সকালের রোদ যতই মিঠে হোক না কেন দুপুর হতে না হতেই তাতে মন খাঁ খাঁ করে ওঠে। আর সে রোদে মাটি তেতে ধুলো ওড়ায় বাতাসে। রাস্তার ওপারে জোলাপাড়ার সারি সারি শিমুলগাছ।
গাছগুলো থেকে সাদা তুলো সুযোগ পেলেই উড়ে এসে পড়ছে আমাদের বাইরবাড়ির আঙিনায়, জড়িয়ে যাচ্ছে নিমগাছে।
তাঁতঘরের গা লাগোয়া নিমগাছে আসতে শুরু করেছে একটা দুটো ফুল। দুপুর একটু থিতিয়ে আসতেই সেই নিমগাছের তলা থেকে ভেসে আসে নৃপেনকাকার বাঁশির সুর,
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে—
তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায়
পারে লয়ে যাও আমায়...
তবে সে বাঁশির সুর কখনোই আমি পুরোটা ধরতে পারি না। বড়োঘরের সিলিং ফ্যানের ঘটাং ঘটাং আওয়াজের তলায় সেই সুর ঘুরপাক খেতে খেতেই হারিয়ে যায় সবসময়। তবে আজ তা হল না।
আজ সকাল থেকেই ঠাকুমা খুব ব্যস্ত। উঠোনের তুলসীতলা গোবরজলে সেই ভোরেই লেপে রেখেছে ঠাকুমা। আর থানা ঘাট থেকে ফুলের সাজি ভরে ধুতরা ফুলও এনে রেখেছে খুব সকালে। নিত্যপূজায় কিন্তু সে ফুল দেয়নি ঠাকুমা।
—ও ঠাকুমা, সাজিতে ধুতরা ফুল থেকে গেল তো।
“ওগুলো বিকেলের জন্য রেখে দিয়েছি দিদি”, ব্যস্ত ঠাকুমা নিত্যপূজা সেরে তাড়াহুড়ো করে বাইরবাড়ির দিকে চলে যায়।
শংকরজ্যাঠার মন্দির থেকে আজ পাটঠাকুর বের হবে। ঠাকুমা বলে নীলঠাকুর। আর ক-দিন পরেই চড়কপূজা। তবে আমার কিন্তু সব আগ্রহ চড়কের মেলা নিয়ে।
—ও মণিপিসি, মেলায় এবারও রঙিন পুতির মালা আসবে? গুড়ের কদমা আর পাঁপড় পাওয়া যাবে? আমার কিন্তু মাটির পুতুল লাগবে এবার।
আমার কথাতে মণিপিসির মনোযোগ দেবার সময় কই?
মণিপিসি ব্যস্ত শিলপাটায় নিমপাতা বাটতে। সেই বাটা নিমপাতার ছোটো ছোটো বড়ি বানিয়ে দাদু রোদে শুকিয়ে রাখে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে চিরতা ভেজানো জল আর এই নিমপাতার বড়ি খেতে হয়।
তিতা সে সময়টুকু আমি সবসময় চোখ মুখ বুজে পার করে ফেলি পরের একচামচ ঝোলা গুড়ের লোভে।
মণিপিসির অমনোযোগে আমিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
বাইরবাড়ির দরজা খুলে দৌড়ে চলে যাই শংকরজ্যাঠার মন্দিরের মাঠে। ঢালু সে মাঠে নামতে গিয়েই দেখতে পাই ঠাকুমাকে। মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে শংকরজ্যাঠা, গায়ের জামা খুলে ঘাড়ে ঝুলিয়ে রেখেছে।
মন্দিরের মাঠ মস্ত বড়ো। মাঠের এপ্রান্তরে দাঁড়ালে অন্য প্রান্তের মানুষগুলোকে ছোটো দেখায় খুব। মাঠের ওপারেই ঋষিপাড়া। আর সেপাড়ার শুরুতেই নৃপেন কাকার বাড়ি।
নৃপেন রুহিদাস, কীর্তনের দলে বাঁশি বাজায়।
আজ শংকরজ্যাঠার মাঠেও ব্যস্ত লোকজনের আনাগোনা। মাঠের ঠিক মাঝখানে বাঁশ পোঁতা হয়েছে। ওখানেই লাগানো হবে চড়কগাছ।
আমি দৌড়ে চলে যাই মন্দিরের বারান্দায়।
—ও ঠাকুমা, নীলঠাকুর কখন যাবে আমাদের বাড়ি?
আমার এই কথা ঠাকুমা পর্যন্ত পৌঁছায় না। ওপাশে রাধারানি সেজে ঋষিপাড়ার পরানকাকা এসে দাঁড়িয়েছে। আর একটু পরেই অস্টকের দল বের হবে।
—ও পরান, দল নিয়ে বেলা পড়লেই চলে এসো আমাদের বাড়িতে।
ঠাকুমা আর দাঁড়ায় না। মন্দিরের মাঠ পেরিয়ে, গোলেনূর দাদির সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাইরবাড়িতে এসে দাঁড়ায়।
আজ দাদু বাজার পাঠিয়েছে তাড়াতাড়ি।
বাবু ছোটো আলুগুলান দিয়ে মাছ রানতি কইছে, সিরাজচাচার রিক্সাতেই এখন প্রায় প্রতিদিন বাজার আসে।
মাছ আর সবজির আলাদা ব্যাগ উঠোনে পড়লেও, কলাপাতার প্যাঁচানো পান রাখা হয় লাল বারান্দায়।
মা আর বড়োবউমা উঠোনের ব্যাগগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ঠাকুমা মন দেয় কলাপাতায় প্যাঁচানো পানে।
কলতলায় পেতলের গামলায় জল ভরে সেই পান ধোয় ঠাকুমা। এরপর একটি পরিষ্কার নরম কাপড় দিয়ে যত্ন করে পানগুলো মুছে পেতলের পানের বাটায় রেখে দেয়।
উঠোনে কলাপাতা পেতে মা চিতল মাছের আঁশ ছাড়িয়ে কেটে রেখেছে।
রান্নাঘরের উনুনে আঁচ পড়ে গেছে। আজ ঠাকুমার তাড়াহুড়ো। তাই খুব বেশি পদ হবে না। ওল সেদ্ধ, তিল ছড়িয়ে লালশাক, পেঁপের ঘণ্ট আর চিতল মাছের রসা।
ঠাকুমা ছোটো আলু সেদ্ধ বসিয়েছে।
—ও ঠাকুমা, মাছের রসা করবে?
জলে ভেজানো গোটা জিরা আর শুকনো মরিচের বাটি টেনে শিলপাটার কাছে নিতে নিতে ঠাকুমা বলে, “তোমার দাদু চিতল মাছের রসা পছন্দ করে যে দিদি!”
ঠাকুমা শিলবাটায় জিরা বাটতে শুরু করেছে। ওদিকে উনুনে বসানো ছোটো আলুর হাঁড়িতে বলক উঠছে।
ঠাকুমা জিরা আর শুকনো মরিচ বাটা শেষ করে উনুনের পাশে চলে এসেছে। ধুয়ে রাখা চিতল মাছের টুকরো থেকে বেছে বেছে নেয় পেটিগুলো। এরপর তাতে হলুদ, লবণ মাখিয়ে সরিয়ে রাখে।
সেদ্ধ ছোটো আলুগুলোর গরম জল ঝরিয়ে নেয় এরপর। উনুনে লোহার কড়াই উঠেছে। তাতে সর্ষের তেল অনেকটা। গনগনে আগুনের উনুনে তেল তেতে উঠতে সময় নেয় না। ঠাকুমা একটা একটা করে মাছ কড়াইতে ফেলছে। মাছের তেল সর্ষের তেলে মিশে কড়াইতে তেলের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ঠাকুমা সেই তেলে সময় নিয়ে মাছগুলো ভাজছে।
মা এর মধ্যে সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে।
বেশ লাল করে মাছগুলো ভেজে তোলে ঠাকুমা। এরপর সেদ্ধ আলুগুলোয় হলুদ লবণ মাখিয়ে ঠাকুমা সাঁতলে তুলে নেয়।
এবার কড়াইয়ের তেলে গোটা জিরা আর তেজপাতা ফোড়ন পড়ে। ফোড়ন বেশ কড়া হতে ঠাকুমা বেটে রাখা জিরাবাটায় আর-একটু জল মিশিয়ে কড়াইতে দেয়। একটু কষিয়ে মশলা তেল ছাড়া হয়ে আসতেই শুকনো মরিচবাটা পড়ে কড়াইয়ে। একটু জল আর চিনি দিয়ে এবার ঠাকুমা অনেকটা সময় কষায় মশলা।
কষানো লাল মশলায় হলুদগুঁড়ো আর লবণ দিয়ে আরও খানিকটা সময় নাড়াচাড়া। মশলা থেকে তেল ছাড়লেই তাতে পড়ে সাঁতলানো আলু। একটু নেড়ে তাতে পড়ে গরম জল ঝোলের জন্য।
ঝোল ফুটে উঠতেই ঠাকুমা লাল করে ভেজে রাখা চিতল মাছের পেটিগুলো দিয়ে দেয়। ঝোলের ভেতরে হাবুডুবু খেতে খেতে চিতলমাছ ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করে।
সেই ঘ্রাণ আরও তীব্র হয় চন্দনের মতো মিহি করে বাটা গরমমশলার বাটায়। দারচিনি, সাদা এলাচের সাথে আজ ঠাকুমা কয়েকটি গোলমরিচও বেটে নিয়েছে।
গরমমশলা দিয়ে ঠাকুমা বেশি সময় উনুনে কড়াই রাখে না।
চিতলমাছের রসা গরমমশলা দিয়েই নামিয়ে নিতে হয় দিদি, না হলে মশলার ঘ্রাণ উড়ে যায়।
লোহার কালো কড়াই থেকে ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হবার আগেই ঠাকুমা কাঁসার বাটিতে বেড়ে ফেলে চিতলমাছের রসা।
আজ ঠাকুমার সব কাজেই তাড়াহুড়ো। লাল বারান্দায় পাত পড়ে গেছে এর মধ্যে।
আজ আমাদের পাতে লাল আউশের ভাত।
—গিন্নি, আউশের ভাতে চিতলের রসা ভালোলাগে বেশি। মাখিয়ে খাও।
দাদুর পাশে বসে আমি চিতলের লাল রসায় আউশের ভাত মেখে মুখে দিয়েই ঢকঢক করে জল খাই।
দাদু আমাকে মাছের কাঁটা বেছে দেয়। আমি ভাত ফেলে মাছ আর আলু খেতে শুরু করি।
লাল বারান্দায় পাত উঠে যেতেই বাইরবাড়িতে ঘুঙুরের আওয়াজ। অস্টকের দল নীলঠাকুর নিয়ে চলে এসেছে।
আমাদের তুলসীতলায় বসানো হয় নীলঠাকুরের পাট।
ঠাকুমা পূজার থালে বেলপাতা আর ধুতরার ফুল এনে উঠোনে রাখে। আর ঠিক তখনই রাধারানি বেশে পরানকাকা গেয়ে ওঠে,
“শির হইতে গুঞ্জাফল তুলি শ্যামরায়,
নমো প্রেমময়ী বলিয়া দিলা রাধার পায়।
খুলিয়া চাঁপার মালা এলায়ে কবরী,
বধুঁর যুগলপদ বাঁধেন কিশোরী।’’
সে সুরের তালে তালে দুলতে থাকে ঘুঙুর বাঁধা পরানকাকার পা। তবে সে সুর ছাপিয়ে হঠাৎ বেজে ওঠে বাইরবাড়ি নিমতলায় নৃপেনকাকার বাঁশি।
আমি উঠোনে নীলপূজা, অস্টক গান সব ফেলে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াই বাইরবাড়িতে।
নৃপেনকাকা অস্টক দলের সাথে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু চড়কগাছে পিঠে শূল বেঁধে বনবন করে ঘুরতে তাকেই আগে দেখা যায় সবসময়।
তবে চড়কগাছে ঘুরতে থাকা সে নৃপেনকাকা আমার কাছে সবসময়ই কেমন অচেনা।
বেলার তেজ কমে আসছে। জোলাপাড়ার শিমুল তুলা পলকা বাতাসে উড়ে আসছে তাঁতঘর আঙিনায়। আর নৃপেনকাকার বাঁশির সুর গাইছে,
তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায়
পারে লয়ে যাও আমায়...
ভারী ভালো লাগলো পড়তে। অ্যাজ ইউজুয়াল। এই পর্বের ছবিও আমার ভালো লাগলো। এই সিরিজটা খুব উপভোগ করছি।
ভালো লাগলো পড়তে । বাইবাড়ির আঙিনা,বড়ঘরের সিলিং ফ্যান কতকাল আগে বলতাম আমরা