আজকাল একটা চিন্তায় মন মাঝে মাঝে একটু ঝিম মেরে যায়, এমনিতে কোন কিচ্ছুটি নিয়ে বিশেষ ভাবিত হইনা। আমার চেনা পরিচিত আপনজনেরা যদি ভালো থাকে তাহলে একা বোকা নিজের জন্যে আর কি নিয়েই বা ভাবার আছে!কিন্তু সেই ২০০৯ সাল থেকে সক্কাল হলেই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নৌকোটুকু বাদ দিয়ে বাকি সব রকম যান বাহনে চেপে যে এই শ্যামল সবুজ আদিগন্ত খোলা প্রান্তরে এসে হাঁপ ছাড়ি, যে কিনা আমার চোখের আরাম মনের আশ্রয় যাপনের ইন্ধন, সে হারিয়ে আমি থাকব কেমনে!
ক’দিন হল বেশ ঠান্ডায় আমাদের আপিস পাড়া রোদ্দুর পড়ে এলে কেমন জুবুথুবু হয়ে যাচ্ছে। গাছ
পালা পশু পক্ষী মানুষ জন সক্কলে।
সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে সব শুনশান। আমাদের এখন বাড়তি কাজের চাপে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়। যখন বেরোই, বাইরে খোলা আকাশের নিচে, বিশাল বড় বিল্ডিংটা কেমন যেন ঠান্ডায় চুপ করে জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে থাকে। চারপাশে কেউ কোত্থাও চোখে পড়ে না। সিকিউরিটিরা কান মাথা ঢেকে ঢুকে শীতের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে।
আমাদের ছেলেবেলায় শীতের দিন আসত অনেককিছু সঙ্গে নিয়ে। কালী পুজোর পর পরই অল্প অল্প ঠান্ডা পড়তে শুরু করত। বড়মা বলত, কালী ঠাকুর জলে পড়লেই ধরণী ঠান্ডা হন। তখন কার্তিক মাসেই লেপ রোদে দিয়ে রাখার চল ছিল। নক্সা কাটা টকটকে লাল শালুর লেপে সাদা মার্কিনের ওয়াড়। রাত পোশাক (মায়ের সেলাই করা) পরিয়ে গায়ে ক্রিম দিয়ে বিছানায় শুইয়ে, মা বারান্দা থেকে লেপ এনে গায়ে দিলে হিহি করে কাঁপুনি লাগিয়ে সেই লেপ গরম হতে বেশ খানিক সময় নিত। কি যে মজা লাগত তখন! বড় রামধনু রঙের দিন ছিল সে।
শীতের সবজিতে বাজার ভরে উঠত। তখন এত রং বেরঙের ক্যাপসিকাম ব্রকলি ইত্যাদি ছিলনা। কিন্তু ঢাউস ঢাউস ফুলকপি বাঁধাকপি বড় বড় লাল মুলো, টুকটুকে লাল বড় বড় রসাল দেশী টমেটো। শালগোম ওলকপি তাজা সবুজ সীম। আলতাপাটি সীম, টাটকা তাজা লকলকে পালং শাক, পেঁয়াজ শাক, বোথো শাক, মেথি শাক, পেঁয়াজ কলি, বড় বড় বেগুনি রঙা মাখম মোলায়েম বেগুন। যা নাকি কাঁচা পেঁয়াজ লঙ্কা সরষের তেল দিয়ে মেখে পুড়িয়ে খাওয়ায় জন্যেই কেনার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। সাদা সাদা গোল মুক্ত কেশী বেগুন। নতুন আলু। কচি কচি মটরশুঁটি, সর্ষে শাক, ছোলা শাক, বাবা নিয়ে আসত, সেই ছোলা শাক থেকে কাঁচা মিষ্টি ছোলা ছাড়িয়ে খেতাম। গোলগোল ছোট ছোট নতুন আলুর দম মটরশুঁটির কচুরি, নতুন আলুর দম ধনে পাতার চাটনি, বেগুনভাজা। এই সব ছিল শীতের খাবার আপামর বাঙালির রসনার পরিতৃপ্তি।
গাছে গাছে কুল পুষ্ট হয়ে উঠত, কিন্তু সরস্বতী পুজোর আগে তো কুল খাওয়া নিষেধ ছিল সেকালে। রসাল শাখালু। রাঙা আলু, আমাদের জেঠা মশাই রাঙ্গা আলু সেদ্ধ খেতে খুব ভালো বাসত। বিরাট কাঁসার বগি থালায় চুড়ো করে চাষের চালের গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, বড় জামবাটি ভরা গরম ডাল এক থাবা রাঙ্গা আলু ভাতে আর কিছু একটা চচ্চড়ি বা ছোট্ট ছোট্ট মটর দানার মত চাষের খোসা শুদ্ধ আলুভাজা দিয়ে জেঠা মশাই যে তৃপ্তি করে ভাত খেত, কাছারি যাওয়ার সময়, সামনে বসে দেখে আমার চনমন করে ক্ষিদে পেয়ে যেত।
টুকটুকে আপেল ছোট ছোট গোল দার্জিলিংয়ের কমলা লেবুতে বাজার ছেয়ে যেত। আবার বড় বড় ফোস্কা ফোস্কা খোসার নাগপুরী কমলাও আসত। বাবার সঙ্গে বাজার গেলে সেই সময় নাকে আসত লঙ্কার ঝাঁঝ আর ধনে পাতার গন্ধ। বুক ভরে টেনে নিতাম। আজও যেন নাকে লেগে আছে।
মিষ্টির দোকানে থরে থরে নতুন গুড়ের টুবো টুবো রসগোল্লা সন্দেশ, ঘিয়োর ভাজা হত মস্ত কড়াইয়ে। খোয়া ক্ষীর কেনা হত পিঠে পুলির জন্যে। লোকজন মাটির হাঁড়িতে করে পাতলা খেজুরের গুড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করত।
বাঁকুড়ার বিখ্যাত মেচা সন্দেশ এই শীত কালেই পাওয়া যেত। উল্টানো কলসির মত চিনির কোটিং করা হালকা এলাচের গন্ধ ভরা সে মিষ্টির কি আস্বাদ!
বাবা পাটালি গুড় নিয়ে আসত। বাবার কাছেই শেখা, দুই আঙ্গুলের ঘষায় যে গুড় গলে যায় সেই হল আদত গুড়।
শীতের কালে বাড়ি বাড়ি খেজুর গুড়ের পায়েস আর পিঠে পুলি পাটিসাপটা রাঙ্গাআলুর পিঠে রাজত্ব করত। মায়ের হাতের খেজুর গুড়ের পালো। ওই বাঙালি ফিরনী যাকে বলে। ঠান্ডা ঠান্ডা কি ভালোই যে লাগত খেতে!
সেকালে শীতের সময় রাস্তা ঘাটে গুলু গুলু কান ঝোলা ফুটফুটে কুকুর ছানু দেখা যেত। আমাদের বাড়ির গলির উল্টোদিকে মহারাজদের খাবারের দোকান ছিল, তার পিছনে খানিক খোলা জায়গায় প্রতি বছর কুকুরের বাচ্চা দিত। ওরা আদর যত্ন করত। এক আধ বার ওদের অনুমতি নিয়ে সেই মোটু সুটু বাচ্চা গুলোকে আদর করে আসতাম। যেখানে সেখানে খেলার মাঠে একটু গোলগাল কুতকুতে চোখের ছানা দেখলেই মনে হতো বাড়ি নিয়ে যাই।
পশু পক্ষীর ওপর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই ভালবাসা আজও রয়ে গেছে।
সরস্বতী পুজোর পর বাড়িতে লাল লাল টোপা কুলের প্রবেশ ঘটত। বড়ই প্রিয় ছিল তার টক মিষ্টি স্বাদ। নারকুলে কুল ঠিক অত স্বাদের লাগত না। টোপা কুলের চাটনি, আচার আহা!
জলপাই এর দেখাও মিলত এই সময়েই। তারও চাটনি আচার করা হ’ত।
মণিমুক্ত হীরে জহরতে গাঁথা ছিল আমাদের সেই সমস্ত অতি সাধারণ যাপন। বাবারা থলে ভর্তি করে বাজার করত, কে কি খেতে ভালোবাসে সেই কথা মাথায় রেখে, মা বড়মা কাকি পিসিরা হাসিমুখে সারাদিন কে কি খাবে সেই সব রান্না করত। এই ভাবেই দিন কাটত।
সমাজ সংসার রাজ্য রাজনীতিও বিশেষ জটিল ছিল না। যে যার মতাদর্শ নিয়ে থাকত। তর্কাতর্কি ছিল কিন্তু হা* না*হা*নি এত ব্যাপক হারে ছিল না।
দেখতে দেখতে আমরা কেমন যেন হি* ন্দু - মু*স*লি*ম এই দুইয়ে ভাগ হয়ে গেলাম।
আমার অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে এই প্রশ্ন বার বার উঠে আসে যে আমাদের দেশের বাকি সমস্ত সমস্যার কি সমাধান হয়ে গেছে? মানে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য সমস্ত? তাই এখন আমরা মন্দির মসজিদ এই নিয়ে পড়েছি!
কি জানি কিছু বুঝিনা। শুধু মনটা বড় বিষন্ন হয়ে ওঠে।
এর শেষ কোথায় কে বলে দেবে!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।