বারবেলা আসার আগেই বাড়ির উঠোন খাঁ খাঁ করে ওঠে।
ছিটেফোঁটা এটুকু রোদই কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই পুরো উঠোনটাকে তাতিয়ে তোলে। আর সেই তাপে নেতিয়ে পড়া গাছের পাতাগুলো আস্তে আস্তে নিস্প্রভ হতে শুধু করে। পরিশ্রান্ত দুপুরের গা জুড়ে জমতে থাকে উত্তাপ। আর তাঁতঘরের পাশে জংলাগাছের ঝোপ থেকে একটু পর পর ডেকে ওঠে ঘুঘু। পুকুরের স্হির জলে পানকৌড়ি ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে যতটুকু ঢেউ ওঠে, তা মিলিয়ে যেতেই নিঃশব্দ হয়ে যায় ভরদুপুরের বৃষ্টিহীন বেলা।
সেসব নিশ্চল দুপুরে আমি ঠাকুমার শীতলপাটি আর তালপাখাকে অগ্রাহ্য করি অতি সংগোপনে।
কাঠের সিলিং-এ ঘটাং ঘটাং শব্দে একঘেয়ে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যান যতটুকু হাওয়া দেয়, তার চেয়ে ঢের বেশী নীরব দুপুরের সুর ভাঙে। দাদুর রেডিওটাও মৃদু সুর করে বাজতে বাজতে কখন যেন থেমে যায়। ভাতঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে ঠাকুমার হাতের তালপাখাটা থেমে যেতেই আমি খুব আলগোছে বেরিয়ে আসি বড়-ঘর থেকে।
বাড়ির সবগুলো ঘরের দরজা ভেজানো। উঠোনে এককোণে রাখা জলভরা হাতল-ভাঙা বালতিটা। ঠাকুমা ঘড়ায় করে জল এনে ভরে রেখেছে। সেই বালতিতে কখনো কাক, কখনো শালিক এসে বসে। ঠাকুমা বলে,
‘জলের খোঁজে ওরা এদিক-ওদিক ঘোরে এসময়।’
কিন্তু এখন সে জলের বালতিটাও একা চুপচাপ পড়ে রয়েছে।
উঠোনে যতটুকু শব্দ তা ওই তাঁত-মাকুর। আর মাঝেমাঝে উড়ে আসা বাঁশির সুর। তবে তা খুব অনিয়মিত।
আমি ভেতরবাড়ির উঠোন ছেড়ে বাইরবাড়ির দিকে চলে আসি। তাঁতঘরের সামনে নতুন রঙ করা সুতো মেলে দিচ্ছে দু’জন তাঁতি।
লাল, হলুদ, সবুজ রঙের জল চুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে। আমি মেলে রাখা সুতোর নীচে হাত পেতে দিই। হাত ভরে যায় রঙিন জলে। এক হাত থেকে অন্যহাতে, অন্যহাত থেকে দেবদারু পাতায় - রঙিন জলের খেলায় মত্ত আমি।
মণি, ভরদুপুরে জল নিয়ে খেলতি আছে?
মানিক কাকুর চোখ এড়িয়ে আমি তাঁতঘরের সামনে আসতেই পারি না। আমি রঙিন জল ফেলে দিয়ে হাত ঝাড়ি।
‘ও মানিক কাকু, অল্প একটু জল নিয়েছিলাম তো।’
ঠাকুমাকে যদি মানিক কাকু বলে দেয় আমি এই দুপুরে ঘুম বাদ দিয়ে একা একা জল নিয়ে খেলছিলাম, তাহলে ঠাকুমা সন্ধ্যাবেলায় গুড়ের কদমা দেবে না আমাকে।
মানিক কাকুর অবশ্য আমার কথা শোনার সময় নেই। সুতোগুলোয় রঙ কতটুকু পোক্ত হলো তা দেখতে শুরু করেছে।
আমি তাঁতঘরের সামনে থেকে সরে আসার অজুহাত খুঁজে পাই।
তাঁতঘর বলতে গেলে দেবদারু বাগানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর এক চিলতে মাটির পথ। ওপাড়েই গোলেনূর দাদীর তাঁতঘর। আমাদের বাইরবাড়ি আর গোলেনূর দাদীর বাইরবাড়ি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক ওখানেই সুপারি বাগান। হুট করে দেখলে বোঝার উপায় নেই আসলে কাদের আঙিনায় সংসার পেতেছে এই সুপারি বাগান।
প্রাচীরবিহীন এ পাড়াটা আসলে একটা প্রকান্ড বাড়ি। এজন্যই তো ও বাড়ির মানুষের মন খারাপ হলে এ বাড়ির মানুষ দুঃখ পায়, আবার এ বাড়ির মানুষের আনন্দ-আবেগে অন্যবাড়ির মানুষগুলো এসে জড়ো হয়।
এই ঝিমিয়ে পড়া দুপুরে কিন্তু বাইরবাড়ির বারান্দায় আজ সারা পাড়া এসে জড়ো হয়নি। আসলে যে সব দিন তেতে ওঠা দুপুর হলকা হাওয়া দেয়, সে সব দিনে এই বারান্দা ফাঁকাই থেকে যায়।
আমি ফাঁকা বারান্দায় কাঠের বেঞ্চিতে বসে পা দোলাচ্ছি। সামনে গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছে সবুজ পাতা এসেছে। কিন্তু আজকের আগুনে হাওয়ায় তা অনেকটা নেতিয়ে আছে।
‘একা একা কী করিস ওখানে?’
কোহিনূর ফুপু নিজেদের উঠোন বসে শাকের নরম ডগা ভেঙে নিচ্ছে।
আমি বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে নেমে একমুহূর্তে গিয়ে হাজির হই গোলেনূর দাদীর উঠোনে।
‘ও কোহিনূর ফুপু, এখনও রান্না হয়নি তোমাদের?’
‘হাটের দিন এ বাড়ি উনুন জ্বলতি দেরী হয় রে মনি।’
কুচো চিংড়ি আর বেলে মাছ কাটছে গোলেনূর দাদী।
শেষ হাটে মাছের দাম কমে যায় বলে তোবারক মামা ব্যাগ ভরে মাছ কিনে এনে বোনের বাড়ি দিয়ে যায়। সাথে কখনো কখনো হাটে না বিক্রি হওয়া খুঁত শাড়িটাও।
গোলেনূর দাদীর উঠোনে ছিটেফোঁটা যেটুকু রোদ আসে সেটুকু বারবেলা আসতে না আসতেই উধাও হয়ে যায়। রোদহীন বেলায় সে উঠোনজুড়ে শুধুই ছায়া। সে ছায়াতে ছায়াহীন কোহিনূর ফুপুর গা ঘেঁষে আমি বসি।
‘শাক বাছবি আমার সাথে?’
আমি চঞ্চল হয়ে উঠি। কত্তদিন পর এমন সুযোগ এলো। সেই কবে ঠাকুমার রান্নাঘরে মটরশুঁটি ছাড়াবার বায়না ধরেছিলাম। অনেকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করার পর ঠাকুমা ক’খানা মটরশুঁটি এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো,
‘ও দিদি, উনুনের পাড়ে বসতে এতো তাড়াহুড়ো?’
আমি মটরশুঁটি ছাড়াতে ছাড়াতে উল্টো প্রশ্ন করেছিলাম,
‘ও ঠাকুমা, তোমার মতো কবে রান্না করতে পারবো আমি?’
সেদিন ঠাকুমা এ প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেছিলো,
‘আমার দিদি স্কুল-কলেজ সব শেষ করে অফিসে যাবে তো, রান্না করার সময় পাবে কোথায়?’
কিন্তু ঠাকুমা জানে না মাটির খুঁটিবাটিতে আমি ইটের কুচো, বালু, গাছের পাতা দিয়ে ঠিক ঠাকুমার মতোই রান্না করি।
আমি আর ক’টা শাক বাছতে পারি? কোহিনূর ফুপু দ্রুত হাতে সব ডাঁটার শাক বেছে নেয়। ওদিকে গোলেনূর দাদীরও দু’রকম মাছ কাটা-বাছা শেষ।
গোলেনূর দাদীর রান্নাঘরের উনুনে বিভিন্ন উৎসবে আর বিশেষ দিনে শুধু আঁচ পড়ে। এছাড়া উঠোনের খোলা উনুনে অনান্য দিন রান্না হয়।
আজও তাই গোলেনূর দাদীর উঠোনের উনুনে আঁচ পড়লো। প্রথমে শুকনো পাতা আর পাটখড়ি, এরপর আঁচ বাড়লো খড়িতে।
উনুনে কালো লোহার কড়াই চড়লো।
কোহিনূর ফুপু এর মধ্যে কয়েক কোয়া রসুন থেঁতলে নিলো শিলপাটায়।
কালো কড়াইয়ে তেল পড়তেই ধোঁয়া ছড়িয়ে জানান দিলো তা তেতে গেছে। মাছগুলোর হলুদ লবণ মাখিয়ে একটু সাঁতলে তুলে নিলো গোলেনূর দাদী।
গোলেনূর দাদীর বাড়ির পেছনে ঝোপ-জঙ্গল থেকে ঘুঘু পাখি থেমে থেমে ডেকে উঠছে। আর গোলেনূর দাদীর ছায়াঘেরা উঠোন একটু পরপর চঞ্চল হয়ে উঠছে রান্নার ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দে।
কড়াইয়ে এবার থেঁতলানো রসুন পড়লো। একটু নাড়তেই তা বাদামী হয়ে আসলো। এরপর অনেকটা পেঁয়াজ কুঁচি আর বুকচেরা কাঁচামরিচ যোগ হলো তাতে। গনগনে আঁচে তেতে থাকা কড়াইয়ে তা পড়তেই ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়লো উঠোনে। দমকে কেশে উঠলাম আমি।
‘সরে বস মণি। পানি খাবি একটু?’
কোহিনূর ফুপু উত্তরের অপেক্ষা না করেই জলের গ্লাস ভরে এনে সামনে ধরলো।
ঠান্ডা জল ঢকঢক করে খেতে গিয়ে কতকটা ছলকে জামা ভিজে গেলো।
‘এদিক আয়’
গোলেনূর দাদী হাত ধরে টেনে নিয়ে আঁচল দিয়ে আমার জামার জল মুছে দেয়।
‘ও দাদী, সুমি কবে আসবে ওর নানাবাড়ি থেকে?’
গোলেনূর দাদীর বাড়িটা অনেকদিন হলোই এমন ফাঁকা হয়ে আছে।
গোলেনূর দাদী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,
‘সৌদি থিকা ওর বাপ ফিরলি পরে বাড়িত আসবি ওরা।’
আমি মনে মনে ভাবতে থাকি,
‘সৌদি থেকে রাশিয়া কতদূর? সুমির আব্বা কী ইচ্ছে হলেই সাহেব কাকুর কাছে যায়? সেই যে কবে সাহেবকাকুর চিঠি এলো এরপর তো আর কোনো খবর নেই। ঠাকুমা তো প্রতিদিনই দাদুকে একবার করে পোস্ট অফিসে পাঠায়।’
কড়াইয়ে এরমধ্যে হলুদ বাটা আর লবণ পড়েছে। একটু কষিয়ে তাতে এবার শুকনোমরিচ বাটা পড়লো। কড়াইয়ের লাল মশলায় তেল ভাসছে।
আর বাতাসে ভাসছে ঝাঁঝালো পেঁয়াজ আর রসুনের ঘ্রাণ। গোলেনূর দাদীর বাড়ির খুব পরিচিত ঘ্রাণ এটা।
মশলায় এবার সাঁতলে রাখা চিংড়ি আর বেলে মাছ পড়লো। অল্প একটু জল দিয়ে গোলেনূর দাদী ভালো করে কষাতে লাগলো মাছগুলো।
বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেছে। থেমে থেমে ডেকে ওঠা ঘুঘুটাও থেমে গেছে এখন।
কোহিনূর ফুপু প্লেটে ভাত বেড়ে বারান্দায় পাটি পেড়ে নিলো।
উনুনের কড়াইয়ে শাক পড়তেই কচি শাকগুলো থেকে পানি বেরিয়ে ঢেকে দিলো মাছগুলোকে। গোলেনূর দাদী এবার একটি ঢাকনা ঢেকে দিলো কড়াই। খড়ি ঠেলে আঁচ বাড়িয়ে দিলো।
সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে আছরের আজান ভেসে আসছে।
গোলেনূর দাদী ওযু করতে চলে গেলো কলতলায়। আর ঠিক তখনি আমাদের বাড়ির বাইরবাড়ির দরজা খুলে গেলো,
‘ও দিদি, না ঘুমিয়ে তুমি এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছো?’
ঠাকুমা পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো গোলেনূর দাদীর উঠোনে।
কোহিনূর ফুপু উনুনের আঁচ কমাতে খড়ি বের করে নিলো। এরপর একটু নেড়েচেড়ে নামিয়ে নিলো দোমাছা।
‘ও কোহিনূর, তোমাদের খেতে আজ বেলা গেলো তো।’
‘হাটের দিন আগবেলায় বাজার আসে না জেঠিমা।’
কোহিনূর ফুপু বারান্দার পাটিতে বেড়ে রাখা ভাতের থালার সামনে দোমাছার কড়াইটা রাখে।
গোলেনূর দাদী মোনাজাতের জন্য হাত তুলেছে।
‘ও কোহিনূর, আম কাসুন্দি আজ রোদে দিয়েছিলাম, একটু বাটিতে করে এনে দিচ্ছি।’
ঠাকুমা তাড়াহুড়ো করে বাড়ির দিকে চলে যায়।
ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কা নাসতাই’-ন……..গোলেনূর দাদী বিড়বিড় করতে করতে আমার মাথায় ফুঁ দেয়। আমার শরীর কেমন জুরিয়ে যায়। কোহিনূর ফুপুর পাশে গিয়ে বসে গোলেনূর দাদী।
ঠাকুমা বাটি ভরে আম কাসুন্দি এনে রাখে দোমাছার কড়াইয়ের পাশে।
থালে জমে থাকা ভাত ভাঙে গোলেনূর দাদী।
দোমাছা থেকে কয়েকটি চিংড়িমাছ বেছে বাটিতে করে আমার সামনে রাখে কোহিনূর ফুপু,
‘এ ক’টা তোর’
আমি ওখান থেকে একটা একটা মাছ নিয়ে মুখে পুরি। ঝালে চোখ ছলছল হয়ে উঠতেই গোলেনূর দাদী জলের গ্লাস এগিয়ে দেয়,
‘পানিটুকু খা মণি…….’
আমি ঠান্ডা জলটুকু জিহ্বায় ধরে রাখি।
ঝোপ-জঙ্গল থেকে হঠাৎ ঘুঘুটা আবার ডেকে ওঠে, আর ওদিক থেকে দাদু হাঁক দেয়,
‘গিন্নি যাবে নাকি আমার সাথে………’
আজ সাহাপাড়ার মন্দিরে কীর্তনের দল আসবে।
এই সিরিজটির মায়াবী লেখার ধরণ নিয়ে আগেই অনেক কথা হয়েছে। আমার কিন্তু একটা অন্য কৌতূহলও আছে। এই লোভনীয় পদগুলি কি প্রতিবার রান্না করে ছবি তুলে দেওয়া হয়?
এই ছবির ব্যাকড্রপ আর বারল্যাপ গুলো আমার বেশ ভালো লাগছে।
অপূর্ব
মুগ্ধ ।
এটা অনেকদিন আসেনি