দেবদারু গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে একটু আধটু আকাশ দেখা গেলেও সন্ধ্যার তারাগুলো ঠিকঠাক গোনা যায় না কখনই। তাই বাইরবাড়ি টিমটিমে ইলেকট্রিক বাল্বটা জ্বলে ওঠার আগেই আমি আর মনিপিসি এসে দাঁড়াই গোলেনূর দাদীর সুপারি বাগানে। একহারা গাছগুলোর মাথায় গা এলিয়ে পড়ে আছে বিশাল আকাশ। সন্ধ্যায় এ বাড়ি ও বাড়ির তুলসীতলায় বাতির পড়ার সাথে সাথেই সে আকাশে জেগে ওঠে বিন্দু বিন্দু আলোর তারা।
ও মনিপিসি, অরুন্ধতীকে তো আজ খুঁজে পাচ্ছি না। আজ আবার চিনিয়ে দেবে?
তাঁত মাকুরের আওয়াজ থেমে গেছে খানিক আগে।দল বেঁধে তিন চারজন তাঁতী সুপারি বাগান ঘেঁষা পাকা রাস্তাটা পেরিয়ে কালিবাড়ির রাস্তা ধরলো। সবার হাতে গামছায় বাঁধা ভাত তরকারির খালি বাটি। সে দল যত এগোয় তাঁতঘরের ঝাঁপিগুলো একে একে পড়ে যায়।
মনিপিসি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে আঙুল তোলে।
সে আঙুল ঘুরিয়ে ক্রতু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গেরী, বশিষ্ঠ,মরীচী প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকে। সেই চিহ্ন আমি চোখে নিয়ে মনিপিসির দিকে তাকাই। কই আমি তো অরুন্ধতীকে দেখতেই পেলাম না। মনিপিসির আঙুলটা অন্যপাশে সরে গেলো।
বশিষ্ঠের পাশে অস্পষ্ট ওটা অরুন্ধতী?
পাড়ার প্রায় সব ঘরে সান্ধ্য পূজার ঘন্টা বেজে ওঠে। এ সময়টা এলেই দাদু বাইরবাড়ির কাঠের চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। হাতদু’টো পেছনে দিয়ে মাথানিচু করে এগোয় তাঁতঘরের দিকে।তাঁতঘরে অল্প আলোর ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে। সে বাতি এতই অনুজ্জ্বল যে নিমগাছের নীচে সন্ধ্যা হতে না হতেই জমে যায় অন্ধকার।
দাদু সে অন্ধকার কেটে এগোয়। গিয়ে দাঁড়ায় তাঁতঘরের সামনে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ঠাকুমা উলু যোগার দিয়ে ওঠে। শুক্লার ঠাকুমা সুর করে পড়তে শুরু করেছে পাঁচালী,
দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ
ধীরে ধীরে বইতেছে মলয় বাতাস…
আমার মন আকাশ থেকে এখন উবে গেছে। চালকলার নৈবেদ্য’র কথা মনে আসতেই আমি সুপারি বাগান ছেড়ে বাইরবাড়ির বারান্দায় উঠে আসি।
বড়ঘরের এক কোনে পূজার আসন। কপালে লাল সিঁদুরের টিপ পরে ঠাকুমা দূলে দূলে পাঁচালী পড়ছে। আমার মন পাঁচালীতে নেই। আমি প্রসাদের থালে বাতাবিলেবুর উজ্জ্বল গোলাপি রঙ দেখছি।
পাঁচালী শেষ হতে না হতেই এক হাতের ওপর আরেকটি হাত থেকে পাতি ঠাকুমার সামনে। হাতে পড়ে আতপের নৈবেদ্য, এক টুকরো পেয়ারা আর বাতাবি লেবু। কপালে ঠেকিয়ে খাবার আগেই আঙুলের ফোঁকর গলিয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে নৈবেদ্য’র চালকলা।
ও ঠাকুমা, সব পড়ে যাচ্ছে দেখো।
ঠাকুমার আলতা পরা পা দু’টো আমার দিকে এগোয়। আমার হাতের তলে হাত দিয়ে বলে, এতটুকুন হাতে অতকিছু কি আঁটে?
বৃহস্পতিবার রাতে লাল আটার রুটি হয় বাড়ির সবার জন্য। সাথে বেগুন ভাজি আর নিরামিষ তরকারি। সবার শেষে জামবাটি ভরা দুধ আর চিনি চাঁপা কলা।
তবে এতসব আয়োজন করতে ঠাকুমা আর মা যতই তাড়াহুড়ো করুক না কেনো তবুও দেরি হয়ে যায়। দাদু রেডিওর নব ঘুরিয় ভয়েস অফ আমেরিকা ধরে। দু’চোখের পাতা জোড়ানো ঘুম আমার।
‘গত ৭ই মে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে জাতীয় পার্টি।’
রান্নাঘর থেকে ডাক আসে। ও দিদি, খেতে আসো।
ঘুমের আলস্য জড়ানো আমি এক পা দু পা করে রান্নাঘরের বারান্দায় পেতে রাখা পাতের পাশে গিয়ে বসি। চিনি চাঁপা কলা দুধে মাখিয়ে ঠাকুমা দু’একবার মুখে দিতেই আমার ঘুম জেঁকে বসে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। ঠাকুমা শোলোক ধরে,
চেছেমুছে দুধের সর
এতটুকু খেয়ে পেট ভর
ঠাকুমার হাতে দুধের বাটি। আমি আর একটুও খাবো না। আমি খুনখুন শুরু করি।
ও ঠাকুমা, আমাকে বিছানায় দিয়ে এসো।
ঠাকুমা আর জোর করে না আমাকে। বিছানায় পড়তেই আমি ঘুমে তলিয়ে যায়।
সন্ধ্যার আকাশে আজ যে যে তারা চিনেছিলাম সেগুলো আস্তে আস্তে মেঘের তলে হারিয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু তখনো আমার অচেনা।
ঠাকুমার খাট লাগোয়া বাইরবাড়ির জানালা। সে জানালার উপরে নকশা করা টিনের শেড। সেই শেডে অনবরত টুপটাপ শব্দ। আর সাথে একটু থেমে থেমে শোঁ শোঁ আওয়াজ। আমি ঠাকুমার গা ঘেঁষে শুই।
ও দিদি, ভয় নেই ঝড় উঠেছে।
জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকা আমাকে ঠাকুমা কাঁথা দিয়ে ঢেকে আরেকটু নিজের কাছে টেনে নেয়। ঠাকুমার ওমে আমি সব ভয় ভুলে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
ভোরের আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ঝড় থেমে গেলেও বৃষ্টি এখনো ঝরছে। ঠাকুমা আজ একটু দেরিতে উঠেছে। আজ ছরা জল দেওয়া নেই। ফুল তুলতে সাহাপাড়া যাওয়া নেই।
বৃষ্টিতে ভিজে বাইরবাড়ি থেকে কাঠ টগর ফুল নিয়ে বারান্দায় রেখেছে ঠাকুমা। ফুলের সাজি থেকে জল গড়িয়ে মিশে যাচ্ছে লাল বারান্দায় জমা বৃষ্টির জলে।
ও ঠাকুমা, আজ শুধু কাঠ টগরে পূজা দেবে?
তুলসীতলায় ঝড়ে জমা পেয়ারা, বরই আর ডালিম পাতা সরাতে ব্যস্ত ঠাকুমা অব্দি সে কথা পৌঁছাত না।
আজ সকালে রান্নাঘরের উনুনে আঁচ পড়তেও দেরি হয়েছে।মা সকালের চা নামাতেই ঠাকুমার নিত্য পূজা শেষ।
তুলসীমালা চালে মুগের ডাল আর কুচানো আলু মিশিয়ে ঠাকুমা উনুনে বসিয়েছে। চাল ডাল ফুটে উঠলে লবণ আর ঘি মিশিয়ে নামিয়ে নেবে ঠাকুমা।
বৃষ্টির তোড় আবার বাড়লো।
দাদুর স্কুলে যাবারও তাড়া নেই। আজ ছাত্ররা স্কুল কামাই করবে। বৃষ্টির দিনে দাদু তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে ফিরে দাবার বোর্ড নিয়ে বসে যায়।
এসব আয়েসি দিনে দাদু বাজারে যেতে চায় না। ঠাকুমাকে বলে, ঘরে যা আছে তা দিয়ে চালিয়ে নাও।
‘বাবু, বাড়িত আছেন?’
সকালের ঘি ভাত শেষে দাদু হাকিমপুরি জর্দা দিয়ে ঠাকুমার বানানো পান মুখে পুরেছে মাত্র।
কী রে শ্যামল, তুই এই বৃষ্টির দিনে।
শ্যামল কাকা, জেলে পাড়ায় থাকে। আমাদের বাড়ির যে কোনো অনুষ্ঠানে মাছ জোগানের দায়িত্ব শ্যামল কাকার।
বৃষ্টিতে জবজবে ভিজে বাইরবাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামল কাকা। হাতে খালুই।
বাবু, শেষ রাইতে নদীত জাল ফেলাইছিলাম। চিতল উঠছে একখান দ্যাখেন...
কথা শেষ হবার আগেই খালুই থেকে চিতল মাছ বাইরবাড়ির বারান্দায় গড়িয়ে পড়লো।
বৃষ্টির দু’একটা ঝাপটা এসে পড়লে চিতলের গায়ে। জলের বিন্দুগুলোও রূপালী।
শ্যামলকাকার মুখে হাসি।
দাদু ঘাড় ঘুরিয়ে ঠাকুমার দিকে তাকায়, বাড়ির সবাই চিতল মাছের কোরা পছন্দ করে।
ঠাকুমা মাথাটা ‘হ্যাঁ’ সূচক নাড়াতেই দাদু আমার দিকে তাকায়। ও গিন্নি, তাহলে নিয়ে নিলাম তোমার পছন্দের মাছ।
কে বললো চিতল মাছ আমার পছন্দের? আমি তো শুধু ঠাকুমার হাতের লাল কোরা ভালবাসি।
শ্যামল কাকা এবার হিসেবে বসে।
বাবু, গতবারের কাতল আর এবারের চিতল হক্কল মিইল্যা ষাট ট্যাকা।
ঠাকুমা পান বানিয়ে এনে দাদুর হাতে দেয়। সেই পান শ্যামল কাকার দিকে এগিয়ে দাদু বলে, সামনের হাটবারে আসিস। সব হিসাব করে দিয়ে দেবো।
পান মুখে পুরে শ্যামল কাকার হাসি চওড়া হয়।
বাবু, দুই একখান কাটা কাপুড় পাওয়া যাইবো নাকি? বাড়ির বৌগের জইন্য নিতাম।
সামনের হাটবারে নিয়ে যাস শাড়ি, এখন সব গাঁটে বাঁধা হয়ে গেছে।
তাইলে গেলাম বাবু, মুখে একইরকম হাসি ঝুলিয়ে শ্যামল কাকা বৃষ্টিতে আস্তে আস্তে আবছা হয়ে গেলো।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে এখন।
বাইরবাড়ির বারান্দা থেকে চিতল মাছ চলে গেছে রান্নাঘরের বারান্দায়। সেখানে কলাপাতায় মাছটা ফেলে ঝিনুক দিয়ে আঁশ ছাড়াচ্ছে মা। রান্নাঘরের মেঝেয় পড়েছে শিলপাটা। লাল শুকনো মরিচ ও জিরা বাটতে বসে গেছে মনিপিসি।
বাড়িতে বড় মাছ এলে ঠাকুমা নিজে হাতে কাটে। বাড়ির সবাই বলে ঠাকুমার হাতে কাটা মাছ সবার পাতে সমান জোগান দেয়।
মাছের পেটিগুলো কেটে আলাদা করে রেখেছে ঠাকুমা। এরপর খুব কাঁটার অংশটুকু নিয়ে ঠাকুমা বসে গেছে কুরতে। ঝিনুক দিয়ে মাছ কুরিয়ে কাঁটা আলাদা করছে ঠাকুমা একমনে। সেই কোরা মাছে আরেকবার কাঁটা বেছে দিচ্ছে মা।
ও ঠাকুমা, কত কাঁটা এই মাছে!
দিদি, তুমি খাবে বলেই তো এত সময় নিয়ে একটা একটা কাঁটা বেছে নিচ্ছি।
সত্যিই অনেক সময়। আজ দুপুরের উনুনে আঁচ পড়তে দুপুর হয়ে গেলো। একদিকে থেমে থেমে বৃষ্টি তার উপর আবার বাতাস শুরু হলো। ঠাকুমা এবার তাড়াহুড়ো শুরু করলো।
আজ বেশি পদ হবে না। ওই তো বাদাম আর নারকেল দিয়ে বাগানের কলার মোচা, পেঁপে ভাজি আর চিতলমাছের লাল কোরা।
পেঁপে ভাজি আর মোচার ঘন্ট হয়ে যেতেই ঠাকুমা কোরা মাছে হলুদ, লবণ আর ঝালের গুড়ো দিয়ে ভাল করে মেখে নেয়। তাতে অল্প একটু আতপের গুড়ো দিয়ে একটা মণ্ড বানায় ঠাকুমা।
উনুনের আগুনে টগবগ করে ফুটছে কড়াইয়ের জল। সেই জলে ঠাকুমা হাত বাঁচিয়ে কোরার মণ্ড দিয়ে দিলো। একটু পরেই রঙ বদলে সাদাটে হয়ে ভেসে উঠলো কোরার মণ্ড। ঠাকুমা মণ্ডটাকে আরোও কিছুসময় ফুটতে দিলো। এরপর ঠাকুমা উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে জল ঝরিয়ে নেয় কোরার মন্ডের। ধোঁয়া ওঠা মণ্ডকে লোহার খুন্তা দিয়ে ঠাকুমা অনেকগুলো টুকরো করে নিলো।
আবার উনুনে আঁচ বাড়লো। লোহার কড়াই পড়লো তাতে। সর্ষের তেল অনেকটা।
কোরার টুকরোগুলো ঠাকুমা লাল করে তাতে ভেজে নেয়।
তেলে এবার জিরা আর তেজপাতা ফোড়ন পড়লো। ফোড়নের ধোঁয়া উঠতেই তাতে বাটা জিরা আর বাটা টকটকে লাল শুকনো মরিচ। বাটি ধোয়া জলে সেই মশলা খানিক সময় কষালো ঠাকুমা। মশলা থেকে তেল ছেড়ে আসতেই ঠাকুমা তাতে হলুদ আর আদা বাটা দিয়ে আরোও কিছুসময় কষায়।
তেল ছেড়ে আসা মশলার ঘ্রাণ রান্নাঘরের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঠাকুমা ঘটি থেকে গরম জল দিয়ে ঝোল দেয় মশলায়। গরমজল কষানো মশলায় পড়তেই টগবগ করে উঠলো। আর দেরি নয়। এবার ঠাকুমা লাল করে ভেজে রাখা টুকরো মাছের কোরা কড়াইয়ে দিয়ে দিলো।
ঢাকনা পড়লো কড়াইয়ে।
বৃষ্টির তোড় কমেছে। কিন্তু কালচে মেঘের ছায়ায় উঠোনে একটু একটু করে অন্ধকার জমা হচ্ছে।
ঢাকনা তুলে ঠাকুমা মিহি করে বাটা গরম মশলা দেয় লাল রসায়। গনগনে খড়ি বের করে উনুনের আঁচ কমায়। এরপর বেশ খানিকটা ঘি ছড়িয়ে ঠাকুমা উনুন থেকে নামিয়ে নেয় চিতল মাছের কোরা।
উঠোনের মেঘের ছায়ায় আবার বৃষ্টিজলের বাড়বাড়ন্ত।
রান্নাঘরের ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে উঠলো। আজ দুপুর বেলাতেই কেমন কালো মেঘ সন্ধ্যা নামিয়েছে।
রান্নাঘরে পাত পড়েছে সবার।
আমার পাতে আমনের সাদা ভাত আর লাল কোরা। আমি ভাত ভুলে একে একে সব কোরার টুকরো শেষ করি।
ও ঠাকুমা, একটাও কাঁটা নেই। ঠিক মাংসের মতো।
এজন্যই তো গিন্নির জন্য আজ চিতল মাছ রাখলাম। নিজের পাত থেকে আরেকটা কোরা তুলে আমার পাতে দেয় দাদু।
আমি এবার দাদুর গা ঘেঁষে বসি, শ্যামল কাকাকে বলবে প্রতিদিন চিতল মাছ দিয়ে যেতে।
বলবো গিন্নি, দাদু হেসে ওঠে।
বৃষ্টিজলে আস্তে আস্তে ধুয়ে যাচ্ছে উঠোনে মেঘের অন্ধকার এই শেষবেলায়।
এই সিরিজটা পড়ার জন্যে মুখিয়ে থাকি প্রতি সপ্তাহে। বলা হয়না কখনো কিন্তু আমি পড়ি, আমরা পড়ি।