বড়ঘরের সিলিং ফ্যানের অনবরত ঘটাং ঘটাং শব্দ দুপুরগুলোকে কখনই ঝিম মেরে যেতে দেয় না। লাল মেঝেতে পাতা শীতলপাটিতে বাইরবাড়ির দরজা দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে গা এলিয়ে পড়ে আছে। আর সেই রোদের সাথে সন্ধি করে বড়ঘরও কেমন তেতে উঠেছে।
কুলোয় ভরে শুকনো বরই রোদে দিতে মনিপিসি টিনের দোতলায় গিয়েছে। শুকনো বরই ঢেঁকিতে কুটে আচার বানায় ঠাকুমা। আবার কাঁচা আমের সাথে শুকনো বরই দিয়ে বানায় টক। সেই টক থেকে আমি খুঁটে খুঁটে ওই শুকনো বরইগুলোই খাই আমি।
সিলিং ফ্যানের ঘটাং ঘটাং শব্দ এড়িয়ে কান পাতি দোতালার টিনের চালে। মনিপিসির পায়ের শব্দ খুঁজি।
মনিপিসিটা সেই কখন গেছে উপরে; রেডিও’র নাটক শেষ হলো, ঠাকুমা রান্নাঘরের কাজ সেরে কলতলায় চলে গেলো, দাদু নস্যি টেনে রেডিও’র আওয়াজ কমিয়ে শুয়ে পড়লো তবুও মনিপিসির নীচে আসার নাম নেই।
শীতলপাটি থেকে বারবেলার তাতানো রোদ এখন আমার গায়ে উঠে এসেছে।
দিদি, এই গরমে রোদে শুয়ে আছো? ঠাকুমার ধোয়া শাড়ির ঘ্রাণ আমার নাকে এসে ধাক্কা দেয়। লালবারান্দায় খাম্বার সাথে ঝুলানো রাশিয়ান ডিম্বাকৃতির আয়নায় সামনে দাঁড়ানো ঠাকুমা। হাতে তিব্বত স্নো’র কৌটা।
ও ঠাকুমা, তুমি ঘুমাবে না? সেই কখন থেকে একা একা শুয়ে আছি। মনিপিসিটা কখন ওপরে গিয়েছে জানো?
আমার অনুযোগে ঠাকুমার মন নেই। তিব্বত স্নো-এর কৌটো খুলে আঙুলে তুলে নেয় বেশ খানিকটা সাদা স্নো। এরপর সারামুখে আলতো হাতে মেখে আয়নার মাথায় লাগানো চিরুনী নামিয়ে নেয়। নাক বরাবর সিঁথি টানে। এরপর সেই চিরুনীর কোণা দিয়েই সিঁদুর ভরে সিঁথিতে।
সিলিং ফ্যানের শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে দাদুর ভাতঘুমের ভারী নি:শ্বাসের শব্দ। আর ওদিকে খুব মৃদূ আওয়াজে রেডিওতে বেজে চলেছে,
কত যুগ গেলো পথ চেয়ে
তবুও তো পথ ফুরায় না
আমার মন বলে তুমি আসবে..
হঠাৎ কাঠের সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাই। ধপ ধপ শব্দগুলো কেমন ছন্দ মিলিয়ে নীচের দিকে নামছে। আমি গা থেকে রোদ তাড়ানোর অজুহাতে ওপাশে সরে যাই। হাতে কালো পাথরের বড় একটি বাটি হাতে মনিপিসি বড়ঘরের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।
ও মনিপিসি বাটিতে কী এনেছো? এতক্ষণ কী করছিলে উপরে?
মনি, তুই আজও ঘুমালি না? মনিপিসির হাতের বাটিটার প্রতি আমার অদ্ভুত আগ্রহ বেড়েই চলেছে। শিকবিহীন কাঠের বড় জানালার ঠিক নীচে সেই বাটিটা রাখে মনিপিসি। আমি সব ভয় অগ্রাহ্য করে ঘাড় ঊঁচিয়ে বাটির ভেতর কী আছে দেখতে যাই। কিন্তু ঠাকুমা কলাপাতার মাইজ দিয়ে চট করে ঢেকে ফেলে বাটি।
মনিপিসি এবার আমাকে প্রায় অগ্রাহ্য করে বাইরবাড়ির দরজা পেরিয়ে গোলেনূর দাদীর উঠোনের দিকে চলে যায়।
তবে ঠাকুমা ঠিকই আমার পাশে চলে আসে, লাল সুতোর ফুলতোলা আমার বালিশটাতে ভাগাভাগি করে শোয়।
এরপর ক্লান্তি জড়ানো গলায় বলে, দুইবোনে একটু জিরিয়ে নেই আসো।
তিব্বত স্নো, ধোয়া শাড়ির সোঁদা ঘ্রাণ আর সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে আওয়াজে আমি আস্তে আস্তে তন্দ্রায় তলিয়ে যাই।
তন্দ্রা ভাঙে কোহিনূর ফুফুর ডাকে, কীরে মনি আর কত ঘুমাবি?
সে ডাক স্বপ্ন ভেবে আমি ঠাকুমার শরীরে লেপ্টে ঘুমাতে যাই, কিন্তু কোথায় ঠাকুমা? লালমেঝেয় পাতা শীতলপাটিতে চারপাশে শূন্যতা নিয়ে ফুল তোলা বালিশে আমি একা পড়ে আছি।
আমার রাগ হয়, কান্না পায়, ঠাকুমা আবার আমাকে একলা ফেলে চলে গেছে।
আমি চুপচাপ বাইরবাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। কোহিনূর ফুফু আর মনিপিসি গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছের নীচে চট পেতে বসে জয়দানা পিঠা কাটছে হাতে।
দু’জনের হাত একই ছন্দে একই মাপের পিঠা কেটে কুলা ভরে ফেলেছে। আমি ততক্ষণে ঠাকুমার কথা ভুলে গেছি। ও কোহিনূর ফুফু আমিও বানাবো জয়দানা, বারান্দা থেকে আমি প্রায় লাফিয়ে নামি।
কোহিনূর ফুফুর ঠোঁটে হাসি, এজন্যই তো আমি তোকে ঘুম থেকে উঠতে বললাম।
আমার হাত জলে মাখানো কাঁচা ময়দার ছোট্ট একটা খন্ডে কেমন ভরে যায়!
আমি মনিপিসির হাতের ছন্দে তাল মেলাতে চাই, কিন্তু পারি কই? আবার ওদিকে আমার মাপহীন জয়দানাগুলো কুলোয় পড়ে কেমন বেখাপ্পা লাগে।
আমার মন জয়দানা থেকে উবে যায়। আমি ময়দার খন্ডে নানারকম আকৃতি দিতে দিতেই দেখি তা কী অদ্ভুতভাবে পুতুল হয়ে উঠেছে।
আমি যত্ন করে পুতুলের চোখ দিতে যাবো তখনই ইতুর ডাক, মনি চারগুটি খেলবে?
আমি জয়দানা ভর্তি কুলায় পুতুলটা ফেলে দৌড়ে বারান্দায় উঠি, সাদা সাদা কড়িতে দান ফেলতে থাকি ষোলোদানের অপেক্ষায়।আর উল্টে পড়া একটি কড়িকে আঙুলের টোকায় অন্য কড়ির সাথে ছুঁইয়ে গুনি, এক....দুই...
চারগুটিতে মগ্ন হতে হতেই টের পাই মনিপিসিদের জয়দানা পিঠা কাটা শেষ হয়। বিকেলের তেজ কমে আসা রোদে সে পিঠা গা শুকাতে থাকে। আর তখনই নাকে এসে ধাক্কা দেয় বুট বিরনের ঘ্রাণ।
একই সাথে গোলেনূর দাদীর গলার আওয়াজ, কোহিনূর আসরের নামাজে বসবো, ইফতারির জন্য আখায় বুট বিরন বসাইছি, খেয়াল রাখিস।
কোহিনূর ফুফু দেরী না করে বাড়ির দিকে এগোয়, এক হাতে জয়দানার কুলা আর অন্য হাতে ঠাকুমার সেই কালো পাথরের বাটি। আমি এবার সুযোগ পেয়েই জিজ্ঞাসা করি, পাথরের বাটিতে কি আছে কোহিনূর ফুফু?
কোহিনূর ফুফু হাওয়ায় ভাসায় দু’টো শব্দ, ঝোলা গুড়।
চারগুটি খেলা শেষ না হতেই রোদ বুজে যায়। জেঠি ঠাকুমা ইতুকে ডেকে নেয় সন্ধ্যা নেমে আসছে বলে। আমি বাইরবাড়ির বারান্দায় আবছা অন্ধকারে বসে দেখতে থাকি, গোলেনূর দাদীর বড়ঘরের বারান্দায় কোহিনূর ফুফু লেবুগুড়ের শরবত বানায়। গোলেনূর দাদী হাড়ি থেকে বুট বিরন থালে থালে বাড়ছে।
আর সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসতেই গুড়ের শরবত হাতে তুলে নেয় গোলেনূর দাদী। একইসাথে বেজে ওঠে ঠাকুমার পূজার ঘন্টাও।
জয়দানার কুলা দু’তিন রোদ না পেতেই ঈদ এসে যায়।
তাঁতঘর আজ কেমন নিস্তব্ধ, মাকুর খটাস খটাস শব্দ ছাড়া বেমানান এপাড়া।
তবে সকাল থেকেই বাইরবাড়িতে এক অন্যরকম আলোড়ন। সব আনাগোনার উদ্দেশ্য অবশ্য গোলেনূর দাদীর উঠোন। কোহিনূর ফুফুও আজ কেমন যেন অন্যরকম হয়ে আছে। গোলাপী রঙের নতুন কামিজে কোহিনূর ফুফুকে কী সুন্দর লাগছে!
আর ওই তো গোলেনূর দাদী, পাটভাঙা শাড়ি আর চোখের সূর্মায় কেমন অচেনা লাগছে। সুমীও আজ নতুন জামা পড়েছে।
কিন্তু মানুষগুলোর আজ এ বাড়ির দিকে তাকানোর সময় কই?
এরমধ্যেই সুমীর দাদাজান সাদা জোব্বা পড়ে বাইরবাড়ির আঙিনা পেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে হুট করে চলে গেলেন। বাতাসে আতরের গন্ধ এদিক ওদিক ধাক্কা খেয়ে আমার চারপাশেই ঘুরপাক খেতে লাগলো।
আমি বাইরবাড়ি থেকে ভেতর বাড়িতে চলে আসি।
উঠোনে বাজারের ব্যাগ এসে পড়েছে। আজ কোনো রিক্সাওয়ালা বাজার আনেনি। দাদুর স্কুল বন্ধ। বাজার থেকে আজ দাদু হাঁসের ডিম এনেছে।
কাজের ঝামেলা কম, তাই ঠাকুমারও আজ রান্নাঘরে যেতে গড়িমসি। লাল বারান্দায় পা মেলে কাঁথায় সবুজ সুতোর বড় ফোঁড় তুলছে।
মনি, কোহিনূর ফুফুর ডাক। বরই গাছের তলায় একটা বড় বাটি হাতে দাঁড়ানো। তোর জন্য জয়দানার পায়েস এনেছি।
কোহিনূর ফুফুর হাত থেকে বাটিটা নেয় মনিপিসি।
ঘিয়ে ভেজে ঘন দুধে তোর দেওয়া ঝোলা গুড়ে আম্মা এই পায়েস রান্না করেছে, খেয়ে দেখিস রীতা; কোহিনূর ফুফু বলে আর দাঁড়ায় না।
মনিপিসি লাল বারান্দায় বাটিটা রাখতেই লোভী চোখে সেদিকে তাকাই।
খাবি? মনিপিসির আহ্বানে সাড়া হতেই কাঁসার বাটি আর চামচ হাতে মা এসে দাঁড়ায়। আর জয়দানা পায়েসের বাটি আমার হাতে আসতেই সেই জলে মাখানো কাঁচা ময়দার পুতুলের কথা মনে পড়ে যায়।
পুতুলটির তো চোখ দেওয়া হয়নি।
চোখহীন সেই পুতুলের জন্য আমার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে।