এসব দিনে দুপুরগুলো তেতে উঠে খুব। সব রোদ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছের পাতাগুলো দুপুর হতে না হতেই মলিন হয়ে যায়। আর তাঁতঘরের পুকুর নিশ্চল জল হয়ে এসব দুপুরে ঝিমুতে থাকে। ঝিমধরা সে দুপুরের গায়ে একঘেয়ে ডেকে চলে ফটিক জল পাখি ‘ টিক ......জল.......টিক জল......টিক’।
ঠাকুমা আঁচলের কোণা দিয়ে ঘাম মুছে বিড়বিড়িয়ে ওঠে, ও দিদি এবার বৃষ্টি হবে দেখো।
দোতলার টিনের চাল রোদের তাপ শুষে গুমোট হয়ে উঠেছে।এতোটাই গুমোট যে একটু সময় পরেই গরমে হাঁফ ধরে যায় উপরের ঘরে। ঘেমেনেয়ে অস্হির আমি তবুও আমার সেখানে থাকতেই হবে।
ও ঠাকুমা, রাই সর্ষে নেবে না?
মাটির ডোলা থেকে ঠাকুমা লাল সর্ষে ধামায় ঢালছে। কাঠের দোতলা ঘরের পূবদিকে একটা ছোট্ট জানালা। সেই জানালার পাল্লা দুটো খুলে দিলে বরইপাতারা হুড়মুড়িয়ে দোতলা ঘরে ঢুকে পড়ে। আর সে পাতা চুঁইয়ে যতটুকু আলো ঠিকরে পড়ে কাঠের পাটাতনে তাতে হরেকরকম ছায়ার বাড়বাড়ন্ত।
সেসব ছায়ায় কখনো নিশ্চলতা, আবার কখনো দোলাচল।
এবার রাই সর্ষে বেশি আসেনি দিদি মাদলা গ্রাম থেকে, ঠাকুমা ছোট একটা মাটির কলস উপুর করে ঢেলে নেয় সব রাই সর্ষে।
ঠাকুমার কাঁচাপাকা চুল কপালে লেপ্টে গেছে ঘামে। আর সেই ঘামে সিঁদুর গলে গোল টিপটা কেমন থেবড়ে গেছে।
ও দিদি চলো এবার, কেমন ঘেমে গেছো দেখেছো?
আমার চুলের গোড়ায় জমে থাকা ঘাম গাল বেয়ে নামছে। আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছেই সে হাত বাড়িয়ে দেই ঠাকুমার সামনে, ও ঠাকুমা গুড়ের কদমা দেবে না?
চড়কের মেলা থেকে গুড়ের কদমা কিনে ঠাকুমা জমিয়ে রাখে মাটির হাঁড়িতে মুড়ির ভেতর। সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে আমার খইয়ের বাটিতে একটা করে পড়ে।
ও দিদি, একটু আগেই অতটা আচার খেলে, পেটে ব্যথা হবে তো।
আমি হাত না নামিয়ে চোখ দু’টো নামিয়ে নেই।
আমার ঠোঁট ফোলানো দিদি, ঠাকুমা টেনে আমাকে কোলে তুলে হাতে গুঁজে দেয় গুড়ের কদমা।
সে কদমা আমি রয়েসয়ে খাই। একটু একটু করে খাই ফুরিয়ে যাবার ভয়ে।
সর্ষের ধামা নিয়ে দুপুর ফুরানোর আগেই ঠাকুমা থানাঘাটে যাবে।
চলন জলে ধোয়া সে সর্ষে সারারাত কলার মাইজে গা জুড়াবে। আর সকালের প্রথম রোদ মেখে ঝরঝরে হয়ে উঠতেই ঢেঁকির গড়ে গড়িয়ে পড়বে।
বাড়ির সবাই ভাতঘুমে।থেমে থেমে শুধু ঠাকুমার ধামা কূলার শব্দ। ফটিক জল পাখির ডাক থেমে গেছে। পড়ন্ত দুপুরের বুকজুড়ে হলকা হাওয়ায় তাঁতমাকুরের খটাস খটাস।
তবে আজকাল মাকুর আওয়াজ সেই আগের মতো সারা পাড়া জাগিয়ে রাখে না। গোলেনূর দাদীর দশখানা তাঁতের চারটা বিক্রী হয়ে গেছে।
নদীর ওপাড়ে নতুন পাওয়ার লুম বসেছে।
মানিক কাকুর মুখে দু’দিন আগে কথাটি শুনে দাদু অনেকসময় মাথা নীচু করে বসেছিলো।
ঠাকুমার সর্ষে ঝাড়া শেষ। ধামা কাঁখে ঠাকুমা লাল বারান্দা থেকে উঠোনে নামতেই আমি বড়ঘরের ভেতর দৌড়ে যাই। মেঝেয় পাটি পেতে ঘুমিয়ে থাকা মনিপিসির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলি,
ও মনিপিসি, কলাগাছের মাইজ কেটে রেখো, আমরা থানাঘাটে যাচ্ছি।
থানাঘাটের জলে ঠাকুমা ধামা ডুবিয়ে সর্ষে ধোয়া শুরু করতেই হাইস্কুলের মসজিদ থেকে ভেসে আসে,
আল্লাহু আকবার
আশহাদু-আল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ.......
আমি ঘাট লাগোয়া ধুতরা গাছের ফুল নিয়ে খেলতে খেলতে দেখি কালিবাড়ির বারান্দার বসে থাকা পাগল শিবু রুহিদাস আচমকা দাঁড়িয়ে কানে আঙুল দিয়ে আজানের সাথে গলা মেলাচ্ছে,
হাইয়া আলাস সালাহ......
থানাঘাট থেকে আমরা বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই সুপারি বাগানের মাথায় টুপ করে তলিয়ে যায় সূর্য। উঠোনে তুলসীতলায় বাতি পড়ে। আর দাদুর রেডিও কুনকুন করে গেয়ে ওঠে,
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে।
কি জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা ভেবে বলো না....
সংসারের নিত্য কাজের অতিরিক্ত কোনো কাজ থাকলেই থাকলেই ঠাকুমা খুব ভোরবেলা উঠে যায়। আজও তাই আমাকে ঘুমের কোলে রেখেই ঠাকুমা উঠে পড়েছে। আর এসব ভোরে ঠাকুমার সঙ্গী পূর্ণির মা,
ও জ্যাঠিমা, ঢেঁকির গড় মুছতি হবি তো?
অথবা,
ছরা জলের গোবর পালাম না তো।
আমি সেসব শব্দ অগ্রাহ্য করে বিছানা ছেড়ে সবার আগে গিয়ে দাঁড়াই মেলে রাখা সর্ষের কাছে। হাত ডুবিয়ে দেখি গতকালের ভেজা সর্ষে কতটা ঝরঝরে হলো।
উঠোনে দিনের প্রথম রোদ আলগোছে এসে দাঁড়িয়েছে আমার পেছোনে। সে রোদে সর্ষে ওম নেবে।
সকালে লাল আউশের ঘি ভাত উনুনে বসিয়েই ঠাকুমা লগি নিয়ে আমগাছ তলা গিয়ে দাঁড়ায়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কাঁচা আম পাড়ে।
পূর্ণির মা নেড়েচেড়ে সর্ষে শুকাচ্ছে।
খোলা উনুনে মাটির হাড়িতে জল ফুটছে।
কাঁচাআম কুচানোর জন্য লাল বারান্দায় বসে গেছে মনিপিসি। সকালের পাত উঠে যাবার আগেই ঠাকুমা ঢেঁকিতলা চলে এসেছে।
ঢেঁকির গড়ে ঝরঝরে সর্ষে পড়ে। কয়েক পাড়েই গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় সর্ষে।
গুঁড়ো সর্ষে মাটির হাড়ির ফুটন্ত জলে পড়তেই ঘন হয়ে আসে। একটু ফুটে উঠতেই তাতে কুচানো কাঁচা আম পড়ে।
মা রান্নাঘর থেকে জিরা, শুকনামরিচ, তেজপাতা ভেজে গুড়ো করে আনে। অনেকটা সময় সর্ষে ফুটিয়ে ভাজা গুড়ো মিশিয়ে ঠাকুমা নামিয়ে নেয় আম কাসুন্দি।
এই আম কাসুন্দি কিন্তু এখনো কয়েকদিন রোদ পোহাবে। এরপর বয়ামে উঠবে।
আজ দুপুরের উনুনে আঁচ পড়তে বারবেলা হয়ে গেছে। তাই পদের সংখ্যা আজ কম। হাঁসের ডিম কষা, ডাটা আর জালি কুমড়া দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল, আম বেগুন।
আম বেগুনের জন্য ঠাকুমা কুচানো আম আর গুড়ো সর্ষে আলাদা করে রেখেছিলো সকালেই।
ডুমো করে কেটে রাখা বেগুনে লবণ হলুদ মাখিয়ে ভেজে নেয় ঠাকুমা। এবার সর্ষের তেলে শুকনা মরিচ আর কালোজিরা ফোড়ন পড়ে। ফোড়নের ঘ্রাণ বাতাসে ছড়তেই তাতে জলে গোলানো সর্ষে গুড়ো কড়াইয়ের ফোড়নে মেশে।
তাতে হলুদ লবণ ছড়িয়ে কষায় ঠাকুমা। সর্ষে থেকে তেল ছেড়ে এলে কুচানো আম মিশিয়ে দেয়। সাথে একটু জলও।
সবশেষে ভাজা বেগুন আর অল্প চিনি ছিটিয়ে অল্প আঁচে কিছু সময় রাখে ঠাকুমা।
আজ দুপুরের পাত পড়েছে পড়ন্ত বেলায়। বেলার গায়ে হলকা তাপ এখনো কমেনি। পাতের মোটা আউশে আম বেগুন মাখিয়ে মুখে দিতেই কপাল গড়িয়ে নামতে থাকে ঘামের বিন্দু। আর ঠিক তখনি তাঁতঘরের নিমগাছ থেকে ডেকে ওঠে ফটিক জল পাখি,
‘ টিক .....জল....টিক ....জল’