কলতলা ঘেঁষা আমগাছে মুকুল আসতে না আসতেই শুরু হয়ে যায় ঠাকুমার আচার দেবার প্রস্তুতি। আগের বছরের আচারের বয়াম ধুয়েমুছে রোদে শুকানো, সর্ষে ভাঙিয়ে তেল করে রাখা, বাছা শুকনো মরিচ রোদে দেওয়া আর ঝোলা গুড়ের মাটির কলসটি পেছন থেকে সামনে আনা।
ও ঠাকুমা, এই গুড়ের ভাঁড় কবেকার?
ঠাকুমা মাটির ঢাকনা সরিয়ে সেই ভাঁড়ে হাত ডুবিয়ে তুলে আনে কালচে লাল জলা গুড়। এরপর নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ নিয়ে বলে, কেন দিদি ভুলে গেছো? আইনুল দিয়ে গেলো যে সেদিন।
হ্যাঁ তাই তো, আইনুল চাচা সেদিন কয়েক ভাঁড় গুড় আর তিসি দিয়ে গেলো তো।
আসলে ক'দিন হলই দাদুর মাদলা গ্রামে যাবার কথা ছিল। কিন্তু স্কুলের জন্য হয়ে উঠছিলো না। আর যাওবা স্কুল থেকে সময় পায় ওদিকে আবার তাঁতঘরে বসতে হয়। অবশেষে কাকু এক সোমবার হাট কামাই করে তাঁতঘরে বসলো, তখন দাদুর সুযোগ হলো মাদলা গ্রামে যাবার।
আগে থেকেই দাদু বলে রেখেছিলো, গিন্নি এবার কিন্তু তোমাকে নিয়ে যাবো।
সেদিন সকাল হতেই আমি হাতমুখ ধুয়ে শিশুশিক্ষা নিয়ে বসে পড়েছিলাম। দুলে দুলে,
পাখিসব করে রব
রাত্রি পোহাইলো
কাননে কুসুম কলি
সকলি ফুটিলো...
শেষ করেই ধারাপাতে হাত দিয়েছিলাম।
মনি, এত তাড়াহুড়া করছিস কেন? চায়ের কাপে তেল মাখানো মুড়ি ফেলতে ফেলতে মনিপিসি বলেছিলো।
তুমি জানো না আজ আমি দাদুর সাথে মাদলা গ্রামে যাবো, পড়া শেষ না হলে দাদু সঙ্গে নেবে না তো। আমি আবার ধারাপাতে মন ডুবাই,
এ আর ক এক
দ উ কার ই দুই...
ও গিন্নি, তুমি না পড়লেও আমি নেবো, তোমার জায়গাজমি তোমাকে চেনাতে হবে তো। দাদুর গলায় আহ্লাদের আভাস পেয়েই আমি ধারাপাত বন্ধ করে ফেলি। ও দাদু, মাদলা গ্রাম কতবড়? সে গ্রামে মানুষ থাকে? ওখানকার সব জমি আমাদের? সুযোগ পেয়েই আমি প্রশ্নের ঝাঁপি খুলি।
ওদিকে রান্নাঘরের উনুনে আজ সকালে ঘি ভাত নয়, ঝরঝরে ভাতের সাথে মাসকলাইয়ের ডাল আর বড়ি দিয়ে পেপের ঘন্ট। আমার সে সব ভাল লাগে না। কিন্তু ভাত না খেলে মাদলা গ্রামে যাওয়া বন্ধ। কী করি!
ও ঠাকুমা, বড়ি ভেজে ভাত মাখিয়ে দাও। কড়কড়ে লাল করে ভাজা কুমড়ো বড়ি আর সর্ষের তেল দিয়ে ঠাকুমা ভাত মেখে দেয় আঠা করে। সেই আঠা ভাতের ছোট ছোট কয়েকটি বল খেয়েই ঢকঢক করে জল খেয়ে ফেলি। ও ঠাকুমা, ভাত শেষ করেছি মনিপিসিকে বলো আমার চুল বেঁধে দিতে।
লাল-সাদা ফ্রকের উপর মায়ের বানানো বকুল ফুল প্যাটার্নের লাল সোয়েটার পড়ে আসতেই মনিপিসি দু'পাশে ঝুটি করে দেয়। কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো আঁচড়ে সমান করে দিয়ে কানের পেছনে একটা কাজলের টিপ পড়িয়ে দেয়। ও মনিপিসি আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি, কাজলের টিপ কেন লাগাও?
তিব্বত পাউডার আমার মুখে বুলিয়ে মনিপিসি বলে, আমার মা'টাকে বড় হতে দিলে তো। কিছু না বুঝেই আমি মনিপিসির গলা জড়িয়ে ধরি, তোমার জন্য আইনুল চাচার বাড়ি থেকে গুড়ের নই আনবো।
বাইরবাড়িতে দাদুর সেই রিক্সাওয়ালা বেল বাজিয়ে ওঠে, বাবু আসেন।
ধুতির কোঁচা পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে ঠাকুমার বাড়িয়ে দেওয়া পান মুখে দেয় দাদু, গিন্নি চলো।
আমি দাদুর হাত ধরে রিক্সায় গিয়ে বসি।
পৌষের সকাল রোদের গা থেকে কমলা রঙ মুছতেই দেয় না। নরম রোদের গা জুড়ে মোলায়েম তাপ একটু হাওয়া পেলেই আবার দপ করে নিভে যায়।
আমি দাদুর গা ঘেষে বসি, দাদুর পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে। গিন্নি, জাড় লাগে নাকি? একটু কুঁকড়ে আমি বলি, না দাদু। পাছে জাড়ের কথা বললে যদি মাদলা গ্রামে যাওয়া না হয়।
পুকুরপাড়, বসাক পাড়া, দরগাপাড়া ছেড়ে রিক্সা চলছে নদীঘাটের দিকে। ঘাটের ওই পুরাতন বটগাছের ঝুড়িগুলো মাটি প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। রিক্সা থেকে নামতেই ঘাটের এবড়োথেবড়ো খাড়া পাড় ভেঙে আমি নীচের দিকে নামতে থাকি, ও গিন্নি, আস্তে যাও, পড়ে যাবে। সে কথা আমি শুনলে তো। এক ছুটে থামি ঘাটে বাঁধা নৌকার কাছে।
আমাকে দেখেই জয়দেব মাঝি চেঁচিয়ে ওঠে, মাস্টারমশাই ধীরে নামেন আমি আপনার নাতির কাছে আছি।
এটুকু পাড় ভাঙতেই দাদু কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে, গিন্নি তুমি এমন করলে আর কখনো সাথে আনবো না কিন্তু। দাদুর মুখের চিন্তাটুকু দেখতে পায়েই নিজের ভুল বুঝতে পারি। দাদু, আমি নদীর কাছে যেতাম না তো, নৌকা দেখেই তাড়াতাড়ি নেমেছি।
জয়দেব মাঝি আমাকে কোলে নিয়ে নৌকায় বসিয়ে দেয়। দাদু পাশে বসতেই আমি ফিসফিস করে বলি, আমি সবসময় তোমার হাত ধরে থাকবো মাদলা গ্রামে গিয়েও, দেখো তুমি।
পৌষের মরা করতোয়া তখন ঢেউ হারিয়ে নিশ্চুপ। নির্বিকার সে নদীর বুকে বৈঠা আছড়ে পড়লে যেটুকু আলোড়ন উঠছে, তা নিমেষেই কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে।
ওপার এখন খুব কাছে চলে এসেছে। অল্পসময় পড়েই ঘাটে লাগে নৌকা। আমি পাড়ে আইনুল চাচা কে দেখে চেঁচিয়ে উঠি, আইনুল চাচা।
ঘাটের পাড় ঘেঁষা জমিতে এখন সবুজ সর্ষে গাছ। গায়ে গা লাগানো গাছগুলো সবুজ চাদরের মতো পড়ে রয়েছে জমির বুকে। ও দাদু, এটা আমাদের জমি? এটা কাদের জমি? কীভাবে বুঝতে পারছো এটা আমাদের জমি না? আমাদের জমি চিনতে পারবে তো?
আমার প্রশ্নে অস্থির হয়ে দাদু বলে, গিন্নি নিজের জিনিষ সবাই চিনতে পারে।
আমি সেসব বুঝি না। আমার কাছে সব জমিই একইরকম লাগে, এমনকি পুরো মাদলা গ্রামও নিজের মনে হয়। জমির আল ধরে আমরা গিয়ে উঠি আইনুল চাচার বাড়ি।
সে বাড়ির বাইরবাড়িতেই জ্বাল হচ্ছে গুড়। বড় বড় লড়াই কড়াই আর বিশাল এক উনুনের এমন মহাযজ্ঞ আমি এই প্রথম দেখছি। আমার পা থেমে যায়। মাথায় গামছা বাঁধা আরোও কয়েকজন সেখানে বড় খুন্তা দিয়ে অনবরত নাড়ছে কড়াইয়ের রস।
আম্মা আসো, আইনুল চাচা আমাকে থামতে দেয় না। ভেতর বাড়িতে গিয়েই আমার খেয়াল হয় শীতের শুকনো ধুলোয় সাদা হয়ে গেছে আমার উলের লাল মোজা। আইনুল চাচা নিজে খুলে দেয় রাবারের জুতা আর উলের মোজা। কলতলায় রাখা টিনের বালতিভরা জল থেকে হাতমুখ ধুইয়ে দিতেই দাদুর হাঁক, এবার গুড় কেমন হবে রে আইনুল? রস তো অনেক হবে মনে হচ্ছে। আইনুল চাচার উঠানে পাইল করে রাখা আখ।
আইনুল চাচার পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের হয়, বাবু ভালই হবে তো মনে কয়।
উঠোনের রোদে তখন তেজ বাড়তে শুরু হয়েছে। সেই রোদে পড়ে থাকা বেতের পাটিতে আইনুল চাচার রান্নাঘর থেকে আসে রসে ভেজানো চিতই পিঠা আর খই। একটু পড়ে ফুটানো ঘন দুধ। আমি দু'চারটে খই মুখে দিয়েই চলে যাই বাইরবাড়িতে।
কড়াইয়ের ঘন রস তখন বাদামি থেকে লাল হচ্ছে। ওদিকে বিশাল বিশাল খুন্তা তা এফোঁড়ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তিরতির বাতাসে গুড়ের ঘ্রাণ মিশে ভেসে যাচ্ছে মাদলা গ্রাম ছাড়িয়ে।
আইনুল চাচার বাড়ির চারপাশের সব জমিই আমাদের। সেসব জমিতেও সবুজ সর্ষে গাছ সবে বাতাসে দুলতে শুরু করেছে। দাদু কতটা আখ থেকে গুড় হবে আর কতটা আখ বেঁচতে হবে তা আইনুল চাচাকে বুঝিয়েই বাড়ি ফেরার পথ ধরে।
তবে সাথে শুধু আমি নই, এবার কয়েক হাড়ি ঝোলা গুড়, গুড়ের নই আর তিসি নিয়ে আইনুল চাচাও আমাদের পথ ধরে।
আর আইনুল চাচা বাড়িতে পা রাখতেই হাঁক, মা এদিক আসেন, মা এগুলান কই রাখি, মা এবারের তিসি খুব ভাল।
ঠাকুমাও কেমন ব্যস্ত হয়ে পড়ে আপ্যায়নে, আইনুল ভাত খেয়ে যেও, আইনুল মুড়কি আর দুধটুকু খেয়ে নাও, এই যে তোমার বেশি করে খয়ের দেওয়া পান।
আজও তার অন্যথা হয় না।
আজ বাঘকাকু ইলিশ মাছ এনেছে বাজার থেকে। উনুন থেকে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে চালকুমড়ার ঘন্টো নামতেই ওঠে ইলিশের সুক্তো।
ইলিশ মাছের টুকরোগুলো শুধু লবণ মাখিয়ে সাঁতলে নেয় ঠাকুমা। মা ততক্ষণে সবজি কেটে এগিয়ে দিয়েছে ঠাকুমার দিকে। বেগুন, কাঁচা পেপে, কাঁচাকলা, চালকুমড়া সব লম্বা করে কাটা।
ঠাকুমা সবার আগে ভেজে নেয় বেগুন। লাল করে ভেজে তুলে রাখে। এরপর তেলে কাঁচা পেপে আর কাঁচা কলা। সেগুলোও ভাল করে ভেজে তুলে নেয়। কড়াইয়ে আরেকটু সর্ষের তেল পড়ে। সে তেল থেকে ধোঁয়া উঠতেই ধুনি, মেথি আর সর্ষে পড়ে ফোড়নে। ফোড়ন ফুটে উঠতেই চালকুমড়া দেয় ঠাকুমা। একটু সময় নেড়ে লবণ দিয়ে ঢাকা দেয়। কিছু সময় পর ঢাকনা তুলে তাতে দেয় সব ভাজা সবজি । সবজি গুলো ভালমতো নেড়েচেড়ে তাতে ঘটি থেকে অল্প জল দেয় ঠাকুমা। আবার ঢাকনা পড়ে।
ঠাকুমা এরমধ্যে বেটে নেয় রাধুনি আর আদা। ঠিক চন্দনের মতো রঙ হয় তার।
ঢাকনা তুলে ঠাকুমা এবার মাছ দিয়ে দেয়। ইলিশ মাছ সবজির গা মাখা ঝোলে পড়তেই কেমন গায়ে মেখে নেয় সবজির রঙ। সবুজ আর সাদাটে সে রঙে ইলিশের চেহারার ধার বাড়ে। একটু পরেই ঠাকুমা সেই রাধুনি আর আদাবাটা কড়েইয়ে ঢেলে দেয়।
রাধুনির ঘ্রাণ তখন এ বাড়ি ছেড়ে পাড়ার বাড়িগুলোতে আসন গেড়েছে। দেরি করে না ঠাকুমা। কয়েকটা কাঁচামরিচ ঝোলে ফেলে ঠাকুমা নামিয়ে নেয় ইলিশের সুক্তো।
বড় ঘরের লাল বারান্দায় আইনুল চাচার পাত পড়ে একপাশে। অন্যপাশে আমি আর দাদু।
পাতের ভাত ফুরাতেই ঠাকুমা বাটি ভরে নতুন ঝোলা গুড় নিয়ে আসে।
ও আইনুল, আজ দই আনা হয়নি। একটু গুড় খাও।
আমাদের সবার পাতে পড়ে ঝোলা গুড় আর লেবু। লেবুর ঘ্রাণ মাখা গুড় মুখে দিয়ে আমি তাকাই আইনুল চাচার দিকে।
পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো তখন সব দেখতে পারছি আমি, মা সুকোত ঝোল খুব সুয়াদ হইছিলো আজ।
ঠাকুমা একটু হেসে এগিয়ে আসে, ও আইনুল তোমার জন্য তিলের কটকটি রেখেছি, মনে করে নিয়ে যেও যাবার সময়।
আর ওদিকে পেয়ারা গাছের ছায়া ততক্ষণে বুজে আসছে, মরা রোদ শীতবেলার গা থেকে মুছে যাচ্ছে তখন একটু একটু করে।
এই রান্না টা নতূন জানলাম !!কি অদ্ভুত সুন্দর রান্না হতো সেই সময়ে !!স্বপ্ন মনে হয় !!
আপনার এই রেসিপিগুলো আমি বাড়িতে চেষ্টা করি বানানোর। হয়তো পুরো স্বাদ আসে না,কিন্তু দিদার রান্নার কথা খুব মনে পড়ে।
আমি জানতাম না স্মৃতি, রাবি শেষবর্ষে পড়ুয়া ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় ছাত্রী আমার একমাত্র উত্তরাধিকার এ যুগের মৌলীী তোমার লেখার এত ভক্ত...!!!
ওর আবদার... 'মা তুমি জোরে পড় আমি শুনবো... উনার লেখার মধ্যে এক ধরনের আবেগ.. আদর... আহ্লাদ আছে যা সমস্ত লেখাটায় অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে.....
আমি আর কি বলবো বল? শুধু বলি... তোমার এই লেখাগুলো এই যান্ত্রিক যুগে বড় প্রয়োজন.... নইলে যে আমাদের নাঁড়ীছেড়া একসময় আমাদেরই চিনবে না....
খুব প্রিয় মায়া য় ভরা লেখা .
ইলিশের শুক্তো ।..নতুন লাগলো ।.ভালোও লাগলো ।.রান্নাটা খুব ভালো হয়েছে .☺️
প্রতিবার নতুন নতুন রান্নার রেসিপি.... কি সুন্দর একটা লেখা।
আমি যে বিভোওওর হয়ে থাকি....