তাঁতঘর-ঘেঁষা একচিলতে পুকুরটা এমনিতে খুব নিরীহ। কিন্তু জোয়ারের বাতাস পেলেই ফুলেফেঁপে জংলাগাছের ঝোপগুলো ভাসিয়ে ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় তাঁতঘরের মেঝেতে। বছরভর দেবদারুর ছায়ায় জিরানো তাঁতঘরের মেঝেতে পুকুরের জল আসতে না আসতেই সেখানে জল-কাদার একচ্ছত্র আধিপত্য।
আর ওদিকে, বিলের জলে আষাঢ়ে পূর্ণিমার ছায়া পড়তেই, আমাদের পুকুরটিও তাঁতঘর ছাপিয়ে বাইরবাড়ি ভাসিয়ে তোলে।
হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁতগুলো থেকে আসা বন্ধ হয়ে যায় মাকুর ‘খটাস খটাস’ শব্দ। আর সে শব্দ বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই, পুরো পাড়া ঢাকা পড়ে যায় এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়। তার উপরে, বানের জলে বিচ্ছিন্ন এ বাড়ি ও বাড়ির উঠোনগুলোতেও শূন্যতা। প্রয়োজন ছাড়া উঠোনের জল না মাড়িয়ে সবাই ঘরেই থাকে।
আমাদের বাড়ির উঠোনে এখনও জল আসেনি। তবে জোয়ারের বাতাস যেভাবে মেঘ টেনে আনছে তাতে জল ঝরিয়ে উঠোন ভাসতে আর কতক্ষণ।
এমন দিনগুলোতে ঠাকুমা কাঠের দোতলা ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ধানের ডোলা, সর্ষের ডোলা, গুড়ের কলস, তিলের হাঁড়ি সব পুবদিকে সরিয়ে দক্ষিণ-পাশটা ফাঁকা করে ফেলে। বাড়ির উঠোনে জল ছুঁতে না ছুঁতেই সবাইকে টেনেটুনে ঠাকুমা সেই ফাঁকা জায়গাতে জড়ো করে ফেলে। এতগুলো মানুষ ওই কাঠের দোতলায় ধরে নাকি? তবুও ঠাকুমার কথা,
জলের সাথে কত পোকামাকড় ভেসে আসে, ওরা বিষ ছড়িয়ে বাতাস পর্যন্ত বিষাক্ত করে দেয়।
তাই ঠাকুমার শাসনে সবাইকে ওই ক’টা দিন কাঠের দোতলায় থাকতে হবে।
আর এমন দিন মানেই আমার জন্য অফুরন্ত আনন্দ। কখনো মনিপিসির পাশে বসে সুয়োরানী দুয়োরানীর গল্প শোনা, আবার কখনো ছোটকাকুর সাথে বসে সাহেবকাকুর পাঠানো তাঁর অসংখ্য ছবি-ভরা রাশিয়ান অ্যালবাম দেখা।
মনি দেখেছিস, সমুদ্রের পাড়ে দিলীপদাকে একদম সাহেবদের মত লাগছে!
কিংবা
দিলীপদার ওভারকোটের মতন আমার একটা ওভারকোট লাগবে।
আমি সমুদ্র, ওভারকোটের ভিড় থেকে সাহেবকাকুর নির্লিপ্ত চোখদুটো খুঁজে বের করি। এ বাড়ির প্রতিটি মানুষের সব আগ্রহ-কৌতূহল লুটে নেওয়া মানুষটি ছ’মাস অন্তর একটা চিঠি আর বিদেশী কিছু জিনিষ পাঠিয়েই নীরব থেকে যায়। এদিকে, ঝিমনো দুপুরে, সকলের ভাতঘুমের আড়ালে, কেউ কেউ সেই মানুষটির বারবার পড়া পুরোনো চিঠি নিয়ে বসে; আবার কেউ ছেলের বড় ডিগ্রী হাতে ধরে নিজের অপূর্ণতা ভুলবে - এই আশায় সকাল-বিকেল ক্যালেন্ডারের পাতায় দিন গোনে।
তবে বানের জলের খবর না পৌঁছালেও ঠাকুমার চিঠিতে বাদলবাড়িতে সাহেবকাকুর কাছে সাফল্যের মানত হিসেবে শিন্নি দেবার খবরটা ঠিকই পৌঁছে যাবে। এই তো, কালকেই ঝড়জল মাথায় নিয়ে দাদু আর আইনুল চাচা নদীর ওপাড়ে গিয়ে শিন্নি দিয়ে এল। নদীর জলে জোয়ার এসেছিল, তাই কাল সন্ধ্যায় আইনুল চাচাকে আর বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি।
রাতে বড়ঘরের বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভে রান্না করা চালডাল মিশিয়ে পাতলা খিচুড়ি আর বেগুন-ভাজি খেতে খেতেই দাদুর হুকুম এল,
আইনুল, কাল ভোরে উঠিস, হাটবারে ভোরের ট্রেনে তাজা মাছ আসে।
ও দাদু, এই বানে হাট কোথায় বসবে?
উপজেলা অফিসের উঁচু মাঠে ভাঙা ভাঙা হাটে ভেলায় করে জোলার ঘরে থাকা তাঁতের শাড়ি, গেরস্থ বাড়ির জলে ডুবে যাওয়া গোলার ধান, ভেঙে পড়া মাচার লকলকে ডগায় ভরা পুঁইশাক নিয়ে বসে এসব দিনের হাট। তাই ভোরের ট্রেনে মাছের চালানেও এসে পড়ে দু’একটা ভালো মাছ।
গিন্নী, বানের জল যত ভাসায় হাটের বেলা তত বাড়ে।
বাবু, পানি আর একহাত বাড়লিই আমার গরুগুলান ভাসতি থাকবি নে …
আইনুল চাচার এই কথায় জোয়ারে মেঘভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দাদু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,
বিলের জলে স্রোতের টান তো মাদলা গ্রামের দিকেই রে আইনুল।
আইনুল চাচার মুখটা রান্নাঘরের বেড়ায় ঝোলানো অল্প পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাল্বের আলোয় খুব ম্লান দেখায়।
তবে সে মুখ থেকে আমার মনোযোগ সরিয়ে দিলো মনিপিসির ডাক,
মনি উপরে আয়, বিছানা করেছি।
দোতলায় কাঠের মেঝেয় কাঁথাবালিশের ঢালাও বিছানা মানে আমার কাছে উৎসব। একবার মা-পিসিদের মাঝখানে শুয়ে গল্প শোনা, আরেকবার ঠাকুমার পাশে শুয়ে, জল বাড়লে কোন কোন শস্যের ক্ষেত তলিয়ে যাবে তার হিসেব করা -
ও ঠাকুমা, মাদলা গ্রামেও বান হয়েছে? জমিগুলো এখন সব জলের নীচে?
জল আরও বাড়বে দিদি, আমনের বীজ সব নষ্ট হয়ে যাবে ...
ঠাকুমার কথা ফুরবার আগেই টিনের দোচালায় ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। এর সাথে, বাতাসে হুড়োহুড়ি করছে বড়ই গাছের চাল-ছোঁয়া ডালপাতা।
ঠাকুমা জানালার হুড়কা তুলে দেয়।
দিদি, কাঁথা গা থেকে ফেলে দিও না, জোয়ারের বাতাসে সর্দি হয়।
আমি ঠাকুমার গা ঘেঁষে শুই।
বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাতাসের তেজ। সাথে মেঘের ডাক।
নদীর জল হাতখানেক বেড়ে যাবে এই জোয়ারে … আইনুলের গোয়ালে …
দাদুর কথা বৃষ্টিজলের শব্দে হারিয়ে যেতে থাকে। আমি তলিয়ে যাই ঘুমে, ঠাকুমার ওম কেড়ে নিয়ে।
ঘুমের ভেতরেও সেই জলের শব্দ। মাথার উপরে বৃষ্টি জল নিয়ে আমি আর আইনুল চাচা ভেলায় করে এ-পাড়া ও-পাড়া ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছি মাদলা গ্রামে … জলের উপরে ভেসে আছে পুঁইয়ের মাচা … আমি হাত বাড়াই জলে … জলজ গাছে জড়িয়ে যায় আইনুল চাচার বৈঠা … দূরে আমাদের বাড়ির ছায়া বানের জলে দুলছে … বানের জলে বৃষ্টিজল ঝড়ছে … টুপ টুপ টুপ … বৃষ্টির বেগ বাড়ে … আইনুল চাচার বৈঠায় ক্রমাগত জড়িয়ে যাচ্ছে জলজ গাছ … গাছ বৈঠায় জল কেটে আমাদের ভেলা সামনে আগায় কই … বানের জলে এবার জোয়ারের ঢেউ … আমাদের বাড়ির ছায়া বৃষ্টিজলে ধুয়ে যাচ্ছে … আমাদের বাড়িটা বৃষ্টিজলে ডুবে যাচ্ছে …
মনি … মনি … ওঠ … সকালবেলা স্বপ্ন দেখছিস …
মনিপিসির ডাকে ঘুম ভাঙতেই টের পাই ঘরের দোচালাতেও বৃষ্টির জল পড়ছে টুপটাপ।
স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিস? কাঁদছিলি যে …
আমি কিছু বলি না, শুধু মনিপিসির গা ঘেঁষে বসি।
হ্যাঁ সত্যিই জল বেড়েছে কাল রাতে। বাড়ির উঠোনে সে জল চলে এসেছে। পায়ের পাতা তলিয়ে যাচ্ছে জলে নামলে।
আমার সীমানা তাই এখন বড়ঘরের লাল বারান্দা অবধি। সেখানে কেরোসিনের স্টোভে চড়েছে চা। আইনুল চাচা আরও আগেই চলে গেছে হাটে।
সকালের খাবার আজ চিড়া, খৈ, দুধ। সকালের সে পাত উঠে যেতেই আইনুল চাচা হাট থেকে ফিরল ইলিশ মাছ নিয়ে।
বাবু, ম্যালাদিন পর এইরম চকচকা ইলিশ দেকতি পেলাম; তেলতেলে পেটিখান আপনে খুব ভালো খান তো।
লাল বারান্দায় মুখে কলাগাছের বাকল বাঁধা ইলিশ মাছটা চুপচাপ পড়ে রইল।
কিন্তু তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে গেল ঠাকুমার।
কেরোসিনের স্টোভে তখন ঝিঙেশাইল চাল ফুটছে।
ঠাকুমা আইনুল চাচার থালে খৈ, দুধ আর গুড়ের কদমা ঢালে।
ও আইনুল, এটুকু খেয়ে চা নাও। আমি ভাত বসিয়ে দিয়েছি। দেরি হবে না। ইলিশ মাছ হাতে করে আনলে তুমি, তোমার সামনে তা না দিলে শান্তি পাব না।
আজ ভালোমন্দ খাবারের কথায় আইনুল চাচার পান খাওয়া দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ছে না।
চায়ের কাপ ফুঁ দিয়ে জুড়াতে জুড়াতে বলে,
মা, আইজ থাক; বিলের পানিত খুব স্রোত নামিছে; গরুগুলান বাঁচাতি হবি।
ঠাকুমা এর মধ্যে মাছ কাটতে বসে গেছে।
ভগবান কে ডাকো, কিচ্ছু হবে না।
ইলিশের রুপালি আঁশে ভরে গেলো লাল-বারান্দার ওপাশ।
জোয়ারের বাতাসে ঝিঙেশাইল চালের ঘ্রাণ এখন। ভারী সে বাতাসে বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেরোসিন স্টোভের নীল আঁচ।
মনিপিসি ভাতের হাঁড়ি উপুড় দিল, মাড় ঝরাতে।
ঠাকুমা কলতলায় মাছগুলো ধুতে ধুতে গলার স্বর চড়াল,
রীতা, পুঁইয়ের মাচা থেকে কয়েকটা ডগা নিয়ে আয়।
আজ আমার পিছু ধরার বায়না উপেক্ষিত হল।
না, তুই এখন জলে নামিস না, এই জলে গা চুলকায়।
মনি চলে গেল ঠাকুমার বাগানের দিকে।
ঠাকুমা কলতলা থেকে এসেই স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে দিল। পুঁইয়ের কচি ডগাগুলো হাত দিয়ে ভেঙে নেয় ঠাকুমা। লোহার কড়াইয়ে সেই পুঁইয়ের পাতাডগা, হলুদ, লবণ আর কাঁচামরিচ ফেলে ঠাকুমা তাতে ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। আলতো নয়, বেশ জোর দিয়েই ঠাকুমা তা মাখাতেই পুঁইয়ের পাতাডগা সব এলিয়ে পড়ল। ঠাকুমা এবার তার উপরে শুইয়ে দিল কতগুলো ইলিশমাছের চাকা। হাত-ধোয়া জল জড়িয়ে গেল মাছগুলোর গায়ে।
কড়াই স্টোভে চড়ল। ঢাকনা পড়ল তাতে।
আইনুল, আর বেশি সময় লাগবে না।
ঠাকুমার কথার উত্তর দেবার আগেই চঞ্চল হয়ে উঠল আইনুল চাচা,
মা, আমি কলতলা থেইক্যা খানিক পানি ঢাইল্যা আসি; বান ঠেইলা বাড়িত যাতি বেলা গড়াইয়্যা যাবিনি।
ঠাকুমা মাথা নেড়ে সায় দেয়।
স্টোভের আঁচ কমিয়ে ঠাকুমা মাছগুলো আলতো হাতে উল্টে দেয় ঠাকুমা। নরম মাছগুলো তেল-ঝোলে আরও চকচকে হয়ে উঠেছে। কচি পুঁইয়ের ঘ্রাণ আর ইলিশের ঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে জলমগ্ন বাড়ির উঠোনে।
ঠাকুমা আরও কয়েকটি চেরা কাঁচামরিচ দিয়ে মাছের কড়াই ঢেকে দিল।
আইনুল চাচার পাতে পড়ে গেছে ধোঁয়া ওঠা ঝিঙেশাইল চালের ভাত। সে ভাত জুড়াচ্ছে জোয়ারের বাতাসে।
অল্প আঁচে কড়াইয়ে তেল ছাড়ছে বর্ষার ইলিশ।
আইনুল চাচা স্নান সেরে লাল বারান্দায় উঠে এল। বানের জলে ভেজা পায়ের ছাপ সে বারান্দায় ফেলে এগিয়ে গেল কাঁঠাল কাঠের পিড়ির দিকে।
ঠাকুমা পাতের ঝিঙেশাইল ভাতের পাশে তেলতেলে ইলিশের পেটিটা তুলে দিল, আর ভাতের ওপর কাঁচামরিচ।
ভাতের পাত পড়ল আইনুল চাচার সামনে।
পুঁই ইলিশের তেল-ঝোল ভাত মেখে আইনুল চাচা মুখে পুরতেই আকাশে জমে থাকা জোয়ারের মেঘে আরেক পরত মেঘ জমল। এলোমেলো বাতাসে তিরতির করে কেঁপে উঠল উঠোনে জমা বানের জল, তাতে পেয়ারা গাছের নিথর ছায়াটুকুও এলোমেলো হয়ে গেল।
আইনুল, আস্তে আস্তে খাও। নদীভাঙা, দেশভাঙা মানুষগুলোকে বানের জল আর কতই বা ভয় দেখাবে …
ঠাকুমার কথা শেষ না হতেই বৃষ্টিজলে ভেসে যেতে লাগল
পেয়ারা গাছের সেই ছায়াটুকুও।
উফফফ। ইলিশ মাছের ছবিটা দেখে মন উদাস হয়ে গেলো পুরো। ফ্রেশ ইলিশ কতকাল যে খাইনি। কিছু বাংলাদেশী বা ইন্ডিয়ান দোকানে যে ফ্রোজেন ইলিশ পাই , সেগুলোর বয়স আমাদের থেকে বেশি হয়তো।
:(:(
অসাধারণ । অসাধারণ ।অসাধারণ ।
আর পর্ব নাই? আসবে না?? কি হবে তাহলে?? কি পড়ে জ্বালাপোড়া ছাতাপড়া দাগধরা মন জুড়াব এমন আরামে???