুমা দ্রুত পায়ে ধানের কাছে চলে আসে। পা দিয়ে নেড়েচেড়ে দেয় ধান, আজ সারাদুপুর রোদ খেলেই ধান শুকিয়ে যাবে দিদি। ঠাকুমা ধানে পা দিতেই আমি গিয়ে বসি ঢেঁকির উপর, ও ঠাকুমা আজ বিকেলেই ধান বানবে? মাথা নেড়ে ঠাকুমা হ্যাঁ বলতেই আমি ছুট লাগাই বাইরবাড়ি। মনিপিসি ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চুলের ক্লিপ কিনছে যে।
ফেরিওয়ালার চৌকো কাঁচের বক্সে আসলে যাদু আছে। যা চাওয়া যাই তাই মেলে। আমার একটা গোলাপি ফুল ক্লিপ লাগবে তো। আর একটা লাল নেলপলিশও। ও হ্যাঁ, লালচুড়ির কথা তো ভুলেই গিয়েছি। আমার আবদার দেখেই মনিপিসি চটপট বলে ওঠে, মনি বাচ্চাদের এত সাজতে হয় না। বললেই হলো, আমি তো পূজার জামার সঙ্গে মিলিয়ে ক্লিপ লাগাবো এবার।
আমার ঘ্যানঘ্যান শুনেই দাদু বাইরবাড়িতে চলে আসে, গিন্নি যা যা চায় কিনে দে রীতা।
আমি চুড়ি, ক্লিপ আর নেলপলিশ নিয়ে যখন উঠোনে এসে দাঁড়ায় ঠাকুমা ততক্ষণে উনুনে আগুন দিয়ে দিয়েছে। আজ খুব বেশী রান্না হবে না। দুপুরের খাওয়া সেড়ে আজ মুড়ির ধান বানা হবে যে। আজ বাজারের ব্যাগ নিয়ে কোনো রিক্সাওয়ালাও তাই আসবে না। রান্নাঘরের মাচার নীচে রাখা সবজির ধামার তলানিতে যা আছে তা দিয়েই দুপুরের পর্ব সারা হবে।
ঠাকুমা কালো পাথরের বাটি হাতে বড়ঘরের দিকে যেতেই আমি পিছু পিছু হাঁটা ধরি, ও ঠাকুমা নেলপলিশের রঙটা কত সুন্দর দেখছো? ঠাকুমা পেছনে ফেরে না, ওসব রঙ ভাল না; আমার দিদি তো রঙ ছাড়াই সুন্দর। আমি থেমে যাই। লাল বারান্দায় বসে ভাবি, কাল ফেরিওয়ালা এলে সব ফিরিয়ে দেবো।
ঠাকুমা কালো পাথরের বাটি ভরে তুলশীমালা আতপ চাল নিয়ে উপরতলা থেকে নেমে আসে। লাল বারান্দায় বসে থাকা আমার হাতে তিলের কটকটি গুঁজে দিয়ে বলে, কাল মুড়ির মোয়া বানাবো দিদি। আমি তিলের কটকটি পেয়ে আনন্দে গোলেনুর দাদীর বাড়ির দিকে চলে যাই।
আর লাল বারান্দায় অবহেলায় পড়ে থাকে ফেরিওয়ালার সেই চুড়ি, ক্লিপ।
গোলেনুর দাদীর তাঁতঘর ঘেঁষা সুপারি বাগান।একটা দু'টো কমলারঙের সুপারি সবুজ ঘাসের উপর পড়তে না পড়তেই কোথা থেকে যেন গোলেনুর দাদী চলে আসে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। তাঁতঘর ঘেঁষে কত্তগুলো পাকা সুপারি পড়ে আছে। কিন্তু গোলেনুর দাদীর দেখা নেই।
আমি পা টিপে টিপে সেই বাগানের ভেতর যাই। একটা, দুইটা, তিনটা কোঁচড় ভরে যায় আমার কমলারঙের সুপারিতে। তাঁতঘরের ভেতর কেউ গাইছে,
' বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে।
বন্ধু কাজল ভ্রমরারে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু
কয়া যাও কয়া যাও রে'
আমার কোঁচড় ভরতেই আমি দৌড়ে যাই গোলেনুর দাদীর ঘরের দিকে, ও দাদী দেখো কত সুপারি তোমার বাগানে পড়েছিলো।
গোলেনুর দাদী বারান্দায় একটা বড় জলচৌকিতে চুপচাপ হয়ে বসে আছে। গোলেনুর দাদীর চোখমুখের সে ছবি আমার খুব অচেনা। আমার ডাকে গোলেনুর দাদীর তেমন পরিবর্তন হয় না। জলচৌকিতে বসেই খুব আস্তে বলে, ঠাকুমাকে দে, পূজার জন্য সুপারি লাগবে বলছিলো।
আমি গোলেনুর দাদীর চেহারা পড়তে না পেরে যখন বাড়ির দিকে হাঁটছি তখন সুমী আমার পাশে এসে বলে, দাদাজান এ মাসেও বাড়ি আসবো না।
সুমীর দাদাজানকে আমি ক'বার দেখেছি মনে পড়ে না। তাই বলতে গেলে প্রায় অচেনা মানুষটির আসা না আসার কোনো ছাপই আমার কাছে খুব স্পষ্ট হয় না। আমি সুমিকে পেছনে ফেলে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকি, ঠাকুমা তোমার পূজার সুপারি বারান্দায় রাখলাম।
উঠোনের মেলা ধানে ততক্ষণে বারবেলার রোদ পড়েছে।
আমি কলতলা থেকে কয়েক ঘটি জল মাথায় ঢেলেই রান্নাঘরে গিয়ে উঠি। রান্নাঘর জুড়ে তখন ভাজাভুজির ঘ্রাণ। ও ঠাকুমা, কতরকম ভাজি! কাঁসার বগি থাল থেকে মুচমুচে ভাজা আলু আমার হাতে দিয়ে ঠাকুমা বলে, পটল বিরন ভাজাভুজির সাথে খেতেই ভাল লাগে।
উনুনের কড়াইয়ে বেগুনের চাক ভাজা শেষ হতেই ঠাকুমা সেই তেলেই অর্ধেক করে কেটে রাখা পটল একটা একটা করে দেয়। এপাশওপাশে একটু লাল করে ভেজে নেয় পটলগুলো। সবগুলো পটল ভাজা হলে এরপর তেলে একটু ঘি মিশিয়ে তাতে দারচিনি, এলাচ ফোড়ন দেয়। এরপর তাতে জিরা বাটা, শুকনো মরিচ বাটা, আদা বাটা, দিয়ে বেশ কষিয়ে নেয় ঠাকুমা। মশলা থেকে তেল ছেড়ে এলে ভিজিয়ে জল ঝড়ানো তুলশীমালা আতপ চাল কড়াইয়ে পড়ে। সাথে সাথেই হলুদ আর লবণ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেজে নেয়। চাল আর মশলা কষানোর ঘ্রাণ তীব্র হতেই ঠাকুমা গরমজল দিয়ে দেয় চালে। গরমজল পড়তেই কড়াইয়ের চালগুলো ফুটতে শুরু করে। খুন্তা দিয়ে নেড়ে ঠাকুমা জল আর চাল ভাল করে মেশায়। এরপর চালগুলো জল খেয়ে ফুলে উঠতেই তাতে পড়ে ভাজা পটল। এরপর ভিজিয়ে রাখা কিশমিশ আর ভাজা বাদাম মিশিয়ে ঠাকুমা উনুনের গনগনে খড়ি বের করে আঁচ কমায়। ততক্ষণে কড়াইয়ের চাল সব জল টেনে নিয়েছে। একটু ঘি আর চিনি ছড়িয়ে ঠাকুমা কড়াইয়ে ঢাকনা দেয়। তুলশীমালা আতপচালের ঘ্রাণ ততক্ষণে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঠোনে মেলে রাখা ধানে গিয়ে মিশেছে।
দাদু টিফিনে স্কুল থেকে ফিরে স্নান আর আহ্নিকও সেরে নিয়েছে। লাল বারান্দায় দাদুর পাশে আমার পাত পড়ে।পটল বিরন থেকে কিশমিশ আর বাদাম বেছে বেছে খেয়ে আবার বায়না ধরি বাদামের। দাদু নিজের পাত থেকে খুঁজে বের করে দেয় সব বাদাম।
দুপুরে সেদিন ভাতঘুম আর হয় না। ঠাকুমা রোদ মরে এলেই গা ধুয়ে ঠাকুর শয়নে দেয়।
বাইরবাড়ির গোলকচাঁপা গাছের ফুরিয়ে আসা ফুলগুলো সব তুলে আনে ঠাকুমা ভেজা কাপড়েই। ও ঠাকুমা, তুমি সব ফুল নিয়ে নিলে আমার খেলনাবাটির ফুল কই? ঠাকুমা কয়েকটি ফুল ফেলে দেয় নারিকেলের মালইয়ে। কিন্তু খেলি কই? আবার ঠাকুমার পিছে পিছেই বড়ঘরে ঢুকি।
ঠাকুমা ধোয়া শাড়ি পড়ে ঠাকুর শয়নে বসে। জল বাতাসায় পূজা। সব আচার একে একে সারে ঠাকুমা। একদম শেষে শয়ন দিয়ে ঠাকুরকে নকশী হাতপাখায় বাতাস। ও ঠাকুমা, আমাকে ওই পাখাটা দিবা? কী সুন্দর নকশা করা তোমার ঠাকুরের পাখা।
এই পাখাটা তোমার জন্য রেখে যাবো দিদি, ঠাকুমা বাতাস করা থামিয়ে বলে।
কোথায় যাবে ঠাকুমা? আমিও তো ঠাকুমার সাথেই যাবো, ঠাকুমা তো সব জায়গাতেই আমাকে নিয়ে যায়---- এসব ভাবতে ভাবতেই ঠাকুমার ঠাকুর শয়ন শেষ হয়ে যায়।
ঢেঁকির গড়ে দীঘা ধান পড়ে। মুড়ি ভাজা হবে, মুড়ির মোয়া হবে। তখন সন্ধ্যার মুখে কোথা থেকে যেন একটা ঠান্ডা বাতাস এসে মিশে যায় আমাদের বাড়ির উঠোনে।
আর ঠিক তখনি গোলেনুর দাদী আরোও দু'তিনটি কমলারঙের সুপারি হাতে নিয়ে ঢেঁকিতলা এসে দাঁড়ায়।
চোখেমুখের সেই অচেনা ভাবটুকু ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। সুপারিগুলো ঠাকুমার আঁচলে বেঁধে দেয় গোলেনুর দাদী আর বলে, বউ এই সুপারিগুলান খুব মিঠা ।
খুব ভালো লাগছে ।অপেক্ষায় ছিলাম ।আমিও এমনি পা দিয়ে উঠোনে মেলে রাখা ধান নেড়ে চেড়ে দিতাম .
পরিবেশ বর্ণনার কারণেই লেখাটা পদগুলোর মতো স্বাদু হয়ে উঠছে।
তোমার লেখার মাঝে নিজের হারিয়ে যাওয়া ছেলে বেলা খুব সহজেই খুঁজে পাই বলেই মনে হয় তোমার রসুই ঘরের অপেক্ষা করি । পড়ার সময় মনে হয় না জানি এবার কোন সময় টা ফিরে পাব। আর রেসিপি গুলি ও অসাধারন।
মুগ্ধতা..... হাত ধরে নিয়ে যায় সে কোন পুরনো দিনে।
এমন সাবলীল লেখা আমি খুব কম পড়েছি। কি করে লেখেন এমন মন কেমন করা লেখা?