বেলার গা জুড়ে লেপ্টে থাকা রোদে পড়েছে ধান। মেলে রাখা সে ধানের ঘ্রাণ রোদ পাহারায় ভেতর বাড়িতে ঘুরপাক খায়। তবে বেশী সময় নয়, সুযোগ পেলেই সেই রোদ টপকে ধানের ঘ্রাণ পৌঁছে যায় বাইরবাড়ির সুপারি বাগানে। তাঁতঘরের মাকুরে টান পড়ে। আর ঠিক তখনই বাতাসে ভোকাট্টা হয়ে উড়তে থাকে বাঁশীর সুর
‘ যদি বন্ধু যাবার চাও
ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে’
আর এদিকে আমি সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ি খড়ের পালায়।
নতুন ধান এসেছে তো বাড়িতে। গোলেনূর দাদীর গরু দিয়ে সব ধান মাড়িয়ে খড় পালা করা হয়েছে বাইরবাড়িতে। সুযোগ পেলেই সেই পালায় দৌঁড়ে গিয়ে ঝাঁপ দেই আমি।
‘ মনি, খড় নিয়ে সারাদিন খেলতি আছে? রাত্তিরবেলা গা চুলকাবে নে দেখিস।’
গোলেনূর দাদীর কথা শোনার সময় আছে নাকী আমার? ঠাকুমা আর মা রান্নাঘরে। মনিপিসি কলেজে গেছে। আরেকটু পরেই মা স্নানের জন্য ডাক দেবে। আমি গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছের তলা থেকে দৌঁড় লাগিয়ে আরোও একবার ঝাঁপ দেই খড়ের পালায়।
বাড়ির উঠোনে রোদ তো দৌড়ে বেড়ায়। কোথাও ক’মুহূর্ত দম নেয় তো কোথাও উঁকি দিয়েই পালিয়ে যায়। পূর্ণির মা সকাল থেকেই রোদ ধরে ধরে ধান মেলছে।
‘ ও মনি, জ্যাঠিমা ডাকতিছে তো’
তাঁতঘরের সেই বাঁশির সুর এখন থেমে গেছে।
‘ তান ডোলে মেরা মন ডোলে
দিল কা নেহী কারার
কোই বাজায়ে বাঁশুরিয়া......’
টেপ রেকর্ডারে ফুল ভলিউম বাজছে। সেই সুর আর মাকু টানার খটাস্ খটাস্ শব্দ পুরো পাড়াকে কেমন জাগিয়ে রেখেছে।
পূর্ণির মা আমাকে ডেকেই আবার লেগে পড়েছে রোদ ধরতে। রান্নাঘর সামনে এখনো পেয়ারা গাছের ছায়া পড়েনি। পা দিয়ে ঠেলে ধানগুলো সেদিকে এগিয়ে দেয় পূর্ণির মা।
‘ ও ঠাকুমা ডেকেছো কেন?’
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে যেটুকু রোদ আসছে তাতে উনুনের ধোঁয়া মিশে ঘোলাটে হয়ে গেছে। সে ঘোলা আলোতেও ঠাকুমার সিঁদুর পড়া মুখটা খুব উজ্জল।
‘ দিদি, স্নান করে নাও তাড়াতাড়ি। কত কাজ আজ দেখেছো?’
ঠাকুমার কথা শেষ হবার আগেই নাকে এসে ধাক্কা দেয় আলোচালের ঘ্রাণ।
‘ ও ঠাকুমা, আজ আলোচালের ভাত করেছো?’
ঠাকুমার উত্তর পাবার আগেই পূর্ণির মা’র হাঁক,
‘ জ্যাঠিমা ধানের ছোট ধামা ঢেঁকিতলা রাখছি, ঢেঁকির গড় মুছতি হবি?’
আজই ধান ভানা হবে? ধান তো মোটে দু’দিনের রোদ পেলো!
ঠাকুমা উনুনের গনগনে খড়িটা বের করে জল ঢেলে নেভায়। উনুনের পোড়া কয়লার অবশিষ্ট আঁচে দুধভরা পেতলের খাবড়ি বসিয়েই ঠাকুমা উনুনের পাড় ছাড়ে।
মা গিয়ে বসে সেখানে।
সর্ষের তেলের বাটিটা হাতে নিয়ে ঠাকুমা উঠোনে নামে। পেছন পেছন আমিও। আমগাছের তলায় যতটুকু রোদ তাতে হাওয়ায় দুলে পড়া ডালিম গাছের ছায়া ক্রমাগত লুকোচুরি খেলছে।
সেখানে পিঁড়ি পেতে বসি আমি আর ঠাকুমা। আমার চুলের গোঁড়ায় তেল ঢালতে ঢালতে ঠাকুমা বলে,
‘ ও দিদি, মাথাভরা এমন চুল তো আমার ঠাকুমার ছিল। তুমি আসলে আমার ঠাকুমা, তাই না বলো?’
আমি কিছু না বুঝেই বলি,
‘ ও ঠাকুমা, তোমারও ঠাকুমা আছে?’
আমার কথায় বাতাস কাঁপিয়ে হেসে ওঠে পূর্ণির মা,
‘ ক্যান তোমারই ঠাকুমা থাকবি শুধু?’
আমি কী বুঝি জানি না, শুধু হাঁটুতে পিঠ ঠেকিয়ে ছুঁয়ে থাকি ঠাকুমাকে।
আজ দুপুরে পাত পড়েছে খুব তাড়াতাড়ি। তবে সে পাত শুধু বাড়ির ছেলেদের আর আমার। নতুন আলোচালের ভাত, নতুন আলুর ডুমো ভাজি, ঘি ভাসা ঘন মুগের ডাল, পালং শাকের সুক্তো আর ডালের বড়ার রসা।
ফেলে ছেড়ে পাতের ভাত কোনোরকমে শেষ করে হাতে নিলাম জমিয়ে রাখা ডালের বড়া।
ঠাকুমা ততক্ষণে ঢেঁকিতলা চলে গেছে। ধুয়ে মুছে রাখা ঢেঁকির গড়ে তেল সিঁদুর লাগিয়ে দিয়েছে ঠাকুমা। এরপর ধামা থেকে ধান গড়ে পড়তেই উলু যোগার দিয়ে ওঠে মা। সেই উলু যোগারের আওয়াজে একটু একটু করে মিশতে থাকে ঢেঁকি পাড় দেবার শব্দ।
উঠোনের রোদ পোহানো বাকী ধানে ঠিক তখনই গা মেলে দেয় বাইরবাড়ির দেবদারু গাছের ছায়া। পূর্ণির মা আর দেরী করে না। বড় বড় ধামায় ভরতে শুরু করে দেয় রোদের ওম মাখা ধান।
আর ওদিকে কুলায় তুষ ঝেড়ে ধবধবে ঝিঙেশাইল চাল আলাদা করছে ঠাকুমা,
‘ পূর্ণির মা স্নান করে আসো বাড়ি গিয়ে, বেলা পড়ে এলো তো।’
বাড়ির বাতাসে ক্ষীরের সুক্ষ্ম ঘ্রাণ একটু একটু করে ঘাঁটি গাড়ছে। আমি দৌড়ে রান্নাঘর যাই,
‘ মা, ক্ষীর হয়েছে?’
‘ হ্যাঁ, ঠাকুমাকে বলো।’
খাবড়ির গায়ে লেগে থাকা শুকনো ক্ষীর চেঁছে নরম ক্ষীরে মেশায় মা।
ঠাকুমা ধামা ভরা নতুন ঝিঙেশাইল চাল রান্নাঘরের বারান্দায় রেখে কলতলা গেছে।
মনিপিসি লাল বারান্দায় রাখা ধামাভরা ধানগুলো পুরাতন কাপড়ে ঢাকছে।
তাঁতঘর থেকে মাকুরের আওয়াজ কমে আসছে।উঠোনের দেবদারু ছায়াও মিশে গেছে মাটিতে। তারে মেলে রাখা শুকিয়ে যাওয়া কাপড়গুলো হিম হিম বাতাসে একটু পর পর কেঁপে উঠছে। মনিপিসি দেরী না করে না আর। কাপড়গুলো গুটিয়ে ঘরে তুলে আনে।
ঠাকুমা কখন যে রান্নাঘরে গিয়ে উঠেছে আমি টেরই পাইনি। উনুনের নতুন আগুনের ধোঁয়া উঠোনে ভাসা শুরু করতেই আমি রান্নাঘরে পৌছে যাই।
ঠাকুমা ততক্ষণে ক্ষীরের ছোট ছোট বল বানিয়ে ভরে ফেলেছে থাল। আর উনুনের আগুনে তেতে উঠছে ঘি মেশানো তেল।
‘ ও ঠাকুমা, আমি ক’টা মোটরদানা বানাবো।’
আমার বায়না করার মানুষ তো ওই একটাই।
আমি হাতের তালুতে ঘি লাগিয়ে ক্ষীরের বল বানাতে শুরু করি। তবে তা গোল না হয়ে চ্যাপ্টা, লম্বা, সরু সব রকমের হতে শুরু করলো।
আমার রাগ হয়, বিরক্তি আসে।
‘ তোমার মতো হয় না কেন ঠাকুমা?’
‘ ওই তো কত সুন্দর হচ্ছে দিদি। আর দেখো এতগুলো মটরদানার ভেতর তোমারগুলো কেমন অন্যরকম! এটাই তো ভাল দিদি।’
বলতে বলতে ঠাকুমা ক্ষীরের মটরদানা কড়াইয়ের ঘি মেশানো তেলে ফেলে। ফেলতেই লালচে হয়ে ফুলে ওঠে মটরদানা। ঠাকুমা বেশী সময় কড়াইয়ে রাখে না তা।আরেকটু লাল হতেই তুলে নেয়।
এরপর তেলের কড়াই নামিয়ে পেতলের হাঁড়ি বসায় উনুনে ঠাকুমা । ফুটে উঠতেই তাতে জলে ভিজিয়ে রাখা ধবধবে ঝিঙেশাইল আতপ পড়ে দুধে। দুধে চাল পড়তেই রান্নাঘরে ভাসতে থাকে ঝিঙেশাইল আতপের সুঘ্রাণ।
‘ ও ঠাকুমা, এটা নতুন ধানের চাল?’
‘ কত সুন্দর ঘ্রাণ দেখেছো দিদি নতুন চালের।’
কাঁসার ডাবর হাতা দিয়ে পায়েস নেড়ে দেয় ঠাকুমা আরেকবার। নতুন চাল বেশী সময় নেয় না সেদ্ধ হতে। ঠাকুমা এবার তাল মিছড়ি গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেয় পায়েসে।
পায়েস ঘন হয়ে আসলেই লাল মটরদানা মিশিয়ে দেয় ঠাকুমা। এরপর খড়ি বের করে আঁচ কমিয়ে ঢেকে রাখে হাঁড়ির পায়েস অল্প সময়।
ঠাকুমা পায়েসের হাঁড়ি থেকে পূজার থালে পায়েস ঢালে। আর বাকী পায়েস টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে ।
এই টিফিনবাটি কাল নিশ্চিন্তিপুর যাবে।
বেলা ডুবতেই কোন ফাঁকে সন্ধ্যা বাড়ির উঠোনে নি:শব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। আর সে সন্ধ্যার গা জুড়ে এখন ঝিঙেশাইল চালের ঘ্রাণ।
মনিপিসি তুলসীতলায় কলার মাইজ,এক বাটি নতুন চাল, ধানের ধামা, কড়ি আর প্রদীপ গুছিয়ে ফেলেছে।
মাটির প্রদীপগুলো আমি আর মনিপিসি বানিয়েছি ক’দিন আগে।
ঠাকুমা মটরদানার পায়েস তুলসীতলায় রাখে। অন্ধকার এতক্ষণে উঠোন ছুঁলো। পূর্ণির মা বাড়ি থেকে স্নান সেরে নতুন কাপড় পড়ে চলে এসেছে।প্রদীপের সলতায় আগুন জ্বালাতেই দেবদারু গাছের মাথায় দুলে উঠে চাঁদ।
রাস পূর্ণিমার হলুদ চাঁদ।
সে চাঁদের আলো মটরদানার পায়েসে পড়তেই মনিপিসি শঙ্খে ফুঁ দেয়। আর ঠাকুমা ধামার ধানে গুঁজে দেয় কড়ি। প্রদীপের সলতায় আরোও অনেকটা ঘি পড়ে।
যত প্রহর প্রদীপ জ্বলবে তার দ্বিগুণ ধান হবে পরের বছর।
উপোসী পূর্ণির মা ঠাকুমার সাথে নতুন খাওয়ার উপোস ভাঙ্গে মটরদানার পায়েসে।
দেবদারু গাছের মাথায় ঝুলতে থাকা রাসের চাঁদ তখন উঠোনে নেমে এসেছে সব আলো নিয়ে। আর সেখান থেকে আলো চুরি করে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তুলসীতলার প্রদীপ।
নতুন খাওয়া তো এখনও শেষ হয়নি। উনুনে ফুটছে নতুন আতপের সেদ্ধ ভাত। এদিকে রাতও হয়ে যাচ্ছে বেশ। কাল খুব ভোরে উঠতে হবে তো। দাদু আর ঠাকুমার সাথে নিশ্চিন্তিপুর যাবো যে কাল।
সেদ্ধ ভাত উনুন থেকে নামতেই তাই রান্নাঘরের বারান্দায় তাড়াহুড়ো করে পড়ে গেলো পাত।
সব সেরে ঠাকুমা তুলসীতলার প্রদীপের সলতা আরেকটু ঘি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়। রাসের চাঁদ ততক্ষণে সরে গেছে সুপারি বাগানের মাথায়।
ঠাকুমার গায়ে তখনো লেগে আছে ঝিঙেশাইল আতপের ঘ্রাণ।
সে ঘ্রাণে শ্বাস নিতে নিতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুমের অতলে হঠাৎ জেগে ওঠে হলুদ আলোর চাঁদ। আমি আর ঠাকুমা সেই আলোয় নিশ্চিন্তিপুরের পথে। ক্ষেতের আইল, নদীর ঘাটে ভাঙা বাড়ি, মরিচের ক্ষেত, আমবাগান সব পেছনে রেখে আমি আর ঠাকুমা ছুটছি।
আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি যে!
ঠাকুমা আর আমি বারবার একই ক্ষেতের আইলে ঘুরপাক খাচ্ছি।
কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে তাঁত মাকুর আওয়াজ। চাঁদের আলোয় আরেক পোচ হলুদ জমলো। বাতাস কেটে ভেসে এলো সুর। বাঁশির সুর।
‘খুঁজি তারে আসমান জমিন
আমারে চিনি না আমি,
এ বিষম ভ্রমের ভ্রমি
আমি কোন্ জন, সে কোন্ জনা।।