এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কোলকাতার রক  

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ জুন ২০২৪ | ১৮৮ বার পঠিত
  • কোলকাতার রক
    শুকদেব চট্টোপাধ্যায়

    শৈশব থেকে দেখা কোলকাতা শহর উন্নয়নের ছোঁয়ায় পরিবর্তিত হয়েছে, সজ্জিত হয়েছে নতুন নতুন সাজে। আর এই উন্নয়নের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে চেনা জানা পুরনো অনেক কিছু। নিত্য দেখা কিছু জিনিস মানচিত্র থেকে মুছে গেলে বড় ফাঁকা লাগে। স্মৃতিবেদনাতুর হয়ে পড়ি।

    বহুতলের আগ্রাসনে শহরের বুক থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সেকালের ঘরবাড়িগুলো। সাথে হারিয়ে যাচ্ছে যৌথ পরিবার আর খোলামেলা জীবন। টু বি এইচ কে, থ্রি বি এইচ কের ভুল্ভুলাইয়ায় হারিয়ে গিয়েছে বৈঠকখানা, দালান, উঠোন, রক,পালঙ্ক, ভাল কাকু, ছোটকা, রাঙা কাকিমা, ফুল পিসির মত সুন্দর জীবনের অনেক দুর্মূল্য সামগ্রী। আমরা এখন স্কোয়ার ফুট মাপা জীবনে পাক খাচ্ছি।

    এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শহর কোলকাতায়, বিশেষত উত্তর কোলকাতায়, এখনো কিছু পুরনো বাড়ি দেখা যায়। এগুলির কিছু শরিকি বিভাজনে খন্ডিত হয়ে গেছে, কিছু পুরনো অবয়বে অখণ্ড অবস্থায় আছে। এই বাড়িগুলির আকার, আয়তন, গঠনশৈলী, গৃহস্বামীর সঙ্গতি অনুযায়ী হত। আকার ও আয়তনে যতই ভিন্ন হোক, সদর দরজার পাশে একটা রক(রোয়াক) আর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ঘর আর দালান পেরিয়ে একফালি ঊঠোন, কোলকাতার অধিকাংশ পুরনো বাড়িতে এদুটি থাকত। বাড়ির এই দুটি অংশ বাঙালির চরিত্রের এক বিশেষ দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে,সেটি হল আড্ডা। আড্ডা ছিল বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রক, বৈঠকখানা আর উঠোন ছিল সেই আড্ডারই তিনটি পরিসর। বৈঠকখানা থাকত বড়লোকেদের বাড়িতে । সেখানে নিত্য বন্ধু বান্ধবদের আড্ডা বসত। গৃহস্বামীর চরিত্র অনুযায়ী নির্ধারিত হত আড্ডার চরিত্র। বিদগ্ধজনের বাড়িতে সাহিত্যের আসর যেমন বসত তেমনই বাবুদের বৈঠকখানায় বসত সঙ্গীত ও নৃত্যের রঙিন মজলিস। মধ্যবিত্ত চিরকালই একটু রক্ষণশীল। বাড়িতে বাইরের ঘর একটা থাকত বটে, কিন্তু তা ব্যবহার হত অভ্যাগতদের সাথে কথা বলার জন্য। সেখানে আড্ডা একেবারে হত না যে তা নয় তবে তুলনায় অনেক কম। আড্ডার মৌতাত চড়াতে হলে বেরতে হত বাড়ির বাইরে।

    পুরনো কোলকাতার আড্ডার অন্যতম পছন্দের জায়গা ছিল রক। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন—আড্ডা শব্দটা রোয়াক বা চাতালের সঙ্গে জড়িয়েই প্রথম চালু হয়েছিল, আর কোলকাতাকে একটা বিশেষ প্রসিদ্ধিও দিয়েছে রোয়াক কি চাতালের শহর হিসেবে।

    যৌবনে পা দেওয়ার সাথে সাথেই ছেলেদের অনেকেরই ঠেক হত পাড়ার রকে। সে এক অনাবিল আড্ডার জগৎ। কুড়ি পেরনো ছেলে ছোকরা থেকে সত্তর পার করা বৃদ্ধ অনেকেরই বড় পছন্দের জায়গা ছিল এই রক। রকে তরুণদের প্রাধান্য থাকলেও বয়স্কদের জন্যও কোথাও কোথাও কোন বিশেষ রক সংরক্ষিত থাকত। কোন কোন রকে বয়স অনুযায়ী সময় ভাগ করা থাকত। আবার কোন পাড়ায় রক কম থাকলে কখনো কখনো কসমোপলিটন আড্ডাও দেখা যেত। লম্বা রকের এক এক ধারে এক এক বয়সীদের আড্ডা। তবে এমন আড্ডা কমই থাকত। কারণ,একই রকে বসে বড়দের সামনে ধুমপান করা বা একটু সাহিত্য বর্জিত ভাষায় গুলতানি করা সম্ভব হত না। আড্ডায় কোন রকম সেন্সর থাকলে তার মেজাজ নষ্ট হয়ে যায়।
    রকের আড্ডা একান্তভাবে পুরুষদের জগত। মেয়েদেরও আড্ডার নিজস্ব পরিসর আছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর অন্দরমহলে মহিলাদের জমিয়ে আড্ডা বসত।গড়াত বিকেল পর্যন্ত। তবু স্ত্রীরা পুরুষদের বেহিসাবি আড্ডাকে কখনই তেমন সুনজরে দেখে না। আড্ডা সেরে বাড়ি ফিরতে একটু রাত হয়ে গেলে বৌয়ের সম্ভাষণ খুব একটা মধুর হয় না।

    আড্ডার সময় রকে অপরিচিত কোন ব্যক্তির বসাটা একেবারেই পছন্দ করা হত না। কোন না কোন ভাবে তাকে উঠে যেতে বাধ্য করা হত। এই প্রসঙ্গে দুটি মজার ঘটনার কথা বলি। ঘটনা দুটির পরিণতি অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত।

    হরিশ মুখার্জী রোড আর চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রিটের সঙ্গমস্থলে একটা লম্বা লাল রক আছে। নাম, পাঞ্জাবী রক। রাস্তা ক্রমশ উঁচু হতে থাকায় রকটা প্রায় পিঁড়ের মত হয়ে গেলেও এখনো টিকে আছে। আগের থেকে একটু ফিকে হয়ে গেলেও ওখানে এখনো আড্ডা হয়। কয়েক যুগ আগে ওখানে ছিল নিতাই, টিকুন, নিলু, পান্তুদের ভরা সংসার। মাঝে সাঝে পাগলা তপনও এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ওই রকে এসে বসত। পাগল হলেও পাড়ার ছেলে আর ঠান্ডা প্রকৃতির বলে কেউ খেঁদিয়ে দিত না। একদিন বিকেল বেলা আড্ডার সময় রকের হকদারেরা দেখে অপরিচিত এক মাঝ বয়সী লোক রকে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। ওরা রকে গিয়ে বসার পরেও লোকটি ওঠার কোন আগ্রহ দেখাল না। সকলেই বেশ বিরক্ত। মজাদার বদমাইস টিকুন ছিল ঐ আড্ডার মধ্যমণি। সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে লোকটিকে দেখিয়ে অন্যদের উদ্দেশ্যে বলল,”একদম ঘাঁটাস না, মনে হচ্ছে মালটা পাগল।”
    উত্তরে নিলু বলে, “ধোপদুরস্ত জামা প্যান্ট পরে কেত মেরে সিগারেট টানছে, ও পাগল!”
    -- এমন এক একটা কথা বলিস যার কোন মানে হয় না। সব পাগলই কি ছেঁড়া জামাকাপড় জড়িয়ে ঘোরে নাকি? এ অবস্থাপন্ন ঘরের পাগল, দরজা খোলা পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাড়ির লোকজন খুঁজতে এল বলে।
    বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। পক্ষে- বিপক্ষে দু তিনবার কথার আদান প্রদান হতেই লোকটা আর চুপ করে থাকতে পারল না। রক ছেড়ে দাঁড়িয়ে টিকুনের দিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠল—আমি পাগল? শালা তুই পাগল, তোর গুষ্টি পাগল।
    লোকটির আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কুকথার স্টক সেরকম না থাকায় ওটুকু বলেই থেমে গেল।
    টিকুন এতটুকু না রেগে হাসতে হাসতে বলল, “এবার তো বুঝতে পারলি যে আমি ঠিক। পাগল কখনো নিজেকে পাগল বলে না।”
    লোকটি আর কথা না বাড়িয়ে গজরাতে গজরাতে চলে গেল।
    অমিত আর অর্চনার দেখা সাক্ষাতের পছন্দের জায়গা হল গঙ্গার ধার। । দুজনেই চাকরি করে, অমিত ডাক্তার আর অর্চনা সরকারি কর্মচারী। এক এক দিন এক এক জায়গায় বসে। সেদিন বিকেলে বসেছিল শোভাবাজারের সেকেলে একটা বাড়ির রকে। একটু পরে দেখে এক বয়স্ক লোক সামনে পাইচারি করছেন আর মাঝে মাঝে কটমট করে ওদের দিকে তাকাচ্ছেন। ওরা আন্দাজ করল যে ওদের এই প্রকাশ্যে বসে প্রেম করাটা ভদ্রলোক নিতে পারছেন না। এটা ওনার ব্যক্তিগত সমস্যা তাই ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প চালিয়ে গেল। একটু পরে আরো কয়েকজন বয়স্ক মানুষ গল্প করতে করতে ওখানে এসে জড় হলেন। প্রথম জনকে উদ্দেশ্য করে ওনাদের একজন বললেন—ওহে অরুণাভ, মুখটা অমন ব্যাজার কেন হে? রকে না বসে অমন পাক খাচ্ছ কেন?
    যার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তিনি ভুরু দুটো যথা সম্ভব এক জায়গায় এনে যুগলের দিকে ইশারা করে বললেন—বসার কি আর উপায় আছে? নিজের চোখেই তো সব দেখতে পাচ্ছ।
    অর্চনা আর অমিত বুঝতে পারল যে রকটা ওই লোকগুলোর বিকেলবেলার আড্ডার জায়গা, ওই সময় ওখানে ওদের উপস্থিতিটা কাম্য নয়। অমিত রসিক ছেলে, রকের একপাশে সরে এসে মিষ্টি করে ডাকল—ও অরুণাভ দাদু, অনেক তো জায়গা রয়েছে, এসে বসুন না। মিছিমিছি ঘুরছেন কেন? আমরা তো নাতি নাতনির মত, পাশে বসতে অত সংকোচ করছেন কেন?
    বয়স যতই হোক, রাস্তাঘাটে দাদু সম্বোধনটা অনেকেই পছন্দ করেন না।
    অরুণাভ চিড়বিড়িয়ে উঠলেন—চোপ রাও বেহায়া ছোকরা। কে তোমার দাদু হে, কে তোমার দাদু?
    রাগা দূরে থাক অমিত ব্যাপারটায় বেশ মজা পাচ্ছিল।
    আবার মিষ্টি করে বলল—ঠিক আছে দাদু বলব না। কাকুতে আপত্তি নেই তো অরুণাভ কাকু?
    অমিতের কথায় কেউ কেউ হেসে উঠলেন।
    তাইতে অরুণাভ আরো ক্ষেপে গিয়ে বললেন— এই নচ্ছারকে আর আস্কারা দিওনাতো।
    অমিত আর উত্যক্ত না করে উঠে জায়গা ছেড়ে দিয়ে অন্যদের বসতে অনুরোধ করল।
    আগতদের একজন অমিতকে চিনতে পেরে বললেন—আরে ডাক্তার চক্রবর্তী যে, কেমন আছেন ভাই?
    শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ভদ্রলোক অন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন—ক’মাস আগে আর জি কর হাসপাতালে এই ডাক্তার আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।
    অমিতের ডাক্তার পরিচয় শোনার সাথে সাথে পরিবেশটাই পালটে গেল। ওদের চলে যেতে বলা দূরে থাক, বয়সের স্বাভাবিক ধর্মে সকলে নিজেদের রোগের ফিরিস্তি শোনাতে শুরু করলেন। এমনকি অরুণাভও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসেছেন। অমিত সংক্ষেপে সকলকে সন্তুষ্ট করে ওখান থেকে চলে এল। সকলেই বসতে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু বয়স্কদের মাঝে বসে আর যাই হোক প্রেম করা চলে না।

    রকের আড্ডার পীঠস্থান হল উত্তর কোলকাতা। দক্ষিণ কোলকাতায় ভবানীপুর, কালীঘাট, চেতলার মত কিছু অঞ্চলে রকের আসর থাকলেও উত্তরের তুলনায় তা নগন্য। দক্ষিণ কোলকাতার একটা বড় অংশ অনেক পরে গড়ে উঠেছে তাই অধিকাংশ বাড়িতেই রকের ঠাঁই হয়নি। বাড়ির পুরুষেরা যাতে বন্ধু বান্ধবদের সাথে বাড়ির বাইরে বসে গল্পগুজব করতে পারে মূলত সেই কারণেই রকগুলি বানান হত। একটা সময় পরে সেগুলি চলে যেত পাড়ার ছেলেদের দখলে। সিগারেট আর বিড়ির ধোঁয়ার মেঘের মাঝে সারাদিন ধরে গুলতানি চলত। এককালের পক্ষীর দলের মত রকের আড্ডাবাজদেরও নিজস্ব বুলি ছিল। রকের সেই বুলি ঘুরত কোলকাতা এবং মফস্বলের তরুণদের মুখে মুখে। কিচাইন-ঝামেলা, গ্যানা- হাতবোমা, চাপ্লুসি-গোপনে, রসগোল্লা- অপদার্থ, ভাতি- সঙ্গিনী, বৈঠকবাজি- বিশ্বাসঘাতকতা ---রকের নিজস্ব এইসব অগুন্তি শব্দ দিয়ে অনায়াসে শব্দকোষ তৈরি করা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির বয়স্ক লোকজনের কাছে বিরক্তির কারণ ছিল তাদের গৃহ সংলগ্ন রক। নিজের বাড়িতে ঢুকতে হত উৎপাত স্বরূপ ‘রকবাজ’দের পাশ কাটিয়ে। আপাত দৃষ্টিতে এই উৎপাতদের ভিন্ন রূপও ছিল।
    বাগবাজারের নন্দ মিত্তিরকে এলাকার সকলেই চেনে। চেনার কারণটা অবশ্য ভাল কিছু নয়। অমন কিপটে আর দুর্মুখ চট করে দেখা যায় না। চাঁদা হোক বা অন্য কোন রকম সাহায্য, নন্দর কাছ থেকে কিছু পাওয়া গেছে এমন ঘটনা বিরল। প্রতিক্রিয়ায় কখনো বাড়ির সামনে মরা কুকুর বেড়াল পড়েছে আবার কখনো আড়াল থেকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ ভেসে এসেছে। কিন্তু কোন কিছু করেই নন্দকে সাইজ করা যায়নি। নন্দর ধারণা এসবের মূলে আছে ঠিক উল্টোদিকের রকের আড্ডার জানোয়ারের দল। রক কোন সময় ফাঁকা থাকে না, দু চারটে জানোয়ার সব সময়েই বসে আছে। শালাদের দেখলেই নন্দর গা জ্বলে যায়। বাড়িতে সমত্ত মেয়ে আছে তাই রাস্তার দিকের জানলাও ভরসা করে খুলে রাখতে পারে না।

    একদিন কাজ থেকে বাড়ি ফিরে নন্দ দেখে ওর বৌ যোগমায়া খুব অসুস্থ। মেয়ে ডাক্তারকে খবর দিয়েছে।

    ডাক্তার যখন এসেছে তখন যোগমায়া প্রায় সংজ্ঞাহীন। ডাক্তার যত শীঘ্র সম্ভব রুগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। একা কিভাবে কি ব্যবস্থা করবে ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে সাহায্যের আশায় নন্দ পাগলের মর ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল। প্রথমেই নজর গেল সামনের আড্ডাটার দিকে। অনেকগুলো ছেলে তখন ওখানে বসে গুলতানি করছে। তখন আর ভেবে নষ্ট করার মত সময় নেই। উপায়ন্তর না দেখে ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে নন্দ কাতর ভাবে বলল—আমার বাড়িতে বড় বিপদ, একটু আসবে ভাই?

    ঘটনা শুনে নন্দকে আশ্বস্ত করে ছেলেগুলো বলল—কাকু আপনি শান্ত হন। আমরা সকলে আছি, কোন চিন্তা করতে হবে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকজন নন্দর বাড়িতে পৌঁছে গেল। তাদের অধিকাংশই নন্দর অপছন্দের ওই জানোয়ারের দলের। নন্দকে কিছুই করতে হয়নি। ছেলেগুলোই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মুমূর্ষু যোগমায়াকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করল। ভর্তির সময় প্রয়োজনীয় টাকাটাও নিজেরাই যোগাড় করে জমা দিয়েছে। যোগমায়া যে ক’দিন হাসপাতালে ছিল সে ক’দিন রাতজাগা থেকে আরম্ভ করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ, সব ওরাই পালা করে করেছে। ডিসচার্জের দিন স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য হাসপাতালে পৌঁছে নন্দ দেখে যে ছেলেগুলো আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। এতবড় একটা বিপদের আঁচও ওরা গায়ে লাগতে দিল না। নন্দর দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল।

    এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পাড়ার অনেক বিপদ নিষ্ঠার সঙ্গে সামলাত ওই রকবাজ ছেলেগুলো। ওরা ছিল পাড়ার হেল্প-ডেস্ক।

    রকের আড্ডায় মেয়েদের পোশাকআশাক,স্ট্যাটিসটিক্স, চলন নিয়ে বিস্তারিত চর্চার পাশাপাশি খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, আনন্দ- দুঃখ, চাওয়া -পাওয়া,ঘটনা-দুর্ঘটনা, হেন বিষয় নেই যা না উঠে আসত। প্রত্যেক আড্ডাতেই দু-একজন আড্ডাধারী থাকে। এদের কেন্দ্র করেই আড্ডা আবর্তিত হয়। কথাবার্তার অননুকরণীয় ভঙ্গীতে এরা মাতিয়ে রাখে রকের পরিমণ্ডল। আড্ডায় আর এক ধরণের লোক দেখা পাওয়া যায়, যারা হাসিঠাট্টার উৎস। কোথাও মামা, কোথাও বড় ভাই, কোথাও খুড়ো নামে সম্বোধিত এই লোকগুলো ছিল আমোদের যোগানদার। গলি থেকে রাজপথ রক সর্বত্রই ছিল, তবে চাহিদা বেশি ছিল গলি আর রাজপথের মোড়ের রকগুলোর। পাশে একটা চা আর পান বিঁড়ির দোকান থাকলে তো সোনায় সোহাগা। প্রত্যেক আড্ডার নিজস্ব চরিত্র আছে, স্বাদ আছে, আবহাওয়া আছে। যাঁর যেরকম রুচি তিনি সেইরকম আড্ডার শরিক হন। রকের আড্ডার কোন অ্যাজেন্ডা থাকে না, এটিকেট থাকে না,নিয়ম থাকে না। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আড্ডা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “যে কাপড় আমি ভালবাসি আড্ডার ঠিক সেই কাপড়। ফরসা কিন্তু অত্যন্ত বেশি ফরসা নয়, অনেকটা ঢোলা, প্রয়োজন পার হয়েও খানিকটা বাহুল্য আছে, স্পর্শকোমল, নমনীয়। গায়ের কোথাও কড়কড় করে না, হাত-পা ছড়াতে হলে বাধা দেয় না, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে চাইলে তাতেও মানা নেই। অথচ তা মলিন নয়...।

    গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে রকের আড্ডার শান্তি বিঘ্নিত হতে শুরু হয়। ১৯৬৬র খাদ্য আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট সরকারের বরখাস্ত হওয়া ইত্যাদি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরে নানা জায়গায় প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এরপর নকশাল আন্দোলনে শহর উত্তাল হয়ে ওঠে। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হতে থাকে সশস্ত্র সংগ্রামের বার্তা। পেটো আর বোমের আওয়াজে কাঁপতে থাকে শহর। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে পুলিস আর সিাআরপির আনাগোনা। শুরু হয় ধরপাকড়, যার প্রধান লক্ষ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রকের আড্ডা। তখন রকের তরুণদের কিছু সমাজ বদলের স্বপ্নে ব্রতি হয়ে আত্মগোপন করেছে, বাকিরা রক ছেড়েছে বিপদ এড়াতে। সব রকের আড্ডাই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর, কোথাও বা একেবারেই শুনশান হয়ে গেল।
    রাজনৈতিক ঝড় ঝঞ্ঝা কেটে যাওয়ার পর সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে রকের হাজিরা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। কিন্তু ততদিনে সামাজিক পরিবেশ, পরিস্থিতি অনেকটাই পালটে গেছে। বসা আটকাতে কোথাও পাঁচিল দিয়ে রক ঘিরে দেওয়া হয়েছে, কোথাও আবার সিমেন্ট লেপে তাতে উল্টো করে পেরেক বা কাঁচ পুঁতে দেওয়া হয়েছে। ওই এলোমেল সময়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া রকের চেনা ছন্দ আর সেভাবে ফিরে আসেনি। রক এখন বিপন্ন প্রজাতি।পটলডাঙ্গার রকে বসে আর কেউ ‘ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফেলিস-ইয়াক-ইয়াক’ বলে পাড়া কাঁপাবেন না। সাহিত্যভাবনা থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে ঘনশ্যাম দাস, ব্রজদা, পিনডিদার মত জনপ্রিয় চরিত্রগুলো। আধুনিকতার স্রোতে ভেসে গেছে তাদের গড়ে ওঠার মত সামাজিক পরিবেশ। ভার্চুয়াল জগতের স্বপ্নরাজ্যে বিলীন হয়ে গেছে জীবন্ত আড্ডার জগত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন