এমনিতেই উঠোনে রোদের খুব একটা আসা যাওয়া নেই, এর উপর দেবদারু গাছের মাথায় ঘাপটি মেরে থাকা কালো জলমেঘের বাড়বাড়ন্ত। কখনো কখনো আবার সেই মেঘ শরীর প্রসারিত করে ছুঁয়ে দিচ্ছে বাইরবাড়ির সুপাড়ি বাগানের মাথাও। সুযোগ পেলেই অনবরত জল ঝড়িয়ে রোদহীন উঠোনটাকে কেমন প্যাচপ্যাচে করে দিচ্ছে।
আর এরমধ্যেই ঠাকুমা কাঠের লম্বা বাঁটের সুতি কালো কাপড়ের ওই এটলাস ছাতাটা নিয়ে বড় ঘর আর রান্নাঘর করছে অনবরত।
ও ঠাকুমা আস্তে আসো, তুমি পিছলে পড়ে যাবে তো। ঠাকুমার হাতে পেতলের ঘটি ভরা জল আর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরা গুড়ো চায়ের কৌটা। এতকিছু একসাথে আনতে গিয়ে ঠাকুমার মনোযোগ এটলাস ছাতা থেকে সরে গেছে হুট করেই। বা’হাতে ধরা ছাতাটা একপাশে সরে গিয়ে বৃষ্টিজলকে সুবিধা করে দিচ্ছে ভিজিয়ে দিতে।
ও ঠাকুমা, তুমি ভিজে যাচ্ছো তো।
টিনের দোচালা চুঁইয়ে পড়তে থাকা জলে লাল বারান্দা অনেকটাই ভিজে গেছে। এরসাথে বরই গাছের ওই বড়ঘর ছুঁইয়ে থাকা ডালটা গায়ে মাখা বৃষ্টিজল তিরতির করে কেঁপে পুরোটাই ঝরিয়ে দিচ্ছে লালবারান্দায়। আমি সেই জল এড়িয়ে শিকবিহীন কাঠের জানালার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি।
তবে ঠাকুমা আর মনিপিসির চোখ এড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে সেই জল আলপনা আঁকার সুযোগ কিন্তু হাতছাড়া করছি না।
মনিপিসি আজ বাড়িতেই আছে। বৃষ্টির জন্য কলেজ যেতে পারেনি। রেডিও’র টেবিল লাগোয়া মনিপিসির চৌকি পাতা। সেই চৌকিতে বসেই রেডিও টেবিলের বইগুলো নাড়াচাড়া করছে মনিপিসি।
না করে উপায় নেই তো। খুব সামনেই মনিপিসির আই এ পরীক্ষা। কালরাতেও ইংরেজী নিয়ে দাদুর কাছে বকা খেয়েছে। মনিপিসিটা পড়তেই চায় না একদম। সুযোগ পেলেই মা আর কোহিনূর ফুফুর সাথে দিলরুবা হলে ম্যাটিনি শো দেখতে যায়। আর সেদিন তো হল থেকে ফিরেই ববিতার মতো চুল কেটে নিয়েছে কোহিনূর ফুফুর কাছ থেকে। আমাকে বলেছিলো এবার সত্যি সত্যি ববিতাকে দেখাতে আমাকে হলে নিয়ে যাবে। কিন্তু গেলো কই? আমি দুপুরের খাবারের পর বড়ঘরের মাঝেই ঠাকুমাকে লেপ্টে মহাভারতের পন্চপান্ডবের গল্প শুনতে শুনতে তন্দ্রায় চলে গিয়েছিলাম। আর সে সুযোগেই ওরা ম্যাটিনি শো’য়ে চলে গিয়েছিলো। সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিলো। তাই কাল যখন দাদুর কাছে ইংরেজী ঠিকঠাক পারছিলো না মনিপিসি, তখন খুব আনন্দ হচ্ছিলো আমার।
তবে দাদুর বকা খেয়ে মনিপিসির মাথাটা নিচু হতে হতে যখন চোখগুলোও আড়াল হয়ে গেলো, তখন কেন যেন আমার ভাল লাগছিলো না। আমি পায়ে পায়ে গিয়ে মনিপিসির পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। আর আঙুল দিয়ে ছুঁইয়ে থাকলাম মনিপিসির হাতটা।
ও মনিপিসি, ইংরেজীটা ভাল করে পড়ো। আমার কথা শুনে মনিপিসির কী হলো জানি না, উঠে কাঠের বড় জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। আর এরপরেই কাঠের সিঁড়ির তলা থেকে বের করে আনলো কেরোসিনের স্টোভ।
মনি, ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা কর স্টোভের সলতা পাল্টাতে হবে কীনা।
ঠাকুমাকে দেখতে পেলে তো জিজ্ঞাসা করবো? জলভরা পেতলের ঘটি, এটলাস ছাতা আর গুড়ো চায়ের কৌটা লাল বারান্দায় রেখেই ঠাকুমা কলতলা চলে গেছে।
মনিপিসি স্টোভের পুড়ে প্রায় ফুরিয়ে আসা সলতাগুলো বদলায় কাগজের প্যাকেটে জড়ানো লম্বা সাদা সলতায়। গুনে গুনে ছয়টা সলতা। এরপর প্যাঁচ ঘুরিয়ে মুখ খুলে স্টোভে কেরোসিন ঢালে মনিপিসি। তারপর লাল বারান্দায় স্টোভটা রেখে আবার বইয়ের কাছে চলে যায় মনিপিসি।
ঝমঝম বৃষ্টিটা এখন ঝিরঝির বৃষ্টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
কলতলা থেকে পেয়ারা গাছ, তুলসীতলা পেরিয়ে ঠাকুমা ঢেঁকিতলা এসে দাঁড়িয়েছে। ভেজা শাড়ির সাথে একটা ভেজা গামছা গায়ে জড়ানো। আর হাতে পেতলের ছোট বালতি ভরা টিউবওয়েলের জল। সেই জলের ভেতর বরই গাছের পাতায় জমে থাকা জল টুপটাপ পড়ছে।
আর সেই আচমকা জলের টোকায় বালতির জল কেমন উপচে পড়তে চাইছে উঠোনের জমে থাকা জলে।
ও ঠাকুমা উঠে আসো, বৃষ্টি নামবে আবার।
ঠাকুমা পেতলের বালতি থেকে ঢেকিতলায় নতুন গজিয়ে ওঠা তুলসীর ঝাড় আর শ্বেতকাঞ্চনের গোড়ায় জল ঢালে। এরপর দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে,
ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্। ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহষ্মি দিবাকরম্।।
আর দেরী করে না ঠাকুমা, প্রায় দৌড়ে উঠে আসে লাল বারান্দার সিঁড়িতে। পেতলের বালতি লাল বারান্দায় নামিয়ে পায়ের কাছের ভেজা কাপড় গুটিয়ে হাতের মুঠোয় পুরে। এরপর সেই ভেজা কাপড়ের চেপা জলে পা ধুয়ে ঘরে চলে যায়।
আজ ঠাকুমার নিত্য পূজায় শুধু ওই গাছের শ্বেতকাঞ্চন। আর পূজোর প্রসাদে গুড়ের বাতাসা।
পূজো সেরে ঠাকুমা বারান্দায় রাখা স্টোভের সলতায় আগুন দেয়। এরপর পেতলের খাবড়িতে ঢালে ঘটি থেকে জল।
কেরোসিন আগুনের নীলচে ধোঁয়া পাক খেতে খেতে উঠোনের ভেজা বাতাসে মেশে।
চায়ের জলে বলক আসতেই তাতে গুড়ো চা পাতা পড়ে। সবশেষে দুধ আর চিনি। চাবি ঘুরিয়ে স্টোভের আঁচ কমায় ঠাকুমা। একে একে সবার কাপে চা পড়ে, কিন্তু ঠাকুমার চা পড়ে কাঁসার গ্লাসে।
ও ঠাকুমা, আজ তোমার একাদশী?
আজ সকালে সবাই চায়ের সাথে সর্ষের তেল মাখানো মুড়ি খেলেও ঠাকুমা তা নেয় না। বরং আঁচলে গরম গ্লাসটা জড়িয়ে ফুঁ দিয়ে জুরিয়ে খুব ধীরে ধীরে খেয়ে যায় সেই চা।
আজ ঠাকুমার তাড়াহুড়ো নেই।
সকালের লাল আটার রুটি মা রান্নাঘরে বানিয়ে ফেলেছে। আর মনিপিসি লাল করে বেগুন ভেজেছে। কিন্তু এগুলোর সাথে ঝোলাগুড়ের জন্য আমি ঘ্যানঘ্যান করছি।
ও মনিপিসি, তুমি জানো না রুটি বেগুন ভাজির সাথে আমার ঝোলা গুড় ভাল লাগে।
মনিপিসি উপরতলা থেকে এনে ঝোলাগুড় আমার পাতে ফেলতেই ঠাকুমা বলে ওঠে, দিদি এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, দুপুরে তুমি আমার পাকে খেও।
এই দিনে ঠাকুমার পাক মানেই খুব সাধারণ কিন্তু দারুণ স্বাদের কিছু।
ও ঠাকুমা, আজ কী রান্না করবে? উত্তর পাবার আগেই বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে।
দাদুর স্কুলে প্রথম সাময়িকী পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাই দাদু বৃষ্টিদিনের আয়েশী দাবাখেলা গুটিয়ে স্কুলে গেলেও , বাজারে যেতে পারবে না।
ঠাকুমাকেই আবার এটলাস ছাতা নিয়ে বৃষ্টিতে নামতে হয়।
রান্নাঘর আর বড়ঘরের কোণায় বেশ খানিকটা জায়গা। ক’দিন আগেও এখানে গোয়ালঘর ছিল। সাদা দু’টো গাই ছিল। কিন্তু এখন এখানে সবজীর বাগান। মিষ্টি কুমড়ো, ঝিঙে, চাল কুমড়ো আর শশার বাগান।
ঝুড়ি ভরে মিষ্টি কুমড়ো, ঝিঙে আর কুমড়োর শাক আসে লাল বারান্দায়। সেখান থেকে কতকটা কুমড়ো আর ঝিঙে নিজের পাকের জন্য রেখে বাকীটা রান্নাঘরে পাঠায় ঠাকুমা।
বৃষ্টির তোড় বেড়েই চলেছে। বাইরবাড়ির সুপারিবাগানে এই দুপুরেই সন্ধ্যা নেমেছে আকাশের জলভরা কালো মেঘের ছায়ায়।
রান্নাঘরে উনুনে আঁচ পড়ে।
ঝিঙে আর মিষ্টি কুমড়ার পাতুড়ি,মটরের ডাল আর চাল কুমড়ার চাক ভাজি। কিন্তু আজ আমার রান্নাঘরের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। আমি লালবারন্দায় বৃষ্টিজল বাঁচিয়ে ঠাকুমার গা ঘেঁষে বসে আছি।
ঠাকুমা কুমড়ো, ঝিঙে আর আলু ডুমো করে কেটে পাথরের বাটির জলে ফেলে। বাটির জল দুলে ওঠে ঠাকুমার হাতের শাখা আর লাল পলার মতো।
এরপর কাউনের চাল জলে ভিজিয়ে ধুয়ে নেয় ঠাকুমা।
কেরোসিনের সলতায় আবার আগুন পড়ে। নীলচে আগুন শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলতেই পেতলের খাবড়ি স্টোভে ওঠে। সর্ষের তেল পড়ে তাতে। ডুমো সবজীগুলো জল ঝরিয়ে লবণ আর হলুদ মেখে খাবড়িতে সাতলে নেয় ঠাকুমা।
বৃষ্টির জল তুলসীতলায় জমতে শুরু করেছে।
সাতলে নেওয়া সবজী তুলে খাবড়িতে জল দেয় ঠাকুমা। সেই জলে দারুচিনি, এলাচ আর তেজপাতা পড়ে। ফুটে ওঠা জলে সেসব মশলার ঘ্রাণ বৃষ্টি বাতাসে কাটাকুটি খেলতে শুরু করতেই ধুয়ে রাখা কাউনের চাল তাতে ভাসিয়ে দেয় ঠাকুমা। অল্প সময় ভেসেই হাবুডুবু খেতে শুরু করে চালগুলো।
কিছু সময় ঢেকে দেয় খাবড়ি। এরপর চালগুলো হলুদ খোলস ত্যাগ করে সাদা হয়ে উঠতেই তাতে পড়ে সাতলানো সবজী। সাথে লবণ আর চিনি।
রান্নাঘরের উনুন নিভে গেছে আজ আগেই।
দাদু স্নান সেড়ে বড়ঘরের মেঝেতে পিঁড়ি পেতে বসেছে আজ, গিন্নী তুমি আমার সাথে খাবে না?
কীভাবে খাই? আজ তো ঠাকুমার একাদশীর পাকে খাবো।
বরইগাছে প্রাচীর হয়ে থাকা পাতাগুলোয় বৃষ্টির ধোঁয়াটে আলো জমতে শুরু করেছে।
বাইরবাড়ির বারান্দায় জল ঝরতে দেওয়া কালো ছাতার পাশে গিয়ে দাঁড়াই আমি। তাঁতঘরে আজ তেমন হৈ চৈ নেই। বৃষ্টিজলে ভিজে নেতিয়ে আসা দিনের সাথে তাল মিলিয়ে তাঁতিরাও আজ চুপচাপ শুধু মাকুড় টানছে।
সুপারিবাগান ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে। দু' তিনটে পাকা সুপারি বুকে নিয়ে বাগানের ঘাসগুলো কোনোরকমে ডুবতে ডুবতে ভেসে আছে। আমার ইচ্ছে হয় বৃষ্টিতে ভিজেই গোলেনূর দাদীকে সুপারি কুড়িয়ে দিয়ে আসি।
দিদি, আসো খাবে। ঠাকুমার ডাক আমি কোনদিনও উপেক্ষা করতে পারি না। তাঁতঘর, সুপারি বাগান সব ভুলে দৌড়ে লাল বারান্দায় যাই আমি।
কাঁসার বগি থালে ধোঁয়া ওঠা রঙিন সবজী বিরন। আমি থাল টেনে কাছে নিতেই চামচ ভরে ঘি দেয় ঠাকুমা, মেখে খাও দিদি।
ঠাকুমার পাতে ঘি'য়ের সাথে কাঁচামরিচ। ঠাকুমা কাঁচামরিচ ভেঙে সবজী বিরন মুখে দিতেই যাবে ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাবা বাড়িতে ঢোকে, শহরে বদলির অর্ডার আজই এসেছে।
মুখের কাছে সবজী বিরন ধরা হাতটা থেমে যায় ঠাকুমার। খুব ধীরে তা ফিরে আসে থালের উপর।
আর ওদিকে দেবদারু গাছের মাথায় জলভরা মেঘ দিনের শেষ আলো মেখে কেমন রূপালী হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে।