দেবদারু বাগানের মাথায় থমকে থাকা আকাশটা দেখে প্রায়ই মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে। আর কখনো কখনো তো কালচে মেঘের পরত জমে আকাশটা এত নীচে নেমে আসে যে, মনে হয় গাছের পাতাগুলো মেঘের ভেতরে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। তবে একটু হাওয়া ছাড়লে সেই মেঘ জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে আকাশটাকেই একটু একটু করে দূরে নিয়ে যায়।
তবে আকাশ যতই দূরে যাক না কেনো, জলধোয়া দেবদারু গাছের পাতাগুলো আরোও সবুজ আর চনমনে হয়ে ওঠে। উটকো হাওয়ায় টুপটাপ পড়তে শুরু হয় বেগুনি ফল। আকাশ, মেঘ সবকিছু ভুলে আমি দৌড়ে চলে যাই দেবদারুর তলায়। বেগুনি ফলগুলো সব কোঁচড়ে ভরতে হবে যে আমায়। নইলে রান্নাবাটি খেলার সময় ইতু, শুক্লার সঙ্গে আবার কাজিয়া হবে। খেলার জিনিস ভাগাভাগি করতে গেলে সবসময়ে ওরা আমাকে কম দেয়।
আজ আমি ওদের কাছ থেকে কিচ্ছু নেবো না। একটা, দুইটা, তিনটা… বেগুনি ফল তুলে কোঁচড় ভরে ফেলছি আমি। বাইরবাড়ির দেবদারু বাগানের গা ঘেঁষে তাঁতঘর। তারপর এক চিলতে পুকুর। পুকুরপাড়ে শ্বেতটগর গাছে সারা বছরই সাদা টগর। আর তার ঠিক তলায় কলমি-হেলেঞ্চার জঙ্গল।
কীরে মনি বৃষ্টি না কমতিই খেলতি নামিছিস? তোর ঠাকুমা জানে? কয়দিন আগেই তো জ্বর থিকা উঠলি। গোলেনূর দাদি আমাকে কিছু বলারই সুযোগ দেয় না। গলা আরোও চড়ায় এবার। ও বৌ… বৌ…
ঠাকুমা লাল বারান্দায় বসে কথামৃত পড়ছিলো। দাদু বাজারে চলে গেছে আগেই। মা আর মনিপিসি খই বেছে রাখছে গুড় মাখানোর জন্য। আম কাঁঠালের দিনে সকালের পাতে প্রায়ই আম দুধ আর মুড়কি পড়ে। তাই আশ্বিন মাস ছাড়াও এ বাড়িতে এসময় আরেকবার গুড়ে পাক পড়ে।
আমি বাইরবাড়ির বারান্দায় বসে একা একা চারগুটি খেলছিলাম। বৃষ্টি ধরে এলেই তো দেবদারু বাগানে এলাম। আমার দেবদারু ফল লাগবে যে। আরেকটু পরেই ইতু, শুক্লা, সুমি সবাই চলে আসবে। গোলেনূর দাদির ডাক ঠিক ঠিক ভেতর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ঠাকুমা আঁচল মাথায় তুলে এসে দাঁড়ালো বাইরবাড়িতে। না দিদি, তুমি একদম কথা শোনো না; ক’দিন আগেই তো জ্বর থেকে উঠলে।
ঠাকুমা আমার কোঁচড়ের ফলগুলো নিজের কোঁচড়ে নেয়। সত্যিই ভেজা ফলে আমার জামা ভিজে গেছে। আর এতক্ষণে বুঝতে পারলাম টিপটিপ বৃষ্টিতে এরইমধ্যে আমার চুলও ভিজে গেছে। ঠাকুমা ভেতর বাড়িতে যাবার জন্য তাড়া দেয় আমাকে। জ্বর আসতি না আসতিই তো চোখ দুইখান উল্টাইয়া দিস; ঠাকুমার কানতি কানতি বেহুঁশ হওয়ার দশা হয়, জানিস?
আধাভেজা গোলেনূর দাদির কোঁচড় উপচে পড়া কলমি আর হেলেঞ্চা ডগা। আমি সেদিক তাকাতেই গোলেনূর দাদি সহাস্য উক্তি, বর্ষার জলে শাকগুলান লকলক করতিছে বৌ। পুকুরপাড়ের ওই কলমি-হেলেঞ্চার জঙ্গলে গোলেনূর দাদি ছাড়াও আরেকজন মানুষের খুব আনাগোনা। তাঁতঘরের ড্রাম মাস্টার মানিক কাকুর। সকালবেলায় তাঁতঘরের কাজে একটু টান পড়লেই গিয়ে দাঁড়ায় পুকুরপাড়ে। বেছে বেছে লকলকে কলমি-হেলেঞ্চার ডগা তুলে কচুরপাতা ভরে ফেলে। এরপর দুপুর আসার আগেই সুযোগ বুঝে কচুর পাতায় মোড়ানো শাকের ডগা পৌঁছে দিয়ে আসে নিজের বাড়িতে। দাদু বা বাঘকাকু কোনো প্রশ্ন করার আগেই একগাল হেসে মানিক দাদুর উত্তর, কাঁচকি মাছ আর কাসুন্দি দিয়ে রানতি কয়ে আলাম।
গোলেনূর দাদি রান্না করে রসুন শুকনো মরিচ আর বেগুন দিয়ে। মনিপিসি ভালো খায় বলে এই ডগা রান্না হলেই কলার পাতায় মুড়িয়ে কোহিনূর পিসি নিয়ে আসে। তবে আমাদের বাড়ির উনুনে এই ডগা সেদিনই ওঠে যেদিন কুচো চিংড়ি বাজারের ব্যাগে থাকে। কলমি-হেলেঞ্চায় কচি সবুজ ডগায় লেপ্টে থাকা চিংড়িগুলো বেছে বেছে মুখে পুড়তেই বেশি ভালো লাগে আমার। আজও তাই বাজারের ব্যাগ আসতেই আমার উৎসাহ বেড়ে যায়। নিশ্চয়ই দাদু বৃষ্টিদিনে তাড়াহুড়ো করে পাঁচমিশালি মাছ কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাতে লুকিয়ে থাকে কুচো চিংড়ি।
বৃষ্টিতে উঠোন কাদামাখা। সে উঠোনে বাজারের ব্যাগ উপুড় হলো। লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এলো কুচকুচে কালো কৈ। বেরিয়েই এদিক ওদিক ছুটে কাদা খেলতে শুরু করেছে মাছগুলো। আমার মাথা মুছে ঘরে পাঠিয়ে ঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে উঠলো মাছগুলো নিয়ে। মুঠোভরা ছাই ছটফটানো মাছগুলোর চোখেমুখে মাখিয়ে পরাস্ত করার চেষ্টা।
ও ঠাকুমা, কাঁটা দেবে তো। কায়দা করে মাছের মাথা ধরে ঠাকুমা আমার দিকে তাকায়, এভাবে ধরতে হয় দিদি, তাহলে কাঁটা দিতে পারে না। ঠাকুমা ছাই মাখানো মাছের আঁশ ছাড়াতে শুরু করেছে। কেন যেনো তবুও আমার ভয় সরছে না। সেই যে সেবার কৈ মাছের কাঁটায় ঠাকুমার আঙুল কতটা ফুলে গিয়েছিলো! অনেকদিন বীরেন দাদুর দেওয়া হোমিওপ্যাথি খেতে হয়েছিলো ঠাকুমার।
এরইমধ্যে বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। বৃষ্টিজলে ধুয়ে যাচ্ছে মাছের গায়ে জড়ানো ছাই।
তাঁত মাকুর শব্দ আজ একটু ম্লান। বৃষ্টির দিনে তাঁতঘরের ঢালু জায়গাগুলো জল জমে যায়। সেসব জায়গার মাকুগুলো খটাস খটাস শব্দ তোলা বন্ধ রেখেছে আজ। তাই বলে কিন্তু তাঁতিদের কমতি নেই তাঁতঘরে। আলসে এসব দিনে তাঁতঘরের ভেতর আসর জমে খুব। কেউ বাঁশিতে সুর ধরে তো কেউ গলায়। বাঁশির সুর বৃষ্টিজলে ভিজে ভিজে কাদামাখা উঠোন একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছে,
জানো না মন খালে বিলে
থাকে না মিল জল শুকালে
জানো না মন খালে বিলে
থাকে না মিল জল শুকালে
কি হবে আর বাঁধা দিলে
শুকনা মোহনা… সাধন হবে না
উনুনে আঁচ পড়তে আজ দেরি হয়ে গেলো। তাই পদের সংখ্যাও যৎসামান্য। কিছুসময় পড়েই দাদু স্কুল থেকে চলে আসবে। দিন যতই অন্যরকম হোক না কেনো ঘড়ির পেন্ডুলাম দুলে বেলা একটা জানান দিলেই দাদুর হাঁক শোনা যায়, গিন্নি কই? আমি যতই পাড়া বেড়ানো হই না কেনো এই সময়ে ঠিকই আমাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে। নাহলে তো দাদুর পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের হওয়া কাঠি লজেন্স মনিপিসির দখলে চলে যাবে। কত চেয়ে চেয়ে এরপর নিতে হয়।
রান্নাঘরে তাড়াহুড়ো বাড়ছে। ওল সেদ্ধ, তিল কুমড়ো, পাঁচমিশালি ডাল আর কৈ মৌরি হবে আজ। উনুনে ভাতের হাড়িতে ওল পড়ে গেছে সেদ্ধ হতে। কুমড়োর লাল ডুমো জলে ডুবে আছে। আর লাল বারান্দায় কেরোসিন স্টোভে ফুটছে পাঁচমিশালি ডাল।
আমি পায়ে পায়ে বাইরবাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়াই। এপাশটায় সুপারি বাগান। তার গা ঘেঁষে গোলেনূর দাদির উঠোন। এখান থেকে ওবাড়ির ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায়। বড়ঘরের বারান্দায় বসে কোহিনূর ফুফু কলমি-হেলেঞ্চার ডগা কুচিয়ে নিচ্ছে। আর গোলেনূর দাদি এক কোণে চরকা ঘুরিয়ে ববিনে সুতা ভরছে।
অসংখ্য গাছঘেরা বাড়িটি চিরকালই কেমন নিরীহ। এসব বৃষ্টিদিনে বাড়িটি যেনো আরোও নির্বিকার হয়ে ওঠে। আমার চেঁচিয়ে কোহিনূর পিসিকে ডাকতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু ও বাড়ির নিস্তব্ধতা দেখে আমার আগ্রহ ফুরিয়ে যায়। বৃষ্টি একটু একটু করে ধরে আসছে।
উনুনে তেতে ওঠা তেলে হলুদ-লবণ মাখানো কৈ মাছ পড়লো। মনিপিসির পেছন পেছন আমিও রান্নাঘরে গিয়ে উঠি। শিলপাটায় মৌরি বাটছে মা। আর এর আগেই গোটা জিরা আর কাঁচামরিচ বেটে রেখেছে। সর্ষের তেলে হাল্কা লাল করে একটা একটা মাছ ভেজে নিচ্ছে ঠাকুমা। ও ঠাকুমা, কোনো মাছ জিইয়ে রাখলে না? সব রান্না করে ফেলবে আজ?
কৈ বা মাগুর মাছ বেশি এলে ঠাকুমা মাচানের নীচে মাটির হাঁড়িতে জলে জিইয়ে রাখে। কিন্তু আজ তা করেনি। ঠাকুমার সময় নেই উত্তর দেবার। সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। আরেকটু পড়েই দাদু চলে আসবে।
উল্টেপাল্টে সবগুলো মাছ ভাজা শেষ করেই ঠাকুমা কড়াইতে আরেকটু সর্ষের তেল দিলো। তাতে মেথি ফোড়ন। ফোড়ন কালো হবার আগেই জিরা আর কাঁচামরিচ বাটা পড়লো কড়াইয়ে। সঙ্গে বাটি ধোয়া জল। গনগনে খড়ি ঠেলে উনুনের আঁচ বাড়ালো ঠাকুমা। মশলা থেকে তেল বেরিয়ে আসছে। এবার তাতে হলুদ গুঁড়া আর লবণ পড়লো। আরেকটু জল ছিটিয়ে মশলা কষাতে লাগলো ঠাকুমা।
বৃষ্টি এখন একদম ধরে এসেছে। কিন্তু আকাশ এখনো কালো। কাদামাখা উঠোনেও কালো মেঘের ছায়া পড়েছে। তাঁতমাকুর শব্দের সাথে আরও একটি শব্দ যুক্ত হয়েছে এখন। নীচু সুরে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে একটানা। তবে তা শুনতে একটু কান পাততে হচ্ছে।
এবার কড়াইতে পড়লো মৌরি বাটা। একটু নেড়েচেড়ে ঠাকুমা অল্প জল দিয়ে দিলো। তাতে কিন্তু মশলা ডুবলো না।বুকচেরা অনেকগুলো কাঁচামরিচ পড়লো তাতে। আর সাথে সাথেই ভাজা কৈ গুলোও। আর দেরি করে না ঠাকুমা। নেড়েচেড়ে মাছে মশলা মাখিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়। গনগনে খড়ি টেনে বের করে উনুনের আঁচ এবার কমায় ঠাকুমা।
মৌরির আর কাঁচামরিচের ঘ্রাণ বৃষ্টিদিনের ভারী বাতাসে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। আকাশের মেঘে আরেক পোঁচ কালি পড়লো। উঠোনের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা দিনেরও আলো কমলো খানিক।
গিন্নি কই? দাদু চলে এসেছে। উনুন থেকে কৈ মৌরি নামলো। দাদু স্নান সেরে আহ্নিক শেষ করে লাল বারান্দায় পাতের সামনে বসে পড়েছে। কিন্তু তাঁর ভাতের থালায় হাত পড়েনি। গিন্নি তাড়াতাড়ি খেতে এসো। আমি মনিপিসির সাথ ধরেছি গোলেনূর দাদির বাড়ি যাবার জন্য। সাদা টিনের থালে কৈ মৌরি।
গোলেনূর দাদির বড়ঘরের বারান্দায় পাটি পড়েছে দুপুরের খানার। হাঁড়ি ভরা ভাত, বাটিতে বাগারের রসুন ভাসা মসুর ডাল আর শাকের ডগা ভাজি। অন্য একটা বাটিতে কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ। কৈ মৌরি দেখে গোলেনূর দাদির চাপা দীর্ঘশ্বাস, কোহিনূরের আব্বা খুব ভালো খায় কৈ মৌরি। উটকো বাতাসের হিসহিস শব্দ। সাথে একটু একটু মেঘের ডাক। আমরা দাঁড়াই না।কৈ মৌরির থালটা গোলেনূর দাদির হাতে দিয়েই বাড়ির পথ ধরি। পা চালিয়ে ভেতর বাড়িতে চলে আসতেই দাদুর ডাক, গিন্নি তোমার জন্য ওল সেদ্ধ ভাত মাখিয়ে বসে আছি তো।
কাঁচামরিচ ভাতে মাখিয়ে নেবার আগে ওল মাখানো অল্প ভাত দাদু আমার পাতে তুলে দেয়। আমি কাঠের পিঁড়িতে বসে তা মুখে তুলতেই ঝমঝম করে নেমে আসে বৃষ্টি। উঠোনের বুকে জমে থাকা কালো মেঘের ছায়া বৃষ্টি জলে একটু একটু করে মুছে যেতে থাকে। তাঁতঘরে বাঁশির সুর,
দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না
তুমি কেন জানলে না
সময় গেলে সাধন হবে না
কি সুন্দর !!আচ্ছা ওই দেশ টা কি আমাদের ছিলো ?এই রকম ?মুক্ত ।..ভয়হীন ।...মানবিক ।..একত্রে বেঁচে থাকা ।..ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া ।..ছোট ছোট আশা আখাঙ্খা ।..ভেদাভেদ নেই ।..হিংসা নেই ।..ঈর্ষা নেই ।..আছে শুধু মানুষ ।..কিছু ভালো মানুষ !!!!ওই দেশ টা কি আমাদের ছিল ?কোথায় গেলো ??????
বলার ভঙ্গিটি ও মৌরি কই এর মতো।ভারি স্বাদু পরিবেশন
এত মায়ামাখা সপনে জড়িয়ে যাই... ঐ ভাত ব্যনূনুনের ঘ্রাণের মতই...মনকেমন করে