বরইগাছের পাতা চুইয়ে বড়ঘরের টিনের চালে টুপটাপ নীহার পড়ার শব্দে আমি আরেকটু আঁকড়ে ধরি ঠাকুমাকে। আমার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে লেপ টেনে গলা অব্দি ঢেকে দেয় ঠাকুমা, শীতে জাক দিছে দিদি। ও ঠাকুমা, এখনো তো অন্ধকার। আমার হাত ছাড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে দু'হাত জড়ো করে কপালে ঠেকায় ঠাকুমা। আমার ফিসফিসানি ঢাকা পড়ে যায় টিনের চালের নীহার চুইয়ে পড়ার শব্দে। দিদি, পৌষমাসে সলক হতেই তো ভরদুপুর হয়ে যায়।
ঠাকুমা আর দেরী করে না। অন্ধকার উঠোনে রান্নাঘরের বেড়ায় লাগানো টিমটিমে বাল্বের আলোয় ঠাকুমার লম্বা ছায়া পড়ে। আমিও লেপের ওম ছেড়ে ঠাকুমার পাতলা চাদর জড়িয়ে লাল বারান্দায় দাঁড়াই। নীহারে পা ভিজে শীতশীত লাগতেই মায়ের গলা, মনি স্যান্ডেল পড়ো। পাশে মনিপিসির বড় স্যান্ডেলে পা গলিয়ে ঢেঁকিতলা গিয়ে দাঁড়াই। উঠোনের বাতি নিভে যেতেই বুঝি সাদাটে কুয়াশা প্রকাণ্ড বরইগাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘাপটি মেরে আছে।
আজ ঠাকুমা কেন যেন খুব তাড়াহুড়া করছে।
পূজার ফুল তুলতে সাহাপাড়ার ওদিকেও যায় না। বাইরবাড়ি থেকে কাঠটগর এনে লাল বারান্দায় রেখেই এঁটেল মাটিতে উঠোন লেপতে বসে। বড় বৌমা পেয়ারা গাছের তলায় মাটির ডুলি আর বেতের ধামা এনে জড়ো করে। সাদাটে কুয়াশা আরোও সাদা হয়ে বাড়ির উঠোন কেমন ধোঁয়াটে করে দিয়েছে।
ও ঠাকুমা, আজ আইনুল চাচা আসবে?
কোনোরকমে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেই ঠাকুমা কলঘরে ঢুকে যায়। আমি বড় বৌমার দেখাদেখি বেতের ধামাগুলো উঠোনে উলটো করে রাখতে থাকি। আইনুল চাচা আসার কারণ যাই হোক না কেন, আমার আনন্দের কারণ কিন্তু আলাদা।
মানুষটি এ বাড়িতে এলেই আমি গুড়ের নই খেতে পাই। কখনো কখনো সেই নইয়ে সাদা তিলও মেশানো থাকে।
ঠাকুমা পূজা সেরে আসতেই উনুনে ওঠে মোটা লাল আউশ চালের ফেনা ভাত। আর তাতে ভাতেসেদ্ধ নতুন আলু, সীম, বেগুন। ফেনাভাত উনুন থেকে নামানোর আগে লবণ আর ঘি মেশাতেই আমি রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে বসি। ঠাকুমার তাড়াহুড়ার সাথে আমার আনন্দ মিশে সারা বাড়িতে বেশ একটা উৎফুল্ল ভাব তখন। আমার পাশে বসে ঘি মেশানো ফেনাভাতে দাদু কয়েকটি কাঁচামরিচ ভেঙে নিয়ে বলে, আইনুল আসলে আমাকে খবর দিও গিন্নী।
সকালের খাবার সারা হতেই উঠোনে সাদা কুয়াশা কেটে নরম রোদের উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে যায়। ঠাকুমা মাটির ডুলি টেনেটুনে রোদে দেয়। বেতের ধামাগুলো একটার পর একটা গোছাতেই বাইরবাড়িতে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ। হাতের ধামা ফেলে আমি দৌড়ে যায় বাইরবাড়িতে।
আইনুল চাচা, কত্তগুলো বস্তা!
আইনুল চাচার মোষের গাড়ি ঠিক আমাদের বড়ঘর ঘেঁষা বাইরবাড়ির মাটিতে চাকার দাগ ফেলে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের তাঁতঘরের সামনে। আইনুল চাচা পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে হেসে বলে, আম্মা ঠাকুমারে ডাকো।
আমার ডাকতে হয় না, মাথায় ঘোমটা টেনে ঠাকুমা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ও আইনুল, বস্তাগুলো ভেতরবাড়ির উঠানে রাখো।
বাবু কই? আইনুল চাচার কথায় আমার মনে পড়ে যায় দাদু তো খবর দিতে বলেছিলো।
আমি ছুট লাগাই স্কুলের দিকে।
গোলেনুর দাদীর বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড় পাড় হয়ে, থানাঘাটের পুকুর পাড় ঘেঁষে পোস্টঅফিসের সামনে গেলেই দাদুর স্কুল। আমি না থেমে এক দৌড়ে স্কুলের বারান্দায় উঠে যায়। ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। দপ্তরি কাকার ঘরে উঁকি দেই আমি। দাদু কই? আমাকে বসিয়ে দপ্তরি কাকা চলে যায় দাদুকে ডাকতে।
দপ্তরি কাকার ঘরের জানালা দিয়ে কালিবাড়ির বটগাছটা স্পষ্ট দেখা যায়। তার তলায় নিতাই রুহিদাস বসে বসে জুতা সেলাই করছে। দাদু ক্লাশ শেষ করে আসছে তুমি বসো, দপ্তরি কাকা ঘরে ঢোকে না। স্কুলে পাতকুয়ার পাশে টিউবওয়েল বসানো হচ্ছে, সেখানে চলে যায়। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে টিউবওয়েল বসানোর কাজ দেখতেই দপ্তরি কাকা দুইবার ঘন্টা বাজিয়ে দেয়। দ্বিতীয় ক্লাশ শেষ হলো। গিন্নী চলো, আমি দাদুর পিছন পিছন হাঁটা শুরু করি।
কালিবাড়ির মোড় পেড়িয়ে বাড়ির রাস্তা ধরতেই আমার আবদার, দাদু রঙিন কাঠি লজেন্স নেবো। মোল্লা দাদুর দোকান থেকে আনারস আঁকা কাগজে মোড়ানো কাঠি লজেন্স হাতে নিয়ে দাদুকে পেছনে ফেলে আমি প্রায় দৌড়ে আমাদের তাঁতঘরের সামনে চলে আসি। ততক্ষণে প্রায় ফাঁকা আইনুল চাচার মোষের গাড়ি। দাদুকে রাস্তার কোণায় দেখা যেতেই আমি কাঠি লজেন্স মুখে পুড়ি, দাদু বস্তা আরোও আছে কিন্তু। আমি দাদুর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বাড়ির উঠোনে মাষকলাই আর সরিষা গায়ে গা লাগিয়ে পড়ে আছে। আর বাটি ভরা মুড়ি, মুড়কি, গুড় নিয়ে আইনুল চাচা লাল বারান্দায় বসে আছে। ঠাকুমা গ্লাস ভরে চা এনে দিতেই আইনুল চাচার লাল দাঁতগুলো ঝিলিক দেয়, মা একটা পান দিয়েন।
আইনুল চাচা ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে শব্দ করে করে চা খায়, চায়ের গ্লাস লাল বারান্দায় উপুর করে বেশী করে জর্দা দেওয়া পান মুখে পুরে। একটু পরপর লাল দাঁত বের করে হাসে কিন্তু আমার নইয়ের কথা বলে না তো।
উঠোনের রোদে মুগডালের বস্তা খুলতে থাকা আইনুল চাচার পাশে দাঁড়িয়ে উশখুশ করতে থাকি আমি। বড়ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে দাদু, ও আইনুল এবার মাসকলাই-এর দানা তো বেশ বড় রে। পাশে থাকা আমার উশখুশ অগাহ্য করতে থাকে আইনুল চাচা, বাবু এবার মুগের রঙও সোনার মতো হইছে দেখেন।
আমার ধৈর্য্যের দম ততক্ষণে ফুরিয়ে এসেছে, আইনুল চাচা নই আনোনি এবার। আবার লাল দাঁতের ঝলক, জামাটা নিইয়্যা আসো।
আমি রান্নাঘরের সাথে লাগানো মইয়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখা আইনুল চাচার ঘিয়ে পাঞ্জাবীটা নিয়ে আসি এক দৌড়ে। সেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বেরিয়ে আসে কলাপাতায় মোড়া নই। তাতে দু'একটা সাদা তিলও উঁকি দিচ্ছে। সবুজ পাতার সে আনন্দ পৌষের মরা রোদে মেলে রাখা মুগ, মাসকলাই আর সর্ষের সাথে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। বাড়ির উঠোন তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে আগত অতিথ আপ্যায়নের। আজ হাট থেকে রিক্সাওয়ালার হাতে বাঘকাকু পাঠিয়েছে শোলমাছ।
বাজারের ব্যাগ উঠোনে পড়তেই ভেতর থেকে সাদা পেটের মিশমিশে কালো শোলমাছ হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে। উঠোনের বুকে হেলেদুলে মাখতে থাকে মাটি। বড় বৌমা কচুপাতা আর হাতভরে ছাই নিয়ে এসে দাঁড়ায় পাশে। ছাইমাখানো মাছের কালো আঁশটেগুলো কচুপাতা ছাড়িয়ে উঠোনের মাটিতে গিয়ে পড়ছে, ততক্ষণে বাতাসে ঘি মেশানো বাঁধাকপির ঘ্রাণ। আমি নই খেতে খেতে রান্নাঘরে গিয়ে উঠি, ও ঠাকুমা তালবেগুন ভাজি করবা? আর ফুলকপি আর মটরশুটি দিয়ে কী হবে?
মুগডাল ছিটিয়ে রান্না হবে, জলে ভিজিয়ে রাখা বেশ কয়েকটা শুকনোমরিচ পাটায় বাটতে বসে যায় ঠাকুমা। তালবেগুনের চাক ভাজতে উনুনের পাশে বসে মা।
ততক্ষণে উঠোনে সব শস্য বস্তা খুলে ঢালা শেষ আইনুল চাচার। সারা উঠোন জুড়ে শস্যের পিরামিড। পুন্যির মা কুলো নিয়ে বসে গেছে পেয়ারা গাছের নীচে। সর্ষে ঝেড়ে ঝেড়ে বেতের ধামায় ভরছে। সর্ষের ধুলো বারবেলার ভারী বাতাসে মিশে বাড়ির উঠোনেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
মুগডাল ছিটিয়ে ফুলকপি আর মটরশুঁটির ডালনা রান্না শেষ।
উনুনে ধোয়া কড়াই ওঠে। শোলমাছে হলুদ আর লবণ মাখিয়ে তেলে ছাড়ে ঠাকুমা। ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দে উঠোনের শস্য ছাড়ার শব্দ লুকিয়ে যায়।
মাছগুলো লাল করে ভেজে তুলে, সেই তেলে জিরা আর তেজপাতা ফোড়ন পড়ে। এরপর হলুদ আর লবণে মাখানো ডুমো করে রাখা নতুন আলু কড়াইয়ে পড়ে। আলুগুলো বেশ কিছুক্ষণ ভেজে ঠাকুমা লাল মরিচ বাটা আনেকটা দিয়ে দেয়। বাটনা রাখা বাটি ধুয়ে অল্প একটু জলও দেয় তাতে। অল্প সময় নেড়েচেড়ে এবার জিরাবাটা আর হলুদ গুড়া কড়াইয়ে দিয়ে হাত ধোয়া জল ছিটিয়ে ঠাকুমা নাড়তে থাকে মশলা আর তেল আলাদা হওয়া পর্যন্ত। আলুর গায়ে লাল মশলার পরত পড়ে যায়, তেল আলাদা হয়ে।
পেতলের ঘটি থেকে জল ঢালে ঠাকুমা কড়াইয়ে। জলের তলায় আলুগুলো লুকিয়ে পড়ে। উনুনে নতুন খড়ি ঠেলে দিয়ে আঁচ বাড়ায় ঠাকুমা। কড়াইয়ের ঝোল ফুটে ওঠে। লাল করে রাখা শোলমাছের টুকরো গুলো লাল ঝোলে পড়ে আরোও লাল হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ ঝোল ফুটিয়ে চন্দনের মতো বাটা গরম মশলা আর ঘি দিয়ে কড়াই নামায় ঠাকুমা।
আমি উঠোনে এসে দাঁড়াই। ও আইনুল যাও চান সেরে আসো, বারান্দা থেকেই দাদুর হাঁক। আইনুল চাচার লালদাঁতের হাসি, আমি থানাঘাট থেকে একখান ডুব দিইয়্যা আসি।
বড়ঘরের বারান্দায় আজ দুইপাশে পিঁড়ি পড়েছে। একপাশে দাদু আর আমি, অন্যপাশে আইনুল চাচা। লাল শোলমাছের রসা শুশিয়ে শুশিয়ে শেষ করি আমি। ঢকঢক করে ঠান্ডা জল খাই। তবুও আমার নাকের জল পড়া কমে না।
এবার হরিপদ ঘোষের দিয়ে যাওয়া দই আমার আর আইনুল চাচার পাতে পড়ে।
মা, দইয়ের মাথা আমারে দিলেন? আইনুল চাচার হাসিটুকু ফুরায় না। আমি ঝালে জ্বলতে থাকা জিহবায় দই রেখে জুড়ানোর অপেক্ষা করতে থাকি।
সব মাটির ডোলায় ডাল আর সর্ষে ভরা শেষ হতে বিকেল গিয়ে সন্ধ্যায় মেশে।
বিকেলের রোদ মরে যেতেই বাতাসে কনকনে শীতের জাড় নামে। আইনুল চাচা মাফলারে মাথা আর গলা পেঁচিয়ে মোষের গাড়ির ক্যাঁচক্যাচ আওয়াজ তুলে যখন মাদলা গ্রামের দিকে রওয়ানা হয়, আমি আর মনিপিসি তখন আইনুল চাচার নিয়ে আসা চালভাজা বেশী করে সর্ষের তেল মাখিয়ে বাইরবাড়ির বেঞ্চে বসে কুড়মুড় করে খেতে থাকি।
ঠাকুমার সন্ধ্যাপূজার ঘন্টাও বেজে ওঠে একইসাথে।
ছবির মত একটি গল্প আর সাথে একটি অসাধারণ রেসিপি । মুগ্ধ হয়ে পড়েছি ।
মনে হয় অনন্তকাল চলুক এই ধারাবাহিক।
মন কেমন করে....কি যেন ছিল..কি যেন মনে পড়িপড়ি করে...মন টা কেম..ন করে ...