বারবেলা হতে না হতেই রোদের তেজ কমে যায়, উঠোনে মেলে দেওয়া কাপড় তুলতে দেরি হলেই সন্ধ্যার হিম হিম বাতাসে কেমন নেতিয়ে পড়ে আর ভাদুরে রোদ পোহানো সেই কাঁথা রাখা কাঠের বাক্সের ফাঁকা জায়গা ঘন অন্ধকারে ভরে যায়।
ও ঠাকুমা, নতুন এই কাঁথাটা তো তোমার সেই বড় পাড়ের লাল শাড়ি দিয়ে করা। আমি নেবো এটা। ঠাকুমা একের পর এক সবগুলো কাঁথা বাক্স থেকে বের করে রাখে। এরপর এগোয় শস্য রাখার ডোলার দিকে। পাশেই রাখা পাথরের বাসন থেকে বেছে নেয় কালো পাথরের বাটি। গিয়ে দাঁড়ায় মাটির ডোলার একদম গা ঘেঁষে। এরপর ঢাকনা সরিয়ে ভেতরে হাত দিতেই সিঁড়ি থেকে সঞ্জীব কাকুর ডাক, মনি কই রে, এদিক আয়। মাটির ডোলা, পাথরের বাটি আর ঠাকুমার লাল শাড়ির নতুন কাঁথা থেকে আমার উৎসাহ টুপ করে উবে যায়। খুশি না লুকিয়েই চিৎকার করি, সঞ্জীব কাকু আসছি দাঁড়াও।
ঠাকুমাকে পেছনে ফেলে আমি দৌড়ে নামি কাঠের দোতলা থেকে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সঞ্জীব কাকু। বুকের কাছের আদর্শলিপি ধরে আমাকে ইশারায় ডাকে, কই স্লেট নিয়ে আয়। আমি দৌড়ে গিয়ে দাদুর রেডিও'র পাশ থেকে স্লেট হাতে নিয়েই কাকুর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, আমি সব স্বরবর্ণ লিখতে পারলে সন্দেশ বিস্কুট দেবে তো? ঘাড় নেড়ে 'হ্যাঁ' বলে সঞ্জীব কাকু বড়ঘরের মেঝেয় পাটি পাড়ে। সন্দেশ বিস্কুট দেবো, তার আগে সবগুলো স্বরবর্ণ লিখে শুদ্ধ উচ্চারণে আমাকে শোনাতে হবে। আমি দেরি না করে পাটিতে বসেই কালো স্লেট সাদা দাগে ভরিয়ে তুলি। আর মুখে বলি, অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৯(লী)। দেখেছো সঞ্জীব কাকু আজ কিন্তু ৯ (লী) লিখতে ভুল করিনি।
আমার মাথায় হাত ছুঁইয়ে সঞ্জীব কাকু বলে, ভুল করে ধরতে পেরেছিলি বলেই তো শিখতে পারছিস। সঞ্জীব কাকুর এসব কথায় আমার আগ্রহ নেই। আমার এখন ওই সাদা সন্দেশ বিস্কুটের দিকে মন; এবার দাও সন্দেশ বিস্কুট, চকের গুড়ো লেগে থাকা সাদা হাত পাতি আমি। উঁহু, এখন দেবো না, পড়া শেষ কর মন দিয়ে তবে পাবি। সঞ্জীব কাকুর সাথে আমার ভাব তো ওই সন্দেশ বিস্কুট দিয়েই। না হলে আমি কি শুধু স্বরবর্ণ পড়তে ঠাকুমাকে ফেলে চলে আসি?
আমার উশখুশ বাড়ে।
রান্নাঘরের বারান্দায় ভর সন্ধ্যায় নানা আয়োজন দেখে সেই উশখুশ এবার অস্থিরতায় গিয়ে দাঁড়ায়, থাক আজ আমি সন্দেশ বিস্কুট নেবো না; তোমার কলেজের পড়া নেই আজ ? আমি আদর্শ লিপি বন্ধ করে শ্লেটের উপরে রাখি। কিন্তু সঞ্জীব কাকু তা মানলে তো? মুখের হাসিটা ধরে রেখেই বলে, পড়াশুনা না করলে বড় হবি কীভাবে? সত্যিই তো তাই! আমি সঞ্জীব কাকুকে ভালমতো দেখি। মানুষটি কত লম্বা! এত বড় হয়েছে তো ওই পড়াশুনা করেই। দাদু বলে সঞ্জীব কাকু খুব ভাল ছাত্র। বৃত্তি পেয়েছে দু'বার। সাহেব কাকুর মতো মেধাবী সঞ্জীব কাকু। এজন্যই তো সাহেব কাকু বৃত্তি নিয়ে রাশিয়া পড়তে চলে গেলে ওনার ফাঁকা ঘরটায় তালা পড়ে গিয়েছিলো। সঞ্জীব কাকু যেদিন আমাদের বাড়িতে এলো সেদিনই দাদু নিজের হাতে তালা খুলেছিলো সে ঘরের; সঞ্জীব এই ঘরটা আমার সেজো ছেলের,ওই টেবিলে বসেই ও পড়তো, ছেলেটা আমার পিএইচডি করছে রাশিয়ায়।
যতবার সাহেব কাকুর গল্প করে, দাদুর গলাটা কেমন কেঁপে যায়। ঠাকুমাও যখন দাদুর রেডিও রাখা টেবিলের ওয়েলক্লথের নীচ থেকে সাহেব কাকুর চিঠিগুলো বের করে, তখন কেমন চুপচাপ থাকে অনেকসময়। তবে সঞ্জীব কাকু আমাদের বাড়িতে জায়গীর থাকতে আসার পর থেকেই দাদু সারাক্ষণ সঞ্জীব কাকুরই কথা বলে, সঞ্জীবকে রাতে ভাতের সাথে একটু দুধ দিও, সকালের ফেনা ভাতে সঞ্জীবকে ঘি দিয়েছো? ছেলেটা খুব মেধাবী, খুব বড় কিছু হবে একদিন। ও দাদু, সঞ্জীব কাকু তো বড় হয়েই গেছে আর কত বড় হবে? আমার প্রশ্নের উত্তরে দাদুর পান খাওয়া ঠোঁটে হাসি ফোটে, গিন্নি ও বড় কিছু নয়, আরোও কত বড় হতে হবে।
ধুর, ওসব আমি বুঝি নাকী?
তবে সঞ্জীব কাকু এ বাড়িতে আসার পর আমার যে প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে আদর্শলিপি নিয়ে বসতে হবে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও, তা কিন্তু খুব বুঝে গেছি। তবে আমার সেই অনিচ্ছাকে ওই সন্দেশ বিস্কুট দিয়ে বশ করে নিয়েছে সঞ্জীব কাকু অল্পদিনেই। আমি সন্দেশ বিস্কুটের লোভেই দুলে দুলে আদর্শলিপি থেকে পড়ি, ' অ' তে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো, 'আ' তে আলস্য দোষের আকর।
সুর করে পড়ার মধ্যেই দেখতে পাই ঠাকুমা পুরাতন কুলা উপরতলা থেকে নিয়ে আসে। মনিপিসিও বসে গেছে রান্নাঘরের বারান্দায় কুটনো কুটতে। তাড়াতাড়ি পড়তে গিয়ে আমার দুলুনি বেড়ে যায়। বর্ণমালা পড়া শেষে শতকিয়া শুরু করি। ১ থেকে ৩০ পর্যন্ত পড়তেই দেবদারু গাছের মাথা থেকে দিনের শেষ আলোটুকুও নিভে যায়। হালকা নেহার দেবদারু গাছের ফাঁকে জায়গা করে নেয়। আর ঠাকুমার সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা বাজতেই সব ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি আমি, আমার পড়া হয়ে গেছে কাকু, কাল শতকিয়া শেষ করবো। আমার চকের গুড়ো লেগে থাকা হাতে দু'খানা সন্দেশ বিস্কুট দিতে দিতে সঞ্জীব কাকু বলে, আজ ছুটি দিলাম কাল থেকে কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণ ধরতে হবে। সাদা বিস্কুটগুলো হাতে পেয়েই আদর্শলিপি,স্লেট আর বর্ণমালা সব পেছোনে ফেলে ছুটে যাই রান্নাঘরের বারান্দায়, মনিপিসি আজ রাতে কেন রান্না হবে? মা পিঠা কেন বানাচ্ছো? আমার কথার উত্তর দেবার সময় নেই কারো। আমি ছোট ছোট কামড়ে সন্দেশ বিস্কুট খেতে খেতে বারবার তাকাই বড়ঘরের দিকে। সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা আর পিঠা ভাজার ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দে বাড়ির সবজায়গাই কেমন ব্যতিব্যস্ত। আমি মনিপিসির পাশে বসে কুচানো বাঁধাকপির কয়েকরকমের সবুজ চোখ দিয়ে আলাদা করতে থাকি। মায়ের পিঠা ভাজা শেষ হতেই মৌরি আর আদা বেটে রাখে। ঠাকুমা রান্নাঘরের বারান্দায় আসতেই মনিপিসি চা বানিয়ে দাদুর জন্য নিয়ে বড়ঘরে চলে যায়।
উনুনে তখন পাঁচরকম মেশানো ডাল ফুটছে। ঠাকুমা তাড়াহুড়ো করে কয়েকরম সবজিও কেটে নেয় ডুমো করে। ফুটতে থাকা ডাল লোহার ডাল ঘুটনি দিয়ে ভাল করে ঘুটে নিয়েই ডুমো সবজিগুলো দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ ফুটিয়ে পাঁচফোড়ন আর তেজপাতার ফোড়নে ডাল উনুন থেকে নামে।
এরপর ধোয়া কড়াইয়ে ভিজিয়ে রাখা বুটের ডাল আর কুচানো বাঁধাকপি অল্প জল, লবণ দিয়ে ভাপে বসায় ঠাকুমা। গনগনে খড়ি বের করে আঁচ ঢিমে করে। মায়ের বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঠাকুমা আমার দিকে তাকায়, দিদি কখন থেকে চুপচাপ বসে আছো তুমি! সুযোগ পেয়ে আমি প্রশ্নের ঝুরি খুলি, ও ঠাকুমা রাতে কেন রান্না করছো? মা পিঠা কেন বানালো? তুমি পুরান কুলা কেন নামালে? নিজের বাটি থেকে সর্ষের তেল মাখানো একমুঠ মুড়ি আমার হাতে দিয়ে বলে, কাল ভোরে ঘুম থেকে উঠলেই দেখতে পাবে সব।
বাঁধাকপি আর বুটের ডাল আধাসেদ্ধ হতেই ঠাকুমা নামিয়ে নেয় কড়াই। আরেকটি কড়াই উনুনে ওঠে। তাতে সর্ষের তেল দিতেই বেশি তেতে ওঠা কড়াইয়ে ধোঁয়া ওড়ে। এরপর ফোড়নে তেজপাতা আর জিরা। তা কালো হবার আগেই আধাসেদ্ধ বাঁধাকপি আর বুটের ডাল কড়াইয়ে পড়ে। অল্প নেড়েচেড়ে তাতে বেটে রাখা মৌরি আর আদাবাটা। ভাল করে তা মিশিয়ে দেয় ঠাকুমা। অল্পসময় পরে অনেকগুলো বুকচেরা কাঁচামরিচ কড়াইয়ে পড়ে। একটু নেড়েই ঢাকনা পড়ে যায় কড়াইয়ে।
কিছুসময় পর ঢাকনা খুলে ঘি মিশিয়ে সাদা মৌরি বাঁধাকপি নামিয়ে নেয় ঠাকুমা।
পরেরদিন ভোরের অপেক্ষায় আমি দুপুরের রান্না করা রিঠা মাছের রসা দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
ভোরে ঘুম ভাঙে ঠাকুমার শঙ্খের আওয়াজে। আমি তাড়াহুড়ো করে গায়ের কাঁথা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসি। ঠাকুমা সারা বাড়িতে ধূপের ধোঁয়া দিতে ততক্ষণে বড়ঘরের বাইরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের আলোমাখা কুয়াশা দেখি আমি। বাড়ির উঠোন তখনো আবছা অন্ধকারে ঢাকা। মা উঠোনের মাঝখানে পাটখড়ি দিয়ে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠাকুমা পুজোর থালে গুড়, কাঁচাহলুদ, ভেজানো ছোলা, নিম পাতা আর সর্ষের তেল দিয়ে উঠোনে আনে। মনিপিসি কালরাতে ভেজে রাখা পিঠাগুলো থাল ধরে সেই আগুনের পাশে রাখে। ঠাকুমা এবার সেই পুরানো কুলা একটি কাঠি দিয়ে পেটাতে পেটাতে বাড়ির আনাচকানাচ ঘোরে। আর বিড়বিড় করে,
আশ্বিন গেলো, কার্তিক এলো
ছোট বড় ধান গর্ভে এলো।
ধান রইলো ভূঁয়ে,
যা শত্রু চলে যা
উত্তরদিক দিয়ে।
আমিও ঠাকুমার পেছন পেছন ঘুরে সবটা মুখস্থ করে ফেলি।
ঠাকুমা কুলা রেখে আগুনে হাত ছেঁকে আমাকে ইশারায় ডাকে। কাছে যেতেই হাতের তালুতে জমিয়ে রাখা সবটুকু ওম আমার মুখে আর মাথায় মাখিয়ে দেয়। এরপর নিমপাতার ডাল দিয়ে বাতাস করে আমাকে। সবশেষে কাঁচা হলুদ আর গুড় ভেঙে আমার হাতে দেয়, খাও দিদি, রোগবালাই দূরে যাবে। আমি তা মুখে পুরতেই সর্ষের তেল অনেকটা নিয়ে আমার মাথায় মাখিয়ে দেয় ঠাকুমা। এরপর আর দেরী করে না ঠাকুমা। আমাকে নিয়ে কলতলায় গিয়ে টিউবওয়েল চেপে ধোঁয়া ছড়ানো জল আমার মাথায় ঢালে ঠাকুমা।
উঠোনের অন্ধকার ততক্ষণে কেটে গেছে। থালের পিঠেগুলো তখন গোয়ালে গরুর মুখের কাছে গিয়ে পড়েছে। লাল বারান্দায় ভাতের থালে কাল রাতে রান্না করা পাঁচডাল আর মৌরি বাঁধাকপি খেতে খেতে আমার চোখ পড়ে উঠোনের পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া পাটখড়িগুলোর দিকে। খাওয়া ভুলে আমি বিড়বিড় করে উঠি,
আশ্বিন গেলো, কার্তিক এলো
ছোটবড় ধান গর্ভে এলো।
আগের পর্বগুলির মতো ভালো লাগলো . শুধু একটি প্রশ্ন ব উ ট er ডাল কি ডাল ?
ছোলার ডালকে বুটের ডাল বলা হয় এ আমি উত্তর বঙ্গেও দেখেছি।
ভঙ্গিটি বড় রমণীয় !
জায়গীর থাকার প্রথার কথা প্রথম পড়েছিলাম সচলায়তনে 'জায়গীরনামা' - এক ব্লগারের বালকবেলার স্মৃতি। (http://www.sachalayatan.com/sheikhjalil/13014)
এই লেখাটি তথা সিরিজটি ভারি কোমল মায়াময়।
ভালোলাগায় ডুবে আছি....
এই সিরিজটা ভীষণ ভাল লাগছে পড়তে। অনেকটা গিরিবালা দেবীর রায়বাড়ির মত।